#এরই_মাঝে
#পর্ব-১৯
শায়লার মুখের হতবাক অবস্থা কাটেনি। রিদওয়ান বললো-“বসো।”
মহুয়া হাত ধরে টানলো ওকে। নিজের পাশে বসিয়ে ইশারা করলো। টেবিলের উপর ছোট একটা কেক যার উপর লেখা আছে ‘হ্যাপি বার্থডে শায়লা’। মহুয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো-“আপু, তোর পছন্দের কেক। ভাইয়া এনেছে। তাড়াতাড়ি কেটে ফেল।”
শায়লা পালা করে একবার রিদওয়ান আরেকবার মহুয়াকে দেখলো। তারপর আচমকা মহুয়ার গালে চড় দিলো। মহুয়া হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়েছে, ওর চোখ দুটো টলমল। রিদওয়ান বোকা বনে গেলো। শায়লার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো সে৷ মেয়েটার চোখ মুখ ঠিকরে যেন আগুন বেরুচ্ছে। আশ্চর্য! কি এমন করেছে ওরা? জন্মদিনই তো পালন করতে চেয়েছে তাতে এতো হাইপার হওয়ার কি আছে? বিরক্ত রিদওয়ানের নজর মহুয়ার উপর পড়তেই চরম মেজাজ খারাপ হলো। সে মুখ খিচিয়ে জানতে চাইলো-“সমস্যা কি তোমার শায়লা? কিসের এতো ভাব তোমার বলো তো? যে যাই করছে কিছু পছন্দ হয় না তোমার। এতো ভালো ছাত্রী তুমি ব্যবহারের এই অবস্থা কেন?”
“আপনাদের সমস্যা কি? এইসব আদিখ্যেতা কে করতে বলেছে? আমি বলেছি? এসব কিছু চাই না আমার। না আপনার এইসব দেখানো কেয়ার না ওর দরদ। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।”
রিদওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“তুমি একটা বেয়াদব মাথামোটা আর স্বার্থপর মেয়ে। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবো। যদি তা না ভাবতে তাহলে আজকের দিনে এমন কিছু করতে না যেখানে আমাদের দু’জনের উদ্দেশ্য তোমাকে আনন্দ দেওয়া। একটু কেয়ার দেখিয়েছি বলে মাথা কিনে নাওনি। একা থাকতে চাও তো? থাকো তুমি একা একা। মহু চলে আয়। তোকে পৌঁছে দিয়ে আমি হলে ফিরবো।”
মহুয়া চোখ মুছে নিয়ে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালো। একবার বোনের দিকে তাকালো। মুখ কঠোর বানিয়ে বসে আছে শায়লা। মহুয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রিদওয়ানের পিছু পিছু চলে এলো।
“ভাইয়া, আপনি আপুর উপর রাগ করে থাকবেন না। আমি তো আগেই বলেছিলাম ও এমন রিয়্যাক্ট করতে পারে। আপনি শুনলেন না। আসলে ও ইচ্ছে করে কিছু করেনি ভাইয়া। জন্মদিন নিয়ে খুব বাজে স্মৃতি আছে আমাদের। বাড়িতে কখনো আমরা আমাদের জন্মদিন পালন করি না।”
রিদওয়ান ধমকে উঠলো-“চুপ কর মহু। যত যাইহোক এরকম ওপেন প্লেসে সিনক্রিয়েট করা আমি একদম পছন্দ করি না। তোর বোনের আক্কেল হওয়া উচিত। আর তাছাড়া আগে জন্মদিন পালন হয়নি বলে এখন হবে না? বাজে স্মৃতি আছে থাক, এখন ভালো স্মৃতি বানাতে হবে। ভালো স্মৃতি খারাপ স্মৃতিকে ভুলিয়ে দেবে। কিন্তু তা তোর বোন মানবে কেন? ওর তো দুঃখবিলাস করতে হবে। দুঃখী আত্মা কোথাকার।”
মহুয়া খিলখিল করে হাসলো-“ভাইয়া, কি বললেন এটা? আপা শুনলে তো আপনাকে কাঁচা আমের মতো চিবিয়ে খাবে।”
রিদওয়ান রাগ দেখিয়ে বললো-“আর আমি আদর করবো তোর বোনকে? ওকে আমি লবন মরিচ দিয়ে মাখিয়ে খাব।”
“হিহিহি, সাথে একটু সর্ষের তেল দিলে বেশি স্বাদ লাগবে ভাইয়া।”
রিদওয়ান না বুঝে জানতে চাইলো-“সর্ষের তেল কোথায় দেব?”
মহুয়া মুখ কাচুমাচু করলো-“কাঁচা আমের ভর্তায় একটু সর্ষের তেল দিলে আম মাখানো খেতে মজা লাগে বেশি। আপনি বললেন না আপুকে লবন মরিচ দিয়ে মাখাবেন? সাথে একটু সর্ষের তেল দিলে আরও ভালো লাগবে।”
রিদওয়ান হেসে দিলো-“খুব দুষ্ট হয়েছিল মহু।”
“সরি ভাইয়া। আপনি আপার উপর রাগ করবেন না প্লিজ। ওর কোন দোষ নেই আসলে।”
“খুব বোনকে বাঁচাচ্ছিস না? আচ্ছা বাদ দে ওর কথা। তুই বল, কোচিং কেমন চলছে? মক টেস্টগুলো ঠিকঠাক দিতে পারছিস?”
“পারছি ভাইয়া। ভালো হচ্ছে পরীক্ষা।”
মহুয়ার মাথার আলতো গাট্টা দিলো রিদওয়ান-“গুড। মেরিট লিষ্টে যেন তোর নাম থাকে।”
মহুয়া লাজুক হাসলো। পরপর তিনটে মক পরীক্ষায় সে হায়েস্ট নাম্বার পেয়েছে সেটা আর সে বললো না।
*****
রুবিনা আজ সারাদিন নিজের কামড়া থেকে বের হয়নি। তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনটা দশ বছর আগে বিষাদের কালো মেঘে ঢেকে গেছিলো। আজ সেই বিশেষ দিন। এক যুগ সংসার করার পর শায়লার দশম জন্মদিনে জেনেছিল তার সবচেয়ে আপন মানুষটা পর হয়ে গেছে। মানুষটা সেদিন তার নতুন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। সেই স্মৃতি মনে করে রুবিনার নয়ন আজও আর্দ্র হয়ে যায়। মেয়েটার সেদিন জন্মদিন ছিলো। প্রথম সন্তান বলে শায়লার জন্মদিন সবসময় বিশেষ ভাবে পালন হতো। যত ব্যস্ততাই থাক ওদের বাবা মেয়ের জন্য সময় বের করে বাড়ি আসতো। সেই লোকটাই মেয়ের জন্মদিনে নতুন সঙ্গী নিয়ে হাজির হলো। আনন্দের দিন বেদনায় রুপান্তর হতে সময় লাগেনি। মনে করে রুবিনা ফুপিয়ে উঠলো। মেয়েটা বড্ড আঘাত পেয়েছিল। সেই দিনের পর থেকে আর কোনদিন এ বাড়িতে জন্মদিন পালন হয়নি।
আজ শায়লা দূরে। নিশ্চয়ই সারাদিন মন খারাপ করে শুয়ে আছে। কান্নাকাটি ও করছে হয়তো। রুবিনার সাহস হয়নি ওকে ফোন দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। শায়লা একদমই পছন্দ করে। পারলে হয়তো এই দিনটা নিজের জীবন থেকে মুছে দিত। রুবিনা কয়েকবার ফোন হাতে নিয়ে রেখে দিয়েছে। সন্ধ্যার কিছু পরে শায়লার ফোন পেয়ে যারপরনাই অবাক হলো সে। তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরে বললো-“শায়লা, কি হইছে মা?”
“মা, আমি কি খুব খারাপ মেয়ে? আমি কারো কথা ভাবি না?”
শায়লার কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনে রুবিনা অবাক হলো-“কে বলছে এই কথা? আমার শায়লাকে কে এতো বড় অপবাদ দেয়?”
শায়লা ফোঁস ফোঁস করে নাক টানে-“আমার জন্মদিন ভুলে যেতে চাই এটা কি খারাপ কথা মা? ওই লোকটা আমাদের সাথে অন্যায় করলো তার শাস্তি আমরা কেন পাচ্ছি মা? কেন আমাদের জীবনের সব আনন্দ নাই হয়ে গেলো? ওই লোকটা তো ভালো আছে মা, সুখে আছে। তোমাকে কষ্ট দিয়ে দিব্যি আনন্দ করছে।”
রুবিনা নিশ্চুপ, বুকের ভাঙচুর হচ্ছে। কম্পিত কন্ঠে জবাব দিলো-“কেউ সুখে থাকলে কষ্ট পেতে নেই শায়লা।”
শায়লা হাসলো, তাচ্ছিল্যের সুরে বললো-“তুমি কি দিয়ে তৈরি মা? কিভাবে এখনো মানুষের ভালো কামনা করো?”
রুবিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“আমি ভালো কামনা করার কে শায়লা। আল্লাহ যা করার করবে।”
শায়লা কিছু বললো না। মেয়ের নিরবতায় রুবিনা অস্থির হলো-“সব ঠিক হয়ে যাবে শায়লা। তুই এসব নিয়ে একদম ভাববি না। তুই পড়ালেখা শেষ করে বড় চাকরি করবি, রিদওয়ান এর সাথে তোর একটা সুন্দর সংসার হবে দেখিস। আমি তোর সংসারে বেড়াতে যাব। একদিন অনেক আনন্দে থাকবি তোরা। আমি মা হয়ে তোদের জন্য কিছু করতে না পারলেও অনেক অনেক দোয়া করি তোদের জন্য শায়লা। আমি যা পাইনি তোরা যেন তাই পাস।”
“স্বপ্ন দেখছো মা। এই স্বপ্ন কখনো পূরন হবে না। আমি কোন ডাক্তারকে বিশ্বাস করে তোমার মতো ঠকতে চাই না।”
“ছিহ মা, এসব কি বলছিস? রিদওয়ান এমন ছেলে নয়। সবাই এক হয় না শায়লা। সবাইকে এক মাপে ফেলে বোকামি করিস না। জীবন শুরুর আগেই জীবনকে জটিল করিস না শায়লা। বড্ড ভুল করছিস।”
শায়লা ফিসফিস করলো-“আমার ভয় লাগে মা, কাউকে বিশ্বাস করতে খুব ভয় লাগে। কত কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়েছি।”
রুবিনা স্বান্তনা দিলো-“বলছিতো রিদওয়ান অমন না। ওর সাথে সুখে থাকবি তুই। শুধু উল্টো পাল্টা আচরণ করে ওকে রুষ্ট করে দিস না। ছেলেটা ভালো। কি সুন্দর করে আমাকে মা ডাকলো। মন পরিস্কার না হলে কেউ এমনভাবে ডাকতে পারে না।”
শায়লা চুপচাপ মায়ের কথা শোনে। রুবিনা বলে-“অতীত ভুলে যা শায়লা। ভয়কে জয় করে রিদওয়ান এর সাথে জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে তোল। বিশ্বাস কর দেখবি জীবন কত সুন্দর। জীবন তোকে সুযোদ দিয়েছে তুই সুযোগ লুফে নিয়ে জীবনকে দেখিয়ে দে তুইও পারিস সুখে থাকতে।”
চলবে—
© Farhana_Yesmin