এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
363

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্ব- ১৮ (সমাপ্তি পর্ব)
সানজিদা মাহি
____________________________________

সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। তনু বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে বৃষ্টি দেখছে একাগ্রচিত্তে। শ্রাবণ মাস শেষের দিকে। দুটো মাস মিলিয়েই কেন বর্ষাকাল হতে হবে? আর কয়টা মাস বেশি হলে এমন কি ক্ষতি হতো? আর কিছুদিন পর বর্ষা ফুরিয়ে যাবে। সহসা বৃষ্টির দেখা মিলবে না ভাবতেই কেমন যেন মন ভার হয়ে আসে। মনে পড়লো ছোটবেলার বৃষ্টিস্নাত একটা দিনের কথা। সারাদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিলো অবারিত ধারায়। নানুবাড়ির কাঠের জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছিলো তনু। জানালার ধারে খাট পেতে রাখা। তাই আরাম করে বসে জানালার বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। ছোট খালা এসে হুট করে তনুর পাশে বসলেন। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলেন,
” মন খারাপ তোর? ”
তনু দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,
” না তো। বৃষ্টি দেখছি ”
ছোট খালা ভীষণ অবাক হয়ে বললেন,
” বৃষ্টি আবার এভাবে বসে বসে দেখার জিনিস নাকি? তুই দেখি একদম তোর মা’র মতো পাগল হয়েছিস ”
” মাও কি বৃষ্টি পছন্দ করতেন খালা? ”
” শুধু পছন্দ করতেন বললে ভুল হবে। বৃষ্টি দেখলে খুশিতে রীতিমতো পাগল হয়ে যেত। তারপর সে কি হৈচৈ! ” হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথাটা শেষ করে ছোটখালা একচোট হেসে নিলেন। তনু বাইরের দিকে পুনরায় তাকালো তখন। মনে হলো, ঠিক এইভাবে জানালার পাশে বসে মাও একদিন বৃষ্টি দেখতেন। ছোট্ট তনুর মনটা আদ্র হয়ে গেল অর্বাচীন বিষাদে। কেন ওর মা নেই? মা থাকলে নিশ্চয়ই দু’জন একসাথে বৃষ্টি দেখতো। মা ওকে জড়িয়ে ধরে দুলে দুলে ছড়া শোনাতেন। তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ফরিদা এখন তনুর সাথে অনেক বেশি সাবলীলভাবে কথা বলেন। মাঝে মাঝে নিজে চা বানিয়ে নিয়ে এসে বলেন, চল তনু গল্প করি। সত্যি ফরিদা যদি নিজ থেকে ওকে কাছে টেনে না নিতেন তবে তনু কখনো মায়ের ভালোবাসার স্বাদ গভীরভাবে আস্বাদন করবার সুযোগ পেত না।

আজ শুক্রবার বলে বাসার সবাই উপস্থিত। ভেতর ঘরে বাবা আর ভাইদের আড্ডা বসেছে। হঠাৎ হঠাৎ বিনয়ের উত্তেজিত, উচ্চস্বরে বলা কথা এসে তনুর কানে ধাক্কা খাচ্ছে। সেসবকে অগ্রাহ্য করে তার মন পড়ে রয়েছে বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টির গতি বেড়েছে বলে ছিটকে এসে তনুর মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। স্নিগ্ধ, শীতল জল এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর নমনীয় তনুখানি। তনু মুগ্ধ হয়ে শুনছে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার। ঢেউটিনের ফাঁক গলে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে নিচে। ধুপ করে নিচে পড়তেই চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্রোতের রেশ। বাড়ির পূর্ব পাশ বরাবর নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছে অনেকক্ষণ যাবত একটা কাক কা কা ডেকে যাচ্ছে থেমে থেমে। কিছুক্ষন পরপর কাকটা গা ঝাড়া দিয়ে গায়ে পড়া বৃষ্টিজল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে তনুর মুগ্ধ চোখজোড়া অকস্মাৎ স্থির হলো বকুল গাছের নিচে। আধভেজা শরীরে একজন যুবক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এদিকে ফিরে। গায়ের সাথে লেপ্টে আছে ধূসর রাঙা শার্টখানা। প্রায় ঘাড় অবধি নেমে আসা চুলগুলো চুইয়ে নামছে বৃষ্টির অবাধ ধারা। চোখ তার জোয়ার- ভাটা বিহীন স্রোতস্বিনীর ন্যায় সুস্থির। উদভ্রান্ত, নিষ্পলক, বিহ্বল চাহনী। ওষ্ঠের এককোণে যত্নে গড়া এক ছটাক হাসি। তনু ভাবে কল্পনা কত সুন্দর। তবে কিছু কিছু কল্পনাকে সত্য বলে ভ্রম হয়। সেদিন বিনুর সাথে কেনাকাটা শেষে ফেরার পথে বিনু বলল, আপা আসো টেলিফোনের দোকানে যাই। একটা কল করার আছে। বিনু ভেতরে কথা বলছিল, তনু দাঁড়িয়েছিল বাইরে। হঠাৎ পাশের দোকানে চেয়ে দেখলো মাঝারি আকারের, চিকন করে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে দোকানের দিকে ফিরে। গায়ে নীল শার্ট। ঘাড়ের কাছাকাছি অবধি চুলগুলো নেমে এসেছে। পেছন থেকে দেখে তনু স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলো। এক পা, দু-পা করে এগিয়ে বিস্মিত, অস্থিরপনা গলায় বলল, আপনি এখানে? লোকটা ফিরে চাইতেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলল সে। সরি বলে কোনোরকমে সরে এলো সেখান থেকে। নিজের এমন বিরক্তিকর স্বভাবের জন্য সে নিজের ওপর একচোট ঝাড়লো একাই একাই সেদিন৷ আর আজ আবারও চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে। আগেরটা ভুল বোঝাবুঝির হলেও এ নিশ্চিত কল্পনা। আর সেটা জেনেও মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করে।

তনু দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। একতালে বর্ষিত জল এসে ভিজিয়ে দিতে লাগলো ওকে আদুরে ভঙিতে। তনু আনমনে হেঁটে এসে দাঁড়ালো মানুষটার সামনে৷ পললবিহীন চোখে চোখ রেখে চোখের ভাষা পড়তে চাইলো।

” এলেন? ” কন্ঠে তার মৃদু আকুলতা, সামান্য অভিমান মিশ্রিত অনুযোগ। কর্তামশাইয়ের দৃঢ় কন্ঠ,
” আসতেই হলো ”
” দেরি হলো যে বড়?”
” নিজের সাথে যুঝতে হলো। দূরত্ব খুঁজতে লেগেছিলো সত্য ভালোবাসাকে ”
তনুর মনে দমকা হাওয়া এসে জুড়ে বসলো একপাল উষ্ণতা। চোখ না সরিয়ে জানতে চাইল,
” পেলেন? ”
” পেলাম বলেই এলাম “, উত্তর দিতে বিলম্ব হলো না কর্তামশাইয়ের । তনুও ভুলল না প্রশ্ন করতে। কন্ঠে ঝংকার তুলল অনুরাগের প্রভঞ্জন।
” তবে আগে কি ছিল? ”
” মস্ত বড় ভুল ”
ভুলটাকে মানতেই হলো অবশেষে৷ তাই স্বীকার করতে কার্পন্য করেনি কর্তামশাই। তনু মুখ হাসি হাসি করে বলল,
” স্বীকার করেন? ”
” করতেই হলো। নইলে পেতাম কি করে তোমাকে? ”

চারদিকে রাজ্যের নিরবতা নেমে এলো মুহূর্তে । অন্তর্নিহিত, অন্তর্নিবিষ্ট পর্দা দ্বারা ঢেকে দিল সব কোলাহল। শুধু রইলো বৃষ্টির টিপটিপ কলতান। ঠিক এতটা কাছ থেকে দেখা হয়নি কখনো। নিঃশ্বাসের শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছিলো নিঃশ্বাস। জলপূর্ণ গ্লাসে একটা দুটো করে ফোঁটায় ফোঁটায় রঙ ফেললে যেমন করে রঙটুকু নিজের ঘনত্ব ছড়িয়ে দিতে থাকে অনতিক্রমে। ঠিক তেমনই করে দুটো হৃদয় মঞ্জিলে ক্রমশ মোলায়েম এক ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছিলো এক কদম, দু-কদম করে পা ফেলে সন্তর্পণে।

” আমাকে কি ক্ষমা করা যায়? ”
প্রশ্ন করে মাহমুদ। অপরাধবোধে নুইয়ে আসা মাথা বুক অবধি এসে ঠেকেছে। মাটির দিকে নয়ন জোড়া স্তিমিত। তনু ভুলে গেল উত্তর দিতে। কুসম রাঙা, বৃষ্টিভেজা মুখের ওপর তার দৃষ্টি। ভেজা চুল হতে ফোঁটায় ফোঁটায় স্নিক্ত জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আবারো মনে মনে আওড়ে বলল, কল্পনা এতো সুন্দর!
” ক্ষমা করবে না তবে? ”
সম্বিত ফিরলো তনুর। প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল,
” বহু আগেই করে দিয়েছি যে ”
মাহমুদ চোখ তুলে চাইলো। কাজল আঁকা চোখে কি যেন খুঁজল। অধীরতা প্রকাশ পেল বুকের ঢিপঢিপানি শব্দে৷ সামনে দাঁড়ানো এই মানবী তার অতি চেনা। অথচ কাজল আঁকা মায়ায় সিক্ত চোখগুলোকে এত কাছ থেকে আবিষ্কার করার অবকাশ হয়নি কখনো। প্রাঞ্জল দৃষ্টির বাইরে একটা গোটা মানুষের সমস্ত মনকথন লুকিয়ে রাখা এখানে। সেই গোপন অভিসন্ধি, অনুরাগ, অভিমান আর ভালোবাসাকে জানার এক প্রবল তৃষ্ণা জেগে উঠলো সদর্পে। তারপর অভূতপূর্ব একটা কাজ করে ফেলল সে আচমকা। দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে হাতের চামড়া কুঁচকে গেছে।সেই ভেজা ভেজা হাতে ছুঁলো একহারা সোনালি চুড়িতে সজ্জিত লম্বা, শ্যামাঙ্গীনির কোমল হাতটাকে। মুঠোর মধ্যে কম্পনরত হাতের উষ্ণতা কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো তনুর মনকে। বিভ্রান্তিতে সে পলক ফেলতে ভুলে গেল। গাঢ় সন্নিবেশে জড়িয়ে রাখা অপর হাতটার দিকে একবার চাইলো। তবে এটা কল্পনা নয় সত্যি? তনুর ভড়কে যাওয়া চাহনী দেখে মাহমুদ দ্বিধান্বিত হলো। তনু নির্দ্বিধ চেতন নিয়ে জানতে চাইলো,
” আপনি সত্যি এসেছেন? ”
এতটা মুহূর্ত অঘোষিত কাব্যিক কথোপকথনে কাটানোর পর প্রথমবার করা প্রশ্ন পুনরায় করবার কারণ খুঁজে পেল না মাহমুদ। হাত ধরেছে বলে তনু কি পছন্দ করছে না? তনু টানা কয়েকবার চোখের পলক ফেলে নিঃশ্বাস টেনে বিড়বিড় করে বলল,
” ইয়া আল্লাহ এটা দেখি কল্পনা না! ”

মাহমুদ হেসে ফেলল অনুচ্চস্বরে। তনু চকিতে চাইলো তার দিকে। পরমুহূর্তে লজ্জায় লাল আভাযুক্ত গাল লুকোতে মাথা নিচু করে ফেলল। মাহমুদ মুঠোয় ধরে রাখা হাতটাকে টেনে এনে বুকে ছোঁয়াল। হৃদ প্রকোষ্ঠের ক্রমাগত ধুকপুক বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো তনুর হৃদয়েও কম্পন সৃষ্ট করেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওর সাধারণ, অনাড়ম্বর জীবনে এমন মধুর দিন এসেছে। আয়োজন হীন এই হঠাৎ কল্পনাকে বাস্তবে টেনে আনতে একটু বেশিই দূরাভিলাষী মনে হলো নিজেকে।

ফরিদা তনুকে ডাকতে বারান্দায় এসেছিলেন। অদূরে বকুল গাছের নিচে চোখ পড়তেই থেমে গেলেন আচম্বিতে৷ কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন সামনের দৃশ্যের ভাবার্থ বুঝতে। এদিককার কাহিনি স্পষ্ট হতেই মৃদু হেসে ঘরে চলে গেলেন দ্রুত পায়ে। তার অনেকক্ষণ পর কাক ভেজা দুটো মানুষকে দরজার সামনে দেখতে পেয়ে সবগুলো চোখ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো। নুরুল সাহেব বললেন,
” আরে মাহমুদ তুমি দেখি একদম ভিজে গেছো ”
বিনয় ভ্রু কুঁচকে বলল,
” তনু ভিজলো কি করে? ”
তনু মনে মনে ভাইয়ের ওপর চরম বিরক্ত হলো। প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে বাঁচতে মাহমুদের হাত থেকে ভিজে যাওয়া কাপড়ের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটে গেল। মাহমুদ ভেতরের মানুষ গুলোকে জবাবদিহি করার ভঙ্গিতে আমতা আমতা করে বলল,
” জামা বদলে আসছি ”

মেয়ে জামাই এলেন বলে রান্নার পদ বাড়াতে হলো ফরিদাকে। আজকে শুধু মুরগীর মাংস আর ডাল করেছিলেন। এখন চিংড়ির মালাইকারি আর রসুন ভর্তা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তনু মায়ের সাথে কাজে হাত লাগালো। এই ফাঁকে চিংড়ির মালাইকারি রান্না শিখে নেয়া হলো। তনু ভেবেছিলো মা হয়তো কিছু জানতে চাইবেন। অন্তত সবকিছু ঠিক হয়েছে কিনা এটুকু জানার কৌতুহল নিবারন করা কষ্টের। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো মা বেশ স্বাভাবিক। ওকে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাননি। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে ওর সাথে কথা বলতে বলতে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তনু মনে মনে বাবার তারিফ না করে পারলো না। বাবা ওদের জন্য একজন যোগ্য মা-ই এনেছেন। যে শুধু যে মায়ের দায়িত্বটাই ঠিকঠাক পালন করতে জানে তা না৷ বরং সম্পূর্ণ সংসারটাকে নির্ভেজাল আয়ত্তে গুছিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন পরিপক্ব হাতে।

জুম’আর সালাতের পর পুরুষদেরকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ফরিদা আজ খাবার বেড়ে দেয়ার দায়িত্বটা তনুকে দিলেন। তনুর হাত কাঁপছে। আজ যে মানুষটা সবার সঙ্গে একসাথে বসেছে। সে চেষ্টা করছে তার উপস্থিতি ভুলে যেতে। বাঁধ সাধলো মন। এতো লজ্জা বুঝি তার একাই লাগছে? কর্তামশাইয়ের পাতে তরকারি দিতে গিয়ে হাতের কম্পনে টেবিলে পড়ে গেল খানিকটা। নুরুল সাহেব কোমল গলায় বললেন,
” আস্তে কর মা। এতো তাড়া নিস না ”
তনু সবার পাতে খাবার দিয়ে বিনয়ের প্লেটে মাংস দিতে এলো। দেখতে পেল বিনয় মিটিমিটি হাসছে। তনু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” কোন পিস দেব ভাইয়া ”
বিনয় মুখ গম্ভীর করে সিরিয়াস টাইপ ভাব নিল। আস্তে করে বলল,
” তোর জামাইয়ের পছন্দের পিস ছাড়া যেকোনো পিস দিতে পারিস ”
তনুর রাগ চড়ে গেল সপ্তমে। ওর সাথে বিনয়ের সর্বদা শত্রুভাবাপন্ন আচরণের হদিস পেল না। তনু বেছে বেছে মুরগীর পাখনা আর গলার অংশ প্লেটে দিতে দিতে মনে মনে বলল,
” এবার ঠিক আছে? ”
বিনয় বাবাকে প্লেট দেখিয়ে বলল,
” দেখো বাবা তোমার মেয়ে কত কিপ্টা! ”
তনু প্রতিবাদ করলো।
” আমার কি দোষ বাবা? তোমার ছেলেই তো বলল…”
” কি বলেছি আমি? ” বিনয় হাত উল্টে প্রশ্ন করলো। তনু উত্তর করতে পারলো না। মনে মনে বলল, বদের হাড্ডি একটা!

নুরুল সাহেব জামাইয়ের দিকে ফিরে প্রসন্নচিত্তে জানতে চাইলেন,
” চিংড়ির মালাইকারিটা কেমন হয়েছে বলো? ”
তনয় ফিক করে হেসে ফেলল। খাবারের লোকমাটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বলল,
” এমনভাবে বলছো বাবা যেন তুমি নিজেই রান্না করেছো ”
” নিজে করিনি ঠিক আছে। কিন্তু তোর মা তো আমাকে করে খাওয়ায় না। বড় চিংড়ি খেলেই নাকি কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে চিৎপটাং হয়ে যাব। যাক জামাইয়ের উছিলায় খাওয়া হলো ”
মাহমুদ সলজ্জ ভঙি বজায় রেখে বলল,
” মা তো আপনার ভালোর জন্য বলেছে বাবা ”
” দেখেছো বাবা এসব কথা বলে সমালোচনা করে লাভ নাই। দল ভারী করতে পারবে না। দুলাভাই আগেই শ্বাশুড়ির পক্ষে চলে গেছে ”
বিনয়ের জবাবে লজ্জা পেয়ে সামান্য হাসলো মাহমুদ। সে ভেবেছিলো খাবার টেবিলে নিশ্চয়ই তাকে জেরা করা হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তনু কাউকে কিছু জানায়নি। মেয়েটার সংযম দেখে আরেকবার মুগ্ধ হলো। মনে মনে পণ করলো, তনুকে কখনো কষ্ট দেবে না। চাইলে সে পারতো মাহমুদকে কঠিন দন্ডে দন্ডিত করতে। অথচ অনায়াসে সবকিছু সামলে নিয়েছে। নিজের কষ্টটুকু যে এমন করে আড়াল করতে জানে তাকে ভালো না বেসে থাকা যায়? হাজার ত্রুটিবিদ্ধ হলেও স্বচ্ছন্দ্যে তাকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। উষ্ণতার অধিকতর প্রাবল্যে অবচেতন মনে চোখ তুলে চাইলো তনুর দিকে। তনুও একটু আড়ালে থেকে দেখছিল ওকে। চোখে চোখ পড়তেই ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো চোখ নামিয়ে নিল। মুখের হাসি আড়াল করতে না পেরে দেয়ালের দিকে মুখ করে রইলো। এই সুন্দর মুহূর্তটা কি আবার কখনো পুনরুত্থিত হবে? এই সময়টা মানুষের জীবনে বারবার আসে না। অনুভূতি রঙ বদলায়। ভালোবাসাটা একই থাকে শুধু অনুভব করার ব্যপ্তিটা একেকরকম হয়। এটুকু বোঝবার ক্ষমতা তনুর আছে। তাই তো খুশির মাঝে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনাতে চলে এলো।

***

সাঁইসাঁই করে মফস্বলের রাস্তা ধরে বাইসাইকেল ছুটছে। সাইকেলে বসা কপোত-কপোতীকে দেখে যে কেউ এক ঝলক তাকাতে বাধ্য হয়। মফস্বলের রাস্তায় এমনতর চিত্র বিরল। আর বিরল বলেই মানুষের চোখে খেলা করছে খানিকটা কৌতুহল, খানিকটা বিদ্রুপ। যদিও বৃষ্টির দিন বলে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। তবে যারা আছে তাদের এমন দৃশ্যের ওপর থেকে দৃষ্টি অগ্রাহ্য করবার ক্ষমতা নেই তা সহজেই অনুমেয়। ছোট শ্যালকের কাছ থেকে সাইকেলটা ধার নিয়েছে মাহমুদ। বৃষ্টি পড়া থেমেছে, তবে আকাশের মুখ ভার। আলো আঁধারির মিশেলে গম্ভীর পরিবেশে বাতাসের প্রাণোচ্ছল উচ্ছাস। পেছনে বসা তনুর হিজাব বাতাসে পটপট করে উড়ছে। ওর কাছে মনে হচ্ছে ডানা মেলে উড়ে চলেছে একটা নূতনতর সুখাবৃত রাজ্যে। বিনু থাকলে নিশ্চয়ই মুখে কৃত্রিম ঈর্ষা বজায় রেখে বলতো, আপা তোর বরটা কি রোমান্টিক রে! আর আমারটা দেখ একদম ঠান্ডা পানি! ভাবতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল সে। পেছন থেকে ভেসে আসা হাসির শব্দ শুনে মাহমুদ সাইকেলের গতি না কমিয়ে সুধালো,
” কি হলো হাসছো যে একা একা? ”
হাসি থামালো তনু।
” না তেমন কিছু না ”

মফস্বলের ছোট্ট একটা পার্কে এসে সাইকেল থামলো। পার্কের সম্মুখের নিম্নাংশে প্রবাহিত হচ্ছে নদী। সেখানে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা। তার একটু পেছনে পাশাপাশি সমান্তরালে কয়েকটা সিমেন্টের বেঞ্চ। তনু সাইকেল থেকে নেমে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা দেয়ালের মতো অংশটায় এসে দাঁড়ালো। যেখান থেকে স্পষ্ট নদী দেখা যায়। অজস্র কচুরিপানার দল বর্ষার উতলা জলভরা নদীতে ভেসে যাচ্ছে জোয়ারের গতিবিধি লক্ষ্য করে। কিছু কচুরিপানার স্তুপে পানকড়ি আর বকপাখি দাঁড়িয়ে আছে। কচুরিপানা যেন তাদের নৌবাহন। একটা পানকৌড়ি ডুব দিয়ে মুখে করে মাছ নিয়ে উড়ে চলে গেল ওপারের দিকে৷

” এই নেও ”
তনু পেছন ফিরে দেখলো মাহমুদের বাড়িয়ে দেয়া হাতে কৃষ্ণচূড়া ফুল। ফুল হাতে নিল সে।
” কোথায় পেলেন? ”
উত্তরে মাহমুদ পার্কের কোণার দিকে চাইলো। তনুও দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ে দেখলো এক কোনায় বিশাল একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। ফুল পড়ে নিচে বিছিয়ে আছে।
” কি সুন্দর! ”
” তোমার প্রিয়? ”
” আমার প্রিয় কদম ”
মাহমুদ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
” এখানে কদম গাছ নেই? ”
” নেই মনে হয় ”
তনু একটা ফুল মাহমুদের কানে গুঁজে দিয়ে সশব্দে হেসে ফেলল। মাহমুদ মুখ গোমড়া করলো।
” ছিঃ খুব বাজে দেখাচ্ছে না? ”
” আমার কান তো হিজাবে ঢাকা। তাই আপনার কানে দিয়ে দেখলাম কেমন লাগে ”
” কেমন লাগে? ” মাহমুদে বুকে দুই হাত বেঁধে উৎসুক ভঙিতে প্রশ্ন করলো।
” তনুর কর্তামশাইর মতো! ”
মাহমুদ মাথা আরেকটু সামনে হেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এ্যা? কি মশাই? ”
” কর্তামশাই! ”

আজ তনু উচ্ছ্বাসে হাসছে। হাসির দমকে ওর চোখগুলো কুঁচকে গেল। মাহমুদ চেয়ে আছে বিমুগ্ধ হয়ে মূঢ়ের ন্যায়।

” তোমার রিমঝিম হাসিটা বয়াম বন্দি করতে পারলে ভালো হতো। যখন বুড়ি হয়ে যেতে, দাঁত পড়ে গিয়ে এমন করে হাসতে পারতে না। তখন বয়ামের ছিপি খুলে কান পেতে শুনতাম ”
” হাসলে রিমঝিম শব্দ হয়? ”
” ওটা উপমা ”
তনু হেঁটে গিয়ে বেঞ্চে বসলো। নীমিলিত চোখে, মাথা উঁচিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে রইলো।
” আমার বাসায় টেপ রেকর্ডার আছে। আপনি চাইলে হাসি রেকর্ড করে রাখতে পারবেন ”
মাহমুদ হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে বলল,
” আচ্ছা তনু। পূর্বের ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা শুনবে না? ”
তনু চোখ মেলল। মাহমুদের দিকে না তাকিয়ে নদীর দিকে চাইলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
” আপনি বললে শুনব ”
” আর না বললে শুনবে না? ”
” শোনাটা জরুরি না ”

মাহমুদ ওর পাশে এসে বসলো। তার দৃষ্টিও এখন নদীর দিকে। আকাশের মন খারাপি ভাব আরও বেড়েছে বোধ হয়। তমসাচ্ছন্ন করে ফেলেছে চারদিক। দুঃখগুলো অন্তরীক্ষের বুকে ছড়িয়ে দেবার আগাম প্রস্তুতি। মাহমুদ এই অসাধারণ মানবীর সাহচর্যে এসে কেবল একের পর এক মুগ্ধ হচ্ছে। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ে হলে প্রথমেই হয়তো সবকিছুর ব্যাখ্যা চেয়ে বসতো। অথচ তনুকে সুযোগ দেবার পরও নির্বিকার। তার একগুঁয়ে মা যে কোন মেয়েকে ছেলের বৌ করে এনেছে তা যদি জানতো তবে হয়তো ওকে গৌরিপুরের ওই অখ্যাত গ্রামে না পাঠিয়ে নিজের কাছে রেখে দিত। কথাটা ভেবে হিংসে হলো মায়ের প্রতি। ভাগ্যিস তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও মা তনুকে সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন৷ মাহমুদ ফিরলো তনুর দিকে। টের পেল হৃদ প্রকোষ্ঠে আবারও কম্পমান অনুভূতি। অনুভূতি প্রকাশে স্বচ্ছ একটা শব্দ বলে দিলেই তো হয়। তার জন্য এতো দ্বিধান্বিত হবার খুব বেশি প্রয়োজন আছে কি?

” এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়।

এমন দিনে মন খোলা যায়–

এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে

তপনহীন ঘন তমসায়॥ ”

তনু চোখ সরু করে বলল, ” এই আপনি নাকি কবিতা জানেন না! ”
” জানি না তো বলিনি। বলেছি সবসময় আসে না৷ আর এটা তো রবীন্দ্রনাথের কবিতা ”
” ওহ ”

বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগলো। আকাশ কি মানুষের মতো দুঃখেও কাঁদে, সুখেও কাঁদে? তবে এই কান্নাটা কিসের? তনুর এখন আনন্দ হচ্ছে খুব। আকাশেরও কি তাই? মাহমুদ তনুর হাত চেপে ধরে বলল,
” চলো বৃষ্টিতে ভিজি ”
তনু আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সাইকেলের দিকে ছুটলো। তারপর হাত নাড়িয়ে মাহমুদকে ডেকে চেঁচিয়ে বলল,
” সাইকেলে চড়ে! ”
মাহমুদ এসে উঠে বসলো সাইকেলে। তনু পেছনে বসতেই প্যাডেলে চাপ পড়লো। বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়। আকাশে জমে থাকা কৃষ্ণ মেঘ আর সন্ধ্যার আঁধার মিলে এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। স্বল্প আলো আর অধিক তমসা ভেদ করে রাস্তা ধরে গন্তব্যে ছুটে চলেছে সাইকেল।

” তনু একটা কথা বলা হয়নি তখন ”
” বলুন না! ”
বৃষ্টির জন্য শোনা যাবে না ভেবে বা অন্য কারণেই হোক মাহমুদ চেঁচিয়ে বলল,
” আমি তোমাকেই ভালোবাসি ! ”
বৃষ্টির ঝনঝন শব্দের মাঝে একটা অতীব সুন্দর, ছোট্ট, মন ভালো করা বাক্য এসে ধাক্কা দিল তনুর কর্ণকুহরে। শিরশিরে অনুভূতির পলকা হাওয়ায় ছুঁয়ে দিল সমস্ত মন। তনুর মুখের ভাষা বিলুপ্তির পথ ধরেছে। বাকহীন তনু মাহমুদের ভেজা শার্টে খামচে ধরা হাতকে ছাড়িয়ে দু’হাতে শক্ত করে সম্মুখের ব্যক্তিটির শরীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিল। মনে মনে বলল,
” ভালোবাসি কর্তামশাই ”

~ সমাপ্ত ~