এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-১৩

0
234

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১৩
সানজিদা মাহি
_____________________________

দ্বিপ্রহরের প্রখর, তেজদীপ্ত রোদে ঝলমলে নদীজলে বালিকণা সমতুল্য উজ্জ্বল রশ্মি উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা। ছোট ছোট ঢেউ স্বেচ্ছায় যোগ দিচ্ছে তাদের খুশিতে। এ সময় নদীতে নৌকা চলাচল কম থাকে। তাই অনেকটা দূরত্বে দু-একটা নৌকা নিয়ে মাঝিরা বৈঠা বেয়ে চলেছে আপন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মেহগনি গাছের ছায়ায় নিচের দিকে পা ঝুলিয়ে উঁচু পাড়ে ঘাসের ওপর বসেছে মাহমুদ। নদীর পানি এতদূর অবধি পৌছায়নি বলে অনায়াসে পা ঝুলিয়ে বসা গেছে। দুই ঘন্টা পেরিয়েছে মাহমুদ এখানে এসে বসেছে। অথচ উঠবার নাম নেই, কোথাও যাবার তাড়া নেই। এখন তার অফুরন্ত সময়। সেই সময়টাকেই কাজে লাগাচ্ছে নদী আর পারিপার্শ্বিক চিত্র অবলোকন করে। মাঝে মাঝে দৃষ্টিতে গিয়ে ঠেকছে শূন্যতা। তখন সব নিরব, কোথাও যেন কিছুই ঘটছে না যা কিছু আর সকলের চোখে পড়ে। সব নিশ্চুপ, অনুত্তর, কোলাহলহীন। কোথাও টুঁ শব্দটিও নেই। শুধু মাহমুদের চোখে যেসব ছবি আর ঘটনাবলি ভাসে তাই সত্য।

সেদিনের প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে আজ তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছে মাহমুদ। পরিচিত কেউ এখন তাকে দেখলে চমকে যেত অকস্মাৎ । চোখের নিচে কালশিটে দাগ, রুক্ষ, এলোমেলো চুল, শুকনো মুখখানা দেখে মনে হয় মৃত্যু পথযাত্রী এক যুবক মৃত্যুুর জন্য বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনে চলেছে ক্লান্তি ভুলে। শুধু শারীরিক অসুস্থতা মানুষকে এতটাও কাবু করতে পারে না। শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণাই মাত্র তিনদিনে একটা মানুষকে আগাগোড়া বাহ্যিকভাবে পাল্টে দেয়। শান্তা চলে যাবার পর হতবিহ্বল হয়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট, রঙ ওঠা, খুপরির মতো স্টেশন মাস্টারের জন্য বরাদ্দ ঘরটায়। কিছুক্ষণ পর নজু দৌড়ে আসে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে গড়গড় করে বলে চলেছিল খাবার নিয়ে এসে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তনুর সবটা জেনে যাওয়ার কথা। মাহমুদ জানে না, তনু কতটুকু শুনেছে আর কতটুকু নিজ থেকে কল্পনা করে নিয়েছে। কিন্তু এতটুকু স্পষ্ট বুঝেছে, পরদিন এ অভিমান থেকেই একা একা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তনু। নজু যখন ওকে তনুর কথা বলল, ঘোরের মধ্যে থাকায় মাহমুদ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। সে চেয়ারে বসে টেবিল থেকে বোতল উঠিয়ে পানি পান করলো। তারপর নজুকে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? নজু উদ্বেগ ভরা কন্ঠে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো। সম্পূর্ণ মনোযোগে শোনার পর মাহমুদের মনে হলো দুঃখ আর বিপদ সর্বদা একই সঙ্গে আসে মানুষকে একা আর অসহায় করে দিতে।

মাহমুদ আত্মপীড়ন নিয়ে অস্থিরভাবে ছুটে গেল প্লাটফর্মে। বাইরে তখন প্রচন্ড বারিপাত। বৃষ্টি জল ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিয়েছে প্লাটফর্মের সম্মুখের অংশ। সেখানে প্রায় দুই ইঞ্চি পানি জমেছে। একটু আগে শান্তা চলে গিয়েছিল। অথচ সে শান্তার কথা ভুলে গিয়ে উদ্বেগে উৎকন্ঠিত হলো তনুর জন্য। তার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মন বলছিলো, তনু এই বৃষ্টি দিয়ে বাড়ি পৌছাতে পেরেছে তো? নাকি মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজছে এখনো? সে নিশ্চয়ই এখন মাহমুদকে ঘৃণা করবে! যদি তাই হয় তবে ভুল কিছু করবে না। মাহমুদ তো ঘৃণা পাওয়ারই যোগ্য। একদিকে শান্তা আর অন্যদিকে তনুর ঘৃণা। নিজেকে ভীষণ অচ্ছুৎ, নোংরা, অপবিত্র মনে হচ্ছিলো তার৷ হৃদয় দহনের উৎপীড়নে দাউদাউ করা অগ্নিশিখায় এক টুকরো শুকনো খড়খড়ে কাঠের ন্যায় পুড়ছিল সে অভ্যন্তরে। শান্তা কিংবা তনু দু’জনেই তাকে ঘৃণা করবার মতো হলেও কিছু একটা সম্বল অন্তত পেয়েছে আপাতত বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু সে? সে এই কষ্ট, ব্যাথাতুর হৃদয় দহন নিয়ে কার কাছে ভিড়বে? মাহমুদ প্রথম থেকেই তনুকে সবকিছু খুলে বলতে চেয়েছিলো। যখন শান্তার কোনো প্রতিত্তোর এলো না, অপেক্ষার পর অপেক্ষা পেরিয়েও একটাও চিঠি এলো না, তখন মাহমুদ ধরেই নিয়েছিলো শান্তা নামক মেয়েটি তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে একেবারে। এখন যেহেতু তনু নামের এই নবীনতম মানুষটি যে কিনা তার জীবনের সাথে স্বীকৃতি স্বরূপ জড়িয়ে গেছে, তখন সব ভুলে তারও উচিত জীবনকে নতুন পথে পরিচালনা করা। তাই বলে চাইলেই তো আর অতীত ভোলা যায় না৷ মাহমুদ সময় নিচ্ছিলো৷ পুরনো অনুভূতির রেশ নিয়ে নতুন কাউকে ভালোবাসার চেষ্টা করা বৃথা৷ মাহমুদের অতীত জেনে গেলে বোকাসোকা, সরল মেয়েটা অযথা কষ্ট পাবে বলে শেষ পর্যন্ত সে সবকিছু আড়াল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কে জানতো বড় অবেলায় শান্তা আবার ফিরে আসবে! অন্তঃকরণের বীভৎস যন্ত্রণা নিয়ে বৃষ্টিজলে নিজকে ধুয়ে নিতে পা বাড়ালো সে। যদি অন্তত সামান্য কষ্টটুকু বৃষ্টি ধুয়ে নিতে পারে তবে তাতেই সে সন্তুষ্ট। বিস্তৃত ভাবনার অতল গহ্বর ভেসে ভেসে সে হাঁটতে লাগলো রেললাইনের মাঝপথে গন্তব্যহীনভাবে। ঘন্টাখানেক ভিজে ফিরলো পুনরায় প্লাটফর্মে। ওকে দেখতে পেয়েই নজু দৌড়ে এলো। বুঝাই যাচ্ছিলো এতক্ষণ সে কতটা উদ্বীগ্ন নিয়ে সময় পার করেছে। মাহমুদকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে আটকাবার হিম্মত হয়নি তার। এই ছোট মানুষটাও যেন বুঝে গিয়েছিলো কষ্টের সময় কাউকে নিজের মতো একা ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়। বিয়ের আগে বেশিরভাগ রাত এখানেই থেকে যেত মাহমুদ। তাই এখনো কয়েকটা জামা কাপড় আছে যেগুলো বাড়ি নেয়া হয়নি। ভেজা জামা বদলে সে রক্তিম চোখ নিয়ে বসে রইলো চৌকির ওপর। অতিমাত্রায় ভেজার ফলে গৌরবর্ণা চামড়া কুঁচকে গেছে বুড়ো মানুষের মতো। কম্পমান পা জোড়া নিয়ে মাথা নিচু করে ঠায় বসে রইলো একই স্থানে। সেদিন আর সে বাড়ি ফিরলো না। ওর এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে নজুও বাড়ি না ফিরে রয়ে গেল সাথে।

***

শান্তার সাথে মাহমুদের পরিচয়টা বড় নাটকীয় । সবে সকালের ট্রেন গিয়েছে। ধীরে ধীরে জনসমাগম কমে গিয়ে প্লাটফর্ম খালি হচ্ছে। মাহমুদ টিকিট আর কাগজপত্র গুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলো ব্যস্ত হাতে । কাজের মাঝখানে রডের শিক দেয়া ছোট্ট জানালাটার ওপাশে একটি নারী অবয়ব দৃশ্যমান হলো।

” এক্সকিউজ মি! আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন? ” মেয়েটির রিনরিনে সুর কানে যেতেই মাহমুদ চোখ তুলে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
” জ্বি? ”
” বোকাইনগর আমার দাদা বাড়ি। আমি আসলে এই প্রথম এসেছি তো তাই চিনি না জায়গাটা। আপনি একটু আমাকে পৌছে দেবার ব্যবস্থা করবেন প্লিজ..?”
মাহমুদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনার সঙ্গে আর কেউ নেই? ”
” জ্বি না। আমি একাই এসেছি “, ইতস্তত স্বরে উত্তর করলো শান্তা। মাহমুদের চোখে তখন বিস্ময়। একা একটা মেয়ে গৌরিপুর চলে এলো? তাও চিনে না, কখনো আসেনি এমন একটা জায়গায়! কৌতুহল চেপে না রেখে বলল,
” কিছু মনে করবেন না। আপনি কোথা থেকে এসেছেন জানতে পারি? ”
শান্তা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সে বুঝতে পারছে না উত্তর দিলে ছেলেটা আবার কেন এসেছে জিজ্ঞেস করে বসবে কিনা। কিন্তু না বললেও সাহায্য করবে বলে মনে হয় না। তাই চট করে বলেই ফেলল,
” ঢাকা থেকে ”
” ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ চলে এসেছেন চিনেন না এমন জায়গায় একা একা? ”
শান্তার চোখমুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো। লোকটার কাছে সাহায্য চাইতে এসে দেখি ভুল করে ফেলেছে। মাহমুদ জবাবের অপেক্ষা না করে বাইরে বেরিয়ে এলো। দরজায় তালা দিয়ে চাবি পকেটে নিল৷
শান্তার দিকে ঘুরে বলল,
” চলুন আপনাকে দিয়ে আসি ”
” আপনি পৌছে দেবেন? ”
” হ্যা আর কেউ নেই যে আপনাকে পৌছে দিতে বলব। নজু থাকলে ওকে দিয়ে পাঠাতাম। ছেলেটা অসুস্থ তাই আসছে না দুইদিন ”
শান্তা কথা না বলে নিশ্চুপ রইলো। মাহমুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মন নিয়ে। হুট করে এভাবে চলে এসেছে দেখলে দাদাজান আর চাচা কি ভাববে কে জানে। দাদাজান তো প্রায়ই চিঠি লিখতেন আসবার জন্য। কিন্তু হুট করে না জানিয়ে এলে প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই ভালো হবে না। সে যাই হোক প্রথমে ভুজুংভাজুং দিয়ে কিছু একটা বোঝাতে পারলেই হবে। এরপর না হয়ে সময় বুঝে আসল কথাটা বলে ফেলবে।

অনেকটা পথ হেঁটে একটা গরুর গাড়ি পাওয়া গেল। এতটা পথ হেঁটে হেঁটে গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থাকে আচ্ছামতো মনে মনে ঝাড়লো শান্তা। মাহমুদ সামনে সামনে হাঁটছে। সে পেছন থেকে অনুসরণ করে চলেছে। তার যে প্রচন্ড পা ব্যাথা হয়ে গেছে তা এই অপরিচিত লোকটিকে বলবার মতো সাহস পেল না। তাছাড়া লোকটারও বা কি দোষ? এখানে সবার পায়ে হেঁটেই বহুদূর অবধি যাওয়ার অভ্যেস। অজপাড়াগাঁয়ে কতটা আর উন্নতি প্রত্যাশা করা যায়। অবশেষে যখন একটা গরুর গাড়ি পাওয়া গেল তখন সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বাবা, রক্ষে হলো এবার! গরুর গাড়িতে উঠলো সে এই প্রথমবারের মতো। যন্ত্রচালিত গাড়ির মতো দ্রতগতির না হলেও বেশ ভালোভাবে চলছে। শান্তা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো গ্রামের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। নিচু জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। যতদূর চোখ যায় হলদে রঙের পাকা ধানের ক্ষেত বিস্তৃত। মাথার ওপর থমথমে সূর্যরাজ অকাতরে বিলাচ্ছে হলুদিয়া, পিঙ্গল রোদ্দুর। রোদের তেজটা গায়ে লাগছে না ছাউনির মধ্যে থাকায়। মাহমুদ উল্টোদিকে ফিরে পা ঝুলিয়ে বসেছে। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ায় মাহমুদ হঠাৎ শান্তির দিকে দ্রুত ফিরে বলল,
” বোকাইনগর কার বাড়ি যাচ্ছি সেটাই তো বললেন না? গাড়ি কোথায় নিয়ে পৌঁছুবে? ”
শান্তা নিজের বোকামি বুঝতে পেরে মনে মনে প্রমোদ গুনলো। লোকটি আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি বলে সেও সেধে সেধে বলেনি এতক্ষণ। অপ্রতিভ কন্ঠে বলল,
” আহমেদ মজুমদারের বাড়ি ”

বাড়ির উঠোনে গিয়ে গাড়িটা থামলো। উঠোনের একপাশে দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে মাটিতে ঘর এঁকে “কুতকুত ” খেলছিল। গরুর গাড়ি আসতে দেখে সে খেলা থামিয়ে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অনাহূত অতিথিকে চিনবার চেষ্টা করছে৷ শান্তা গাড়ি হতে নেমে মেয়েটির সামনে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো,
” দাদাজান বাড়ি আছেন? ”
মেয়েটি জোরে জোরে উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে তার দুই বেনুনিও নড়ে উঠলো৷ পাল্টা প্রশ্ন করে সে তার পরিচয় জানতে চাইলো। উত্তরে শান্তা নিজের নাম বলতেই মেয়েটি আশ্চর্যান্বিত হলো। উচ্ছসিত হয়ে বলল,
” আপনে শান্তা? মানে শান্তা বুবু? ”
শান্তা সামান্য হেসে বলল, ” হ্যা ”
মেয়েটি এবার ওর এক হাত পাকড়ে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে চলল,
” দাদাজান ঘরেই আছে। আসেন বুবু ”

আহমেদ সাহেব খাটের ওপর এক পা তুলে চোখে চশমা লাগিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে জমির কাগজপত্র দেখছিলেন৷ তাহমিনা ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল,
” দাদাজান! দেখো কে আসছে ”
আহমেদ সাহেব চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে চাইলেন তাহমিনার পাশে দাঁড়ানো ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা তরুণীটির দিকে। শান্তার মুখে মিটিমিটি হাসি।
” কি বুড়ো? চিনতে পেরেছো তো? ” কন্ঠে আহ্লাদ এনে বলল সে।
আহমেদ সাহেব চশমাটা ভালো করে নাকের ওপর উঠিয়ে দিয়ে বললেন, ” শান্তা না? ”
” এই তো চিনেছো ”
” কার সঙ্গে আসছিস? তোর বাপ কই? ”
” বাপ বাপের জায়গায়। আমি একাই এসেছি ”
শান্তার মাঝে ‘কুচ পরোয়া নেহি’ ভাব। আহমেদ সাহেব উৎকন্ঠিত হলেন।
” একা এলি কি করে? তুই তো চিনিস না কিছুই ”
” তোমাদের স্টেশন মাস্টারকে বললাম পৌছে দেবার ব্যবস্থা করতে। সে নিজে পৌছে দিল ”
” কোথায় ও? বাইরে দাঁড়িয়ে আছে নাকি? ”
শান্তা দাঁতে জিভ কাটলো।
” ইশ! লোকটাকে তো কিছু না বলেই চলে এসেছি ”

শান্তা দৌড়ে বাইরে এসে দেখলো মাহমুদ নেই। গরুর গাড়িটিও নেই। কি আশ্চর্য! লোকটা কিছু না বলে এরই মধ্যে চলে গেল? পরক্ষণেই মনে হলো, লোকটার তো কোনো দোষ নেই। দোষ ওর নিজের। তার উচিত ছিল বলে আসা। দাদাজানও শুনে বলল,
” না কাজটা ঠিক হলো না তোর। অন্তত ভেতরে আসতে বলা উচিত ছিল ”
শান্তার মুখ মলিন হলো৷ সে তখন গাড়ি থেকে বেরিয়ে অমনি তাহমিনার সাথে ভেতরে চলে এলো। গাড়ি ভাড়াটাও দিল না। অচেনা একজন হয়েও লোকটা এত কষ্ট করে এতদূর অবধি পৌছে দিলো বিনা লাভে। আবার ফিরেও যাবে নিজের খরচে। শান্তা মৃয়মান কন্ঠে দাদাকে বলল,
” সত্যি ভুল হয়ে গেছে দাদাজান ”

শান্তার দাদা আহমেদ সাহেব গ্রামের সম্মানিত ও শিক্ষিত বয়োবৃদ্ধ। আর্থিক অবস্থাও স্বচ্ছল। বড় ছেলে আনোয়ারের একমাত্র মেয়ে শান্তা৷ আনোয়ার পড়াশোনার সূত্রে শহরে থেকেছে হাইস্কুল জীবন থেকেই। পরবর্তীতে চাকরি হওয়ায় বিয়ে করে সেখানেই থিতু হয়েছে। তিনি প্রায়শই কয়েকদিনের জন্য বড় ছেলের বাসায় থেকে আসেন। তার একমাত্র কারণ নাতনি শান্তা। শান্তা আর তার বাবার জীবনে বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় শান্তার ধারণা হয়েছে বাবাকে ছাড়া সে কোথাও গেলেই তার বাবা অসুস্থ হয়ে যাবেন। আর আনোয়ার সেই দূর্ঘটনার পর সেই যে একবারে গ্রামে আসা ছেড়েছে, সে আর এ মুখো হয়নি। বহু বলে কয়েও তাকে গ্রামে আনা গেল না৷ সেকারণে শান্তার কখনো দাদাবাড়ী আসা হয়নি। আহমেদ সাহেব তার ছোট ছেলে আলম, পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একসাথে থাকেন। আলমের বড় মেয়ে তাহমিনা আর ছোট ছেলে তৈয়ব দাদার কাছ থেকে কেবল শুনে গেছে ঢাকায় শান্তা নামের তাদের এক জেঠাতো বোন আছে। কখনো সামনাসামনি তার সাথে দেখা হয়নি। দাদাজান একবার বলেছিলো ওদেরকে সেখানে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেসময় মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই পরিকল্পনা বাদ পড়ে গিয়েছিলো।

চাচি শান্তাকে কখনো না দেখেও যেভাবে অতি যত্নে খাওয়াবার দায়িত্ব নিয়েছে তাতে শান্তার মনে হলো এদের সাথে তার আরও আগে সখ্যতা গড়ে তুলবার দরকার ছিল। এতদিন অনেক ভালেবাসা আর আদর, যত্ন থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে বাবার কারণে। এখন বাবার প্রতি রাগ থেকে সম্পূর্ণ দোষ গিয়ে পড়লো তারই ঘাড়ে। চাচাকে সে দেখেছে অনেকবার। দাদাজানের সাথে চাচাও তাদের বাসায় গিয়েছে। কিন্তু চাচি আর বাচ্চাদের আচরণ এমন যেন তারা শান্তাকে ছোটবেলা থেকেই দেখছে। শান্তা আরও একটি ব্যাপার খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে। এরা গ্রামের বাকি মানুষদের মতো অতটা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। হয়তো এর পেছনে দাদাজানের ভূমিকা রয়েছে। তার দাদাজান মানুষটা ভারী আশ্চর্যের মানুষ। এই মানুষটা খুব সহজে মানুষকে প্রভাবিত করতে জানে৷

রাতে খাবার পর তাহমিনা এসে বলল,
” বুবু, তোমারে দাদাজান ডাকতেছে ”

আহমেদ সাহেব সুস্থির ভঙ্গিতে খাটে বসেছিলেন। বোঝা যাচ্ছিলো তিনি শান্তার জন্য অপেক্ষা করছেন। শান্তা অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দাদার পাশে বসলো ধীরলয়ে । সে জানে দাদাজান তাকে কি জিজ্ঞেস করবার জন্য পাঠিয়েছে। তাই ভনিতা না করে নিজেই বলে ফেলল।
” যে মেয়েটি বাবা অসুস্থ হয়ে যাবে ভেবে কখনো নিজের ছোট্ট গন্ডির বাইরে বেশিক্ষণ থাকেনি সে কি করে একা একা এতদূর চলে এলো, এই তো জানতে চাইছো দাদাজান? ”
” তোকে বুদ্ধিমতী বলেই জানি ”
শান্তা অভিমানে গলা ভার করলো। মাথা নুইয়ে থমথমে কন্ঠে বলল,
” বাবাকে শাস্তি দিতেই আমি এসেছি ”

দাদাজান অনুচ্চ শব্দে হাসলেন। যেন শান্তার ছেলেমানুষী কথায় বেশ মজা পেয়েছেন। শান্তা তখনো মাথা নুইয়ে রেখেছে। তার অশ্রু টলমল চোখ, ক্ষীণ রাগে আরক্তিম হওয়া গাল আর ওই চোখের ভেতর লুকিয়ে থাকা বাবার প্রতি রাজ্যের অভিমানের ছিটেফোঁটাও যেন দাদাজান দেখতে না পায় তাই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। দাদাজান জানেন, শান্তা বাবাকে কতটা ভালোবাসে। হঠাৎ কি অভিপ্রায়ে বাবার প্রতি এমন চমৎকার শাস্তি আরোপ করেছে শান্তা, সেটা জানার কৌতুহল হলো। তিনি নিরবতা পালন করে শান্তাকে সময় দিলেন। জানেন, নাতনি প্রশ্নের আগেই যেহেতু উত্তর দিয়েছে সেহেতু শাস্তি আরোপের কারণও নিজেই দর্শাবে।

শান্তা চোখ মুছে স্বাভাবিক হলো। মাথা সোজা করে দাদাজানের দিকে না তাকিয়ে বাবাকে অভিযুক্ত করে তবেই দাদার দিকে ফিরলো। চোখের ভাষায় জানালো, এর একটা বিহিত দাদাজানকে করতেই হবে। অভিযোগ শুনে আহমেদ সাহেব উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। শান্তার অভিযোগটি যে নিছক ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিছুই নয় সেটিই যেন তার হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। শান্তা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
” তুমি হাসছো? আমি হাসির কথা বলেছি? ”
দাদাজান সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামালেন। প্রশ্রয়ের সুর তুলে বললেন,
” ধূর বোকা! হাসলাম কারণ বাবার প্রতি তোর ভালেবাসা ঠিক কতটা বিপুল তা আরেকবার ভালোভাবে বুঝলাম। এর একটা বিহিত অবশ্যই আমি করব। তুই চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুরবি, খাবি, মজা করবি। দাদাবাড়ী এসেছিস এই প্রথম। সময়টা উপভোগ করা হলো, বাবাকেও শাস্তি দেয়া হলো ”
শান্তা আবার গাল ফোলালো।
” তুমি আবারো মজা করছো দাদাজান? ”
” মজা করছি কিন্তু সত্য কথা বলেছি। তা তুই সারাদিন ধরে বাসার বাইরে, তোর বাবার অবস্থা এখন কি হয়েছে সেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছি ”
” বাবাকে নিয়ে চিন্তা করো না তো। আমি খালামনির ডাইরিতে আসার সময় লুকিয়ে চিঠি রেখে এসেছি। টেলিফোন করে বলতে পারতাম। কিন্তু তাহলে এখানে আসাই হতো না। সেও তো ষড়যন্ত্রে যুক্ত! ” চোখমুখে অস্ফুটে বিরক্তি ফুটিয়ে কথাটা বলল শান্তা। আহমেদ সাহেব নাতির অভিব্যক্তি দেখে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন।
” দাদাজান! আবার হাসছো! ”
দাদাজানের কান্ড দেখে মেঘমেদুরে মন নিয়ে ঘর থেকে ধুপধাপ পদক্ষেপে বেরিয়ে এলো শান্তা। ধূর! কেউ তাকে বোঝে না!

***
কাজ নেই বলে চৌকির ওপর শুয়ে পায়ের ওপর পা উঠিয়ে নানান কথা ভাবছিলো মাহমুদ। কড়া নাড়ার শব্দে চট করে উঠে বসলো। তাকিয়ে দেখলো ডাকপিয়ন। কি ব্যাপার বাড়ি থেকে চিঠি এলো নাকি? মাহমুদ উঠে গিয়ে ডাকপিয়নের কাছ থেকে চিঠি নিল। রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর করতেই ডাকপিয়ন চলে গেল জোর কদমে পা চালিয়ে। চিঠির খামে অপরিচিত নাম দেখে সংশয়ে পড়ে গেল সে। এই নামে কাউকে তো সে চিনে না। ঠিকানা ভুল করেনি তো? ভাবনাটা অমূলক ঠেকতেই হাত নেড়ে উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গি করলো। নাম ভুল হতে পারে কিন্তু নাম, ঠিকানা দুটোই একসাথে ভুল হয় কি করে! সংকোচ নিয়ে কতক্ষণ চিঠিটা এপাশ ওপাশ করে দেখলো। তারপর দোনোমনা করে একসময় খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বের করলো৷ এক পৃষ্ঠার ছোট্ট চিঠি। দাগহীন, মার্জিত, সুশ্রী হাতের লেখা। চিঠিটা পড়ে মাহমুদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।

চলবে ইন শা আল্লাহ…