#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৭
৩৬.
রাত গহীনে নিবিড় কালোর ধূম্রজালে পিষ্ট নীরার ঘরের বিছানার চাদর। দুমড়ে মুচড়ে একাকার চাদরের একপাশ। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। মন’টা কেমন সর্বদা কু ডাকে। বিছানার মাঝখান’টায় ঠোঁট উল্টে ঘুমোচ্ছে ছোট্ট আদুরে আকাশ। নীরা চোখ জুড়ানো মাতৃমমতা নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। বিয়ের এক বছরের মাথায় যখন ছেলেটা হলো নীরার খুব রাগ হয়েছিলো। সহ্য হতো না বাচ্চা’টাকে। খেতে দিতো না। ছুয়ে দেখতো না। আহ্লাদ করে আদর করতো না। নিষ্পাপ শিশু’টার মুখের দিকে তাকালেই রাজ্যের বিরক্তি শরীরে চেপে ধরতো।
তখন কতোই বা বয়স নীরার! মাত্র বাইশ বছর! ওই বয়সে সে এতো তাড়াতাড়ি মা হতে চায়নি। তখন তো সংসারের মারপ্যাঁচ-ই বুঝে উঠা হয়নি। অনিচ্ছার বিয়েতে এতো তাড়াতাড়ি একটা বাচ্চা তার কল্পনার বাইরে ছিলো। জীবনে যেমন ভাবে নিজের স্বামীকে চেয়েছে, যেভাবে বিয়ের পরের দিনগুলো কল্পনায় সজ্জিত করেছে তার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়িত হয়নি। হয়তো সাজিদের নীরার প্রতি কোনো ভালোবাসা ছিলো না বলেই। আদেও এখন হয়েছে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা ওর কাছে নেই। আচ্ছা নীরা-ই কি পেরেছে সাজিদকে ভালোবাসতে? মনের কোনো এক কোণায় বন্দি খাঁচার অদৃশ্য অচিন পাখি’টা কি মাঝে মাঝেই ডানা ঝাপটায় না? মাঝেমধ্যেই কি বিষন্নতার কবলে পরে সকল ব্যথা জেগে উঠে না? কি আশ্চর্য! দুজন মানুষ কেউ কাউকে কখনো ভালোবাসে নি অথচ একদম মৌন থেকে সংসার করে যাচ্ছে। নীরার মাঝেমধ্যেই মনে হয় তাদের দুজনের সংসারের গিট’টা ভীষণ হালকা। একটুখানি কোথায় আটকে রয়েছে। সামান্য ঝড়ো বাতাসের বৃষ্টি হলেই বাধন ছিড়ে যাবে। বাধন’টা হয়তো আটকে আছে…আকাশ নামক এই একচ্ছত্র স্নেহময়ী, নিষ্পাপ বাচ্চা’টার মাঝে। নীরা আকাশের উল্টানো ঠোঁটে চুমু খেলো। তার ছেলে’টা ভারি সুন্দর! একদম সবুজা হক এর মতো। নীরা গম্ভীর মুখে আদর দিয়ে বলল,
‘বাবা, তোর দাদুমনির মতো কেনো হলি মা’র মতোন হতে পারলি না?’
নীরার ঘরের সামনে দিয়েই সেসময় যাচ্ছিলেন সিড়িন হক। নীরার কথা’টা তার কানে এসেছে। তিনি থেমে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ নীরা আর আকাশের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনের দুয়ারে ভেসে গেলো তিক্ত বাক্যের খেলা,
ঠিক এই কারণেই নীরা সংসার’টাকে কখনো ভালোবাসতে পারেনি আর ভালোবাসতে পারেনি বলেই সংসারের প্রতি কখনো তার মায়া, মমতা জন্মায়নি। একান্ত নিজের আপন বলে মনে হয়নি। নীরার চোখ দেখলে মনে হয় সেই চোখে শুধু আক্ষেপ, উদাসীনতা, বিষন্নতা। সাজিদ’কে সবুজা জেদ ধরে আগেভাগে বিয়ে দিয়ে বড়ো ভুল করে ফেলেছে। ওকে যেমন সময় দেওয়ার দরকার ছিলো তেমনি নীরারও আরেকটু বয়স হওয়ার দরকার ছিলো। নীরার শ্বাশুড়িও ঠিক নীরারই মতোন। শুধু একটু চুপচাপ কিন্তু সমসময় নিজের’টা ভেবে গেছে। যখন ইরার বাচ্চা হচ্ছে না তখন সাজিদকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নীরাকে ঘরে এনে তড়িঘড়ি করে বাচ্চা নেওয়ালো। বাড়ির বড় বউয়ের বাচ্চা হচ্ছে না উপরুপন্তর আকাশ পরিবারের বড় ছেলে হবে। এই একটা গড়িমা, ঠুনকো কিছু দম্ভ এবং বংশের উঁচু মাথা কুড়াতে গিয়ে আদতে সে ওদের মস্ত বড় ক্ষতি করে ফেলল।
৩৭.
কাঠের আলমারি থেকে টিয়া একটা কালো শাল বের করেছে। বাইরে হালকা শীত শীত। শাল বের করতেই সাদা রঙের শার্ট’টা পরে গেলো মেঝেতে। টিয়া মাথা ঝুকে তুললো। তুলেই ঝাপটে শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলো কাপড়’টা। বিকেলের নাস্তা খেতে গিয়ে প্রযুক্তের শার্টে একদিন ইচ্ছে করেই সস ফেলে দিয়েছিলো। ইরা প্রযুক্তর শার্ট’টা নিয়ে বলেছিলো, ‘রেখে যা! আমি ধুয়ে দিবো। তুই প্রচ্ছদের একটা শার্ট পর।’
পরে অনেক কষ্টে, অনুতাপের ভান করে, ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে শার্ট’টা ইরার থেকে কব্জা করে নিয়ে এসেছে। বলেছে, ‘সুন্দর করে ধুয়ে ফেরত দিয়ে দিবে।’ এরপর সে আনাড়ি হাতে বুকের কাছের সস লাগার অংশটুকু শুধু ধুয়েছে ঠিকই কিন্তু ফেরত দেয়নি। প্রযুক্তের নিজেরও আর মনে নেই। টিয়া শার্ট’টা চেপে ধরে বিছানায় বসলো। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে প্রযুক্তর গায়ের গন্ধ নিলো যেনো। বন্ধু-বান্ধব’রা বলে, ভালোবাসার মানুষের গায়ের গন্ধ, জামার গন্ধ শুকলে নাকি নেশা ধরে যায়। কই টিয়ার তো নেশা হলো না! তার নাকে তো উল্টো সস হুইল পাউডার মিশ্রণের বিদঘুটে গন্ধ এসে বাড়ি খেলো। টিয়া বারকয়েক চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না। শার্ট’টা চেপে ধরেই বসে থাকলো। হঠাৎ দরজাটা ধাক্কা দিয়ে কেউ খুলে ঘরে ঢুকলো। টিয়া টপাস করে চোখ খুলল। নীরা হেসে বলল,
‘কি করছো?’
টিয়া ঝটপট শার্ট’টা আড়াল করতে করতে ইতস্তত হেসে বলে, ‘কিছু না। তুমি এইসময়?’
‘হ্যাঁ এলাম। একা একা ভালো লাগছিলো না। কি লুকালে?’
নীরা উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে টিয়ার পেছনে দেখার চেষ্টা করে। টিয়া আরেকটু পেছনে শার্ট’টা রেখে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। নীরা এগিয়ে গিয়ে জোর করে শার্ট’টা হাতে তুলে নিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলো। এরপর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এটা কার শার্ট?’
টিয়া আমতা আমতা করে বলে, ‘আমার.. আমার।’
নীরা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে শার্ট’টা ভালোভাবে পরখ করতেই একপাশে হালকা লাল লাল দাগ দেখতে পায়। সচেতন দৃষ্টিতে দেখে কিছুক্ষণ পর মনে পরে গিয়েছে এমন ভঙ্গি নিয়ে বলে,
‘এই, এটা প্রযুক্ত ভাইয়ার শার্ট না? হ্যাঁ তো, এটা তো তার’ই। তুমি নিজে ধুবে বলে ভাবীর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলে।’
টিয়া আড়চোখে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘ না। তুমি ভুল বলছো।’
‘আমি একদম ঠিক বলছি।’
নীরা একটু চুপ থেকে আবার বলল, ‘তুমি টিয়া…তুমি প্রযুক্ত ভাইয়ার শার্ট ঝাপটে ধরে বসেছিলে? আমি আগেই ভেবেছিলাম।’
টিয়া ক্ষোভ নিয়ে বলল, ‘তুমি ভুল বলছো এটা আমার। কি আবোলতাবোল সব বকছো? তার শার্ট আমি নিয়ে বসে থাকবো কেনো?’
নীরা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘এটা তোমার নয়। আমাকে শেখাতে এসো না। তোমার বয়স আমি পার করে এসেছি।’
তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে নীরা টিয়ার মাঝে তুমুল ঝগড়া হলো। ঝগড়ার এক সময় টিয়া রুক্ষ গলায় উচ্চস্বরে বলল,
‘তোমার এতো মাতাব্বরির জন্যই আমি তোমাকে পছন্দ করি না। কই বড় ভাবী তো এভাবে আচরণ করে না। তুমি বড় ভাবীর মতো হতে পারো না? কি দেখে যে এ বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছে তোমায়, আল্লাহ মাবুদ জানে।’
নীরা চোখ লাল করে ধমকে উঠলো, ‘টিয়া…। দাঁড়াও, আমি আজ’ই তোমার ভাইয়াকে বলছি।’
৩৮.
সিড়িন হক সিড়ি বেয়ে নামছিলেন। ইরাকে উপরে উঠতে দেখেই ধমক দিলেন,
‘কি ব্যাপার? তুমি নিচে নেমেছো কেনো?’
ইরা হালকা গলায় জবাব দিলো, ‘এমনি মা। সারাদিন ঘরে বসে…’
সিড়িন হক ইরাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘চুপ থাকো। তোমার এই নিচে আসা-যাওয়া নিয়ে আমার ছেলের সাথে এতো মনমালিন্য হলো আর তুমি কিনা তোমার বেখেয়ালিপনায় সিড়ি বেয়ে উঠছো নামছো?’
ইরার চোখ টলমল করে উঠলো। সে আজ মাত্র একবার-ই নিচে নেমেছে। তাও খিদে পেয়েছে বলেই। ঘরে অর্জন ঘুমাচ্ছিলো। ইচ্ছে করেই জাগায়নি। সারাদিন বিশ্রামের সুযোগ পায়নি মানুষ’টা।
মাঝখানে ঘুম ভেঙে ইরাকে না দেখতে পেয়ে তড়তড় করে নিচে নেমে এসেছে অর্জন। মায়ের কথা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেলো। মেয়েটা ভারি অবাধ্য তো! এতোবার না করে, তবুও তার কোনো হেলদোল নেই? অর্জন এসে আবার ইরাকে ধমক দিলো।
‘নিচে নেমে এসেছো কেনো? আমাকে ডাকলেই তো হতো।’
ইরার নিজেকে অসহায় লাগলো। কি মহা মুশকিল! অর্জন ইরার হাত ধরে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই সিড়িন হক গম্ভীর সুরে বললেন,
‘আরেকজনের কি খবর? বাপের বাড়ি থেকে আসতে হবে না নাকি? দু’দিন তো হলো। ফোন করেছিলে?’
ইরা দু’পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে না করলো। সিড়িন হক বললেন,
‘ফোন দিয়ে কাল-ই আসতে বলো। দিন-রাত উপর-নীচ না করে পরিবারের মানুষ’গুলোর দিকে খেয়াল রাখো। খেয়াল রাখার ইচ্ছে থাকলে ঘরের এক কোণায় বসে থেকেও রাখা যাবে।’
চোখের পলক ফেলতেই যেনো টুপ করে পানি গড়িয়ে পরলো। ইরা ঠোঁট চেপে অর্জনের সাথে উপরে চলে গেলো। সিড়িন হক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটার চোখের পানি দেখতে তার ভালো লাগে না। কিন্তু কি করবে? এই যে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে নামে; আল্লাহ না করুক, যদি পা’টা পিছলে যায়? দু দু’বার মিসক্যারেজ! মেয়েটা আর কত সহ্য করবে? এতো বড় মেয়ে কেনো যে বুঝে না? কেনো যে একটু সতর্ক হয়ে চলে না? পরিবারের সবার দিকে তার খেয়াল অথচ নিজের দিকেই কোনো ধ্যান নেই।
বারান্দার এক কোণায় অশ্রু ভাসিয়ে তমসার নিঝুম বাতাসে ইরা বসেছিলো মন খারাপ নিয়ে। অর্জন কেনো ধমক দিলো? কল্পনা মনে হলেও সত্যি, মা যে তাকে খুব সন্তর্পণে ভরসা করে, ভীষণ ভালোবাসে তা সে বুঝে। ধমক দিলে তার চোখ টলমল করে উঠে ঠিকই কিন্তু কখনো কষ্ট হয় না। অথচ অর্জন কিছু বললেই তার ভেতর’টা একদম পুড়ে যায়। সবাই বকা দিবে, মারবে, কাটবে কিন্তু কখনো অর্জন কিছু বলতে পারবে না।
আকস্মিক পেছন থেকে মন খারাপের পুরুষ’টা জড়িয়ে ধরে কাধে নাক ঘষে আদুরে স্বরে বলল,
‘রাগ হয়েছে?’
ইরা চোখ মুছে অন্যদিকে তাকালো পরক্ষণেই আবার ভিজে উঠলো। অর্জন আহ্লাদ নিয়ে বলল,
‘মাফ চাই, ইরাবতী। তুমি কেনো বারবার সিড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করছো বলো তো?’
ইরা গাল ফুলিয়ে অর্জনের একান্ত আহ্লাদী হয়েই উত্তর দেয়, ‘আমার খিদে পেয়েছিলো যে!’
অর্জন হাসলো। হেসেই তৃপ্তি নিয়ে ইরার গালে লম্বা চুমু দিলো। লজ্জায়, ভালোবাসায়, আদরে ইরার চোখ জোড়া আবারও টুলটুল করে উঠলো। তার স্বস্তি হয় এই ভেবে যে, এই পরিবারের সবাই তাকে ভালোবাসে! সব্বাই….! সবাই তাকে স্নেহ করে, আদর করে, তার খেয়াল রাখে কিন্তু তবুও তাকে ধমকে কথা শোনায়!
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৮
৩৯.
বড় রাস্তা ধরে চার চাকার ঘর্ষনে যান্ত্রিক বাহন’টা নিজ গতিতে এগোচ্ছে। প্রত্যুষের ঝিমানো বাতাস, হালকা রোদের আদর, ঝকঝকে সূর্যের শুভ্র ঝিলিকের ভিড়ে দীর্ঘসময়ের কোনো বন্দি পাখিকে মেলে দেওয়ার মতোই উড়ছে দুষ্টুর খোলা কোমর ছড়ানো চুল’গুলো। জানালায় হাত ঠেকিয়ে প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে সে বলে,
‘আর কিছুদিন থাকতাম।’
প্রচ্ছদ দুষ্টুর দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয়,
‘কাল রাতে ভাবী ফোন দিয়েছিলো। মা তাড়াতাড়ি আসতে বলেছেন।’
দুষ্টু হাতে মাথা ঠেকিয়ে মন খারাপ নিয়ে বসে রইল। খানিক বাদে প্রচ্ছদের ফোন এলো। কথা বলার এক পর্যায়ে দুষ্টু শুনতে পেলো সে বলছে,
‘আচ্ছা, আমরা আসছি।’
ফোন রেখে পলকে গাড়ি ঘুরানো হলো। দুষ্টু চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছি?’
প্রচ্ছদ জবাব দেয় না। তার মুখ থমথমে, গম্ভীর, রক্তশূণ্য। যেনো এমন কোনো খবর যাতে তার দেহ, হৃদয়, মন ক্রমাগত নিরবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত জড়াচ্ছে আর ক্রমেই রিক্ত শুন্য হয়ে যাচ্ছে বুকের বা’পাশ। দুষ্টু আবার শুধালো প্রচ্ছদ অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দেয়,
‘উকিলের চেম্বারে যেতে হবে।’
দুষ্টু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কেনো যে ওমন উদ্ভট ভাবে তাকিয়ে রইল কে জানে! তবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তার কেমন মিশ্র অনুভূতি হলো। ভালোও লাগছে না আবার খারাপও লাগছে না। খুশিও হচ্ছে না আবার দুঃখও পাচ্ছে না।
যাওয়ার পথে ফোনের শো-রুমের সামনে গাড়ি থামিয়ে প্রচ্ছদ নতুন ফোন কিনলো। ফোন কিনে গাড়িতে বসতেই দুষ্টু উৎফুল্লতা নিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘দিন।’
প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকে ফোনের প্যাকেট খুলে। দুষ্টু চোখ পিটপিট করে বলে, ‘দিন। আমি খুলছি তো।’
‘আশ্চর্য! তোমাকে কেনো দিবো?’
প্রচ্ছদের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর। দুষ্টু যেনো আকাশ থেকে পড়লো,
‘আমাকে কেনো দিবেন মানে? আমার জন্য কিনেন নি?’
প্রচ্ছদ কাধ ঝাঁকিয়ে পাত্তাহীন ভাবে বলে, ‘না। তোমার জন্য কেনো কিনবো? তুমি তো আমার ফোনই নিয়ে নিয়েছো।’
দুষ্টু ঠোঁট উল্টে বলে, ‘দেখুন, ফাইযলামি করবেন না। আপনি আমার ফোন ভেঙেছিলেন বলেই আমি নিয়েছিলাম। আপনার এই পুরাতন ফোন আমি নিবো না। নিয়ে নিন। আমাকে নতুন ফোন দিন।’
প্রচ্ছদ বাঁকা হাসে, ‘যখন জোর করে ফোন নিয়ে নিয়েছিলে তখন ভাবার দরকার ছিলো, এটা যে পুরাতন ফোন।’
দুষ্টু গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে ঘুরে, ‘আপনি একটা ফাজিল লোক। একটা ফালতু।’
‘আর তুমিও ছ্যাচড়া। যার তার ফোন জোর করে নিয়ে নাও।’
দুষ্টু আগুন লাল চোখে তাকায়। প্রচ্ছদ মিটিমিটি হাসে। দুষ্টু আঙ্গুল তুলে বলে, ‘একদম হাসবেন না।’
প্রচ্ছদ এবার ঠোঁট প্রসারিত করে শব্দ করে হাসলো। দুষ্টু রেগে গাড়িতে বাড়ি মারে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে হঠাৎ পেলব রোদ্দুরের আলতো হাওয়ায় মনের স্ফটিক অনুভূতি উজাড় করে দিয়ে প্রচ্ছদ হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ডিভোর্স নেওয়ার সাথে সাথেই কি আপনার প্রেমিক কে বিয়ে করবেন?’
প্রচ্ছদের কণ্ঠধ্বনি অন্যরকম শোনায়। দুষ্টু খেয়াল করে প্রচ্ছদের অনুভূতিপ্রবন কথাগুলোর মাঝে যখন গলার স্বর’টা অন্যরকম হয়ে যায় তখন সে আপনি করে ডাকে। মাঝেমধ্যে শুনতে কিন্তু মন্দ লাগে না! দুষ্টু হালকা মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকালো। জবাব দিলো না। অনেকক্ষণ পরে নিজ থেকে প্রশ্ন করলো,
‘আচ্ছা ডিভোর্সের পর আপনি কি করবেন? আপনার জীবনে কি কেউ নেই?’
‘আছে তো।’
প্রচ্ছদের জোর গলায় এহেন উত্তর শুনে দুষ্টু অবাক হলো। ঠোঁটের মাঝে ফাঁক। চোখের তাঁরায় বিস্ময়তা।
‘আছে?’
‘হুম।’
‘নাম কি?’
‘নাম তার গোপনী।’
‘গোপনী? আজব!’
দুষ্টু বিস্ময়ে হেসে হালকা গলায় প্রশ্ন করে। অদ্ভুত নাম! প্রচ্ছদ মৃদু মাথা ঝাঁকায়। দুষ্টু কুচকানো ভ্রু’তে সামনের দিকে ঘুরলে হঠাৎ মনে পরে, ‘দৃষ্টি বলেছিলো, যদি প্রচ্ছদ তোকে ভালোবেসে ফেলে?’
দুষ্টু তাচ্ছিল্য হাসে। উদ্ভট কথা না? ভালোবাসবে কোথা থেকে? তার মনে তো অন্য কোনো নারীর বসবাস। গোপনী! সেজন্যই বোধহয় সে বিয়ে করতে চায়নি। দৃষ্টি সবসময় ভুল করে। দুষ্টু বিরবির করলো, ‘আপু তুমি সবসময় ভুল বলো।’
৪০.
ভার্সিটির গোল চত্বরে বসে টিয়া ক্রমাগত দু’হাত মুচড়াচ্ছিলো। ক্লাস না করে সে এককোনার একটা বড় গাছের গুড়িতে বসে নিজের সাথে নিজে কথা বলছে। কাল রাতে অসীম সাহস নিয়ে নীরার সাথে কথা কাটাকাটি করে শান্তিতে ঘুম দিলেও সকালে উঠে সাহস জানালা দিয়ে পালিয়ে, ভয় দরজা দিয়ে ঢুকেছে। ভাইয়া জানলে কি হবে? আল্লাহ! ভেবেই গলা শুকিয়ে আসে। সকালের নাস্তা না করেই চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরেছে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
সেই পথ দিয়েই প্রযুক্ত হন্তদন্ত হয়ে কোথাও ছুটছিলো। টিয়া দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে ডাকলো,
‘স্যার।’
প্রযুক্ত শুনলো না। টিয়া একটু জোরে ডাকলো। প্রযুক্ত ঘাড় ফিরিয়ে টিয়াকে দেখে বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে এলো। ফোন করে কাউকে বলল,
‘হ্যাঁ, টিয়া ভার্সিটিতে। চিন্তা করবেন না।’
টিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। প্রযুক্ত তেজ নিয়ে বলল,
‘তুমি যে ভার্সিটিতে এসেছো, বাড়িতে কাউকে বলে আসোনি? আবার ক্লাস এটেন্ড না করে এখানে বসে আছো কেনো?’
টিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাড়ির একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সবাই তাকে নিয়ে সবসময় একটু বেশি উৎসুক কিন্তু এতোটা ধরা-বাধা নিয়ম আজকাল ভালো লাগছে না। সে মৃদু আওয়াজে প্রশ্ন করে,
‘কে ফোন করেছিলো?’
‘তোমার ভাবী।’
‘বড় ভাবী?’
‘নাহ, নীরা ভাবী।’
টিয়ার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। এই মহিলার সমস্যা কি? তার ব্যপারে অযথা খোঁজখবর নিয়ে কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে না? কি প্রমাণ করতে চাইছে সে? এতোটা সেনসেটিভ ননদ সোহাগি ভাবী তো সে কোনোকালেই ছিলো না। টিয়া চোখ মুখ কঠিন করেই বলল,
‘শুনুন, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।’
প্রযুক্ত গমগম আওয়াজে বলল, ‘বলে ফেলো।’
প্রায় সাথে সাথেই টিয়ার রাগ, সাহস, তেজ ছুটে পালালো। মস্তিষ্কে ভর করলো একরাশ ভয়, চিন্তা, সংকোচ। এবার টিয়া কি উত্তর দিবে? সব যেনো গুলিয়ে গেলো। যতটা শক্ত, কঠিন চোখে মুখে কথাটা বলেছিলো, এখন ঠিক ততটাই অসহায় চোখে প্রযুক্তর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রযুক্ত চোখ গরম করে বলল,
‘ কুইক।’
টিয়া মিনমিনে স্বরে বলে, ‘আমি একজনকে পছন্দ করি।’
‘হ্যাঁ? কি বললে?’
টিয়া চোখ মুখ খিচে হালকা গলায় আবার বলল, ‘একজনকে পছন্দ করি।’
কথাটা বলতেই টিয়ার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জোড়া যেনো ছেড়ে দিলো। ঠান্ডায় অবশ হয়ে এলো হাত, পা। প্রযুক্ত বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘পছন্দ করো? কাকে? আমরা তাকে চিনি?’
টিয়া বন্ধ চোখে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। প্রযুক্ত কিছুক্ষণ আকস্মিক, বিস্ফোরিত, অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে চলে গেলো। টিয়া চোখ খুলে আশ্চর্য হলো, প্রযুক্তের নিস্তব্ধে চলে যাওয়ার কারণে।
টিয়া কি অসময়ে ভুল কথা বলে ফেলল? বোকামি করে ফেলল? সে কী ভীষণ বোকা! এই অসময়ে হুটহাট এই কথাটা বলে ফেলার কি আদেও কোনো প্রয়োজন ছিলো?
টিয়ার কান্না পেলো। ভীষণ কান্না! কান্নার চোটে গলার স্বর রোধ হয়ে এলো। দু’বছর আগে ভার্সিটিতে যখন ভর্তি হলো প্রযুক্তের শিক্ষকতা, অন্যরকম চলন-ফেরন দেখে মনের মাঝে দৈবাৎ, খুব অজান্তেই সূক্ষ্ম অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে গেলো। কিন্তু এর আগেও প্রযুক্তের সাথে দেখা হয়েছে তবে কখনো এমন অনুভূতি অনুভব হয়নি। ওমন চাকচিক্য, সুন্দর চলন, ভিন্ন এটিটিউড, সবার মুখে ক্রাশ প্রযুক্ত স্যার শুনতে শুনতেই কি তবে টিয়ার মনে অন্যরকম সেই অনুভূতি’টা তৈরি হয়ে গেলো?
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৯
৪১.
ওরা যখন বাড়ি ফিরলো তখন প্রায় দুপুর। দুষ্টু সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো সিড়িন হকের। মাথা নুইয়ে নিলো সে। পেছনে প্রচ্ছদ আসছে। সিড়িন হক মোটা স্বরে বললেন,
‘চুল খোলা কেনো?’
দুষ্টু নিচু মাথায় আড়চোখে তাকালো সাথে ভীষণ বিরক্তও হলো। সে হিজাব বাধা অবস্থায়’ই চলাফেরা করে সবসময়। তবুও অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘ভেজা ছিলো।’
‘বাইরে কখনো চুল ছেড়ে বের হবে না।’
দুষ্টু মাথা ঝাঁকালো। কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল,
‘ভাবলাম বদ্ধ গাড়ির ভেতরেই আসবো কেউ তো দেখবে না। তাই আর কি হিজাব বাধিনি।’
সিড়িন হক প্রতিত্তর না করে চলে গেলেন গটগট করে আওয়াজ তুলে। ঘরে গিয়ে ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে কোমরে হাত রেখে দুষ্টু শুধালো,
‘আচ্ছা, আপনারা মা-ছেলে এরকম কেনো? রস কষ নেই কোনো? অর্জন ভাইয়া দেখুন তো কি সুন্দর! আপনি তার মতো হতে পারেন না?’
প্রচ্ছদ বাঁকা চোখে তাকিয়ে দুষ্টুকে নকল করে বলল,
‘অর্জন ভাইয়া সুন্দর কারণ তার বউ বেশি সুন্দর।’
দুষ্টুর মুখটা হা হয়ে গেলো। বিস্ময়ে তেজে উঠে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘মানে? আমি সুন্দর নই?’
‘এই সুন্দর সেই সুন্দর না! তুমি এসব বুঝবে না। ছাড়ো। বুঝার বয়স হয়নি তোমার।’
দুষ্টু হা করে নিজের দিকে আঙ্গুল তাকঁ করে বলল,
‘আমার? আমার বোঝার বয়স হয়নি? আপনি জানেন আমার বয়স কত?’
প্রচ্ছদ ভ্রু নাঁচালো, ‘কত?’
‘চার’মাস পর ছাব্বিশ হবে।’
‘কিন্তু তোমার আচরণ ষোড়শী কিশোরীর মতোন অথচ আমি একটা বুড়ি’কে বিয়ে করেছি।’
‘আবার অপমান?’
‘তুমি সেটারই যোগ্য।’
বলেই প্রচ্ছদ ওয়াশরুমে ঢুকলো। দুষ্টু এগিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় লাথি মেরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘আজ বের হন শুধু টোকাইওয়ালা। আপনার একদিন কি আমার যতদিন!’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছদ চুল গোছাচ্ছিল। দুষ্টু ফোনে চোখ রেখে নাক ফুলিয়ে বিছানার এক কোণায় বসে আড়চোখে প্রচ্ছদকে’ই পর্যবেক্ষণ করছিলো বারংবার। প্রচ্ছদ গুনগুন করে উঠলো। গুনগুনানোর কিছু অংশ দুষ্টুর কানে একটু আধটু বাড়ি খেলো।
‘হাউশ কইরে বাপে আমায় করায়ছিলো বিয়া
বউ আনতে গিয়াছিলাম একশ গাড়ি নিয়া
এখন দিনে রাতে দেখায় তার আসল চেহারা
বউ তো নয় যেনো সিসি ক্যামেরা
বউ তো নয় যেনো সিসি ক্যামেরা…’
দুষ্টু খেঁক করে উঠলো, ‘এই টোকাইওয়ালার বংশধর।’
প্রচ্ছদ গান বন্ধ করে চোখ রাঙিয়ে তাকালো,
‘আরেকবার টোকাইওয়ালা ডাকলে খুব খারাপ হবে।’
দুষ্টু চুল উড়িয়ে পাত্তাহীন গলায় বলে, ‘ টোকাই’কে টোকাইওয়ালা ডাকবো না তো কি ডাকবো? আমার বাসার ফুল গাছের নিচে কি কি যেনো টুকছিলেন। মনে নেই?’
প্রচ্ছদ হাত মুঠো করে বলল, ‘রেডিকিউলাস।’
দুষ্টু মিটমিট করে হেসে ফোনে ব্যস্ত হলো সাথে আবারও বলল, ‘অলসো ইউ টোকাইওয়ালা।’
‘তোমাকে আমার ঢোলের মতো থাপড়িয়ে বাজাতে ইচ্ছে করছে।’
প্রচ্ছদ দাঁতে দাঁত চাপলো। দুষ্টু হেসে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো৷ হঠাৎই প্রচ্ছদ সপ্রতিভ হাসলো। কিছু মনে পরে গিয়েছে এহেন ভঙ্গিমায় বলল,
‘গট ইট। ডুগডুগি। পার্ফেক্ট না? টোকাইওয়ালার ডুগডুগি?’
দুষ্টু চকিতে ফোন থেকে চোখ সরালো। প্রচ্ছদের দিকে সাপের ন্যায় ফুঁসে উঠে তাকালো। প্রচ্ছদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘যাও ডুগডুগি, আমার কালো শার্ট’টা বের করে নিয়ে এসো। গো ফার্স্ট। আমি বের হবো।’
দুষ্টুর চোখ তখনো তাক করা প্রচ্ছদের দিকে। তেজের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। যেনো এখনি চোখ থেকে আগুন ঝরবে আর ভস্ম করে দিবে এই ফালতু পুরুষ’টাকে। সে আকস্মিক উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
‘আপনাকে আমি কত সুন্দর নাম দিয়েছি আর আপনি আমাকে এই বিচ্ছিরি নাম’টা কেনো দিলেন? আপনাকে এই নাম দেওয়ার যথেষ্ট যুক্তি আছে। আমাকে এই নাম দেওয়ার যৌক্তিকতা কি, বলুন?’
দুষ্টুর ছেলেমানুষী রাগের চোটে প্রচ্ছদ শব্দ করে হাসলো। বলল,
‘ নাম দেওয়ার জন্য যুক্তি লাগে না। যৌক্তিকতা খুঁজতেও হয় না। হৃদয় দিয়ে অনুভব করলে হাগু নামও মধুর মনে হয়।’
বলেই প্রচ্ছদ আবারো শব্দ করে হেসে চলে গেলো। দুষ্টু নাক ছিটকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ঘেন্না নিয়ে বলল, ‘ছি! ওয়াক থু! ইতর লোক।’
৪২.
দুপুরে সাজিদ খেতে এলো। নীরা বিছানার উপর বসে পায়ের উপর পা তুলে কানে হেডফোন লাগিয়ে ফোনে কি যেনো দেখছিলো এবং শব্দ করে হাসছিলো।
সাজিদ এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়ি খুললো। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো। ব্লেজার খুলল। টাই ঢিলে করলো। এসব করতে করতেই আয়না গলিয়ে নীরার দিকে চাইলো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু আশ্চর্য হলেও যেনো সত্যি নীরার সাজিদের দিকে খেয়াল নেই। ইভেন সাজিদ যে ঘরে এসেছে তাও বোধহয় এই মেয়ে খেয়াল করেনি। চোখ তুলে দেখেনি একবারও। সাজিদের মনে হলো, এই মুহুর্তে যদি নীরাকে বলা হয়, যেকোনো একটা বেছে নাও। স্বামী কিংবা ফোন। তবে নীরা ফোন বেছে নেবে।
বুক চিরে অনেক দিন বাদে কিছু হতাশ বিতৃষ্ণার দীর্ঘশ্বাস ঠিকরে বেরুলো। বিয়ের প্রথম থেকেই এমন নতুন বিষয় নয় তবুও সাজিদের আফসোস লাগছে আজ। নীরা আর পাঁচটা সাধারণ বউয়ের মতো নয়। সে এক ওভারস্মার্ট বউ। যে বউ সারাদিন শুয়ে বসে থাকবে, ফোন টিপবে, ঘুমাবে, সাজবে, ঘুরবে, মজার মজার খাবার খাবে, আনন্দ-ফুর্তি করবে। মাঝে মাঝে দেখলে মনে হয়, তার কাছে যেনো সংসার মানে একটা খেলা। তার খুশিটাই মুখ্য। আর পাঁচটা সাংসারিক মেয়ে সে নয়, স্বামীর দেখভালের মেয়ে সে নয়, বাচ্চা-কাচ্চা সামলানোর মেয়ে সে নয়। তার কাছে জীবন মানেই যেন আনন্দ। জীবন মানেই যেন সে একা। আশেপাশের সবাইকে এক প্রকার ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে সে এড়িয়ে চলবে অথচ কেউ কিছু বলতে পারবে না।
এই যে সাজিদ এলো রোদে পুড়ে…অফিসের কাজকর্ম শেষ করে কান্ত হয়ে.. নীরার কি এইসময়টায় উচিত ছিলো না সাজিদকে একটু সময় দেওয়ার? সাজিদকে ভালোবাসার? এক গ্লাস ঠান্ডা পানি ওর মুখের সামনে ধরতো! ওর ঘড়িটা একটু খুলে দিতো! পকেট থেকে রুমাল, মানিব্যাগ বের করতো! ব্লেজার’টা নরম হতে খুলে নিতো! কেনো নীরা তার একটু যত্ন করে না? কেনো একটু অন্যান্য মেয়েদের মতো আহ্লাদ করে না? সাজিদের জন্য সাঁজে না? সাজিদের ঘর্মাক্ত বুকে দৌড়ে আছড়ে পরে না? উল্টে বলে, ‘যাও তো, ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমাকে খুব উইয়ার্ড দেখাচ্ছে।’
সাজিদ নীরার উপর থেকে চোখ সরালো। ঠিক এই কারণ গুলোর জন্য সেও কখনো নীরাকে ভালোবাসতে পারেনি। মন থেকে কাছে টানতে পারেনি। মনে মনে যে একটা অদ্ভুত… অদৃশ্য হৃদয়বন্ধন থাকে তা তাদের কখনো হয়ে উঠেনি। আর হয়ে উঠেনি বলেই হয়তো কেউ কাউকে যত্ন করতে পারেনি। এই সময়টাতে এসেও দুজন দুজনার কাউকে আগলে রাখতে পারছে না। নিজের একান্ত করে ধরে রাখতে পারছে না। সুতোয় টান পরছে। যেনো ছিড়ে যাবে এক্ষুণি।
সাজিদ ওয়াশরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসতেই নীরা হাত থেকে ফোন রাখলো। এরপর গম্ভীর গলায় বলল,
‘কথা আছে।’
সাজিদ নির্বিকার কণ্ঠে বলে, ‘বলো।’
‘তোমার বোন..’
সাজিদ থামিয়ে দিলো মাঝপথেই, ‘আমার বোন তোমার কি হয়?’
নীরা একটু অবাক হলো। একটু রাগও হলো। তবে এখন রাগারাগি করার উপযুক্ত সময় নয় বলে চোখ বন্ধ করে রাগ সংযম করে বলল,
‘টিয়ার ভাবসাব ভালো না। ও বোধহয় প্রেম করছে।’
সাজিদ চকিতে তাকালো। চোখ বিস্ফোরিত। অবাক কণ্ঠে শুধালো, ‘এই বয়সে ও প্রেমের কি বুঝে?’
নীরা মুখ বাকিঁয়ে বলল, ‘ওতোটাও কচি না।’
সাজিদ চোখ গরম করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। নীরা একটু চুপ থেকে বলল, ‘ও প্রযুক্তর সাথে প্রেম করছে।’
সাজিদ টপাস করে চোখ খুলল। বিস্ময়তায় মুখের বুলি উড়ে গেল গগনের মেঘের ভাঁজে। মুখে বিশাল বড় আশ্চর্যতার চিহ্ন। কিছুক্ষণ পর নীরার দিকে বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে পাত্তাহীন ভাবে আবার চোখ বন্ধ করলো। এরপর চোখ খুলে উঠে চলে গেলো খাবার ঘরে। যেতে যেতেই বিরবির করে বলল,
‘যত্তসব পাগলের প্রলাপ। আত্মা চমকিয়ে দিয়েছিলো আমার।’
চলবে❤️