এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-২২

0
2

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ২২

সুহানার বাবা অয়ন ও আরিশের নামে কেস করেছে, পুলিশ এসে আরিশকে ওর বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। অয়নকে আগেই পুলিশ স্টেশনে এনেছে। মেঘ আসতে চাইছিলো কিন্তু আরিশ ওকে আনতে চায়নি, ও চায়না মেঘ কোনো ঝামেলায় জড়াক। সুহানার বাবা অয়ন ও আরিশকে পুলিশের সামনে বসিয়েই মেয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেন…

‘ তোমাদের আমি বিশ্বাস করতাম, ছোটো থেকে তোমরা তিনজন ভাইবোনের মতো একসঙ্গে থেকেছো। তোমাদের কাছে এমনকিছু আশা করিনি আমি ‘

‘ সরি আঙ্কেল, কিন্তু আমরা নিরুপায় ছিলাম। আপনি আপনার মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করেননি আর আমরা বন্ধু হিসেবে ওকে কষ্টে দেখতে চাইনি তাই ওকে ওর ভালোবাসার মানুষকে পেতে সাহায্য করেছি ‘

আরিশের কথা শুনে ভীষন রেগে গেলেন সুহানার বাবা, রাগী কণ্ঠে বললেন…

‘ তোমাদের এই উস্কানিতে এতবড় একটা কাজ করার সাহস পেয়েছে ও। এই তোমাদের উস্কানিতে আমাদের পরিবারের সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেই ধারণা আছে তোমাদের?’

‘ আঙ্কেল, আমরা জানি আপনি নিজের মেয়ের জন্যে চিন্তিত কিন্তু সুহানা যাকে বিয়ে করেছে সে অনেক ভালো ছেলে। আপনি চাইলে ওর সঙ্গে একবার দেখা করে…’

‘ এখানে আমি তোমাদের উপদেশ শুনতে আসিনি অয়ন, আমার মেয়ে কোথায় সেটা বলো নাহলে আজকের রাতটা তোমাদের এখানেই কাটাতে হবে!’

সুহানার বাবার ধমকি শুনেও ওরা বিচলিত হলো না, অয়ন বললো…

‘ আঙ্কেল, আমি জানি আমরা ভুল করেছি, কিন্তু বন্ধু হিসেবে আমরা ওকে সাহায্য করেছি। এতে আমাদের কোনো আফসোস নেই ‘

‘ দেখো, আমি এসব ফালতু কথা শুনতে চাইনা আমার মেয়ে কোথায় সেটা জানতে চাই!’

‘সুহানা যেখানেই আছে ভালো আছে আঙ্কেল! ওকে ওর মতো ভালো থাকতে দিন না ‘

অয়ন ও আরিশকে সুহানার বাবা ও অফিসার মিলে অনেকভাবে প্রশ্ন করে, কিন্তু ওরা কিছুই বলেনি। কিছুক্ষণ পর আফজাল সাহেব ছেলেকে ছাড়ানোর জন্যে উকিল নিয়ে আসেন ঠিকই কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় থানার অফিসার বলেছে আগামীকাল সকালে উকিল নিয়ে আসতে বিধায় আজকের রাতটা বাধ্য হয়ে জেলেই কাটাতে হবে! পরদিন সকালে উকিলের ব্যক্তিগত কিছু কাজের জন্যে আসতে একটু সময় লাগবে বলে জানায়, সকাল দশটা প্রায় গেছে। আরিশ অয়ন দুজনে ঠিক করেই নিয়েছিলো যে যাই হয়ে যাক সুহানার ঠিকানা বলবে না। একটু পরে আফজাল সাহেব এলেন, সঙ্গে মেঘও এসেছে। মেয়েটার চোখমুখ ফুলে গেছে, ওকে দেখে বসা থেকে উঠে এগিয়ে এলো আরিশ। সেলের ফাঁকা দিয়ে আরিশ হাত বাড়িয়ে দিতেই মেঘ ওর হাতটা শক্ত করে ধরলো, ধরা কণ্ঠে আরি জিজ্ঞাসা বললো..

‘ আরিশ, তুমি ঠিক আছো তো?’

আরিশ মেঘের গালে হাত দিয়ে বললো…

‘ আমি একদম ঠিক আছি, কিন্তু তোমার একি অবস্থা হয়েছে? মুখটা দেখেছো আয়নায় কেমন দেখাচ্ছে?’

আরিশের সঙ্গে এভাবে জেলে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে তা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি মেঘ, যদিও এখানে অয়ন আরিশের কোনো দোষ নেই তবুও জেলে তো একটা রাত কাটাতে হলো।

‘ আরেহ, তুমি এমনভাবে কাঁদছো কেনো? কয়েক ঘন্টার জন্যে জে’লে রেখেছে আমাকে, ফাঁ’সিতে তো ঝু’লি’য়ে দেয়নি ‘

রেগে গেলো মেঘ…

‘ সকাল সকাল কিসব বাজে কথা বলছো তুমি এসব?’

‘ ওকে, রিল্যাক্স! মজা করছি আমি ‘

‘ তোমার চিন্তায় সারারাত আমার কাল ঘুম হয়নি আর তুমি এখানে মস্করা করছো! বের হও এখান থেকে আগে, তারপর তোমার খবর আছে ‘

মেয়েটা রাগ দেখানোর চেষ্টা করছে ঠিকই কিন্তু মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়েছে, আরিশ ওকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আফজাল সাহেব পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিলেন ততক্ষণে অয়নের বাবাও এসে হাজির, উনিও ছেলের জন্যে উকিল নিয়ে এসেছেন। অয়নের উকিল এসে অয়নকে ছাড়াতে ছাড়াতেই হঠাৎ সুহানার আগমন ঘটলো, সঙ্গে জয়ও আছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে ওদের দুজনকে দেখে অবাক হলো সকলেই অবাক হলো! আরিশ মেঘকে প্রশ্ন করলো…

‘ ওরা এখানকার খবর কিভাবে জানলো! মেঘনা তুমি কি কিছু বলেছো?’

‘ আমি ওদের কিছু জানাইনি ‘

সুহানা ভেতরে এসেই অফিসারকে বললো…

‘ অফিসার, আমি সুহানা! আমার বাবা আমার ওপর রাগ করে ওদের নামে কে’স করেছে। আমার বন্ধুদের কোনো দোষ নেই, ওদের ছেড়ে দিন’

‘ কিন্তু আপনার বাবা তো অন্য কথা বলেছে, তোমার বন্ধুরা নাকি তোমাকে উস্কেছে বিয়েটা করার জন্যে?’

‘ ওরা আমাকে সাহস জুগিয়েছে, উস্কানি দেয়নি! আর বিয়েটা আমরা স্বেচ্ছায় করেছি, ওরা শুধু বন্ধু হিসেবে আমাদের সাহায্য করেছে। আপনি ওদের ছেড়ে দিন, আমার বাবার সঙ্গে যা কথা বলার আমি বলবো ‘

‘ ঠিক আছে, ‘ আপনার বাবাকে খবর দেওয়া হবে। উনি আসুক তারপর এটার একটা সুরাহা হবে। আপাতত সকলে বসুন ‘

অফিসার সকল দিক ভেবে সুহানার বাবাকে ফোন করে আসতে বললেন, মেয়ে এত সহজেই থানায় এসেছে শুনে সুহানার বাবা অবাক হয়েছিলেন বটে! সুহানা সেলের কাছে এগিয়ে আসতেই অয়ন প্রশ্ন করলো…

‘ তুই কিভাবে জানলি আমরা এখানে?’

‘ আমি আরিশকে ফোন করেছিলাম, ওর ফোন বন্ধ দেখে ল্যান্ডলাইনে কল করেছিলাম তখন আন্টির কাছে শুনলাম। তোরা কি রে? ঠিক করেই নিয়েছিলি যে এখানে যাই হোক আমাকে কিছু জানতে দিবি না?’

‘ আমরা তোকে এতো ছোটো ব্যাপারে টেনশন দিতে চাইনি ‘

জয় আরিশকে বললো…

‘এটা ছোটো ব্যাপার নয় আরিশ, আমাদের জন্যে তোমরা শুধু শুধু ঝামেলায় কেনো পড়বে বলো?’

‘ তেমন বড় ব্যাপারও ছিলো না, আমরা এমনিতেই ছাড়া পেয়ে যেতাম আর এখানে আমরাই ম্যানেজ করে নিতাম সবটা’

‘ আমার জন্যে আমার বন্ধুরা সাফার করবে আমি দূরে বসে আরাম করবো? অসম্ভব! তোদের যাতে ভবিষ্যতে। কোনো সমস্যায় না পড়তে হয়, আমার বাবা যাতে তোদের আর বিরক্ত না করতে পারে সেই ব্যবস্থা করেই যাবো আমি ‘

সকলে অপেক্ষায় বসলো, কিছুক্ষণ পর সুহানার বাবা থানায় এলো। বাবা মেয়ের কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা চললো, পরে জয় ওনাকে কিছু কথা বলে শান্ত করলো। যদিও সুহানার বাবার জয়কে একদমই পছন্দ নয়, তবে এই মুহূর্তে নিজের রাগ সামলানোর জন্য জয়ের কথাগুলো বাধ্য হয়ে শুনলো। সবার মতামত শোনার পর অফিসার সুহানার বাবাকে বললেন…

‘ দেখুন, আপনার মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে আর প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি স্বেচ্ছায় বিয়ে করে সেখানে আমাদের বাঁধা দেওয়ার অধিকার নেই। উল্টে আপনার মেয়ে যদি বলে বসে আপনি ওদের সংসার ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন তাহলে তখন আমরা আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারবো। এবার আপনারাই ঠিক করুন কি করবেন ‘

সুহানার বাবা কিছু বললেন না, এ মুহূর্তে নিজের মেয়ের ওপর ভীষন রেগে আছেন উনি। সুহানা বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো…

‘ আব্বু, আমরা বাড়ি গিয়েও কথা বলতে পারবো। তোমার যা বলার আছে আমরা দুজনেই শুনবো কিন্তু এরপর থেকে আমাদের কোনো বিষয়ে তুমি প্লিজ আমার বন্ধুদের টেনে এনো না ‘

যার জন্যে এত কাহিনী সেই মেয়েই ফিরে এসেছে বলে সুহানার বাবা আপত্তি করলেন না, ঠিক করলেন যা আলোচনা করার বাড়ি ফিরে করবেন। পুলিশ আরিশ অয়ন দুজনকেই ছেড়ে দিলো। পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে সুহানা জয় দুজনেই সুহানার বাবার সঙ্গে বাসায় যাবে, যাওয়ার সময় অয়ন জিজ্ঞাসা করলো…

‘ সুহানা, আঙ্কেলকে দেখে মনে হলো অনেক রেগে আছে। আমরা কি আসবো তোর সঙ্গে? কোনো কথা উঠলে আমরা…’

‘ তোমরা এমনিতেই আমাদের জন্যে অনেককিছু করলে, আমাদের জন্যে অনেক ঝামেলাও পোহাতে হলো তোমাদের। এবার সবটা না হয় আমরা দুজনেই সামাল দেবো!’

‘ কিন্তু জয়, আমরা থাকলে ব্যাপারটা সামলানো আরো সহজ হবে মনে হয়। কি বলিস আরিশ?’

‘ হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয় ‘

‘ আরিশ, তোরা আর এসব ঝামেলায় আসিস না। আব্বুকে আমরা না হয় কোনোভাবে ম্যানেজ করে নেবো। এমনিতেই আমাদের জন্যে তোদের বিনা দোষে একরাত জেলে থাকতে হলো। আই অ্যাম রিয়েলি সরি ‘

‘ বেস্টফ্রেন্ডদের সরি বলছিস? আমাদের সঙ্গে কবে থেকে ফর্মালিটি মেইনটেইন করা শুরু করলি তুই?’

‘ সরি রে!’

‘ সরি বলার কিছুই হয়নি, ভাবিস না এইটুকু বিষয়ের জন্যে আমরা আর তোকে সাহায্য করবো না। কোনো দরকার পড়লে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কল করবি ‘

অয়ন আরিশ মিলে সুহানা ও জয়কে সাহস দিচ্ছে, মেঘ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে। ওদের তিনজনের বন্ধুত্ব ভীষণ ভালো লাগে মেঘের, ইদানিং এতো অটুট বন্ধুদের উদাহরণ তেমন দেখাই যায়না। কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরলো আরিশ, ছেলেকে দেখেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন রেহানা বেগম। ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন…

‘ বাবা, তুই ঠিক আছিস তো? পুলিশ আবার কিছু করেনি তো?’

‘ আম্মু, আমার কিছুই হয়নি। শুধু সারারাত ফ্লোরে বসে থেকে শরীর ব্যথা হয়েছে। রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে ‘

‘ কে বলেছিলো তোকে এতো বড় একটা কাজ করতে হ্যা? খবরদার! ভবিষ্যতে আর এরকম কিছু করতে যাবি না। জানিস ওভাবে হুট করে পুলিশ তোকে তুলে নিয়ে যাওয়ায় আমি কতো ভয় পেয়ে গেছিলাম?’

‘ আম্মু, শান্ত হও তুমি। তোমাকে ছেলে একদম সুস্থ স্বাভাবিকভাবে ফিরে তো এসেছে, এতো চিন্তা করো না এখন ‘

‘ তুই আর এমনকিছু করিস না যাতে আমাকে চিন্তিত হতে হয় ‘

আফজাল সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন…

‘ তোর ওই হঠাৎ ট্রিপে যাওয়ার বিষয়টা আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো, কিন্তু তুই যে এমনকিছু করতে যাচ্ছিস ভাবিনি। সঙ্গে করে মেঘনাকে নিয়ে গেছিলি কেনো? তোর সঙ্গে যদি ওকেও তুলে নিয়ে যেতো পুলিশ?’

‘ ওকে নিয়ে গেলে কি হতো? আমি তো ছিলামই ওখানে, আমি ওর খেয়াল রাখতাম’

ছেলের কথা শুনে আফজাল সাহেব ও রেহানা বেগম ও মেঘ তিনজনই হতভম্ব হয়ে গেলো, এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো অথচ ছেলেটার মাঝে চিন্তার লেশমাত্র নেই! মা বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা শেষে রুমে এলো আরিশ ও মেঘ!

‘ জেলে থাকার কষ্ট কেমন সেটা আগে জানলে লোকে হয়তো ক্রা’ই’ম করাই ছেড়ে দিতো, এক রাত থেকেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে!’

আরিশ নিজের জেলে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে শুরু করেছিলো, এরই মাঝে হুট করে মেঘ এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে! মুচকি হেসে আরিশ প্রশ্ন করলো…

‘ কি ব্যাপার, আজ হঠাৎ এতো ভালোবেসে জড়িয়ে ধরা হচ্ছে কেনো!’

আরিশের বুকে মুখ গুঁজে মেঘ উত্তর দিলো…

‘ তুমি প্লিজ ভবিষ্যতে আর এমনকিছু করোনা যাতে আজকের মত কোনো ঘটনা ঘটে ‘

দু হাতে মেঘের মুখটা তুললো আরিশ…

‘ বোকা মেয়ে, এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? পুলিশ কি আমাকে কোনো অপরাধে তুলে নিয়ে গেছিলো?’

‘ তবুও! ঐভাবে…’

‘ থাক, এইসব নিয়ে আর আলোচনা করতে হবেনা। যা হবার হয়ে গেছে, তুমি এখন মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলো ‘

হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে আবারো আরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেঘ বললো…

‘ আই মিসড ইউ ‘

সারারাত এতো ঝড় ঝাপটা পার করে আসার পর সকালবেলা বউয়ের এতো ভালোবাসা ভালোই লাগছে আরিশের, সুযোগ পেয়ে নিজেও মেঘকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো। মেয়েটা বুঝি আজকাল একটু বেশিই ভালোবাসতে শুরু করেছে…!!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]