“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১০)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
(ক’পি করা নি’ষেধ।)
১৯.
এক শুক্রবারের বিকেলে হঠাৎ পাত্রপক্ষ দেখতে আসে শর্বরীকে। যদিও তার কাছেই কেবল ব্যাপারটা হঠাৎ মনে হলো, কেননা সে ছাড়া বাড়ির অন্য সবার হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল সবাই জানে যে আজ এসময়ে পাত্রপক্ষ আসতে পারে। শর্বরী অনু আর রিমাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও তারা দুজন বলল না যে পাত্রপক্ষের আসার কথা তারা আগে থেকেই জানত। আসলে ফুফুই বারণ করেছিলেন বলতে, ফুফুকে তো সবাই জমের মতো ভয় পায়। তাই কেউই এই বিষয়ে কিছু বলেনি। শর্বরী বুঝতে পারল দুপুর বেলায় ফুফুর হুট করে আগমনের কারণটা। বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে বরাবরই সে অন্যদের ইচ্ছেতেই চলেছে। মনে করেছে সবার কথা মতো চলাই তার গুরু দায়িত্ব। কখনো প্রশ্ন তোলেনি, কখনো না বলেনি। তাছাড়া তার জন্য তার পরিবার সবসময় সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। তাই তার ভরসা আছে তাঁদের মতের উপর। কিন্তু আজ, এই প্রথম মনে হচ্ছে একবার নিজের মনের কথা শোনা উচিত। এখন মন কী চায় তাই সে বুঝতে পারছে না। তবে এটা বুঝতে পারছে, তার মনের কোণে কোথাও একজন আছে। অথচ সে কে, সেটাই ধরতে পারছে না।
পাত্রপক্ষের সামনে বসার পর থেকেই শর্বরীর কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল বুকের মধ্যে। সামনে বসে থাকা অমায়িক মানুষ গুলোকে কেমন বিরক্তিকর মনে হতে লাগল। তাঁদের কোনো কথারই ঠিক করে জবাব দিল না। দেবেও বা কী করে? প্রশ্ন গুলো তার কানে আসলেই তো? ফুফু তার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে পেছন থেকে দুই তিন বার চিমটি কাটলেও সে টলে না। বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গিয়ে তিনি বলেন,
“আসলে কী হয়েছে, ওঁর কাল রাত থেকেই প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা। এখনও অসুস্থ। হঠাৎ এমন কঠিন জ্বরে একদম দুর্বল হয়ে পড়েছে মেয়ে আমাদের।”
নীরদের মা ছেলের উপর রাগ করে আসেননি মেয়ে দেখতে। নীরদের বাবা, চাচা-চাচী আর উনাদের মেয়ে রাইসা এসেছে। এক দেখাতেই চাচী আর রাইসা শর্বরীকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছেন। নীরদের বাবা চাচাকেও দেখা গেল বেশ প্রসন্ন হয়েছেন। যদিও প্রথমে পাত্রীর অন্যমনস্ক আচরণ উনাদের সবাইকেই ভাবিয়ে তোলে কিন্তু রামিশা চৌধুরীর কথা শুনে তাঁরা স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। নীরদের বাবা সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
“আপনাদের মেয়েকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আপনারা রাজি থাকলে বাকি কথায় এগোনো যাক!”
শর্বরীর বাবা নড়ে চড়ে বসে বললেন, “আমাদেরও অমত করার কোনো কারণ নেই। আপনাদের কোনো ডিম্যান্ড থাকলে,
“আমাদের ডিম্যান্ড একটাই, আপনাদের মেয়েকে খুব দ্রুত আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। এছাড়া আমরা আর কিছুই চাই না। আপনাদের মেয়েকে যত্নে রাখার জন্য আল্লাহর রহমতে আমার ছেলের সবই আছে। দয়া করে এর বাইরে কিছু বলে আমাদের আর ছোট করবেন না।”
শর্বরীর বাবার বুক থেকে যেন পাথর নামল এ কথা শুনে। এমন একটা পরিবারই তো তিনি চেয়েছিলেন মেয়ের জন্য। তিনি উঠে দাঁড়াতেই নীরদের বাবাও উঠলেন, দুজনে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করেন। এদিকে নীরদের চাচীও এসে শর্বরীকে একটা স্বর্ণের মোটা চেইন পরিয়ে দিলেন। শর্বরীর মা, চাচীদের দেখা গেল মিষ্টি বিতরণ করছেন সবার মাঝে। মাজেদের মাকে দেখা গেল মিষ্টির গোটা প্যাকেট নিয়েই নিজের ঘরের দিকে ছুটলেন। শর্বরীর বিয়ে লাগতে চলেছে এই আনন্দে অনু আর রিমা দোতলায় দাঁড়িয়েই নাঁচতে লাগল। খোকন কিছু বুঝল না যদিও তবুও বড় বোনদের খুশিতে লাফাতে দেখে সেও তাদের সাথে তাল মেলাতে লাগল। সবার এত আনন্দের মধ্যেই শর্বরীর চোখটা বারবার ভিজে আসতে লাগল। কেন এত কষ্ট হচ্ছিল তা সে কোনো ভাবেই বুঝতেই পারল না।
শুক্রবার হওয়ায় নীরদ সেদিন ছুটিতে ছিল। দুপুরে ভাত খেয়েই এক ঘুম দেয় ওঠে একদম সন্ধ্যার পর। ঘুম ভাঙতেই দেখে সরোদ তার পাশে বসে টিভি দেখছে। নীরদ শোয়া থেকে উঠে বলল,
“তুই কখন এসেছিস?”
“ষাঁড়ের মতো যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন।”
“জাগিয়ে দিতে পারতিস।”
“আরে ঘুমাও ঘুমাও। সারা সপ্তাহ এত খাটুনির পর একটু বিশ্রাম নেওয়া তো তোমার প্রাপ্য। তাছাড়া সামনে আরো ব্যস্ত দিন আসছে, ঘর সংসার, চাকরি সব সামলাতে গিয়ে রাতেও আর ঘুমানোর সুযোগ পাবে না।”
“মানে?”
“মানে আর কী? বাবা-মা, বড় চাচা গিয়ে তোমার বউ পছন্দ করে এসেছেন। সামনের মাসের যে কোনো দিনে বিয়ের তারিখ ঠিক হতে পারে।”
কথাটা শুনে নীরদের মনে একরাশ তিক্ততা জমে উঠল। অথচ সে-ই তো এত তোড়জোড় করে সবাইকে পাঠালো। ধ্যাত, রাগের মাথায় মানুষ বরাবরই ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। সে এখন আর চাইছে না এই বিয়ে করতে। সত্যি বলতে তার আর বিয়েই করতে ইচ্ছে করছে না। বারবার তার মনে হতে লাগল, মানুষের জীবনে বিয়ে একটা ফালতু চ্যাপ্টার! বিশ্রী চ্যাপ্টার!
রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, শর্বরী তখন জেগে। তার আজ কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে কী যেন নেই! খুব কাছের, খুব ভালোবাসার কিছু একটা সে হারিয়ে ফেলছে। এই অদ্ভুত অনুভূতিটা সেদিন ফুফুর বাড়িতে নীরদকে ওভাবে তাড়িয়ে দেয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে। কেন এমন হচ্ছে! ওই লোকটার জন্য এত খারাপ লাগছেই বা কেন? হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই টেবিলে গিয়ে বসল। ড্রয়ার থেকে সেই ছবিটা বের করল। সেদিনও ঠিক কী ভেবে মানুষটাকে এঁকেছিল তা সে জানে না। আজ সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার মনে হলো, যেন ছবি নয় স্বয়ং নীরদই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তবে আজ, এই প্রথম সেই দৃষ্টিতে ভয় ছাড়া অন্য কোনো কিছু খুঁজে পেল শর্বরী। লোকটা শেষবার কেমন গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল! আর একটু খেয়াল করলে হয়তো তখনই দেখতে পেতো ওই চোখে কত কথা জমা ছিল। যা কি না বোকা শর্বরী একবারও জানতে চায় নি।
২০.
সেদিনের পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। বিয়ের দিন ক্ষণ এখনও ঠিক হয় নি। একটা সময়ে পৌঁছে শর্বরীও উপর ওয়ালার উপর সবটা ছেড়ে দিয়েছে। আজ হঠাৎ একটা জরুরী কাজ পড়ে যাওয়াতে বাড়ির গাড়ি নিয়ে সে একাই বের হয়। গাড়ি চালনায় শর্বরী আগে থেকেই দক্ষ এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সও করা আছে, এমনিতে মাঝে মাঝেই সে নিজে ড্রাইভ করে। তবে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। আজই কি থেকে কি হয়ে গেল! রাস্তা ফাঁকা থাকায় বেশ দ্রুত গতিতেই ড্রাইভ করছিল, হঠাৎ টার্ন নিতেই একটা পথশিশু এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার জন্য দৌড় দিতেই শর্বরী তাড়াতাড়ি ব্রেক কষে কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে যায়। গাড়ির ধাক্কায় মেয়েটা ছিটকে পড়ে একটু দূরে। তা দেখে শর্বরী একটা আর্তনাদ করে ওঠে। সাথে সাথেই সেখানে লোক জড়ো হতে থাকে। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যেতেই পথচারীরা এসে তাকে নানান কথা শোনাতে লাগল। কেউ একজন পু’লি’শে কল করার কথা বলল। মুহুর্তের মধ্যেই ভ’য়ে আতঙ্কে শর্বরীর মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেল। সে মেয়েটার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। কয়েকটা লোক তাকে ঘিরে ধরতেই একজন কোথা থেকে এসে সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে আনে। শর্বরী লোকটাকে সাথে সাথেই চিনতে পারে। আরেফিন! অরিনদের বাড়ির!
আরেফিন বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে করে নিয়ে নিজের গাড়িতে তুলতে নিলে লোকগুলো তাকে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে সে তাদের ধ’ম’কে উঠল,
“বাচ্চাটার চিকিৎসার প্রয়োজন। আপনারা যেখানে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাবেন তা না করে এভাবে ফেলে রেখেছেন আবার অন্য কাউকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতেও দিচ্ছেন না। মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায় তবে আপনাদের সবার নামেই কেস করা হবে। মনে থাকে যেন।”
লোক গুলো এরপর আর বাধা দেয় না। আরেফিন শর্বরীর হাত ধরে টেনে এনে তাকে গাড়িতে বসায়। তার হাত দুটো মুঠোয় পুরে ভরসা দিতে থাকে, কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে। শর্বরী সেসবের কিছুই শুনল না। সে এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। এটা সে কি করে ফেলল!
গাড়ি এসে থামল স্পার্ক হসপিটালের সামনে। তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে স্ট্রেচারে ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেফিন একাই ছোটাছুটি করছিল। শর্বরীর পা জমে আসছিল বারবার। কেউ যেন তার দেহের সবটুকু শক্তি শুষে নিয়েছে। সে ওয়েটিং চেয়ারে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে।
রাউন্ডে থাকা অবস্থায় চরম সংকটাপন্ন রোগীর খবর পেয়ে নীরদ আর ডক্টর রোকসানা দুজনেই ছুটে আসেন। নীরদকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই শর্বরী উঠে দাঁড়ায়। তার পা এতক্ষণে যেন সচল হয়েছে। সে দৌড়ে নীরদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। শর্বরীকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে নীরদও তার দিকে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি আসতেই শর্বরী খেয়াল করল এবার আর তার চোখের পানি বাধা মানছে না। সে ঠিকমতো কথা বলতে পারছিল না, বারবার এক কথা বলতে লাগল,
“ডক্টর, আমি… আমি… একজনকে মে’রে… ফেলেছি।”
শর্বরী হুঁ হুঁ করে কাঁদতে লাগল। নীরদ যদিও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কিন্তু তার মনেও অজানা ভ’য় এসে ভর করল। সে এক হাতে শর্বরীকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“না, তুমি কাউকে মা’রো নি। তুমি কাউকে মা’র’তে পারো না। ভ’য় পেও না, আমি আছি তো!”
ডক্টর রোকসানা ততক্ষণে ইমার্জেন্সি বিভাগে চলে গেছেন। নীরদ শর্বরীকে চেয়ারে বসিয়ে সেলিমকে কল করে ডেকে আনল শর্বরীকে দেখে রাখার জন্য। ততক্ষণে আরেফিন ও সেখানে এসে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে শর্বরী উঠে দাঁড়াতেই সে বলল,
“মেয়েটাকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে।”
#চলবে।