এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১৬
সানজিদা মাহি
__________________________________________
হাতে হাত ধরে সামনে পিছনে নাড়াতে নাড়াতে ফুটপাত ধরে হাঁটছে তনু আর বিনু। আজ বৃষ্টি হয়নি। ঝকঝকে নীলাদ্র আকাশে সামান্য শুভ্র মেঘের আবাস৷ এধার থেকে ওধারে ধীরলহে চলছে তাদের ভেসে বেড়ানোর ক্ষুদ্রকায় আয়োজন।কৃষ্ণ-ধূসর মেঘ গুলো হয়তোবা আজকের জন্য ছুটি নিয়েছে। ফুরফুরে বাতাসে পীতাভ রোদ্দুর গায়ে মেখে দু’বোন আজ বেরিয়েছিল মার্কেটে যাবার উদ্দেশ্যে। তনু কেবলমাত্র নিছক ভালোবাসা থেকে নয় স্বামীর সম্মান বাঁচাবার লক্ষ্যে নিজের জমানো অর্থগুলো ভেঙে পরিবারের জন্য কিছু কিনতে চেয়েছিল। অন্যদের জন্য জিনিস কেনা হলেও বিনুকে এখনো কিছু দেয়া হলো না৷ তনু চেয়েছিলো মায়ের মতো তাকেও একটা শাড়ি কিনে দেয়। কিন্তু বিনুর অনাগ্রহী মনোভাব,
” এতো শাড়ি দিয়ে কি করব? নিজের জামাইয়ের যেখানে শাড়ির কারবার! তুই বরং অন্যকিছু দে আপা ”
সেই অন্যকিছুটা যে কি মাথা খাটিয়ে তাই বের করতে পারলো না তনু এখন অবধি। তনুকে যেটাই দিতে চায় তার এক কথা ” এটা তো আমার আছেই অন্যকিছু দে “। তনু একপ্রকার বিরক্ত। তার অনুপম কিছুর কথা মাথায় আসছে না। যা আসছে তার সবই সাধারণ, সর্বজনীন। এক কথায় বলা যায় তার সবকিছুই বিনুর রয়েছে। শেষে সে বিরক্ত হয়ে বলল,
” আছে বলে কি হয়েছে? নিজের এক জিনিস ঢের থাকুক তবুও কি মানুষ তাকে একই জিনিস দেয় না?”
” ক্ষ্যাপলি নাকি? ”
” না বিরক্ত লাগছে। কিছু একটা তো নিবি ”
” না নিলে দুলাভাইয়ের টাকা বাঁচবে ”
তনু সন্তর্পণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বিনু অন্তত ভাবছে কর্তামশাইয়ের টাকাতেই ওদেরকে উপহার দেয়া হচ্ছে৷ হঠাৎ একে প্রহসন বলে মনে হলো ওর৷ যে মানুষটা এই এতদিন একটিবার খোঁজ পর্যন্ত নিল না সে লোকের মান বাঁচাবার তার এতই তাগিদ পড়েছে কেন?
পরিবারের বাকিদের জামা-কাপড় কেনা শেষ করে ওরা কসমেটিকসের দোকানে প্রবেশ করলো৷ তনু আড়চোখে চাইলো বিনুর দিকে। জিজ্ঞসু দৃষ্টিতে জানতে চাইলো সাজের জিনিস নিবি? ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বিনু মাথা দোলালো সামান্য। শেষে কয়েকটা সাজের জিনিস নিয়ে ওরা দোকান থেকে বের হলো। বৃষ্টি নেই বলে মানুষের কাজের তাড়া বেড়েছে। সাই সাই করে গাড়ি যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। দোকান থেকে বেরিয়ে দু’জন রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। বোধহয় একবছরের বেশি হয়েছে ওরা একসাথে হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে একসঙ্গে। বিনুর বিয়ের পর অনেককিছু বদলালো তনুর জীবনের নিয়মগুলোর মধ্য হতে৷ যেমন প্রায় সময় তনু বলতো, আপা দমবন্ধ লাগছে আজ কেমন। চল ঘুরে আসি। হয়তো আসরের সালাত শেষে বিছানায় আরাম করে গা এলিয়ে দিয়েছে সে তখন। এসময় কার ইচ্ছে করে আলসেমি ঠেলে বাইরে যেতে? গাইগুই করেও বিনুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত না৷ কোনোভাবে রাজি করাতে না পারলে শেষে বিনু তার মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করতে উদ্বত হতো। রাগ দেখিয়ে বলতো,
” ঠিক আছে যাবি না তো? আমিও তোর সঙ্গে কথা বলব না দুইদিন। দেখব কেমন করে থাকিস ”
বিনুর এই এক বৈশিষ্ট্য। সে শত চঞ্চল হলেও রাগ করে কথা বন্ধ করে দেবার ক্ষমতা আছে তার। বিনু কথা কম বললেও একসাথে থেকে মান অভিমান বজায় রেখে থাকতে পারে না। প্রয়োজনে কথা বলতে গেলেও বিনু যখন অভিমান জিইয়ে রেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, এ ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না তনু। তাই এই এক অস্ত্রতেই তাকে কাবু করা সহজ। পুরনো দিনগুলো কত মধুর ছিল। সময়ের সাথে সবকিছু হারিয়ে যেতে থাকলো। জীবনের কিছু সুখস্মৃতি ক্রমে ক্রমে ফিকে হয়ে এলো। এখন সেসব কেবলই আবছায়া রূপকথা। সারা রাস্তা বকবক করে, পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে ওরা যখন বাড়ি এসেছে তখন অন্য চমক অপেক্ষা করছিলো ওদের জন্য।
বিনুর বর বসে আছে বাবা-মার বেডরুম কাম ডাইনিং রুমে। হাতের ব্যাগগুলো তনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বিনু বরের দিকে এগিয়ে গেল হাসিমুখে। তনু সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে কেটে পড়লো মুখটাকে পানসে করে। বিনুর বর চট্টগ্রাম গিয়েছিলো ব্যবসায়ের কাজে। যাবার সময় বিনুকে রেখে গিয়েছিল শ্বশুরবাড়ি। এখন যেহেতু ফিরে এসেছে তারমানে কাজ শেষ। আর তাই সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বিনুকে। বিনু চলে যাবে ভাবতেই মনের আকাশে কালো মেঘে ছেয়ে গেল তনুর। ইশ আর কয়টা দিন থাকলে কি এমন হতো?
বর আসায় খুশিতে ঝলমল করতে করতে মায়ের সঙ্গে রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে বিনু। বিনুর বর ওদের দু’বোনের কামড়াটা আপাতত দখল করায় তনু এসে অস্থায়ী আবাস গড়লো ভাইদের ঘরে। বিনয় বাসায় নেই। তনয়ও স্কুলে। তাই ঘর খালি ওদের। রান্নাঘরে গিয়ে সে বোনকে খোঁচাতে লাগলো৷
” তোর এখানে কি? আমি রান্না করছি৷ যা ঘরে যা ”
বিনু অনুচ্চস্বরে বলল, ” কেন ঘরে কি? ”
” ঘরে তোমার মুন্ডু ”
” ঘরে গিয়ে এখন মুন্ডু চিবোতে বলছিস? ” সিরিয়াস ভঙ্গিতে রসিকতা করতে ছাড়লো না বিনু।
” তাই তো করো তুমি। জামাইয়ের মাথাটা বকবক করে শেষ করে দেও! ”
বিনু চেঁচিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
” দেখেছো মা? আপার কথার কি শ্রী? ”
তনু বোনের মুখ চেপে ধরলো,
” চুপ! চুপ! ”
ওদের কান্ড দেখে ফরিদা হেসে ফেললেন৷ তনুর পক্ষ নিয়ে বললেন, ” তনু তো ঠিকই বলেছে। জামাই একা একা বসে আছে। কি লাগবে দেখ। আমরা দুজন দেখছি রান্নার ব্যাপারটা ”
কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সলজ্জ মুখে রান্নাঘর থেকে সরে এলো বিনু৷ তনুর মনে হলো বুকের একপাশে কেমন একটা ব্যাথা ব্যাথা লাগছে। কান্না পাচ্ছে খুব। কান্না পেলেও যে কাঁদতে নেই সবসময়। কান্না আড়াল করে সে হাসিমুখে মায়ের সাথে কাজ করতে লাগলো।
বিনু চলে গেল বিকেলবেলায়। বিনয় ছিল না বাসায়৷ বাকি সবার উপস্থিতিতে বিদায় নিয়ে চলে গেল ওরা। বিনু সঙ্গে করে যেন নিয়ে গেল সমস্ত কোলাহল আর আনন্দের সরঞ্জামকে। ও চলে যেতেই এতগুলো মানুষ থাকা সত্বেও পুরো বাড়িটা রূপ নিল নির্জন শূন্যতায় খা খা করা গড়ের মাঠের মতো। তনু বালিশ মুখের সামনে চেপে ধরে চোখের ভিজিয়ে দিতে লাগলো বালিশটাকে। অনেকবার সে বলতে চাইছিলো বিনু আর কয়টাদিন থাক। কিন্তু বিনু কি সত্যি থাকতো? স্বামীর সাহচর্য পেয়ে মেয়েটা কেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলো। তা দেখে সে আর নিষেধ করতে পারেনি৷ এখন চলে যওয়ায় বড় বেশি একাকী আর নিঃস্ব মনে হচ্ছে নিজেকে। পুরো ঘরটায় সে থেকেও যেন নেই। ঘরের আধা মালকিন চলে যাওয়ায় অপর মালকিনের উপস্থিতি যেন এখন নিষ্ক্রিয়। বিনু থাকায় এই কয়েকদিনে ব্যক্তিগত কষ্টটাকে হালকা লেগেছিল। সামনাসামনি দুঃখগুলোর সঙ্গে যুঝতে হয়নি খুব একটা। এখন একাকী পেয়ে প্রাচীন কষ্টের মতো ওকে আবারো আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে ভাবতেই ভয় বাড়ছে ক্রমশ। এমন আবেগী, নড়বড়ে মন নিয়ে সে কি করে লড়াই করবে ভেবে পেল না৷ সঙ্গীন গৃহে এ যেন ঠিক হাজতবাস। অদৃশ্য চার দেয়ালে কপাট বদ্ধ করে পুনরায় আঁটকে রাখা নিজেকে। কাচের জারে শক্ত করে পুরে রাখা আবেগকে অদৃশ্য বলয়ে ছিপি খুলে আবারও কেউ বের করে নেবে অজ্ঞাতসারে৷ তারপর বেয়নেটের মতো ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে জখম করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হবে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন সে এক! না তনু আর পারছে না মেনে নিতে৷ জীবনে এই প্রথম একটা আঘাত জীর্ণশীর্ণ করে দিল ওকে আগাগোড়া। অথচ জীবন মানেই পরীক্ষা। জীবন মানেই লড়াই করে বেঁচে থাকা। যতদিন মানুষ বেঁচে রবে ততদিন সে এক যুদ্ধরত সৈনিক। মরে না যাওয়া অবধি এই যুদ্ধের ময়দান হতে বেরোবার সাধ্যি নেই কারো।
মাগরিবের আজান দেয়ায় উঠে পড়লো তনু। সবটুকু মনোযোগ দিয়ে অজু করে সালাতে দাঁড়ালো। এই একটি জায়গা যেখানে প্রভুর দাসত্বকে স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নেয়া বান্দারা সর্বোচ্চ স্বস্তি পায়। জায়নামাজে ফেলা এক ফোঁটা অশ্রু মানুষের জীবনকে কত দ্রুত আর উত্তমভাবেই না বদলে দিতে পারে। রবের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা যদি আন্তরিক হয়ে থাকে তবে মুমিন ব্যক্তির সমস্ত দায়িত্ব তো রব নিজের হাতে তুলে নেন। তার আর ভয় কি? সবরের ফল হয় মিষ্টি। মানুষ যে জিনিসটা দুম করে পেয়ে যায় তার দাম কতটুকু হয়? অথচ পরিশ্রম আর সবরের ফলাফল হিসেবে যা পাওয়া যায় তার মিষ্টতা লাভের সুযোগ তো কেবল তারাই পায় যারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে পারে, ভরসা রাখে মালিকের ওপর। নিজের জীবনের এই চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে যাকে তনুর সবচাইতে বেশি প্রয়োজন তার কাছে মন খুলে না বলে কেঁদে কেটে বালিশ ভেজানো যে কতটা বৃথা তা সেজদায় অশ্রু বিসর্জনে আরও প্রগাঢ়ভাবে উপলব্ধি করলো সে। বহুদিন পর সালাতের মিষ্টতা পান করে শান্ত মন নিয়ে সালাত শেষ করলো সে। ভুলেই গিয়েছিল এতদিনে তার রবের আনুগত্যের চাইতে দুনিয়ার এসব মিথ্যে মোহ আর ভালোবাসা অতি তুচ্ছ। যে রবকে ভালোবাসে তাকে উত্তম সঙ্গী মিলিয়ে দেবার দায়িত্ব তো রব স্বয়ং নিজেই নিয়েছেন।
ফরিদা এসেছিলেন ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা দড়িতে মেলে দিতে। পাশের ঘর থেকে কুরআনুল কারিমের সুরেলা তিলাওয়াত এসে তার কর্ণকুহরে পৌছালো। আচ্ছন্নের মতো দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন ভেতর থেকে ভেজিয়ে রাখা দরজার অপরপ্রান্তে। তনু সূরা আর-রাহমান তিলাওয়াত করছে।
” ফাবি আইয়্যি আ-লা- ই রাব্বি কু’মা তুকাজ্জিবান ”
” এবং তোমরা তোমার রবের কোন কোন নেয়ামত কে অস্বীকার করবে ”
এই আয়াতে এসে কন্ঠটা অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিবার। কান্নাচাপার একটা ব্যর্থ চেষ্টা যেন। তিনি তনুর গর্ভধারণী মা না হতে পারেন কিন্তু এই মেয়েকে সাড়ে চার বছর বয়স হতে দেখছেন৷ নিজের কন্যার ন্যায় বড় করেছেন৷ মেয়ে শত চেষ্টা করলেও মায়ের কাছে দুঃখ আড়াল করে রাখতে পারে না৷ ফরিদা আর তনুর মাঝমাঝি একটা বাহ্যিক দেয়াল গড়ে উঠেছে। হয়তো তিনি মেয়েটাকে ভালোভাবে বুকে টেনে নিতে পারেননি বলেই। মেয়ের কষ্টে তারও যে কষ্ট হয়। নিঃসীম বেদনা অনুভব হয় ভেতরে ভেতরে তা তিনি নিজেও কখনো প্রকাশ হতে দেননি। তবে মনে হচ্ছে এই অপ্রকাশের খেলাটা আর বেশিদিন চালিয়ে গেলে বড় বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে। তনুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে হবে স্বামীর সঙ্গে কি হয়েছে। এক সপ্তাহ পেরিয়েছে অথচ ছেলেটা বউকে একা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে এলো না নিজে। ফরিদা বিশ্বাস করেন তার মেয়ের কোনো দোষ নেই। তনু বরাবরই সরল। এমন মেয়ে কখনো নিজ থেকে ভুল করবে না যাতে কষ্ট পেয়ে কাঁদতে হয়৷ তেলাওয়াতের সুর থেমে যাওয়ায় শব্দ না তুলে ধীরে ধীরে পা তুলে দরজার সম্মুখ হতে সরে এলেন তিনি৷ সুযোগ বুঝে তনুকে জিজ্ঞেস করতে হবে সবটা।
***
বারান্দায় বসে রাস্তার ওপাশের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে একধ্যানে বসে রইলো তনু। রোদ নেই, বৃষ্টি নেই। তবু সন্ধ্যার নামার আগে চারপাশে আঁধার নেমেছে। বৃষ্টি আসার পূর্বলক্ষণ। তনু নিশ্চুপ মেয়েটি হয়ে বসে রইলো বৃষ্টির অপেক্ষায়। বৃষ্টি এলেই যেন উষ্ণ পৃথিবীর ন্যায় তার নিজস্ব পৃথিবীতেও নামবে শীতলতা। চোখেমুখে আবছা বিষন্নতার পর্দা নেমে এসেছে ওর অজান্তেই। মন খারাপকে হাতছানি দিয়ে ডাকবার প্রয়োজন পড়ে না। সে আপনাতেই ধরা দিতে সদা প্রস্তুত। আজকাল এমন হয়েছে যে সারাক্ষণই বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সে। বিনুটা যাবার পর থেকেই কিছু ভালো লাগে না। বিনু ওর দুঃখ গাঁথা জানে না। ওকে স্বান্তনার বাণীও তাই দিয়ে যায়নি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছিলো সে।
মানুষের যখন মন ভেঙে যায় তখন একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার হয়। যেখানে গিয়ে সে সংকোচহীন আচরণ করতে পারবে, যে তাকে মায়ায় জড়িয়ে কৌতূহল এড়িয়ে প্রশ্ন ছাড়াই দুটো স্বস্তিদায়ক কথা বলবে, মন খুলে একটুখানি গল্প করবে, তার মন ভালোর চেষ্টা করবে। এরপর মন ঠিক হয়ে গেলে সে পাখি হয়ে উড়ে গেলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সে যে একদিন খুব করে আগলে রেখেছে তা মনে গেঁথে যাবে! এই যেমন বিনু চলে গেছে অথচ ওর সান্নিধ্যকে খুব করে মিস করছে তনু। সারাক্ষণ বাড়ি মাতিয়ে রাখা আর নিজের বিষাদ ছায়া লুকিয়ে রেখে হাসিমুখ দিয়ে সকলকে জয় করে নেয়া ওর পক্ষেই কেবল সম্ভব।
ফরিদা দুই কাপ চা নিয়ে এক কাপ তনুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তনু একটু সংকোচ নিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। মা আর কখনো এভাবে নিজ থেকে চা বানিয়ে ওর পাশে বসেনি। তাই মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে নিশ্চিত। সে একটু জড়োসড়ো হয়ে বসলো। ফরিদা চেয়ার টেনে ওর কাছাকাছি বসলেন। কিয়ৎক্ষন দু’জনই বাক্যবিহীন বসে থেকে চা পান করলো। ফরিদা মনে মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। কিভাবে কি বলা যায় তাই ভাবছিলেন আর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তনু চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বকুল গাছের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছিলো। কথা ছাড়া এভাবে চুপচাপ বসে থাকায় সংকোচটা একটু বেশিই লাগছিলো। ফরিদা হঠাৎ চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে তনুর দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় ডাকলেন,
” তনু! ”
তনু মৃদু চমকে চাইলো মায়ের দিকে।
” জ্বি ”
” তুমি ভালো আছো? ”
তনু হাসার চেষ্টা করলো।
” হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন মা? ”
” কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই ”
তনু মাথা নিচু করলো। সে আসলেই ব্যর্থতায় পর্যুদস্ত একজন মানুষ৷ মন খারাপ টুকুও সে মায়ের কাছ থেকে আড়াল করতে পারলো না। মা এরপর কি জিজ্ঞেস করে বসেন তা ভেবে উদ্বীগ্ন হচ্ছিলো সে৷
ফরিদা কয়েক মিনিট কথা বললেন না। এক দৃষ্টিতে দেখলেন মেয়েকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” জানো তনু, তোমার বাবাকে বিয়ে করার একটা বড় কারণ ছিলে তুমি। তোমার বাবা দোজবরে তার উপর দুটো সন্তান আছে তার৷ আর আমার তো শুধু বিয়ে হতে গিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। বিয়ে হয়নি। আমি চাইলে এ সম্বন্ধ ভেঙে দিতে পারতাম কিন্তু দেইনি কেন জানো? আমি যখন শুনলাম উনার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে তখন সারারাত ভাবলাম এ নিয়ে। তোমার ভাই বিনয়ের বয়স যতটুকু ছিল তাতে সে সামলে নিতে পারবে নিজেকে। কিন্তু ওইটুকুন একটা মেয়ের মায়ের সাহচর্য খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। আমি তোমাকে দেখিনি কিন্তু কল্পনা করছিলাম একটা ছোট্র ফুটফুটে মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলে শুয়ে আছে “।
ফরিদা থামলেন। তার চোখের কোলাজ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। তনু তখনও মাথা নিচু করে রেখেছে। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি ঝরছে টেবিলের ওপর। বাইরে অনতিক্রমে তমসা ঘনিয়ে আসছে। যেকোনো সময় বিজ্ঞাপন বিহীন বৃষ্টি নেমে আসবে।ফরিদা ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন।
” আমি মনে নয় আদর্শ মা হতে পারিনি তনু। তুমি আমাকে ভালোবেসে মা ডাকো। তবু কোথায় যেন একটা বাঁধা থেকে যায় আমাদের মাঝে ৷ কোনো অদর্শিত দেয়াল আমাদেরকে কাছে রেখেও দূরে ঠেলে রেখেছে। নইলে তুমি যে কষ্টে আছো, তোমার মুখের অপ্রসন্নতার ভেতর লুকিয়ে থাকা সেই কষ্ট টুকু কেন আমাকে বলতে পারছো না? ”
বিমর্ষচিত্তে ফরিদা তাকিয়ে রইলেন তনুর দিকে। তনু একটা কথারও জবাব দেয়নি।
” বিনুকে নিয়ে অতটাও চিন্তা কখনো করিনি যতটা তোমাকে নিয়ে করেছি। বিনু নিজেকে যেকোন পরিস্থিতিতে সামলে নিতে জানে। আর আমি জানি আমার বড় মেয়েটা তেমন না৷ সে ভেতরে ভেতরে ধুঁকে মরবে তবু কষ্টের কথা কারো কাছে বলবে না। তনু তুমি কি সত্যি আমাকে নিজের আপন মায়ের জায়গাটা আমাকে দিতে পেরেছো? যেভাবে বিনু আর তনয়ের আগে আমি তোমাকে সন্তানের জায়গাটা দিয়েছি? ”
তনু আর থাকতে পারলো না। আচম্বিতে মাকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। কান্নার দমকে হেঁচকি উঠতে লাগলো। ফরিদা এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। বিষাদতুর কন্ঠে বললেন,
” নিজেকে আর কষ্ট দিস না মা। আমাকে সবটা খুলে বল। তোর সুখের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলেও আমি তাই নেব ”
“তুই” শব্দটা যেন অদর্শিত দেয়ালটাকে মুহূর্তে ভেঙে চূড়মার করে দিল। তনু হয়ে অবাক হয়ে উপলব্ধি করলো, ছোটবেলায় মায়ের আঁচলের তলায় নিজেকে আড়াল করে মায়ের গা থেকে যে “মা” “মা” গন্ধটা পেত , ফরিদার গা থেকে এখন সেই গন্ধটাই পাচ্ছে। জন্ম না দিয়েও কেউ কেউ আদর্শ মা হয়ে যায়। যে সৎ সন্তানকে দূরে ঠেলে না দিয়ে বরং আরো বেশি কাছে টেনে নেয়। বিক্ষুদ্ধ কান্নাকে দমিয়ে রেখে তনু বহু কষ্টে বলল,
” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা… ”
ফরিদা তনুকে ছোট্ট বাচ্চাটির মতো করে আরো শক্ত করে নিজের সঙ্গে চেপে ধরলেন৷ মনে পড়লো ছোটবেলায় একদিন খেলতে গিয়ে ভাঙা কাঁচে পা কেটে গিয়েছিলো তনুর। সে রাতে পায়ের ব্যাথায় ভীষণ জ্বর এসেছিলো ওর। জ্বরের ঘোরে ফরিদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলো। কিছুতেই নিজের কাছ থেকে ছুটতে দিচ্ছিলো না৷ ছোটবেলার সেই তনু এত বছর পর আবার যেন মায়ের কোলে ফিরে এলো। ফরিদা নিজের মাথাটাকে আলগোছে তনুর মাথার সঙ্গে হেলিয়ে দিলেন।
সে রাতে তনু একটা ভীষণ কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। সে কর্তামশাইকে শান্তাকে বিয়ে করে নিতে বলবে। ফরিদা বারবার বলছিলেন, ” এটা তুই সইতে পারবি তো মা? ”
জবাবে নির্লিপ্ত গলায় বলেছিলো,
” আল্লাহই সহজ করে দিবে মা ”
মেয়েদের এই সহ্য ক্ষমতাটুকু আছে বলেই আল্লাহ তা’আলা নিয়ম তৈরি করেছেন। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তো সেই রব যিনি কখনো বান্দার ওপর জুলুম করেন না। বরং বান্দা নিজেই নিজের ওপর জুলুম করতে করতে প্রবৃদ্ধির দাসত্ব বরণ করে নেয়। একজন সতী সাধ্বী নারীর জন্য এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব যে তার স্বামী একজন পরনারীর প্রতি অনুভূতি পোষণ করে বাঁচবে। হালালটাকে মেনে নিতে মানুষের কতই না কষ্ট অথচ স্বামীকে হারাম পথে যেতে দেখেও নির্লিপ্তি নিয়ে কাটিয়ে দেয় অনায়াসে । যেন এটুকু মেনে নেওয়াই হালাল সম্পর্ককে মেনে নেয়ার চেয়ে সহজ। তনু জানে এ সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়া কষ্টকর তবে অসম্ভব নয়। ভালোবাসার মানুষের ভালোর কথা চিন্তা করে হলেও এ সিদ্ধান্তে তাকে অবিচল থাকতে হবে….
চলবে ইন শা আল্লাহ…