#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ১১
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
বর্ষার আর্দ্র বাতাসের সাথে গ্রীষ্মের দাবদাহের সম্পূর্ণ এক মিশ্রন ঘটে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের মিলনকালে। মানে যখন গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে সবে বর্ষা পড়তে শুরু করে। এমনি একটা সময় চলছে এই প্রকৃতিতে। যাকে এক কথায় বলে ভ্যাপসা গরম সেটাই চলছে ঢাকা শহর জুড়ে।
ঢাকা শহরের গরমে এমন সময়ে না শান্তি আছে বাইরে আর না আছে ঘরে। তবে যারা এসির বাতাসে থাকার সামর্থ রাখে তাদের
ব্যাপারটা ভিন্ন। তাদের কাছে সারাটা বছরই সর্বত্রই বসন্তকাল বা সহনীয় শীতকাল। সবে
দশ দিন যাবত শাহের আলী গরীব থেকে বড়লোক হয়েছে।
বেয়াই হতে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ শীতাতপ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাট সে পেয়েছে।
এর মধ্যেই শাহের আলী এসিতে সম্পূর্ণ অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
তার উপর বেয়াই হতে প্রাপ্ত গাড়িটাও সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সারাদিন গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ানো, এ রেস্টুরেন্ট সে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, এ শপিং মল, ও শপিং মলে কেনাকাটা করা। এসব করতে করতেই শাহের আলীর দশটা দিন কেটে গেছে স্বপ্নের মতো। কোনোদিন পেটপুরে খেতে না পারা শাহের আলী খেয়েছে দামী রেস্টুরেন্টে বুফেতে গোটা পরিবার নিয়ে। রানুকে সে কল পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলো এত আরাম আয়েশের চাপে। দশ দিনেই যেনো সে নিজেকে দশ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছে। অভিজ্ঞতার ডায়রি তার পরিপূর্ন হয়ে গেছে। যা কোনোদিন দেখেনি, তাই সে দেখেছে, যা কোনোদিন ছুঁতেও পারেনি, তা ভোগ করেছে।
বিশাল বড় ড্রয়িং রুমের বিশাল বড় মনিটরে ঝাকানাকা নাচ গান তো দেখেছেই, সেই সাথে সিনেপ্লেক্সে গিয়েও ইংরেজী ছবি দেখে এসেছে, কোনো কিছু না বুঝলেও সে দেখে এসেছে দ্য মমির মতো একশন থ্রিলার মুভি।
আজ পরনে কটকট্টা রংয়া শার্টের সাথে কটকট্টা মেরুন কালারের ব্লেজার পড়ে স্ত্রী ও পরিবারের সাথে ফ্যামিলি ছবি তোলায় ব্যস্ত শাহের আলী।
স্থান সাফারি পার্ক, গাজিপুর। একেবারে
নেহায়েতই গরীব থেকে হঠাৎ ই বড়লোক হলে যা যা লক্ষণ প্রকাশ পায় তার সবকিছুই তার মধ্যে আছে। কালো গায়ের রংয়ের সাথে চোখে বেগুনি গ্লাসের রংয়ের চশমা যে এক্কেবারেই বেমানান তা তার চারপাশের লোকজনের চাহুনি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আশ পাশের সব লোকজন তাকে চোখে উপহাস করছে। স্ত্রী ছখিনা বেগমও কম বেমানান নয়। সে ও কটকট্টা লাল রংয়ের শাড়ি পড়ে এসেছে। তিন মেয়েদেরকেও দিয়েছে বেমানান সব পোশাক আশাক। রানুর পরেই ঝুমা। ঝুমার বয়স সতেরো। ঝুমার পরে বিনা, যার বয়স পনেরো। আর সবার শেষের ইতি। ইতির বয়স দশ। সবাইকে এই গরম পরিবেশেও পরিধান করানো হয়েছে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়েবাড়ির পোশাক।
সাফারি পার্কে কেউ নিজেদের গাড়ি করে যেতে পারে না। এ বিষয় নিয়েও শাহের আলী পার্কের গেইটে নিরাপত্তা কর্মিদের সাথে একনাগাড়ে ঝগড়া করেছে।
নিজের বেয়াই রায়হান তালুকদারের নাম উল্লেখ করে গরম দেখিয়ে বলেছে,
“এই ব্যাটা জানিস, বিরগেডিয়ার( ব্রিগেডিয়ার) জেনারেল রায়হান মাহমুদ আমার বেয়াই লাগে। আমি ভেতরে আমার গাড়ি দিয়াই যামু! এসি ছাড়া আমার থাকার অভ্যাস নাই। গরমে বাঁচি না! ”
শুনে দায়িত্ব প্রাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বলে,
” স্যার, ওখানে এনিম্যাল গুলো ছাড়া অবস্থায় আছে, ওখানে আপনার গাড়িতে গেলে, এনিম্যালগুলো ভীত হয়ে আপনাকে এটাক করবে! ইটস কোয়াইট ডেঞ্জারাস! ”
কিন্তু শাহের আলী জানে না এনিম্যাল কি জিনিস? আর ডেঞ্জারই কি!
সে বরঞ্চ উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করে বলে,
” কিসের এনিম্যাল? এই গাড়ি দিয়া সব এনিমালেরে মাল বানায়া দিমু!”
তার এসব আজগুবি কথা শুনে আশপাশের লোকজন হাসতে হাসতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলো।
পরে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি এগিয়ে এসে তাকে পুরাটা বুঝিয়ে বলে যে,
” স্যার, প্লিজ বুঝার চেষ্ঠা করেন। সাফারি পার্ক হচ্ছে, এমন এক পার্ক, যেখানে কিনা প্রাণিরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, আর মানুষ সেখানে যায় বদ্ধভাবে, অর্থাৎ ওখানে যাওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট গাড়ি আছে, সেই গাড়িতে চড়ে। আর ওসব গাড়ির শব্দ প্রাণিদের বিরক্ত করে না। আর বাঘ, হাতি বা সিংহ ঐ গাড়ি ভাঙ্গতেও পারে না। তাতে প্রাণিগুলোকে অতি সন্নিকট থেকে দেখা সম্ভব হয়!”
এবার শাহের আলীর বিষয়টা বোধগম্য হয়। সে লজ্জিত না হয়ে, বরঞ্চ লোকটার হাতে একটা একশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললো,
” যাও, তুমি আমারে জ্ঞান দান করলা বলে তোমারে অর্থ দান করলাম! ”
সে এবার অযথা তর্ক থামিয়ে সবার জন্য প্রবেশ টিকিট ক্রয় করে নেয়।
এদিকে গরমে সবার ঘামে লেপ্টে যাচ্ছে মুখের মেকাপ। ঝুমা, বিনা ও ইতি তিনজনই বিয়ের সাজ সেজে এসেছে৷ সবার এমন ভাব যেনো মাটতে আর পা পড়ে না।
মেয়ের বিয়ের মাত্র দশ দিন। এই দশ দিনেই শাহের আলির ভেতরের রুপ বের হতে শুরু করেছে। রায়হান মাহমুদ হতে প্রাপ্ত নগদ পঞ্চাশ লক্ষ টাকার দশ লক্ষ টাকাই এ দশ দিনে সে শেষ করে দিয়েছে অপব্যয় করে । আর দশ লক্ষ টাকা সে দিয়ে দিয়েছে এক পুলিশকে। কারন কিডনি বিক্রির বরাতে রায়হান মাহমুদের কাছ থেকে, এত টাকা কড়ি আর ফ্ল্যাট সাথে মেয়ের বিবাহ এসব আদায় করার বুদ্ধি সেই পুলিশ অফিসারই তাকে দিয়েছিলো। আর সেই পুলিশ অফিসার ছিলো এসবের স্বাক্ষী। তবে ধুরন্ধর সে লোক শাহের আলীর কাছ থেকে দশ লক্ষ টাকা আদায়ের শর্তও করিয়ে নেয়।
.
.
চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড!
এ খবর রাফসান বাসার কাউকে জানালো না।
কয়েকবার সে নিজের ব্যাগে লুকিয়ে রাখা ব্র্যান্ডির বোতল খুলে পান করার চেষ্ঠা করলো। যদি দু:খ সামান্য ভুলানো যায়! কিন্তু না! এ দু:খ যে মোচন হওয়ার নয়।
তাই সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো কুমিল্লা চলে যাবে ইলোরার কাছে। আর সামনা সামনিই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।
একাকিত্বই তার দু:খ গুলোকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইলোরাক বিয়ে করে সে দু:খ জলাঞ্জলি দেবে।
যেই ভাবনা সেই কাজ।
সাথে সাথেই ড্রাইভারকে ছাড়াই একা একাই গ্যারেজ হতে গাড়ি বের করে নিলো।
যাওয়ার পথে ডায়মন্ড হারবার হতে কিনে নিলো একটা ডায়মন্ডের রিং। ইলোরাকে ওটা দিয়েই প্রপোজ করবে বলে।
দ্রুত ড্রাইভ করে তিন ঘন্টার মধ্যেই কুমিল্লা চলে এলো সে৷
ইলোরার বাসা সে চেনে না। আর সে এখন কোনো ক্লিনিকে নাকি সি এম এইচ এ, তাও সে জানে না।
তাই ইলোরাকে কল দিলো।
” কোথায় তুই? আমি অলমোস্ট কুমিল্লা চলে এসেছি। মিট মি এজ সুন এজ পসেবল! ”
তবে ইলোরার কন্ঠে দ্বীধা।
” আমি তো আজ বাসায়ই, তবে এত রাতে? আমি বেশ টায়ার্ড রে!”
রাফসান একথা শুনে বিদ্ধস্ত স্বরে বললো,
” আমি এত দূর হতে একা ড্রাইভ করে আসলাম, আর তুই কিনা?”
ইলোরা এবারে হাসতে হাসতে বললো,
“নো প্রব, এমনিতেই, তোর জন্য আমি অলওয়েজ ওপেব, তাহলে চলে আয়, ঠিকানা. নে.”
রাফসান দ্রুত চলে গেলো সেই ঠিকানায়।
ইলোরা বিশাল ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে। তার বাবা মা যে তার ছোটো বেলায়ই সেপারেশনে চলে গিয়েছিলো, তা রাফসানের জানা আছে। ইলোরা তার নি:সন্তান মামা মামীর সাথে থেকেছে, ঢাকায়। সেখানে তার মা ও আসতো, বাবাও দেখতে আসতো প্রায়ই।
তবে এ বাড়িতে ইলোরার মা, বাবা, মামা, মামী কাউকে সে দেখতে পেলো না।
ইলোরার পড়নে স্বচ্ছ নাইটি পোশাক। এরকম বেশে কোনোদিনই সে ইলোরাকে দেখেনি। রাফসান ভেতরে ঢুকেই একটা পুরুষালী গন্ধ পেলো।
ইলোরা নাস্তা পরিবেশন করলো। সাথে কয়েক রকমের ড্রিংক। রাফসান অবাক হলো। ইলোরা ড্রিংক করে! করলে করুক। তার যেনো সেসবে সমস্যা নেই৷ অন্য কোনো কথাই আর রাফসান বাড়াতে চায় না। সে যত দ্রুত সম্ভব ইলোরাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করতে চায়।
ডিংক গুলো গ্লাসে ঢালতে ঢালতে ইলোরা বললো,
” এত রাতে এই শরীর নিয়ে একা ড্রাইভ করে কেনো এসেছিস?”
ইলোরা হাসিমুখেই এই প্রশ্ন করলো।
” তোকে সারপ্রাইজ দিলাম, খুশি হোস নি তুই?”
” খুশিটা এখন আর আমার এত সহজে ধরেনা, রে! বেশি এডাল্ট হয়ে গেছি তাই বুঝি!”
ইলোরার কন্ঠে ক্লান্তি।
” গতরাত ঘুমাতে পারিনি, নাইট করেছিলাম তাই, আজ খুব টায়ার্ড, তোকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ওয়েট!”
একথা বলেই ইলোরা, ডাকলো,
” প্রাণ! এই প্রাণ এদিকে আসো!”
রাফসানের কাছে ব্যাপারটা ঘোলাটে লাগলো। তবে এক সুদর্শন যুবা পুরুষ সেদিকে এগিয়ে এলো।
ইলোরা পরিচয় করিয়ে দিলো,
” রাফসান, এ হলো সোপান, সিঙ্গার সোপান, আর আমার প্রাণ, আর প্রাণ, এ হলো রাসু বলেছিলাম না, মেজর রাফসান, মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। ”
প্রাণ নামের লোকটার দিকে চেয়ে রাফসান চিনে নিলো।
” আরে! উনি তো আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত পপ সিঙ্গার! ”
ইলোরা যোগ করলো,
” আর আমার ফিয়ন্সি! আমরা প্রায় তিন বছর এক ছাদের নিচেই আছি, তোকে জানানো হয়নি, বাট..”
ইলোরার এ কথায় রাফসানের মাথায় যেনো বাঁজ পড়লো।
(চলবে)
#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ১২
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
ঘড়িতে সময় রাত একটা ছুঁই ছুই। আবহাওয়ার তুলকালাম অবস্থা। হন্তদন্ত হয়ে হঠাৎ ই একটা বাঁজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠলো গোটা দুনিয়া। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেও আধুনিকতার আবিষ্কার আই পি এস ব্যাটারির কল্যানে বাতি, ফ্যান চলতেই থাকলো। বোঝাই যাচ্ছে হয়তো খুব আশেপাশেরই কোনো খোলা মাঠে বা উঁচু গাছের উপর পড়েছে বাঁজ। তবে ইলোরার কথা শুনে রাফসানের মাথায় আরো জোরে বাঁজ পড়লো। বাঁজ খালি মাঠে পড়লে সেই মাঠের কোনো ক্ষতি হয়না। কিন্তু উঁচু গাছের উপর পড়লে সেই গাছ গুঁড়িয়ে যায়। রাফসানের ক্ষেত্রেও তাই হলো। যেনো নিরালোকে দানবীয় এক বাঁজের কবলে বৃহদাকার এক বৃক্ষ।
পাশেই বসা ইলোরার সেই ‘প্রাণ’ নামক ব্যক্তিটি ঠোঁটের উপর দুটো আঙ্গুল দিয়ে মিটিমিটি হেসে চলছে। সে সোফায় আরাম করে বসলো। ইলোরাও তার গায়ের উপর ঢলে বসলো একদম অঙ্গা অঙ্গী ভাবে। সে যেনো বিশাল মজা পাচ্ছে, কারন ইলোরা তাকে তার ফিয়ন্সি বা বাগদত্তা বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
তাদের দুজনকে এভাবে এত ক্লোজ অবস্থায় দেখে, আর প্রাণের এই দুষ্টু হাসি দেখে রাফসানের মেজাজের পারদ উঁচুতে উঠলো। তবুও রাফসান সেই মেজাজকে আড়াল করতে সামান্য হেসে ইলোরাকে বলে উঠলো,
” ফিয়ন্সি? কবে হলো এসব? একবার জানাতে তো পারতি?”
ইলোরার সেই প্রাণ নামক ব্যক্তিটি তখনো সোফায় বসে, ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে পূর্বের ন্যায় রহস্যময় ও দুষ্টু হাসি হাসছে।
রাফসান দেখলো ইলোরার মাথার চুলগুলো ভেজা, সাথে সেই প্রাণ নামক লোকটারো। গোটা ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই।
“তার মানে এরা দুজনে….?” রাফসান আর ভাবতে পারলো না।
প্রাণই বলে উঠলো,
” হ্যাঁ, যা ভাবছেন তাই, আমরা একসাথেই আছি বেশ অনেক দিন!”
রাফসানের চোখে বিস্ময় আর বুকে এক বুক ভাঙ্গা কষ্ট।
ছোটো থেকেই ইলোরাকে সে চেনে। এক ধরনের ভালোলাগা ছিলো, সফট কর্ণার ছিলো, সর্বোপরি পছন্দের এক মেয়ে ছিলো। তবে সেটা ভালোবাসা ছিলো কি না সে জানে না। কারন ভালোবাসা নামক জিনিসটা সে তার স্ত্রীর জন্য গচ্ছিত রেখেছিলো৷ কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি কখনো। ইলোররও তার প্রতি সফট কর্ণার ছিলো, সেটা তার কেয়ারিং দেখলেই বোঝা যেতো।
ইলোরা মেয়েটার পার্সোনালিটি দারুন। কাউকে ঠকানো বা মিথ্যাচার মেয়েটার স্বভাবে নেই। যার সাথে সবকিছু শেয়ার করতো সে। আর সে কিনা?
রাফসান সর্বদা ইলোরাকে তার নিজস্ব মতাদর্শ শোনাতো, আর সেদিকে ইলোরা কিনা এই রকম পশ্চিমা অত্যাধুনিক ন’গ্ন মতাদর্শে বিশ্বাসি?
রাফসান সোপানকে টিভিতে এক দু বার দেখেছিলো লাইভ মিউজিক শো তে। দারুন গায়কি তার! দেশের লোকের কাছে সে সঙ্গীতশিল্পী প্রাণ সোপান নামেই পরিচিত। দারুন ফেমাস লোকটা!
রাফসান সোপানের দিকে আরো একবার তাকিয়ে পুনরায় ইলোরার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলো,
” হাউ ইরোটিক! ফিয়ন্সির সাথেই এক ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করেছিস?”
ইলোরার মুখ সামান্য দ্বীধান্বিত হলো এ প্রশ্নে।
সে উত্তর করার আগেই বরং প্রাণ উত্তর করলো।
” একচুয়ালি রাফসান.. আমরা গত দু বছর যাবত লিভ ইনে আছি, আমরা বিয়েতে বিশ্বাসী নই! ওপেন রিলেশনশীপ বলতে একটা টার্ম হয়তো আপনি জেনে থাকবেন। আমরা সেটাই করছি।”
ইলোরা প্রাণের কথার সাথে তার দিকে তাকিয়ে নিজের সম্মতিসূচক হাসি যোগ করলো।
সাথে সে রাফসানের হাবভাব বুঝার চেষ্ঠা করলো। এবং বুঝলোও সে যে,এইসব কথা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। সে তার এসব কথা সহজভাবে নিচ্ছে না।
তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ইলোরা সামান্য কেশে বলে উঠলো,
” রাফু, ডোন্ট মিন মি দোস্ত! একচুয়ালি তুই তো জানিস আমি কি ধরনের ফ্যামিলিতে বিলং করি।ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হয়েছি। বাবা এক জায়গায় আর মা আরেক জায়গায়, জন্মের পর থেকেই বাবা মায়ের ঝগড়া দেখেছি, এন্ড তারপর সেপারেশন। দুজনের মধ্যে প্রচন্ড ব্লেইম গেম চলতো, মতের অমিল, মা’রামারি, ইত্যাদি তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো। তারপর মা আরেক পুরুষকে আর বাবা আরেক নারীকে বিয়ে করে নিজেদের সংসার করা শুরু করে। আর মাঝখানে ভিক্টিম কে? এভাবেই বিয়ে জিনিসটার প্রতি আমার কেনো জানি কোনো গুড ফিলিংস নেই। কিন্তু আমি জানি তোর বাবা আর তুই ভিষণই কনজার্ভেটিভ মাইন্ডের। তোর, বাবা, দাদা, দাদী পুরোদস্তুর ধর্মপ্রাণ। সেজন্যই আমি কোনোদিন আমার এই লিভ ইনের বিষয়টা তোকে জানাইনি। এর আগেও দু জনের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো। একসাথেই ছিলাম আমরা। বাট কাউকেই জানাই নি। আর আমার গার্ডিয়ানই বা কে? মামা মামীর কাছে বড় হয়েছি। কাউকে জবাবদিহি তো আর করতে হয় না। বিয়েতে আমার বিশ্বাস নেই। তাই বিয়ের মতো একটা প্রমিসিং সম্পর্কে জড়ানোর মানে কি? তার আগে একত্রে থেকে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিতে দোষ কি?
রাফসানের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো, এসব কথা বহন করতে।
রাফসানের কেনো জানি ইলোরার এসকল লেইম ও ভিত্তিহীন কথাবার্তার কাউন্টার দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না।
সে কঠোর ভাবেই বললো,
” তো আর মোট কয়জনের সাথে এরকম লিভ টুগেদার করার ইচ্ছে আছে তোর?”
ইলোরা বুঝলো যে, রাফসান তাকে অপমানিত করতে চাইছে। করারই কথা। কারন এখন যা বলছে সে তা রাফসানের চিন্তারো বাইরে।
তাই রাফসানের কথাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার উদ্দ্যেশ্যে সে বলে উঠলো,
“তবে তুই জিতেছিস রে রাফু? রানুর মতো মেয়েরা কোনোদিন স্বামির সাথে বিট্রে করে না, তারা স্বামিকে ঠকায় না, । তুই আরেকটা বিয়ে করলেও, তোর বউ কোনোদিনও তোকে ছেড়ে….
রাফসানের ভেতরের রাগ এবার উগরে এলো,
“যাস্ট শাট আপ ইলোরা। আমার ব্যাপারে তোকে কিছু বলতে হবে না। ”
ইলোরা রাফসানের দিকে গাঢ় দৃষ্টি দিয়ে বললো,
“তুই এতো রিএক্ট কেনো করছিস রাফসান? তুই ও কি আমাকে বিয়ে করতে চাইতি নাকি? আর ইউ জেলাস? এখনো তুই প্রানের সাথে হ্যান্ডশেইক করিস নি! ”
বলেই সে হো হো করে হেসে দিতো। যেনো সে এসব বলে শুধুমাত্র রসিকতাই করেছে।
রাফসান তার পকেটে রাখা হাতটির সাথে সেই বস্তু অর্থাৎ আংটির অস্তিত্বওটের পাচ্ছিলো।
” ছি: এ কার জন্য সে আংটি এনেছে? ছি:!”
তবুও সে স্বাভাবিক আছে তা বুঝাতে সে প্রাণ সোপানের সাথে হ্যান্ডশেক করলো, তবে চোখে চোখ রাখতে পারলো না।
তারপর অন্যদিকে মুখ করে রাফসান বসলো।
ইলোরার প্রশ্নের সে কোনো উত্তর সে এখনো দেয়নি। সত্যিই তো, সে ইলোরাকে বিয়েই করতে চেয়েছিলো।
নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার এলো রাফসানের। ইলোরা প্রাণকে ড্রিংকস ঢেলে দিলো। রাফসান নিলো এক গ্লাস পানি। ওসব তার শরীরে সইবে না।
সে ভাবতে লাগলো, আর নিজেকে নিজেই বলতে লাগলো,
“তাই বলে লিভ ইন? ছি: ইলোরা এত নিচে নামতে পারলো? মায়াবী চেহারার আড়ালে এই বি’ভৎস রুপ লুকিয়ে রেখেছে ইলোরা? ও কি কোনো ধর্ম মানে? মনে তো হয় মানে না? কারন বিবাহ বহির্ভুত নর নারীর একত্রে বসবাস কোনো ধর্মই গ্রাহ্য করে না! এসব অপবিত্র, হা’রাম, অনৈতিক সম্পর্ক! ”
বাইরে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। রাফসানের গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
ইলোরা তাকে গেস্ট রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো।
রাফসান খাবে না জানিয়ে দিলো। কারন সে জানালো সে রাতে খেয়ে এসেছে।
একান্ত ঝড়বৃষ্টি বলেই রাফসান এ বাসায় রয়ে গেলো। তাছাড়া ইলোরার কথা শুনে তার প্রতি রাফসানের ঘৃণা চলে এসেছে। শুয়ে শুয়ে রাফসানের মস্তিষ্ককে একটা হ্যাক করা কম্পিউটারের মতোই হ্যাক করে নিলো রানুর ব্যাপারটা, রানুর ভাবনা। সে অনুভব করলো রানুকে। মেয়েটার গায়ের বর্ণ শ্যামবর্ণা হলেও চোখ দুটিতে অদ্ভূত মায়া আছে।
নিতান্ত গ্রাম্য, অশিক্ষিত ও আনস্মার্ট, আনকালচার মেয়ে রানু।
সে এত এত অকথ্য গালি দিয়েছে, তথাপি রানু ছিলো নিরুত্তর। মেয়েটার ধৈর্য্য চরম লেভেলের। আর সে যখন অজ্ঞান হয়ে যায়, তখন মেয়েটার ” আল্লাগো…! বলে গগনবিদারী চিৎকার এখনো রাফসানের কানে ভাসে। কারন সে সময় সে কানে সবকিছুই শুনতে পারছিলো। মেয়েটা ধার্মিক। সে বাবার মুখে শুনেছিলো, বিয়ের রাত্রে সারা রাত সে তারই জন্য খোদার দরবারে দোয়া করেছিলো।
রাফসানের চোখে একবার মেয়েটার কান্নারত নেত্রদ্বয় ভেসে উঠলো। তবে এবার আর রাফসানের ঘৃণা এলো না, বরং এলো এক ধরনের সহমর্মিতা।
রাফসান ভাবলো, রানুর অঙ্গ সে নিজের অঙ্গে ধারণ করছে। রানুর র’ক্ত তার শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রথমবারের মতো, নিজের শরীরে রানু মেয়েটার অস্তিত্ব অনুভবে সে কেমন শান্তি শান্তি অনুভূতি পেলো৷
সে একবারের জন্যও ভেবে বসলো, কিছু না হলেও তো সে মেয়েটার একজন কলাবরেশন পার্টনার হতে পারে। মেয়েটাকে দেখে এ মনে হয়নি যে, কোনো বিপদ সে ঘটাতে পারে।
বরং মেয়েটা যেনো এক শান্ত শিষ্ট নদীর মতো। যেদিকে প্রবাহিত হবে সেখানে শান্তিই প্রবাহিত হব্র।
আর সেই শান্তির অনুভূতি নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়বে না বলতে বলতেও ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়েই রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিলো রানু। সকাল সকালই মালতিকে সাথে নিয়ে সাত পদের ভর্তা, ভাত রান্না করেছে সে। দাদা দাদী দুজনেই এখানে এসে মোটামুটি সবল বোধ করছে। দুজনেই ফজরের নামাজ পড়ে একসাথে হাঁটতে বেরোয়।
এসেই আবার সব নাস্তা রেডি পায়, তাও নিজেদের পছন্দ মতো সব খাবার।
রানু, দাদী শাশুড়ীর চুলে বিলি কেটে কেটে তেল দিয়ে দিচ্ছে, দাদী আরামে দুচোখ বুজে আছে।
রানু তেল দেওয়ার সাথে টিভিতে ওয়ার্ল্ড নিউজ দেখছে।
” গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় গত ২৪ ঘন্টায় আরও কমপক্ষে ১৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যার ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরতায় উপত্যকাটিতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫১ হাজারে।”
রানুর চোখে অশ্রু চলে এলো এ নিউজ দেখে। চোখ মুছতে মুছতে দাদা শ্বসুরকে বললো,
” দাদা, এরা কোনো মানুষ নাকি জা’নোয়ার? এত মানুষ মা’রে এরা, এদের অন্তর কাঁপে না একটুও? এই দেশ কোনখানে দাদা? আমার যাইতে মন চাইতেছে। দাদা আপনের পুরানা বন্ধুকটা দেন তো। গিয়া আমি ওদেরকেউ মা’রমু, এমন মনে হইতেছে।
দাদা শ্বসুরও নিউজ দেখে বিস্মিত হয়ে যায়। সাথে রানুর কান্না। মেয়েটার মনে এত মায়া!
দাদা রানুকে বোঝ দেয়,
” কান্না করো না বুবু, দোয়া করো। আমাদের দেশের মানুষ আমরা সবাই ই’সরায়েলি পন্য বয়কট করেছি, আর গা’জার গণহ*ত্যার প্রতিবাদে লং মার্চ ফর গা’জা চলছে। আমার বয়স হয়েছে তাই যেতে পারলাম না। তরুন বয়সে আমরা কতকি যে করেছি ইয়ত্তা নাই। আর এখন মনে সাড়া দিয়েও শরীর সায় দেয় না। ”
দাদী রানুকে মনে করিয়ে দেয়, আজ তার টিচার আসবে বাসায়। এখন থেকে সে আর মোটেও অশিক্ষিত থাকবে না।
দাদীর চুলে তেল দেওয়া শেষ হতেই দাদী তাগাদা দেয়,
” নির্ভানা, বুবুজান, সকাল থেকে তো অনেক কাজ করেছো, এবার বই খাতা নিয়ে রেড়ি হও। ঠিকমতো না পড়লে তোমার শ্বসুর আব্বা কিন্তু তোমার খবর করবে!”
দাদা দাদী তাকে এখন নির্ভানা নামেই ডাকে।
দাদীর একথা শুনে খেতে খেতেই বিষম খায় রানু।
এই বয়সে এসে পড়াশোনা তার মস্তিষ্কে ধরবে তো?
ছোটোবেলায় কয়েক ক্লাশ পড়েছিলো সে। এই যেমন ক্লাশ থ্রি তে ছয় মাস। ক্লাশ ফোরে তিন মাস। আর ক্লাশ ফাইভে আট মাস। এই তার পড়া। কোনো ক্লাশেরই ফাইনাল পরীক্ষায় সে অংশগ্রহণ করেনি। প্রধান শিক্ষকের হাতে পায়ে ধরে অটোপাশ নিয়ে নিয়েছিলো৷ তারপর তো গ্রাম থেকে ঢাকাতেই চলে এলো৷ কমলাপুর রেলস্টেশনের বস্তিতে থাকা শুরু করলো। সাথে মানুষের বাসায় কাজ করতো। পড়াশুনা ভেস্তে গেলো।
তবে রাস্তাঘাটে স্কুল কলেজের ছেলেমেয়ের দিকে সে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, আর মনে মনে বলতো,
” ইশ! আবার যদি স্কুলে পড়তে পারতাম!”
.
.
ইলোরার বাসায় সে রাতটা ঘুমিয়ে সকালে ইলোরাকে আর না ডেকেই চুপি চুপি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলো রাফসান।
রাস্তায় সে একটা সিদ্ধান্ত সে নিয়েই নিলো।
রানু মেয়েটার সাথে একবার হলেও ঠান্ডা মাথায় ডিল করা উচিত।
( চলবে)