এরই মাঝে পর্ব-১

0
154

#এরই_মাঝে
#পর্ব-১

“দাদাজান তোমার বিয়ে ঠিক করেছে আপু। আজ রাতে পাত্রপক্ষ বাড়িতে আসবে কথা পাকা করতে।”
বিনার কথা শুনে বই থেকে চোখ তুললো শায়লা। তার হাতে থাকা হুমায়ুন আহমেদের মৃন্ময়ী উপন্যাসটি ভাজ করে রাখলো। চোখের চশমাটা আরেকটু ঠেলে দিলো নাকের ডগায়। তারপর আত্মবিশ্বাসের সাথে ধমক দিলো ছোট বোনকে-“এসব কি ধরনের ফাজলামো বিনা? আমার বিয়ে অথচ আমি জানি না? দাদাজান নিশ্চয়ই তোর কানে কানে এসে বলে গেছে এই কথা?”
বিরক্তিতে বিনার নাক কুঁচকে উঠলো-“উফফ আপা, তুমি একটা কি বলোতো? বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে বেতন পাই নাকি? শুধু শুধু মিথ্যাে বলবো কেন?”
শায়লা পুনরায় মুখের সামনে বই ধরলো-“তোকে আমার চেনা আছে বিনা। তুই হচ্ছিস গসিপ কুইন। তোর কাজই হলো নানা রকম কথা খেলিয়ে মজা নেওয়া। সরি, তোকে মজা দিতে পারছি না আমি।”
বিনা লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো-“ছেলেরা ঢাকা থেকে আসবে। বিরাট বড়লোক। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো নাতো? এলে বুঝবে মজা।”
এবার শায়লা বিরক্ত হলো-“বিরাট বড়লোক আবার কিরে? আমরা কম বড়লোক? এরকম ছোট লোকের মতো কথা বলিস কেন?”
“আমাদের কি আছে আপা? সব তো দাদার সম্পদ। আমাদের তো বাব…”
বিনা কথা শেষ করতে পারে না। শায়লা তাতস্বরে চেচিয়ে উঠলো-“কানের কাছে ভ্যাজরভ্যাজর বন্ধ কর বিনা। না হলে কানের উপর দেব ধরে একটা। ফাজিল মেয়ে কোথাকার।”
বিনার নয়নদ্বয় জলে টইটম্বুর। সে বোনের দিকে অসহায় চোখে চাইলো-“আমার কথা বিশ্বাস করলে নাতো। বিকেলে দাদাজান যখন ডাকবে তখন বুঝবে এই বিনা মিছে বলেনি।”
শায়লা পাত্তা দিলো না। সে আবার বই পড়তে মনোযোগ দিলো। মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। এই জানালাটা ভীষণ প্রিয় শায়লার কাছে। জানালার সামনে বিরাট বড় পুকুর। পুকুরের পাশ দিয়ে বড় রাস্তা। সারাদিন রিকশার টুংটাং, গাড়ির হর্ন শোনা যায়। সকাল বিকেল নিয়ম করে স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের দলবেঁধে আসা যাওয়া চলে। একসময় নিজেও তো এই পথ দিয়ে স্কুল কলেজে গেছে। নষ্টালজিক হয়ে শায়লা বই বন্ধ করে জানালায় এসে দাঁড়াল।

এখন কার্তিক মাস, তবুও গরম বাতাস ভেসে আসছে পুকুরের ওপাশ থেকে। মাথার উপর ফ্যান চলছে কিন্তু সে বাতাস গায়ে লাগছে না। ঘেমে একাকার শায়লা হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলো। নওগাঁতে গরম বেশি পড়েছে এবার। শায়লা জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছে প্রিয় জায়গা ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তার। এরপর এখানে আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধে। শায়লা তৃষ্ণার্তের মতো জানালা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। তার দৃষ্টি বাইরের রাস্তায়।

মেয়েকে ডাকতে এসে থমকে গেছে রুবিনা। মেয়েটা কেমন যেন মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রুবিনা অনেকটা সময় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে দেখলো। তার চেহারা জুড়ে মুগ্ধতা। শায়লার পিঠের উপর লম্বা বেনী ঝুলছে। একহারা গড়নের মেয়েটার গায়ের রং ফর্সার দিকে। চেহারা অনেকটা বাবার আদল পেয়েছে। মনটাও কঠিন আবরণে ঢেকে রাখা। রুবিনা জানে আবরণের ভেতরের মনটা নরম কাদামাটির মতো। মেয়েটার হৃদয়ে কঠিন ব্যামো আক্রান্ত যেটাকে রুবিনা ঘৃনার ব্যামো বলে। এই ব্যামো মেয়েটাকে কঠিন বানিয়ে দিয়েছে।
“মা, কি দেখছো ওভাবে?”
রুবিনা চমকে গেলো। বুঝে পেলো না মেয়ে বুঝলো কি করে তার উপস্থিতি? সে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়ালো-“শায়লা, বুঝলি কি করে আমি এসেছি?”
শায়লা হাসলো-“বোঝা যায় মা। যারা হৃদয়ের কাছের মানুষ তারা যত দূরেই থাকুক তাদের অস্তিত্ব টের পেতে সময় লাগে না।”
রুবিনা মুগ্ধ নয়নে মেয়েকে দেখলো। কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটা। এতটুকু মেয়ের মাথায় এতো বুদ্ধি কি করে হলো? সে তো এতো বুদ্ধিমতী না। সবাই তাকে বোকা রানী বলে। বোকা বলেই না দুয়োরাণী হয়েছে।
শায়লা রুবিনার পানে দৃষ্টি দিলো। মৃদু হাসি দিয়ে বলে-“মেয়েকে এভাবে দেখতে নেই মা। নজর লাগবে তো।”
রুবিনা হেসে দিলো-“আচ্ছা যা আর দেখবো না।”
“কেন এসেছ তাই বলো। মিছে আলাপ করতে আসেনি জানি। এই সময় তো তুমি মহা ব্যস্ত থাকো।”
শায়লা অভিযোগ করলো নাকি টিপ্পনী কাটলো বুঝলো না রুবিনা। এই সময় সে সত্যিই ব্যস্ত থাকে। দুপুরের খাওয়ার পাট চুকতে চুকতে বিকেল। সব গুছিয়ে গোসল করে নামাজে বসে সে। মেয়েকে দেখতে দেখতেই জবাব দিলো-“তোকে ডাকতে। আব্বা তোকে ডাকছে৷”
“দাদাজান!”
কিছুটা অবাক হলো শায়লা। বিনার কথাটা মনে পড়লো ঝট করে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“এইসময়? হঠাৎ?”
রুবিনা হুট করে ফিরে যেতে যেতে জবাব দিলো-“জানি না। তুই চলে যাবি। হয়তো কিছু বলবে। দেখ গিয়ে।”
রুবিনা আসলে জানে কিন্তু নিজে বলার সাহস পেলো না। শায়লা ভীষণ রকম অভিমানী মেয়ে। আত্মসম্মানবোধ প্রখর। ওকে হুট করে কিছু বলে ফেলা যায় না।

*****

“দাদাজান, আসবো?”
দরজায় ঠকঠক করে জানতে চাইলো শায়লা। মাওলানা তৈয়বুর রহমান আরাম কেদারায় শুয়ে ছিলো। দেওবন্দ থেকে পাশ করে আসায় গ্রামে লোকে তাকে ডাকে তৈয়ব মাওলানা। নাতনির কন্ঠ শুনে উঠে বসলো। চোখের চশমাটা খুলে মুছে নিয়ে আবার চোখে দিলো।
“শায়লা বুজান, এসো ভেতরে এসো।”
শায়লা ভেতরে এসে দাদার পাশে রাখা টুল টেনে বসলো-“আমাকে ডেকেছো দাদাজান?”
“হুমমম বুজান, তোমার ভার্সিটির ক্লাস যেন কবে থেকে?”
তৈয়ব মাওলানা নাতনির দিকে চেয়ে আছেন। শায়লা হাসলো। প্রায় প্রতিদিন দুই তিন বার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তাকে।
“আগামী সপ্তাহে দাদু। আমি শুক্রবার ঢাকায় চলে যাবো।”
জবাব শুনে গুম হয়ে গেলো তৈয়ব মাওলানা। শায়লা বুঝলো তার যাওয়ার কথা শুনে দাদুর মন খারাপ হয়েছে। সে চুপচাপ দাদাজানের হাত ধরলো-“আমি ছুটিতে নিয়মিত বাড়িতে আসবো দাদাজান। তুমি এ নিয়ে একদম ভেবোনা।”
তৈয়ব মাওলানা পরম মমতায় নাতনির হাত হাতের মুঠোয় নিলো-“তোমাদেরকে অনেক ভালোবাসে তোমাদের এই দাদাজান সেটা জানো তো?”
শায়লা অবাক হয়ে বললো-“হুমমম জানি। কিন্তু হুট করে এসব বলছো কেন দাদাজান?”
তৈয়ব মাওলানা চোখ বুজে শ্বাস ফেললো-“বুজান,
তোমাকে না জানিয়ে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি যদি রাগ না করো তবে বলতে পারি।”
শায়লার বুক ধক করে উঠলো। দাদাজান কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে? বিনার কথাটা সত্য নয়তো? কেন যেন ভয় করছে শায়লার। সে কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলো-“কি সিদ্ধান্ত দাদাজান? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কি বলবে বলোতো?”
তৈয়ব মাওলানা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-“তোমার মত না নিয়ে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি আমি।”
শায়লা তৈয়ব মাওলানার হাত ছেড়ে দিলো। আর্তনাদ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো-“কি বলছো দাদাজান? তুমি জানো না আমার কি ইচ্ছে? তবুও এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত আমায় না জানিয়ে কেন নিলে দাদাজান?”
তৈয়ব মাওলানার গলা কেঁপে উঠলো-“বুজান, তুমি আমাকে ভুল বুইঝো না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। তুমি মানা কইরো না।”
শায়লা ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো-“তোমাকে নিজের সবচেয়ে আপনজন ভেবেছিলাম দাদাজান। তুমি আমার স্বপ্নপূরনের কান্ডারী হয়েছিলে। সেই তুমি কিনা আমার স্বপ্নপূরনে বড় বাঁধা তৈরি করে দিতে চাইছো? এ কেমন বিচার তোমার দাদাজান?”
তৈয়ব মাওলানা ভীষণ কষ্ট পেলেন নাতনির কথায়। আহত স্বরে বললো-“আমাকে নিয়ে এমন বিচার তোমার মনে আসলো কি করে বুজান? আমাকে তুমি এই চিনলে?”
শায়লা অধৈর্য্য হয়ে বললো-“এতো কিছু আমি বুঝি না দাদাজান। তুমি এই বিয়ের কথা বন্ধ করো। আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করবোনা কিছুতেই।”
তৈয়ব মাওলানা নাতনির হাত ধরলো। কাছে টেনে বসিয়ে দিলো-“বুজান, আমাকে এতো অবিবেচক মনেহয় তোমার? একটুও কি বিশ্বাস নেই আমার উপর? এতোদিন দায়িত্ব পালন করেও কি তোমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি বুজান? আমি কি সবসময় ন্যায়ের পথে হাঁটি নাই?”
শায়লা মরিয়া হলো-“বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা না দাদাজান। তুমি জানো আমার ইচ্ছা। তুমি কিভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিলা?”
তৈয়ব মাওলানা গম্ভীর কন্ঠে বললো-“কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলাম জানতে চাও? তাহলে শোন, তোমাদের নিয়ে চিন্তা হয় আমার। তোমার দাদী বুড়ি আর আমি, আমাদের দু’জনেরই বয়স হইছে। যখন তখন মরে যাইতে পারি। আমি প্রায়ই এই চিন্তা করে ব্যাকুল থাকি, আমার অবর্তমানে তোমাদের অভিভাবক কে হবে? আমি না থাকলে এই সম্পদ, বাড়িঘর আর পাঁচটা অবলা মেয়েকে কে দেখবে বুজান? তুমি বলো? কার ভরসায় শান্তিতে চোখ বুজবো? আর অভিভাবক না থাকলে তোমাদের বিয়েই বা দেবে কে? কে তোমাদের আশ্রয় হবে? অভিবাবকহীন মেয়েদের বিয়ে বড় কষ্ট বুজান।”
শায়লা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো-“তোমার নাতজামাই দেখবে আমাদের? তোমার নিজের রক্তই যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে অচেনা কারো উপর কিভাবে ভরসা করতে পারো? এইগুলা হাস্যকর যুক্তি দাদাজান। এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে দেখে না। সবার নিজেকে নিজেরই দেখতে হয় এইটা কি তুমি জানো না?”
“নাতজামাই দেখবে এমন আশা করি না। আমি চাই নাতজামাই তোমার সাহস হবে। দেখবা তো তুমিই। পাশে একজন থাকলে সাহস হয় বুজান।”
“কি অদ্ভুত কথা বলছো দাদাজান? সারাজীবন আমাদের একা চলার সাহস দিয়ে আজ এই কথা? আমি মানি না দাদাজান। তোমার এই অন্যায় মানতে পারছি না। তুমিও শেষ পর্যন্ত পাখনা কাটার দলে চলে গেলা?”
শায়লার চোখে অদ্ভুত বিস্ময়। সে নজরের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলো না তৈয়ব মাওলানা। সে ভেজা ভেজা চোখ নিয়ে বললো-“এইভাবে বইলো না বুজান। তুমি আমার মনের অবস্থা বুঝতেছ না। অবলা মেয়ে মানুষ পেলে সকলে কিভাবে ঠকাইতে চায় এইটা তো তুমি নিজেই দেখছো। আমি তোমাদের অকুল পাথারে ফেলতে পারবো না বুজান। কিন্তু আমি তোমাদের পাখনা কাটতে চাই না। আমি চাই তোমরা যেন ভালোভাবে উড়তে পারো। সেই পথ তৈরী করে দিতে চাচ্ছি শুধু। আমাকে একটু বোঝো বুজান, মেনে নাও আমার কথা।”
শায়লা মাথা নাড়ে-“কিছুতেই না দাদাজান। জোর করলে আমি কালই ঢাকায় চলে যাবো।”
“তাদের কথা দিয়ে ফেলছি বুজান। আর তুমি জানো জান দিয়ে হলেও কথা দিয়ে কথা রাখি আমি। তোমার দাদাজান একজন মাওলানা, সমাজের সন্মানি মানুষ। তুমি যদি দাদাজানকে অপমান হতে দেখতে চাও তাহলে কিছু বলার নেই আমার। তার মান এখন তোমার হাতে।”
শায়লা কিছু বলতে না পেরে ফিরে গেলো। তার ভীষণ রাগ হচ্ছে, শরীর জ্বলছে। এলোমেলো পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগুলো সে। রান্নার আয়োজন দেখে বুঝলো মেহমান সমাদরের এলাহি আয়োজন চলছে। পুরো রান্নাঘর জুড়ে বাজার ছড়িয়ে আছে। দু’জন সহকারী সেগুলো গোছাচ্ছে। মা যথারীতি রান্না করছে দাদীজান বসে বসে কাজের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। শায়লা ভনিতা না করে মাকে প্রশ্ন করলো-“মা তুমি আগে থেকে জানতে?”
রুবিনা এতোটাই চমকে গেলো যে তার হাত থেকে বাটি পড়ে গেলো। সে মেয়ের দিকে তাকালো ভয়ে ভয়ে-“কি জানার কথা বলছিস শায়লা?”
শায়লা নিস্পৃহ ভাবে মাকে দেখলো-“আমি কি বলছি তুমি ভালো করেই জানো মা। আমাকে আগে বলো নাই কেন?”
রুবিনাকে অসহায় দেখালো। শায়লার দাদী নাজনীন রুবিনাকে উদ্ধার করলো-“তোমার মা কিছু জানে না বুজান। তোমার দাদাজানের সিদ্ধান্ত এটা। তোমাকে ঢাকায় একা পাঠাতে রাজি না সে। এমনিতেই গ্রামে তোমাদের নিয়ে আলোচনার শেষ নাই। ঢাকায় পড়তে গিয়ে যদি ওলটপালট কিছু হয় তাহলে আবারও তোমার মায়ের দিকে আঙুল উঠবে। সবাই বলবে সে তার মেয়েদের মানুষ করতে পারে নাই। এইগুলা শুনে কি ভালো লাগবে তোমার? তাছাড়া মেয়ে তো তুমি একা না। বিনা, মহুয়া ওরাও আছে। ওদের ভবিষ্যৎ ভাবনাও তো ভাবতে হবে। কিছু ভুলভ্রান্তি হলে তোমার সাথে সাথে ওরাও ভুগবে। তুমি যত যাই বলো বুজান, তোমার দাদাজানের সাথে আমি একমত। বিয়ের পর যত খুশি পড়ালেখা করো।”
শায়লা রেগে চেচিয়ে উঠলো-“তোমাদের দেওয়া শিক্ষার উপর ভরসা নাই যখন তাহলে এতো পড়ালেখা করালো কেন? এতো স্বপ্ন দেখানোর কি দরকার ছিলো। তীরে এসে তরি ডোবানোর কোন প্রয়োজন ছিলোনা।”
নাজনীন বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে হাসলো-“না নাই। ভরসা নাই বইলাই এই সিদ্ধান্ত।”
রুবিনা ভ্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো-“এসব কি শায়লা? দাদির সাথে কিভাবে কথা বলছো? শিক্ষিত হয়ে সহবত ভুলে যাচ্ছ দেখছি?”
শায়লা রেগেমেগে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। অসম্ভব রাগ উঠছে তার। কেন এমন করলো দাদাজান? বললেই হতো তোদের পড়াবো না বেশি, স্বপ্ন দেখিস না। তা না করে বড় বড় কথা বলে স্বপ্ন দেখিয়ে এখন নাকি একা পাঠাবে না। শায়লা ঘরে না গিয়ে পুকুর পারে এসে বসলো। তার কান্না পাচ্ছে ভীষণ অসহায় বোধ হচ্ছে। কঠিন সময়েও না কাঁদা শায়লা অভিমানের ঝাঁজে থাকতে না পেরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।

“বুবু, কি করো?”
শায়লা তাকিয়ে দেখলো মহুয়া হেঁটে আসছে বড় রাস্তা ধরে। শায়লা চোখ মুছে নিলো দ্রুত-“তোর ক্লাস শেষ?”
“হ্যা। তুমি হঠাৎ এইসময় পুকুর পাড়ে আসছো যে?”
বলতে বলতে মহুয়া বোনের পাশে বসলো। শায়লা নরম গলায় জবাব দিলো-“এমনি। ভালো লাগতেছিল না।”
“বুবু, একটা পরামর্শ দাও তো। এতোদিন তো তোমার কাছে পড়া বুঝতাম। এখন কি করবো? এই সিলেবাস তো একা পড়া কঠিন।”
শায়লা দীর্ঘ শ্বাস গোপন করলো। বোনের পানে চেয়ে রইলো খানিকক্ষণ। মহুয়ার চেহারায় আদূরে ভাব প্রকট হয়ে আছে। শায়লা কোমল কন্ঠে জবাব দেয়-“কলেজের অংক আর ইংরেজি টিচারের কাছে পড়। আর বেশি সমস্যা মনে করলে আমাকে ফোন দিবি আমি বুঝিয়ে দেব। হ্যারে মহুয়া, তুই কি এখনো ডাক্তারিই পড়তে চাস?”
মহুয়া মিষ্টি করে হাসলো-“তোমার কোন সন্দেহ আছে? তুমি তো চান্স পেয়েও পড়লে না।”
“কিন্তু তোর খারাপ লাগবে না কেউ যখন বলবে আরে তুমি…”
মহুয়া থামিয়ে দিলো শায়লাকে-“না পড়লেও বলবে আপু। এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে…”
“মহুয়া, ঘরে যা। গোসল করে খেয়ে নে। তোর ভাত বেড়ে রেখেছি টেবিলে।”
রুবিনা এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েদের পেছনে। মাকে দেখে মহুয়া উঠে গেলো। শায়লা উঠতে চাইছিল রুবিনা বাঁধা দিলো-“তুই বয়, কথা আছে তোর সাথে।”
রুবিনা মেয়ের পাশে বসলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো পুকুরের দিকে। শায়লা মনমরা হয়ে বসে আছে। রুবিনা হঠাৎ করে শায়লার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিলো-“আমি খুব খুশি যে তোরা কেউ আমার মতো নরম মনের হোসনি।”
শায়লা বিস্মিত হয়ে মাকে দেখলো। রুবিনা মেয়ের হাতে চুমু দিলো-“কিন্তু মারে,আমাদের বিপদে যখন কেউ ছিলো না তখন তোর দাদাজান ছিলো। শক্ত ঢাল হয়ে ছিলো আমাদের মাথার উপর। মানুষের নানা কথার বানে জর্জরিত হওয়া থেকে বাঁচাইছে। নিজের সন্তানদের পর্যন্ত ত্যাগ করেছে আমাদের কথা ভেবে। সেই মানুষটা যখন আমাদের জন্য কিছু বলে বা করে তখন বুঝে নিতে হবে এর পেছনে হয়তো কোন কারন আছে। তার উপর রাগ করে তার সমস্ত ভালো কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা কি ভালো রে মা?”
শায়লা ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আঁটকায়। কোন জবাব দিলো না। রুবিনা মেয়ের হাত নিয়ে গালে ঠেকালো। ভেজা কন্ঠে বললো-“সব পুরুষ তোর বাবার মতো হবে না শায়লা। তোর দাদাজানও তো পুরুষ মানুষ, সে কি খারাপ? ভেবে দেখ সে না থাকলে আমাদের কি হতো। রাজি হয়ে যা শায়লা। ওই বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট দিস না। মানুষটা তোকে বড্ড ভালেবাসে। তুই সুখী হবি দেখিস। তোর সব স্বপ্নপূরন হবে।”
শায়লা দূর্বল গলায় জবাব দিলো-“তুমি অলীক স্বপ্ন দেখছো মা। এমন কিছুই হবে না। দেখে নিয় তুমি।”
রুবিনা মেয়েকে বুকে টেনে নিলো-“তোর ভালো হবে মা। দেখিস এক জীবনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। এই দুঃখী মা তোকে আশীর্বাদ করছে।”
বলতে বলতে রুবিনার চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। কাঁদছে শায়লাও। যে জীবনে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার আশা নেই সে জীবনে সুখ আসবে কি করে তার জানা নেই।

চলবে—
©Farhana_Yesmin