#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩৫
শায়লার জীবনে রিদওয়ান যেমন আচমকা এসেছিল তেমন আচমকাই যেন হারিয়ে গেলো। সেদিনের পর থেকে রিদওয়ানের ছায়াও পড়েনি শায়লার জীবনে। এমনকি যারা এতোদিন রিদওয়ান এর কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো তারা ভুলেও রিদওয়ান এর নাম উচ্চারন করে না শায়লার সামনে। এই যে মহুয়া মেডিকেলে পড়ছে, রিদওয়ান ভাইয়ার নাম ডেকে ডেকে হয়রান হতো সেও বলে না আর। এতো কাছাকাছি থেকেও বোনের সাথে কদাচিত দেখা হয় শায়লার। মহুয়া ভীষণ ব্যস্ত থাকে। ক্লাস পড়া তারপর টিউশন এক দৌড়ের জীবন তার। এতো সময় কোথায় তার।
শায়লা নিজেও দৌড়ের উপর থাকে। ক্লাস এক্সাম পড়ালেখা তারউপর দেড় বছর আগে শখের বশে ইউটিউবে নিজের একটা ভিডিও চ্যানেল খুলেছে। সেখানে সায়েন্সের সাবজেক্টগুলোর ক্লাসের ভিডিও আপলোড দেয় নিয়মিত। এই কাজে প্রচুর সময় ব্যায় হয় শায়লার। গত দেড় বছরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ইউটিউব চ্যানেলের গ্রোথ ভালোই হয়েছে। বছর খানেক হলো ফেসবুক পেজ খুলে সেখানেও রেগুলার ভিডিও আপলোড দেয়। তরতরিতে ভিউ বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে ইউটিউব চ্যানেলের সাবসক্রাইবার। শায়লাও অন্য দিকে মন দেওয়ার সময় করতে পারে না। তবে রিদওয়ানকে একদম যে মনে পড়ে না এমন বললে ভুল হবে। শাওয়ার নিতে গিয়ে বুকের খাঁজে কালো হয়ে থাকা দাগটায় নজর গেলে রিদওয়ানকে মনে পড়ে তার। হুটহাট গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শায়লা চুপ করে বিছানায় বসে থাকে। ভীষণ হাসফাস লাগে তার। কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে-“তুমি না ডাকলে আর কোনদিন আসবো না তোমার সামনে। আজকের পর থেকে তুমি আমাকে ঘেন্না কোরো শায়লা তাতে তোমার বেঁচে থাকতে সুবিধা হবে।”
শায়লা চমকে ওঠে। আশেপাশে তাকিয়ে আঁতিপাঁতি খোঁজে কথা বলা মানুষটাকে। খুঁজে না পেয়ে একসময় বোঝে তার অস্তিত্ব নেই রুমে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের বুকের গভীর থেকে উঠে আসা কান্না দমন করে। চোখ দুটো অবশ্য অবাধ্য হয়ে যায়। দরদরিয়ে জল গড়ায় দু’চোখ বেয়ে। কেন কাঁদছে তাও যদি বুঝতো শান্তনা পেতো। শেষ স্মৃতিটা এতো কুৎসিত তবুও কেন রিদওয়ানকে ঘৃণা করতে পারে না? কেন বুক জুড়ে হাহাকার হয়? শায়লা মুখে পানি দেয়, এক কাপ চা বানিয়ে এনে পড়ার টেবিলে বসে। বই টেনে নিয়ে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। তার মন পড়ে থাকে এলোমেলো ভাবনায়। ইদানীং মনেহয় ছোট্ট একটা শহর ঢাকা। আগে কারণে অকারণে রিদওয়ানের সাথে দেখা হতো অথচ গত দুই বছরের বেশি সময়ে একদিনও হয়নি কেন? এও কি সম্ভব? ক্লান্ত অবসন্ন শায়লা আবার বিছানায় আসে। এপাশ ওপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে যায়। এভাবেই ভালো মন্দ মিলিয়ে দিন কাটছে তার।
*****
অনেকদিন পরে সকালের দিকে ওয়াহেদের ফোন এলো বলে অবাক হলো শায়লা। এক ওয়াহেদ নিয়ম করে তার খোঁজ রাখে। কোন সমস্যা আছে কিনা, কিছু প্রয়োজন আছে কিনা সামান্য দু’টো লাইন তবুও শায়লার ভালো লাগে। সেই সাথে কিঞ্চিৎ অসস্তিবোধ হয়। ওয়াহেদ এতোদিনে একবারও রিদওয়ানের কথা বলেনি ওর কাছে। এমনকি জানতেও চায়নি ওদের ব্যাপারে। তবুও স্বাভাবিক আচরণ করে ওর সাথে। এটা তাকে সত্যি অবাক করে। ওয়াহেদের ফোন বলেই তাড়াহুড়ো করে ফোনটা রিসিভ করে শায়লা-“আঙ্কেল, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”
“আছি মোটামুটি। আম্মু, তুমি কেমন আছো? এই বাবাটার একবারও খোঁজ নাও না। খুব রাগ করেছি তোমার উপর।”
ওয়াহেদের কথায় থতমত খেলো শায়লা। লজ্জাও কম পেলো না। সত্যিই সে নিজ থেকে ফোন দেয়না কখনো। মিনমিন করে উত্তর দিলো-“সরি আঙ্কেল। আসলে এতো ব্যস্ত থাকি যে সময় করে উঠতে পারি না। আম রিয়েলি সরি।”
ওয়াহেদ হাসলো মৃদুস্বরে-“তাও ঠিক। তুমি ভীষণ ব্যস্ত এটা তো জানা কথাই। যদিও পড়ালেখার পাঠ চুকেছে অনেক আগে তবুও মাঝে মাঝে তোমার ক্লাসগুলো দেখি। নতুন করে অংক শিখছি। খুব মজা লাগছে জানো তো। হা হা হা।”
ফোনের ওপাশে শায়লা লাজুক হেসে নিরব রইলো। ওয়াহেদ বললো-“তুমি কিন্তু দারুণ পড়াও শায়লা। কে কে তোমার ভিডিও দেখে জানলে অবাক হবে। তোমাকে নিয়ে প্রাউড হয় মেয়ে।”
নিজের প্রসংশা শুনে দমে গেলো শায়লা। ওয়াহেদ বুঝেই কথা পাল্টে নেয়-“শোন, তুমি তো আমাদের বাড়ির রাস্তা ভুলেই গেছো। আমাদেরকেও ভুলে গেছ। এটা কি ঠিক?”
শায়লা বলার কিছু খুঁজে পেলো না। ওয়াহেদ বলে উঠলো-“রিদওয়ানের ফ্লাইট তো আগামীকাল। তুমি আসছো তো?”
শায়লার ভ্রু কুঁচকে গেলো। রিদওয়ানের ফ্লাইট মানে? বুকটা ধক করে উঠলো। কোথায় যাচ্ছে রিদওয়ান? সে প্রশ্ন করেই ফেললো-“ফ্লাইট মানে?”
“ও দুই বছরের জন্য ইউকে যাচ্ছে এমডি করতে। অনেকদিনের জন্য যাচ্ছে বলেই তোমাকে বলা। অবশ্য রিদওয়ান বলেছিল তোমাকে না জানাতে। তোমার মন খারাপ হবে তাই। আমার মনে হলো এতোদিনের জন্য যাচ্ছে, একবার দেখা করা উচিত তোমাদের। আমি জোর করবোনা তোমাকে। যদি ইচ্ছে হয় তাহলে এসো রিদওয়ানের ভালো লাগবে।”
শায়লার বুকটায় যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনেহচ্ছে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। সে কোনরকমে বললো-“আমি চেষ্টা করবো আঙ্কেল। কোন শিডিউল না থাকলে যাব। এখন আবার ল্যাব এক্সাম চলছে তো।”
ওয়াহেদ খানিকটা মন খারাপ করা গলায় বললো-“কষ্ট করে হলেও এসো। ছেলেটা কিছু না বললেও জানি তোমাকে দেখলে খুশি হবে। বাকীটা তোমার ইচ্ছে।”
“জ্বি।”
বলে তাড়াতাড়ি ফোন নামিয়ে রাখলো শায়লা। তার ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে। একগ্লাস পানি খেলো শায়লা। ছটফট করে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু শান্তি পেলো না। কি হচ্ছে এসব? রিদওয়ান দেশের বাইরে যাচ্ছে তাকে একটিবার জানালো না? এমনকি তার পরিবারের লোকজনকেও জানালো না? দাঁতে দাঁত চাপে শায়লা। রিদওয়ানও তাহলে ধোঁকাবাজি করলো তার সাথে? দাদাজানের উপর ভীষণ রাগ উড়লো শায়লার। খুব তো গর্ব করতো রিদওয়ানকে নিয়ে।
এবার যেয়ে হাতে কলমে প্রমান দেখাবে, তার বন্ধুর নাতি কিভাবে তাকে ধোঁকা দিলো। কেন যে এই পুরুষ জাতিকে বিশ্বাস করে না। তারপর দেখবে কি বলে বুড়ো? শায়লা উঠে বসলো আবার। কি মনে করে মহুয়াকে ফোন দিলো। দু তিনবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো মহুয়া-“বড়পা, সকালের জরুরি ক্লাসে আছি। কি জন্য ফোন দিয়েছিস তাড়াতাড়ি বল।”
“রিদওয়ান ইউকে যাচ্ছে জানিস?”
উত্তেজনায় বোনের ক্লাস চলাকালীন সময়েও কথা শুরু করলো শায়লা। মহুয়া ততোধিক গম্ভীর হয়ে শান্ত গলায় জবাব দিলো-“জানি। না জানার কি আছে?”
শায়লার আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। সে চেচিয়ে উঠলো-“জানিস? রিদওয়ান বলেছে তোকে? তাহলে আমাকে বলিসনি কেন?”
“তুই তো জানতে চাসনি কখনো, আমি খামোখা সেধে সেধে বলে কি তোর হাতের মার খাবো? শোন বড়পা, ক্লাস চলছে আমি রাখছি। পরে কথা বলবো।”
শায়লা আরও কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু মহুয়া ফোন কেটে দিয়েছে। রাগে গা চিরবিড়িয়ে ওঠে শায়লার। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মাকে ফোন দিলো-“মা শুনেছ কিছু?”
সকালের এই সময়টাতে রুবিনা ভীষণ ব্যস্ত থাকে। মেয়ের ফোনে বিরক্ত হলো-“কি জানবো?”
“তোমার আদরের রিদওয়ান নাকি ইউকে যাচ্ছে?”
“জানি। এই বলতে সাতসকালে ফোন দিয়েছিস? ক্লাস নেই আজ তোর?”
রুবিনার কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। শায়লা অসহিষ্ণু হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“জানো মানে? তোমরা সবাই জানো আর আমি জানি না? কেন?”
“তোর জানতে হবে কেন? তুই তো ওকে পছন্দ করিস না। তাহলে তোকে বলবে কেন?”
রুবিনার কথায় শায়লা দমে গেলো। মিনমিনিয়ে বললো-“তাই বলে জানাবে না? আমি ওর বউ না? আমার তো অধিকার আছে ওর সব ব্যাপারে জানার।”
রুবিনা হতবাক কন্ঠে জানতে চাইলো-“তুই পাগল টাগল হয়ে গেছিস নাকি শায়লা? কি বউ বউ লাগিয়ে রেখেছিস? গত দুই বছরে একবারও ফোন দিয়েছিস ওকে? ও কি করছে না করছে জানতে চেয়েছিস?”
শায়লা ঝাঁজিয়ে উঠলো-“আমি কেন ফোন দেব? ওর না আমার খবর রাখা উচিত ছিলো। আগলে রাখার দায়িত্ব স্বামীর হয় বউয়ের না।”
রুবিনা মেয়েকে ধমক দিলো-“বেশি বকবক করিস না শায়লা। ওর কি দায়িত্ব সেটা ও ভালোই জানে। তোর সেসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। তাছাড়া দু’জন দু’জনার মতো আছিস থাক না। তোর এতো কেন লাগছে ওকে নিয়ে? মন দিয়ে পড়ালেখা করছিস তাই কর।”
শায়লা বিস্মিত হলো-“একটা ছেলে তোমার মেয়েকে বিয়ে করে তার সাথে অন্যায় করলো আর তুমি এখনো তার পক্ষে কথা বলছো? তুমি কার মা সেটা বলো তো?”
“অন্যায় করে কেউ যদি নিজেই নিজেকে শাস্তি দেয় তাহলে তাকে কেন আমি আবার তাকে সাজা দিয়ে পাপ বাড়াব? যেখানে আমি জানি আমার মেয়ের দোষও কম না। শোন, আমি এখন ব্যস্ত আছি। পরে ফোন দিস।”
রুবিবাও ফট করে ফোন কেটে দিলো। শায়লার চরম মাত্রার রাগ উঠছে। মন চাইছে ফোনটা আছড়ে ভাঙতে। কত্ত বড় সাহস? নিজে অন্যায় করে সবার কাছে সাধু সেজেছে। নিজের পরিবারের কাছে তাকেই ভিলেন বানিয়ে দিয়েছে। এখন আবার তাকে না জানিয়ে চুপিচুপি ইউকে যাওয়া হচ্ছে। খুব কেয়ার দেখাতো আগে অথচ এখন বিদেশ যাওয়ার খবরটা পর্যন্ত তাকে দিলো না। না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়ার তাল? তারপর ওখানে গিয়ে কোন এক সাদা চামড়ার সাথে ঝুলে পড়বে আর শায়লাকে ডিভোর্স লেটার পাঠাবে। ভাবনাটা শায়লার মাথা নষ্ট করে দিলো। শায়লা ঠিক করলো সে যাবে রিদওয়ানদের বাড়িতে রিদওয়ানের কাছে কৈফিয়ত চাইতে। কেন তার সাথে এমন করলো? সে কি এতোই ফেলনা? তাহলে এতোদিন বউ বড় বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিল কেন? বদমায়েশ ছেলেটাকে সে দেখে নেবে। ঠিকঠাক জবাব না দিলে ওকে যেতেই দেবে না কোথাও।
চলবে—
#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩৬
“আরে শায়লা যে! কি সৌভাগ্য আমার। তুমি এতদিন পর কোত্থেকে এলে?”
শায়লা সত্যিকার অর্থেই ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। জাকিয়ার হাসি হাসি মুখ দেখে আর কথা শুনে তার গলা শুকিয়ে খুসখুসে কাশি উঠে গেলো। এই মহিলা যেভাবে হাসছে, নির্ঘাত কোন মতলব আছে। শায়লা ভয়ে ভয়ে শুকনো হেসে জবাব দিলো-“আপনি ভালো আছেন আন্টি?”
জাকিয়া প্রানখোলা হাসি দিলো-“খুব ভালো আছি। এতোদিনে রিদওয়ান এর আক্কেল এসেছে দেখে খুশিও লাগছে। তোমার খবর কি বলো? ইউটিউবে নাকি টিউশন দিচ্ছ? ভালো খুব ভালো। আরে তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো বসো এখানে।”
শায়লার চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড় হলো। জাকিয়ার আজ হয়েছে কি? তার সাথে এতো গল্প ফাঁদছে কেন? শায়লা ঢোক গিললো। অনিচ্ছায় জাকিয়ার পাশে বসলো। জাকিয়া মুচকি হাসলো-“জানো, রিদওয়ান ইউকে যাচ্ছে কেন?”
শায়লা না বুঝে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জাকিয়া বললো-“মানে রিদওয়ানের ইচ্ছে ছিলো অস্ট্রেলিয়াতে যাবে। ওখানেও এমডিও সুযোগ পেয়েছে কিন্তু শেষ মুহুর্তে সেটা ক্যান্সেল করে ও ইউকে যাচ্ছে। কেন জানো?”
শায়লা মাথা দুলায়। জাকিয়া চু চু শব্দ করলো-“তুমি জানবেই বা কিভাবে? তোমার সাথে তো আর রিদওয়ান যোগাযোগ রাখেনি। আচ্ছা আমি বলছি শোন। খুব গোপন কথা। কাউকে বলো না কিন্তু। রিদওয়ানকে তো আরও বলবে না। ও যদি জানে আমি তোমাকে এসব বলেছি তাহলে খুব রাগ করবে।”
শায়লার বুক ধড়ফড় করলো। এমন কি বলবে জাকিয়া? এভাবে বলছে কেন? শায়লা অস্থির চোখে রিদওয়ানের রুমের দরজায় নজর ফেলে। রিদওয়ান কি নেই বাসায়? জাকিয়া যেন শায়লার মনের চঞ্চলতা টের পেলো। শায়লাকে ডেকে প্রশ্ন করলো-“রিদওয়ান কি কখনো তোমাকে সেঁজুতির কথা বলেছিল?”
শায়লা থমকে গেলো। সেঁজুতি কে? রিদওয়ানের সাথে সেঁজুতির কি সম্পর্ক? সে হতবিহ্বল হয়ে মাথা নাড়ে-“না বলেনি। কে সে?”
জাকিয়া গালে হাত দিয়ে অবাক হলো-“ওমা! কি বলছো? সেঁজুতির কথা বলেনি তোমাকে? আমি তো ভাবতেই পারছি না ও তোমাকে সেজুতির ব্যাপারে কিছু জানায়নি। ছেলেটাও কেমন দেখো? আমার খুব খারাপ লাগছে শায়লা। এতো বড় ঘটনা কি তোমার থেকে লুকানো উচিত হয়েছে ওর? আচ্ছা আমি বলছি শোন। সেঁজুতি ওর একমাত্র বান্ধবী। খুব ছোট থেকে একসাথে পড়ালেখা করেছে। দু’জন দু’জনকে খুব পছন্দ করতো জানো। রিদওয়ান তো সেঁজুতি বলতে অজ্ঞান ছিলো। পড়ালেখা কোচিং সব একসাথে করতো ওরা। আমরা তো ভেবেছিলাম ও সেঁজুতিকেই বিয়ে করবে। কিন্তু ইন্টারের পর সেঁজুতি লন্ডন চলে গেলে রিদওয়ান খুব কষ্ট পেয়েছিল। জানোই তো রিদওয়ান ওর দাদুকে কি ভলোবাসতো। দাদুকে ফেলে দেশের বাইরে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেনি। তাই ওকে ফেলে সেঁজুতি যখন দূরে চলে গেল তখন থেকে রিদওয়ান নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেলো। রাগ করে সেঁজুতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো। সেই থেকে দু’জনার অভিমান চলছে। এতোদিনে মনেহয় সেঁজুতির সাথে রিদওয়ানের অভিমানের বরফ গললো। তা না হলে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া ক্যান্সেল করে ইউকে তে কেন যাবে বলো?”
“কি বলছেন এসব আন্টি?”
কম্পিত কন্ঠে বললো শায়লা৷ ওর হাত পা কাঁপছে মাথাটা বনবন করছে। এসব কি বললো জাকিয়া? সব কি সত্যি? নাকি শায়লাকে মিথ্যে বলে রিদওয়ানের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে? যা কিছু ভেবে আজ এখানে এসেছিল সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো শায়লার। এতো বড় বেইমানি তার সাথে? রিদওয়ান কিভাবে করতে পারলো এমন কাজ? রাগে শায়লার চোখ মুখ দিয়ে গরম হলকা বের হচ্ছে। জাকিয়া অবলা মুখ করে বললো-“আমি একটুও মিথ্যে বলছি না শায়লা। তুমি হয়তো ভাবতে পারো আমি তোমাকে রিদওয়ানের কাছ থেকে দূরে রাখতে বানিয়ে বানিয়ে বলছি এসব। আমাকে বিশ্বাস না হলে তুমি পল্লবীকে জিজ্ঞেস করো। ওকে নিশ্চিয়ই বিশ্বাস করো তুমি?”
শায়লা কোন জবাব দিলো না। আসলে জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা নেই ওর। এতো বাজে একটা সত্য আজ জানতে পারবে এটা জানলে এখানে আসতোই না আজ। এর চাইতে কোন যোগাযোগ না থাকা ভালো ছিলো। এখন পরিস্কার বুঝতে পারছে রিদওয়ান কেন এতোদিন তার সাথে যোগাযোগ করেনি। শায়লার সাথে এতো বড় অন্যায় করার পরও কেন কখনো সরি বলেনি। যেই রিদওয়ান সপ্তাহে দুই তিনবার ওর হলের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো সেই রিদওয়ান আঁচমকা দুই বছরের বেশি সময় তাকে না দেখে কাটিয়ে দিলো। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে তার। শায়লা তাহলে সেঁজুতির রিপ্লেসমেন্ট ছিলো। যেই না সেজুতিকে পেয়েছে অমনি শায়লার থেকে মন উঠে গেছে তার। শায়লার শরীরটা জ্বলছে অপমানে। ওর মন চাইছে এখান থেকে চলে যেতে। চলে যাওয়ার কথা ভেবে উঠে দাঁড়াতেই ওয়াহেদকে দেখা গেলো। পল্লবীও রান্না ঘর থেকে উঁকি দিলো। ওয়াহেদ শায়লাকে দেখে খুশি হলো-“আরে, তুমি এসেছ? কখন এলে শায়লা মামনী? এতো দেরি করে এলে কেন? রিদওয়ানটা বিকেলেই বেরুলো। কি যেন কেনাকাটা বাকী আছে ওর।”
রিদওয়ান নেই শুনে শায়লা যেন স্বস্তি পেলো। অনেকটা ঝোঁকের বসে এখানে এসেছিল। এখন ভুলটা শুধরে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পল্লবী এসে শায়লাকে জড়িয়ে ধরলো-“আল্লাহ শায়লা, তুই আমাদের এভাবে ভুলে গেছিস? রোদেলা তোর কথা বলতে বলতে পাগল বানিয়ে ফেলে।”
শায়লা অনুচ্ছায় হাসলো-“কোথায় ও? ওকে নিয়ে আসো ভাবি।”
“রোদেলা ওর বাবার সাথে বেরিয়েছে। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।”
“ওহহহ।” ম্রিয়মান গলায় বললো শায়লা। পাশ থেকে জাকিয়া পল্লবীকে ডাকে-“শোন, ওকে নিয়ে যাও তোমার ঘরে। গল্প করো দু’জন মিলে।”
শায়লা অবাক নয়নে জাকিয়াকে দেখলো এক পলক। হুট করে এতো ভালোমানুষী কেন দেখাচ্ছে জাকিয়া? এতো উদারতার কারণই বা কি? ওয়াহেদ বললো-“হ্যা, এতোদিন পরে এলো মেয়েটা। পল্লবী, রিদওয়ানকে ফোন দাও একটা। দেখো কোথায় আছে।”
“দিচ্ছি বাবা। এই শায়লা, চল ও ঘরে।”
পল্লবী শায়লাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো নিজের ঘরে। সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশে বসলো। ফোন হাতে নিতেই শায়লা ওর হাত চেপে ধরলে-“কি করছে ভাবি?”
“রিদওয়ানকে ফোন দেই। ওকে বলি তুই এসেছিস।”
শায়লা মাথা নাড়ে-“প্লিজ বলো না কিছু। ফোনই দিয় না।”
পল্লবী অবাক হয়ে শায়লার হাত ধরে জানতে চাইলো-“তোর আর রিদওয়ানের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে? তুই এ বাড়িতে আসিস না একদমই। রিদওয়ানও তোর কথা বলে না কখনো। শায়লা, কি হয়েছে বল আমাকে?”
শায়লা নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বললো-“তুমি ভুল ভাবছো। তেমন কিছু হয়নি। দু’জনই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত আছি।”
পল্লবী শায়লার চোখে চোখ রাখতেই শায়লা নজর নামিয়ে নেয়। পল্লবী ওর চিবুক ধরে মুখটা তুললো-“আমার সাথে মিথ্যে বলছিস? কি হয়েছে বলবি তো? কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে তোদের?”
অনিচ্ছায় শায়লা চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সে তার ঠোঁট কামড়ে ধরলো। শায়লাকে আগলে নিলো পল্লবী-“কাঁদছিস কেন পাগলী? রিদওয়ান কিছু বলেছে তোকে?”
শায়লা মাথা নাড়ে। কান্না গিলে নিয়ে নাক টেনে বললো-“আমি কিছু জানতে চাই ভাবি। সত্যি উত্তরটা দেবে তো?”
পল্লবীর কপালে ভাজ পড়লো-“তোকে মিথ্যে বলবো কেন শায়লা?”
শায়লা আকুল গলায় জানতে চাইলো-“তাহলে বলো সেঁজুতি কে? রিদওয়ান আর সেজুতি কি একে অপরকে ভালোবাসতো? তাহলে আমাকে বিয়ে করলো কেন?”
পল্লবীর মুখ ফ্যাকাসে দেখায়, কম্পিত কন্ঠে সুধায়-“সেঁজুতির কথা কে বললো তোকে? কিভাবে জানলি তুই?”
শায়লা হেলায় হাসলো-“কিভাবে জেনেছি তা দিয়ে কি হবে ভাবি? তুমি আমাকে বলো এসব সত্যি কিনা? প্লিজ ভাবি।”
পল্লবী গলা কাঁপে-“শায়লা, অনেক পুরনো কথা এসব। এখন এসব জেনে কি হবে শায়লা? তুই রিদওয়ানের বউ এটাই সত্যি, বাকীসব মিথ্যে।”
“তার মানে সব সত্যি?” শায়লার কন্ঠ কঠোর শোনায়। পল্লবী তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো-“সত্যি মিথ্যা যাইহোক কোন কিছুতে কিছু আসে যায় না শায়লা। তুই আর রিদওয়ান স্বামী স্ত্রী। এটাই একমাত্র সত্যি। পুরনো কথা কেন টানছিস বুঝতে পারছি না।”
শায়লা ছলছল নয়নে পল্লবীকে দেখলো-“তুমি জানো ও ইউকে কেন যাচ্ছে? কারণ ওখানে সেঁজুতি আছে।”
পল্লবী হা করে তাকিয়ে থেকে বললো-“অসম্ভব! এমন কিছু হতেই পারে না। তুমি ভুল জেনেছিস।”
শায়লা গোঁয়ারের মতো মাথা নাড়ে-“এতদিন সবকিছু ভুল জেনেছি ভাবি। এখন সব ঠিকঠাক জানছি। সেঁজুতি যদি রিদওয়ানের জীবনে খুব বড় কিছু না হতে তাহলে ও আমাকে সেঁজুতির কথা জানাতো।”
পল্লবী শায়লার হাত জড়িয়ে ধরে-“শায়লা, খামোখাই মাথা গরম করছিস। পুরো ঘটনা না শুনে এমন মন্তব্য করা অনুচিত। আর রিদওয়ানকে ভুল বুঝে নিজেদের সম্পর্ককে ঠুনকো বানিয়ে দিচ্ছিস। এমন করিস না বোন। তোর যদি কিছু জানার থাকে তাহলে রিদওয়ানের সাথে কথা বল। সব মিটিয়ে নে।”
শায়লা অসহায় চোখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকে আনমনা হলো-“যে তার কোন গোপনীয়তার ভাগ দেয়নি আমাকে তার সাথে কি মেটাব ভাবি? আমি কি এতোটাই ঠুনকো? বাবাহীন জীবন আর বিলাসে মানুষ হইনি বলেই কি আমার সাথে যা খুশি তাই করা যায়? আমি তো কাউকে এই অধিকার দেইনি। কেন এমন করলো রিদওয়ান আমার সাথে?”
পল্লবীকে অসহায় দেখায়। ঘটনা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে কিছুই বুঝছে পারছে না। সেঁজুতির কথা কে বললো শায়লাকে সেটাও বুঝতে পারছে না। সে মরিয়া হয়ে বললো-“দেখ শায়লা, রিদওয়ান দুইবছর বা তার বেশি সময়ের জন্য দূরে চলে যাবে। আজ এসেছিস ওর সাথে কথা বল, সময় দে ওকে। চাইলে ওর কাছে কৈফিয়ত চা। শুধু শুধু ভুলভাল কাজ করে জীবনটাকে জটিল করে তুলিস না।”
শায়লা উঠে দাঁড়ালো, ব্যাগটা কাঁধে তুলে বললো-“যার জীবনে কোন অধিকার নেই তার কাছে কিসের কৈফিয়ত চাওয়া। কারো জীবনে অনধিকার চর্চা করার অভ্যেস আমার নেই। রিদওয়ান তার সেঁজুতির সাথে ভালো থাক। আমাকে ছাড়াই রিদওয়ানের জীবন ভালো চলছে। ভালো থেকো।”
পল্লবী কিছুটা চেচিয়ে উঠলো-“শায়লা, যাস না এভাবে। শুনে যা একবার।”
শায়লা শুনলো না। সে দরজা খুলে কোনদিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো। রিদওয়ানদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে শায়লা দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে দিলো। কেন বারবার বেহায়ার মতো এই বাড়িতে ছুটে আসে শায়লা? যেখানে প্রতিবার তাকে চোখে জল নিয়ে ফিরে যেতে হয়? সে কি এতোই ফেলনা যে বারবার কাঁদবে অকারণে?
শায়লা দূর থেকে বাড়িটাকে দেখলো একনজর। জলে ভেজা চোখে মনে মনে পন করলো, আর কোনদিন আসবে না এই বাড়িতে, কোনদিন না।
চলবে—
©Farhana_Yesmin