এরই মাঝে পর্ব-২০

0
201

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২০

কয়েকদিন ধরে নিজের মনে চলা দ্বিধা কাটিয়ে শায়লা শেষ পর্যন্ত রিদওয়ানকে ফোন করলো। ভেবেছিল রিদওয়ান ওর ফোন ধরবে না। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দুইবার রিং হতেই রিদওয়ানের গলা শোনা গেলো-“হ্যালো।”
শায়লা কি বলবে ভেবে পেলো না। গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বেরুল না। রিদওয়ান বিরক্ত হয়ে বললো-“কথা বলবে না তো ফোন দিয়েছ কেন শায়লা? আমি ভীষণ ব্যস্ত কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো নয়তো ফোন রাখো।”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে শায়লা। মুহূর্ত পার হয়ে গেলেও ও কিছু বলে না। রিদওয়ান বিরক্ত হয়ে ফোন কান থেকে নামাবে শুনলো-“আপনার একটু সময় হবে?”
রিদওয়ান না বুঝে বললো-“কি বললে পরিস্কার করে বলো।”
“আপনার সাথে দেখা করতে চাইছিলাম। কখন সময় হবে আপনার?”
“আমি তোমাকে পরে ফোন করবো।”
রিদওয়ান ফোন কেটে দিলো। শায়লা ভীষন মন খারাপ হয়। কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো কেন? শায়লা স্তিমিত হয়ে বসে রইলো কিছুসময়। ঘন্টা পার হওয়ার পরও যখন ফোন এলো তখন আশা ছেড়ে দিলো। ভেবেছিল আজ পড়াতে না গিয়ে রিদওয়ান এর সাথে বসবে। কিন্তু মনেহয় না রিদওয়ান ফোন দেবে। শায়লা কাপড় পরিবর্তন করে টিউশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো।

রিদওয়ানের ফোন এলো রাতে। শায়লা তখন টিউশন থেকে ফিরেছে মাত্র। শরীর ক্লান্তিতে নূয়ে আসতে চাইছে তবুও ফোনটা ধরলো-“হ্যালো।”
“সরি তখন কথা বলতে পারিনি। ডিউটিতে ছিলাম তো।”
“ইটস ওকে।”
শায়লা রিদওয়ানের কৈফিয়তের প্রতিউত্তর দিলো মৃদুস্বরে।
“কি যেন বলছিলে? দেখা করতে চাও?”
“হুমম।”
“কাল পারবোনা, পরশু বিকেলে আসি?”
“ঠিক আছে।”
শায়লার হু হা শুনে কিছু বলতে চাইছিল রিদওয়ান কিন্তু পরমুহূর্তে কি ভেবে নিজেকে সামলে নিলো। রিদওয়ান ফোন কাটতেই শায়লা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো, কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলো।

*****

“কোথাও যাচ্ছ?”
তানিয়ার প্রশ্নে মুকুল মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। ছোট্ট হ্যান্ড লাগেজে দু’টো শার্ট আর দু’টো প্যান্ট গুছিয়ে নিতে নিতে বললো-“ঢাকায় যাচ্ছি। তিনদিনের একটা সেমিনার এটেন্ড করতে। কিছু অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার এসেছে মেডিসিনের উপর লেকচার দেবে।”
তানিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মুকুলের কথা শুনে তাকে মোটেও সন্তুষ্ট মনে হলো না। সে গলায় কিছুটা হেলা ঢেলে বললো-“ঢাকায় যাচ্ছ ভালো কথা, মেয়েদের সাথে আবার দেখা করতে যেয় না। এখন তো তোমার দুই মেয়ে ঢাকায় থাকে। ওহহহ বড় মেয়ের তো বিয়েও হয়েছে ঢাকায়।”
মুকুলের হাত থেমে গেলো। সে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-“অহেতুক কথা না বললে হয় না? তুমি জানো ওরা আমার সাথে যোগাযোগ করা দূর কথা পর্যন্ত বলে না।”
“ওরা না বলুক তুমি তো বলতে চাও।”
তানিয়া হাসলো। মুকুল মেজাজ খারাপ করে উত্তর দিলো-“আমার একার ইচ্ছেয় কিছু আসে যায় না তানিয়া। আর সবসময় ওদের নিয়ে টানাটানি না করলে হয় না? তুমি জানো ওদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
“হুমমম জানি। তোমার অদ্ভুত পরিবারে তুমি এখন বাইরের লোক। তা না হলে কি আর মেয়ের বিয়ের খবর অন্য লোকের মুখ থেকে শুনতে হয়? কিন্তু আমার চিন্তা অন্য জায়গায় বুঝলে। হিউম্যান সাইকোলজি কি বলে জানো?”
মুকুল কিছু না বলে তানিয়ার মুখ পানে তাকিয়ে রইলো। তানিয়া বেশ ধীরে ধীরে বললো-“যে তোমাকে এভোয়েড করবে তার প্রতি তুমি আকৃষ্ট হবে। তাকে জয় করে নিতে তোমার মন মরিয়া হয়ে উঠবে। তোমার মেয়েরা তোমাকে যত ভুলে যেতে চায় তুমি ততই তাদের মনে জায়গা করতে চাইছো। আর তা করতে যেয়ে তুমি আমার বাচ্চাদের অবহেলা করছো। আমি মা হয়ে তা কি করে সহ্য করি বলো? এমনিতেই তোমার পরিবারে ওদের অবস্থান শুন্য।”
মুকুলের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির আভাস-“আমি ওদের অবহেলা করলাম? কোথায়? দেখো তানিয়া তুমি জেনেশুনে আমাকে বিয়ে করেছ। এখন ঘুরেফিরে তোমার আলোচনা এই বিষয়ে এসে আঁটকে যায়। এটা কি ঠিক হচ্ছে?”
তানিয়া কাঁধ ঝাঁকাল-“ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট। এড়ানো গেলে অবশ্যই এড়াতাম।”
মুকুল হাল ছেড়ে দিলো। হাতে ব্যাগ নিয়ে বললো-“এসব নিয়ে কৈফিয়ত দেওয়া সময়ের অপচয়। তিনটায় ফ্লাইট। আসছি আমি।”
তানিয়ার মুখে কঠিন রেখা ফুটে আবার মিলিয়ে গেলো। সে মুকুলের যাওয়াটা দেখলো চুপচাপ। মাঝে মাঝে সব ধ্বংস করে দিতে মনচায়। বিয়ে সংসার সব এখন গলায় কাটা ফোঁটার মতো মনেহয়। না গিলে ফেলা যাচ্ছে না উগলে দেওয়া।

বিমান ঢাকার দিয়ে উড্ডয়নের সময় মুকুল একদৃষ্টিতে মেঘগুলো দেখে। সাদা তুলোর মতো মেঘগুলোর স্থির নয়। উড়ছে ঘুরছে ছুটছে অজানা পথে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুকুল অতীত ঘুরে আসে। আজকাল এই জীবনটা ক্লান্ত লাগছে মুকুলের।

মুকুল রাজশাহী মেডিকেলের ডাক্তার।হাসপাতালের পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিস বেশ জমিয়ে করছে। তার বর্তমান স্ত্রী তানিয়া একজন ডাক্তার। রাজশাহী মেডিকেলে জয়েন করার পর এখানেই থাকা হতো বেশি। শুরুতে সপ্তাহের ছুটিছাটায় নওগা যেত। তারপর ধীরে ধীরে তানিয়ার সাথে পরিচয় হলো। তানিয়া তার পাঁচ বছরের জুনিয়র হলেও ব্রাইট স্টুডেন্ট বলে নিজের প্রফেশনে তাড়াতাড়ি এগিয়েছে। কাজ করতে করতে আলাপ পরিচয় কখন গাঢ় হলো দু’জনের কেউই টের পেলো না। একসময় মনেহলো কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না। মুকুলের ইচ্ছে ছিলো রুবিনা আর তানিয়া দু’জনার সাথেই সংসার সমান্তরালে চালিয়ে নেওয়ার। কিন্তু গ্রামের এইচএসসি পাশ রুবিনা হুট করে এমন বেকে বসবে আর বাবা বউমার সাথে তাল দেবে সেটা কখনো ভাবেনি মুকুল। দুই বোনের এক ভাই মুকুল। বাবা মা বোনদের আদরের ছিলো। কখনো ভাবেনি বাবা তাকে জীবন থেকে ত্যাজ্য করতে পারে। তাই তো তানিয়াকে বিয়ে করে নিয়ে বাড়িতে গেছিল মুকুল। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি মুকুলের। তার আগেই তৈয়ব মাওলানা তাকে সন্তান হিসেবে অস্বীকার করলো। তাদের বংশে কোন দ্বিতীয় বিয়ে ছিলো না। মুকুল প্রথম এমন কাজ করলো। লজ্জায় তার বাপ তাকে ত্যাজ্য পূত্র করলো।

মাঝে মাঝে মনের মধ্যে সুক্ষ জ্বলুনি টের পায় মুকুল। রুবিনা তার ভাগের সবটুকু ভালোবাসা ভোগ করছে বলে। বাড়ির এতো কাছে থেকেও বাড়ি যেতে পারে না মুকুল। মায়ের সাথে কালেভদ্রে ফোনে কথা হয় বাবা তাও বলে না রাগ করে। মেয়েদের মন কেমন করে মুকুলের। বাবার জন্য মায়ের আদরের জন্য ছটফট করলেও ও বাড়ি যাওয়া তার বারন। সবকিছু হচ্ছে রুবিনার জন্য। এই একটা মেয়েমানুষ তার সবকিছু কেড়ে নিলো। মেয়েদের মনেও তার জন্য ঘৃণা জন্ম দিয়েছে। তার মেয়েদের জীবনে বাবার অস্তিত্ব নেই। শায়লার কথা শুনে বড্ড কষ্ট পেয়েছিল মুকুল। মেয়েটা ডাক্তারিতে চান্স পেয়েও পড়লো না। এতোটা ঘৃনা করে বাবাকে? মেয়েটা খুব আদরের ছিলো মুকুলের। চোখ দুটো জ্বলে মুকুলের।

আপাত দৃষ্টিতে তানিয়ার সাথে তার সুখী সংসার। একছেলে এক মেয়ে তাদের। একটার বয়স দশ আরেকটা আট। তানিয়া সকাল থেকে রাত অব্দি ব্যস্ত, বাচ্চাদুটো নানা নানী আর গর্ভনেসের কাছে বড় হচ্ছে। দাদা দাদীর আদর ওদের ভাগ্যে নেই। মুকুল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সবকিছু তো মুকুলের জন্যই হচ্ছে। সবগুলো বাচ্চার জীবন এলোমেলো হলো একমাত্র তার কারণে।

*****

লেকের পাশে বেঞ্চে শায়লা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রিদওয়ান দুইকাপ চা নিয়ে এসে পাশে বসলো। চায়ের কাপ শায়লার দিকে বাড়িয়ে দিলো। শায়লা চুপচাপ চায়ে চুমুক দিলো। রিদওয়ানও চুপ করে বসে রইলো। আজ সে কথা না বলার পণ করেছে। অবশেষে শায়লা নিরবতা ভঙ্গ করলো-“সরি।”
রিদওয়ান তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।
“সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখীত।”
“মহুকে বলেছ?”
শায়লা না বুঝে তাকায়-“মানে?”
“মানে সরি শুধু আমাকে বললে হবে? তুমি অতো লোকের সামনে মহুকে চড় দিয়েছ ওকে সরি বলবে না?”
শায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা দুলায়-“আচ্ছা বলবো। ওতো আমার বোন, আমাকে বুঝবে। পরে একসময় বলে দেব।”
রিদওয়ানের মুখের রেখায় ভাজ পড়ে-“তারমানে বলতে চাইছো আমি তোমাকে বুঝবোনা তাই সরি বলছো?”
শায়লা প্রতিবাদ করে মাথা নাড়ে-“এমন কিছু বলতে চাইনি। কথা বানাবেন না প্লিজ।”
রিদওয়ান চুপ করে গেলো। রিদওয়ানের মুখটা দেখে আবারও অনুশোচনা হলো শায়লার। মৃদুস্বরে বললো-“সরি, আপনাকে হার্ট করতে চাইনি। আমি সত্যি সেদিনের জন্য দুঃখীত। আসলে জন্মদিনের স্মৃতি সুখকর নাতো তাই জন্মদিন পালন করি না। মহুয়ার জানার কথা।”
রিদওয়ান চাপা স্বরে বললো-“মহু বলেছিল। ওর কোন দোষ নেই।”
শায়লা চুপ করে গেলো। রিদওয়ান হুট করে আলোচনার বিষয় বদলে ফেলে জানতে চাইলো-“তুমি এতোগুলো টিউশন কেন করছে? তোমার পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে না?”
“নাহ। বেশ একটা রুটিনে এসে গেছে জীবন। আড্ডার সময়টা টিউশনে দিচ্ছি।”
“কিন্তু এভাবে তো জীবন চলে না শায়লা। সবকিছুর প্রয়োজন আছে জীবনে। বন্ধুদের সঙ্গ, পরিবারের সঙ্গ, মাঝে মাঝে অনর্থক ঘুরে বেড়ানো এগুলো বেঁচে থাকার খোরাক। তুমি কেবল দুঃখী দুঃখী হয়ে থাকবে এমনটা কি হয় বলো? নিজে সুখে না থাকলে আরেকজনকে কিভাবে ভালো রাখবে?”
হুট করে রিদওয়ানের মুখে এমন ভারী কথা শুনে অবাক হলো শায়লা। ছেলেটাকে যতটা উড়নচণ্ডী মনেহয় ততটা সে নয়। শায়লার ভালো লাগলো রিদওয়ানের কথাগুলো। তার ঠোটের কোনে অস্পষ্ট হাসির আভা ফুটে উঠলো।

চলবে—
© Farhana_Yesmin