ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
452

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪০.
পার্কিং লটে এসে গাড়ি পার্ক করেই আমীর হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল৷ তার তাড়াহুড়ো দেখে জাবিদা হকচকিয়ে বলল,” কি ব্যাপার?”

আমীর পূর্ণ উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইল,” তোহা কোথায়?”

জাবিদা এদিক-ওদিক তাকাল। লিভিংরুমে সবাই একসঙ্গে বসে আছে। কিন্তু তোহা এখানে নেই। সেই ব্যাপারে কারো খেয়ালও নেই। আলিফ বলল,” আসলেই তো, তোহা কোথায়?”

আমীর রাগে গর্জন করে বলল,” আপনাদের কোনো ধারণা আছে? ও যেকোনো সময় একটা ভুল স্টেপ নিতে পারে। অথচ আপনারা কি নিশ্চিন্তে বসে আড্ডা দিচ্ছেন! যেন কিছুই হয়নি। ওর যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে আপনাদের সাথেও ভালো হবে না।”

আলিফ উঠে দাঁড়ালো। তাকে ভীষণ বিচলিত দেখালো।

” মানে? তোহার কি হয়েছে?”

আমীর সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। মাহমুদ সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন,” তুমি কি বলতে চাও সরাসরি বলো। আমরা ওর বডিগার্ড না যে সারাক্ষণ ওকে চোখে চোখে রাখব৷ এতো সমস্যা থাকলে ওকে নিজের কাছে নিয়ে রাখো৷ আমাদের কাছে পাঠানোর কি দরকার ছিল?”

আলিফ চাপা কণ্ঠে বলল,” বাবা স্টপ ইট, এগুলো কেমন কথা?”

আমীর ক্ষোভে অস্থির হয়ে বলল,” প্রয়োজনে আমি সেটাই করব।”

তারপর সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল৷ তাকে ছাদে পৌঁছাতে হবে। মাহমুদ বিড়বিড় করে বললেন,” সাংঘাতিক বেয়াদব এই ছেলে।”

আলিফও আমীরের পিছু নিল। নিঃশ্বাস আটকে ছাদে পৌঁছালো আমীর। এটুকু পথ উঠে আসতেই সে হাঁপিয়ে গেল। অত্যন্ত মানসিক চাপ আর স্থবিরতা তাকে গ্রাস করে নিল। অবশেষে কার্ণিশে তোহাকে সুরক্ষিত অবস্থায় দাঁড়ানো দেখে তার হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক হলো। সে স্বস্তি ফিরে পেল। বুক ভরে শ্বাস নিল একবার। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আলতো কণ্ঠে ডাকল,” মায়া।”

হাসি মুখে পেছন ফিরে তাকাল তোহা। আমীর বিমুগ্ধ হলো। এই হাসিই বুঝি একদিন তার মৃ-ত্যুর কারণ হবে। নয়তো বেঁচে থাকার! তোহা কয়েক পা এগিয়ে এসে ভ্রু কুচকে বলল,” আরে, ঘেমে গেছেন দেখছি৷ এমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন আপনাকে? ”

একটু থেমে তোহা আবার বলল,”কি করে জানলেন যে আমি ছাদে আছি?”

আমীর বিব্রত হলো। কি উত্তর দিবে এখন? তোহাকে তো স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। নাকি সে কিছু লুকাচ্ছে? অবশ্যই আমীরের সামনে সে কান্নাকাটি করবে না। কিন্তু তার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে এই ব্যাপারে আমীর নিশ্চিত৷ নয়তো আত্মহত্যা করতে ছাদে কেন আসবে? তোহা খুব চাপা স্বভাবের। সহজে কিছু বলতেই চায় না। আমীর বলল,” তুমি এখানে কি করছো?”

তোহা চটপটে উত্তর দিল,” আমি কি করছি সেটা পরের বিষয়। আগে বলুন আপনি এখানে কি করছেন? এমন লাফিয়ে লাফিয়ে ছাদে উঠলেন কেন? ট্রেইন ছুটে যাচ্ছিল নাকি? নিন, ঘাম মুছুন।”

তোহার তার জিন্সের পকেট থেকে রুমাল বের করে আমীরের হাতে দিল। আমীর হকচকিয়ে গেল। আসলেই সে খুব ঘেমে গেছে। তাছাড়া ভয়ও তো পেয়েছিল। আরেকটু দেরি হলেই তার নিঃশ্বাস থেমে যেতো। এতো প্রেশার নিয়ে কি বাঁচা যায়? উফ, আমীরের একবার ইচ্ছে হলো তোহাকে এখনি এই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেতে। কিন্তু কোন অযূহাতে নিয়ে যাবে? তোহাই বা তার সঙ্গে কেন যাবে? আমীর কিছু বুঝতে পারছে না৷ তার কি করা উচিৎ? সে কেবল অসহায় দৃষ্টিতে তোহার দিকে তাকিয়ে রইল।

তোহার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। ঠোঁট জুড়ে অল্প হাসি। বেশ সপ্রতিভ কণ্ঠে বলল,” আপনার কি হয়েছে বলুন তো আমীর সাহেব? কোনো বিষয় নিয়ে টেনশন করছেন নাকি? আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন। হতে পারে আমি আপনার কোনো উপকারে আসলাম!”

আমীর হালকা করে কাশল। চিন্তিত গলায় বলল,” তোমাকে নিয়েই আমার টেনশন। তুমি এই বাড়িতে আসার পর কি কি হয়েছে আমাকে বলো। আমি জানি তুমি ভালো নেই।”

খিলখিল করে হেসে উঠল তোহা। মুখে হাত রেখে হাসি থামিয়ে বলল,” কি আশ্চর্য, আমি যে ভালো নেই এটা আমিই জানি না। অথচ আপনি জানেন। মিনিটে মিনিটে ছুটে আসছেন। অস্থির ভাব করছেন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার মৃ-ত্যুর খবর পেয়েছেন। আমি যদি সত্যি ম-রেও যাই তাও কেউ এইভাবে ছুটে আসবে না।”

” মায়া এইসব কেমন কথা?” আমীরের চোয়াল শক্ত, কণ্ঠ ধারালো। তোহা নরম হেসে বলল,” ঠিকই বলছি। এই পৃথিবীতে আমার সেরকম আপন কে আছেন বলুন? যে আমি ম-রে গেলে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলবে?”

” সেজন্য কি তুমি সত্যি ম-রে যাবে?”

” না, না, মৃ-ত্যু এতো সহজ না। যদি সহজ হতো তাহলে বোধহয় ভালো হতো। জানেন, ওই আকাশের দিকে তাকালে আমার কি মনে হয়? ওইযে তারাগুলো দেখছেন! তাদের মধ্যে একজন বুঝি আমার বাবা। তিনি আমার দিকে চেয়ে হাসছেন। আমাকে ডাকছেন। দেয়ালের উপর উঠে হাত-পা মেলে দিলেই আমি আমার বাবার ডাকে সাড়া দিতে পারি।”

আমীর শক্ত করে তোহার হাত চেপে ধরল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, শাসনের স্বরে বলল,” এই ধরণের কথা আর কখনও বলবে না। এসব আজে-বাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”

তোহা হাত ছাড়িয়ে বলল,” আপনি এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? আমি ম-রলেও আপনার কি আর বাঁচলেও আপনার কি? আপনার নিজের জরুরী কাজ ফেলে আমার পেছনে এভাবে সময় নষ্ট করা উচিৎ হচ্ছে না।”

আমীরের মন বলে উঠল,” আমার জীবনে তুমিই একমাত্র জরুরী। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ততদিন আমার প্রধান কাজ শুধু তোমাকে সুরক্ষিত রাখা।”

মুখে বলল,” কারো কথা ভাবার দরকার নেই। তুমি ম-রে গেলে কেউ কাঁদবে কি-না, কারো কিছু যায়-আসবে কি-না, এসব চিন্তা না করে নিজের জন্য বাঁচো মায়া। একবার চিন্তা করো তোমার বাবার কথা। তিনি বেঁচে থাকলে কি তোমার এই অবস্থা দেখে খুশি হতেন? হতে পারে এখন তিনি বেঁচে নেই। কিন্তু তাতে কি? তিনি অবশ্যই তোমাকে দেখছেন। তোমার উচিৎ নিজের বাবার আত্মার শান্তির জন্য হলেও সুস্থভাবে বাঁচা। আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকব। বি স্ট্রং, বি ব্রেইভ। তুমি সবকিছু করতে পারো।”

কথাগুলো বলতে বলতে আমীর তোহার কাঁধে হাত রাখল। সেই হাতের দিকে চেয়েই তোহা প্রশ্ন করল,” আপনি সারাজীবন আমার পাশে কেন থাকবেন? কে আপনি আমার? এমনি এমনি তো কেউ কারো পাশে থাকে না!”

আমীর কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে বলল,” আমি তোমার গুড ফ্রেন্ড হয়ে থাকব।”

তোহা নিজের কাঁধ থেকে আমীরের হাত সরিয়ে বলল,” আমার ফ্রেন্ড লাগবে না। যে আমাকে শুধু দায়িত্ব মনে করে সে আমার গুড ফ্রেন্ড কিভাবে হবে?”

” স্যরি৷ এখন থেকে আর দায়িত্বের কথা বলব না।”

“আমার বাবা কি আপনার গুড ফ্রেন্ড ছিল না? মৃ-ত ফ্রেন্ডের দেওয়া দায়িত্ব এতো সহজে ভুলে যাবেন?”

” তাহলে তুমিই বলো, আমি কি করব?”

তোহার মন কেঁদে উঠল। ব্যাকুল হয়ে সে শুনতে চাইছে শুধু একটি কথা। যা আমীর কখনও বলবে না! সে অন্যদিকে ফিরে চোখের কোণ মুছে বলল,” আমি কেন বলব? আপনার কি আমাকে কিছুই বলার নেই?”

আমীর নিজের মনে বলল,” আমি মুখ খুললে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।”

তোহা আমীরের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে খুব অভিমান করল। রাগী গলায় বলল,” ফুপু আপনাদের জন্য ডিনারের আয়োজন করেছেন। নিচে চলুন। খেয়ে-দেয়ে চলে যান। আর কখনও আসবেন না। আমি ঘৃণা করি তাদের, যারা সত্যি প্রকাশ করতে ভয় পায়।”

তোহা এই কথা বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল। আলিফ সবকিছু শুনছিল বাইরে দাঁড়িয়ে। তোহাকে বের হতে দেখেই দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে পড়ল সে।

আমীর স্তব্ধ, নিঃসাড় হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে রইল অনেকটা সময়। চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে লাগল। তোহার শেষ কথা কানে বাজতেই থাকল,” আমি ঘৃণা করি তাদের, যারা সত্য প্রকাশ করতে ভয় পায়!”

আমীর আকাশের দিকে তাকাল। অনেকটা নিশ্চল কণ্ঠে স্বগতোক্তি করল,” তোমার ভালোবাসা আমার কাছে স্বপ্নতুল্য মায়া। বাস্তবে তো আমি শুধু ঘৃণার যোগ্য!”

চলবে

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪১.
তোহাকে ছাদ থেকে নামতে দেখেই জাবিদা ছুটে এলো। তাকে জেঁকে ধরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল। অশান্ত স্বরে বলল,” তোর কি হয়েছে মা? মুখের অবস্থা এরকম দেখাচ্ছে কেন? আর আমীর আমাদের এসব কেন বলল? তুই ওকে কি বলেছিস যেটা আমাদের বলা যাচ্ছে না?”

মাহমুদ সাহেব তোহাকে রাগী গলায় কিছু বলতে নিচ্ছিলেন। কথা তাঁকে থামিয়ে দিল,” বাবা, থাক বাদ দিন। আপনি ঘরে চলুন প্লিজ।”

তোহা কোনো জবাব দিচ্ছে না৷ মাহমুদ সাহেবকে নিয়ে কথা ঘরে ঢুকে গেল। পেছন থেকে আলিফ নেমে এসে জবাব দিল,” ওর মনখারাপ মা। ছোটমামার মৃ-ত্যুশোক এখনও কা-টিয়ে উঠতে পারছে না। প্রতিদিন একা একা ছাদে গিয়ে হাঁটে।”

জাবিদা বিচলিত গলায় বলল,” সেকি, ওর যে এই অবস্থা তুই আমাকে আগে বলবি না?”

” আমি তো জানতাম না। মনের কথা বলার মতো সম্পর্ক ওর সাথে আমার তৈরী হয়নি। আমি শুধু বাইরে থেকে শুনেছি যখন আমীরসাহেবের সাথে ও কথা বলছিল।”

তোহার মুখ অস্বস্তিতে ছোট হয়ে গেল। আলিফ তাদের কথা শুনেছে ভেবেই কেমন যেন লাগছে। অবশ্য সেও তো কথা আর আলিফের কথোপকথন লুকিয়ে শুনে নিয়েছিল। যদিও ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত না। জাবিদা তোহার কাঁধে, মাথায় হাত বুলাতে লাগল। খুব সান্ত্বনা ভরা কণ্ঠে বলল,” আচ্ছা আমরা কি আসলেই তোর কেউ না? তোর মনখারাপ হলে আমাদের কাছে আসবি। আমার সাথে কথা বলবি। দরকার লাগলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবি৷ তা না করে একা একা ছাদে গিয়ে কেন হাঁটবি? এগুলো কোনো কথা? তোর বয়সী মেয়েদের কত আজে-বাজে চিন্তা আসে মাথায়! আর কখনও যাতে আমি না দেখি একা একা থাকতে। তোর আলাদা ঘরে থাকাও বন্ধ। আজ থেকে রাতে আমার সঙ্গে শুবি।”

মাহমুদ সাহেবকে ঔষধ খাইয়ে ঠান্ডা করার পর কথা লিভিংরুমে এলো। জাবিদা কথাকে উদ্দেশ্য করে বলল,” বউ মা, তুমি কি মেয়েটার সাথে একটু গল্প করতে পারো না? সবসময় একা থাকে ও। সদ্য বাবা ম-রে গেছে। ওর কষ্টটাও তো আমাদের বোঝা উচিৎ। আমরা ছাড়া ওর কে আছে? ও কিন্তু এখন আমাদের বাড়ির সদস্য। এই বাড়ি থেকে ও কোথাও যাবে না। ওকে মেনে নিতে না পারলে তুমি আর আলিফ আলাদা বাড়ি নিয়ে থাকো। তোহা আমার কাছেই থাকবে।”

তোহা এই পর্যায় বলল,” ছি ফুপু, কি বলছো এসব? আমার জন্য তোমাদের সংসার আলাদা হবে মানে? এরকম কিছুই হবে না। আমিই সময়মতো এখান থেকে চলে যাবো। ”

আলিফ প্রতিবাদী কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” কোথায় যাবে?”

তোহা নিশ্চুপ। জাবিদা একটা ধমক দিল তাকে। কথা বলল,” একদম এমন কথা বলবে না। তুমি এখানেই থাকবে তোহা। তোমাকে নিয়ে আমাদের কারো সমস্যা নেই। আর সমস্যা থাকলেও এটা তোমার ফুপুর বাড়ি। তোমার এখান থেকে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।”

তোহা চোখের জল মুছল। জাবিদা সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমার লক্ষী মা। এভাবে কাঁদিস না৷ তুই কাঁদলে আমার কলিজা ফেটে যায়!”

মুহূর্তেই একটা পিনপতন নিরব পরিবেশের সৃষ্টি হলো। তোহার ভেজা চোখ দেখে সকলে আবেগী হয়ে উঠল। অথচ কেউ জানেই না, তোহার কান্নার পেছনের আসল কারণটা কি!

আমীর ধীরপায়ে নিচে নামছিল। তার মাথাটা নত। মুখ খুব শুকনো আর করুণ। সে দ্রুত প্রস্থানের পায়তারা করছিল। তোহার চোখের দিকে তাকানোর সাহস আর অবশিষ্ট নেই। নিজেকে তেলাপোকার চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। অপরাধবোধ তাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে ভালোবাসার কাছে। আলিফ কিছুক্ষণ শক্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থেকে দূরে গিয়ে কাউচে বসল। জাবিদা সৌজন্যতায় ভরা কণ্ঠে বলল,” এদিকে এসো, বাবা। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তুমি না এলে আমরা তোহার মনের কষ্টের ব্যাপারটা জানতেই পারতাম না৷ তুমি অনেক করেছো ওর জন্য। তোমার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই।”

আমীর অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। সে যা করেছে, তার জন্য আজীবন শাস্তি পেলেও কম হয়ে যাবে। ঋণী হওয়া তো দূর, আসল সত্যি জানলে তার মুখে থুতু দিতেও সবার ঘৃণা হবে। হ্যাঁ, সে এতোটাই জঘন্য পাপী! আমীর নিষ্প্রাণ গলায় বলল,” আমি আসছি।”

সাথে সাথেই তোহার উত্তেজনা ভরা কণ্ঠ ভেসে এলো,”যাবেন না।”

আমীরের পা দু’টো থমকে গেল। হৃৎস্পন্দন বাড়তে লাগল৷ তোহার ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় নেই। অথচ তাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতাও নেই। এ কেমন দোটানা! জাবিদা বলল,” হ্যাঁ তাইতো। তুমি চলে যাবে কেন? তোমার জন্য কত রান্না করেছি আমি। অন্তত একবেলা যদি আমার বাড়িতে তুমি না খাও তাহলে আমি আফসোসে ম-রে যাবো। না খেয়ে তোমাকে কিছুতেই যেতে দিবো না। তুমি আমার মৃ-ত ভাইয়ের একমাত্র ভরসাযোগ্য মানুষ ছিলে। আমার কাছে তুমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ”

আমীর খুব কষ্টে উচ্চারণ করল,” আমার সময় নেই।”

” সকালেও একই কথা বলে পালিয়েছো। আর তোমাকে পালাতে দিচ্ছি না। কথা, টেবিলে খাবার সার্ভ করো। আজকে আমাদের গেস্ট খেয়েই যাবে।”

আন্তরিকতার খাতিরে আমীর সামান্য হেসে বলল,” প্লিজ আন্টি, জোর করবেন না। আসলেই আমার সময় নেই।”

” তোমার সাথে না আরেকজন ছিল? সেই ছেলেটা কই?”

” ও আসেনি। আমি একাই এসেছি। আরেকদিন এলে ওকে সহ নিয়ে আসবো। তখন খেয়েও যাবো।”

” উহুম। ওকে সহ আরেকদিন নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু আজকে তোমাকে খেয়ে যেতেই হবে।”

আমীর কিছুতেই রাজি হবে না। পুনরায় নিষেধ করতে চাইল। তখনি তোহা খুব অনুরোধ মিশ্রিত কণ্ঠে আওড়াল,” ফুপু যখন এতো করে বলছে তাহলে খেয়ে যান না প্লিজ! মাত্র কিছুসময়ের ব্যাপার।”

আমীর একনজর তোহার দিকে তাকাল। ওই মায়াবী, কোমল মুখটা দেখে মন ভিজে গেল মুহূর্তেই। আর কিভাবে মানা করবে সে? মাথা নিচু করে টেবিলে বসল। তোহা বেসিনের সামনে গিয়ে বলল,” এদিকে আসুন৷ হাতটা ধুঁয়ে নিন।”

আমীর শান্ত ভঙ্গিতে উঠে সেদিকে গেল। তোহা তখন ফিসফিস করে বলল,” আ’ম স্যরি। ছাদে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম হয়তো। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি এরকমই।”

আমীর গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। কিছু বলতে পারল না। কি বলবে সে? তার কিছু বলার মুখ নেই। কথা হাসিমুখে খাবার সার্ভ করছে। জাবিদাও পূর্ণ আনন্দ নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। তোহারও ভালো লাগছে। সে ঠিক আমীরের বরাবর আসনে বসল। এখন সে মনোযোগ দিয়ে আমীরের খাওয়া দেখবে। পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার দৃশ্য! দূরে গম্ভীর মুখে আলিফ বসে আছে। দূর থেকেই লক্ষ্য করছে সে তোহার মুগ্ধ দৃষ্টি, আমীরের আঁড়চোখে তোহার দিকে তাকানো। তাদের মধ্যে যে গোপন রসায়ন চলছে তা আঁচ করতে মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না আলিফের।

জাবিদা কর্কশ গলায় ডাকল,” তুই এতো দূরে বসে কি করছিস? এদিকে আয়। আমীরের সাথে খেতে বোস। আদব-কায়দা ভুলে গেছিস নাকি? গেস্টকে কেউ একা খেতে দেয়?”

আলিফ না পারতে বাধ্য হয়েই আমীরের পাশে বসল। খাওয়ার ইচ্ছে নেই তবুও অল্প করে প্লেটে পাস্তা নিল। তোহা গালে একহাত ঠেঁকিয়ে লাজুক দৃষ্টিতে আমীরের খাওয়া দেখছে। কি শৈল্পিক ভঙ্গিতে খাচ্ছে আমীর! যাকে ভালো লাগে, তার সবকিছুই বুঝি ভালো লাগে। সে যদি একটু করে হাঁচি দেয় তাহলেও বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। মন বলে, ‘আহা এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাঁচি।’

হঠাৎ তোহার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলো। আলিফ জহুরী চোখে একবার তোহা তো আরেকবার আমীরকে পর্যবেক্ষণ করছে। তোহা গলা পরিষ্কার করে ডাকল,” ফুপু শোনো, তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার ছিল। মনে আছে?”

জাবিদা ব্যস্ত স্বরে বললেন,” হ্যাঁ মনে আছে। ডিনারের সময় তুই কি যেন ঘোষণা দিবি বলেছিলি।”

তোহা মুচকি হেসে আমীরের দিকে তাকাল। তারপর সিরিয়াস হয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,” প্রথম যেদিন আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম, তখন ফুপু কিছু কথা বলেছিল আমাকে। ফুপু তোমার কথাগুলো কিন্তু আমি মোটেও উড়িয়ে দেইনি। তাছাড়া সেগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো কথাও ছিল না। অনেক ভেবেছি আমি। ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বিয়ে করব ফুপু।”

আমীরের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আলিফের হিঁচকি উঠল। কথা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ডাইনিং টেবিলের সামনে। জাবিদা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তোহা সবার অবস্থা দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,” ওই ছেলেটাকে আসতে বলো।”

সবাই হতভম্ব। কেউ কোনো কথা বলল না।জাবিদা কেবল শুকনো গলায় শুধাল,” কোন ছেলে?”

তোহা খানিক বিরক্ত হয়ে তাকাল,” যাকে আমার ছবি দেখিয়েছিলে… তার কথা বলছি।”

জাবিদার মাত্র মনে পড়ল৷ সে তখন দ্রুত গতিতে মাথা নাড়তে লাগল। আলিফের দিকে নজর যেতেই দেখল রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আলিফ। সঙ্গে সঙ্গে জাবিদা বলল,” না থাক, প্রয়োজন নেই। এসব বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। পড়াশুনায় মনোযোগ দে। তুই হঠাৎ বিয়ে করতে যাবি কেন? তোর কিসের অভাব?”

তোহা ম্লান হাসি টেনে বলল,” অভাব যে আমার কিসে সেটা তোমরা ভালো করেই জানো। শুধু শুধু বাস্তবতা এড়িয়ে তো লাভ নেই। বিয়ে একটা আমার আসলেই দরকার। তাছাড়া যেই ছেলে সব সত্যি জানার পরেও আমার দায়িত্ব নিতে চায় তাকে বিয়ে না করলে ভুল হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। বিয়ের জন্য আমি একদম প্রস্তুত। তুমি তাদের আসতে বলো তো, প্লিজ।”

আলিফ খুব তেজালো কণ্ঠে বলল,” সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো মানে? বয়স কত হলো তোমার? মাত্র বাইশ বছরে কেউ বিয়ে করে?”

” বিয়ের জন্য অনুমোদিত বয়স আঠারো বছর। সেখানে আমার চার বছর পেরিয়ে গেছে। আমার তো মনে হয় বিয়ের জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। তাছাড়া লাইফটা তো আমার। যদি আমি বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত মনে করি তাহলে তোমাদের প্রবলেম কি?”

আমীর নড়াচড়াহীন অবস্থায় নিথর হয়ে বসে আছে। তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হচ্ছে। বুকে অপ্রতিরোধ্য একটা দহন জ্বালা ছড়িয়ে পড়ছে। তোহা উচ্চারণ করল,” মানুষ আমাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করে। আমি একটা বিয়ে করলে আশা করি সবার দুশ্চিন্তার অবসান হবে। তখন আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে শুধু আমার বর। এটাই ভালো নয় কি?”

আমীর যে প্লেটে খাচ্ছিল সেই প্লেটটা সটান করে টেবিল থেকে ফ্লোরে পড়ে গেল। কাঁচের প্লেট ভেঙে টুকরো হলো, মেঝে নোংরা হলো। সবাই চমকে উঠল। আমীর কেবল স্থির। সে ইচ্ছে করেই প্লেট ফেলেছে। তোহার সিদ্ধান্ত শুনে প্রথমেই তার ইচ্ছে করেছিল টেবিল জুড়ে সমস্ত প্লেট, কাঁচের গ্লাস, চামচ এক ধাক্কায় ফেলে দিতে। ক্রোধ সংবরণ করে বহুকষ্টে বসে ছিল। কিন্তু তোহার শেষ কথাটা শুনে রাগটুকু আর সামলানো গেল না।

জাবিদা টিস্যু নিয়ে ছুটে এসে বলল,” ইশ, কিভাবে হলো এটা?”

আমীর নরম গলায় বলল,” খেয়াল করিনি।”

কথা আস্তে-ধীরে মেঝে থেকে ভাঙা প্লেটের টুকরো তুলতে লাগল। জাবিদা টিস্যু দিয়ে আমীরের প্যান্ট মুছে দিতে নিলেই আমীর বলল,” আমাকে দিন। আমি করছি।”

তোহার হাসি পেয়ে গেল। আর কেউ না বুঝলেও সে ঠিক বুঝতে পারছে যে এসব কিভাবে হলো! আলিফেরও ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। তার চেহারা শক্ত, মুখ গম্ভীরতর হলো। কথা মেঝে পরিষ্কার করতে করতে বলল,” এসব সেন্সিটিভ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা পরে হবে তোহা। এখন বাদ দাও তো। আমীর সাহেব, আপনাকে অন্য প্লেটে দিচ্ছি।”

জাবিদা সাথে সাথে নতুন প্লেট সাজাতে লাগল। আমীর বাঁধা দিয়ে বলল,” প্লিজ, লাগবে না। আমার পেট ভরে গেছে। আমি এখন উঠতে চাই।”

তোহা বিস্মিত হওয়ার ভং ধরে বলল,” আরে, এতটুকুতেই আপনার পেট ভরে গেল? কিছুই তো খেলেন না দেখছি!”

আমীর তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” ইটস ওভার।”

জাবিদা আলতো করে হাসল,” আচ্ছা বাদ দাও। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে জোর করতে হয় না। তুমি যাও হাত ধুঁয়ে এসো।”

আমীর হনহন করে হেঁটে বেসিনের দিকে গেল। একবারও তোহার দিকে তাকাল পর্যন্ত না। তোহা মুখ টিপে হাসি সামলালো। কোপ একদম জায়গামতো লেগেছে।

আমীর হাত ধুঁয়ে কাউচে বসল। কথা তাকে ডেজার্ট খেতে দিল। রাগে গজগজ করছে আমীরের শরীর। সে এমনভাবে ডেজার্ট মুখে নিচ্ছে যেন চামচটা চিবিয়ে খেতে চায়। এসব দেখে তোহার বেশ মজা লাগছে। এবার যদি মানুষটা মুখ খোলে! আলিফ ডাইনিং রুম নিরিবিলি পেয়েই তোহাকে প্রশ্ন করল,

” এটা কেমন কথা তোহা? তুমি বিয়ের জন্য হঠাৎ পাগল হলে কেন? সময় কি চলে যাচ্ছে? ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নিও না প্লিজ। যদি আমার আর কথার জন্য তুমি এটা ভেবে থাকো, তাহলে তোমাকে জানিয়ে দেওয়া ভালো যে আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে।”

” প্লিজ আলিফ ভাইয়া, এরকম কিছু না। আমি তোমাদের জন্য বাধ্য হয়ে এটা কেন করব? এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের সিদ্ধান্ত। আর আমি মনে করি এতেই আমার ভালো। ”

” এতে তোমার ভালো না। নিজের ভালো সবাই বোঝে না। তুমি অন্তত বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।”

” আমি এই বিষয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না প্লিজ।”

তোহা এটুকু বলে নিজের ঘরে চলে এলো। দরজা আটকে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমীরের রাগান্বিত মুখটা কল্পনা করল কয়েকবার। খুশিতে চিলিক দিয়ে উঠল সর্বাঙ্গ। ভালো না বাসলে কি শুধু বিয়ের কথা শুনেই কেউ এতোটা জেলাস ফীল করতে পারে? ঈর্ষায় আমীরের মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছিল। ক্ষণে ক্ষণেই ট্রিগারড হচ্ছিল সে। অবশেষে না পারতে কাঁচের প্লেটটাই ভেঙে ফেলল। কি হাস্যকর ব্যাপার! হাসতে হাসতে তোহার পেট ব্যথা শুরু হলো।

চলবে

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪২.
নিশুতি রাত। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। স্নেহা আগুন জ্বালিয়ে বাইরে এসে বসল। নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে আজ। বহুদিন পর যেন প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল। এতোদিন তার দমটা আটকে ছিল চার দেয়ালের মাঝে। আর ক’টা দিন ওখানে থাকলে সে নিশ্চিত ম-রে যেতো। এই নির্জন জায়গায় কিছুক্ষণ আরাম-আয়েশ করে কাটানো যাবে। সে রাশেদ নামক বিপদের থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে, এটা ভেবেই শান্তি লাগছে। কিন্তু এভাবে বসে থাকলে চলবে না। তাকে দ্রুত কিছু করতে হবে যেন রাশেদ আর কখনও তার জীবনে আসতে না পারে।

সকালের জন্য ফ্লাইটের টিকিট কাটা আছে। স্নেহা এই দেশে থাকবে না। সে যেখানে যাবে সেখান থেকে আমীরের খবর রাখা খুব সহজ। সর্বপ্রথম তোহার ঝামেলা মেটাতে হবে। যা স্নেহার কাছে বামহাতের খেল। তোহাকে কেবল সত্যিটা জানাতে পারলেই কেল্লাফতে। সে আর জীবনেও আমীরের মুখ দেখতে চাইবে না। তারপর থেকে আমীর শুধু স্নেহার! এই কথা চিন্তা করেই পৈশাচিক আনন্দে হেসে উঠল সে। হাসির দমকে কেঁপে উঠল তার শরীর।

দূর থেকে গুলজার এই দৃশ্য খুব মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করছে। স্নেহার ফরসা পিঠ আর উন্মুক্ত পেট আগুনের নরম আলোয় কি লোভনীয় দেখাচ্ছে। সেদিকে গাড়লের মতো চেয়ে থাকতে গুলজারের ভালো লাগছে। কিন্তু স্নেহা জানতে পারলে তাকে খু-ন করবে। আপাতত তার প্রাণের ভয় নেই। এই গভীর অরণ্যে কেউ আসবে না স্নেহাকে সাহায্য করতে। একমাত্র গুলজারই স্নেহার রক্ষকবচ। আর রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখনি সবচেয়ে বড় বিপদের সূচনা হয়।

বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে স্নেহার। মা কেমন আছে? একবার কি সে যাবে দেখা করতে? কিন্তু মা তার মুখও দেখতে চায় না। ফীহার মৃত্যুর পর থেকেই সে স্নেহাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। যদিও এতে স্নেহার তেমন কিছু যায়-আসে না। পৃথিবীর সব মানুষ তাকে ঘৃণা করুক, শুধু আমীর তাকে ভালোবাসুক! এক জীবনে এটাই তার চাওয়া।

স্নেহা গলা উঁচু করে ডাকল,” গুলজার।”

” জ্বী ম্যাডাম।” ফ্যাসফ্যাসে গলায় গুলজার জবাব দিল। স্নেহা ভ্রু কুচকে পেছনে তাকাতেই দেখল গুলজার ঠিক তার পিঠের কাছেই বসে আছে। তাকে দেখে ভয়ে খানিক চমকে উঠল স্নেহা। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। গুলজার হেসে ফেলল। কেমন গা শীতল করা হাসি তার।

” ভয় পেয়েছেন ম্যাডাম?”

গুলজারের এমন প্রশ্নে স্নেহা বিরক্ত হলো। রাগান্বিত গলায় চরম মেজাজ দেখিয়ে বলল,” তোমাকে ভয় কেন পাবো? তুমি জ্বীন না ভূত? আমার সামনে থেকে সরো। না ডাকলে কাছে আসবে না। একবার বলেছি না?”

গুলজার চারিপাশ দেখতে দেখতে বলল,” এই অন্ধকার জায়গায় আপনার যদি হঠাৎ কোনো ক্ষতি হয় ম্যাডাম? আমি আপনার খেয়াল রাখছি। আমি ভেতরে চলে গেলে আপনাকে দেখবে কে?”

গুলজারের কথা বলার ভঙ্গি, তাকানো, কিছুই সুবিধার মনে হচ্ছে না। স্নেহা শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বলল,” আমার খেয়াল আমি রাখতে পারি। তোমাকে ভাবতে হবে না। যাও এখান থেকে। ”

গুলজার হাসতে লাগল। স্নেহা রেগে প্রশ্ন করল,” অকারণে হাসছো কেন? কি হয়েছে তোমার?”

” কিছু না ম্যাডাম। আমি ফার্ম হাউজে যাচ্ছি। কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন।”

” হুম যাও।”

গুলজার চলে যেতেই হাঁফ ছাড়ল স্নেহা। গরমেও শাড়ির আঁচল দিয়ে পুরো শরীর আবৃত করে রাখতে তার অসহ্য লাগছে। সেজন্যই গুলজারকে ভেতরে পাঠাতে হয়েছে। কিন্তু এই নির্জন জায়গায় তার ভয়ও লাগছে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল সকাল হতে সময় বেশি নেই। আর মাত্র দুইঘণ্টা। কোনমতে সকালটা হলেই সে রওনা দিবে এয়ারপোর্টে। বাকি সময় সেখানে নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে। এই মোবাইল ফোন আজ সকালেই স্নেহা কিনেছে। তার একাউন্টে যত টাকা ছিল, লকারে যত গয়না ছিল সব বের করে এনেছে। আজকেই বিদেশ যাওয়া যেতো। কিন্তু রাশেদ এয়ারপোর্টে তার খোঁজ করতে পারে। ধরা পড়ার ভয়ে সে আজরাতটা ফার্ম হাউজে কাটাবে। তারপর সকালে খুব ভোরে উঠে এয়ারপোর্টে রওনা হবে। এমনটাই পরিকল্পনা।

কিন্তু আসন্ন বিপদের শঙ্কাও স্নেহাকে শান্তি দিচ্ছে না। গুলজার স্নেহার অনেক বিশ্বস্ত সহচর। সে যেমন শক্তিশালী তেমনি ধূর্ত। তাকে দিয়ে স্নেহা এই পর্যন্ত অনেক ভয়ংকর কাজ করিয়েছে। স্নেহার পাপের নব্বই ভাগ সাক্ষী হলো গুলজার। কিন্তু কখনও সে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। সবসময় বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে। রাশেদও এমন ছিল। গুলজারের থেকেও রাশেদের প্রতি বেশি বিশ্বাস ছিল স্নেহার। কিন্তু সে কি করল? আমীরের সাথে মিলে স্নেহাকে কি নিখুঁতভাবেই না ঠকালো! এরপর আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।

গুলজারের প্রতিও বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। সব ছেলে মানুষই আসলে একরকম। এরা গোলামী করে, আবার যার গোলামী করে তাকেই কামনা করে। কি বিভৎস! কি নোংরা চিন্তা! স্নেহার গা গিনগিন করছে বিতৃষ্ণায়। বার বার মনে হচ্ছে, এখনি গুলজার আসবে। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবে। স্নেহা তার ব্যাগ থেকে ধারালো ছু/রি বের করে হাতে নিয়ে রাখল। প্রয়োজনে সে খু-ন করবে। গুলজারকে এখানেই মাটিচাপা দিয়ে দেশ ছাড়বে। দেশ ছাড়ার আগে এটাই হবে তার শেষ খু-ন।

শুকনো পাতার মরমর আওয়াজে ত্রাসিত হলো স্নেহা। ভয় পেল না। সে সহজে ভয় পাওয়ার মেয়ে নয়। আগুনের ঝান্ডা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতে আগুন সাথে থাকলে শেয়াল-কুকুর কাছে আসবে না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, ক্রমশ পায়ের শব্দ গাঢ় হচ্ছে। হঠাৎ করেই হাসির শব্দ শুনতে পেল। এখানে তো মানুষ আসার কথা নয়। তাছাড়া রাতেরবেলা জায়গাটা সবচেয়ে নিরব থাকে। স্নেহা ঘরে ঢুকে জানালা দিয়ে দেখল, চার-পাঁচজন নেশাগ্রস্ত লোক হেঁটে আসছে। ভয়ে শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। এই অবস্থায় তারা যদি স্নেহাকে দেখে, তাহলে ভয়ংকর ব্যাপার হবে। স্নেহা হয়তো একজনের সাথে পারবে। চার-পাঁচজনের সাথে কি করে পারবে?

ভয়ে নিরুপায় হয়ে অবশেষে মূল দরজার কপাট শক্ত করে আটকে দিল যাতে চাইলেও কেউ ভেতরে আসতে না পারে। হাতের ছু/রিটা সংরক্ষণ করে নিজের কাছেই রাখল। গুলজারকেও সে বিশ্বাস করে না। একা বাড়িতে তাকে পেয়ে যদি পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন কি হবে? নিজের সুরক্ষার জন্য গুলজারকে সাথে এনেছিল। অথচ এখন তাকেই ভয় লাগছে। স্নেহার মনে হচ্ছে সে বড় বোকামি করেছে।

বেডরুমে ঢুকতেই স্নেহা খুব অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হলো। তার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো চিৎকার। বিছানায় গুলজার শুয়ে আছে। তার হাতের মুঠোয় নিজের গোপন অঙ্গ। স্নেহা এই দৃশ্য দেখা মাত্রই দৌড়ে বেরিয়ে গেল। হাত-পা কাঁপতে লাগল তার। সেই কাঁপা হাতে দরজা খুলতে গেলেই মনে পড়ল বাইরে আরও চার-পাঁচজন হায়েনা দাঁড়িয়ে আছে। যারা স্নেহার চিৎকার শুনে ইতিমধ্যে টের পেয়ে গেছে যে এখানে মেয়ে উপস্থিত। একে একে তারা সকলে এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। প্রতিটি ধাক্কার সাথে স্নেহার বুক কেঁপে উঠছিল। সে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল মেঝেতে। তখনি গুলজার তার কালো ছায়া নিয়ে স্নেহার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে আরও ভয়ে দেয়ালের সাথে শিটিয়ে গেল স্নেহা। কোনমতে ছু/রি তার দিকে তাক করে কাঁপা কণ্ঠে আওড়াল,” কাছে আসবে না, খবরদার। সত্যি বলছি খতম করে ফেলব।”

গুলজার বীভৎস ভঙ্গিতে হাসল। ফিসফিস করে বলল,” আমি কিন্তু দরজা খুলে দিবো ম্যাডাম। আপনার শরীরের ফুলের মতো সুবাস তারাও উপভোগ করবে। আপনি কি চান? দরজা খুলে দেই?”

স্নেহা দ্রুত গতিতে দুইপাশে মাথা নাড়ল। মিনতির স্বরে বলল,” না, প্লিজ না। এইরকম কোরো না। আমার কাছে যত টাকা আছে তার অর্ধেক আমি তোমাকে দিয়ে দিবো। প্রমিস। তবুও তুমি দরজা খুলো না গুলজার। তোমার পায়ে পড়ছি।”

” টাকা লাগবে না। আমার লাগবে আপনাকে। আপনি আমার মাথাটাই খারাপ করে রেখেছেন ম্যাডাম। আমি সবকিছুর নেশা ছাড়তে পারব কিন্তু আপনার নেশা আমি ছাড়তে পারব না। আমার এই নেশা ছাড়িয়ে দিন। আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকব।”

স্নেহা রাগে ছু/রিটা নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইলেই গুলজার মূল দরজার কপাটে হাত রাখল। বাইরে থেকে যেভাবে দরজা ধাক্কানো হচ্ছে তাতে যেকোনো সময় এই দরজা ভেঙে যেতে পারে। ভয়ে স্নেহার কণ্ঠমণি শুকিয়ে এলো। গুলজার বলল,” আমি কিন্তু সত্যি সত্যি দরজা খুলব ম্যাডাম। তারপর আপনি আর নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না। কিন্তু আমার প্রস্তাবে রাজি হলে আমি আপনাকে বাঁচাবো। আর রাজি না হলে ওদের কাছে আপনাকে ছেড়ে দিবো। এবার বলুন কি চান? আমি কি…”

গুলজার দরজার কপাট ধরে টান দেওয়ার আগেই স্নেহা চেঁচিয়ে বলল,” না, আমি রাজি। তুমি যা চাও তাই হবে। আমি সব করতে রাজি কিন্তু দরজা খুলো না প্লিজ৷ দোহাই লাগে তোমার।”

স্নেহা হাতজোড় করল। তার সারা শরীর তিরতির করে কাঁপছে। গুলজার নির্দেশ দিল,” তাহলে শাড়িটা খুলুন ম্যাডাম।”

স্নেহা অসহায় হয়ে সেটাই করল। এছাড়া তার কোনো উপায়ও নেই। চূড়ান্ত সর্বনাশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই সর্বনাশ নিজের হাতেই ডেকে এনেছিল। ঠিক এই মুহূর্তে স্নেহার খুব করে মনে হচ্ছে, তার যদি মৃ-ত্যু হতো!

বাইরে থেকে ছেলেগুলোর চিৎকার ভেসে আসছে। তার মধ্যে একটা কণ্ঠ খুব পরিচিত,” জানবউ দরজা খোলো প্লিজ। লুকিয়ে থেকে আর লাভ কি বলো? তোমার খোঁজ একবার যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ছি না আমি। সেটা তুমিও ভালো করে জানো। তোমাকে সাথে নিয়েই বাড়ি যাবো। আর কোথাও পালাতে দিবো না। সকল চেষ্টা বৃথা। আমার কাছে তোমার আত্ম সমর্পণ করা ছাড়া উপায় নেই। যা হওয়ার হোক, হার কিন্তু আমি মানছি না।”

রাশেদ হেসে উঠল নিজস্ব কায়দায়। তার কণ্ঠ শুনে মুহূর্তেই স্নেহার চেহারায় খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। সে তেড়ে এসে গুলজারকে ধাক্কা মেরেই দরজা খুলে ফেলল। রাশেদ দরজা থেকেও অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনের সবাইকে উপেক্ষা করে স্নেহা সবেগে দৌড়ে রাশেদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আচমকা এহেন আক্রমণে রাশেদ ভড়কে গেল অনেকটা। টাল সামলাতে না পেরে দুই কদম পিছিয়েও গেল। বিস্ময় সামলে উঠতেই তার মনে হলো, এটা স্বপ্ন নয়তো? সে রসিকতার স্বরে বলল,” এমনভাবে ছুটে এলে যেন আমাকে খুব মিস করছিলে! ব্যাপারটা কি?” স্নেহা রাশেদের বুকে মুখ ডুবিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,” আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। যেখানে খুশি নিয়ে যাও প্লিজ।”

রাশেদ স্নেহার অবস্থা দেখে ভয় পেল। চোখমুখ বিধ্বস্ত, কণ্ঠে কান্নার বেগ তাছাড়া সে এতোক্ষণ খেয়াল করেনি স্নেহার শরীর অর্ধনগ্ন। রাশেদ দ্রুত নিজের শার্ট খুলে স্নেহার গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ” কি হয়েছে?”

স্নেহা মাথা নিচু করল। কি আর হবে? রাশেদকে ছেড়ে আসার শাস্তি পেয়েছে সে। আঙুল উঠিয়ে ফার্ম হাউজের দিকে ইশারা করল। রাশেদ সামান্য এগিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,” আমার বউয়ের এই অবস্থা কে করল? কোন কু*র বাচ্চার এতোবড় সাহস?”

রাশেদের গর্জন শুনে ভেতর থেকে গুলজারের শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল।

__________________
তোহা সকাল থেকে শাড়ি পরে সেজে-গুজে বসে আছে। তোহাকে সাজিয়ে দিয়েছে কথা। মুখে যতই না বলুক, তোহার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ তারই। এটা তোহাও বুঝতে পারে। অবশ্য তারই বা দোষ কি? ঘরের শত্রু বিভীষণকে কি কেউ বেশিদিন ঘরে রাখতে চায়?

জাবিদা যে পাত্র ঠিক করেছেন তাদের সকালেই আসার কথা ছিল। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। কিন্তু কেউ আসছে না। তোহা যে বিয়ে করার জন্য অপেক্ষায় কাতর ব্যাপারটা সেরকম না। গতকাল সে আমীরের সামনে এতো জোর দিয়ে বিয়ের কথা বলেছিল, এখন নিষেধ করলে ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায়। সবাই ভাববে তার মতের কোনো দাম নেই। এজন্যই চুপচাপ শাড়ি পরে বসে থাকা। ছেলে আসুক, তাকে দেখুক, তারপর চলে যাক। তোহা বলে দিবে ছেলেকে তার পছন্দ হয়নি। তাহলেই হলো। সহজ সমাধান।

কিন্তু দাবার চাল এভাবে উল্টে যাবে তা কে জানতো? বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। তাও পাত্রপক্ষের আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। ফোন পর্যন্ত তারা ধরছে না। তোহা খুবই অপমানবোধ করছে। এভাবে আসবে বলে অপেক্ষা করানোর মানে কি? যদি উদ্দেশ্যই হয় না আসা?

” ছেলে নাকি আমাকে খুব পছন্দ করেছে? তাহলে এখন ফোন ধরে না কেন ফুপু? তুমি সত্যি কথা বলো, আদৌ কি আমাকে পছন্দ করেছে নাকি বানিয়ে বলেছো?”

জাবিদা মলিন দৃষ্টিতে তাকাল। মলিন কণ্ঠে জবাব দিল,” বানিয়ে বলবো কেন? কি আশ্চর্য! তোর মতো মেয়েকে পছন্দ করবে না এমন ছেলে ইটালিতে নেই। অবশ্যই ছেলে তোকে খুব পছন্দ করেছে। তোর ছবি দেখেই পাগল হয়ে গেছিল।”

” যদি তাই হয় তাহলে আসছে না কেন? ফোন কেন ধরছে না?”

” নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে। দাঁড়া দেখি না, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে…”

” সকাল থেকে শাড়ি পরে বসে আছি ফুপু। এখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। আর কত অপেক্ষা করব? আমি পারব না। শাড়ি খুলে ফেলছি।”

জাবিদা বাঁধা দিল না। সে নিজেও এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে ছেলে আসবে না। যতই আধুনিক দেশে থাকুক, বাঙালি মানসিকতা বদলায় না। সে হলো ফ্যামিলি টাইপ বাঙালি ছেলে। হয়তো বাবা-মাকে রাজি করাতেই পারেনি। একটা অনাথ মেয়েকে বাড়ির বউ করতে চাইবে এমন মহান পরিবার বিরল। তোহার সামনে এই কথাটা জাবিদা বলতে পারছে না। ছেলে প্রথমে তোহার ছবি দেখে পাগল হয়েছিল, কিন্তু তার নিজের ইচ্ছাই তো সব নয়৷ তার ফ্যামিলিও আছে। তারা রাজি না হলে সম্বন্ধ আর কিভাবে এগোবে?

তোহা গুণগুণ করতে করতে শাড়ি বদলে স্কার্ট আর টপ পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিশ্চিন্তে চুল আঁচড়াচ্ছে। ছেলেপক্ষ আসা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। জাবিদার কান্না পেল হঠাৎ। আহারে, এই মেয়েটার কি হবে? পৃথিবীতে এমন মহামানব কোথায় পাওয়া যাবে যে অনাথ মেয়েটিকে সারাজীবন নিজের কাছে আগলে রাখবে? ভালোবাসবে? বিয়ের পর সব মেয়েদের দু’টো বাড়ি হয়। তোহার বাড়ি হবে একটাই। স্বামীর বাড়ি। সেই স্বামীই যদি তোহাকে ভালো না বাসে তাহলে মেয়েটা কি নিয়ে বাঁচবে? রাগ করে বাপের বাড়ি যাওয়ার অবস্থাও তার নেই। দুনিয়ায় এতো নিঃসঙ্গ কেউ হয়? এসব কথা ভাবতে গেলেও জাবিদার মাথা ব্যথা করে। ভীষণ কান্না পায়। সে উঠে তোহার ঘর থেকে চলে গেল।

তোহা বাগানের পাশে হাঁটতে বের হয়েছে। ছেলেপক্ষ তো আসেনি। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমীরকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। আমীর যেন জানে, ছেলেরা এসেছিল। বিয়ের কথাও পাকাপাকি হয়ে গেছে। তাই হাতের ইশারায় আজাদকে ডাকল সে। বাগানে এলোমেলো ভাবে পায়চারী করছিল আজাদ। তোহার ডাকে সাড়া দিয়ে অল্প হাসল সে। তোহা বলল,” আজাদ সাহেব, এদিকে আসুন।”

আজাদ যেন সামান্য ভড়কে গেল। সে তোহাকে একটু-আধটু ভয় পেতে শুরু করেছে। এই ব্যাপারটা তোহার বেশ ভালো লাগছে। দুইহাত পেছনে গুটিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে এলো আজাদ। ইতস্তত কণ্ঠে বলল,” কেমন আছেন ম্যাডাম?”

” ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

” জ্বী, আমিও ভালো।”

” মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে ভালো নেই।”

” জ্বী ম্যাডাম?” আজাদ চমকে তাকাল। তোহা হেসে বলল,” কিছু না। মজা করলাম আপনার সাথে। শুনুন, একটা জরুরী কাজ আছে আপনার।”

” আবার কি জরুরী কাজ?” আজাদের চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠল। তোহা বলল,” ভয় নেই। আজকে লাফ দেওয়ার কথা বলব না। আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা ছিল সেটা নিশ্চয়ই জানেন!”

” জ্বী ম্যাডাম।” আজাদ মাথা নাড়ল।

” আপনার বসও ব্যাপারটা জানে, তাই না?”

” জ্বী।”

” আপনার তো কাজই এখানের সব খবর ওখানে ট্রান্সফার করা।”

আজাদা মাথা নিচু করল। তোহা ঝুঁকে এসে জানতে চাইল,” আচ্ছা, আমি কাশি দিলেও কি সেদিকে খবর যায়?”

আজাদ এবারও মাথা নাড়ল। তোহার সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়ও আমীরকে জানাতে হয়৷ তোহা মৃদু হেসে প্রশ্ন করল,” আর কি খবর যায় শুনি?”

” সব ধরণের খবর।”

” কিন্তু এই খবরটা যাবে না।”

” কোন খবর ম্যাডাম?” আজাদ একটু শঙ্কিত হলো। আমীরের কাছে খবর গোপন করা কোনো সহজ কাজ নয়। ব্যাপারটা আমীর জানলে তার লাইফ রিস্ক হতে পারে। এদিকে তোহাকেও রাগানো ঠিক হবে না। আজাদ আছে মহা বিপদে! কি যে করবে!

তোহা ফিসফিসিয়ে বলল,” আমাকে যে পাত্রপক্ষ দেখতে আসেনি এটা যেন আপনাদের স্যার জানতে না পারে। তিনি জানবেন পাত্রপক্ষ এসেছিল। আমাকে খুব পছন্দও করে গেছে। আমার বিয়ে একেবারে ফাইনাল। মনে থাকবে?”

আজাদ কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেই হেসে উঠল। তোহা ভ্রু কুচকালো। ধমকের স্বরে বলল,” হাসছেন কেন আজব!”

আজাদ হাসতে হাসতেই বলল,” এসব স্যারকে বলে লাভ নেই। স্যার আগে থেকেই সব জানেন।”

” আগে থেকে কিভাবে জানল? আপনি জানিয়েছেন নিশ্চয়ই! ”

” না ম্যাডাম। কি যে হচ্ছে সেই সম্পর্কে আপনার ধারণাই নেই।”

তোহা চোখ বড় করে তাকাল। প্রায় অগ্নিদৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” কি হচ্ছে? আমাকে সব বলুন নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”

আজাদ খানিক বিব্রত হয়ে বলল,” একবার ভাবুন তো ম্যাডাম, পাত্রপক্ষ কেন আসলো না?”

” কেন আসলো না সেটা আমি কিভাবে বলবো? আমি নিজেও তো জানি না।”

” কারণ স্যার নিষেধ করেছেন। এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যেন কোনো পাত্র এই বাড়ির ত্রিসীমানাতেও ঢুকতে না পারে।”

বিস্ময়ে তোহার মুখ হাঁ হয়ে গেল। বড় করে শ্বাস নিয়ে সে উচ্চারণ করল,” মানে?”

” জ্বী ম্যাডাম। আপনার বিয়ে হয়ে যাবে আর স্যার চেয়ে চেয়ে দেখবেন এটা আপনি কি করে ভাবলেন? আমাদের স্যার এতোটা কাঁচা খিলাড়িও না.. ”

” শাট আপ, আর একটা কথা বললে আপনার গলা টিপে দিবো আমি।”

আজাদ দ্রুত চুপ মেরে গেল। তোহা রাগান্বিত হওয়ার ভাণ ধরে সেখান থেকে চলে এলো। কিন্তু মনে মনে সে হাওয়ায় উড়ছে। তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছে। আচ্ছা, মানুষটা এমন কেন? এতোকিছু না করে নিজের মুখে এসে একবার বললেই তো হয়। এতো ইগো কিসের?

খুশিতে দিশাহীন হয়ে তোহা দৌড়ে ঘরে যেতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তে মাহমুদ সাহেব সামনে চলে এলেন। তাঁর সাথে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে উল্টে পড়ে গেল তোহা। মাহমুদ সাহেব উত্তপ্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। তাঁকে ভীষণ বিরক্ত দেখালো। তাঁর হাতে যে মলাট বদ্ধ বইগুলো ছিল সেগুলো নিচে পড়ে গেছে। তোহা সব বই গুছিয়ে তুলে দিতে দিতে বলল,” স্যরি ফুপা।”

মাহমুদ সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। তিনি চলে যেতে লাগলেই তোহা পেছন থেকে ডেকে বলল,” আমাকে আপনি এতো অপছন্দ কেন করেন?”

মাহমুদ সাহেব হিমশীতল কণ্ঠে উত্তর দিলেন,” সেই সত্যি তোমার না জানাই ভালো। একটা কথা মনে রেখো, পৃথিবীতে সবাইকে পছন্দ করা যায় না। সে যত ভালো মানুষই হোক।”

চলবে