ওগো বিদেশিনী পর্ব-০১

0
219

#ওগো_বিদেশিনী
#প্রথম_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন [লেখিকা]

আর্ট গ্যালারির সবচেয়ে বড় ফ্রেমে নিজের মুখায়ব দেখে অবাকের অষ্টম আশ্চর্যে পৌঁছে গেলো অষ্টাদশী ক্যামেলিয়া মেহরিন।

খুব নিখুঁত শিল্প শৈলীতে জলরঙের ছোঁয়ায় নরম রং তুলির আঁচড়ে আঁকা হয়েছে প্রতিকৃতিটি।
বুক পর্যন্ত আঁকা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একটি কিশোরী মাথায় হরেক রঙের বিদেশি ফুলের ক্রাউন পরিহিত রয়েছে।

গায়ে রয়েছে অফ সোল্ডার ল্যাভেন্ডার রঙের জামা,হালকা কার্ল বাদামি চুল গুলো ঘাড়ের দুই পাশে পড়ে রয়েছে, দুধে আলতা গায়ের রঙ ,লাল টকটকে ঠোঁট দুটো যেনো স্বর্গের বাগানে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়ি, গাঢ় নীল রঙের চোখের মণি গুলোকে মনে মনে হচ্ছে প্রগাঢ় পারাবার। আর ঠোঁটের নিচের কুচকুচে কালো তিলটা যেনো ঘোর অমানিশার রাত।

নিজের আকৃতির এতো সুন্দর নিখুঁত চিত্র দেখে অষ্টাদশীর ভ্রু কুঁচকে এলো সাথে লম্বা লম্বা সরু চিকন তুলতুলে আঙ্গুলি স্পর্শ করলো নরম অধর।

ক্যামেলিয়া যতটা না অবাক হচ্ছে নিজের প্রতিকৃতি দেখে তার চাইতেও বেশি অবাক হচ্ছে ছবির ক্যাপশনে ইংরেজিতে ইটালিক ফন্টে নিজের নাম “ক্যামেলিয়া”লিখা দেখে।

“”তার মানে যিনি ছবিটি এঁকেছেন তিনি খুব ভালোভাবেই তাকে চিনে এমনকি নাম পর্যন্ত জানে”?

“কিন্তু কিভাবে সম্ভব সে তো এই দেশের মেয়ে নয়?”

হ্যা, তার বাবা বাংলাদেশী কিন্তু তার জন্ম,বেড়ে ওঠা কিছুই এখানে নয়।
বরং সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে প্রথম বারের মতো সে এখানে এসেছে ।

“তাহলে এই ছবি ওয়ালা কিভাবে তাকে চিনে?”

ছবির ফ্রেমের আশে পাশে চোখ বুলাতেই ছবির নিচের এক কোনায় কালো কালির আঁচড়ে সংক্ষেপে

” আর্ট বাই”M c”চোখে পড়লো ক্যামেলিয়ার।”

অনেক ক্ষণ নিজের জানা পরিচিত সকল মানুষের নামের ফুল মিনিং করেও হিসেব মিলাতে পারলো না ক্যামেলিয়া মেহরিন।

“কে সেই “M c”?

হঠাৎ ই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজে ভাবনার রাজ্য থেকে বের হলো ক্যামেলিয়া,পাশে দাঁড়ানো তার সমবয়সী কাজিন “নাবিহা টুসি”ফিসফিসিয়ে তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ভাবনায় ডুবে থাকার দরুন সে তা শুনতে পায়নি।

টুসি ক্যামেলিয়ার হাতে চিমটি কেটে বলে উঠলো

“কখন থেকে ডেকেই চলেছি মন কই থাকে তোর?”

চিমটি খেয়ে চমকে কেঁপে উঠে ক্যামেলিয়া।টুসীর দিকে তাকিয়ে
কিছু বলতে যাবে ক্যামেলিয়া তার আগেই টুসি বলে উঠলো

” চল ভাইয়া আমাদের খুঁজবে ,না পেলে অযথা হিসহিস করবে।”

ক্যামেলিয়া এখানে এসেছিলো মূলত টুসীর জন্যই,
টুসীর বড় ভাই “রিজভী রেজওয়ান”খুব ভালো চিত্রশিল্পী।

উহু প্রফেশনাল না সে শখের বসে বিভিন্ন হাবিজাবি আঁকে।এমনিতেই পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যাবসা সামলায়। সুযোগ পেলেই মাঝে মাঝে রিজভী ছবি আঁকতে বসে যায়।

রিজভীর চিত্রকর্ম দেখতেই তারা এসেছে!
ক্যামেলিয়া প্রথমে মানা করেছিল কারন সে কিছুই চেনেনা এখানকার ।
আর টুসি একটু বেশিই চঞ্চল ভরসা করা যায়না তাকে।

রিজভীর ভরসাতেই তারা একসাথে আর্ট এক্সিবিশনে এসেছে।

এখানে এসে বিভিন্ন ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎই নিজের ছবিটি দেখতে পায় ক্যামেলিয়া।

টুসি হঠাৎ ই তাড়া দেখিয়ে বলে উঠে

“ভাইয়ার ওখানে যেতে হবে তাড়াতাড়ি চল ”

,এই বলেই ক্যামেলিয়ার হাত ধরে টেনে দৌড়াতে উদ্যত হয়।টাল সামলাতে না পেরে পা স্লীপ করে ক্যামেলিয়া পেছন দিকে চিত হয়ে পড়ে যেতে নেয়
,ভয়ে ক্যামেলিয়া চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।

“এই বুঝি ভরা লোক সমাগমে ইজ্জত এর চাটনী হয়েই যায়।

―কিন্তু না”

হঠাৎ ই শক্ত একটা পুরুষালী হাতের থাবা তার পিঠে অনুভব করে,ভয়ে ভয়ে এক চোখ খুলে ঘাড় কাত করে পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় ত্রিশ কি বত্রিশ বছরের এক অতি সুদর্শন যুবক এক হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে অন্য হাত তার পিঠে ঠেকিয়ে হেসে হেসে সামনে দাঁড়ানো কিছু ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলে যাচ্ছে অবলীলায়।

ছেলেটিকে দেখতেই দুই চোখ বড় বড় করে ফেললো ক্যামেলিয়া।

ছেলেটির পড়নে লাইট ব্রাউন রঙের স্যুট, হাতে রোলেক্স এর ফিতা ওয়ালা ঘড়ি,লি কোপার এর চকলেট কালার এর বেল্ট সাথে ম্যাচিং শো, ডার্ক ব্রাউন রঙের স্টাইল করে কাটা চুল গুলো জেল দিয়ে এক পাশে সেট করা, ধবধবে সাদা মুখটা ক্লিন শেভড। লম্বা কমপক্ষে ছয় ফুট তো হবেই সাথে জিম করা বডি।

“উফ আর তাকানো যাচ্ছেনা চোখ ঝলসে গেলো রে বাবা!”

সহসায়ই ক্যামেলিয়ার হুশ ফিরলো।

নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো সে।

এভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে একটা ছেলেকে দেখেছে সে ভাবতেই লজ্জায় গায়ে কাঁটা দিলো তার।

“ছিহ,কি লজ্জা কি লজ্জা!

ভাগ্গিস লোকটি একটি বারের জন্যও তার দিকে তাকায় নি।
তাকালে হয়তো দেখতে পেতো কিভাবে একটি মেয়ে তার দিকে ক্যাবলা কান্তের মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

ক্যামেলিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে গট গট করে টুসীর কাছে গিয়ে পিঠে দুই ঘা লাগিয়ে দিলো।

যেহেতু এখানে উচ্চস্বরে আওয়াজ করা নিষেধ তাই মুখে কিছু বলতে পারল না ক্যামেলিয়া।

টুসি আর ক্যামেলিয়া কে দেখতে পেয়ে রিজভী বলে উঠলো―

“কোথায় ছিলি তোরা?”

“পাক্কা আড়াই মিনিট ধরে খুঁজে চলেছি তোদের ।সময় জ্ঞান হীন মানুষ আমি পছন্দ করিনা জানিস না তোরা?”

রিজভীর এরকম সময় নিয়ে কঠোরতা দুজনের কারোরই পছন্দ হলো না,শুধু মিন মিনিয়ে

” সরি ভাইয়া বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।”

“চল দেরি হয়ে যাচ্ছে বাসায় ফিরতে হবে!”
এই বলেই প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে হাঁটা শুরু করলো রিজভী।

দুজনেই মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়ে রিজভীর পেছন পেছন হাঁটা ধরলো।

সারাটা রাস্তা ক্যামেলিয়া কোনো কথাই বলেনি,মাথায় তার একটা প্রশ্নই বার বার ঘুর পাক খাচ্ছে কে এই “এম সি?

“আর আমার ছবি ই বা সে আঁকতে যাবে কেন?”

ভাবতে ভাবতে গাড়ির ব্রেক কষার মৃদু ঝাকুনিতে চিন্তা ভাবনায় ভাটা পড়লো।
গাড়ি থেকে নেমে টুসি আর ক্যামেলিয়া ড্রয়িংরুমের দিকে হাঁটা দিলো,রিজভী চলে গেলো গাড়ি গ্যারেজে ঢুকাতে।

“কিরে এতো দ্রুত ফিরে এলি যে?
অবাকের স্বরে জানতে চাইলেন টুসীর মা নাজনীন সুলতানা।

টুসি তার মায়ের এহেন কথা শুনে কোমরে দুই হাত গুঁজে মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো

“দ্রুত ফিরে এসেছি তাই না আম্মু?”

“তোমার ঐ বজ্জাত বিল গেটস এর সাথে আমাদের যাওয়াই ভুল হয়েছে।”

“তার কাছে সময়ের প্রচুর দাম”

“সব কিছুতেই সময় বেঁধে দেয়া,একটা ঘন্টাও কাটাতে পারিনি আরো নাকি আড়াই মিনিট লেট করেছি।”
বলেই মুখ ভেংচালো টুসি।

―এসব অত্যাচার কি মানা যায় আম্মু?

― জানো ওখানে কত সুন্দর সুন্দর ছবি ছিলো সব গুলো দেখতেই পারি নি !

“তাইনা রে ক্যামু?”

ক্যামেলিয়া কোনো শব্দ না করে ফ্রেশ হবার কথা বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে তার রুমে চলে যায়।

ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতেই হাস্যজ্বল সেই যুবকের মুখ ভেসে উঠে আয়নায়,ক্যামেলিয়া দ্রুত পানির ঝাপটা ছুড়ে মারে আয়নায়,নিজের দুই হাতের আজলায় মুখ ঢেকে চিল্লিয়ে বলে উঠে

“এসব কি হচ্ছে আমার সাথে?”

হঠাৎ ই ওয়াশ রুমের দরজায় নক করার শব্দে হকচকিয়ে ক্যামেলিয়া বলে উঠে

“কে ওখানে?”

“আম্মু ভাত খেতে ডাকছে টেবিলে আয় ”

বলে প্রস্থান নেয় টুসি।

লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসে ক্যামেলিয়া।

“আহ!এবার শান্তি লাগছে।”

গায়ে লং গেঞ্জি আর স্কার্ট প্লাজো পরে গলায় একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে উপস্থিত হয় ক্যামেলিয়া।

ক্যামেলিয়ার চাচা নাবিল হাসান নিজের পাশের চেয়ার নির্দেশ করে ক্যামেলিয়াকে বসতে বলেন।

ক্যামেলিয়া চেয়ার টেনে বাধ্য মেয়ের ন্যায় নাবিলের পাশে বসে গেলো।

ক্যামেলিয়া একটা প্লেট নিয়ে তাতে ভাত বাড়তে উদ্দত হতেই নাবিল হাসান ইতস্তত করে বলে উঠলো―

তোমার কি এখানে একা একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে মা?

এই প্রশ্নের উত্তর ক্যামেলিয়া কি দিবে?

কিছুক্ষণ মৌন রইলো ক্যামেলিয়া।প্লেটের ভাতের ভেতর আঙ্গুলি নাড়াচাড়া করে আহত স্বরে বলে উঠলো―

“আমি এখানে ভালো আছি বড় আব্বু”

“আমার এখানে থাকতে কোনো প্রকার কষ্ট হচ্ছে না আর তাছাড়া একা কোথায়?

ভাইয়া আছে,টুসি আছে ।

আর বড় আম্মু থাকতে আমার কি কোনো প্রকার কষ্ট হবার কথা বড় আব্বু?

নাবিল হাসান লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে দম ছাড়লেন।মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়েই তিনি শান্তনা দেবার ভাষা হারান।

ক্যামেলিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন

তোমার নানা নানী কি তোমাকে ফেরত নিয়ে যেতে চায়?

“তারা আমাকে কখনো জোর করবে না বড় আব্বু,আমি যেতে চাইলে সেটা অন্য হিসেব।

“আর তারা অন্য কাস্ট এর ।কোনো বিধর্মীর কাছে আমি থাকতে চাইনা বড় আব্বু,হোক তারা আমার অতি আপনজন।”

বলেই শান্ত ভাবে এক লোকমা ভাত মুখে তুললো ক্যামেলিয়া।

নাবিল হাসান চশমা খুলে টেবিল থেকে একটি টিস্যু নিয়ে গোপনে চোখের জল মুছলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাতের থালা সামনে নিয়ে অতীত ভাবনায় ডুবলেন।

আসফিক হাসান এর দুই ছেলে নাবিল হাসান আর নাফিজ হাসান ।

দুই ভাইকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে ছিলেন বাবা আসফিক হাসান।

তিনি চেয়েছিলেন ছেলেরা তার ব্যাবসার হাল ধরবেন কিন্তু ছোট ছেলে নাফিজের ব্যাবসায়ী হবার কোন ইচ্ছেই ছিলো না।

চাকুরীকে প্রাধান্য দিয়ে নাফিজ পাড়ি জমান সুদূর সুইজারল্যান্ডে।

বাবা আসফিক মনো কষ্টে ,রাগে কখনোই ছোট ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখেন নি, আসফিক হাসান আরো বেশি আঘাত পেয়েছিলেন যখন নাফিজ বিদেশিনী এক খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে এই খবর উনার কর্ন কুহরে আসে।

নাফিজ তার বাবার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েও বার বার ব্যর্থ হয়েছে,কিন্তু নাবিল এর সাথে তার যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিলো।

ছেলে,ছেলের বউয়ের সাথে বৃদ্ধ আসফিক কথা না বললেও বিদেশিনী এমিলি নিয়ম করে আসফিক হাসান কে দিনে দুই বেলা ফোন করতেন আর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বিভিন্ন কথা বলতেন।

বৃদ্ধ গাম্ভীর্য বজায় রেখে হু হা না করলেও ফোন কানে তুলে কথা গুলো ঠিকই শুনতেন।
বিদেশীর মুখে বাংলা ভাষাটা উনি ভালো লাগা থেকে শুনতেন নাকি ভালোবাসা থেকে শুনতেন সেটা উনি নিজেই ভালো জানেন।

একদিন এমিলি কান্না ভেজা কন্ঠে ফোন করেন আশফিক হাসান কে।
আসফিক ফোন তুলতেই এমিলি জানান
তার ছোট ছেলের ঘরে নাতনি আসতে চলেছে।

সেই দিন প্রথম বৃদ্ধ আশফিক এমিলির সাথে কথা বলেন এবং এর পর প্রতিদিন নিয়ম করে এমিলির খুঁজ খবর নিতেন।
কিন্তু কোনো এক সূক্ষ্ণ অভিমানের কারনে নাফিজের সাথে কথা বলতেন না।

আসফিক সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন ক্যামেলিয়ার জন্মের সময়,ছোট ছেলের ঘরের নাতনি বলে কথা।যখন সবকিছু স্বাভাবিক এর পথে তখন ই এমিলি ক্যান্সার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

,ক্যামেলিয়ার বয়স তখন সবে দশ।বিদেশ বিভুঁইয়ে মাতৃহীন মেয়েকে লালন পালন করতে বেশ বেগ পোহাতে হয় নাফিজ কে।
এমিলি খ্রিস্টান ধর্ম থেকে মুসলমান হবার কারনে তার পরিবার ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।
এদিকে মেয়ে ক্যামেলিয়া সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাওয়ায় নাফিজ তাকে বাংলাদেশ এও নিয়ে আসতে পারে নি।

ক্যামেলিয়া আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে আর তার দাদু ভাই,বড় চাচা ,চাচী,চাচাতো ভাই বোন সকলের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে।

বিদেশের মাটিতে জন্ম বেড়ে ওঠা হলেও নাফিজ মেয়েকে বাঙালি কালচার আর ভাষা খুব ভালোভাবেই রপ্ত করাতে পেরে ছিলেন।

ক্যামেলিয়ার বয়স যখন সতেরো হঠাৎই একদিন নাফিজ এর অফিস থেকে ফোন আসে বাসার ল্যান্ড লাইনে।

ক্যামেলিয়া হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নাফিজের সুইস এক সহকর্মী জানায় যে,
“নাফিজ স্ট্রোক করেছে তাকে ইমিডিয়েটলি জুরিখ সেন্ট্রাল হসপিটাল এ নেয়া হয়েছে।

ক্যামেলিয়া দিশেহারা হয়ে যায়,এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে সে?
কাঁদতে কাঁদতে সে তার নানা নানীর কাছে ফোন করে সাহায্য চায়।

অসহায় মেয়েটির কান্না সেদিন ফেলতে পারেন নি এমিলির বাবা মা।
তারা জেনেভা শহর থেকে জুরিখ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

ক্যামেলিয়া ল্যাভেন্ডার রঙের একটি হাঁটুর নিচ পর্যন্ত অফ সোল্ডার ড্রেস পরিহিত ছিলো ।
আলুথালু চুলে কাঁদতে কাঁদতে হাতের ফোন আর কিছু সুইস ফ্রাঙ্ক(টাকা) নিয়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসে।

কিন্তু রাস্তায় সে কোনো ট্যাক্সি ই দেখতে পায়না।
কাঁদতে কাঁদতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে ক্যামেলিয়া।

হঠাৎই একটি কালো রঙের গাড়ি দেখতে পায় ক্যামেলিয়া।
বসা থেকে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠে

―গ্রূইজ্যে(হ্যালো)
―বিত্তে হিলফি (সাহায্য করুন প্লিজ)

মেয়েটিকে দেখেই কড়া ব্রেক কষে গাড়িতে থাকা যুবক।

এই শীতের মধ্যে একটি হাতা বিহিন ছোট জামা পড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে মেয়েটি,দেখে যুবকের মনে মায়া হলো।

দৌড়ে গাড়ি থেকে নিজের মোটা ভারী জ্যাকেট এনে মেয়েকে গায়ে জড়িয়ে বলে উঠলো―

―”একচুয়ালি আম এ বাংলাদেশি টুরিস্ট,আম নট গুড এট সুইস ল্যাঙ্গুয়েজ।”

―প্লিজ আমাকে হেল্প করুন আমার পাপা হসপিটাল এ ভর্তি সহসাই বলে মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মেয়েটি।

বিদেশি মেয়ের মুখে ফ্লুয়েন্টলি বাংলা শুনে থমকে যায় যুবক।

দ্রুত মেয়েটিকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গুগল ম্যাপ সার্চ করে হসপিটাল এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

যুবকটি তার কাজের তাগিদে প্রায় ই এখানে আসে।কিন্তু এবারের উদ্দেশ্য তার ভিন্ন ছিলো।

সে এসেছিলো তার বাবার বন্ধুর সাথে দেখা করতে তার বাবার দেয়া কিছু জিনিস নিয়ে।

কিন্তু পথিমধ্যে মেয়েটির আর্তনাদে যুবকটি তাকে সাহায্য না করে পারলো না।

চল্লিশ মিনিট ড্রাইভিং এর পর তারা হসপিটাল এর সামনে পৌঁছে যায়।
ক্যামেলিয়া গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে হসপিটাল এর ভেতর ঢুকে যায়।

যুবকটি গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিতে নিলেই মেয়েটির ফোন সিটের উপর পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নেয় ।

ফোন নিয়ে হসপিটাল এর ভেতর ঢুকে মেয়েটিকে খুঁজতে থাকে।

এর মধ্যে হঠাৎই মেয়েটির ফোন বেজে উঠে।

যুবক ফোন রিসিভ করবে নাকি করবে না দ্বিধান্বিত হতেই লাইন কেটে গিয়ে স্ক্রিনে ভেসে উঠে হাস্যজ্বল ফ্যামিলি ফটো।

ভালো করে নজর দিতেই যুবকের ভ্রু কুঁচকে যায়।

“নাফিজ আংকেল”!

বলেই দৌড়ে রিশিপশন এ এসে ইংলিশে জিজ্ঞেস করে
― হেয়ার আম লুকিং ফর মিস্টার নাফিজ হাসান’স কেবিন।
―ক্যান ইউ টেল মি?হুয়ার হি ইজ?

রিশিপশনিস্ট মেয়ে কম্পিউটার এ চেক করে যুবক কে বলে দিলো
―সেভেন্থ ফ্লোর,কেবিন নাম্বার 705।

যুবক দৌড়ে লিফটের কাছে এসে দেখলো লিফট ভরে গেছে।এর পর দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে সাত তলায় কাঙ্খিত কক্ষের সামনে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাপাতে থাকে।

নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেলো নাফিজ হাসান কথা বলার অবস্থা তে নেই,ডক্টর তাদের সকল কার্যক্রম প্রয়োগ করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

মেয়েটি তার বাবার উপর হামলে পড়ে কেঁদেই যাচ্ছে।

তড়িঘড়ি করে কেবিনে প্রবেশ করলো এমিলির বাবা মা।
তারাও এসে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ডেকে চলছে
―লর্ড প্লিজ হেল্প।

যুবকটি নাফিজ হাসানের কাছে এগিয়ে গিয়ে ডেকে উঠলো
―আঙ্কেল।

হঠাৎ ই ডিউটি ডক্টর এসে সকলকে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন।যে কোনো একজন থাকতে পারবে ভেতরে।
যুবক বের হতে নিলেই নাফিজ হাসান তার আঙ্গুল আলতো করে টেনে ধরেন।

ডক্টর যুবক কে কেবিনে রেখে বাকি সবাইকে বাইরে বের করে দেন।
কারন বেশি হৈচৈ পেশেন্ট কে আরো অসুস্থ করে তুলবে।

যুবক কিছু বলতে নিলেই ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে ভাঙা ভাঙা শব্দে নাফিজ হাসান বলে উঠে

―তোমার কন্ঠ শুনেই আমি চিনে ফেলেছি পরিচয় লাগবে না!

“আমি আর বাঁচবো না বাবা,আমার মেয়েটাকে দেশে আমার ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেবে আর আমাকে এমিলির পাশে দাফনের ব্যাবস্থা করবে কারন যে আমার জন্য ধর্ম ছেড়েছে তাকে ছেড়ে আমি দেশে যেতে চাইনা।”

সামান্য দুটো লাইনের কথা বলতে অনেক সময় আর কষ্ট হলো নাফিজ হাসানের।
আরো কিছু বলে উঠলো ঠোঁট নেড়ে,কিন্তু যুবক সেগুলো বুঝতে পারলো না।

মৃদু চোখ খুলে নাফিজ হাসান বহু কষ্টে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠলো
―তোমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ের কথা ঠিক করেছিলো তোমার বাবা।

আর কিছুই বলতে পারলেন না নাফিজ হাসান,হঠাৎ জ্ঞান হারালেন।
যুবক দ্রুত ডক্টর ডেকে আনলো।

মেয়েটি তার নানীর কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলছে।

যুবকটি ফোনে সকল কে এই খবর জানালে দেশেও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়।
বৃদ্ধ আশফিক ছেলের একটু কথা শোনার জন্য পাগল হয়ে যান।
কিন্তু নাফিজ আর কথা বলেনি।

হাসপাতালে দুদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ইহলোক ত্যাগ করেন নাফিজ হাসান।

#চলবে?