#এসো_রূপকথায় (৬)
বাড়ি ভরা মেহমান। রিয়া স্বভাবে ভীষণ চটপটে। স্কুল থেকে এসেই এত মানুষ দেখে তার হৃদয়ে প্রশ্ন জাগল। ড্রয়িং রুম দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেল লম্বা দেহের একটি ছেলেকে। ফর্সা ত্বক। দেহের গঠন মাঝামাঝি ধরনের। ছেলেটা কেমন করে তাকাল যেন। বোঝা গেল দুষ্টু স্বভাবের। রিয়ার ভালো লাগল না। ও ছুটে গেল রান্না ঘরে। মা তখন রান্না বান্নায় ব্যস্ত।
“ও মা, বসার ঘরে এত মানুষ কেন?”
“এসে গেছিস। হাতে হাত লাগা তো মা।”
“ওরা কে মা?”
“তোর বাবার বন্ধুর পরিবার। অনেক দিন ধরেই আসবে আসবে করে আজ এলেন।”
“কেন এলেন?”
কথাটি বলতেই ফাহমিদা ভ্রু কুঞ্চিত করে মেয়ের দিকে তাকাল। তার মেয়েটা হয়েছে বড়ো অদ্ভুত।
“এসব কী কথা রিয়া? মেহমানদের প্রতি এমন মনোভাব রাখবে না।”
“আচ্ছা মা।”
“এখন খাবার গুলো নিয়ে আসো তো।”
ভদ্র মেয়ের মতো খাবার নিয়ে গেল রিয়া। ডাইনিং ভরাট করে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। খাবারের ঘ্রাণে ম ম করছে চারপাশ। রিয়ার পেটের ভেতরে থাকা ক্ষুধার দল চেচিয়ে ওঠল যেন। এদিকে মা অতিথি সেবায় ব্যস্ত। মন খারাপ করে ঘরে ফিরল রিয়া। আপা বসে আছে। হাল্কা সাজগোজ করেছে। রিয়া উদাস সুরে শুধাল,”সাজছিস কেন আপা?”
“এসে গেছিস। তুই ও তৈরি হয়ে নে।”
“কেন? কোথায় যাব?”
“বাবার বন্ধুর বাড়ি।”
“মানে?”
“নিচে মেহমান দেখিস নি?”
“দেখেছি তো।”
“ওদের বাসায় যাব ঘুরতে। শুনেছি বিশাল বাড়ি। তাছাড়া এলাকা ও ভীষণ সুন্দর।”
রিয়া আগ্রহ পেল না। এদিকে মেহনূর সাজগোজ করে বসে আছে। খানিক বাদে ঘরে প্রবেশ করল কারিব। বড়ো ভাইকে অন্য রকম শ্রদ্ধা করে ওরা। তাই ওঠে দাঁড়াল।
“দাঁড়ালি কেন? বোস তোরা।”
রিয়া বসল না। বরং ভাইয়ের কাছে এগিয়ে গেল। হাত ধরে বলল,”ভাইয়া,তুমি ও যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ। তুই ও তো যাবি।”
“আমার ইচ্ছে করছে না।”
“পাগল মেয়ে। গেলে ভালো লাগবে। তাছাড়া ওদের বাড়ির সবাই খুব ভালো।”
রিয়া ছোট ছোট করে চেয়ে রইল। ও যেতে চাইছে না ঐ দুষ্টু ছেলেটার জন্য।
মুন্সিগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইল। ভীষণ দূরের রাস্তা। এতটা জার্নি করার অভ্যেস নেই রিয়ার। ও রাস্তা ভরে বমি করতে করতে গেল। এক প্রকার অসুস্থ হয়ে পড়ল যেন। কখন কীভাবে পৌছাল জানা নেই। চোখ মেলল যখন তখন বেশ রাত হয়ে আছে। অন্ধকার পরিবেশ। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেল। লাফিয়ে ওঠল। আশ পাশ হাতিয়ে কোনো মতে দরজা খুলে বেরোল। তারপর কোথায় যে এল সে নিজেও জানে না। ঠান্ডা ভেজা একটি হাত ওর ছোট হাতটাকে স্পর্শ করল। সমস্ত শরীর কম্পন হলো রিয়ার। আলো জ্বলল ক্ষণিকেই। রিয়ার ভীত হওয়া দৃষ্টি। রিসানের দু চোখে বিস্ময়।
“আমার রুমে কী করছ তুমি?”
রিয়া কিছুই বুঝল না। পুরোপুরি চাইল। দেখতে পেল ছেলেটার গায়ে শুধুই তোয়ালে। উন্মুক্ত লোমশ বুকে পানি জমে আছে। কিশোরী কন্যার হৃদয়ের ধুকপুক বেড়ে গেল। আর একটু হলেই কান্না করে দিত। তবে রিসান সামলে নিয়ে বলল,”অন্ধকারে চলে এসেছ? আচ্ছা, ভয় পেও না। ঐদিকটায় দরজায়। তারপর ডান পাশের করিডোর দিয়ে নিচে নেমে যাবে। ওখানে সবাইকে পাবে।”
রিয়া হু না কিছুই বলল না। কোনো মতে পালিয়ে বাঁচল যেন। রিসানের ফোনটি বেজে চলেছে। তাই মনোযোগটি সরিয়ে নিল ও।
সেবার দারুণ সময় গেল টাঙ্গাইলে। রিসানের বাবারা চার ভাই। সবার বড়ো সারোয়ার ইসলাম, তারপর রাশেদুল ইসলাম, ছোট দুজনের নাম আজিম ইসলাম ও আকবর ইসলাম। আজিম বেশ অনেক বছর আগেই মা রা গিয়েছেন। আকবরের দুই ছেলে মেয়ে নিতু আর রুবাই। বাচ্চা দুটোকে এত ভালো লাগল রিয়ার। ইচ্ছে হচ্ছিল সাথে নিয়ে যেতে। তবে চার পাঁচ বছরের বাচ্চাদের কি সাথে নেওয়া যায়? ফেরার দিন রিয়ার মন খারাপ হলো। তার কিশোরী হৃদয় একটা মানুষকে খুঁজছিল। যার নাম রিসান। কিন্তু মানুষটাকে দেখা গেল না।
এক বছর পর ক্লাস নাইনে পড়াকালীন সময় ব্যক্তিগত ফোন পেল রিয়া। ফেসবুক আইডি ওপেন করল। কিছু দিন পর রিসানের আইডিও পেয়ে গেল। একবছর পর ছেলেটাকে দেখল ও। ভীষণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেহে বলিষ্ঠতা এসেছে। আসার ই কথা। ছেলেটা এখন কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে পড়ছে কী না। এখন তো পারিবারিক ব্যবসাতেও হাত লাগিয়েছে। সব মিলিয়ে দারুণ আছে ছেলেটা। এদিকে রিয়া যে একটা বছর নিদারুণ যন্ত্রণায় ভুগছিল। সেটা কী জানে মানুষটা? পুরো রাত ছেলেটার প্রোফাইলে ঘুরঘুর করল ও। ভালো লাগাটা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিল। চোখের তৃষ্ণা যেন মিটতেই চাইছিল না। ফোনের চার্জ তখন ১%। তবু দমছে না রিয়া। তারপর হুট করেই ফোনটা অফ হয়ে গেল। মন খারাপ হলো ওর। ফোন চার্জে দিয়ে শুয়ে পড়ল। তবে ঘুম সে তো উড়ে গেছে। ঐ রিসান নামের মানুষটার কাছে ভীষণ ভাবে আটকে আছে।
বর্তমান
চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল রিয়ার। সেই সময়টা জীবনে না এলেই বোধহয় ভালো হতো। কাউকে ভালোবেসে না পাওয়ার মতন নি ষ্ঠু র য ন্ত্র ণাটা সইতে হতো না। ছেলেটাকে এক্স বলা যায় না। একদম ই বলা যায় না। মানুষটা নি ষ্ঠু র। রিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। উপেক্ষা করেছিল তার প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিকে। যেই যন্ত্রণা থেকে বের হতে এক বছরে ও বেশি সময় লেগেছিল ওর। একান্ত যন্ত্র ণাটা কেউ দেখে নি রাতের আঁধারে’রা ছাড়া। ঐ য ন্ত্র ণাটা মনে করেই রিয়া বিড়বিড় করে ওঠল,”আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করব না রিসান। কখনোই না। আপনি আমার জীবনে না এলে জীবনটা অনেক বেশি সুন্দর হতো।”
সত্যি সত্যি এক মাস পর ও রিয়ার সাথে যোগাযোগ হলো না রিসানের। ও এখন ব্যস্ত পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছে। পড়াশোনাটাও শেষে পথে। শুরুর দিকে ব্যবসাতে খুব একটা মনোযোগ দিত না। তবে এখন একটু বেশিই মনোযোগ দিচ্ছে। তার সফলতা ও ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে। ওর কাজে খুশি হলো পরিবারের সকলে। তবে খুশি হলেন না আলিয়া। ছেলেটা মাঝ রাতে বাড়ি ফিরছে। আবার ভোরে ওঠেই চলে যাচ্ছে। এসবে তিনি খুশি হতে পারছেন না। মায়ের মন কী না। তিনি সেদিন খুব রাত অবধি জেগে রইলেন। রিসান ঘরে প্রবেশমাত্রই মা কে দেখতে পেল। ক্লান্ত দেহটা ডিভানে এলিয়ে দিয়ে বলল,”এত রাতে জেগে আছ কেন মা?”
“তুই কেন এত রাত করে ফিরছিস?”
“কাজের চাপ যাচ্ছে।”
“তোর বাবা, চাচারা ও তো কাজ করছে। তাদের কেন চাপ যায় না?”
“এসব রাখো। তুমি জানো না এত রাত অবধি জাগা তোমার শরীরের জন্য খারাপ?”
“আর ছেলে যে মাঝ রাতে ফিরছে। কতদিন হয় মুখটাও দেখি না ভালো করে।”
এ কথা বলেই কেঁদে ফেললেন আলিয়া। রিসান ওঠে এসে মা কে আলিঙ্গন করল।
“বাবা তোর কী হয়েছে? এত কাজ কেন করছিস?”
“কিছু হয় নি মা।”
“তাহলে কথা দে আর এত রাত করে আসবি না। শরীরের যত্ন নিবি।”
রিসান কিছুটা নিচু সুরে বলল,”ঠিক আছে মা।”
মেহনূর পানি নিতে এসেছিল। মা ছেলের সুন্দর মুহূর্ত দেখে পানি না নিয়েই ফিরে গেল। ঘরে যেতেই দেখল জাহিদ জেগে আছে। মেহনূর নজর ফিরিয়ে নিল। এদিকে জাহিদের অন্তঃকরণ জ্ব লে যাচ্ছে। এত গুলো দিন পেরিয়ে গেল অথচ তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হলো না। স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক তো শুধু বিছানাতে নয়। মনের সম্পর্কটা যদি ঠিক না থাকে তবে সম্পর্কটাকে কী স্বাভাবিক বলা চলে?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি