এরই মাঝে পর্ব-০২

0
134

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২

“মা, তোমরা কোথাও যাচ্ছ নাকি?”
রিদওয়ান রাতের খাবার খেতে বসে জানতে চাইলো। জাকিয়া বিরক্ত হয়ে ছেলের দিকে তাকালো-“তোমরা মানে? তুইও তো যাচ্ছিস আমাদের সাথে।”
রিদওয়ান খাওয়া থামিয়ে দিলো। তার চোখে বিস্ময়-“আমি! আমার যাওয়ার কথা নাকি? তোমরা যাচ্ছ সেটাই তো জানি না।”
ওবায়েদুল হক মুখের সামনে থেকে পত্রিকা সরিয়ে রিদওয়ানকে দেখলো-“জানবে না কেন? সকালে তো তোমাকে বলা হয়েছিল রিদওয়ান। আমরা সবাই মিলে কাল নওগা যাবো।”
রিদওয়ানের ভ্রু কুঞ্চিত হতে দেখা গেলো-“বলেছিলে নাকি? ক্লাসের চাপে ভুলে গেছি হয়তো। আমি এখন যেতে পারবোনা বাবা। এক্সাম সিডিউল হয়েছে। অনেক আইটেম জমা হয়ে আছে, পাশ না করলে বিপদে পড়বো।”
ওয়াহেদুল হক পত্রিকা ভাজ করে সরিয়ে রাখলো। চায়ের কাপ দূরে ঠেলে দিয়ে বললো-“ভোরে রওনা হবো আমরা এখন এসব বলে কি লাভ বাবা। তোমাকে যে যেতেই হবে। আমরা সবাই যাচ্ছি, বেশি না মাত্র দুইদিনের জন্য। দুইদিনে নিশ্চয়ই তোমার মহা ক্ষতি হয়ে যাবে না?”
রিদওয়ানের খাওয়া শেষ, সে হাত গুটিয়ে নিয়ে বাবাকে দেখলো-“আমার যাওয়াটা জরুরি কেন বাবা? তোমরা সবাই যাচ্ছ যাও না। আমি হলে চলে যাবো।”
ওয়াহেদুল হক বিনা আওয়াজে হাসলো-“তোমার দাদাজানের শরীর ভালো না বাবা। উনি আমাদের সবাইকে একসাথে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। না হলে এমন ঘটা করে যাওয়ার কোন কারণ ছিলো না।”
রিদওয়ান উঠে দাঁড়ালো। ওয়াহেদুল হক ডাকলো তাকে-“একটু কষ্ট হলেও ম্যানেজ করে নাও বাবা। দুটো দিনের ব্যাপার। কাল যাব পরশু ফিরবো। ভোরবেলা বেরুবো আমরা।”
রিদওয়ান জবাব না দিয়ে হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। জাকিয়া স্বামীর কাছে এগিয়ে এলো-“কি বুঝলে? যাবে?”
ওয়াহেদুল হক ভ্রু কুঁচকে তাকালো-“যাবে। তোমার সব গোছগাছ শেষ? বউমাদের? সকালে যেন কোন ঝামেলা না হয়।”
জাকিয়া মাথা নাড়ে-“সব নিয়েছি। তবুও আরেকবার চেক করে নিচ্ছি।”
“ঠিক আছে। সবাইকে বলে দাও পাঁচটার সময় যেন নিচে থাকে। সকালে রওনা দিলে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাব আশা করা যায়। আমি শুতে গেলাম।”
ওয়াহেদুল হক উঠে পড়লো। যদিও টেনশনে ঘুম হবে না তবুও চেষ্টা করতে দোষ নেই কোন।

*****

“আসসালামু আলাইকুম দাদু।”
রিদওয়ান পায়ে হাত দিতেই বয়স্ক হাতটি ওর হাত ধরে ফেললো-“তুমি আসছো দাদু? আমি জানতাম তুমি আসবা। আমার কথা শুনলে কিছুতেই না এসে থাকতে পারবা না।”
রিদওয়ান প্রসন্নচিত্তে হাসলো-“তুমি ডাকলে না এসে পারা যায়? কিন্তু শুনলাম তুমি অসুস্থ। এসে দেখছি ভালোই আছো।”
আব্দুর রব চোখের চশমাটা ভালোমতো এটে নিয়ে রিদওয়ানকে দেখলো। ওর হাত ধরে ছিলো, টেনে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো-“উপর থেকে কি সব বোঝা যায় দাদু? তাহলে তো আর ডাক্তারের প্রয়োজন হতো না পৃথিবীতে।”
রিদওয়ান পঁচাত্তর বছরের সৌম্য দর্শন বুড়ো মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকে৷ চুল সাদা, দাঁড়ি সাদা মানুষটাকে দেখে সুফি দরবেশ মনেহয়। সে একটু চিন্তিত হয়ে বললো-“তোমার শরীর সত্যি খারাপ বলছো?”
আব্দুর রব মাথা নাড়লেন-“শরীরের কথা তো বলতে পারবোনা দাদু তবে মনটা বেশ খারাপ থাকে। বুড়ো হয়ে গেলে কি হয় জানো তো? শরীরের কলকব্জাগুলো ব্রেনের কথা শোনে না। নিজেদের ইচ্ছে মতো নড়াচড়া করতে থাকে। তাদের স্বেচ্ছাচারী আচরণ ভীষনভাবে মনে প্রভাব ফেলে।”
রিদওয়ানের দৃষ্টি গভীর হলো। তার দাদু হুটহাট জীবনধর্মী কথা বলে ফেলে। শুনতে বেশ ভালো লাগে রিদওয়ানের। যদিও স্বভিমানি মানুষটার মনোজগতে প্রবেশ করা কষ্টকর। রিদওয়ানের কেন যেন মনেহয়, দাদু কেবল তার সামনেই কিছুটা খোলামেলা থাকে। মনের আগল খুলে কথা বলে। বাকী সকলের কাছে ভীষণ গম্ভীর।
“তাহলে তো বলতে হয় তোমার শরীর বেশ খারাপ। এবার তাহলে তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো দাদু। কোন কথা শুনছি না।”
আব্দুল রব রিদওয়ানের হাত ছেড়ে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলো-“তোমার দাদীকে ছেড়ে কোথাও যাবো না দাদু। আমি না থাকলে বুড়ির মন খারাপ থাকে। সারাক্ষণ স্বপ্নে আসতে থাকে। কোথাও গেলে শান্তি দেয়না বুড়ি।”
রিদওয়ান হেসে দিলো-“খুব ভালোবাসো দাদীকে, তাই না?”
আব্দুর রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে-“আমি আর কি ভালোবাসি দাদু। সে আমাকে আরও বেশি ভালোবাসে। দেখো না চোখের আড়ালে যেতে দেয় না?”
“হুমমম, খুব বুঝতে পারছি কে কাকে চোখের আড়াল করতে চায় না।”
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে উঠোন ছেড়ে খানিকটা দূরের কবরস্থানের দিকে তাকালো। বছর দুয়েক হলো মানুষটা ওই সাড়ে তিন হাত ঘরের বাসিন্দা হয়েছে।

*****

“শুনছো?”
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে চুল চিরনি চালাতে চালাতে ডাকলো পল্লবী। কল্লেল মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়ে জবাব দিলো-“বলো কি বলবে।”
“রিদওয়ান ভাইকে জানানো উচিত ছিলো না? সে তো ছোট ছেলে না যে জোর করে ধরে বেঁধে বিয়ে দেবে।”
কল্লেল এবার মোবাইল থেকে মাথা তুলে পল্লবীকে দেখলো-“সে চিন্তা তোমার কেন? বাবা মা আছে, দাদু আছে ওরা বলবে।”
পল্লবী সাথে সাথে মুখ কালো করে ফেললো-“আপাকেও কেউ জানালে না। জানলে কি করবে আল্লাহ জানে।”
কল্লেল হাত থেকে ফোন নামিয়ে রেখে পরিপূর্ন চোখে পল্লবীর দিকে তাকালো-“সবার চিন্তা কে করতে বলেছে তোমাকে? অন্যের জন্য এতো না ভেবে একটু সময় নিজের জন্য দিলেও পারো। কাছে থাকলেই শুধু এর ওর কথা শুনি।”
পল্লবীর হাত থেমে যায়। আয়নায় কল্লেলের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো ওর সাথে। ভেতরে ভেতরে কুকরে গেলো পল্লবী। কল্লেল তার তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে পল্লবীকে দেখতে দেখতে জানতে চাইলো-“রোদেলা কোথায়?”
“মায়ের কাছে আছে।”
পল্লব ফিসফিস করলো-“দরজাটা আঁটকে শিগগিরই আমার কাছে এসো।”
পল্লবীর হাত কেঁপে উঠলো। কল্লোল কিসের ইঙ্গিত দিলো বুঝতে সমস্যা হয় না। কিন্তু দুইদিনের জন্য বেড়াতে এসে ঘরভর্তি লোকের মাঝে এসব করা কি জরুরি? ভেবেই নিজের মধ্যে কুঁকড়ে গেলো পল্লবী। কল্লেল ফিসফিস করলো-“কি হলো কি? এভাবে মুর্তি সেজে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কথা কানে যাচ্ছে না? তাড়াতাড়ি এসো। বিকেল হয়ে যাচ্ছে একটু পরেই দাদুর ডাক আসবে।”
পালিয়ে যেতে মন চাইলো পল্লবীর। সারাটা পথ একসাথে এসেছে একটাবারও নিজের দিকে তাকাতে দেখেনি কল্লেলকে। না দু’টো ভালো কথা বলেছে। পুরোটা পথ মোবাইলে চোখ দিয়ে ছিলো। এখন কিনা ভালোমন্দ কথা না বলে মানুষটা তাকে কাছে ডাকছে।

“মালিহা, তুই কি চুল আয়রন মেশিন এনেছিস?”
মাহিলা সুটকেস থেকে কাপড় বের করছিল। পল্লবীর গলা শুনে তাকালো-“এনেছি ভাবি। লাগবে তোমার?”
পল্লবী মাথা দুলায়। সে শাড়ীর আঁচল তুলে দিয়েছে মাথায় ভেজা চুল যাতে দৃশ্যমান না হয়। তবুও মালিহা বুঝে গেলো পুরো ব্যাপার। সে মুচকি হেসে আয়রন মেশিন বের করে পল্লবীর হাতে দিলো-“ভাইয়া তোমাকে কতো ভালোবাসে ভাবি। তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন?”
পল্লবী কথা ঘুরিয়ে উত্তর দিলো-“তুই রেডি? মা বলেছে আধাঘন্টার মধ্যে নিচে নামতে। দাদু কথা বলবে। তারপর ও বাড়ি যেতে হবে।”
পল্লবী এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চায় না বুঝে মালিহাও এড়িয়ে গেলো-“দশ মিনিট লাগবে ভাবি।”
পল্লবী দ্রুত হেঁটে চলে এলো। তার মুখ রক্তজবার ন্যায় লাল হয়ে গেছে। কল্লেল পাজামা পান্জাবি পরে তৈরি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পারফিউম লাগাচ্ছিল। পল্লবীকে দেখে বললো-“মা নিচে নামতে বলেছে। আমি যাচ্ছি তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
পল্লবী জবাব দিলো না। তার কেন যেন হুট করে কান্না পেয়ে গেলো।

*****

“আমরা এখন যাবো আমার বাল্যবন্ধু তৈয়ব মাওলানার বাসায়। তৈয়বকে তো চেন তোমরা সবাই। ছোট বেলার থেকেই ওর সাথে আমার গলায় গলায় ভাব। অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমি আর তৈয়ব মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“কি সিদ্ধান্ত দাদু?”
রিদওয়ানের কৌতুহলী প্রশ্ন শুনে ঘরে উপস্থিত সবাই একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। আব্দুর রব হাসলো-“তৈয়বের নাতনীর সাথে আমি তোমার বিয়ে ঠিক করেছি দাদুভাই। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আত্মীয়তার সম্পর্কে বদল করতে চাই।”
হুট করে এমন কথা শুনে রিদওয়ান হতবাক-“কি কি কি বললে তুমি দাদু!”
আব্দুল রব গম্ভীর চোখে চেয়ে থাকলো নাতির দিকে-“যা শুনেছ তাই বলেছি দাদুভাই। তোমার বিয়ে ঠিক করেছি আমি। দাদু হিসেবে এইটুকু অধিকার তো রাখি নাকি?”
“আর ইউ ম্যাড? এটা কি ধরনের ফাজলামো দাদু? মা বাবা তোমরা কিছু বলছো না কেন?”
রিদওয়ান একে একে সবাইকে দেখলো। প্রায় সকলে নজর লুকাচ্ছে ওর কাছ থেকে। রিদওয়ান হাততালি দিলো-“বাহ বাহ, কি চমৎকার! যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়াপড়শির ঘুম নাই অবস্থা। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে অথচ আমি বাদে সবাই জানে। কি দারুন ব্যাপার। দাদু, আমি কি ছোট বাচ্চা ছেলে যে ধরে বেঁধে বিয়ে দেবে আমার? বিয়ের বয়স হয়েছে আমার? এখনো পড়ালেখাই তো শেষ হয়নি আর বিয়ে। কেন এই বয়সে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করবো আমি? এগুলো কি ধরনের বাচ্চামো দাদু?”
“রিদওয়ান, ঠান্ডা হয়ে বসো তুমি। এতো রাগারাগি করার মতো কিছু বলিনি আমি।”
আব্দুর রব শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেও রিদওয়ান বসলো না। দাঁড়িয়ে থেকে চেচিয়ে উঠলো-“কি বলছো এসব দাদু? যে রকম পরিস্থিতি ক্রিয়েট করেছো এগুলো নাইন্টিজে হতো। জোর করে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়ার চল। এখন যুগ বদলে গেছে, এরকম জোর করে ধরে বিয়ে দেওয়ার যুগ না এটা দাদু। সরি আমি এরকম হুটহাট বিয়ে টিয়ে করতে পারবোনা।”
নাতির মুখে সরাসরি নিষেধ শুনে মনটা ভরাক্রান্ত হয়ে গেলো আব্দুল রবের। সে মন খারাপ করে বললো-“সময় কখনো বদলায় না রিদওয়ান বদলে যায় মানুষ। মানুষের বদলটাকে সময়ের বদল বলে চালিয়ে দেয় মানুষ। আর পুরনো নিয়ম, পুরনো ফ্যাশন বলে গলা উঁচু করলেই কি সব পুরনো হয়ে যাবে? একটা কথা শোননি? ওই যে বলে, ওল্ড ইজ গোল্ড।”
রিদওয়ান মাথা নাড়লো-“সরি দাদু, তোমার এই সিদ্ধান্ত আমি মানতে পারছি না। এরকম কিছু হবে জানলে আমি কিছুতেই এখানে আসতাম না।”
আব্দুল রব ভীষণ কষ্ট পেয়ে গেলেন রিদওয়ানের উত্তরে। কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলো। ম্লান কন্ঠে বললো-“আমি তো ভেবেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার কথা ফেলতে পারবেনা তুমি। সেই বিশ্বাস থেকে বিয়ে পাকা করে ফেলেছি।”
“ভুল করেছ দাদু। আমার কিছু করার নেই সরি।”
রিদওয়ানের কথায় খানিকটা সময় মুক হয়ে রইলো আব্দুল রব। কি বলবেন কি করবেন বুঝে পাচ্ছেন না। হঠাৎ কি ভেবে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-“কিছু কথা বলি তোমাকে দাদুভাই একটু মন দিয়ে শোন। এই গ্রামে আমার জন্ম, তোমার বাবা চাচাদের জন্ম। এই যে এতো বড় বাড়ি, ধন সম্পদ সব আছে অথচ থাকার মানুষ কেবল আমি আর চাকর বাকর। তোমার চাচা ফুপুরা তো দেশেই থাকে না। আর তোমরা দেশে থাকলেও গ্রামমুখী না। যে স্হানে জন্ম সেই স্থানের সাথে কারো কোন যোগাযোগ নেই। এখন হয়তো আমি বেঁচে আছি এইজন্য বছরে একবার আসো তোমরা। আমি মরে গেলে তাও আসবেনা। কবরে শুয়ে এ বাড়িতে তোমাদের একটু পদধূলির জন্য হাপিত্যেশ করবো পরিস্কার বুঝতে পারছি। যেমনটা তোমার দাদী বেঁচে থাকতে করেছে প্রতিটা দিন। বুড়ী তার সন্তানদের পথ চেয়ে থাকতো। অন্য কেউ তো দেশে থাকে না তাই দূর থেকে কাউকে আসতে দেখলেই ভাবতো ওয়াহেদ এসেছে মনেহয়। সন্তানদের কাছে পাওয়ার হাহাকার নিয়েই বুড়ি চোখ বুজলো।”
পুরো রুম জুড়ে নিরবতা। ওয়াহেদুল হক মাথা নিচু করে আছে। অবাক হয়ে ভাবছে মায়ের কথা এর আগে কোনদিন বলেনি বাবা। অবশ্য শোনার মতো সময় তার ছিলো কোথায়? তবে কি মনে অভিমান পুষে চুপ করে থেকেছে বাবা? ওয়াহেদ মুখ তুলে আব্দুর রবকে দেখলো। বাবার দুঃখটা কি খানিকটা বুঝতে পারছে সে? আব্দুল রব ছেলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে-“তোমার দাদী বলতো, ও ওয়াহেদের বাপ কেউ তো ফিরে না গ্রামে। এই দিন দেখার জন্য কি এতো কষ্ট করলাম জীবনে? আমরা মরার সাথে সাথে আমাদের পরিচয় বিলীন হবে গ্রাম থেকে। ছেলেমেয়েরা আসে না কে মনে রাখবে আমাদের? এতো যত্নে গড়া সংসার এই বাসাবাড়ি সব বারো ভুতের আড্ডা হবে। এককাজ করেন, আপনে তৈয়ব ভাইয়ের নাতনির সাথে আমাদের রিদুর বিয়ে দেন। রিদুটার মন নরম ভালোবাসে আপনাকে। আপনের কথা ফেলবে না। আর বউয়ের জন্য হলেও তো শশুর বাড়িতে আসবে ও। শশুর বাড়ি আসলে তো দাদার বাড়িতেও আসবে, তাই না। দাদা দাদীর জন্য দোয়াও করবে।

তোমাদের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে আমার কথাগুলে। ভাবছো এসব ফালতু চিন্তা। মরার পরে কি হবে সেসব ভাবা ফালতু কাজ বইকি কিন্তু আমার বয়সে আসলে হয়তো এই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সক্ষম হবে তোমরা। রিদওয়ান দাদুভাই, আমরা আগের যুগের মানুষ। মুখের কথার অনেক দাম আমাদের কাছে। কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারলে আমরা জীবিত থেকেও মৃত হয়ে যাব। তার উপর তৈয়ব আমার বন্ধু। আমাদের অনেক ইচ্ছা ছিলো আত্মীয়তা করার। নানা কারনে সেই ইচ্ছে পূর্ন হয়নি। এখন তুমিই পারো তোমার দাদী আর আমার মনের এই শেষ ইচ্ছাটা পূরন করতে। তৈয়বকে আমি কথা দিয়েছি ওর নাতনি আমার বাড়ির বউ হবে। উহু, ভয় পেয় না। এখনই সংসার করতে হবে না তোমাকে। কেউ বলবে না বউয়ের দায়িত্ব নাও। মেয়েটা ঢাকায় ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। তৈয়ব ওকে একা পাঠাবে না বলেই এরকম ব্যবস্থা। ওর একটা আশ্রয় হলো তোমার একটা বউ। তোমার দু’জনই নিজের মতো থাকবে। মন চাইলে একে অপরকে সময় দেবে। কোন জোরাজোরি নেই ভাই। তবুও বিয়ের জন্য মানা করো না। বিয়ে তো করবেই একদিন। দাদুর জন্য না হয় একটু আগেই করলে।
আমি কখনো তোমাদের কাছে কোন দাবি করিনি। আজ জীবনে প্রথম ও শেষ বারের মতো কিছু চাইছি মানা করে এই বুড়োটার মনে কষ্ট দিয় না।”
রিদওয়ান কড়া কথা বলতে যেয়েও থেমে গেলো। আব্দুল রবের মুখটা বড্ড ফ্যাকাশে দেখালো। দুপুরে দাদুর বলা কথাগুলো মনে পড়লো তার। শরীর খারাপ নিয়ে কথা হচ্ছিল। মানুষটা শরীর মনেহয় সত্যিই খারাপ করছে। ভাবতে ভাবতে আব্দুল রব চেয়ার থেকে কাত হয়ে পড়তে যায়। রিদওয়ান চেচিয়ে উঠলো-“দাদু!”

চলবে—
©Farhana_Yesmin