#এরই_মাঝে
#পর্ব-১৭
সকালে দু’জনকে একসাথে দেখে জাকিয়া সত্যিই অবাক হলো। শায়লার মায়ের হাতের বানানো পিঠাপুলি দেখে বাড়ির সকলে খুশি হলেও জাকিয়া মোটেও খুশি হলো না। সবার সামনে কিছু না বললেও রিদওয়ান একা হতেই ওকে পাকড়াও করলো। সে বারবার রিদওয়ানকে প্রশ্ন করতে লাগলো-“তুই কবে গেলি? হুট করে দাদুর কাছে গেলিই বা কেন?”
রিদওয়ান যথাসম্ভব বিরক্ত না হয়ে জবাব দিলো-“দাদু ডাকলো মা না যেয়ে কি করবো?”
“দাদু শুধু তোকেই ডাকলো কেন?”
“সেটা আমি কি করে বলবো?”
“তুই আর শায়লা একসাথে গেছিস? ওর সাথে তোর নিয়মিত যোগাযোগ হয়?”
“না মা, আমরা একসাথে যাইনি। শায়লার সাথে আমার যোগাযোগ হয় না। গ্রামে যেয়ে দেখা হলো।”
“ওদের বাড়িতে গেছিলি?”
“হ্যা। দাদুই নিয়ে গেলো।”
জাকিয়া গাল ফুলিয়ে জবাব দিলো-“বাহ, ভালোই তো দাদুর নাতি হয়ে গেছিস। অবস্থা দেখে মনেহচ্ছে তোর দাদুই তোর সব আমরা তোর জীবনে আগাছা।”
রিদওয়ান বিরক্তি হলো-“কেন এসব বলছো মা? এমন কি করলাম আমি?”
জাকিয়া রেগে গেলো-“কি করেছিস? কি করিসনি তাই বল। একেতো তোর দাদুর কারণে তোকে বিয়ে করাতে হলো ওই গন্ডগ্রামে। তাও আবার এমন একটা মেয়েকে যার না বাবা আছে না টাকা পয়সা। কত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি তোর দাদুকে। ওদের সাথে আমাদের কোনদিক দিয়ে যায়? মানুষের কাছে কি পরিচয় দেব বউয়ের? এরমধ্যে তুই দেখছি শশুরবাড়ির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিস। বিয়ে করতে না করতেই বউ আর তার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকছিস।”
রিদওয়ান বিস্মিত হয়ে মায়ের দিকে তাকায়-“কি সব আবোলতাবোল বকছো মা? আমি কখন বউ নিয়ে ব্যস্ত হলাম? ওর সাথে আমার দেখাই হলে সাকুল্যে তিনদিন। আর ওর বাড়ির লোকেদের সাথে প্রথম দেখা হলো। তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি আসলে বুঝতে পারছি না মা।”
“এইসব গ্রামের মানুষগুলো খুব চালু হয় বুঝলি। দেখছিস না তোর হাত দিয়ে কিসব পাঠিয়েছে। এগুলোর কোন দরকার ছিল? আমরা এসব খাই? যত্তসব ছোটলোকী আচরণ।”
মায়ের কথা অসন্তুষ্ট হলেও কিছু বললো না রিদওয়ান। জাকিয়া ছেলের মনোভাব বুঝতে চাইলেও পারলোনা। সে বললো-“তোকে বলছি কি, ওদের সাথে অতো যোগাযোগ রাখার দরকার নেই। তুই বরং মন দিয়ে পড়ালেখা কর। তারপর না হয় দেশের বাইরে পড়তে চলে যা। এখন থেকেই স্কলারশিপের জন্য ট্রাই করতে থাক তাহলে সময় নষ্ট হবে না।”
রিদওয়ান এবারেও কোন কথা বললো না। সে হাই আঁটকে বললো-“মা সারারাত জার্নি করে এলাম একটু ঘুমিয়ে নেই। বিকেলে আবার ডিউটি আছে হাসপাতালে।”
জাকিয়া মন খারাপ করে উঠে দাঁড়ালো-“ঠিক আছে তুই ঘুমা। আমার কথাগুলো ভেবে দেখিস। ডাক্তারি ক্যারিয়ারে একটা বিদেশি ডিগ্রি অনেক ম্যাটার করে। ”
রিদওয়ান ছোটো করে উত্তর দিলো-“হুমমম। ভেবে দেখবো মা।”
*****
“এই শায়লা, আন্টি তো দারুণ পিঠে বানায়। কতদিন পরে যে এসব পিঠে খেলাম।”
পল্লবী একের পর এক পিঠে খেয়ে যাচ্ছে। প্রথমে নারিকেলের পুলি, পরে দুধে ভেজানো চিতই, এখন তালের বড়া মুখে দিলো। মালিহাও খাচ্ছে টুকটাক। ওয়াহেদ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে দুধে ভেজানো পিঠে। বহুদিন পরে এমন সুন্দর আর স্বাদের পিঠে খাওয়া হচ্ছে। শায়লার মা বড় বড় দুটো হাঁস রেধে পাঠিয়েছে। তা দেখে ওয়াহেদ বললো-“বড় বউমা, আজ দুপুরে বরং খিচুড়ি করো। সাথে চাক চাক বেগুন ভাজা। হাঁস দিয়ে খিচুড়ি অমৃত লাগবে।”
পল্লবী হেসে দিলো-“কিন্তু বাবা আজ তো অফিস। দুপুরে তো কেউ বাসায় থাকবে না। রাতে করলে ভালো হতো না?”
মালিহা বললো-“হ্যা বাবা, রাতে খিচুড়ি আর হাঁস পার্টি হোক। অফিস থেকে ফিরে সবাই একসাথে খাবো।”
শায়লা হাসি মুখে ওদের উচ্ছ্বাস দেখছিল। শায়লার ভালোই লাগছে মায়ের হাতের রান্না নিয়ে এমন আলোচনা দেখতে। ওয়াহেদ হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে বললো-“কিন্তু রাতে ওরা থাকবে? রিদওয়ান তো বললো ওর ডিউটি আছে।”
পল্লবী এক মিনিটও দেরি না করে বললো-“রিদওয়ানকে খাবার দিয়ে দেব বাবা। আর শায়লা…”
“আমি থাকবো না ভাবি। নতুন সেমিস্টারের ভর্তির ব্যাপার আছে কাল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আপনারা খান ভাবি, মা আপনাদের জন্যই দিয়েছে।”
এরমধ্যেই জাকিয়া উপস্থিত হলো-“খাবার নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কি আছে বলো তো? তোমরা কখনো খাওনি হাসের মাংস? আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমাদের দেখে। এসব ছোটলোকি আচরণ করছো কেন? ভাব দেখে মনেহচ্ছে খেতে পাওনা তোমরা।”
তিনজনেরই মুখে মলিনতা গ্রাস করলো। পল্লবী আর মাহিলা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে শায়লাকে দেখলো। শায়লার মুখটা আঁধারে ছেয়ে আছে।
ওয়াহেদ মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো-“এসব কি আচরণ জাকিয়া? বউমার মা কষ্ট করে রেঁধে পাঠিয়েছে আমরা মজা করে খেলেই তার কষ্ট সার্থক। তুমি এভাবে বলছো কেন?”
জাকিয়ার মুখের ভাব একটুও পাল্টালো না। আগের মতোই তেজ দেখিয়ে বললো-“তো কি বলবো? তোমরা খাবারের উপর এমনভাবে হামলে পড়েছ মনেহচ্ছে জীবনেও খাওনি।”
ওয়াহেদ রাগান্বিত চোখে সতর্ক করলো জাকিয়াকে-“খাইনি তো। বউমার মায়ের হাতের রান্না আগে খাইনি। এতো স্বাদের পিঠেও খাওয়া হয়নি। তুমি ডায়েট করে খেলে না ভীষণ মিস করলে।”
জাকিয়া মুখ বাঁকালো। ওয়াহেদ শায়লাকে বাঁচাতেই বললো-“মামনী, তুমিও ঘরে যেয়ে রেস্ট নাও। সারারাত জার্নি করে এসেছ।”
শায়লা ঘাড় কাত করে সায় দিলো।
“শায়লা,
জাকিয়া কিছুটা মোলায়েম স্বরে বললো-” শোন শায়লা, তুমি বরং গেস্টরুমে ঘুমাও। রিদওয়ান তো ঘুমিয়ে গেছে। তাছাড়া ও সারারাত জেগে ডিউটি করবে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো ঠিক হবে না।”
জাকিয়ার সূক্ষ্ম অপমানের চেষ্টার শায়লার গা কাঁপছে রীতিমতো। নিজেকে প্রানপনে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে। কথা না বাড়িয়ে সে বললো-“জ্বি।”
ওয়াহেদ বাঁধা দিলো-“শায়লা মামনী, তুমি রিদওয়ান এর ঘরে যাও। তোমার আন্টি তার ছেলের কথা একটু বেশি বেশি ভাবছে। যাইহোক, এখন যেয়ে বিশ্রাম নাও।”
শায়লা এবার আর দেরি করলো না। ঘাড় হেলিয়ে দ্রুত ওখান থেকে সরে এলো। রিদওয়ান এর ঘরে ঢুকে দরজায় গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুসময়। ভীষণ অপমানিত লাগছে তার নিজেকে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, মাথা গরম হয়ে টনটনে ব্যাথা টের পাচ্ছে। টের পেলো চোখ দুটো ভেজা ভেজা। ভাগ্যিস ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। রিদওয়ান যদি ওর চোখের জল টের পায় সেটা আরও লজ্জার হবে। শায়লা আর লজ্জা পেতে চায় না। চোখের জল মুছে নিলো শায়লা। ঠিক করলো এ বাসায় আর আসবে না ও। হাজারবার ডাকলেও আসবে না যতদিন না জাকিয়া তাকে নম্র হয়ে আসার কথা বলবে ততদিন তো নাই।
*****
সন্ধ্যায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিদওয়ান এর সাথে বেরিয়ে এলো শায়লা। গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে শায়লা। রিদওয়ান এর সাথে একটা কথাও বলছে না। রিদওয়ান শায়লাকে দেখলো। কেন যেন মনেহচ্ছে শায়লার মনটা ভীষণ খারাপ। মনের মধ্যে খচখচ করছে রিদওয়ানের। মা শায়লাকে কিছু বলেনি তো?
“শায়লা, কোন কারনে কি তোমার মন খারাপ?”
শায়লা চমকে উঠে রিদওয়ানকে দেখলো। রিদওয়ান কাল বলেছিল ওর মায়ের ব্যাপারে। বরং শায়লাই মানেনি। এখন জাকিয়ার কথা রিদওয়ানকে জানালে সে রাগ করতে পারে। তাছাড়া শায়লার সাথে যত খারাপ ব্যবহারই করুক জাকিয়া রিদওয়ান এর মা। কারো কাছে মায়ের নিন্দে করাটা ভালো দেখায় না। শায়লা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে-“আমি ঠিক আছি।”
রিদওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“তার মানে তুমি ঠিক নেই। আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন কি কিছু হয়েছে? মা, মা কিছু বলেছে কি?”
শায়লা রেগে গেলো-“এতো বেশি বোঝেন কেন? আমি কি বলেছি আপনার মা কিছু বলেছে? শরীর খারাপ লাগছে তাই চুপ করে আছি।”
রিদওয়ান দু’হাত উপরে তুলে ফেললো-“ওকে ওকে, ঠিক আছে। এতো হাইপার হচ্ছ কেন তুমি? আমি কি হাইপার হওয়ার মতো কিছু বলেছি?”
শায়লা কাঠ কাঠ গলায় বললো-“কেউ আমাকে নিয়ে এতো কনসার্ন দেখালে ভালো লাগে না আমার। অভস্ত্য না আসলে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”
রিদওয়ান জবাব দিলো না। নিজের উপর খানিকটা বিরক্ত হলো। সত্যিই কি শায়লার প্রতি অকারণ কনসার্ন দেখাচ্ছে? নিজের মনে আসস প্রশ্ন ওকে অসস্তিতে ফেলে দিলো। রিদওয়ান দ্বিধা নিয়ে শায়লার দিকে তাকালো।
চলবে—-
©Farhana_Yesmin