এলোকেশী বিচিত্রা ফুল পর্ব-০১

0
12

#আরম্ভ_পর্ব
গল্পঃ #এলোকেশী_বিচিত্রা_ফুল
কলমেঃ #সুকন্যা_ইশা

১.
“তোমাকে সে চিঠি দিয়েছে মানেই আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আমি বুঝেছি তোমরা প্রেম করছো। তোমাকে তার সাথেই বিয়ে দেওয়া হবে। প্রস্তুতি নাও।”

বাবার কথা শুনেই পনেরো বৎসরী সাম্রাজ্ঞীর চিত্ত হয়ে উঠেছিলো পুলকিত। বেপরোয়া গতির হৃদয়ের সম্মতিতে মত দিয়ে দিয়েছিলো সে। বয়ঃসন্ধির কক্ষে থাকা মেয়েটার মন বিয়ের কথা শুনেই আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠেছিলো। কারণ সে চেয়ে এসেছে এমনটা। তার কোমল হৃদয় ছিলো অন্যের কাছে বন্দি। মেয়েটা প্রেমে জড়িয়েছে। আর সেই প্রেমের সূত্রেই হয়েছে তাদের কত দেখা সাক্ষাৎ। লুকিয়ে চুরিয়ে। তবে এই প্রথমবারের মতো কোনো প্রেমপত্র পেয়েছিলো সে। কিন্তু তা চোখে পড়ে যায় সাম্রাজ্ঞীর বাবার।

মহানপুর গ্রামের একজন প্রভাবশালী সাহুকার সাম্রাজ্ঞীর বাবা। পাশাপাশি কাঁচা সবজির ব্যবসায়ী। তবে গ্রামে তিনি সকলের কাছে সাহুকার হিসেবেই পরিচিত। মেয়েকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। তাই মেয়ের প্রেমের বিরুদ্ধেও যাননি। সালটা তখনো বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে, ১৯৯৫। তখনকার যুগে সব মেয়েদেরই এমন কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো গ্রামাঞ্চলে। তাই সাম্রাজ্ঞীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। আর গ্রামের মানুষও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যায়নি।

সাম্রাজ্ঞীর মা মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে না চাইলেও তাঁর মতামত ছিলো এই বিয়েতে। কিন্তু,তবুও তিনি মেয়েকে সাবধান করেছিলেন। ছোট্ট মেয়েটাকে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ও বলেছিলেন যেন মেয়ের প্রতিবাদী সত্বা কখনো নীরব না থাকে। সে যেন সঠিক সময়ে সঠিক বাক্য ব্যয় করে। প্রয়োজনে যেন দেহের শক্তি কাজে লাগায়। কারণ,শিক্ষাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার মতো সুযোগ সাম্রাজ্ঞীর নেই।

অতঃপর দিন ক্ষণ ধার্য করে, বহু মানুষকে আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ জানিয়ে সাম্রাজ্ঞীর বিয়েটা হয়ে গেলো। অবশ্যই পাত্রপক্ষের সকলে সাম্রাজ্ঞীকে পছন্দ করেছেন। সাম্রাজ্ঞীর পড়াশোনার ওখানেই ইতি। মাধ্যমিকটাও দেওয়া হলো না মেয়েটার। সে ও বিয়ের কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে অনিচ্ছুক ছিলো। আর পাত্রপক্ষও মেয়েকে পড়াশোনা করাতে চাননি। তাই সাম্রাজ্ঞীকে আর জোর করা হলো না।

যার সাথে সাম্রাজ্ঞীর বিয়ে হয়েছিলো সে হলো সব্যসাচী। বয়স তারও বেশি নয়। দেখতে শুনতে বেশ সুদর্শন। সবে উচ্চ মাধ্যমিকটা শেষ করে ডিগ্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ছেলেটা। বলতে গেলে দুজনেই তখনো অপরিপক্ক। তবুও গ্রামাঞ্চলে এসব কারাই বা মানে! প্রেমের বার্তা যখন বাতাসে ছড়িয়েছে,তখন তো একসাথে থেকে ঘর করাটাই উত্তম। কলঙ্কের কালি না আবার এসে লাগে তাদের গায়ে!

সাম্রাজ্ঞীর জীবনটা অতটাও বিস্বাদের ছিলো না,যতটুকু হয়তো তার কপালে পরবর্তী সময়ের জন্য লেখা ছিলো। কিন্তু মেয়েটা কি আর তা জানতো! সে তো তখনো তার কিশোরী বয়সে দাঁড়িয়ে। তার উড়ন্ত, মুক্ত পাখির মতো সুখী মন। এসব প্রেম, বিয়ে, ভালোবাসার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আগ্রহ তার প্রবল হওয়াটাই স্বাভাবিক। বয়সটাই যে তেমন! কিন্তু আবেগের এই বয়স যে মানুষকে কখনো কখনো পথভ্রষ্ট করে ভুল পথে পরিচালিত করে,তা কজন বোঝে?

২.
শ্বশুর বাড়িতে পদার্পণ করতে না করতেই সাম্রাজ্ঞী পেলো শাশুড়ি ননদের আদর আপ্যায়ন। প্রথম দিনগুলোতে বেশ স্নেহের চাদরে মুড়িয়ে মেয়েটাকে ভালোবাসা দিলো সকলে। কিন্তু তাদের সেই তথাকথিত ভালোর আড়ালে থাকা আসল চেহারা গুলো বেরিয়ে আসতে বেশিদিন সময় নেয়নি।

বাবা মায়ের আদরের মেয়ে সাম্রাজ্ঞী। তাই রান্নাবান্নার তেমন একটা অভ্যাস ছোট্ট সাম্রাজ্ঞীর ছিলো না। অপরদিকে গ্রামাঞ্চলে তখনও মাটির চুলো বাড়িতে বাড়িতে। বেশ কসরতে মেয়েটা একটু একটু করে শিখে নিলো কীভাবে মাটির চুলোয় শুকনো পাতা, লাকড়ি ব্যবহার করে আগুন ধরাতে হয়। শিখে নিলো কীভাবে কাঁটা হাত নিয়েও শিলপাটায় মরিচ মশলা বাটতে হয়। শিখে নিলো মেয়েটা কীভাবে নাকে চোখে উত্তপ্ত ধোঁয়া লাগিয়ে সাদা ধবধবে ভাত, সুস্বাদু তরি-তরকারী রান্না করে বাড়ির সবার মন জয় করতে হয়। কিন্তু সবার মন তো জয় করে নেওয়ার মতো হয় না। পাষাণ মানুষদের মন কীভাবে গলে?

ছোট্ট সাম্রাজ্ঞীর‌‌ শ্বশুর বাড়িতে তার বাবার বাড়ির মতো টেলিভিশন ছিলো না। পাশের বাড়িতে একটা ছোট্ট টেলিভিশন ছিলো যা দেখতে আসতো পুরো পাড়ার অনেক ছোট ছোট কিশোর কিশোরীরা। সাম্রাজ্ঞীও যেতে চায়তো সেথায়। কখনো কখনো চলেও যেতো সবার অগোচরে,প্রিয় সিনেমাটা এক ঝলক দেখার আশা নিয়ে। কিন্তু শ্বশুরের রূঢ় স্বরে দেওয়া অশ্রাব্য গালাগাল শুনতে শুনতে ফিরে আসতে হতো মেয়েটাকে।

উঠতে বসতে সাম্রাজ্ঞী তার মায়ের নামে কটু কথা শুনেছে ননদ-শাশুড়ির মুখে। ঠোঁটে যেন তাদের মধু পড়েনি শৈশবে। সাম্রাজ্ঞী লুকিয়ে কাঁদতো, প্রকাশ্যে কাঁদতো, অর্ধাঙ্গ হিসেবে পাওয়া মানুষটার কাছে গিয়ে কাঁদতো। কিন্তু কোনো ভালো প্রতিক্রিয়া সে পায় নি। যা পেয়েছে তা হলো অবহেলা, সব্যসাচীর দেখানো পড়াশোনার ব্যস্ততা, তার মিথ্যা ভালোবাসার প্রমাণ।

সাম্রাজ্ঞী কথা বলতে চায়তো। সে চায়তো প্রতিবাদ করতে। কিন্তু তার সেই প্রতিবাদী শব্দগুলো কান্না হয়ে অনর্গল ঝরে পড়তো চোখ থেকে কপোল ছুঁয়ে। মায়ের কথা মনে পড়তো ভীষণ। বাবার কথা মনে পড়তো তার। পনেরো বছরে তার বাবা তার গায়ে কখনো ফুলের টোকাটা দেয়নি। কিন্তু শ্বশুর নামক পরের বাবা তার দীর্ঘ চুলের ঘন মুঠি আঁকড়ে আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। সাম্রাজ্ঞীর মা কখনোই বিয়ের পরে তাঁর মেয়ের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। বিয়ে হওয়া মেয়ের সংসারে মায়ের অহেতুক নাক গলানো মানে মেয়ের সংসারের অশান্তি বলে মনে করতেন তিনি। তবুও শাশুড়ি ননদের মুখে সাম্রাজ্ঞীর মায়ের নামে তাকে শুনতে হয়েছে নানান আজে বাজে কথা।

সাম্রাজ্ঞী সইয়ে আসছিলো সবকিছু। সবকিছুই মাথা পেতে নিয়ে চুপচাপ থেকেছে। কখনো কখনো অবশ্যই আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেছে যদিও। কিন্তু তাকে থামানোর প্রচেষ্টা কখনোই ব্যর্থ হয়নি তার শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর। সব্যসাচী কখনোই এসবে থাকতো না। সে বেশিরভাগই বাড়ির বাইরে সময় কাটাতো। রাতেও তার দেখা মিলতো না কখনো কখনো। বলতো,সে তার বন্ধুদের সাথে থাকে। সাম্রাজ্ঞী কষ্ট পেতো। ভীষণ দুঃখে,বিষণ্ণতায় মেয়েটা নিজেকে দোষারোপ করতো বারে বারে। প্রেম যে মহাপাপ! প্রেম মুখ ফুটে কথা বলার অধিকার দেয় না। প্রেম যে সুখ দেয়,তা ক্ষণস্থায়ী। প্রেম মানুষের কপালে আঁকে ভীষণ এক দুর্বিষহ জীবনের আলোকচিত্র,যা অদৃশ্য সেথায়। সেই আলোকচিত্র দৃশ্যমান হয় কেবল চোখের সামনে। আর প্রেমের ছোবলে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায় এক নিরীহ, মুক্ত, সুখী জীবন।

৩.
বারো মাস সংসার করার পরে সাম্রাজ্ঞী আর সইতে পারলো না। সে তালাক চাইলো। সকলের সামনে তার প্রেম করা পুরুষের কাছ থেকে মুক্তি চাইলো মেয়েটা যখন সে জানতে পারলো তার জীবনের অন্য এক তিক্ত সত্য।

সব্যসাচী পরকীয়ায় উন্মত্ত ষাঁড়। যে কম বয়সের মেয়েটার ফুটফুটে আননের মোহে পড়ে সে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো,সেই মেয়েটাকে তার আর ভালো লাগে না। যে মেয়েটার সাথে সে লুকিয়ে প্রেম করেছে, যে মেয়েটাকে সে প্রেমপত্র দিয়েছে,সেই মেয়েটা এখন তার চোখের নীল বিষ। সাম্রাজ্ঞীর ওপর সে কখনো শারীরিক নির্যাতন না করলেও, মানসিক যে যন্ত্রনা সে মেয়েটাকে দিয়েছে প্রতিনিয়ত, সেসব সহনের সীমা ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই। তাই তো সাম্রাজ্ঞী স্বেচ্ছায় তার প্রেমকে ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো,সে ফিরে যাবে বাবার বুকে। ফিরবে মায়ের মমতা মাখানো সুমিষ্ট আঁচল তলে। সে আর থাকতে চায় নি ওই নরকপুরীতে। কারণ যাকে সে দিয়েছিলো প্রেম, সে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে প্রেম ভালো নয়। অন্যকে প্রেম দেওয়া মোটেই ভালো কাম্য নয়। উচিত নয় কাউকে ভালোবাসা।

সাম্রাজ্ঞীর বাবার সাথে সব্যসাচীর পরিবারের বেশ বাকবিতন্ডা হয় পরবর্তীতে। বিশেষ করে সাম্রাজ্ঞীর সেই শাশুড়ি আর ননদের সাথে। ভীষণ সেই ঝামেলা শব্দ-বাক্যে না মেটাতে পেরে অগত্যা সাম্রাজ্ঞীর বাবা আইনের সাহায্য নেন। তবে এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন যেন বাল্যবিবাহের কোনো দোষ নিজের ঘাড়ে না চাপে। মেয়ের কথাটা ভেবে,সমাজের কথাটা ভেবেই তিনি মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন ঠিক। কিন্তু,মন্দ কোনো চিন্তা তাঁর মাথায় ছিলো না কখনোই।

প্রভাবশালী মানুষ হওয়ার কারণে গ্রামে বেশ সম্মানিত সাম্রাজ্ঞীর বাবা। তাঁকে চেনে না এমন কেউ নেই মহানপুর গ্রামের। তাই পরিচিত এক বিশ্বাসী আইনজীবীর হাত ধরে মেয়ের তালাক করালেন তিনি। যদিও এই বিষয়ে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়েছে। তবুও তিনি মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেলেন। তবে,ছেলের বাড়ির সকলকে তিনি রাগের বশে কিছু হুমকি দিলেও পরবর্তীতে সাম্রাজ্ঞীর মায়ের কথায় পদক্ষেপ নেওয়া হতে পিছপা হয়েছিলেন।

তারপর থেকেই সাম্রাজ্ঞী তার বাবার বাড়িতে থাকে। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছে সে। সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে,নিজের খেলার বয়সকে আবার আগলে নিয়েছে মেয়েটা। পড়াশোনায় মন দিয়ে মাধ্যমিকে একটা ভালো ফলাফল করে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা সম্পন্ন করার মানসিক প্রস্তুতি নেয় সে। ধীরে ধীরে সবটা ঠিক হতে থাকে। তার স্বাভাবিক, সুন্দর, সরল জীবনের দিনগুলো ফিরে আসে আবারো। মেয়েটা আবার নতুন করে বাঁচে। নতুন করে হাসে। নিজের এক নতুন জীবন গড়ে। সাম্রাজ্ঞী নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। আর তার এই নতুন জীবন গড়তে পাশে ছিলো মা নামক মানুষটা। যে মানুষটা তাকে প্রেম করার মতো ভুলের জন্য কোনো শাস্তি না দিয়ে বুকে আগলে নিয়েছেন স্নেহে। মেয়ের মনে সাহস জুগিয়েছেন। কোথাও না কোথাও হয়তো তিনি জানতেন মেয়ের এই কঠিন পরিণতির কথা। তাই তো মেয়ের প্রতি নজর রেখে মেয়েকে নতুন স্বপ্নের পথ দেখিয়েছেন তিনি আবারো। যতই হোক,মেয়েরা তো মায়েরই অংশ!

৪.
সালটা এখন একবিংশ শতাব্দীতে। ২০০৫ এর সময়কাল। কোনো এক স্নিগ্ধ ভোরের আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে সবে। চারিদিকে ঊষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। শোনা যাচ্ছে পাখিদের কলকাকলি।

দীর্ঘ এক চাপা শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো সাম্রাজ্ঞী। হাতের মোটা ডায়েরীটার ওপর কয়েক ফোঁটা নোনাজল পড়লো টুপ টুপ করে। এই ডায়েরীটাতেই হয়তো বর্ণিত আছে তার অর্ধ জীবনের কাহিনী। কিন্তু আসলেই কি তাই? জীবন কি এতোই ছোটো, এতোই সহজ যে ফুড়ুৎ করে চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে?

সাম্রাজ্ঞী ভাবে না আর। গোটা দিনটা হেসে খেলে সবটা ভুলে থাকা গেলেও রাত্তিরটা কেন যেন এইসব পুরনো কথা ভেবে,ডায়েরীটার প্রতি পাতায় চোখ বুলিয়েই পার হয়ে যায় কখনো কখনো। হ্যাঁ, সবসময় নয়। কখনো কখনোই। কারণ,আজকাল ভীষণ ব্যস্ত থাকে মেয়েটা। বয়সটা যে তার এখন আর সেই পনেরোতে আঁটকে নেই। এখন সাম্রাজ্ঞীর বয়সটা চব্বিশের শেষ ঘরে। মহানপুর গ্রামের প্রভাবশালী সাহুকারের মেয়ে সাম্রাজ্ঞী এখন একজন ওষুধ বিশেষজ্ঞ।

চলবে।