এরই মাঝে পর্ব-২৯+৩০

0
117

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২৯

শাড়ী পরে দুরুদুরু বুকে ভীরু পায় রুমে প্রবেশ করলো শায়লা। সবুজ রঙের কাতান শাড়ী। মেরুন আর সোনালী সুতোর কাজ পাড়ে আর আঁচলে। শাড়ীটা সেদিনও পছন্দ হয়নি শায়লার আজও হলো না। আয়নায় নিজেকে দেখে একটুও ভালো লাগলোনা। তবুও রিদওয়ানের কথায় শাড়ীটা পরেছে। এখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো রিদওয়ান মন দিয়ে মোবাইল দেখছে। মনোযোগ আকর্ষনে শায়লা হুট করে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ক্রিমের কৌটা ফেলে দিলো। রিদওয়ান চমকে উঠলো। সামনে তাকাতেই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো শায়লাতে। সবুজ রং কাউকে এতোটা মানায়? রিদওয়ান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে শায়লাকে। মুখ দিয়ে আপনাতেই বেরিয়ে এলো-“ইউ লুক স্টানিং শায়লা। সবুজ রং ভালো লাগতো না আমার কিন্তু আজ থেকে সবুজ মনেহয় আমার পছন্দের রং হয়ে গেলো।”
শায়লাকে হতবিহ্বল দেখায়-“মিথ্যে বলছেন।”
রিদওয়ান দৃষ্টি শায়লাতে নিবন্ধিত রেখে মিহি স্বরে বললো-“তোমাকে মিথ্যে বলার কি প্রয়োজন শায়লা। এর আগে কি কখনো মিথ্যে বলেছি?”
শায়লা মাথা নাড়ে-“কিন্তু আপনার সবুজ রং ভালো লাগতোনা?”
রিদওয়ান মুচকি হাসলো-“এখন থেকে ভীষন ভালো লাগার রঙ হয়ে গেলো।”
শায়লার মুখ গোমড়া হলো-“সবুজ আমার একদম ভালো লাগে না। শাড়ীটা আপনার দাদাজান দিয়েছে তাই পরেছিলাম। এটা আপনার দাদীর শাড়ী।”
“এইজন্যই তো আরও বেশি সুন্দর লাগছো। এই শাড়ীতে দু’টো মানুষের মায়া আর ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। সুন্দর না লেগে যাবে কোথায়?”
বলতে বলতে রিদওয়ান শায়লার একদম সামনে এসে দাঁড়ালো। শায়লার কানের দু’পাশের ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। রিদওয়ান যত্ন নিয়ে সেগুলো কানের পাশে গুঁজে দিলো। ঘুরে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা বক্সটা তুললো। মেলে ধরলো শায়লার সামনে-“পছন্দ হয়?”
পার্লের তিন লেয়ারের গলার হার, একজোড়া কানের দূল আর হাতের চুড়ি দু’টো। হার আর কানের দুলের মাঝে মেরুন্ পাথর জ্বলজ্বল করছে। শায়লা মাথা দুলায়-“খুব সুন্দর।”
“যদিও এই শাড়ীর সাথে গয়নাটা যায় না তবুও আজ এটাই পরো। আমার কিনে দেওয়া প্রথম উপহার তোমার জন্য।”
শায়লা রাজি হলো। রিদওয়ান বললো-“আমি পরিয়ে দেই?”
শায়লা এগিয়ে দিলো। রিদওয়ান শায়লাকে নিয়ে বিছানায় বসলো। হাত দুটো টেনে নিয়ে চুড়ি পরিয়ে দিলো। তারপর কানের দুল সবশেষে গলার মালা। এরপর শায়লাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো-“দেখো কেমন লাগছে।”
শায়লা মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখলো। গয়নাগুলো বেশ মানিয়েছে শায়লার গায়ে। পাশে দাঁড়ানো রিদওয়ানের চোখে চোখ পড়তেই লাজুক হয়ে নজর নামিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে আবার তাকালো আবার তাকালো। এতোক্ষণে তার নজরে এলো রিদওয়ানও পান্জাবি পরে আছে। হয়তো এটাই রিদওয়ানের বিয়ের পান্জাবি। নীল রঙা পান্জাবিতে রিদওয়ানকে বেশ সুপুরুষ দেখাচ্ছে। শায়লা বলে ফেললো-“আপনাকে ভালো লাগছে পান্জাবিতে।”
রিদওয়ান হেসে দিলো-“অন্য সময় ভালো লাগে না বুঝি?”
শায়লা ভ্যাবাচ্যাকা খায়-“লাগে। আপনি তো সুন্দর মানুষ সবসময়ই ভালো লাগে।”
রিদওয়ানের চেহারা উজ্জ্বল হলো-“সত্যি? ইউ লাইক মি?”
“হুমমম।”
শায়লা মাথা নিচু করে ছোট করে উত্তর দিলো। রিদওয়ান হুট করে ওর আঁচল টেনে মাথায় তুলে দিলো। মুগ্ধতার আবেশে তাকিয়ে দেখলো অনেকটা সময়। সুরেলা গম্ভীর গলায় বললো-“এবার লাগছো পরিপূর্ণ বউয়ের মতো।”
শায়লা অসস্তিতে মুড়ে আছে তাই কিছু বলা হয়ে উঠলো না। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে। রিদওয়ান ওর খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে কানে ফিসফিস করলো-“হ্যাপি এনিভার্সারি শায়লা, মাই বেটার হাফ।”
শায়লা হতভম্ব। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ যেন সব পরিস্কার হলো তার কাছে। বিয়ের শাড়ী, কুয়াকাটা আসা সবকিছুর কারন জলের মতো পরিস্কার। আশ্চর্য! এতোটা ভুলোমনা কবে হলো সে? বিয়ের বছর পুজলো অথচ সে টের পেলো না। কেমন কাজ হলো এটা? লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। রিদওয়ান কি ভাবছে তাকে? গত একবছরে সে নিষ্ঠার সাথে সম্পর্কটা সামলে যাচ্ছে আর শায়লা কিনা একটা বিশেষ দিন মনে রাখতে পারে না? শায়লার কি কোন দায় নেই? বিয়ে তো মতের বিরুদ্ধে রিদওয়ানও করেছে। রাগটা সেও দেখাতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। আর শায়লা কি করছে? ভীষণ অপরাধী অনুভব হচ্ছে শায়লার।
“কি, কিছু বলবে না? আর কিছু না হোক অন্তত উইশ তো করতে পারো?”
শায়লাকে চুপ থাকতে দেখে রিদওয়ান কিছুটা আশাহত হলো। রিদওয়ানের কথা শোনামাত্রই শায়লা যন্ত্রমানবীর মতো করে উচ্চারন করলো-“হ্যাপি এ্যানিভার্সারি।”
রিদওয়ান এবার উচ্চারণে হাসলো-“মনেহচ্ছে কেউ তোমার কাঁধে বন্দুক ঠেকিয়ে বলছে উইশ কর না হলে গুলি করে দেব।”
শায়লা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। রিদওয়ান বোকা বনে গেলো। কি হলো শায়লার, কেন কাঁদছে ও? কোনভাবে কি রিদওয়ান এর কথায় মন খারাপ হলো? সে ব্যগ্রহয়ে শায়লাকে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল গলায় বললো-“আমার কথায় মন খারাপ হয়েছে? আরে আমি তো ফান করেছি। কাঁদে না প্লিজ।”
শায়লার কান্নার বেগ বাড়ে। রিদওয়ান এর বুকের কাছের পান্জাবি ভিজে যাচ্ছে। রিদওয়ান অসহায় কন্ঠে সুধালো-“আরে কি হলো কি? কেন কাঁদছো শায়লা? এই খুশির দিনে কেউ কাঁদে?”
রিদওয়ান এর কথায় শায়লার কান্না না কমে আরও বাড়লো। রিদওয়ানের বিরক্ত লাগছে এবার। এই মেয়ের মতিগতি বোঝে না সে। কিসে খুশি হয় আর কিসে মনখারাপ বোঝা মুশকিল। ক্ষনে ক্ষনে মন পরিবর্তন হয়। মেয়েটা বোঝে না কেন আপনজনের কাছে অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে হয় না। রিদওয়ান অপেক্ষা করছে শায়লার কান্না থামার। কিন্তু মনেহচ্ছে না এই মুষলধারে বৃষ্টি আজ থামবে। তার সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়েই দম নেবে লাগছে। মাথা নাড়ে রিদওয়ান, উহু তা হতে দেওয়া যাবে না। সে আচমকা মুখ নিচু করে শায়লার কপালে চুমু দিলো। শায়লাকে আরও একটু অবাক করে পরপর ওর গালে অধর ছুঁইয়ে দেয়। শায়লার কান্না থেমে গেছে ততক্ষণে। সে হিচকি তুলছে মৃদু। রিদওয়ানের বুক থেকে সরে যাবে বুঝতেই রিদওয়ান ওর সরু কোমর জড়িয়ে ধরলে দু’হাতে। একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে শায়লাকে ডাকলো-“তাকাও আমার চোখের দিকে। কাকে দেখছো বলো তো?”
শায়লা একবার তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নেয়। ওর জলদগম্ভীর স্বরে কিছু ছিলো, চোখের তারায় শায়লার প্রতি একরাশ মুগ্ধতার আবেশ লুকানোর কোন চেষ্টা নেই। শায়লার শরীর কেঁপে উঠলো তুমুল বেগে। বুকটা অকারণে লাফাচ্ছে দূর্দান্ত গতিতে। পা কাঁপছে, জোর পাচ্ছে না দাঁড়িয়ে থাকার। রিদওয়ান যেন বুঝতে পারলো ওর অভিসন্ধি। দ্রুত ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের সাথে মিলিয়ে নিলো। অন্য হাতে ওর মুখটা তুলে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। শায়লা ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ওর ঠোঁট দু’টো কাঁপছে তিরতির করে। রিদওয়ান তা দেখে মুচকি হাসলো। নাকে নাক ঘষে ঠোঁটে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। নরম অধরে রিদওয়ানের স্পর্শ পেয়ে শায়লা চমকে চোখ খুললো। ওর দু’গাল আর নাকের ডগা রক্তলাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস। রিদওয়ান যেন শায়লার চোখ খোলার অপেক্ষায় ছিলো। সে চোখ নাচিয়ে মুচকি হাসলো-“দেখলে কান্না বন্ধ।”
শায়লার ভ্রু দু’টো প্রথমে কুঁচকে উঠলো তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো রিদওয়ানের দিকে। সব বুঝে আসতেই ছুটে পালাবে কিন্তু পারলোনা। রিদওয়ান ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে না পেরে মিহি স্বরে বললো-“ছাড়ুন না।”
“উহু, আগে আমার উপহার দাও। প্রথম বিবাহ বার্ষিকির উপহার।”
শায়লা অসহায় চোখে চেয়ে থেকে বললো-“আমার মনে ছিলো না একদমই। কিছু কিনে আনিনি তো।”
“চাইলে কেনা উপহারের চাইতে দামী জিনিস দিতে পার তুমি।”
বলেই নিজের ওষ্ঠের দিকে ইশারা করলো। শরমে শায়লার কান উষ্ণতা ছড়ায়, ছটফটিয়ে বলে উঠলো-“এমন করছেন কেন?”
“উপহার না নিয়ে তো ছাড়ছি না তোমায়।”
ভীষণ মোচড়াচ্ছে শায়লা কিন্তু কোনভাবেই জুত করে উঠতে পারছে না। লাজে মরতে বাকি। এই ছেলে যে এতো সেয়ানা জানা ছিলো না শায়লার। দুইজোড়া নয়ন মিলতেই রিদওয়ানের মিটিমিটি হাসি। শায়লার বুঝলো মুক্তি নেই আজ। বাধ্য হয়ে কোনরূপ ভনিতা না করে রিদওয়ানের অধরে অধর ছুঁইয়ে দিলো। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হলো কোথায় ছেলেটা। সে চিলের গতিতে শায়লার ওষ্ঠের দখল নিয়েছে। শায়লার মনে হলো ওর শরীরে হাজারে সুই ফুটছে, পেটের মধ্যে যেন প্রজাপতি ডানা ঝাপটে উঠলো। অনুভুতির তীব্রতায় ওর তনুমন অসার হয়ে আসছে। শায়লা জ্ঞান হারালো।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩০

পিটপিট করে চোখ মেলে অন্ধকার ঘরে রিদওয়ানকে খুঁজলো শায়লা। ধীরে ধীরে উঠে বসলো। চোখ দুটো কচলে নিয়ে ভালোমতো
চোখ বুলিয়ে আধো আঁধার ঘরের কোথাও রিদওয়ানকে দেখতে পেলো না। বারকয়েক ডাকলো উঁচু স্বরে-“শুনছেন, রিদওয়ান, কোথায় আপনি?”
কোন সারা পাওয়া গেলোনা। শায়লা আবার ডাকলো, বারবার ডাকলো তবুও রিদওয়ানের সারা না পেয়ে ভয় পেলো এবার। রিদওয়ান কি রাগ করেছে? রাগ করে তাকে ফেলে চলে গেছে? কিন্তু তার কি দোষ এতে? রিদওয়ান তার এতোটা কাছে যদি সইতে না পারে তাতে তার দোষ কোথায়? শায়লা আরও কয়েকবার ডাকে রিদওয়ান কে। এবার ভয় পেলো শায়লা। বিরবির করলো-“আমাকে ফেলে কোথায় গেলেন রিদওয়ান? প্লিজ ফিরে আসুন।”
আরও কিছু সময় পার হলো। রিদওয়ান এলো না। এবার শায়লা কাঁদতে শুরু করলো। জীবনে প্রথমবার শায়লা দূর্বল মেয়েদের মতো কাঁদছে। কাঁদছে আর নিজেকে দোষ দিচ্ছে। কেন সে জ্ঞান হারালো? এভাবে কতক্ষণ পার হয়েছে জানে না শায়লা। হুট করে দরজা খোলার শব্দে শায়লা হতচকিত হলো। তীব্র ভয় আচ্ছন্ন করে তাকে। রিদওয়ান তো নেই তাহলে কে এলো? শ্বাস আঁটকে রেখে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত টেবিলের উপর থাকা কাঁচের গ্লাস তুলে নিলো হাতে। হাতে গ্লাস উঁচিয়ে দাঁড়ায়। যে আসুক তার মাথায় ভাঙবে এই গ্লাস।

রিদওয়ান দরজা খুলে বাতি দিয়ে ঘুরে তাকাতেই কিছু একটা ছুটে আসছে টের পেলো। সাথে সাথে মাথাটা ঘুরিয়ে নিলো। ওর কান বরাবর ঝনঝন শব্দে গ্লাস আছড়ে পড়লো। রিদওয়ান হতবিহ্বল হয়ে একবার শায়লাকে আরেকবার টুকরো হওয়া গ্লাসের দিকে তাকায়। শায়লা ওকে দেখেই ভ্যা করে কেঁদে দিলো-“আপনি কোথায় গেছিলেন রিদওয়ান? জানেন কত ভয় পেয়েছি?”
রিদওয়ান সাত আসমান থেকে পড়লো-“আমি রুমে নেই বলে তুমি আমার দিকে গ্লাস ছুঁড়ে মারবে?”
শায়লা কেঁদে নাক টানলো-“আমি ভেবেছি অন্য কেউ। নিজেকে বাঁচাতে গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছি।”
রিদওয়ান অপ্রসন্ন মুখে এগিয়ে এলো-“নিজেকে বাঁচাতে আর কি কি করবে তুমি শায়লা? তোমাকে একটু চুমু দিতে গেলে জ্ঞান হারাবে। রুমে না থাকলে গ্লাস ছুঁড়ে মারবে। আম টায়ার্ড শায়লা। তোমার এসব পাগলামি ভালো লাগছে না আমার।”
শায়লা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“আমি পাগলামি করছি?”
“তা নয়তো কি? কোনদিন দেখিনি একটু চুমো দিলে কেউ অজ্ঞান হয়।”
শায়লা রেগে গেলো-“দেখিনি মানে? কয়টা মেয়েকে চুমো দিয়েছেন আপনি? জানলেন কিভাবে কেউ জ্ঞান হারায়নি? বলুন?”
শায়লার আক্রমনত্বক আচরণে ভরকে গেলো রিদওয়ান। আমতা আমতা করে জবাব দিলো-“আমার বন্ধুদের থেকে শুনেছি ওদের এক্সপেরিয়েন্স। কোনদিন শুনিনি চুমো খেতে গিয়ে কেউ জ্ঞান হারিয়েছে।”
শায়লা চুপসে গেলো-“ভয় পেয়েছিলাম।”
রিদওয়ান আরও কয়েক কদম এগিয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে জলদগম্ভীর কন্ঠে বললো-“তুমি কি ভেবেছিলে বলো তো? সামান্য চুমুতে এতো কেন ভয় লাগবে? বিয়ের একবছর পরে একটু চুমুও কি দেওয়া যাবে না তোমাকে? এতো কেন ভয় তোমার শায়লা?”
শায়লা মুখ নিচু করলো চোরের মতো-“কোনদিন কোন ছেলের এতো কাছাকাছি যাইনি। ভয় লাগাটা স্বাভাবিক না?”
“না স্বাভাবিক না। নিজের ভাবনার লাগাম টানো শায়লা। সবসময় নেগেটিভ ভাবনা তোমার মনোজগৎ এমন ভাবে দখল করে রেখেছে যে, কোনকিছু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারো না তুমি। বিয়ের দিন মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম বলে বউ দেখা হয়নি। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে বউ অজ্ঞান হলো বলে বউ দেখা হলো না। কত কি ভেবেছিলাম, হাত ধরাধরি করে গল্প করবো সারারাত, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করবো অথচ কিছুই হলো না।”
রিদওয়ানের কন্ঠে বিরক্তি। শায়লা অপরাধী চোখে রিদওয়ানকে দেখলো। রিদওয়ান হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“কাপড় চোপড় গুছিয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে।”
শায়লা চমকে গেলো রিদওয়ানের কথায়। রিদওয়ান কি বেশি কষ্ট পেয়েছে? ঢাকায় ফিরতে চাচ্ছে কেন? তাদের তো আরও কিছুদিন থাকার কথা এখানে? শায়লা ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো-“সব গুছিয়ে নেব মানে? আমরা না থাকবো ক’দিন? আপনার বন্ধুরা আসবে সকালে?”
রিদওয়ান গম্ভীর হলো-“ওরা পথে আছে কিন্তু আমাদের ফিরতে হবে। বাড়ী থেকে ফোন এসেছিল। দাদাজান অসুস্থ, তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে।”
“মানে? দাদাজান হঠাৎ অসুস্থ হলো কি করে?”
রিদওয়ানের বিরক্তি চরমে ওঠে। সে কর্কশ কন্ঠে বললো-“তা এতোদূর বসে কি আমার জানার কথা? এতো কথা বলছো কেন শায়লা? তাছাড়া একদিকে ভাবতে গেলে ভালোই হয়েছে। এখানে থেকেই বা কি করতাম? ক্ষনে ক্ষনে তোমার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা ছাড়া? তাড়াতাড়ি করো। আর ঘন্টা পর আমাদের বাস ছাড়বে।”
বলে রিদওয়ান দাঁড়ায় না। নিজের জিনিস গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শায়লা দাঁড়িয়ে থেকে দেখলো কিছুসময়। বুঝলো রিদওয়ান বেশ রাগ করেছে এবার। নিজের উপর বিরক্ত হলো সে। কেন এমন করলো সে? জ্ঞান হারানোর কি দরকার ছিলো তার? কিন্তু কেউ রাগ করলে রাগ কিভাবে ভাঙাতে হয় তা জানা নেই তার। তাই নিজের কাপড় গুছাতে শুরু করলো। সব গুছিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। শাড়ী পাল্টে সালোয়ার কামিজ পরে বেরুলো। কানে আর গলার মালাটা খুলতে যেয়ে খুললো না। রুমে এসে চুলগুলো বেনি করে ফেললো। রিদওয়ান জানতে চাইলো-“হয়েছে তোমার?”
শায়লা স্মিত কন্ঠে উত্তর দিলো-“হ্যা।”
রিদওয়ান ফিরে দেখলো ওকে। দেখে অসন্তুষ্ট গলায় বললো-“এসব খোলনি কেন? বাসে এসব পড়ে যাবে?”
শায়লা লজ্জা পেলো এবার। সে ভেবেছিল নিজের হাতে পরিয়ে দেওয়া জিনিসগুলো শায়লার গায়ে দেখে খুশি হবে রিদওয়ান। তাড়াহুড়ো করে সবগুলো গয়না খুলে ফেলে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। ঘরের সব জায়গায় একবার করে চোখ বুলিয়ে শায়লাকে ডাকলো-“চলো। নিচে গাড়ি চলে এসেছে মনেহয়।”
শায়লা নিঃশব্দে রিদওয়ানের পিছু নিলো।

পুরোটা পথ রিদওয়ান গম্ভীর রইলো। কিছুক্ষণ পর পর বাড়ির লোকেদের ফোন আসছে। দাদুকে রাতে হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। রিদওয়ানের স্যার দেখেছেন তাকে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে অবস্থা তেমন ভালো না। রিদওয়ানকে বিচলিত দেখায়। সারাটা পথ শায়লার সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ ছাড়া একটা কথাও বাড়তি বলেনি সে। রিদওয়ান এর অবহেলাটা গায়ে লাগছে শায়লার। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখের কোনে জল জমছে। অভিমানে মন ভারী হচ্ছে। কিন্তু রিদওয়ান যেন দেখেও দেখলো না।

*****

ওরা ঢাকায় পৌঁছাল সকালে। রিদওয়ান বাস থেকে নেমেই জানতে চাইলো-“তোমাকে কে কি মহুর হোস্টেলে পৌঁছে দেব শায়লা?”
“না। আমি দাদুকে দেখতে যাব আগে।”
রিদওয়ান মাথা নাড়ে-“শোন, এখন দাদুকে দেখতে যাওয়ার দরকার নেই তোমার। তুমি বরং মহুর ওখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দাও। পরে সময় করে এসো।”
শায়লার এবার রাগ হচ্ছে। রিদওয়ান এরকম পর পর ব্যবহার কেন করছে ওর সাথে? সে কোন জবাব না দিয়ে রিকশা ডাকলো। ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিজে উঠে বসলো-“আপনার আমার সাথে আসতে হবে না। আপনি দাদুর কাছে যান।”
রিদওয়ান জোর করলোনা-“রাগ করো না শায়লা। আমি আগে গিয়ে দেখি দাদুর কি অবস্থা। তাছাড়া ওখানে বাড়ির সকলে আছে। এই সকালে আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখলে কি না কি মনে করে। ব্যাপারটা কি ভালো হবে বলো? তুমি বরং পরে এসো।”
শায়লা চুপচাপ শুনলেও বললো না কিছু। সে রিকশা নিয়ে চলে গেলো। রিদওয়ান যা বোঝাতে চাইলো তা আদৌও বুঝলো কিনা কে জানে। রিদওয়ান কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আরেকটা রিকশা নিলো। কাল রাত থেকে দাদুর জন্য চিন্তায় মাথা কাজ করছে না। হুট করে সুস্থ মানুষটার কি হলো? রিদওয়ান প্রায় ছুটতে ছুটতে আইসিইউ এর সামনে এলো। ওয়াহেদ মাথা নিচু করে বসে ছিলো। পল্লব আর জাকিয়াও আছে বাবার সাথে। রিদওয়ানকে দেখে ওয়াহেদ এগিয়ে এলো-“রিদু, এসেছিস? ডাক্তার বলছে কন্ডিশন ভালো না। তুই একটু দেখ না বাবা?”
বলতে বলতে ওয়াহেদের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল পড়ে। রিদওয়ান বাবাকে স্বান্তনা দিলো-“আমি দেখছি বাবা। তুমি চিন্তা করো না।”
রিদওয়ান আইসিইউতে ঢুকলো। তার দাদা আব্দুল রব শুয়ে আছেন আইসিইউ এর দুই নাম্বার বেডে। পালসরেট আপ ডাউন হচ্ছে। প্রেশার খুব কম দেখাচ্ছে। রিদওয়ান ইসিজি রিপোর্ট দেখলো। খুব একটা ভালো না। রাতে ব্লাড নিয়ে গেছে। দুপুর নাগাদ ব্লাড রিপোর্ট এসে যাবে। তখন বোঝা যাবে হার্টের ব্লকেজের পরিমান কেমন। এখন ইসিজি রিপোর্টের উপর নির্ভর করে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সাথে স্যালাইন চলছে। রিদওয়ান আব্দুল রবের কাছে বসলো। অনেকটা সময় তাকিয়ে রইলো পৌঢ় মুখটার দিকে। মুখটা হা হয়ে আছে। সেখানে মোটা একটা অক্সিজেন নল ঢুকানো। প্রতিদিন এমন রুগী দেখে রিদওয়ান। অভ্যাস মতো সব কাজ করে। আজ দেখে ওর মাথা কাজ করছে না। বুড়োটা তাকে না জ্বালিয়ে এভাবে শুয়ে আছে দেখে রাগ লাগছে। আব্দুল রবের দূর্বল হাতটা তুলে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়। ফিসফিস করলো-“তোমার নাতবউ আমাকে মানছে না দাদু। একবছরে একটা চুমো পর্যন্ত ঠিকঠাক দিতে দেয়নি। বলতো কি করবো আমি? একটু বুদ্ধি দাও দাদু। দাদীকে কিভাবে মানিয়েছিলে তুমি? তুমিই তো বলেছিলে, দাদী নাকি রাজি ছিল না তোমায় বিয়ে করতে। কি এমন জাদু করেছিলে যে দাদী তোমায় ছাড়া কিছু বোঝেনি জীবনে?”
আব্দুল রব কথা বলে না। মনিটরে কেবল কিছু ডিজিট অদলবদল হয়। রিদওয়ান অচেতন মানুষটাকে দেখলো। সে মন খারাপ করে বললো-“দাদু, ওই অবুঝ মেয়েটার সাথে আমার ভাব না করিয়ে মরবে না তুমি। তুমি না থাকলে ওকে পটানো হবে না আমার। বড্ড শক্ত ওর খোলস। আমি সেই খোলস ভেদ করতে পারছি না। আমাকে ফাঁকি দেবে না দাদু। না হলে আর কোনদিন কথা বলবো না তোমার সাথে। তোমাকে ফিরতে হবে দাদু, আমার জন্য হলেও তোমাকে ফিরতে হবে।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin