ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
463

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
২৯.
চারদিকে শনশন বাতাসের শব্দ। মেঘপূর্ণ আকাশে তারার দেখা নেই। শীতল পরিবেশ। বৃষ্টি নামতে পারে যে-কোনো সময়। প্রকৃতিতে মন উদাস করা নীরবতা। এই ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন মন কেমন করা রাত্রীতে নিঃসঙ্গ এক তরুণী হাত ভাঁজ করে হেঁটে চলেছে উদ্দেশ্যহীন। তার কাছে নেই একটা পয়সা মাত্র। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার কারণে তার খুব ক্লান্তিবোধ হয়। বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে একটা গাছের ছায়াতলে বসল সে। কালো গেঞ্জি পরিহিত একজন লম্বা-চওড়া ভদ্রলোক ঠান্ডা পানি হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,” তুমি তো খুব ঘেমে গেছো সুন্দরী। পানি খাও।”

তোহার মন এমনিতেও খারাপ। মনখারাপ অবস্থায় কেউ এমন আগ বাড়িয়ে বকবক করতে এলে মেজাজটাও খারাপ হয়ে যায়। অপরিচিত একটা মানুষ তাকে তুমি করে কেন ডাকবে? তোহা ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,” আমি কি আপনার কাছে পানি চেয়েছি? অযথা বিরক্ত করবেন না।”

ভদ্রলোক তোহার পাশে বসতে বসতে বলল,” রাগ কেন করছো? তোমার নামটা জানতে পারি?”

তোহা জবাব দিল না। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা একটু গা ঘেঁষে বসার চেষ্টা করল। টুশকি মারার উদ্দেশ্যে বলল,” নাম বলবে না। তাহলে তো শুধু সুন্দরী বলেই ডাকতে হবে। মনে হয় তোমার এই নামটা বেশি পছন্দ! ”

এবারও তোহা নিশ্চুপ। রাগে গা রি রি করছে। লোকটি উপদেশ দেওয়ার মতো বলল, ” এতোরাতে তাও আবার একা সুন্দরী মেয়েদের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। অনেক কিছু হতে পারে।”

” আপনি কি আমার গার্ডিয়ান?” তোহা ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকাল।

লোকটি মধুর কণ্ঠে উত্তর দিল,” না, তা কেন হবো? আসলে মানুষ খুবই হিংস্র প্রাণী। যদি তোমার কোনো ক্ষতি হয়? এই সমাজের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। তাই তোমার খেয়াল রাখছি।”

তোহা উপহাস করে বলল,” আপনি সমাজের প্রতি দায়িত্ব কিভাবে পালন করেন?মেয়েদের ইভটিজিং করে?”

লোকটি চোখ বড় করে তাকায়। চোখেমুখে একটা নিষ্কলুষ সারল্য ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলে,” আমি ইভটিজিং কোথায় করছি? মানুষ হিসেবে মানুষের যত্ন করাকে তুমি ইভটিজিং কেন ভাবছো?”

তোহা চোখ কুটি করে বলল,” সেই বাজার থেকে আমাকে ফলো করতে করতে এই পর্যন্ত এসেছেন আপনি। কি ভেবেছেন আমি কিছু বুঝি না? আর আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন না। অপরিচিত মানুষকে তুমি করে বলা কোন ধরণের ভদ্রতা?”

তোহার চূড়ান্ত রেগে যাওয়া দেখে হাসল লোকটি। রূঢ় ব্যবহারের জবাবে হাসি ফেরত দেওয়া মানুষগুলো ভয়ংকর হয়। লোকটি সামান্য ঝুঁকে এসে গাঢ় কণ্ঠে বলল” তুমি বয়সে আমার ছোটই হবে। আর সুন্দরী মেয়েদের তুমি করেই ডাকতে হয়। এটা পৃথিবীর মধুরতম ডাক।”

তোহা সরে এলো অনেকটা। লোকটির মুখ থেকে বিশ্রী দূর্গন্ধ আসছে। নিঃসন্দেহে সে নেশাগ্রস্ত। তোহার ভয় বেড়ে গেল। সে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” জানোয়ার!”

তোহা উঠে সামনে হাঁটতে লাগল৷ এখানে আর বসে থাকার প্রশ্নই আসে না। দ্রুত তাকে জনবহুল কোনো জায়গায় যেতে হবে। কিন্তু লোকটি তোহার পিছু ছাড়ল না। সে যত দ্রুত গতিতে হাঁটছে, ততই দ্রুত গতিতে লোকটিও তার পিছু আসছে। তোহা একসময় কাঁপা কণ্ঠে বলল,” আমি কিন্তু চিৎকার-চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করব।”

লোকটা ভ্রু উঁচু করে তাকাল। অসহ্যকর হাসি ঠোঁটে এঁটে বলল,” বিনা কারণে চিৎকার করলে মানুষ তোমাকে পাগল ভাবতে পারে। আমি বরং যুক্তিসঙ্গত একটা কারণ ধার দেই।”

কথাটা বলেই খপ করে তোহার হাত চেপে ধরল লোকটা। রসিয়ে রসিয়ে বলল,” এবার চেঁচাও সুন্দরী! দেখি কত চেঁচাতে পারো!”

আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল তোহার মুখ। আশেপাশে তাকিয়ে সে চিৎকার করল,” কে আছেন? বাঁচান আমাকে!”

আশ্চর্য, নীরব এই রাস্তায় দুয়েকজন যে মানুষ আছে তারাও কিছু বলছে না। দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, এই লোকটি কি এলাকার কোনো শীর্ষ সন্ত্রা°সী? শেষমেষ তোহা কার খপ্পরে এসে পড়ল! তার ভয়ে কান্না পেয়ে যায়।

প্রথমে ভদ্রভাবে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল তোহা। তাও যখন কাজ হচ্ছে না… সে চিন্তা করল ব্যাগ থেকে ছুরিটা বের করবে। তার এই ভাবনার মাঝেই সাঁই সাঁই করে একটা বড় গাড়ি তেড়ে এলো। তোহা চোখ বড় করে বলল,” দেখুন, ভালোভাবে বলছি আমার হাত ছাড়ুন। নয়তো আপনি বিপদে পড়তে পারেন।”

লোকটা প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,” তাই নাকি? আমিও দেখতে চাই।”

“আপনি অযথাই নিজেকে বিপদের মুখে ফেলছেন।”

লোকটি তোহার কথায় খুব মজা পাচ্ছে। দারুণভাবে হেসে বলল,” কি করবে? পুলিশ ডাকবে নাকি?”

তোহা ধেঁয়ে আসা গাড়িটির দিকে চেয়ে বলল,” পুলিশ হলেও আপনার বেঁচে যাওয়ার চান্স ছিল৷ কিন্তু এবার কোনোভাবেই বাঁচতে পারবেন না।”

তোহার কথায় অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল লোকটা। আরও শক্ত করে চেপে ধরল তার হাত। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” কোনো শা°লাকে আমি ভয় পাই না। যা আমার পছন্দ হয় তা আমি নিজের করেই ছাড়ি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। ”

লোকটি তার বীভৎস চেহারা নিয়ে ঝুঁকে এলো তোহার মুখের কাছে। আচমকা কালো গাড়িটি তাদের ঠিক সামনে এসে ব্রেক করে। লোকটি চমকে যায়। গাড়ির দরজা খুলতেই সর্বপ্রথম একটা লম্বা পা বেরিয়ে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই পা আঘাত করে লোকটির বুক বরাবর। রাস্তায় মুখ থুবড়ে উল্টে পড়ে যায় চওড়া দেহী রোগা-পাতলা আগন্তুক। নীরব সড়কে যে অল্প কিছু মানুষজন ছিল তারা সবাই এমন ঘটনায় বিচলিত, ত্রাসিত হয়। তোহা অনুরোধ করে বলল ,” ছেড়ে দিন প্লিজ। রাস্তার মাঝে সিন ক্রিয়েট করবেন না।”

আমীর তোহার কথা কানেও তুলল না। সবেগে ছুটে গিয়ে লোকটিকে টেনে তুলে তার চোয়াল, নাক, কপাল, গাল থেতলে দেওয়ার মতো শক্ত ঘু-ষি মা-রতে মা-রতে বলল,” পছন্দ হয়েছে না? খুব পছন্দ? মেয়ে দেখলেই পছন্দ হয়? তোর চোখ আমি উপড়ে ফেলব।”

যে হাতটা দিয়ে সে তোহারকে চেপে ধরেছিল সেই হাত পেছনে নিয়ে মুচড়ে ধরল আমীর। রক্ত হীম করা কণ্ঠে বলল,” এই হাত আমি ভেঙে ফেলব।”

লোকটি পর পর এতোগুলো আঘাতে প্রায় দিশেহারা। চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে। প্রবল নিনাদে কঁকিয়ে উঠল।করুণ গলায় বলল,” ভাই, আমার ভুল হয়েছে ভাই। আমাকে ছেড়ে দিন, দয়া করে আমার হাত ভাঙবেন না!”

আমীর তার চোয়াল চেপে ধরে বজ্রকণ্ঠে বলল,” আগে ওর পায়ে পড়ে বল তোর ভুল হয়েছে। নাকখড় দিয়ে বল আর জীবনে করবি না। নয়তো খু-ন করে ফেলব।”

লোকটি মাথা নাড়ল। সে সবকিছু করতে রাজি। আমীর ধাক্কা মেরে তাকে তোহার পায়ের কাছে ফেলল। তোহার দুই পা ধরে ছেলেটি কাঁদতে লাগল ব্যাকুল হয়ে,” আমাকে মাফ করে দিন আপা। আমি আর জীবনে এমন করব না। যদি করি তাহলে আমি কু-ত্তার গু খাই।”

তোহা মুখ কুচকে বলল,” কু°ত্তার গু খেতে হবে না। আমার পা ছাড়ুন।”

লোকটি দ্রুত পা ছেড়ে দুইহাত জোড় করতে নিয়ে দেখল ডানহাতে প্রচন্ড ব্যথা। তাই শুধু বামহাত উপরে তুলে বলল,” আমি ক্ষমা চাইছি৷ আমাকে মাফ করে দিন।”

তোহা দুঃখিত গলায় বলল,” তখন আমার কথা শুনলে এমন হতো না। এখন দ্রুত যান এখান থেকে।”

লোকটি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। আমীর রেগে পুনরায় তাকে আঘাত করতে নিচ্ছিল কিন্তু তোহা বাঁধা দিল। লোকটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আচমকা দৌড় দিল। প্রাণ বাঁচাতে পেরে আপ্লুত সে। তোহা আমীরের দিকে তাকিয়ে বলল,” এমন কেন করলেন? সামান্য দুইটা ঝারি মা-রলেই হয়ে যেতো৷ এতোটা বাড়াবাড়ি করার কোনো দরকারই ছিল না।”

আমীর রূঢ় মেজাজ নিয়ে বলল,” বাড়াবাড়ি আমি করেছি নাকি তুমি?তোমার সাহস কি করে হলো বাড়ি থেকে বের হওয়ার? যদি সময়মতো না আসতাম তাহলে কি হতো?”

” কিছুই হতো না। আমি নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারি।”

আমীর তাচ্ছিল্য হাসল,” দেখলাম তো কেমন প্রটেক্ট করতে পারো। আমি না এলে তোমাকে তুলেই নিয়ে যাচ্ছিল। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসো এখন।”

তোহা রেগে তাকাল। রোষপূর্ণ গলায় বলল,” আমি আপনার কর্মচারী না যে আপনার সব কথা মেনে চলব। আর আপনার সাথে যাচ্ছিও না আমি। ইটালি তো ভুলেও যাচ্ছি না। এখন থেকে আমি নিজের খেয়াল নিজেই রাখব। আমাকে নিয়ে আপনার আর টেনশন করার দরকার নেই। শুধু আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।”

আমীর শীতল কণ্ঠে বলল,” গাড়িতে গিয়ে বসো নয়তো খুব খারাপ কিছু হবে।”

” আমি আপনার হুমকি ভয় পাই না। চলে যাচ্ছি এখান থেকে। খবরদার আমার পিছু পিছু আসবেন না।”

আমীরের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। তোহা একদম নাছোড়বান্দা। সে গাড়িতে না উঠে গাড়িটা পাশ কাটিয়ে সামনে হেঁটে যেতে লাগল। একবারও পেছনে ঘুরল না। আমীর তার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল। আচমকা তেড়ে এসে তোহাকে জোরপূর্বক পাজাকোলায় তুলে গাড়ির কাছে নিয়ে এলো। তোহা এমন অপ্রত্যাশিত আচরণে হতভম্ব। আমীর রাস্তার মাঝে এমন একটা দুঃসাহসিক কাজ করতে পারে ভেবেই তার আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। সে ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করে উঠল। আকাশস্পর্শী বিস্ময় নিয়ে বলল,” আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? ছাড়ুন আমাকে। আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করব।”

আমীর তোহাকে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দরজা আটকে দেয়। তোহা দুইহাতে ধাক্কাতে লাগে জানালায়। আমীর ড্রাইভিং সিটে এসে বসতেই তোহা সজোরে তার বুকে ধাক্কা মেরে বলল,” আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না। আমি কিছুতেই আপনার সঙ্গে যাবো না।”

আমীর বিকট কণ্ঠে গর্জন করে উঠল,” শাট আপ, আর একটাও ফালতু কথা শুনতে চাই না।”

তোহা ধমক খেয়ে কেঁপে উঠল। মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেল। আমীর রাগী গলায় বলল,” এতোবড় একটা বিপদ হতে যাচ্ছিল তবুও কি হুঁশ হয় না তোমার? একা একা রাস্তায় কোথায় ঘুরবে? এই জায়গা তোমার জন্য সেইফ? এই শহর কি তোমার জন্য সেইফ? এই সময়টা তোমার জন্য সেইফ? বলো কিভাবে আমি তোমাকে ছেড়ে দেই? তুমিই বা কোন সেন্সে একা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে? আমাকে কি পাগল বানাতে চাও?”

আমীর বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। কপালে হাত ঠেঁকিয়ে মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করল। তোহা মাথা নত করে মিনমিনিয়ে বলল,” আমার জন্য কেন এতো ভাবছেন আপনি? আমি তো আপনার কেউ না!”

আমীর স্টেয়ারিং- এ সজোরে আঘাত করে উত্তর দিল,” ভাবছি কারণ তোমার বাবা মৃ°ত্যুর আগে আমার কাছে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন। আই হ্যাভ রেসপনসেবলিটিজ টু ইউ।”

তোহা বেদনাসিক্ত কণ্ঠে জানতে চাইল,” শুধু দায়িত্বের চাপেই কি আপনি আমাকে প্রটেক্ট করছেন? আর অন্যকোনো কারণ নেই?”

আমীর গমগমে নিষ্ঠুর গলায় বলল,” না, আর কোনো কারণ নেই।”

তোহার মুখটা করুণ দেখালো। পাতলা ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপতে লাগল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। দ্রুত জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে সেই অশ্রুটা আড়াল করে সে রুদ্ধ গলায় বলল,” আমার দরকার নেই কারো দয়া।”

আমীর শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল,” এটাকে দয়া ভেবো না!”

সে আর কিছু না বলে গাড়ি চালু করল। তোহা জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ রাস্তা শুধু কেঁদেই গেল। তার উড়ন্ত চুল কান্নারত চেহারা আড়াল করতে পারল না। আমীর পাথরের মতো গাড়ি ড্রাইভ করছিল। একবার তাকাল পর্যন্ত না। সে যে এতোটা পাষাণ হৃদয়ের মানুষ তা আগে জানতো না তোহা!

অথচ আমীরের নিজেকে সবচেয়ে দূর্ভাগা মনে হচ্ছিল তখন। উপরে শক্ত খোলস ধরে রাখলেও ভেতরে থেকে সে চুরমার হয়ে গেছে অনেক আগেই। সে তো তোহার মতো ব্যাকুল হয়ে কাঁদতেও পারছে না। অনুভূতিগুলো দমিয়ে রাখতে হচ্ছে সঙ্গোপনে। এই পৃথিবীতে তার মতো বেচারা আর কে আছে? যার মনের অনুভূতি প্রকাশ করার অধিকারটুকুও নেই!

গন্তব্যে এসে গাড়ি থামল। রানু দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। আমীর বলল,” কাল সকালে ফ্লাইট। সরব তোমাকে নিতে আসবে।”

তোহা চোখের জল মুছে শক্ত গলায় বলল,” যদি আমি চলে গেলেই আপনি দায়মুক্ত হোন তাহলে আজ থেকে আপনাকে দায়মুক্ত করলাম৷ আপনি আর কখনও আমাকে দেখবেন না।”

আমীর জবাব দিল না৷ তোহা দ্রুত গতিতে গাড়ি থেকে বের হয়ে এক দৌড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। রানু তোহাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কিছু বলতে লাগল। সেদিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকতে থাকতে আমীরের চোখ টলমল হয়। সে ফিসফিস করে বলল,” আমাকে সারাজীবন ঘৃণা করার চেয়ে ভালো তুমি আমাকে ভুলে যাও। আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য না।”

পরদিন সকালে একটা বিশাল ব্যাগে করে তোহার আগের বাড়িতে থাকা জিনিসপত্রগুলো সব পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সরব গাড়ি নিয়ে হাজির হলো তোহাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে। রানু তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” ভালো থেকো মা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে আবার ভুলে যেও না। যোগাযোগ রেখো।”

কথাটা নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে বলল রানু। সে নিজেই আসলে তোহার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না! গতকাল থেকে মেয়েটার সাথে সে রুক্ষ আচরণ করেছে। তাই এখন খুব খারাপ লাগছে, মন পুড়ছে। কিন্তু কি আর করবে সে? পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আর কোনো উপায়ও নেই। কাউকে ধোঁকা দেওয়ার চেয়ে তাকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া অনেক ভালো!

তোহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” ভালো থাকার ঔষধ এই দেশেই ফেলে যাচ্ছি আন্টি। ওই দেশে আমার মন বসবে না।”

রানু বিরস মুখে বলল,” মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস হয়ে গেলে সব জায়গাতেই মন বসে যাবে!”

তোহা রানুকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে বলল,” আমার জন্য দোয়া করবেন আন্টি। আমি যেন দ্রুত আমার বাবার কাছে চলে যেতে পারি।”

” ছিঃ, এমন অলুক্ষুণে কথা বলে না। দোয়া করি তুমি যেন সবকিছু ভুলে সুখে থাকতে পারো।”

তোহা মৃদু হাসল। শুধু তার মন জানে সুখে থাকা কত কঠিন! সে যে এখন থেকে অনিশ্চিত অপেক্ষার পথ যাত্রী। আর অপেক্ষার যাত্রীরা কখনও সুখে থাকে না। যতক্ষণ না তাদের নিদারুণ অপেক্ষার অবসান হয়! তোহার অপেক্ষার অবসান বোধ হয় আজীবনেও হবে না কখনও। গাড়িতে ওঠার সময় তোহা জিজ্ঞেস করল,” আপনাদের স্যার কি শেষবারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করতেও আসবেন না?”

সরব উদাস কণ্ঠে বলল,” স্যরি ম্যাডাম। স্যারের শিডিউল আজ অনেক বিজি। তাই উনি আসতে পারছেন না!”

তোহা আবারও হাসার চেষ্টা করল। ব্যস্ত মানুষের জীবন তো ব্যস্ত হবেই! আর আজকের মতো একটা দিনে তো তার ব্যস্ত থাকা বাঞ্চনীয়। ব্যথায় জর্জরিত মন নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল তোহা। সরব এসি ছাড়তে নিলেই সে ভারী কণ্ঠে বলল,” লাগবে না। জানালাটা খুলে দিন। শেষবারের মতো দেশের বাতাসটুকু নেই।”

সরব প্রশ্ন করল,” আপনি কি আর কখনও দেশে ফিরবেন না ম্যাডাম?”

তোহা জানালায় মাথা ঠেঁকিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল,” কেন ফিরবো? এই দেশে আমার কে আছে বলুন?”

সরব নিশ্চুপ হয়ে গেল। তোহার মাথায় খেলতে লাগল হাজারো স্মৃতি। সেই স্মরণীয় রাত। যেদিন আমীরের সাথে তার প্রথম দেখা হয়। ভরসাযোগ্য দু’টি হাত অচিরেই আগলে নিয়েছিল তাকে, দু’টি রহস্যময় চোখ আর গভীর সেই স্বর,” উঠে এসো মায়া, ভয় নেই।” আস্তে আস্তে তোহার নির্ভরতা হয়ে উঠেছিল আমীর। বাবার মৃত্যুর চারদিনের সময় সে কথা দিয়েছিল যে সারাজীবন তোহার পাশে থাকবে। কিন্তু সে তার কথা রাখল কই? তোহা ফিসফিস করে বলল,” বেইমান! আমি আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না। ফোর দ্যা রেস্ট অফ মাই লাইফ, আই উইল হেইট ইউ।”

_____________________
সকাল এগারোটা। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই তোহার ফ্লাইট ছেড়ে দিয়েছে। আমীর ঘড়ি দেখে লিভিংরুমে এসে বসল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হবে ব্যারিস্টার মওদুদ আনাম। আমীর ফয়সালকে ইশারায় বলল স্নেহাকে ডেকে দেওয়ার জন্য। একটু পরেই নিরাশ মুখে হাজির হলো স্নেহা। তার চেহারা শুকনো। সুন্দর মুখটা বড় মলিন দেখাচ্ছে। মনে হয় সারারাত ধরে সে ঘুমায়নি। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। আমীর মৃদু হেসে বলল,” বসো সুইটহার্ট। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কফি?”

স্নেহা কঠিন দৃষ্টিতে চাইল৷ তার মলিন মুখ আরও মলিন হয়ে উঠল। আমীর যেদিনই তার সাথে মিষ্টি গলায় কথা বলে সেদিনই তাদের মাঝে ভয়ংকর কিছু হয়। আজকেও সেরকম একটা ভয়ংকর দিন। আমীর মগে কফি ঢালতে ঢালতে বলল,” বিয়ের আগে আমাদের মধ্যে একটা ডিল হয়েছিল। হয়তো তোমার মনে নেই। আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।”

আমীর কফির মগ স্নেহার দিকে বাড়িয়ে দিল। স্নেহা নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল,” আমীর আমি এখন এসবের জন্য প্রস্তুত না।”

” ঠিকাছে। লাইফে প্রিপারেশন নিয়ে আসলে কোনোকিছু হয় না। আমাদের বিয়েটাও হুট করে হয়েছিল। তোমার মনে আছে? ডিলটা ছিল আমরা একবছরের জন্য ট্রায়াল ম্যারেজ করব। এর মধ্যে যদি আমরা একজন-আরেকজনের প্রেমে পড়ি তাহলে আমরা সারাজীবন একসঙ্গে থাকব। আর নয়তো ডিভোর্স। ”

” সেই একবছর এখনও হয়নি। তুমি কেন এই বিষয়টা নিয়ে এখন কথা বলছো আমি সেটা বুঝতে পারছি না।”

স্নেহা তার মুখের পেশি টান-টান করল। খট করে কফির মগ নামিয়ে রাখল টেবিলে। আমীর নরম হেসে বলল,” রিল্যাক্স! কথা ছিল একবছরের মধ্যে যদি আমাদের মধ্যে কেউ রুলস ব্রেক করে তাহলে যে রুলস ব্রেক করবে, অপর পক্ষ তাকে বিনা নোটিশে ডিভোর্স দিতে পারবে। তুমি শুধু একবার না, কয়েকবার রুলস ব্রেক করেছো।”

স্নেহার চেহারা থেকে সব রক্ত গায়েব হয়ে গেল। কেবল সাদা আর ফ্যাকাশে দেখালো তার মুখ। ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে। তোহাকে আঘাত করার প্রতিশোধ আমীর নিবেই। কিন্তু তাই বলে এভাবে? একদম ডিভোর্স! স্নেহা মোটেও এটা কল্পনা করেনি।

সে বলল,” বুঝলাম। এজন্যই তাহলে তোহাকে তুমি এতো দ্রুত ইটালি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছো? আমিও বলি, হঠাৎ কি এমন হলো? কারণ তুমি জানতে ডিভোর্সের পর আমি ডিরেক্ট গিয়ে তোহাকে সব সত্যি জানিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন আমি কিছুই জানাতে পারব না। খুব ভালো গেইম খেলেছো আমার সাথে। ওয়েল ডান আমীর! তোমার বুদ্ধির প্রশংসা না করে আমি পারছি না। তোহাকে আঘাত করার প্রতিশোধ তুমি এইভাবে নিবে?”

আমীর মুখ শক্ত করে বলল,” গেইম তো তুমিও খেলেছো আমার সাথে স্নেহা। প্রথমত আমাদের বিয়ের প্রধান ভিত্তিটাই মিথ্যা। ওই চিঠিগুলো একটাও মায়ের লেখা চিঠি না, তুমি আমার ইমোশনকে কন্ট্রোল করেছো। দিনের পর দিন আমার সাথে মিথ্যা বলেছো। তোমার এতোবড় প্রতারণার পরেও যে আমি এখনও তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেইনি সেজন্য তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ। সেকেন্ডলি তুমি মায়াকে আক্রমণ করেছো, রানু আন্টিকে হার্ট করেছো, আমার পক্ষে আর তোমাকে টলরেট করা সম্ভব না। ইটস ওভার।”

” তোমার মায়ের একটা বিশেষ জিনিস এখনও আমার কাছে আছে। সেটা কি তুমি পেতে চাও না?”

আমীর দূর্বল হাসি দিয়ে বলল,” আমি তোমাকে আর বিশ্বাস করি না।”

” এইসব কিছু তুমি তোহার জন্য করছো তাই না? কিন্তু কি লাভ? সে কখনোই তোমার হবে না৷ ”

” দরকার নেই। জীবনের সব চাওয়া পূরণ হওয়ার দরকার নেই। কিছু চাওয়া অপূর্ণ থাকুক। বেঁচে থাকার জন্য অপূর্ণতা প্রয়োজন। পরিপূর্ণ মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তাদের খুব শীঘ্রই ম-রে যেতে হয়।”

স্নেহা খিলখিল করে হেসে উঠল। টলমল দৃষ্টিতে বলল,” নিজেকে তাহলে এভাবে সান্ত্বনা দিবে? এটাকেই বলে রিভেঞ্জ অফ নেচার আমীর। আমি আমার ভালোবাসা কোনোদিন পাইনি। তাই তুমিও পাবে না। ”

” চিয়ার্স,আমাদের মধ্যে কেউই আসলে ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না!”

আমীর হেসে উঠল। কেমন পাগলের মতো ছেলেমানুষী হাসি। স্নেহা আফসোসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ডোরবেল বেজে ওঠে এমন সময়। ব্যারিস্টার সাহেব চলে এসেছেন। আমীর বলল, “ওয়েট আ মিনিট। আমাদের ডিভোর্স ফাইল রেডি।”

স্নেহার বুক ঢিপঢিপ করছে। আমীর দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেল।

চলবে

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩০.
গার্ডের বাহুতে ভর করে আহত, দূর্বল অবস্থায় উপস্থিত হলো সরব। তার নাক থেকে টুপটুপ করে নির্গত হচ্ছে র-ক্ত। ডানচোখের একপাশে কালো বৃত্তের মতো আঘাতের চিহ্ন। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখমের দাগ। ঘর্মাক্ত আর পরিশ্রান্ত দেহটা নিয়ে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও নেই। আমীর বিস্ময় সামলে প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে সরব? তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”

পরমুহূর্তেই আমীরের মাথায় সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা চাড়া দিয়ে উঠল। সে চোখ বড় বড় করে আতঙ্ক নিয়ে শুধালো,” মায়া কোথায়? সরব আমাকে বলো, মায়া ঠিকাছে তো? ও কোথায়?”

সরব অস্পষ্ট স্বরে প্রায় ভেঙে আসা গলায় উত্তর দিল,” এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে আমাদের উপর হামলা হয়েছিল স্যার। ওরা ম্যাডামকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। আমি খুব কষ্টে বেঁচে ফিরেছি। কিন্তু ম্যাডাম…”

সরবের মুখ করুণ হয়ে এলো। তার চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগল। আমীরের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায়। সে মুখে একটা বিস্ময়ের হা নিয়ে দিশেহারার মতো তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ খুব ক্ষেপে উঠে সরবের চোয়াল চেপে ধরে বলল,” মানে? তুমি থাকতে ওকে কিভাবে নিয়ে গেল? তুমি কি করছিলে? তোমার এই মুখ দেখানোর জন্য ফিরে এসেছো? জীবন দিয়ে হলেও ওকে বাঁচানোর কথা ছিল না? কিভাবে পারলে ওকে ফেলে আসতে? ইউ বাস্টার্ড!”

গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমীর থাপ্পড় মারল সরবের গালে। সরব লুটিয়ে পড়ল ফ্লোরে। আমীর তাকে টেনে তুলে রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কারা ছিল? কয়জন ছিল? কেন কিডন্যাপ করল?”

” জানি না স্যার। আমি কাউকে চিনতে পারিনি। একটা কালো জীপ নিয়ে এসেছিল।”

” গাড়ির নাম্বার মনে আছে? ট্র্যাক করতে পারবে?”

সরব দুইপাশে মাথা নাড়ল। হতাশ স্বরে বলল,”কিচ্ছু মনে নেই আমার।”

আমীরের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আহত সরবকে আরও আঘাত করতে থাকে সে। মুখ বরাবর একের পর এক ঘুষি মেরে বলল,” ননসেন্স, কি করেছো তুমি? কেন কিছু মনে নেই? তোমার কাজটা কি ছিল ওখানে? শুধু মা-র খাওয়া আর ফিরে আসা?”

গার্ডের সাথে আরও দুইজন ছুটে এসে আমীরকে থামাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কারো চেষ্টা সফল হয় না। আমীরকে থামানো যায় না। সে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। ফয়সাল অনুরোধ করে বলল,” স্যার ছেড়ে দিন, ও ম-রে যাবে স্যার।”

এই কথায় সম্বিৎ ফিরে আসে আমীরের। ধাতস্থ হয়ে সরবকে ছেড়ে দেয়। দূর থেকে নূরজাহান এই দৃশ্য দেখে মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে। ফয়সাল আর আফশান র-ক্তাক্ত সরবকে তোলে। নূরজাহানও ছুটে আসে। চ্যাঙদোলা অবস্থায় সরবকে তুলে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমীরের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সবকিছু অন্ধকার মনে হচ্ছে তার। কি থেকে কি হয়ে গেল এটা! তোহাকে কারা কিডন্যাপ করল? সে এখন কি অবস্থায় আছে? একের পর এক প্রশ্ন যেন মৌমাছির মতো বিষাক্ত হূল ফোটাচ্ছে আমীরের মস্তিষ্কে।

স্নেহা দূরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখে। কিছুক্ষণ পর
ধীরপায়ে আমীরের কাছে এসে দাঁড়ায় সে। তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,” কাম ডাউন আমীর। এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে।”

আমীর মুখ তুলে তীক্ষ্ণ এবং রক্তিম দৃষ্টিতে তাকালো স্নেহার দিকে। তার ওই সুচালো দৃষ্টি দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। স্নেহা বিব্রত হয়ে বলল,” চলো রুমে যাই। তুমি খুব ঘামছো। আগে তোমাকে রিল্যাক্স হতে হবে।”

দুইহাতে আমীরকে ওঠানোর চেষ্টা করল স্নেহা। কিন্তু সফল হলো না। আমীর নিজ শক্তিতে উঠে দাঁড়াল। স্নেহা মলিন মুখে বলল,” আমার হাত ধরো, এসো।”

আমীর পাথরের মতো শক্ত হয়ে রইল। স্নেহার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,” তোমার তো এই ঘটনায় খুশি হওয়ার কথা।”

” তোমার কষ্টে আমি খুশি হতে পারি? আমাকে কি এতো খারাপ মনে হয়? ছি আমীর!”

স্নেহার উত্তর শুনে আমীর না হেসে পারল না। হঠাৎ হেচকা টান মেরে স্নেহাকে কাউচের উপর চিৎ করে ফেলে দিল সে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্নেহা হতবিহ্বল বনে যায়। আমীর তার পকেট থেকে পিস্তল বের করে সরাসরি স্নেহার গলায় চেপে ধরল। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল স্নেহা। কোনোমতে চোখ মেলতেই দেখল আমীরের হিংস্র মুখটা তার খুব কাছে। রক্ত হীম করা দৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে। গা শিরশির করে উঠল স্নেহার।

আমীর গর্জন করে বলল,” টেল মি দ্যা ট্রুথ। ও কোথায়? ”

স্নেহার নিঃশ্বাস আটকে আসে। আমীরের শরীরের ভার সামলাতে কষ্ট হয়। অস্ফূটস্বরে বলে,” বিশ্বাস করো, আমি কিছু জানি না।”

” তুমি সব জানো!” আবারও গর্জন করে আমীর। রূঢ় কণ্ঠে বলে,” যদি ওর বিন্দু মাত্রও ক্ষতি হয় তাহলে সত্যি মে-রে ফেলব তোমাকে।”

” আমি কিছু জানি না…”

আবারও মিথ্যা কথা শুনে আমীরের মাথা ফুটন্ত পানির মতো গরম হয়ে যায়। তীব্র আক্রোশে পিস্তলের মাথা দিয়ে আঘাত করল স্নেহার কপালে। স্নেহা আর্তনাদ করে উঠল। মুহূর্তেই চোখ বুজে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমীর এই ঘটনায় একটু ভড়কে যায়। তারপরেই পাজাকোলায় করে স্নেহাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। বাথটাবের উপর শুইয়ে ঠিক তার মুখ বরাবর কল ছেড়ে দিল। তীব্র পানির স্রোত প্রবাহিত হতেই দশ সেকেন্ডের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল স্নেহা। তার নাকে,কানে পানি ঢুকে ভয়াবহ অবস্থা।

আমীর আচমকা তার মুখটা চেপে ধরল বাথটাবের উষ্ণ জলে। স্নেহা এবার চিৎকারও করতে পারছে না। নড়াচড়াও করতে পারছে না। পানির ভেতর তার নিঃশ্বাস থেমে যায়। গলা কাটা মুরগির মতো কেবল তড়পাতে লাগল। আর কিছুক্ষণ এভাবে ধরে থাকলে সে ম-রেই যাবে। আমীরের হঠাৎ হুশ ফিরল। সে কি করছে এসব? দ্রুত স্নেহাকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায়।

মাথাটা এতোই এলোমেলো হয়ে গেছে যে বোধশক্তি পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। জীবনে কোনো নারীর সাথে এতোটা নৃশংস আচরণ করেনি সে। কিন্তু মায়ার হারিয়ে যাওয়া তাকে সম্পূর্ণ উগড়ে দিয়েছে। তার মনের অনেক বড় একটা দূর্বল অংশ জুড়ে মায়ার বিচরণ। সে অংশে আঘাত লাগায় বেরিয়ে আসছে আমীরের সমস্ত ক্রোধ, হিংস্রতা। সে কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। ধপ করে ভেজা ফ্লোরে বসে পড়ল আমীর। মাথায় হাত রাখল। তিরতির করে কাঁপছে তার হাতটাও। মায়ার চেহারা ভেসে উঠল স্মৃতিপটে। যাওয়ার সময় কেমন করুণ মুখ করে সে বলছিল,” আর কখনও আমাকে দেখবেন না আপনি।” এই কথা মনে পড়তেই আমীর আরও দিগভ্রান্ত, উন্মাদ হয়ে উঠল। বুকের ভেতরটা ছিদ্র হয়ে গেল।

স্নেহা বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল,” আমাকে তুমি মে-রে ফেলতে চাও? তাহলে থামলে কেন? প্লিজ আমাকে মেরে ফেলো। কিল মি!”

আমীর জরাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,” আমি জানি তুমিই মায়াকে কিডন্যাপ করেছো। এটা তুমি ছাড়া আর কেউ করবে না। ”

স্নেহা কথা না বলে ফুঁপিয়ে উঠল। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। রাগে আমীর পেছনের দেয়ালের সাথে কয়েকবার নিজের মাথা বারি দিল। তারই সব ভুল। সে যদি স্নেহাকে তোহার ইটালি যাওয়ার খবর না জানাতো তাহলে হয়তো এসব হতো না৷ এতোবড় বোকামি সে কেন করল? কিভাবে করল! আমীর তীব্র আকুতির স্বরে বলল,” ওকে ছেড়ে দাও স্নেহা, প্লিজ। শী ইজ ইনোসেন্ট! আই বেগড ইউ। ওকে ছেড়ে দাও।”

স্নেহা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” তাহলে আগে তুমি কথা দাও যে আমরা সবসময় একসাথে থাকব। তুমি কখনও আমাকে ছাড়বে না!”

আমীরের মুখ থমথমে হয়ে উঠল। চোখমুখ শক্ত করে তাকাল সে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্নেহার উপর কঠিন হলে চলবে না। মায়া বিপদে আছে। তার নেওয়া একটা ভুল পদক্ষেপ মায়ার জন্য হতে পারে হুমকিস্বরূপ। আমীরের নিজেকে অসহায় আর অকর্মণ্য মনে হলো খুব। সে নিরুপায় হয়ে বলে,” ঠিকাছে। তুমি যা চাও তাই হবে। আমি সব করব তোমার কথামতো। তুমি শুধু ওকে ছেড়ে দাও।”

স্নেহা আক্ষেপের স্বরে বলল,” খুব ভালোবাসো ওকে তাই না? আমাকে কেন এভাবে ভালোবাসলে না আমীর?”

আমীর দূর্বল গলায় বলল,” ভালোবাসতে না পারলেও তোমার সব কথা আমি মানবো। তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই সবকিছু হবে। বাট প্লিজ, ডন্ট হার্ট হার!”

স্নেহা চোখের জল মুছে হাসল৷ আমীরের কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে বলল,” আই লভ ইউ সো মাচ।”

আমীর অনুভূতিশূন্য হয়ে মতো নিথরের মতো বসে রইল। কোনো জবাব দিল না।

_________________
অনেকক্ষণ ধরে সে পড়ে আছে এই নোংরা বিছানায়। তার মাথা এতোই ভার লাগছে যে বালিশ থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। এভাবে কতটা সময় অতিবাহিত হলো, তোহা জানে না। সে প্রাণপণে চিৎকার করে যাচ্ছে,” কেউ কি আছেন? হেল্প মি। হেল্প মি প্লিজ। আমাকে আটকে রেখেছে এরা। কেউ সাহায্য করুন। কেউ বাঁচান।”

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে তোহা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে গেল। একসময় সে সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগল। লোহার দরজা হওয়ায় খুব জোরে শব্দ হচ্ছে। বাইরে থেকে একটা কর্কশ কণ্ঠ বলে উঠল,” ওই দ্যাখ তো শা-লি কি চায়! মুখ বন্ধ কইরা আয়।”

তোহা একটু ঘাবড়ালো। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। এই কঠিন বিপদ থেকে বাঁচতে হলে তাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। তালা খোলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ একজন বলল,” ভাই, আমি কি যামু?”

” যা। কিন্তু খবরদার গায়ে হাত দিবি না।”

” ভাই.. এমন কড়া মাল জীবনেও দেখি নাই। একটু মস্তি করতে না পারলে কি লাভ হইল কষ্ট কইরা?”

তারপরই একটা থাপ্পড়ের আওয়াজ শুনল তোহা। ওই কর্কশ কণ্ঠস্বর বলছে,”এতো কিলবিল করে ক্যান? মস্তি করার জন্য পাঠাইছি তোরে? ধূর, তোগো কারো যাওয়ার দরকার নাই। আমি একলাই যথেষ্ট। ”

খট করে দরজা খুলে যেতেই আলো প্রবেশ করল ঘরে। তোহা প্রথমে দুইহাতে নিজের চোখ ঢেকে নিল। আবছা দৃষ্টিতে দেখল একজন রুগ্ন, কালো, টাকমাথা লোক তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তোহা করুণ গলায় জানতে চাইল,” আপনারা কি চান আমার কাছে? প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে। আমি হাতজোড় করছি, আমাকে যেতে দিন।”

তোহার কথা শেষ হতে না হতেই লোকটি তেড়ে এসে থাপ্পড় মারল তার গালে। তোহা বিছানায় উলটে পড়ে গেল। ব্যথায় ‘বাবা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল। চোখ ভরে গেল অশ্রুতে। কারা এরা? কেন এভাবে অত্যাচার করছে? সে কিছুই জানে না। টাকমাথা লোকটি তোহার চুলের মুঠি টেনে খুব বিশ্রী শব্দের গালি দিল।

তোহা কেঁদে উঠল। এতো বিশ্রী গালি কেউ দিতে পারে? লোকটি বলল,” একদম চুপ। আর একটা চিৎকারও যদি শুনি তাইলে কিন্তু খবর আছে।”

তোহা নিশ্চুপ হয়ে যায়। ঘর অন্ধকার করে লোকগুলো আবার বাইরে চলে গেল।

_________________
নীল আকাশে ভাসমান সাদা মেঘ। তিনতলার পাতাবাহার গাছের সবুজ পাতাগুলো দুলছে। মন উদাস করা দুপুর। হাহাকার বয়ে যাচ্ছে আমীরের বুকে। সাদা মেঘের মাঝখানে সে দেখতে পায় তোহার মিষ্টি মুখ। দৃষ্টি ক্রমশ সিক্ত হয়ে আসে। পেছন থেকে স্নেহা আমীরকে জড়িয়ে ধরল। আমীর প্রথমে একটু চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিল।

স্নেহা উচ্ছল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,”ব্যারিস্টার সাহেব কখন আসবেন?”

” আসবেন।” আমীরের কণ্ঠ উদ্বেগহীন।

” উনার আর আসার দরকার কি? নিষেধ করে দিলেই তো হয়৷ আমরা তো আর ডিভোর্স নিচ্ছি না, তাই না?”

আমীর পেছনে ঘুরে তাকাল। শান্ত গলায় বলল,” আগে মায়াকে সেইফলি পাওয়া যাক। তারপর ডিভোর্স ক্যান্সেল হবে। তার আগে না।”

স্নেহার হাসিমাখা মুখ ম্লান হয়ে গেল। ভ্রু কুচকে বলল,” তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছো না?

” তোমাকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না।”

স্নেহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছু একটা চিন্তা করে বলল,” তুমি ওকে পেয়ে গেলে আবার পল্টি খাবে না তো?”

আমীর উত্তপ্ত দৃষ্টিতে তাকাতেই হেসে উঠল স্নেহা,” স্যরি… আমি তো মজা করলাম। ঠিকাছে আমি তোহাকে আনার ব্যবস্থা করছি।”

” উহুম। কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। আমি নিজে সেখানে যাবো। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।”

স্নেহা আমীরের গলার পেছনে হাত বেঁধে বলল,” ঠিকাছে বাবা, নিয়ে যাবো। কিন্তু তুমি সেখানে গিয়ে কি করবে? ফাইটিং?”

স্নেহার কণ্ঠে রসিকতা। আমীর ওর হাত সরিয়ে তিক্ত গলায় বলল,”আমার সাথে হেঁয়ালি করবে না। ওকে আমি এক ঘণ্টার মধ্যে দেখতে চাই।”
____________
যত সময় যায় ততই বিষণ্ণতা অনুভব করে তোহা। চোখ ভর্তি পানি জমে ওঠে। আশেপাশের সবকিছু এখন ঝাপসা দেখাচ্ছে৷ আবছা আলোতে তার কল্পনায় ভেসে ওঠে মা-বাবার প্রিয় মুখ। ওইতো তারা হাসছে তোহার দিকে চেয়ে। তোহার হৃদয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায়। জাবিদ সাহেব আদুরে কণ্ঠে বললেন,” কেমন আছিস মা? ভয় পাস না। আমরা তো তোর সাথেই আছি!”

তোহার চোখ দিয়ে প্রবাহিত হয় শ্রাবণধারা। বুকের মধ্যে টাল-মাটাল বিরহ ঢেউ টের পায়। আজ যদি বাবা-মা বেঁচে থাকতো তাহলে কি তাকে এইভাবে কষ্ট পেতে দিতো? প্রতিটা মুহূর্তে তোহার মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সে একা, বড্ড একা! সে কি মারা যাবে? মৃত্যুর আগে তার পাশে কেউ থাকবে না এই কথা কি স্বপ্নেও কোনোদিন ভেবেছিল সে? এতো বীভৎস মৃত্যু কারো না হোক! তোহার মা-বাবা তার দুইপাশে বসল। মা তার একটা হাত ধরলেন। অন্য হাত ধরলেন বাবা। তোহা অস্পষ্টভাবে বলল,” আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি বাবা, মা! আমাকেও তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও।”
বাইরে থেকে আবার একটা শব্দ হয়। ব্যাকুল কণ্ঠ ভেসে আসে,” মায়া!”

ঘরে আবারও আলো প্রবেশ করে। ঠান্ডা একটা হাত স্পর্শ করে তোহার শরীর। চোখ মেলে তাকাতেই তোহার মনে হয়, সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। আমীর এখানে কি করে আসবে? তোহা চোখ পিটপিট করে তাকায়। আমীর কোমল গলায় বলল,” কিছু হবে না তোমার। ”

তোহা দূর্বল কণ্ঠে অস্পষ্টভাবে আওড়াল,” আমি, আমি আপনাকে….”

” বলো?”

কথা শেষ না করেই তোহা চোখ বুজে ফেলে। আমীর রুক্ষ মেজাজ নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,”ওর গালে থাপ্পড়ের দাগ কেন? কে মে-রেছে ওকে?”

চারজনের মধ্যে একজন লোক একটু উদাস গলায় বলল,” আমি মারছিলাম। ”

” কেন?”

” মাইয়া মানুষ চিল্লায় বেশি। তাই বাধ্য হয়া একটা চড় দিতে হইছে।”

আমীর তেড়ে গিয়ে লোকটির কলার টেনে ধরল। কিড়মিড় করে বলল,” একটা অসুস্থ মেয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না? সাহস কিভাবে হলো ওকে টাচ করার?”

” আহা, থামো না প্লিজ। ”

স্নেহার অনুরোধে আমীর থামল না। তিন-চারটা ঘুষি মে-রে তবেই ক্ষান্ত হলো। স্নেহা বলল,” তোহা তো ঠিক আছে তাই না? ”

আমীর রাগান্বিত গলায় উত্তর দিল,” কিসের ঠিকাছে? জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ওর।”

” তুমি তাহলে দেরি করছো কেন? ওকে নিয়ে দ্রুত গাড়িতে যাও।”

আমীর আর সিন ক্রিয়েট করল না। তোহাকে পাজাকোলায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এটা একটা পরিত্যক্ত মন্দির। ছোট্ট স্টোর-রুমের মতো নোংরা ঘরে এতোক্ষণ বন্দী ছিল তোহা। ভয়ে তার গায়ে জ্বর এসে গেছে। কেমন বেড়ালের বাচ্চার মতো গুটিয়ে পড়েছে। আমীর তাকে নিয়ে গাড়ির পেছনের আসনে শুইয়ে দিল। তোহা চোখ বন্ধ রেখেই ‘বাবা, বাবা’ বলে আর্তনাদ করছে। আমীর তার পাশে বসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি থাকতে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। সবসময় তোমাকে আগলে রাখব। ”

তোহার হাতটা নিয়ে সেই হাতের উল্টোপিঠে খুব আলতো করে চু-মু দেয় আমীর। খুব ফিসফিস করে বলে,” তোমাকে আমি ভালোবাসি মায়া,নিজের সুখের থেকেও বেশি।”

তোহা কাঁদতে লাগল। আমীর একবুক আকুল তৃষ্ণা নিয়ে তাকে দেখল। পরম যত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর স্নেহা এসে সামনের ড্রাইভিং সিটে বসল। মিররে আমীরকে দেখা যাচ্ছে।কেমন বিবশ হয়ে তোহার মুখের দিকে চেয়ে আছে সে। এভাবে তো ভুল করেও কখনও স্নেহার দিকে তাকায়নি!

স্নেহা আফসোস করে বলল,” তুমি আমাকে কখনও এতো ভালোবাসতে পারবে না আমীর, এটা তোমার ব্যর্থতা। কিন্তু তোহাকে এতোটা ভালোবেসেও ওকে তুমি কোনোদিন পাবে না…. তোমাকে জীবন কাটাতে হবে আমার সাথে। আর এটাই আমার সফলতা।”

স্নেহা মৃদু হেসে গাড়ি চালু করল। আমীর সাবধানে আগলে ধরল তোহার মাথাটা। যেন তার ঘুমের বিন্দুমাত্র অসুবিধা না হয়।

_________________
মওদুদ আনাম সময়মতো ডিভোর্সের সব কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন। স্নেহা আর আমীর তাকে দুই পাশ থেকে ঘিরে বসে আছে। স্নেহার চেহারায় ঝলমলে ভাব। আমীর ভাবলেশহীন। মাথা নিচু করে নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল,” সবকিছু ক্যান্সেল করে দিন মওদুদ সাহেব। আমরা ডিসিশন চেঞ্জ করেছি।”

মওদুদ আনাম অবাক হয়ে বললেন,” সিরিয়াসলি? ”

স্নেহা আনন্দে উচ্ছল কণ্ঠে বলল,” একদম। আমাদের মধ্যে জাস্ট একটা ছোট্ট ঝগড়া হয়েছিল৷ বাট এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। আমরা আর ডিভোর্স নিচ্ছি না।”

মওদুদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” ঠিকাছে। তাহলে আপনাদের আরও তিনমাস সময় দেওয়া হলো। এমনিতেও এই ডিভোর্স ফাইনাল হতে যথেষ্ট ঝামেলা হতো। আপনাদের বিবাহিত জীবনের সময়ানুপাত খুবই কম।”

স্নেহা প্রাণচঞ্চল কণ্ঠে বলল,” শুধু তিনমাস কেন? আগামী ত্রিশবছরেও আমাদের ডিভোর্স হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা সারা জীবন একসঙ্গে থাকব৷ তাই না আমীর? বলো!”

আমীর মৃদু হাসার চেষ্টা করে উত্তর দিল,” হুম, রাইট।”

মওদুদ সাহেব খুশি হয়ে বললেন,” দেটস গুড। কংগ্রাচুলেশনস। শুনে খুব ভালো লাগল আপনাদের সিদ্ধান্ত। আসলে প্রত্যেক দম্পতিরই উচিৎ ডিভোর্সের আগে ভালো করে ভেবে নেওয়া। প্রিয় মানুষকে আমরা ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেই। অথচ আগেই যদি তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারতাম তাহলে আর হারানোর পর আর কাঁদতে হতো না। এরকম অনেক কেইস দেখেছি। এই ক্ষেত্রে আপনারা ভালো কাজটাই করেছেন। আমি খুবই খুশি আপনাদের সিদ্ধান্তে। এভাবেই সুখে থাকুন দোয়া করি সবসময়।”

মওদুদ উঠে দাঁড়ালেন। আমীরের সাথে হাত মিলিয়ে বললেন,” আমীর সাহেব, যাই তাহলে। আবারও কংগ্রাচুলেশনস। ”

আমীর বলল,” থ্যাংকস।”

সে মওদুদ আনামকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল।স্নেহা খুশিতে আত্মহারা হয়ে নূরজাহানকে ধরে জোরে ঘুরাতে লাগল। নূরজাহান থতমত খেয়ে বলল,” রিল্যাক্স ম্যাম।পড়ে যাবো তো।”

স্নেহা থামল। হাসতে হাসতে নূরজাহানের গাল টিপে দিয়ে বলল,” আমি যে কত্ত খুশি হয়েছি নূর! আমীর এতো ইজিলি মেনে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি। কালরাত থেকে অনেক টেনশনে ছিলাম। ফাইনালি ডিভোর্সটা আটকানো গেল। উফ, সবকিছু তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে। তুমি সরবকে ম্যানেজ না করলে আমরা এটা পারতাম না। কিন্তু বেচারাকে এতো মা-র খাওয়ালে কেন? অসুস্থ হয়ে গেছে তো একদম।”

নূরজাহান সতর্ক কণ্ঠে বলল,” আস্তে বলুন ম্যাডাম। কেউ শুনে ফেললে ওকে মে-রে ফেলবে। ”

” ওপপস স্যরি।” স্নেহা তার কণ্ঠস্বর নিচে নামাল। নূরজাহান মনখারাপ করে বলে,” মা-র না খেলে আমীর স্যার কি এতো সহজে সব বিশ্বাস করতেন? আর মেয়েটার সামনেও তো তাকে নাটক করতে হয়েছে। নাহলে ওই মেয়েটার সাথে স্যার যখন কথা বলবে তখন যদি সব বলে দেয়?”

” হুম সেটাও ঠিক। ভালো করেছো তাহলে। বাই দ্যা ওয়ে, সরব ছেলেটা কিন্তু তোমাকে অনেক ভালোবাসে। নাহলে তোমার এক কথায় লাইফ রিস্ক নিয়ে আমাদের হেল্প করতে রাজি হয়ে গেল কেন? আমি কিন্তু বেশ অবাক হয়েছি। তুমি ওর ব্যাপারে সিরিয়াসলি ভেবে দেখতে পারো। তোমাদের বিয়ের সব দায়িত্ব আমি নিবো।”

নূরজাহান লাজুক মুখে হাসল। ব্যস্ত গলায় বলল,” আমি এখন যাই ম্যাডাম। ওর অবস্থা ভালো নেই। একটু দেখা করে আসি।”

” গো এন্ড টেক কেয়ার অফ হীম।”

_________________
মাথাটা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। তোহা চোখ মেলে নিজেকে আমীরের ঘরে আবিষ্কার করল। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। কতক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছে সে? আর এখানেই বা কিভাবে এলো? আমীরের ঘরটা বিশাল। একপ্রান্তে বেডসাইড অন্যপ্রান্তে সোফা। মাঝখানে বড় স্টাডি টেবিল। তোহা বিছানা থেকে নামতেই খেয়াল করল দূরে সোফার উপর ঝিম মেরে আমীর বসে আছে। চোখ দু’টি মুদিত। তোহা ধীরপায়ে হেঁটে সেদিকে গেল। টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে আমীরের মুখে ছুঁড়ে মা-রল।

চমকে উঠল আমীর। হকচকিয়ে বলল,” কি ব্যাপার?”

তোহা ঝুঁকে এসে আমীরের কলার চেপে ধরল। রোষাবিষ্ট দৃষ্টিতে বলল,” কি চান আপনি? কেন খেলছেন আমার সাথে এইভাবে? মে-রে ফেলতে ইচ্ছে করলে একেবারেই মে-রে ফেলুন। একটু একটু করে আধমরা বানানো কি খুব জরুরী? আপনি আমার জীবন শেষ করে দিচ্ছেন।”

আমীর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল। বিভ্রম নিয়ে বলল,” তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

আরও তেতে উঠল তোহা। উচ্চকণ্ঠে বলল,” কেন বুঝতে পারবেন না? এখানে আপনার আদেশ ছাড়া কোনোকিছু হয় না। আপনিই আমাকে কিডন্যাপ করিয়েছেন।”

” তোমার তাই মনে হয়?” আমীর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ওই গভীর চোখের ফাঁদে আবারও আটকে যাচ্ছে তোহা। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” জানি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

আমীর তার শার্টের কুঁচকে থাকা অংশ ঠিক করে বলল,” কিডন্যাপ করার ইচ্ছা থাকলে তোমাকে ইটালি পাঠাতাম কেন?”

তোহা সোফায় বসে পড়ল। গালে হাত রেখে বলল,” সেটাই আমি ভাবছি৷ তাহলে কে করল এসব? আপনার বউ?”

আমীর জবাব দিল না। তোহা নিজেই উত্তরটা বুঝে নিল। চোখ বড় বড় করে বলল,” বুঝেছি। স্নেহার কাজ এসব তাই না?”

আমীর নিরস গলায় বলল,” এখন থেকে ও আর কিছু করবে না।”

” বার-বার আপনি একই কথা বলেন। তারপর ঠিকই ডেঞ্জারাস কিছু হয়। প্রথমে সিকরেট রুমে বন্দী করা তারপর আমার উপর আক্রমণ আর এখন কিডন্যাপ। আচ্ছা আমার লাইফের কি কোনো সিকিউরিটি নেই? এভাবেই কি ওর ভয়ে ভয়ে আমাকে বাঁচতে হবে? আমি আর কত সাফার করব? কোনো অন্যায় না করেও বার-বার আমি শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি। কি আশ্চর্য! ”

” তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, এবার থেকে আর সত্যি কিছু হবে না। আমি প্রমিস করছি।”

তোহা চোখ কুটি করে তাকাল। সন্দেহ নিয়ে বলল,” সত্যি?”

” হুম, একদম।”

” এমনি এমনি তো এটা হতে পারে না। আই কান্ট বিলিভ। ”

” এমনি এমনি কিছু হয় না। সবকিছুর জন্যই দাম দিতে হয়।”

” আপনি কি দাম দিয়েছেন?”

আমীর আবেগহীন গলায় বলল,” আমার সুখ,স্বস্তি আর পুরো জীবনটাই।”

তোহার গাল থেকে হাতটা সরে গেল। হতভম্ব হয়ে বলল,” মানে?”

” কিছু না।”

আমীর উঠে চলে গেল। বাইরে শনশন বাতাস বইছে। বৃষ্টি নামবে মনে হয়। তোহা উদাস দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকাল।

চলবে

®Sidratul মুন্তায

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩১.
সরবের ঘর থেকে নূরজাহানকে বের হতে দেখে আমীর করিডোরের সামনেই দাঁড়িয়ে গেল। নূরজাহান আনমনে হেঁটে আসছিল৷ সে আচম্বিত আমীরকে সামনে দাঁড়ানো দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল।আমীর সচরাচর নিচতলায় আসে না। আর এইসময় তো একদমই না।

আমীর সরবের ঘরের দিকে একপলক তাকিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ল,” তোমার এখানে কি কাজ?”

ছ্যাৎ করে উঠল নূরজাহানের বুক। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। সে কোনোমতেই নিজের বেকায়দা অবস্থা আড়াল করতে পারল না।

” উনার হঠাৎ শরীর খারাপ করেছিল তাই দেখতে এসেছিলাম।” কথাটা বলেই মাথা নিচু করে ফেলল নূরজাহান।আমীর সূক্ষ্ম নজরে খেয়াল করল তার কপালে ঘামের বিন্দু।

“ঠিকাছে।”

আমীর এমন ভাব করল যেন এই কথা খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিয়েছে। অথচ কথাটা একদমই বিশ্বাসযোগ্য নয়৷ এই বাড়িতে সরবের মতো আহত মানুষ অহরহ হয়। কাউকে নূরজাহান দেখতে আসে না। এটা তার কাজ নয়। তাছাড়া এখন রাত এগারোটা বাজছে। এই সময় নূরজাহানের স্নেহার সাথে তিনতলায় থাকার কথা। সন্ধ্যার পর তাকে আর নিচে নামতে দেখা যায় না। সরবকে দেখার জন্য অনেক মানুষ আছে। তাকে কেন এই সময় আসতে হবে?

নূরজাহান আর কিছু না বলে দ্রুত আমীরকে পাশ কাটিয়ে উপরে চলে যায়। তার বুকের ধুকপুকানি অনেক খানি বেড়ে গেছে। সে আমীরকে অসম্ভব ভয় পায়। প্রয়োজন ছাড়া কখনও তার সামনেই আসে না৷ আমীর আজকে কিছু সন্দেহ করলে সর্বনাশ হতো। সরবের সাথে তার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরী হয়েছে এটা যদি আমীর বুঝে ফেলে তাহলে কিডন্যাপিং-এর পরিকল্পনাও সহজেই বুঝে ফেলবে। আমীর তো খুব ভালো করেই জানে স্নেহার সব কাজের ডানহাত যদি হয় রাশেদ তাহলে বামহাত হবে নূরজাহান!
নূরজাহান তিনতলায় এসে স্বস্তিবোধ করল।ভাগ্যিস আমীর কিছু সন্দেহ করেনি। তাহলে তো নানান প্রশ্ন করতো।

সরবের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো আমীর। তার মাথায় অনেক গুলো প্রশ্ন ঘূরপাক খাচ্ছে সকাল থেকে। প্রথমত তোহাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে সরব একা কেন গেল? তার তো ফয়সাল আর ওমরকেও সাথে নেওয়ার কথা ছিল। গাড়িতে যখন তাদের আক্রমণ করা হয় তখন সরবের উচিৎ ছিল সাথে সাথে আমীরকে টেক্সট করা। সেই সুযোগ না পেলেও পরে জানাতে পারতো। কিন্তু সরব জানাল কখন? একদম মা-র খেয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর! এতো বোকা আর দূর্বল সে না। সব ঘোলাটে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই সময় আমীর সরবের ঘরে এসেছিল। তবে নূরজাহানকে দেখার পর তার মনে হচ্ছে, সে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।

আমীর তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। বাইরে অনেক বৃষ্টি, শীতল বাতাস বইছে। এখন বর্ষাকাল। সময়ে-অসময়ে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামে। আমীর বারান্দায় এসে আরাম কেদারায় বসল। তার হাতের শিরা কাঁপছে। সরব এতোবড় বেইমানি করতে পারে এটা ভেবে ক্রোধ সামলাতে পারছে না। কাকে বিশ্বাস করবে এই দুনিয়ায়? সবাই বিশ্বাসঘাতক, নিমক*হারাম!

হঠাৎ একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমীরের হুশ উড়ে যায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে একদম বারান্দার কার্ণিশের কাছে চলে এলো। তোহা একটা পিচ রঙের শাড়ি পরে বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। দুইহাত মেলে দিয়ে বৃষ্টির পানির সাথে খেলছে। শাড়ির আঁচলে পানি নিয়ে মুখে মাখল। তারপর আনমনে হেসে উঠল। জীভের ডগায় বৃষ্টির পানি নিল। চোখ বুজে দুইহাত মেলে দিল আবার। আমীর ঘোরগ্রস্তের মতো কতক্ষণ তাকিয়ে রইল নিজেও জানে না। বজ্রপাতের শব্দে সম্বিৎ ফিরল তার। তারপর দ্রুত ঘরে চলে এলো।

আমীর থম মেরে বিছানায় বসল। বুকের বামপাশে হাত রেখে উপলব্ধি করল, শ্বাসজনিত অস্থিরতা তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। মোবাইল হাতে নিয়ে আফশানকে ফোন করল। একটু পরেই আফশান বাগানে দৌড়ে গিয়ে বলল,” ম্যাডাম, ভেতরে চলুন। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”

তোহা রাগ নিয়ে বলল,” হলে হবো। তাও আমি ভিজব। আপনার কোনো সমস্যা?”

আফশান বিনীতভাবে অনুরোধ করল” প্লিজ ম্যাডাম আসুন। স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে ভেতরে নিয়ে যেতে।”

তোহা এই কথা শুনে সাথে সাথে উপরে তাকাল। আমীর অপলক তার দিকেই চেয়ে ছিল৷ তোহা তাকাতেই দ্রুত নজর ফিরিয়ে নিল। লজ্জা পেয়ে গেল তোহা। গা শিরশির করে উঠল। মাথা নিচু করে বলল,” ঠিকাছে চলুন।”
” জ্বী ম্যাডাম।”

তোহা আফশানের সাথে ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর আমীর বড় করে শ্বাস নেয়। তার মাথায় বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যটা ঢুকে গেছে। এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারল না। স্বস্তি পেল না। রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্নেও দেখল, তোহা বৃষ্টিতে ভিজছে। সরল কিশোরীর মতো বৃষ্টির ফোঁটা হাতে নিয়ে খেলছে। তার প্রাণবন্ত হাসির মাদকতা আমীরকে টানে, মায়াভরা চাহনী একদম ঘায়েল করে দেয়। আমীর দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ঘোরগ্রস্তের মতো এগিয়ে গেল। তোহার কোমর ধরে তাকে একেবারে কাছে টেনে আনল।

” কি চাও তুমি? কেন বার-বার আমার সামনে এসে এভাবে তোলপাড় করে দাও?”

আমীর রূঢ় হওয়ার চেষ্টা করতেই মিষ্টি করে হাসল তোহা। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,” কারণ আমি জানি।”

তার হাসি দেখে আমীর এলোমেলো হয়ে যায়। বিবশের মতো প্রশ্ন করে,” কি জানো?”

তোহা আমীরের গলার পেছনে হাত বেঁধে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,” সব, সবকিছু জানি৷ যা আপনি নিজেকেও কখনও বলতে পারবেন না, তাও আমি জানি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন। প্রচন্ড ভালোবাসেন। আপনার মরুভূমির মতো খড়খড়ে জীবনে আমি এক পশলা সুখের বৃষ্টি হয়ে এসেছি। তাই আপনি তৃষ্ণার্তের মতো আমাকে পেতে চান…”

আমীর তোহার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। অস্বীকার করে বলল,” এসব মিথ্যা কথা। আমি তোমাকে পেতে চাই না। কিন্তু…”

আমীর থামল। তোহার মুখে হাসি লেগেই রইল। আমীরের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসল হঠাৎ। তোহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বলল,” তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না মায়া।”

তোহা হেসে উঠল শব্দ করে। তার হাসির শব্দ আমীরের বুকে ঝড় তুলে দিল৷ তোহা দুইহাতে আমীরের পিঠ আঁকড়ে ধরে বলল,” তাহলে বিয়ে করুন আমাকে।”

আমীর হৃদয়ে শীতল স্পর্শ অনুভব করল। অসম্ভব সুখময় ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বিয়ে শব্দটা এতো মধুর! মিষ্টি একটা গন্ধে ভরে গেল বুক। দু’জন- দু’জনকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।

” হ্যাঁ,আমরা বিয়ে করব।” আমীর উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল। তার চোখ দু’টি স্বপ্নাতুরের মতো জ্বলে উঠল। তোহা ম্লান মুখে উচ্চারণ করল,” কিন্তু… এটা সম্ভব না।”

টলমলে হয়ে এলো তোহার দৃষ্টি। আমীর তোহার মুখটা দুইহাতে আগলে ধরল। তৃষ্ণার্তের মতো তার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,” প্রয়োজনে পুরো পৃথিবী তছনছ করে ফেলব, তবুও তুমি আমার। শুধু আমার।”

_____________
একটি সুন্দর দিনের শুরু। আকাশের কালো মেঘ সরে হীরের মতো ঝকঝকে সূর্য উঁকি দিয়েছে। সেই ঝলমলে আলোয় প্রকৃতি থৈ থৈ করছে। ঘুম ভাঙার পর ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে স্নেহা গোসল সারল। রান্নাঘরে গিয়ে খুব যত্ন করে দুইকাপ কফি বানাল। তার গায়ে আকাশি রঙের ট্রান্সপারেন্ট শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ। মুখে হালকা মেকাপ। ভেজা চুল চেহারায় অন্যরকম আবেদন এনে দিয়েছে। লাবণ্যময়ী রূপ নিয়ে সে কফি হাতে আমীরের ঘরে হাজির হলো। কিন্তু আমীরের ঘরের দরজা লক। স্নেহা আফশানকে ডেকে দরজার চাবি খুঁজে আনতে বলল।

আফশান এই আদেশ শুনে মুখ কালো করে বলল,” কিন্তু ম্যাম, স্যার বলেছেন অনুমতি ছাড়া কেউ যেন ঘরে প্রবেশ না করে।”

স্নেহা চোখ রাঙাল,” তোমাকে যা বলছি তাই করো।”

আফশান বাধ্য হয়ে চাবি এনে দিল। স্নেহা লক খুলে আমীরের ঘরে প্রবেশ করল।ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। স্নেহা টেবিলে কফির ট্রে রেখে জানালা আর বারান্দার পর্দা টেনে দিল। ঝলমলে আলো প্রবেশ করল ঘরজুড়ে। স্নেহা দেখল আমীর বিছানায় খালি গায়ে ঘুমাচ্ছে। কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রাখল স্নেহা। কোমল গলায় বলল,” গুড মর্ণিং হানি, এভাবে কেন শুয়ে আছো? খালি গায়ে আবার ব্লাংকেটও দাওনি৷ যদি ঠান্ডা লাগে?”

আমীর স্নেহার হাতটা চেপে ধরল। ছলাৎ করে উঠল স্নেহার হৃৎপিন্ড। অদ্ভুত ভালো লাগায় শরীর শিহরিত হলো৷ খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে বলল,” কি ব্যাপার? আজকে তোমার কি হয়েছে?”

আমীর পাশ ফিরল। ঘুমের ঘোর তার এখনও কাটেনি। সে সুখের স্বপ্নে ডুবে আছে। মুচকি হেসে বলল,” আমাকে ছেড়ে যেও না।”

স্নেহা আপ্লুত হয়ে বলল,” কক্ষনো যাবো না।” সে মাথা রাখল আমীরের পিঠের উপর। আমীর উল্টো হয়ে ঘুমাচ্ছিল। ফিসফিস করে বলল, “মায়া, আই নিড ইউ।”

স্নেহা মাথা উঠিয়ে তাকাল,” কি বললে তুমি? মায়া?”

আমীর পুরোপুরি ঘুমের ঘোরেই ছিল। স্নেহার কর্কশ কণ্ঠের অত্যাচারে তার ঘুমটা ভাঙল এবার। চোখ মেলে স্নেহাকে দেখেই সে চমকে উঠে বলল,” তুমি এখানে কি করছো?”

স্নেহা চোখমুখ শক্ত করে বলল,” তোমাকে কফি দিতে এসেছিলাম।”
” ও। ”

আমীর উঠে বসল। গায়ে টি-শার্ট জড়াল। স্নেহা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে রুক্ষ গলায় বলল,” ঘুমের মধ্যে হাসছিলে কেন? অনেক সুখের স্বপ্ন দেখছিলে নাকি?”

আমীর কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,” আমার সব স্বপ্নই সুখের হয়। কারণ সেখানে তুমি নেই।”

স্নেহা খুব কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে বলল,” তাহলে কে আছে? মায়া?”

আমীর উত্তর না দিয়ে হাসল। স্নেহা রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ির গোঁড়ায় দেখল তোহা দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার বাহানায় ইচ্ছে করেই তোহার গায়ের উপর গরম কফি ঢেলে দিল। যন্ত্রণায় গর্জে উঠল তোহা। টলমলে দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে তাকাল। স্নেহা জীভ কেটে বলল,” ওপস, স্যরি। খেয়াল করিনি। মাই ব্যাড!”

এই কথা বলেই সে দ্রুত নিচে নেমে গেল। আজই এই বাড়িতে তোহার শেষদিন। স্নেহা শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণছে। যত দ্রুত এই মেয়ে বিদায় হয় ততই ভালো। কিন্তু তার ভয়ও লাগছে। তোহা ইটালি চলে যাওয়ার পর যদি আমীর আবার উল্টে যায়? যদি আবার ডিভোর্সের জন্য উঠে-পড়ে লাগে? তাছাড়া তোহাকে অপহরণের প্রতিশোধ তো সে নিবেই। স্নেহার দুশ্চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না। তোহাকে সে আটকেও রাখতে পারবে না। এই মেয়ে সামনে থাকলে তার গা জ্বলে যায়৷ সবচেয়ে ভালো হতো একে খু-ন করতে পারলে।

_____________
গার্ডকে গাড়ি বের করার নির্দেশ দিয়ে আমীর তোহার ঘরে এলো। তোহা তার পুড়ে যাওয়া উরুতে মলম লাগাচ্ছে। স্কার্ট হাঁটুর অনেকটা উপরে। দরজায় নক না করেই ঢুকে পড়ল আমীর। তোহা বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল। একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। আমীর দ্রুত পেছনে ঘুরে গেল।

তোহা পোশাক ঠিক করে বলল,” কারো ঘরে ঢোকার আগে নক করা ভদ্রতা। নিজের বাড়ি দেখে কি সেটাও ভুলে যাবেন?”

” স্যরি… আসলে আমি তোমাকে ডাকতে এসেছিলাম৷ আমরা এখন বের হবো।”

” এখনি কেন? আমার ফ্লাইট তো দুপুরে তাই না?”

” হ্যাঁ। কিন্তু আমার বাইরে কিছু কাজ আছে।”

তোহা হাসার চেষ্টা করে বলল,” বুঝেছি। আমাকে স্নেহার কাছে রেখে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। সেজন্য সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন?”

” আমার জন্য অনেক কিছু ফেইস করেছো তুমি। আর কোনো ইন্সিডেন্স হোক আমি চাই না।”

” অলরেডি সকাল সকাল একটা ইন্সিডেন্ট ঘটে গেছে।”

” মানে? কি হয়েছে?”

তোহা থামল। সকালে স্নেহার করা ঘৃণ্য কাজটির কথা আমীরকে বলার মানেই হয় না। তাছাড়া আজ তোহা চলে যাবে। স্নেহা আর তাকে কতক্ষণই জ্বালাতে পারবে! সে বলল,

” কিছু না।”

তোহা উঠতে নিয়ে উরুতে জ্বালা অনুভব করল। আমীর উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধাল,” তোমার পায়ে কি হয়েছে?”

” গরম কফি পড়ে গেছিল। তেমন কিছু না।” তোহা দায়সারা। এমনভাবে বলল যেন কিছুই হয়নি। অথচ আমীর দেখতে পাচ্ছে তোহা সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। সে অস্থিরচিত্তে বলল,” এই অবস্থায় হাঁটবে কিভাবে তুমি?”

” কোনো ব্যাপার না। আই উইল ম্যানেজ।”

তোহা খুঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করল। আমীর কাছে এসে বলল,” থাক, আমি হেল্প করছি।”

এই কথা বলেই তোহাকে ফট করে কোলে তুলে নিল সে। তোহার চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,” কি করছেন? আপনার বউ দেখলে আমাকে মার্ডার করবে এবার।”

আমীর নরম স্বরে বলল,”বললাম তো, ও এখন আর তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না।”

আমীর তোহাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। লিভিংরুম পার হয়ে যাওয়ার সময় স্নেহা তাদেরকে দেখে ফেলল। সে গ্লাসে করে পানি খাচ্ছিল। এই দৃশ্য দেখে তার মুখ থেকে পানি ছিটকে বেরিয়ে আসে। খুকখুক করে কেশে উঠল সে। তোহা হাসিমুখে স্নেহার দিকে তাকাল। ইচ্ছে করেই আমীরের গলার পেছনে হাত বাঁধল। ওরা বেরিয়ে যেতেই স্নেহা লাথি মেরে লোহার চেয়ার ফেলে দিল। কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মা-রল।

গাড়িতে সামনের সিটে সরব বসে আছে। আমীর তোহাকে নিয়ে পেছনের সিটে বসাল। তোহা আন্তরিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” সরব ভাই, আপনার শরীরের কি অবস্থা?”

সরব মৃদু হেসে বলল,” এখন ভালো আছি ম্যাডাম।”

গতকাল থেকেই সরব আতঙ্কে ছিল। কিডন্যাপিং-এ তারও যে হাত আছে এই ব্যাপারে তোহা কিছু বুঝতে পেরেছে কি-না! আপাতত সে নিশ্চিন্ত হলো। তোহা স্বাভাবিক আচরণ করছে অর্থাৎ সে সন্দেহও করেনি। আমীর ড্রাইভিং সিটে বসতে নিলেই সরব বলল,” স্যার, আমি থাকতে আপনি কেন কষ্ট করবেন?”

” কোনো সমস্যা নেই সরব। তুমি বসো।”

আমীর গাড়ি চালু করল। তারা প্রথমে একটা হাসপাতালের সামনে থামল৷ আমীর তোহাকে ডাক্তার দেখাবে। তোহা যেতে চায়নি। সামান্য পুড়েই তো গেছে। এমন সিরিয়াস কিছু না। তবুও আমীর জোর করে নিয়ে গেল।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এবার একটা অজানা গন্তব্যের দিকে যেতে লাগল তারা। আমীর জঙ্গলের মতো নিরিবিলি জায়গায় হঠাৎ গাড়ি থামাল৷ সরবের কাঁধে হাত রেখে আমীর বলল,” বাইরে চলো সরব। তোমার সাথে আমার পারসোনাল কিছু কথা আছে। হাঁটতে হাঁটতে বলব।”

“ওকে স্যার।

সরব আশেপাশে তাকাল। এরকম একটা জায়গায় তারা কেন নামবে ঠিক বুঝতে পারল না।আমীর তাকে কেন সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে তাও সরব জানে না। কেমন একটা অদ্ভুত শঙ্কা বাজছে মনে। আমীর তোহার দিকে ঘুরে বলল,” তুমি এখানেই অপেক্ষা করো। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরছি।”

তোহা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” ওকে।”

প্রায় আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল৷ আমীর ফিরে এলো কিন্তু সরব এলো না। নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে বসে আমীর স্বাভাবিকভাবেই ড্রাইভিং শুরু করল৷ তোহা অবাক হয়ে শুধাল,” সরব ভাইকে দেখছি না যে? উনি কোথায়?”

” আসবে না।” আমীরের কণ্ঠে কি যেন ছিল। তোহা ভয় পেল। আশ্চর্য হয়ে তাকাল। আসবে না মানে কি? এমন জঙ্গলের মতো জায়গায় কেউ কোথায় যেতে পারে? অকারণেই তোহার ভেতরটা ছমছম করে উঠল।আমীরের চেহারা ইস্পাতের মতো কঠিন দেখাচ্ছে। তোহার হঠাৎ এমন কেন মনে হচ্ছে যে সরবের সাথে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে?

_____________
ইমিগ্রেশনের পর ওয়েটিংরুমে বসল তোহা। আমীরের বিশ্বাস হচ্ছে না যে তোহা সত্যি চলে যাচ্ছে। সে ঠিক তোহার পেছনেই দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে মোবাইল কিন্তু মনোযোগ তোহার কাছে। অপলক দেখছে সে তোহাকে শেষবারের মতো। আর মাত্র কিছু মুহূর্ত। তারপরই হারিয়ে যাবে ওই জাদুময়ী মুখের অধিকারিণী। কে জানে আবার কবে দেখা হয়! কিংবা আদৌ দেখা হবে কি-না!

হঠাৎ তোহা পেছন ফিরে তাকাল। আমীর অপলক তার দিকেই চেয়ে ছিল। চোখাচোখি হওয়ায় অস্বস্তিতে দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল আমীর। তোহা ব্যাপারটা বুঝেই মুচকি হাসল৷ হঠাৎ উঠে এসে আমীরের সামনে দাঁড়ালো। আমীর অস্বস্তি লুকাতে অন্যদিকে তাকাল। তার মনে হচ্ছে তোহার দিকে তাকালেই গতরাতের স্বপ্নের ব্যাপারটা সে জেনে যাবে। এমন কেন মনে হচ্ছে?আমীর সহজ হওয়ার চেষ্টা করল,” কিছু বলবে?”

তোহা হাসিমুখে জানতে চাইল,” আপনি আমাকে দূর থেকে স্টেয়ার করছেন কেন?”

আমীর কপালে চার-পাঁচটা ভাঁজ ফেলে বলল,”কখন? আমি তো আমার এমপ্লয়িজদের টেক্সট করছিলাম। তোমাকে স্টেয়ার করব কেন? এই দেখো।”

প্রমাণস্বরূপ ফোনের স্ক্রিন দেখালো আমীর। তোহা মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেলল। আমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ফ্লাইটে না ওঠা পর্যন্ত তুমি আমার দায়িত্ব। তাই তোমার খেয়াল রাখাও আমার দায়িত্ব। এটাকে স্টেয়ারিং না ভেবে কেয়ারিং ভাবো।”

তোহা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ল। একটু পর বলল,” আমি কিন্তু আপনাকে অনেক মিস করব। খুব মনে পড়বে আপনার কথা। আপনার মনে পড়বে না?”

” কেন পড়বে না? নিশ্চয়ই পড়বে। ”

আমীর বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। অথচ তোহাকে তার কতকিছু বলার আছে! তোহাকে নিয়ে সে কত-শত রঙিন স্বপ্ন দেখেছে। এসব তোহা কোনোদিন জানবে না। হঠাৎ মনে পড়তেই পকেট থেকে একটা ফোন বের করে তোহার হাতে দিল আমীর।

“এটা নিয়ে যাও৷ তোমার বাবার ফোন। এতোদিন আমার কাছে ছিল।”

তোহা প্রথমে চমকে উঠল। পরমুহূর্তেই তার চোখ ভিজে ছলছলে হয়ে এলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল,” এই ফোন আপনি কোথায় পেলেন?”

” মৃত্যুর পর…তোমার বাবার শার্টের পকেটে পেয়েছি। ”

আমীর খুব সাবধানে কথাটা বলল। তোহা মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল,” আপনি নিজেও জানেন না যে আপনি আমাকে কি জিনিস দিয়েছেন! আমি তো ভেবেছিলাম বাবার কোনো স্মৃতিই আমার কাছে থাকবে না। ”

তোহা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে আমীরকে জড়িয়ে ধরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”

আমীরের শরীর বরফের মতো শিথিল হয়ে গেল৷ বুকের মধ্যে শুরু হলো তুষার ঝড়। তোহা স্বাভাবিক হতেই আমীরকে ছেড়ে দিল। একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল,

” আই এম স্যরি। কিন্তু এই ফোনটা পেয়ে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। জানি না কিভাবে আপনার ঋণ শোধ করব। এতোদিন আমি আপনার কাছে নিরাপদে ছিলাম। সব বিপদ থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন আপনি। আপনার জন্যই ইটালি যেতে পারছি। এখানে তো আমার কেউ ছিল না। আপনি আমাকে সেটা বুঝতেই দেননি। রানু আন্টি আমার অনেক যত্ন করেছেন। আমি সবার কাছে ঋণী।”

তোহা চোখের জল মুছে বলল,” আপনি আসলে অনেক ভালো মানুষ। স্নেহা ভাগ্যবতী যে আপনার মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছে।”

আমীরের চেহারায় নেমে আসে বিষাদের ছায়া। মনে মনে বলে,” কিন্তু আমি সবচেয়ে দূর্ভাগা কারণ তোমাকে আমি কখনও পাবো না৷ এমনকি কখনও চাইতেও পারবো না! ”

তোহা হাসল। মাইকে বিমান উড্ডয়নের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। আমীরের হৃদয় শূন্যতায় খা খা করে উঠল। একবুক যন্ত্রণা বুকের মধ্যে দাবিয়ে রেখে সে মলিন হাসি দিয়ে বলল,” ভালো থেকো।”

” আপনিও ভালো থাকবেন।”

_____________

চলবে