এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-১১ + বোনাস পর্ব

0
2

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১১

আজ ক্লাস করেনি মেঘ, আরিশের কথা শোনার পর থেকেই মনমেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। আরিশের কাছে এমনকিছু শুনবে কখনো আশা করেনি মেঘ, তাই হয়তো কষ্টটা একটু বেশিই পেয়েছে তবুও আশায় ছিলো আরিশ হয়তো ওকে খুঁজতে আসবে না ফোন করে কিছু বলবে। বারবার মেঘ নিজের ফোন চেক করছিলো কিন্তু না তো আরিশ ফোন করেছে না ওকে খুঁজতে এসেছে। এতে আরও বেশি হতাশ মেঘ। বান্ধবীকে এভাবে মন খারাপ করে থাকতে দেখে তিশা কৌতুহল বশত প্রশ্ন করে বসলো…

‘ কি ব্যাপার বলতো তোর? সকালে এতো ভালো মুডে ছিলি এরপর সারাদিন মুড অফ। কিছু হয়েছে?’

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেঘ…

‘ একজনের ওপর ভরসা করতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু আজ জানলাম যে সে আমার ওপর একটুও ভরসা করেনা ‘

‘ মানে? কার কথা বলছিস আর কি হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলবি?’

‘ কি বলবো বলতো? আমি নিজেই কিছু ভেবে উঠতে পারছি না। সামান্য একটা বিষয় নিয়েই আমার ওপর অবিশ্বাস, জানিনা শেষ অব্দি আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি কি হবে জানা নেই ‘

সম্পর্কের কথা উঠতেই তিশা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো যে মেঘ কি নিয়ে আপসেট…

‘ এক মিনিট! তোর হাসবেন্ডের সঙ্গে কিছু..’

‘ বাদ দে এসব, আমার এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না ‘

‘ বাদ দিলে হবে নাকি? হুট করে এভাবে তোর বিয়ে হয়ে গেলো, এরপরও তুই সবটা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিস। এরপরও তোর হাসবেন্ড কিনা তোর ওপর ভরসা করেনা? লোকটাকে সামনে পেলে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতাম আমি ‘

‘ তাকে জোর করে আদৌ কি কোনো লাভ আছে? তুই তো জানিস বিয়েটা আমাদের দুজনের অনিচ্ছায় হয়েছে, আমরা একে অপরকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। হয়তো আমিই শুধু আমার তরফ থেকে সম্পর্কটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু সে পারছে না। পারছে না বলছি কেনো, সে পারেনি ‘

‘ ইটস ওকে মেঘনা, যে তোর কথা ভাবেনা, তার জন্যে মন খারাপ করিস না। আচ্ছা, বিকেল তো হয়ে এলো। বাড়ি যাবি না? ‘

মেঘ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সাড়ে তিনটার মতো বাজে। ব্যাগটা কাঁধে তুলে উঠে দাড়ালো মেঘ…

‘ বাড়ি তো যেতেই হবে, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে’

‘ চল তবে, আমি আজ তোকে এগিয়ে দেই। আর শোন, তোর হাসবেন্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিবি। এরপর দেখবি এমন ঝাড়ি দেবো আমি যে আর কোনোদিন তোকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলতেই পারবে না ‘

‘ তাই? তুই ওকে বকবি?’

‘ অবশ্যই! ছেলেমানুষেরা সবসময় শুধু নিজেদের বুঝ বোঝে, তাদের যা ইচ্ছে বলবে? মেয়েদের কোনো ফিলিংস নেই নাকি? আচ্ছা করে একদিন ঝেড়ে দিলে দেখবি, তোকে আর কষ্ট দিতে পারবে না ‘

শত মন খারাপের মাঝেও বান্ধবীর কথা শুনে হেসে ফেললো মেঘ, তিশা মেয়েটা এই ভার্সিটিতে মেঘের একাকীত্বের সঙ্গিনী। তিশা না থাকলে হয়তো আজ ভীষণ ডিপ্রেসড হয়ে যেতো মেঘ! কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে মেঘ, শাশুড়ির কাছে জানতে পারলো আরিশ এখনও আসেনি। মেঘ ভেবে পাচ্ছে না কি করবে, নিজেই কথা বলবে নাকি আরিশের বলার অপেক্ষা করবে? মেঘ আজ কোচিং সেন্টারে যায়নি, সন্ধ্যায় আরিশ বাসায় এসেছে, মেঘ ভেবেছিলো আরিশ নিজেই হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু নাহ। আরিশ নিজে থেকে একটা কথাও বললো না, উল্টে মেঘের সঙ্গে একটা কথা বলার প্রয়োজনও মনে করেনি। আরিশ আজ এমনভাবে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত যেনো এ ঘরে ও একাই আছে, আর কেউ নেই। আরিশ ওকে ইগনোর করতে চাইছে বুঝে মেঘ নিজেও আর কিছু বললো না। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে কথা বলার ইচ্ছে মেঘেরও নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে আরিশ মেঘকে রুমে পায়নি, সাধারণত ওরা দুজনে প্রায় একই সময়ই ঘুম থেকে ওঠে। প্রথমে আরিশ ভাবলো মেয়েটা হয়তো আজ আগেই উঠেছে, কিন্তু বাড়ির কোথাও ওকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা অবাক হলো। এই সকালবেলা মেঘ কোথায় গেলো? ড্রইং রুমে বসে কফি খেতে খেতে আরিশ এদিক ওদিক দেখছিলো, আনিশা ব্রেড চিবোতে চিবোতে সোফায় এসে বসলো…

‘ ভাবী বাসায় নেই ‘

মেঘ বাসায় নেই শুনে আরিশ কিছুটা অবাক হলো বটে, তবে বুঝতে দিলো না…

‘ আমি জিজ্ঞাসা করেছি?’

‘ তুই এদিক ওদিক দেখছিস বলে আমি ভাবলাম ভাবীকে খুঁজছিস, সকাল সকাল এতো মেজাজ দেখাচ্ছিস কেনো?’

উত্তর দিলো না আরিশ, মনে মনে ভাবতে শুরু করলো মেঘ এই সকালবেলা কোথায় চলে গেলো? এরই মাঝে আনিশা বললো…

‘ আচ্ছা শোন, আজকে আমার এক বান্ধবীর জন্মদিন আছে। তো বাবা বলেছে তুই আমার সঙ্গে যাবি, আমাকে একা ছাড়বে না ‘

‘ আমি কোথাও যেতে পারবো না ‘

‘ কেনো পারবি না? সন্ধ্যায় তো তুই বাড়িতেই থাকিস, আমার সঙ্গে এক ঘন্টার জন্যে গেলে কি হবে?’

‘ বলছি তো যাবো না, আমার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই ‘

‘ ভাব দেখাচ্ছিস? বাবাকে গিয়ে বলবো? দেখ ভাইয়া, সকালবেলা তোকে বাবার বকা খাওয়ানোর ইচ্ছে আমার নেই কিন্তু তুই যদি…’

আফজাল সাহেব নিজের মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসেন, আর আরিশের বিরুদ্ধে গিয়ে আনিশা যদি কিছু বলে তাহলে বাবা উল্টে এসে ওকেই বকবে তা আরিশের জানা। তাই আনিশাকে নিয়ে যেতে রাজি হয়ে গেলো!

‘ ফাইন! নিয়ে যাবো, এখন অন্তত আমাকে বিরক্ত করিস না ‘

‘ ওকে! থ্যাংক ইউ ‘

আরিশ নিজের ফোন বের করলো, ভেবেছিলো মেঘ হয়তো ওকে কোনো টেক্সট করেছে কিন্তু মেঘের কোনো টেক্সট বা ফোন কিছুই নেই। না জানিয়েই এভাবে চলে গেছে? আরিশের মনেও জেদ চেপে বসলো, নিজে থেকে ফোন করবে না মেঘকে!
______________________________________

বিয়ের প্রায় দু মাস পর বাবার বাড়িতে এলো মেঘ। এ বাড়িতে আসার কারণ হিসেবে মেঘ জানিয়েছে যে ওর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়ার জন্যে এসেছে। এতোদিন পর মেয়ে এসেছে বলে ওর মা বাবা বোন সবাই অনেক খুশি। এতোদিন পর মেয়ে এসেছে বলে সায়রা বেগম রান্নাঘরে এলেন মেঘের পছন্দের খাবার বানানোর জন্যে, মেঘও এলো মায়ের সঙ্গে। একটু পরে মাইশাও এসে বোনের সঙ্গে দাঁড়ালো। সায়রা বেগম রান্নার তোড়জোড় শুরু করছে দেখে মেঘ বললো…

‘ আম্মু, এতো ব্যস্ত হতে হবেনা। আমি বিকেলে চলে যাবো ‘

‘ এসেছিস যখন দুদিন থেকে যা ‘

‘ হ্যা, আপু! কতদিন পর এলি তুই। আজকে কিন্তু তোকে যেতেই দেবো না আমি ‘

‘ আচ্ছা বাবা, থাকবো ‘

‘ ইয়েহ! আপু, পাশের বাসায় বিয়ের দাওয়াত আছে আজকে। আমাদের যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আমি যাবো না। আজ সন্ধ্যায় তুই আর আমি মিলে গল্প করবো আপু, ওকে?’

বোনের কথা শুনে বিস্মিত হলো মেঘ…

‘ কোথাও দাওয়াত পেলেই তো হই হই করে দৌড় দিস, আর আজ কিনা বাড়ির পাশের দাওয়াত মিস করবি তুই?’

‘তোর জন্যে একটা দাওয়াত মিস গেলে কিছুই হবেনা, আমি যে এতদিন তোকে কতো মিস করেছি তোর ধারনা নেই’

মাইশা এসে আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো মেঘকে, রক্তের সম্পর্ক না হলেও মাইশার সঙ্গে মেঘের সম্পর্ক যেনো রক্তের সম্পর্ককেও হার মানাবে। সেই ছোট্টবেলা থেকে দুজনের বেশ মিল মোহাব্বত। মেঘও নিজের ছোটো বোনকে ভীষণ ভালোবাসে। সায়রা বেগম যে আজ অনেককিছু রান্না করবে তা ওনার আয়োজন দেখেই বুঝলো মেঘ…

‘ আম্মু, তোমাকে এখনই এতো ব্যস্ত হতে কে বললো বলোতো? থাকছি যখন, পরে করতে পারতে ‘

‘ মেয়ে বিয়ের পর বাপের বাড়ি এলে সব মায়েরাই মেয়েকে ভালোমন্দ খাওয়ানোর জন্যে ব্যস্ত হয় বুঝেছিস? পরে আরো কিছু বানিয়ে দেবো, এখন কিছু বানিয়ে দেই খাওয়ার জন্যে। ‘

‘ আমি হেল্প করি দাও ‘

‘ কিছু করতে হবেনা। তুই চুপ করে দাঁড়া ‘

সায়রা বেগম আরিশের কথা জিজ্ঞাসা করলেন মেঘকে। আরিশের প্রসঙ্গ উঠতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো, পরে হাসিমুখে উত্তর দিলো…

‘ ওর পড়াশুনা আছে, বন্ধুবান্ধব আছে আম্মু। ও এখানে এসে কি করবে? তাছাড়া আমি একা তোমাদের আদর পেতে এসেছি, সঙ্গে জামাই আনলে তো সবাই মিলে তাকে খাতির করবে ‘

মেয়ের কথা শুনে হাসলেন সায়রা বেগম…

‘ আচ্ছা ঠিক আছে, এখন শুধু আমার মেয়ের খাতির করবো। জামাই যখন আসবে তখন দেখা যাবে ‘

নিজের বাসায় আসার পর মেঘের মন কিছুটা হালকা হয়েছে, যদিও কষ্টটা পুরোপুরি কমেনি। হয়তো কমবেও না! তার ওপর গতকাল থেকে আরিশের এই উদাসীনতা যেনো মেঘের কষ্ট আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আপাতত এসব ভাবনা থেকে একটু দূরে থাকতে চাইছে মেঘ, এ বাড়িতে উপস্থিত অবস্থায় স্বাভাবিক থাকতে চাইছে। মা – বাবাকে জানতে দিতে চায়না যে আরিশের সঙ্গে অভিমান করে ও এখানে এসেছে। আজ মেঘকে ক্লাসে না দেখে অয়ন আরিশকে জিজ্ঞাসা করলো…

‘ কীরে, মেঘনা আজকে ক্লাসে আসেনি কেনো?’

রুক্ষ স্বরে আরিশ জবাব দিলো…

‘ অন্যের খবর রাখার সময় নেই আমার ‘

‘ অন্যের খবর? এমনভাবে বলছিস যেনো কোনো পরনারীর খবর জানতে চাইছি? ব্যা’টা! ওই মেয়ে তোর বউ হয় ‘

‘ তোর এত জানার শখ হলে নিজেই ফোন করে জেনে নে, বিরক্ত করিস না আমাকে ‘

‘ যাহ বাবা! কি এমন বললাম? সাত সকালে এমন রাগ দেখাচ্ছিস কেনো!’

উত্তর দিলো না আরিশ, এ মুহূর্তে কেনো যেনো সবকিছুই বিরক্ত লাগছে ওর। গতকাল মেঘের সঙ্গে ওভাবে কথা বলার পর থেকেই ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো ওর, ভেবেছিলো বাড়ি গেলে হয়তো অন্য মেয়েদের মতো মেঘ পুরোনো কথা তুলবে। ওর সঙ্গে ঝগড়া করবে কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি, উল্টে দুজনের মাঝেই গত রাতে পিন পতন নীরবতা ছিলো। আবার সকালে মেঘের এভাবে চলে যাওয়াটাও আরিশকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। এক মুহূর্তের জন্য আরিশ ভেবেই বসলো, মেয়েটা কি রাগ করে বাসা থেকে চলে গেলো? সন্ধ্যায় আনিশাকে ওর বান্ধবীর বাড়িতে দিয়ে চলে আসে আরিশ। পুরো একটা দিন কেটে গেছে, কিন্তু মেঘকে আজ দেখেনি আরিশ। মায়ের কাছে জানতে পেরেছে মেঘ সকালে ওর বাবার বাসায় গেছে, কথাটা জানার পরই আরিশের আরেকদফা রাগ হলো। ওকে না জানিয়ে চলে গেলো? তার ওপর সারাদিন একটা কলও করেনি, অবশ্য আরিশ নিজেও কল করেনি। একা বসে থেকে মাথায় নানান ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে, পরে একটা কফিশপে গিয়ে বসলো ও। সেখানে গিয়ে দেখলো একটা কাপল এসেছে, মেয়েটার সঙ্গে হয়তো ছেলেটার কোনো ঝামেলা হয়েছে। তো মেয়েটা কান্না করছিলো, ছেলেটা কিছুক্ষণ রেগে থাকলেও একটু পরে নিজেই মেয়েটার কাছে ক্ষমা চায়। আরিশ বিষয়টা ভালোভাবে লক্ষ্য করে বুঝলো দোষ মেয়েটার ছিলো তবুও ছেলেটা ক্ষমা চাইছে। বিষয়টা ঠিক হজম হলো না ওর, মেয়ে দোষ করলেও ছেলেকে কেনো ক্ষমা চাইতে হবে। পরমুহুর্তেই আরিশের মনে পড়লো ভার্সিটিতে কথাটা প্রথমে ওই মেঘকে বলেছিলো, এর প্রতিউত্তরে মেঘ নীরব ছিলো। এরপরই মেয়েটা বাসা থেকে চলে গেছে। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আরিশের মনে হলো দোষটা কি তবে আমারই ছিলো?
_____________________________________

বোনের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে মেঘ, আগে এভাবেই দুজনে একসঙ্গে টিভি দেখতো। বহুদিন পর পুরোনো মুহূর্তগুলো যেনো পুনরায় তাজা হচ্ছে। টিভি দেখার এক পর্যায়ে হুট করে মাইশা প্রশ্ন করলো…

‘ আরিশ ভাইয়ার সঙ্গে তোর সংসার কেমন চলে?’

‘ হুট করে এই প্রশ্ন কেনো?’

‘ এমনি, জানতে ইচ্ছে হলো। তোরা সমবয়সী, আবার একই ক্লাসে পড়িস। ক্লাসমেট হয়ে সংসার করতে কেমন লাগে তোদের?’

‘ উম্ম! মন্দ না ‘

মাইশা উঠে বসলো, রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে উৎসুক হয়ে বললো..

‘ তাহলে আমাকে তোর আর ভাইয়ার গল্প শোনা, তোরা এতদিন কি কি করলি। তোদের সম্পর্ক কেমন চলছে সব বল ‘

‘ এসব জেনে তুই কি করবি?’

‘ আপু, প্লিজ! আমার জানতে ইচ্ছে করছে ‘

বোনের এতো অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারলো না মেঘ, আবার আরিশের সঙ্গে ভালো কিছু সময় কাটিয়েছে সেটাও অস্বীকার করেনা ও। মেঘ আরিশের সঙ্গে কাটানো সুন্দর সময়গুলোর বর্ণনাই বোনকে শোনালো আর সেগুলো শোনাতে গিয়ে আরিশের কথা এখন যেনো আরো বেশি মনে পড়ছে মেঘের!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#বোনাস_পর্ব

দুপুরে নিজের রুমে শুয়েছিলো মেঘ, আজ দুদিন হলো বাবার বাড়িতে এসেছে। এখানে আসার পর ভার্সিটিও যায়নি। ভেবেছিলো পুরোটা সময় নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকলে বুঝি আরিশের কথা একটু ভুলে থাকতে পারবে কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। উল্টে সময় যতো বাড়ছে ততোই আরিশকে বেশি মিস করছে মেঘ, দুদিন হলো ছেলেটার সঙ্গে কথা হয়নি। গত দুদিনে যে মেঘ কতোবার মেসেজের ইনবক্স চেক করেছে তার হিসেব নেই। আরিশ একবার ফোন তো দূর টেক্সটও করেনি…

‘ আমি ওভাবে চলে এলাম, তারপরও একটাবার ফোন করে আমার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না? হয়তো আমাকে ছাড়া দিব্যি আছে। অবশ্য, আমি তো ওর সবচেয়ে অপ্রিয় মানুষ। আমার না থাকাই তো ওর জন্যে ভালো ‘

ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেঘ, ও ঠিক করেই নিয়েছিল যে আরিশ যদি নিজে ফোন বা টেক্সট করে সরি বলে তাহলেই ওকে মাফ করে দেবে। আরিশের প্রতি রেগে নেই ও, সেদিনের বলা কথাগুলো আরিশের রাগের মাথায় বলা কথা ভেবে মেঘ ওকে ক্ষমা করার জন্যে প্রস্তুত ছিলো কিন্তু পুরো দুটো দিন কেটে যাওয়ার পরও আরিশের তরফ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে পূর্বের তুলনায় অভিমান দ্বিগুণ বেড়ে গেছে মেঘের!

তখনই টিং করে ফোনে মেসেজ এলো, মেঘ ক্ষিপ্র গতিতে ফোনটা হাতে নিলো। ভেবেছিলো বুঝি আরিশ মেসেজ করেছে কিন্তু নাহ! মোবাইল অপারেটর থেকে মেসেজ এসেছে। এ মুহূর্তে মেঘের নিজেরই নিজের ওপর মারাত্মক রাগ হচ্ছে, ফোনটা ছুঁড়ে বিছানার আরেক মাথায় ফেললো মেঘ।

‘ মেঘনা, তুই একটা নির্লজ্জ্ব! ওই ছেলেটা তোকে অবিশ্বাস করে, তোর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না আর তুই কিনা তার কথাই ভেবে যাচ্ছিস! ইউ ইডিয়ট!’

নিজেকে নিজেই বকাবকি করতে শুরু করলো, এ মুহূর্তে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে মেয়েটার। তখনই রুমের দরজায় নক পড়লো…

‘ মেঘনা, আসবো?’

মায়ের গলা শুনে মেঘ স্বাভাবিক হয়ে বসে মাকে ভেতরে আসতে বললো..

‘ ঘুমাচ্ছিলি? বিরক্ত করলাম নাকি?’

‘ না না, এমনি শুয়েছিলাম আমি ‘

‘ তোর জন্যে বাদামের হালুয়া বানিয়ে আনলাম, খেয়ে বল কেমন হয়েছে ‘

প্রিয় হালুয়া দেখেই মেঘের মনটা ভালো হয়ে গেলো, এক চামচ মুখে দিতেই মন ভরে গেলো ওর। এ মুহূর্তে মন ভালো করার জন্যে যেনো এটারই প্রয়োজন ছিলো।

‘ উম্ম! অনেক মজা!! জানো আম্মু, মনে হচ্ছে কত বছর পর তোমার বানানো বাদামের হালুয়া খাচ্ছি। থ্যাংক ইউ!’

‘ তোর আরো কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলিস, বানিয়ে দেবো। আবার সেই কবে না কবে আসবি ‘

মেঘ মজা করে হালুয়া খাচ্ছিলো তখন সায়রা বেগম বললেন…

‘ জানিস, কয়দিন ধরে ভাবছিলাম তোকে ফোন করে আসতে বলবো। তার আগে তুই নিজেই চলে এসে ভালো করেছিস। কতদিন ধরে আমরা মা মেয়ে মিলে একটু শান্তিতে বসে কথা বলিনা বল?’

‘ সত্যিই আম্মু, অনেকগুলো দিন হয়ে গেছে। জানো, সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় তোমার ডাক অনেক মিস করি। আগে তুমি আমাকে আর মাইশাকে কিভাবে টেনে ঘুম থেকে তুলতে? আর আমাদের প্রতিবার লেট হয়ে যেতো স্কুল কলেজে যাওয়ার জন্যে ‘

‘ মনে থাকবে না আবার! তবে আমার মেয়েটা এখন নিজেই সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে শিখে গেছে। তা, ও বাড়িতে তোর কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’

‘ না আম্মু, আমার শ্বশুর শাশুড়ি ভীষণ সাপোর্টিভ। আমি কি দেখবো উল্টে ওনারাই আমার ভালোমন্দের খেয়াল রাখেন ‘

মায়ের প্রশ্ন শুনে একটু থামলো মেঘ, এরপর হাসিমুখে উত্তর দিলো…

‘ হুমম, এক্সপেকটেশনের তুলনায় ভালোই চলছে ‘

‘ যাক, শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। ঐভাবে তোর বাবা বিয়েতে তোকে করলো, আমি চিন্তায় ছিলাম যে তোদের দুজনের ঠিকমতো বনিবনা হচ্ছে কিনা ‘

‘ তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না আম্মু, সব ঠিক আছে। আমি আর আরিশ সম্পর্কটা স্বাভাবিকভাবে মানিয়ে নেওয়ার পুরো চেষ্টা করছি ‘

সায়রা বেগম মেয়েকে ওর সাংসারিক জীবন সম্পর্কে আরও কিছু কথা জিজ্ঞাসা করলেন। মেঘ স্বাভাবিকভাবেই সবকিছুর উত্তর দিলো। মেঘ চায়না ওর মা বাবা ওর আর আরিশের মধ্যকার সমস্যার কথা জানুক। ওদিকে.. ক্লাব হাউজের বাগানে বসে আছে আরিশ, টেবিলের ওপর থাকা কফির মগটা অন্যমনস্ক হয়ে স্লো মোশনে ঘোরাচ্ছে আর পাশে থাকা ফোনটার দিকে মাঝে মাঝে নজর দিচ্ছে। ওকে এমন অন্যমনস্ক দেখে সুহানা অয়ন দুজনেই অবাক, বন্ধুদের যে সবসময় মাতিয়ে রাখতো সেই ছেলে আজ দুদিন ধরে কেমন মনমরা হয়ে গেছে। অয়ন বললো…

‘ আরিশ, মেইন প্ল্যান তুই করেছিস। এখন আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি আর তুই এমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকলে কিভাবে হবে?’

হুট করেই রেগে উঠলো আরিশ…

‘ শুনছি তো, বল না তোরা যা বলছিস ‘

সুহানা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো…

‘ আরিশ, তোর আবার কি হলো! হুট করে এমন রেগে গেলি কেনো? আমরা তো রাগ করার মতো কোনো আলোচনা করছি না ‘

‘ ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করিস না সুহানা, দুইদিন ধরেই এরকম করছে। কিছু বললেই কেমন ক্ষেপে যাচ্ছে ‘

‘ মানে কি অয়ন! কোনো কারণ ছাড়া ও রাগ করবে কেনো? আরিশ কি হয়েছে?’

‘ বলছি তো কিছু হয়নি, অয়নের কথায় পাত্তা দিস না তো। ও অনেক অযথা কথা বলে ‘

‘ আমি অযথা বলি? তুইই তো অদ্ভুত বিহেভ করছিস দুদিন…ওহহ! ইয়েস, আমি কেস ধরে ফেলেছি। আর কিছু বলতে হবেনা ‘

‘ কি হয়েছে?’

অয়ন আড়চোখে চেয়ে দেখলো আরিশ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, অয়ন একটু ভয় পেলো বটে!

‘ আমি তোকে পরে আলাদা বলবো ‘

‘ অয়ন, মজা করিস না। বল’

‘আরিশ আর ওর বৌর সঙ্গে ঝগড়া চলছে ‘

‘ বাজে বকিস না অয়ন ‘

‘ আরিশ, আমাকে আর কিছু বোঝাতে হবে না। মেঘনা দুদিন ধরে বাসায় নেই, ভার্সিটিতেও আসছে না আর তুইও এরকম মেজাজ গরম করে আছিস। সবকিছু এটাই বোঝাচ্ছে যে তোদের ঝগড়া হয়েছে ‘

‘ এমন কিছুই হয়নি! স্টপ দিস অয়ন!’

সুহানা অয়নকে থামিয়ে বললো…

‘ আহা, মেঘনার সঙ্গেই তোর কিছু একটা হয়েছে আরিশ। সেটা তোর আচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সমস্যা কী হয়েছে চাইলে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারিস। হতে পারে আমরা হেল্প করতে পারবো ‘

‘ সুহানা, তোরা আমার বিষয় নিয়ে কেনো পড়লি বলতো? এখানে তোর বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ‘

‘ তার আগে তোর সমস্যার সমাধান করি? দেখ, একটা সম্পর্কে ঝগড়া হবেই। সরি বলে মিটিয়ে নিলেই হয় ‘

‘ আমি দোষ না করে সরি কেনো বলবো?’

‘ তাহলে মেঘনা কিছু বলেছে?’

‘ না, আমিই বলেছি। কিন্তু আমার মনে হয় না আমি দোষের কিছু বলেছি। মেয়েটা ওভার রিয়েক্ট করছে ‘

‘ আরিশ, মেয়েরা ছোটো একটা কথাও কিন্তু মনে চেপে বসে থাকে। হয়তো তোর কাছে ছোট্ট বিষয় মনে হচ্ছে কিন্তু ওর কষ্ট লেগেছে? মেয়েটা নিশ্চয়ই অভিমান করে বাবার বাসায় চলে গেছে ‘

‘ আমি তো ওকে যেতে বলিনি, আর ও যে গেছে আমাকে বলেও যায়নি। আমি কেনো ওর অভিমান ভাঙ্গাবো?’

‘ এভাবে বলিস না, ও তোর কথায় অভিমান করেই গেছে তাহলে আবার তোকে বলতে যাবে কেনো? মানছি তোদের বিয়েটা জোড় করে দেওয়া হয়েছে তাই বলে ও কি তোর বউ নয়? তোর বউ যদি বলে আমি আর আসবো না তখন কি করবি?

আরিশ কিছু বলার আগেই অয়ন হেসে বলে বসলো…

‘ আর কি হবে? তখন আমরা আরিশ রূপে দেবদাসের নতুন ভার্সন দেখতে পারবো। বিষয়টা কিন্তু দারুন হবে ‘

আরিশ বেজায় চটলো, রাগী চোখে তাকালো অয়নের দিকে…

‘ এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে অয়ন ‘

‘ কি বাড়াবাড়ি হচ্ছে? আমরা তোকে চিয়ার আপ করার চেষ্টা করছি আরিশ। যা হবার হয়েছে। সমস্যা হলে তার সমাধানও আছে ‘

‘ হি ইজ রাইট! একটা সম্পর্কে ঝামেলা লাগবেই, তবে সেটা মিটিয়ে নেওয়াই উত্তম। ওর সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে নে সবটা ‘

সুহানার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো আরিশ কিন্তু মেঘের সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলতে ইগোতে বাঁধছে ওর। মেঘ নিজে থেকেও তো কল করতে পারতো। এসব ভেবে ভেবে আরিশের যেমন মেঘের ওপর রাগ হচ্ছে তেমনি নিজের ওপরও বিরক্ত হচ্ছে!
___________________________________

আজ পাঁচদিন হলো মেঘ বাসায় নেই, তিনদিন ধরে মেঘ ক্লাস করছে ঠিকই কিন্তু আরিশকে যথাসম্ভব ইগনোর করছে। ক্লাস টাইম ছাড়া মেঘকে ভার্সিটির কোথাও খুঁজে পায়নি আরিশ। মেঘ ইচ্ছে করে ইগনোর করছে বোঝার পর আরিশের আরো মেজাজ বিগড়ে গেছে। রোজকার মতো আজও কম্পিউটার গেমস নিয়ে বসেছিলো আরিশ, কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো কয়েকদিন যাবত গেমসে মোটেও মন বসাতে পারছে না অথচ এই গেমস খেলেই কখনো কখনো লম্বা সময় পার করে দিতো। এক পর্যায়ে রীতিমত জোর করেই গেমসে মন বসানোর চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যর্থ হলো, বিরক্ত হয়ে কান হেডফোনটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় গিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। বহুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো আরিশ…

‘ আমি কি ওকে মিস করছি?’

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]