এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-০৩

0
2

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৩

আরিশের কথামতো ওদের বিয়েটা ঘরোয়াভাবেই হয়েছে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত আরিশ কেনো নিলো সেটা পরিবারের লোকেরা তেমন বুঝতে পারেনি তবে মেঘনা ঠিকই বুঝেছে। সব জেনেবুঝেও চুপচাপ বিয়েটা করতে হয়েছে। বিয়ের দিন পুরোটা সময় মেঘনা লক্ষ্য করেছে আরিশের বিরক্তি, এমনকি বিয়ে পড়ানোর পর যখন দুজনের একটা কাপল পিক তোলার কথা বলা হলো আরিশ তাতেও আপত্তি জানায়। যদিও পরে কয়েকটা ছবি তুলেছে। আরিশের আচরণ দেখে মেঘনার আর বুঝতে বাকি নেই যে শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার পর ওর ঠিক কি অবস্থা হবে। শুক্রবার দুপুরে ওদের বিয়েটা পড়ানো হয়েছে, বাসায় আসতে আসতে মাগরিবের আযান পড়েছে। বাড়িতে এসেই আরিশ হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেছিলো, আনিশা পরে মেঘনাকে নিয়ে যায়। আরিশ ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে।

‘ ভাবী, আজ থেকে এটা হলো তোমার নতুন রুম’

সঙ্গে সঙ্গে আরিশ গলা খেঁকিয়ে বলে উঠলো…

‘ও হ্যালো, এটা আমার রুম!’

‘ তোর একার রুম ছিলো, কিন্তু আজ থেকে তোদের দুজনের রুম তো’

‘ একদমই না, এটা আমার রুম ছিলো আর আমারই থাকবে’

‘ ধুর! তোর সঙ্গে কথাই বলবো না আমি। জানো ভাবী, আমার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্ত একটাই আফসোস রয়ে গেলো। খুব ইচ্ছে ছিলো ভাইয়ার বিয়েতে নাচার, সেটা হলো না’

স্মিত হাসলো মেঘ…

‘আজকাল তো ট্রেন্ড হয়েছে কণেরা নিজের বিয়েতে নাচে, ভাইয়ের বিয়েতে নাচতে পারোনি তো কি? নিজের বিয়ের এন্ট্রিতে ড্যান্স রেখো। এক ঢিলে দুই পাখি মা’রা হয়ে যাবে’

‘হ্যাঁ, তারপর ওর বানর নাচ দেখে ওর হাসবেন্ড স্টেজ থেকে পালাবে’

‘ আজকে যা খুশি বল গিয়ে, তোর কথা আমি গায়ে মাখছিনা! ভাবী, তোমার কিছু লাগলে আমাকে বলবে। আমি তোমার দরকারি সবকিছু এনে দেবো, ওকে?’

‘ হুমম, থ্যাংক ইউ!’

‘ আমার জন্যে তো এক গ্লাস পানিও তোকে দিয়ে আনাতে পারিনা, আর তুই কিনা যেচে আরেকজনকে সাহায্য করতে চাইছিস?’

‘ শোন ভাইয়া, আজ আমি অনেক ভালো মুডে আছি। অযথা তোর সঙ্গে ঝগড়া করে মুড খারাপ করতে চাইনা, হুহহহ!! ভাবী, তুমি রেস্ট করো কেমন। আমি পরে আসবো’

আনিশা চলে যায়, অনেক ক্লান্ত লাগছে মেঘের তার ওপর শাড়ি পড়া অবস্থায় আরো অস্বস্তি লাগছে। শাড়ি পরার তেমন অভ্যাস নেই কিন্তু বিয়ের সুবাদে একটা কাতান শাড়ি পরতে হয়েছিলো, এখন সেটা বদলে আরামদায়ক পোশাক না পরা অব্দি শান্তি পাচ্ছেনা মেয়েটা। লাগেজটা খুলে ওখান থেকে জামাটা পরবে সেটা খুজছিলো মেঘ, এরই মাঝে আরিশ হাতমুখ মুছতে মুছতে বলতে শুরু করে…

‘ এই মেয়ে আমার বোন কিনা মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, আমি যাকে অপছন্দ করি তাকেই ও বেশি পছন্দ করে। ভাইবোনের মতের এতো অমিল হয় নাকি!’

‘আমাকে এতোই অপছন্দ তোমার?’

‘তোমাকে পছন্দ করার মতো কি আছে?’

‘তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ?’

‘কেনো? আমার কেমন মেয়ে পছন্দ সেটা জেনে কী তুমি আমার পছন্দসই হওয়ার চেষ্টা করবে? ও ভাবনা বাদ দাও, আই ডোন্ট লাইক ইউ আর কোনোদিন পছন্দ করবোও না। তোমার জন্যে আমার জীবনটা আজ এই বয়সেই শেষ হয়ে গেলো’

একটা জামা বের করে উঠে দাঁড়ালো মেঘ।আরিশের কথাবার্তা শুনে এ মুহূর্তে কান্না আসছে ওর, আরিশ যেনো পারে তো মেঘকে এখনই আবার বাড়ি ফেরত দিয়ে আসে।

‘এমনভাবে বলছো যেনো বিয়েটা করে তুমি একা ফেঁসে গেছো? আমিও ফেঁসে গেছি, তোমার থেকে বেশি ফ্রাস্ট্রেড আমি বুঝেছো?’

‘ তোমার আবার কিসের ফ্রাস্ট্রেশন? তুমি তো স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছো’

‘ বিয়েটা করার জন্যে আমি বাধ্য ছিলাম, আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলোনা’

‘ মানে!’

মেঘ উত্তর দিলো না, ফ্রেশ হতে চলে গেলো। এ মুহূর্তে আরিশের সঙ্গে তর্কে জড়ানোর মতো শারীরিক বা মানসিক শক্তি নেই ওর। আরিশও আর এ বিষয়ে জানার আগ্রহ দেখালো না, মোদ্দাকথা মেঘের কোনো বিষয়েই জানার আগ্রহ নেই ওর। বাসায় ওর খালা – ফুপি এসেছে, সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ওদের বিয়ে। এসব আলোচনা শুনতে আর ভালো লাগছেনা আরিশের। তাই ও বাইরে যায়, যাওয়ার সময় বন্ধু অয়নকেও ফোন করে আসতে বলে। আজ দুপুরে বিয়ের সময় অয়ন ওর সঙ্গে গিয়েছিলো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আরিশ সোজা ক্লাব হাউজে চলে যায়, অয়ন ওখানেই আসে…

‘বিয়ের প্রথম রাতেই তুই বাড়ির বাইরে কেনো? বউ রুম থেকে বের করে দিয়েছে নাকি?’

‘রুমটা ওর নাকি আমার? ওর এতো সাহস হয়নি যে আমাকে রুম থেকে বের করবে বুঝেছিস?’

‘ চিল, ম্যান! এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো? আমি তো মজা করছিলাম’

‘ এই কয়েক ঘণ্টা বাসায় বউ, বিয়ে, সংসার এসব শুনে অতিষ্ট হয়ে বাইরে এসেছি। এখন আবার তুই নতুন করে এসব শুরু করিস না’

‘ আরে বাবা, তোর মেজাজ তো দেখছি বেজায় গরম। কি হয়েছে বলবি তো। মেঘনার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিস নাকি?’

‘ ইয়ার, তুই জানিস আমি নিজের জিনিস শেয়ার করা পছন্দ করিনা সেখানে একটা মেয়ের সঙ্গে আমাকে রুম, বেড শেয়ার করতে হবে। এসব ভেবেই আমার আনকমফোর্টেবল লাগছে’

‘ তো আলাদা একটা বেড কিনে আন, তুই এক বেডে তোর বউ এক বেডে ঝামেলা শেষ’

কথাটা বলেই সশব্দে হেসে উঠলো অয়ন, ওর হাসিও এ মুহূর্তে বিষের মতো লাগছে আরিশের। ধমকে উঠলো ও…

‘ ইয়ার্কি করিস না অয়ন, আই অ্যাম সিরিয়াস। পারলে এই সমস্যার একটা সমাধান দে’

‘ দেখ আরিশ, আমি তোকে ভালোভাবে বলছি। তুই আগে মাথা ঠাণ্ডা কর। হুট করেই সবটা হয়ে গেছে বলে তোর মানতে অস্বস্তি লাগছে, একটু সময় দে। সব ঠিক হয়ে যাবে’

‘তুই তো এমনভাবে বলছিস যেনো তোর তিন চারটা বউ আছে?’

‘ আরে কি বলিস না বলিস, তোর তো তাও বিয়ে হয়েই গেলো আমি এখনো করতেই পারলাম না। দেখ, আমার যতটুকু জ্ঞান হচ্ছে বলছি, এতো হাইপার হোস না। সব ঠিক হয়ে যাবে’

অয়ন আরিশকে বুঝ দিয়ে যাচ্ছে। কোথায় ভেবেছিলো বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে কোনো লাভ হবে, উল্টে অয়নের কথা শুনে হতাশ হচ্ছে। অনেক রাত বলে সুহানাকে ফোন করেনি, নাহলে ওই একটা না একটা উপায় বলে দিতো। রেহানা বেগম মেহমানদের খাবার দিয়ে ছেলে ও বৌমাকে খাওয়ার জন্যে ডাকতে আসেন, কিন্তু ঘরে এসে আরিশকে দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করেন…

‘আরিশ কোথায়?’

‘ আমি ঠিক বলতে পারছি না, হয়তো বাইরে গেছে’

‘ এখন বাইরে? বলে গেছে কোথায় যাচ্ছে?’

না সূচক মাথা নাড়লো মেঘ, রেহানা বেগম আর দেরী না করে ছেলেকে ফোন করলেন কিন্তু ফোন বন্ধ!

‘এই ছেলেটা যে কি করে, ফোন বন্ধ করে রেখেছে।আজকে আবার বাইরে যাওয়ার কি দরকার ছিলো! ওর বাবা জানতে পারলে এখনই বকাবকি শুরু করবে’

মেঘ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে রেহানা বেগম বুঝলেন আরিশ হয়তো ওর সঙ্গেই কোনো ঝামেলা করে বাসার বাইরে গেছে। উনি মেঘকে বসিয়ে ঠান্ডা মাথায় বোঝালেন…

‘ জানো মেঘনা, একটা সম্পর্কের শুরুতে অ্যাডজাস্ট করতে একটু সময় লাগে। তোমাদের বিয়েটা কেমন হুট করে হয়ে গেলো তাইনা? আরিশ আসলে নিজেকে এখনও বিবাহিত মানতে পারছে না, হয়তো তোমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে কিন্তু তুমি প্রকাশ করতে পারছো না। ও যদি কিছু বলে তবে কিছু মনে করো না, আস্তে আস্তে দেখবে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে’

‘ আরিশ আমাকে কিছু বলেনি আন্টি’

স্মিত হাসলেন রেহানা বেগম…

‘ আমার ছেলে তো, আমি ওকে ভালোভাবেই চিনি। যাই হোক, তুমি চলো। সবাই একসঙ্গে খাবার খাবো’

‘ আমি একা যাবো? আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি? যদি আরিশ…’

‘ ফোন বন্ধ রেখেছে, মনে হয় না এখন আর ফিরবে। ওর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না, চলো।’

শাশুড়ির কথায় যুক্তি আছে আবার প্রচুর খিদেও পেয়েছে বিধায় মেঘ আর আপত্তি করলো না। রাত প্রায় বারোটার দিকে বাসায় এসে আরিশ দেখে মেঘ এখনো জেগে আছে, ওকে দেখেই মেঘ প্রশ্ন করে…

‘কোথায় গেছিলে?’

‘বিয়ের কয়েক ঘন্টাও হয়নি, এখনই পুরোনো বউয়ের মতো খবরদারি করতে শুরু করেছো?’

‘তেমন কিছুনা, এতো রাতে বাইরে গেলে তাই..’

‘ শোনো মেঘনা, আমি কোথায় যাবো কেনো যাবো সেটা আবার তোমায় কৈফিয়ত দেবো এই এক্সপেক্টেশন রেখো না। ওকে, লেটস মেইক অ্যা ডিল। আমরা কেউ কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবো না ওকে?’

আরিশের কথা শুনে চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো মেঘের…

‘ আসলে, তোমার মা জানতে চেয়েছিলো। আমি কিছু বলতে পারিনি। তাই এখন জিজ্ঞাসা করছি, পরে যদি আবার কিছু জিজ্ঞাসা করে?’

‘ আম্মুকে আমি পরে বলে দেবো’

আরিশ ফ্রেশ হতে গেলো, মেঘ কিছু বলতে পারলো না। বিয়ে নিয়ে মেঘের অনেক স্বপ্ন ছিলো, ইচ্ছে ছিলো ম্যাচিওর কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার কিন্তু ভাগ্যে যে অন্যকিছু ঠিক করা ছিলো। নিজের ওপরই কেমন রাগ হচ্ছে মেঘের, আরিশের আচরণ মোটেও সহ্য হচ্ছেনা। কি করবে বুঝতেও পারছেনা, নিজের মনকে আপাতত বুঝিয়ে নিয়েছে যা যেভাবে চলছে সেভাবেই মেনে নিতে হবে। মেঘ ঘুমানোর উদ্দেশ্যে শুয়েছে তখনই আরিশ এসে….

‘ওঠো!’

‘কী হয়েছে?’

‘এটা আমার সাইড’

‘আজকে আপাতত ওই সাইডে ঘুমিয়ে পড়ো’

‘আমি সবসময় এই সাইডেই ঘুমাই বুঝেছো? সরো, আমার ঘুম পাচ্ছে’

‘একদিন অন্যপাশে ঘুমালে কি হবে?’

‘আমি কারো জন্যে আমার অভ্যাস বদল করবো না বুঝেছো? সরো, ওদিকে’

সরে গেলো মেঘ, আরিশের সঙ্গে রাত বিরাতে ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই ওর! পরদিন সকালে… ভার্সিটি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরিশ, যদিও ওর বাবা মানা করেছিলো কিন্তু মেঘও ভার্সিটি যাওয়ার অনুমতি চায়। সামনের সপ্তাহ থেকে দুজনেরই পরীক্ষা থাকায় আলফাজ সাহেব আর আপত্তি করলেন না। ওরাই বোধহয় প্রথম দম্পতি যারা বিয়ের পরদিনই ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে যাচ্ছে। সকালের নাস্তা শেষে আরিশ রুম থেকে বাইকের চাবি নিয়ে এলো, বেরোতে যাবে তখনই আফজাল সাহেব বলেন…

‘মেঘনাকে সঙ্গে নিয়ে যা’

‘আব্বু, ও বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবে?’

‘যেটা বললাম সেটা করবি, ওকে সঙ্গে নিয়ে যা। একই জায়গায় যাবি, দুজনকে আলাদা কেনো যেতে হবে?’

‘আঙ্কেল, আমি একাই যেতে পারবো’

‘ না না, আরিশ তোমাকে নিয়ে যাবে। তাছাড়া ও তোমার হাসবেন্ড, এইটুকু দায়িত্ব না নিতে পারলে বাকি দায়িত্ব কিভাবে নিতে শিখবে?’

‘আমি কারো দায়িত্ব নিতে পারবো না আব্বু’

‘ আরিশ, মুখে মুখে তর্ক করিস না। নিয়ে যা ওকে সঙ্গে’

আব্বুর ধমক শুনে আরিশ বাধ্য হয়ে মেঘকে সঙ্গে নিলো, মাঝরাস্তায় গিয়ে হঠাৎ মেঘ আরিশকে বাইক থামাতে বললো। আরিশ বাইক থামাতেই নেমে গেলো মেঘ…

‘ তুমি যাও, আমি এখান থেকে রিক্সা নিয়ে নেবো’

‘ আব্বুর কাছে আমাকে আবারো বকা খাওয়ানোর প্ল্যান করছো নাকি?’

‘ মোটেই না! তুমি যেমন আমাকে পছন্দ করো না, আমিও তোমায় পছন্দ করিনা। তোমার সঙ্গে এক বাইকে উঠে ঘোরার এইটুকু শখ আমার নেই’

‘ গুড! এটা তো আমার জন্যেই ভালোর হলো। আর হ্যাঁ, ভার্সিটিতে কেউ যেনো আমাদের বিয়ের কথা না জানে। যদি জানে তাহলে তার দায় তোমার কাঁধে যাবে বুঝেছো?’

‘তোমার বন্ধুরা তো জানে’

‘সো হোয়াট? ওরা কাউকে বলবেনা’

‘ অতো চিন্তার কিছু নেই, আমিও কাউকে বলবো না। এটা আমার শখের বিয়ে না যে নাচতে নাচতে প্রচার করবো’

‘গুড! আর ক্লাসে আমার সঙ্গে কথাও বলতে আসবে না। আমি চাইনা কেউ সন্দেহ করুক। কিছু বলার থাকলে পরে বলবে’

‘নিজেই এতো ওয়ার্নিং দিচ্ছ, পরে না আবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে তুমিই এসে আমার সঙ্গে কথা বললে’

‘ আমরা ক্লাসমেট, টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা হতেই পারে যেমন আগে হতো কিন্তু এর বেশি নয়।’

মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে মেঘকে অনেকগুলো বিষয় সতর্ক করলো আরিশ, মেঘও চুপচাপ সবটা শুনলো। যদিও আগেই ওর সন্দেহ হয়েছিলো কিন্তু এখন আরিশের কথা শুনে ওর কাছে আরো পরিষ্কার হলো যে আরিশ এই বিয়ের কথাটা কঠোরভাবে গোপন রাখার চেষ্টা করছে।

চলবে…

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#বোনাস_পর্ব

ভার্সিটিতে আসার পর যেনো প্রাণখুলে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেলো মেঘ, গতকাল পুরোটা দিন ভীষন অসস্তিতে কেটেছে মেয়েটার। তার ওপর আরিশের কথা তো আছেই, একদিনেই অতিষ্ট হয়ে উঠেছে মেঘ। এই ছেলেটাকে সারাজীবন সহ্য করতে হবে ভেবেই কেমন কষ্ট হয়! ভার্সিটিতে মেঘের তেমন বন্ধু নেই, মনের কথা শেয়ার করে হালকা হবে এমন পরিচিত কেউ নেই। তবে এক ক্লাসমেট আছে যার সঙ্গে একসাথে থাকে মেঘ, দুর্ভাগ্যবশত সে কয়েকদিন যাবত ক্লাসে আসছে না। অয়ন ক্লাসে ঢুকে মেঘকে দেখে আরিশের কাছে এগিয়ে এসে বললো…

‘ বাহ, বিয়ের পরদিনই বর বউ দুজনেই ক্লাসে উপস্থিত? আমি আরো ভাবলাম দুজনে বুঝি হানিমুনে যাওয়ার প্ল্যান করছিস’

আরিশ খাতায় কিছু লিখতে ব্যস্ত ছিলো, অয়নের কথাটা শুনেই চোখ তুলে তাকিয়ে বললো…

‘ মাইক এনে দেই? সবার সামনে ঘোষণা করেই দে আমাদের বিয়ের কথাটা?’

আরিশ রেগে উঠলো দেখে পাশের ডেস্ক থেকে সুহানা উঠে এসে প্রশ্ন করলো…

‘ আহা, আরিশ! সকাল সকাল মেজাজ এমন বিগড়ে আছে কেনো তোর?’

‘আজকে সকালে? গত রাত থেকে ওর মেজাজ এমন হয়ে আছে, ভেবেছিলাম সকালে ঠিক হয়ে যাবে। এখনো দেখছি একই অবস্থা!’

‘ কাল রাতে ওর মেজাজ বিগড়ে ছিলো সেটা তুই কিভাবে জানলি অয়ন?’

‘কালকে রাতে আমাকে ডেকে বাইরে এনেছিলো, এরপর উদ্ভট কিছু কথা বললো। আমার মনে হচ্ছে এই বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ও একটু বেশীই ভাবছে’

‘ অয়ন, তোরা তোদের এই আলোচনা নিজেদের জায়গায় বসে করবি প্লীজ? আমি এখানে একটু একা থাকতে চাইছি’

‘ওকে, অয়ন! তুই আমায় বলতো কি হয়েছে’

অয়ন গিয়ে সুহানার পেছনের ডেস্কে বসলো, দুজনে আস্তে আস্তে আলোচনা করতে শুরু করলো। আরিশ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো, মেঘ আরেক সারির পেছনের দিকে বসেছে। এক নজর দেখেই চোখ সরিয়ে নিলো আরিশ, মেঘের ক্লাসে তেমন বন্ধু নেই আর ও কাউকে কিছু বলবেও না এই ভেবে কিছুটা স্বস্তি আরিশের! একটানা দুটো ক্লাস শেষ করে মায়ের সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলে নিলো মেঘ, আজ পুরোটা সময় একা কাটাতে হবে ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো। এক কাপ কফি নিয়ে বসতেই এক ছেলে এসে ওর পাশের চেয়ার টেনে বসলো, ছেলেটা ওদেরই ক্লাসমেট। নাম নিহান! আরিশ ডিপার্টমেন্ট টপার, তারপরই নিহান। এক কথায় আরিশ ও নিহান ক্লাসের ফার্স্ট ও সেকেন্ড বয়! নিহান ব্যাগ থেকে একটা নোট খাতা বের করে টেবিলে রাখলো…

‘ মেঘনা, তুমি সেদিন আমার কাছে নোটস চেয়েছিলে। এইযে নাও। আশা করি তোমার কিছু হেল্প হবে এখান থেকে’

‘ থ্যাংক ইউ! এটা আমার ভীষন প্রয়োজন ছিলো, এবারের এক্সামে যে কি লিখবো বুঝতেই পারছি না! প্রিপারেশন ভীষন বাজে’

‘ স্বাভাবিক! এই সেমিস্টারে তো তেমন সময়ই পাওয়া গেলো না, সময়ও যেনো কেমন দ্রুত চলে যাচ্ছে’

‘ আর সময়! আমি তো পড়া শেষই করতে পারছি না, চোখের পলক ফেলতেই যেনো বছর ঘুরে যাচ্ছে’

‘ এক্সাম আসলেই দেখি তুমি বেশি প্যানিক করো, এটা কিন্তু খুব বাজে একটা বিষয়’

নোট খাতাটা ব্যাগে রাখতে রাখতে মেঘ হেসে উত্তর দিলো…

‘ আমাদের মতো অ্যাভারেজ স্টুডেন্টদের প্যানিক করার কারণ তোমাদের মতো টপাররা বুঝবে না। তোমরা তো একটা বিষয় সহজেই মনে রাখতে পারো কিন্তু আমাদের অনেকটা সময় লেগে যায়’

‘ সাধারণ থেকেই মানুষ অসাধারণ হয়ে ওঠে, এটা জানো তো? আরেকটু চেষ্টা করো তুমিও পারবে। হতে পারে শেষে গিয়ে আমাদের থেকেও ভালো কিছু করলে!’

নিহানের কথা শুনে হেসে উঠলো মেঘ…

‘ থাক! আর শান্তনা দিতে হবেনা’

‘ নো! আই অ্যাম সিরিয়াস’

দুজনে কথায় মশগুল ছিলো, এরই মাঝে বন্ধুদের নিয়ে আরিশও ক্যান্টিনে এসেছে। আরিশ মেঘকে দেখেও না দেখার ভান করলো, মেঘ অবশ্য ওকে দেখেনি…

‘ আরিশ, আজ তুই আমাদের ট্রিট দিবি। ধরে নে এটা তোর বিয়ের ট্রিট ওকে?’

‘ ফাইন! যা খুশি কিনে নে’

‘ওকে! অয়ন, আমি যা কিনবো আজকে তুইও তাই খাবি বুঝেছিস?’

‘ আচ্ছা বাবা, কেন!’

সুহানা খাবার কিনতে শুরু করলো, আরিশ ফোনে কিছু করছিলো তখন অয়ন বললো…

‘ আরে আরিশ, একটা বিষয় লক্ষ্য করেছিস? আমাদের সেকেন্ড বয়ের সঙ্গে তোর বৌয়ের কিন্তু ভালো সম্পর্ক! আমি গত ইয়ার থেকে লক্ষ্য করছি, নিহান প্রায়ই এক্সামের আগে ওকে হেল্প করে’

‘করুক, তাতে আমি কি করবো?’

‘ টপার হাসবেন্ড থাকতে তার বউ সেকেন্ড টপারের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে, বিষয়টা কেমন অদ্ভুত না?’

‘তুই কি বলতে চাইছিস এখন আমি ওকে পড়াবো? অসম্ভব! এইসব কথা ভবিষ্যতে আমাকে আর বলিস না’

‘ তোকে তো এখন দেখছি কিছু বলারও উপায় নেই, কিছু বলার আগেই ফুসে উঠিস! যাহ, তোকে আর কিছু বলবো না’

নিহান যে মেঘকে মাঝে মাঝে নোটস দেয় সেটা ক্লাসের অনেকেই জানে, আরিশও জানে। তাছাড়া মেঘের কোনো বিষয়েই নজর দেওয়ার ইচ্ছে ওর নেই তাই বিষয়টাকেও এড়িয়ে গেলো!
___________________________

বিকেলে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতেই জানা গেলো মেঘের মা আজ মেয়ে আর জামাইকে রাতে খাবারের দাওয়াত দিয়েছে। দুপুরে মেঘের সঙ্গে কথা বলার সময় এ ব্যাপারে যদিও ওর মা কিছু বলেননি, তবে ওর বাবা ফোন করে দাওয়াত দিয়েছে। আফজাল সাহেব আরিশকে বলেন মেঘকে নিয়ে কেনাকাটায় যেতে, সন্ধ্যায় ওরা একেবারে তৈরি হয়েই বের হয় যে এখান থেকে কেনাকাটা করে সোজা মেঘের বাসায় যাবে। বাসার সবার জন্য কেনাকাটা করার পর এবার মেঘের নিজের নিজের জন্যে কিছু কেনার পালা। একটা শাড়ির দোকানে এসে ও শাড়ি দেখা শুরু করতেই আরিশ বলে ওঠে….

‘শাড়ি কিনবে নাকি? তোমাকে কিন্তু শাড়িতে মানায়না, অন্য ড্রেসে তাও ঠিকঠাক লাগে, কিন্তু শাড়ি না’

কথাটা শুনে মেঘের অনেক মন খারাপ হয়…

‘ সত্যিই মানায়নি?’

‘ তবে কি আমি মিথ্যে বলছি?’

‘ তাতে কী? সবাইকে সবকিছু স্যুট করবে তার মানে নেই আর স্যুট না করলেও শখ করে পড়তে পারে না নাকি? তোমাকেও পাঞ্জাবি একদম স্যুট করেনা কিন্তু তুমি পড়েছিলে!’

‘ হোয়াট! পাঞ্জাবিতে আমাকে যথেষ্ট মানিয়েছিলো, আর তুমি কি করছিলে?কয়েক কদম চলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছিলে’

‘এতকিছু লক্ষ্য করেছো?’

‘ শুধু আমি কেনো, সবাই লক্ষ্য করেছে। শাড়ি যখন ক্যারি করতে পারো না তখন অন্যকিছু পরলেই পারতে’

‘ বিয়ের দিন মেয়েরা শাড়িই পরে, সেটা ক্যারি করতে পারুক আর নাই পারুক কিন্তু তুমি যে আমাকে লক্ষ্য করেছো এটা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি!’

‘তোমাকে লক্ষ্য করার ইচ্ছে আমার নেই, যা কেনার জলদি কেনো’

‘ তোমার কোনো তাড়াহুড়ো থাকলে যেতে পারো, আমি তো আর বাচ্চা নই যে হারিয়ে যাবো। ঠিকই বাসায় পৌঁছে যাবো’

‘ শোনো, এমনিতেই আব্বুর কাছে আমার দোষের শেষ নেই। তোমার কথা শুনে আমার দোষের সংখ্যা আরো বাড়াতে চাইনা’

‘বাহ, একটা বিষয়ে আমাদের মিল আছে। তুমিও আমার মতই আব্বুকে ভয় পাও’

‘ আব্বুকে ভয় পাইনা, কিন্তু উনি যে কথায় কথায় আমার ক্রেডিট কার্ড জব্দ করেন এই বিষয়টা ভয় পাই’

‘আমাকে বিয়েটাও কি ক্রেডিট কার্ড হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে করলে?’

‘ধরে নাও, তাই!’

আরিশের সোজাসাপ্টা উত্তরে আরো এক দফা হতাশ হলো মেঘ, সবকিছু কতো সহজ ওর কাছে। সব কেমন নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে আরিশ কিন্তু ও পারছে না। মেয়ে বলে হয়তো মানিয়ে নিতে চাইছে, আরিশের মতো ধাক্কা দিয়ে সব সরিয়ে দিতে পারছে না। কেনাকাটা শেষে একটা ব্যাগও আরিশ ধরেনি, সব মেঘই ক্যারি করেছে।অবশ্য মেঘ বলেওনি কিছু, যে ইচ্ছে করে কিছু না করতে চায় তাকে দিয়ে কি জোড় করে কিছু করানো সম্ভব?

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]