এরই মাঝে পর্ব-৩১+৩২

0
120

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩১

মহুয়া কে সাথে নিয়ে শায়লা এলো বিকেলে। রিদওয়ান তখন ছিলো না। শায়লা ফোন দিলে জানালো সে হোস্টেলে ফিরেছে। খানিকক্ষণ পরে আবার আসবে। জাকিয়া আর ওয়াহেদ বসে ছিলো বাইরে। শায়লা এগিয়ে গিয়ে ওদের সালাম জানালো। ওয়াহেদ শুকনো হাসলো-“শায়লা মামনী, কেমন আছো তুমি?”
শায়লা বিব্রত হয়ে জাকিয়াকে দেখলো। ঢোক গিলে বললো-“আমি ভালো আছি আঙ্কেল। দাদুর কি অবস্থা এখন? আমার দাদু ফোন দিতে দিতে পাগল বানিয়ে ফেলছে। দাদুকে একটু দেখতে চাইছে।”
ওয়াহেদের মুখের হাসি মুছে গেলো-“সেটাই তো স্বাভাবিক। আত্মার আত্মীয় অসুস্থ থাকলে কি ভালো থাকা যায়? রিদওয়ান আসলে ওকে বলবো বাবাকে দেখিয়ে দেবে তৈয়ব চাচাকে।”
শায়লা মাথা নাড়ে-“আপনারা কিছু খেয়েছেন আঙ্কেল? চা বা কফি কি নিয়ে আসবো?”
ওয়াহেদ হাসলো-“না মামনী। কিছু খাবো না এখন। তোমরা বসো আমি একটু দেখে আসি।”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। মহুয়াকে বসার ইশারা করে নিজেও বসলো এক সিট দূরত্বে। জাকিয়া এখনো একটাও কথা বলেনি ওর সাথে। সে হুট করে মহুয়াকে ডাকলো-“কি নাম তোমার?”
“মহুয়া আন্টি।”
“তুমি মেডিকেলে চান্স পেলে?”
মহুয়া হেসে মাথা দুলায়। জাকিয়া বললো-“ভালো। তোমার মা রত্নগর্ভা, সব মেয়েই ব্রিলিয়ান্ট।”
মহুয়া গদগদ হয়ে বললো-“দোয়া করবেন আন্টি।”
জাকিয়া ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করলো-“মহুয়া, তুমি কি কষ্ট করে আমার জন্য একটা রং চা আনতে পারবে? একটু বেশি করে লং আর আদা দিয়ে?”
মহুয়া শায়লার মুখপানে তাকালো চকিতে। শায়লা ইশারা দিতেই সে উঠে দাঁড়ালো-“অবশ্যই আন্টি। আমি এখনি যাচ্ছি।”
জাকিয়া মিষ্টি করে হাসলো-“সো সুইট অফ ইউ।”
মহুয়া চলে যেতেই নিরবতা ঘিরে ধরলো শায়লাকে। জাকিয়াকে তার ভয় লাগে এমনিতেই। তার উপর আজ সে শায়লাকে দেখেছে খেয়ে ফেলা দৃষ্টিতে। শায়লার কেন যেন মনেহচ্ছে মহুয়াকে চা আনার কথা বলাটা একটা অজুহাত। আসলে সে শায়লার সাথে কথা বলার সুযোগ তৈরি করলো। ভাবনায় নিমজ্জিত শায়লাকে জাকিয়া ডাকলো-“শোন, তোমরা বেড়াতে গেছিলে?”
শায়লা চমকে তাকালো জাকিয়ার মুখপানে। জবাব দেবে কি দেবে না ভেবে পেলো না। জাকিয়া ভ্রু কুঁচকে আছে। আবারও জানতে চাইলো-“তুমি আর রিদওয়ান বেড়াতে গেছিলে কুয়াকাটা? এর আগে আর কোথায় কোথায় গেছিলে? প্রায়ই যাও নাকি এমন?”
লজ্জায় শায়লার গাল লাল হলো, কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে অসহায় চোখে চারিদিকে নজর বুলিয়ে নেয়। বারবার মনে হচ্ছে রিদওয়ান চলে আসুক এখানে। উত্তরটা সেই দিক। জাকিয়া ফিসফিস করলো-“আমার ছেলেটাকে এইভাবে হাত করলে? কতদিন ধরে চলছে এসব? এমনিতে দেখলে মনেহয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারো না অথচ তলে তলে আমার ছেলের সাথে ঘুরতে যাওয়া। এ আবার কেমন ধারা মেয়ে তুমি?”
শায়লা বিরবির করলো-“আন্টি আপনি ভুল বুঝছেন। আমরা কোথাও বেড়াতে যাইনি। এইবার রিদওয়ান…”
জাকিয়া তেতে উঠলো-“ফের মিথ্যে? আমার ছেলের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছো?”
অপমানে মুক শায়লা। নিজের স্বামীর সাথে বেড়াতে যাওয়া দোষের কি করে হলো এটাই বুঝতে পারছে না সে। কি বলবে ওনাকে যে তাকে অপরাধী ভেবে বসে আছে? জাকিয়া মৃদুুস্বরে বললো-“বাবা আবেগে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমার কি মনেহয় তোমার সাথে আমার ছেলের বিয়েটা হয়ে ঠিক হয়েছে?”
জাকিয়া জুলজুলে চোখে তাকিয়ে আছে। শায়লা হুট করে বলে ফেললো-“আন্টি প্রতিবার দেখা হলেই আমাকে অপমান করেন এটা কিন্তু ঠিক না। আপনার যদি এই বিয়ে নিয়ে এতোই আপত্তি তবে সেদিন চুপ ছিলেন কেন? আমি আপনার ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি। চাইলে আমিও অশান্তি করতে পারি।”
জাকিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। সে ভেবেছে সে টিপ্পনী কাটবে আর শায়লা মুখ বুঁজে মেনে নেবে। উল্টো জবাব পেয়ে জাকিয়ার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট্ট মেয়েটার স্পর্ধা দেখে তার মেজাজের পারদ ধাই ধাই করে বেড়ে গেলো। ভীষণ খারাপ ভাষায় কিছু বলবে ভেবে মুখ খুলবে এমন সময় ওয়াহেদকে দেখা গেলো-“আব্বার শরীরের কন্ডিশন হুট করে খারাপ হচ্ছে জাকিয়া। রেসপন্স করছে না । ডাক্তাররাও কিছু বলছে না। আমার আব্বা…”
ওয়াহেদ ঝরঝর করে কাঁদে। রিদওয়ানকে দৌড়ে আসতে দেখা গেলো-“বাবা, কি হয়েছে? ডাক্তার কি বলেছে তোমাকে? আচ্ছা আমি দেখছি দাঁড়াও।”
বলেই রিদওয়ান পাগলের মতো ছুটে আইসিইউ এর মধ্যে ঢুকে গেলো। মহুয়া চা নিয়ে এসে দেখে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দুইবোন কি করবে বুঝে পেলো না। বোকার মতো এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলো। একঘন্টার মধ্যে রিদওয়ানের বাড়ির লোকে আইসিইউ এর সামনে ভীড় লেগে গেলো। সবাই মন খারাপ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর মধ্যে তাদের দাদাজান ফোন দিচ্ছে বারবার। বন্ধুর খবর জানতে চাইলো। শায়লা কিছু বলতে পারছে না। দাদাজানের চোখ ছলছল করছে। যেন সে বুঝতে পারছে কি হচ্ছে এখানে। সে বারবার আকুল গলায় বলছে-“শায়লা বু, আমার দোস্তকে একটু দেখাও। ওকে আমি একটু দেখতে চাই। আমার দোস্ত কেমন আছে একটু তারে দেখবো।”
শায়লার বুক কাঁপছে। সে ভীড়ে তাকিয়ে দেখলো রিদওয়ান এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। ওয়াহেদ ঠায় বসে আছে, তাকে আগলে ধরে আছে পল্লব আর আসাদ। শায়লা হুট করে রিদওয়ানকে ডাকলো-“শুনছেন।”
রিদওয়ান বুক উথাল পাথাল হচ্ছে। তবুও শান্ত চোখে শায়লার দিকে তাকিয়ে বললো-“বলো। কি হয়েছে?”
“দাদাজান খুব অস্থির হচ্ছে। তাকে একটু দাদাজানকে দেখিয়ে দিন না।”
শায়লা মিনতি করতেই রিদওয়ান মাথা নাড়ে-“দাদুর এই অবস্থা দেখলে তোমার দাদাজান সইতে পারবেনা না শায়লা।”
শায়লা মানলো না-“তবুও দেখান। না হলে এমনিতেও দাদাজান অসুস্থ হয়ে যাবে।”
রিদওয়ান মানা করতে যাচ্ছিল ওয়াহেদ বললো-“দেখিয়ে দে রিদু। মানা করিস না।”
রিদওয়ান চুপ করে থাকলো। নিরবে শায়লার হাত থেকে ফোন নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। ভিডিও কল করে দাদুকে দেখালো। তৈয়ব মাওলানা কাঁদছে বন্ধুকে দেখে। তার ছোটবেলার সাথী আব্দুর রব, তার বুড়ো কালের একমাত্র সঙ্গী আব্দুর রব, তার সুখ সুখের একমাত্র অংশীদার আজ মৃত্যুর দুয়ারে। তৈয়ব মাওলানা হাউমাউ করে কাঁদে। বারবার ডাকে-“আব্দুর রব, আমাকে একা করে যাইও না বন্ধু। আমি কার কাছে মনের কথা বলবো? কে আমার বিপদে পাশে থেকে সাহস দিবে? রব দোস্ত, ফিরে আসো আমার বুকে।”
তৈয়ব মাওলানার বিলাপ কি পৌঁছে আব্দুর রবের কানে? সে এখন বহুদূরের যাত্রার পথে। সে যাত্রায় সে দেখতে পায় তার সঙ্গী স্ত্রীকে যে ভীষণ খুশি হয় তাকে দেখে-‘আপনে আসলেন তাহলে? এতদিনে সময় হইলো?’
‘ঘরবাড়ি যোগ্য হাতে দিয়ে আসতে একটু সময় লাগলো বউ। কিন্তু তুমি দেখি আমারে ছাড়া ভালো আছো।’
‘কইছে আপনেরে। আমি তো আমার রিদুই লাইগা খুশি। ওরে আপনে পছন্দ কইরা বিয়া দিছেন শায়লার লগে। কি যে খুশি হইছি আমি।’
‘কিন্তু আমার ভয় লাগে ওয়াহেদের মা। ওয়াহেদের বউ তো শায়লারে দেখতে পারে না। আমি টের পাই। যদি রিদুরে সংসার করতে না দেয়?’
স্ত্রী ধমক দিলেন তাকে-‘পাগল হইছেন আপনে। জাকিয়া কি করবে সেই চিন্তা আমি করি না। দেখবেন রিদু ঠিকই শায়লারে আগলায়া রাখবো। আমাগো বাড়িতেই ওরা সংসার করবো। দুই বুড়া বুড়ি ওগো সুখ দেখুম।’
‘সত্য বলতেছ তুমি! তাই যেন হয় গো। আমার রিদু যেন আমার বিশ্বাসের মান রাখে।’
‘শোনেন, এতো চিন্তা বাদ দেন। আপনের সব কাম শেষ। এইবার আমার সাথে আইসা বসেন। অনেক গল্প করমু আপনের সাথে।’
‘আসতেছি তো বউ। আমারও অনেক গল্প জইমা আছে। এখন আর আমাদের কাম কি খালি বইসা গল্প করা ছাড়া। সারাজীবন তোমারে সময় দিতে পারি নাই এখন সময়ের অভাব হবে না ওয়াহেদের মা। কতো গল্প করবা করো।’
রিদওয়ান টের পাচ্ছে তার দাদুর ঠোঁট নড়ছে অনবরত। দাদুর চেহারায় খুশির আভা। চেহারাটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। রিদওয়ান কান পাতলো দাদুর মুখের কাছে। কিছুই বোঝা গেলো না। দাদুর কি হ্যালুসিনেসন হচ্ছে? রিদওয়ান ভয় পেয়ে দাদুর হাত জড়িয়ে ধরে। মনিটরে দৃষ্টি গেলো আচমকা। হার্টবিট খুব দ্রুত কমছে দাদুর। রিদওয়ান চিৎকার করলো-“ডাক্তার, দাদুর প্রেশার ফল করছে।”
একটা হুড়োহুড়ি পড়লো রুমে। কয়েকজন ডাক্তার ছটে এসেছে। রিদওয়ানকে সরিয়ে দিলো দ্রুত। ডিউটি ডাক্তার নার্সকে ডাকলো-“ইনজেকশনটা দাও কুইক।”
রিদওয়ানের চোখের সামনে ছুটোছুটি হচ্ছে কিন্তু ও চোখে ঝাপসা দেখছে সব। কিছুক্ষণ পর কানে দু’টো শব্দ এলো-“শক দাও শক দাও।”
রিদওয়ানের পা আঁটকে গেছে যেন। প্রতিদিন ডিউটিতে একটা দু’টো মৃত্যু দেখতেই হয় রিদওয়ানকে। তবুও আজ যেন সবটা কল্পনা লাগছে। মনেহচ্ছে মিছে হয়ে যাক এই মুহুর্তটা। স্বপ্ন হোক। তার দাদু বেঁচে ফিরে আসুক, ছোট বড় আবদার করুক তার কাছে। হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাত পড়লো রিদওয়ান এর কাঁধে-“উই আর সরি রিদওয়ান। ইয়োর দাদু ইজ নো মোর।”

আচমকা নিরবতা নেমে এলো পরিবেশে। দূরে একটা কাক ডেকে গেলো। আকাশে মেঘ ডাকলো অসময়ে। পরিবেশ দেখে শায়লার কেন যেন ভয় করতে লাগলো। মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটবে যাতে তার জীবনটা আবারও এলোমেলো হয়ে যাবে। অশুভ শঙ্কা মন নাড়িয়ে দিয়ে গেলো যেন।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩২

ভোরে ঘুম ভেঙেছে রিদওয়ানের। গত তিনদিন ধরেই ভোরে উঠছে সে। আজও নিয়ম করে নামাজ সেরে দাদুর কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করলো তারপর দু’হাত তুলে দোয়া করলো দাদা দাদীর জন্য। দোয়া করতে করতে রিদওয়ান এর চোখ দুটো ভিজে যায়। টপটপ করে জল ঝরে। বুড়োটা তার কতটা জুড়ে ছিলো তা আগে বোঝেনি কেন সে? সেই ছোট থেকে দাদাদাদীর সাথে তার আলাদা টান। দু’জন তাকে বেশুমার আদর দিয়েছে। বড় হতে হতে রিদওয়ানও যেন দুই বুড়োবুড়ির হাতের লাঠি হয়ে উঠলো। ছোট ছোট আবদার করতো তার কাছে। অধিকারে অনেক কিছু চাপিয়ে দিত। রিদওয়ান বিরক্ত হতো আবার ভালোও লাগতো তার। দাদীর মৃত্যুর পরে সেই যেন দাদুর নির্ভরতার একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠলো। দিনে দিনে দাদা নাতীর বন্ডিং বাড়তে বাড়তে বিয়ে অব্দি এলো। দাদুর প্রতি আকন্ঠ মায়ার রিদওয়ান ডুকরে উঠলো। ওয়াহেদ ছেলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে হাত রাখতেই রিদওয়ান নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। ওয়াহেদ অপরাধী গলায় বললো-“বাবার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি রিদু। তার বড় ছেলে হিসেবে আমি ব্যার্থ।”
রিদওয়ান কিছু বললো না। বাবাকে স্বান্তনা পর্যন্ত দিলো না। জানতে চাইলো-“চাচ্চুকে খবর দিয়েছ?”
“হুম। সে অসুস্থ তাই আসতে পারেনি। আর তোর ফুপুদের তো জানিসই।”
ওয়াহেদ ভেজা গলায় জবাব দেয়। রিদওয়ান চুপ থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“আমি ভেতরে যাচ্ছি।”
ওয়াহেদ কিছু বললো না। ভেজা চোখে সে তাজা কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রিদওয়ান এলো দাদুর ঘরে। বাতি জ্বালিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা সব। এই ঘরে একটা সিন্ধুক আছে। দাদুকে দেখতো এটায় তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গচ্ছিত রাখতো৷ তালা দেওয়া সিন্দুকের চাবিটা পেলো বালিশের তলায়। রিদওয়ান কি ভেবে সিন্দুক খুললো। সিন্দুকের মধ্যে কিছু কাগজপত্র, একটা ছোট গয়নার বাক্স আর একটা পুরনো আমলের ডায়েরি। রিদওয়ান কৌতুহলে ডায়েরি হাতে নিলো। উল্টে পাল্টে দেখলো। কিছু কিছু পাতায় ছোট ছোট করে লেখা আছে। রিদওয়ান ডায়েরি হাতে নিয়ে বসলো বিছানায়।
“ওয়াহেদের সাথে তৈয়বের মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলাম। হুট করে ওয়াহেদ ঢাকা থেকে তার ভার্সিটির কোন মেয়েকে বিয়ে করে আনলো একা একা। বড্ড কষ্ট পেলাম। ওয়াহেদ কেন করলো এমন? আমার বন্ধুর কাছে কেন আমার মাথা নিচু করলো? বিয়েটা তো আমি ওর কাছ থেকে মতামত নিয়েই ঠিক করেছিলাম। ও নিজ মুখে বলতে পারতো, অন্য কাউকে পছন্দ করে ও। আমি কষ্ট পেলেও মেনে নিতাম। সন্তান বাবা মাকে না বুঝলে সেই বাবা মায়ের কষ্টের শেষ থাকে না। তাদের এমন অবস্থা হয় যে না পারে সইতে না পারে কইতে।”
রিদওয়ান পাতার পর পাতা পড়ে যায়। টুকরো টুকরো কত স্মৃতি জমা করেছে বুড়ো। প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে রিদওয়ান ডায়েরির শেষদিকে এলো। তাকে নিয়ে দাদু কিছু লিখেছে কিনা তা দেখতে। একটা টুকরো লেখা পেলো-“রিদওয়ানের মধ্যে নিজেকে দেখি আমি। রিদওয়ান আমার মতো শান্ত, ধীর স্থির। দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ। ওর চেহারার দিকে তাকালেই মনটা তৃপ্তিতে ভরে যায়৷ আমার ইচ্ছে ছিল রিদওয়ান ডাক্তার হবে। আমি একটা হাসপাতাল দেব গ্রামে। রিদওয়ান সেই হাসপাতালের ডাক্তার হবে আর এই এলাকার মানুষের সেবা করবে। সবাই গর্বভরে বলবে, ‘ওই দেখো আব্দুর রবের নাতি রিদওয়ান। যেমন ভালো ডাক্তার তেমন ভালো মানুষ।’ রিদওয়ান এর দাদী অসুস্থ হইলো, সে আমাকে ছেড়ে শহরে যাবে না চিকিৎসা নিতে। কিন্তু এই গ্রামে ভালো হাসপাতাল নাই। মানুষটা অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেলো। আমার মনের ইচ্ছা পাকাপোক্ত হলো। আল্লাহর ইচ্ছায় রিদওয়ানও ডাক্তারি পড়ছে। কিন্তু ওকে মনের ইচ্ছা বলতে ভয় লাগে। যদি আমাকে ভুল বুঝে আমার বাকী সন্তানদের মতো দূরে সরে যায়। ইদানীং একটা চিন্তা খুব মগজ নষ্ট করতেছে। আমার পরে কে এই পরিবারের পরিচয় বাঁচিয়ে রাখবে? এই সম্পদ, ফসলি মাঠ যা আমি বহু কষ্টে অর্জন করেছিলাম সব কি পোকায় খাবে? কেউ কি দেখার থাকবেনা? ছেলেমেয়েরা কেউ গ্রামে থাকতে চায় না। আমি না থাকলে তারা হয়তো সব বেঁচে দেবে। তিলতিল করে রক্ত পানি করে গড়ে তোলা এই বাসাবাড়ি একদিন ভুতের বাড়ি হবে এই ভেবে মন চঞ্চল হয়। অনেক ভেবে একটু স্বার্থপর হলাম এবার। চালাকি করে রিদওয়ানের বিয়ে দিলাম তৈয়বের নাতীনের সাথে। যদি এরপরে রিদওয়ান গ্রামমুখী হয়।”
রিদওয়ানের বুক ধরফর করে। কি লিখেছে দাদাজান এসব? রিদওয়ান অস্থির হয়ে পাতা ওল্টায়। কয়েক পাতা পর আবার লেখা-“রিদওয়ান দাদাভাই, যদি কখনো এই ডায়েরি তোমার হাতে আসে সেই আশায় লিখে রাখলাম। আমি তোমার দাদা আব্দুর রব, তোমাকে আমার সমস্ত সম্পদের ওয়ারিশ করে গেলাম। এরপর তুমি আমার এই সম্পদের যা ব্যবস্থা করার করবে। আমি জানি, এই সম্পদের ওয়ারিশ হিসেবে তোমার চাইতে যোগ্য কেউ নাই। ভালো থেকো ভাই। আমার আর তৈয়বের বন্ধুতের স্মৃতিস্মারক হিসেবে তোমার আর শায়লার থেকে উত্তরাধিকার পাওয়ার দাবী করে গেলাম। জীবনে কারো কাছ থেকে কিছু চাই না, পাওয়ার আশা করি নাই। এই প্রথমবারের মতো তোমার কাছে কিছু চাইলাম। তুমি সেই চাওয়া পূরণ করবা কিনা সেইটা একান্ত তোমার ইচ্ছা। ভালো থাকো দাদাভাই। আল্লাহ সর্বদা তোমার মঙ্গল করুন।”

*****

“শায়লা, এখনো ঘুমাস কেন? ওই বাড়ি যাবি না?”
রুবিনার ডাকে মাথা তুললো শায়লা-“কেন যাব? কি দরকার?”
রুবিনার মেজার তেতে গেলো-“ও কি কথা শায়লা? তোর শশুরবাড়ির সবাই আছে সেইখানে। যাবি না কেন? রিদওয়ানকে অন্তত দেখলে পারিস।”
“সে কি ছোট মানুষ যে তাকে দেখা লাগবে? আর ওই বাড়ির কারো আমাদের প্রয়োজন নাই। শুধু শুধু যায়ে চেহারা দেখাব কেন?”
রুবিনার ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে মেয়ের শিওরের কাছে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-“”তোর কি হইছে শায়লা? এমন করতেছোস কেন? ওরা এতোবড় শোক পাইছে, রিদওয়ান ছেলেটা দাদুর বড় ন্যাওটা ছিলো। তোর এখন ওর পাশে থাকা দরকার। বউ তুই ওর, ওকে স্বান্তনা দিতে হবে তোরই।”
শায়লা মায়ের কোলে উঠে এলো। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করলেও বলতে পারলো না। ছোট করে বললো-“রিদওয়ানের সাথে ওর পরিবার আছে মা। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো।”
রুবিনার এবার সত্যি কপালে ভাজ পড়লো-“তোর কি রিদওয়ান এর সাথে ঝগড়া হইছে শায়লা? এতোদিনেও জামাই এর প্রতি টান আসে নাই কেন?”
শায়লা উঠে বসলো, অসহায় কন্ঠে সুধায়-“কি চাও মা? সকাল থেকে রিদওয়ানকে নিয়ে পড়লে কেন?”
রুবিনা মুখ শুকনো করে বললো-“খাবার বানাইছি। তোর দাদু ওর জন্য বইসা আছে। তোরে নিয়ে ওই বাড়ি যাবে।”
শায়লা কোন কথা না বলে উঠলো। রুবিনা অবাক হলো-“কই যাস?”
“হাতমুখ ধুয়ে দাদুর সাথে ও বাড়ি যাই। না হলে তো আজ আমার খাওয়া জুটবে না।”
রুবিনা হেসে দেয়। মেয়েটা কেন যে সবসময় এতো জেদ করে।

শায়লাকে দেখেই ওয়াহেদ ডাকলো-“শায়লা মামনী, তুমি এসে খুব ভালো করেছ। রিদুটাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে জানো তো? একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। একটু দেখো তো মা তোমার সাথে কথা টথা বলে কিনা।”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সেখান থেকে সরে গেলো।
জাকিয়া ওয়াহেদকে চোখ দিয়ে ধ্বংস করতে চাইলো। ওয়াহেদ পাত্তা দিলো না। পল্লবীকে আদেশ করলো সবাইকে নাস্তা দিতে। তৈয়ব মাওলানা চুপচাপ বসে আছে উঠোনে। ওয়াহেদ ডাকলো-“চাচা, আমরাতো চলে যাব। রিদওয়ান থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু ওকে একা রাখতে চাইছি না। শায়লা থাকলে আপনাদের সমস্যা নেই তো?”
তৈয়ব মাওলানা চুপ থেকে উত্তর দিলো-“সমস্যা কেন থাকবে? শায়লা তার বিয়ে করা বউ। তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমাদেরও নাই। চাইলে রিদওয়ানকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাইতে পারি।”
ওয়াহেদ বললো-“ও যেতে চাইলে নেবেন। তাহলে আমরা চিন্তা মুক্ত থাকতে পারবো। পারলে আমি ক’দিন ওর সাথে থেকে যেতাম। কিন্তু আমার ব্যবসার কাজ বলে ছেলেটাকে একা ছাড়তে হচ্ছে।”
“তুমি ভাইবো না। আমরা ওর খেয়াল রাখুম।”
“জানি চাচা। আব্বার পরে আপনিই আমাদের আপনজন।”
ওয়াহেদের কথা শোনা মাত্রই তৈয়ব মাওলানা ডুকরে কেঁদে উঠলো।

*****

“কে?”
রিদওয়ান খানিকটা বিরক্ত হলো। ওপাশ থেকে মৃদুস্বরে গুঞ্জন উঠলো-“আমি শায়লা।”
রিদওয়ান দরজা খুলে দিলো। শায়লা ঢুকতেই আবার দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শায়লা এগিয়ে এসে ওর কাছে দাঁড়ায়-“আপনার কি শরীর খারাপ? এই ঘরে এসে শুয়েছেন কেন?”
রিদওয়ান চোখ বুঁজে উত্তর দিলো-“এই ঘরে থাকলে মনেহচ্ছে দাদাজানের কাছাকাছি থাকছি।”
শায়লা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে ভেবে পেলো না। রিদওয়ান কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে শায়লাকে ডাকে-“তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো এখানে বসো।”
নিজে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো রিদওয়ান। শায়লা বসতেই ওর কোলে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিলো-“চুলগুলো টেনে দাও তো। মাথাটা খুব ব্যাথা করছে।”
শায়লা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। রিদওয়ান এতো অধিকার নিয়ে কথাটা বললো যেন কত দিনের দাম্পত্য তাদের। রিদওয়ান এর এতো স্বাভাবিক আচরণ কেমন অদ্ভুত লাগে ওর কাছে। জীবনে প্রথম পুরুষের এমন স্পর্শে শায়লার শরীর শিরশির করে উঠলো। পা দু’টো যেন অসার হয়ে গেলো। এ কেমন অনুভূতি? শায়লার শরীর না চাইতে বেয়ারা আচরণ করছে। বুক ধুকপুক করেই যাচ্ছে অনবরত। মনকে কড়া শাসনে রেখে শায়লা রিদওয়ানের মাথায় হাত রাখে। সিল্কি চুলগুলো আলতো হাতে টানে। আরামে চোখ বুঁজে এলো রিদওয়ানের। সে পাশ ফিরে শায়লার কোমড় জড়িয়ে ধরে। রিদওয়ান এর উষ্ণ নিঃশ্বাস শায়লার পেটের উপর আছড়ে পড়ছে। এবার শরীরে কম্পন টের পেলো শায়লা। অসহ্য অনুভূতিতে টিকতে না পেরে ফিসফিস করলো-“কি করছেন? ছাড়েন আমাকে।”
রিদওয়ান ছাড়লো না, জড়ানো গলায় বললো-“তুমি আমাকে ভালোবাসো না কেন শায়লা? একটু কাছে আসতে চাইলে দূরে ঠেলে দাও। আমি কি চাই তা একটুও বুঝতে চাও না। কেন এতো কঠোরতা শায়লা? একটু সহজ হলে কি হয়? দাদু কি বলেছে জানো?”
শায়লার অস্থির লাগে। সে জানতে চায় না দাদু কি বলেছে। রিদওয়ান আগে ছাড়ুক তাকে। সে ব্যাকুল হয়ে নিবেদন করলো-“ছাড়েন প্লিজ।”
রিদওয়ান তাকে ছাড়লো না। উল্টো ভয়াবহ একটা কাজ করে ফেললো। সে শায়লার পেটে মুখ ঘষলো তুমুল অনুভবে। চুমো দিলো পরপর কয়েকটা। শায়লা থরথর কেঁপে ওঠে। তার শরীর উত্তাপ ছড়াচ্ছে। মন তীব্র ভাবে চাইছে বেয়ারা আচরণ করতে। বাধ্য হয়ে রিদওয়ানের চুল টেনে ধরলো শায়লা। রিদওয়ান আচমকা তাকে ছেড়ে উঠে বসলো। তার চোখে চোখ রাখলো। টকটকে লাল চোখ রিদওয়ানের। শায়লা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে। রিদওয়ান দু হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকলো। শায়লা বিস্মিত, হতভম্ব। মানুষটা কি করতে চাইছে? দাদু মারা গেছে আজ চতুর্থদিন, বাইরের ঘরে একগাদা লোক। এর কি মাথা খারাপ হয়েছে? তাছাড়া শায়লা এতোদূর ভাবেইনি তাদের সম্পর্ক নিয়ে। এখন আবেগে ভেসে যাওয়া মানে শরীরের চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করা। সবটা বুঝে উঠে দাঁড়ালো শায়লা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে বলে। আচমকা হাতে টান পড়লো। মুহুর্তের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করলো রিদওয়ানের বুকের তলায়। পাগলের চুমো দিচ্ছে ওকে। কিছু বলার আগেই ওর অধর জোড়া বেদখল হলো। হাত দু’টো বন্দী হলো রিদওয়ানের হাতের মাঝে। রিদওয়ানের আগ্রাসী আচরণে শায়লা বাধা দিতে পারলো না। তার শরীর মন দুটোই অবাধ্য আচরন করছে। শরীর তীব্রভবে রিদওয়ানকে চাইছে, মন রিদওয়ানকে তীব্র ভাবে বাঁধা দিতে চাইছে। দোটানায় ভুগে রিদওয়ানের কাছে শায়লা ধরাশায়ী হলো দ্রুত। শুধু মুদে থাকা নয়নের কোল ঘেঁষে জলের ধারাটা থামলো না।

চলবে—
©Farhana_Yesmin