#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_২২
#সারিকা_হোসাইন
______
নির্ঘুম এক লম্বা রাত কোনো মতে এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই ফজরের নামাজ শেষ করে জগিং এ বের হয়েছে রায়াফ।আজকাল তার কিছুই ভালো লাগছে না।দুশ্চিন্তা আর হতাশা চারদিক থেকে যেনো তাকে গ্রাস করতে চাইছে।চোখ বন্ধ করলেই বিভৎস কিছু পুরোনো স্মৃতি করুন ভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।সারাক্ষন বিভীষিকাময় ভয়ঙ্কর স্মৃতি গুলো তাড়া করে বেড়ায়।বেঁচে থেকেও যেনো সে মৃত আজ ।
নির্জন পার্ক টাতে একের পর এক চক্কর কেটে যাচ্ছে রায়াফ।চতুরপাশের জিনিস নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই।সে নিজেকে নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে কঠিন ভাবে ।কতো সময় ধরে সে এভাবে দৌড়ে চলেছে তা নিজেও ঠাহর করতে পারছে না।চেয়েও যেনো পায়ের গতি রোধ করা যাচ্ছে না এমন অবস্থা।
হঠাৎই চিকন মিষ্টি মেয়েলি স্বরে পায়ের গতি শ্লথ হলো তার।ধীরে ধীরে রাস্তার পাশের বেঞ্চি টার কাছে গিয়ে শক্ত অবস্থানে দাঁড়ালো রায়াফ।পিছন ফিরে শ্যাম বর্ণের মায়াবী মুখশ্রী দেখে নিমিষেই সকল দুশ্চিন্তা মস্তিষ্ক থেকে দৌঁড়ে পালালো।
এতোক্ষন কোনো কিছু টের না পেলেও অসহ্য গরমে শরীরে জ্বালা ধরে গেলো মুহূর্তে।মাথার চুল নিংড়ে চিকচিকে মোটা দানার ঘাম চিবুক বেয়ে নেমে গ্রীবা দেশে বিলীন হচ্ছে।পানি পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠলো।
রায়াফের এমন অদ্ভুত অবস্থা দেখে মেয়েটি সামান্য হেসে হাতে থাকা ওয়াটার বোতল এগিয়ে দিলো
“এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো কেউ দৌড়ায়?দেখেছেন সূর্যের তেজ কতো?”
কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েটির থেকে পানির বোতল নিয়ে ছোট করে থ্যাঙ্কস জানালো রায়াফ।এরপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো সকাল বেলা যারা জগিংয়ে এসেছিলো তাদের কেউ নেই এখন আর।হাতের স্মার্ট ওয়াচ এর দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হলো।
“আসলে চারপাশে খেয়াল না করেই আপন ভাবনায় দৌড়ে যাচ্ছি,বুঝতেই পারিনি এতোটা বেলা হয়ে গেছে।তা আপনি এই সময়ে এখানে কি করে?
নিচু কন্ঠে এনিকে প্রশ্ন টি করে বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি গিলতে লাগলো রায়াফ।
এনি স্মিত হেসে বললো
“আপনার জন্য আসতে হলো মিস্টার।
“আমার জন্য মানে?
ভ্রু কুঞ্চন করে অবাকের স্বরে কথা টা শুধালো রায়াফ।
এনি আঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে উঠলো
“ঐযে তিন তলা সিরামিক ইটের খয়েরি রঙা বিল্ডিং টা দেখছেন ওটা আমাদের বাড়ি।দুতলায় জানালা বরাবর যেই রুমটা দেখতে পাচ্ছেন ওইটা আমার বেডরুম।যখন আমি ডিউটি থেকে ফিরেছি তখন থেকে আপনাকে ফলো করে যাচ্ছি।তিন ঘন্টা ধরে আপনি বিরামহীন হেটে চলেছেন।”
এনির কথায় সামান্য লজ্জিত হলো রায়াফ।এমন ভাবেই দুশ্চিন্তায় মশগুল হয়ে ছিলো যে সে তিন ঘন্টা ধরে একই জায়গায় হেটে চলেছে!
“ইশ না জানি মেয়েটা আমাকে বেক্কল ভাবছে।
রায়াফ পানির বোতল ফিরিয়ে দিতে হাত বাড়িয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো
“আহ আব আসলে হয়েছি কি….”
রায়াফকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এনি বলে উঠলো
“দুশ্চিন্তা কখনোই কোনো কিছুর সমাধান করতে পারেনা।তাই আমি বলবো আজেবাজে চিন্তা না করে মনের জমানো কথা গুলো কাউকে শেয়ার করুন”
“আমার মনের কথা কাউকে শেয়ার করার মতো নয় মিস এনি”
আহত স্বরে কথাটি বলে আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না রায়াফ।
রায়াফের মাথা নিচু করে হনহন করে হেটে যাবার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এনি।
“মানুষটা খুবই নরম মনের।আর নরম হৃদয়ের মানুষের কষ্টই সবচেয়ে বেশি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে।
________
কোমরে একটা সাদা টাওয়েল জড়িয়ে খোশ মেজাজে সিগারেট ফুকে চলেছে যুবরাজ।তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবেই লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে এসেছে।ভালো করে না মোছার কারনে চুলের আগা গড়িয়ে টুপ টুপ করে জল ঝরে পড়ছে।সেদিকে অবশ্য তার কোনো ধ্যান নেই।তার ধ্যান জ্ঞান সব সামনে মেলে ধরা একটা স্থির চিত্রের উপর।নিজের ফোনের স্ক্রিনে রাজ্যের আবেদন ময়ী একটা ছবি বের করে বার বার চুমু খাচ্ছে আর হো হো করে হেসে উঠছে সে থেকে থেকে।চুমু খাওয়া শেষ হতেই ফোনটা সেন্টার টেবিলের উপর রাখলো।
“দাঁড়াও জানেমান নেংটু ঢেকে নেই”
শীষ বাজাতে বাজাতে দ্রুত হাতে একটা হাফপ্যান্ট পরে নিলো যুবরাজ।এরপর সেকেন্ড না গড়াতেই আবার ফোনের লক খুলে ছবিটি বের করে চুমু খেলো।
সদর দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন অদ্ভুত মেজাজ বিগড়ানো ঘটনা পুরোটাই পাক্কা দশ মিনিট ধরে দেখে চলেছে রায়াফ।শেষে বিরক্ত হয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে নিজের গায়ের জগিং ড্রেস খুলতে খুলতে শুধালো
“আজ কাল নেশা পানি বেশি করছিস নাকি?নাকি মেন্টালি সিক হয়ে গেছিস?
রায়াফের তিরস্কার কানে তুললো না যুবরাজ।কারন সবাই জানে সে নির্লজ্জ্ব আর বেহায়া।রায়াফের কথাকে পাত্তা না দিয়ে আরো বার দুয়েক চুমু খেয়ে ফোনটা রেখে স্থির হয়ে বসলো যুবরাজ।
আজকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির দিন।এমন খুশি কি চাইলেই হওয়া যায় নাকি?আজ তো তার জন্য ঈদের দিন।
এস ট্রে তে সিগারেট এর ফিল্টার ঠেসে ধরে নায়কীয় ভঙ্গিমায় সামনের এলোমেলো চুল গুলো ব্যাক ব্রাশ এর মত করে ঠেলে পিছনে সরালো।এরপর টেবিলে থাকা জুসের গ্লাস তুলে আয়েশী ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে ছোট চুমুক দিয়ে রায়াফের দিকে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো।
ফ্রেস হবার জন্য উঠতে উঠতে রায়াফ শুধালো
“এ কোন অসভ্যতামি?
যুবরাজ গ্লাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আদর মাখা কন্ঠে বলে উঠলো
“আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো ব্যটা?ঈদের দিনে কেউ রাগ করে?
“আজকে ঈদ?
ওয়াশরুমের দরজায় পা রেখে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে যুবরাজের পানে দৃষ্টি পাতলো রায়াফ।
“হ্যা আজকে তো ঈদই।তুই জানিস না?
বিশাল কনফিডেন্স এর সহিত প্রশ্ন খানা ছুড়ে মারলো যুবরাজ।
শাওয়ার এর নব ঘুরাতে ঘুরাতে রায়াফ বলে উঠলো
“মেয়াদ উত্তীর্ণ গাজা কখন সেবন করেছিস তুই যুবরাজ?
“গাজা নয়রে বন্ধু গাজা নয়।বেহেশতী শরাব”
যুবরাজের মুখের উপর ধড়াস করে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে শাওয়ার এর শীতল জল রাশির নীচে গিয়ে চোখ বুঝে দাঁড়ালো রায়াফ।এই মুহূর্তে যুবরাজের হেঁয়ালি পনা একদম ভালো লাগছে না তার।
“যেখানে সেকেন্ডে সেকেন্ডে জীবনের রঙ বদলে যাচ্ছে সেখানে কিসের এতো আনন্দ উল্লাস?”
________
রান্না ঘরে আনমনে পায়েসের পাতিলে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছেন মিসেস তনুজা।আজ তার কিছুই রান্না করতে ইচ্ছে করছে না।মাঝে মাঝে এই জীবন তার কাছে বিষাদ ঠেকে।মনে হয় সংসার ছেড়ে দূরে কোনো নির্জন একাকী জায়গায় চলে যেতে পারলে হয়তো মনের ভেতর এর আগ্নেয়গিরির লাভার মতো দগদগে আগুন টাকে নেভানো যেতো।
“কিন্তু স্বামী ,সন্তান ,সংসার ফেলে কোথায় যাবো আমি?
আর ভাবতে পারেন না তনুজা।হঠাৎই নেত্র বেয়ে অঝোর ধারায় জলের ফোয়ারা ঝরতে থাকে।চুলাটা কোনো মতে বন্ধ করে কেবিনেটে হেলান দিয়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন তনুজা।নিজের নাড়ি ছেড়া ধন আদরের ছেলের মায়াবী মুখ খানা চোখে ভাসতেই বুক চাপড়ে হাই হুতাশ করে ডুকরে উঠেন তিনি।
“আমার বাচ্চা”!ওরে আমার বাবা রে!
“আমার বাচ্চাটার কি দোষ ছিলো রে আল্লাহ?কেউ কেনো আমার এতো সুন্দর বাচ্চাটাকে মেরে দিলো?আমার সহজ সরল ছোট বাচ্চাটা।হায়রে মাবুদ এই নিষ্ঠুরতা তুমি কিভাবে মেনে নিলে?সন্তানের লাশটা দেখার নসিব পর্যন্ত করলে না?
ধীরে ধীরে তনুজার কান্নার দমক ভারী হয়ে এলো।বুকের ব্যথাটা কঠিন ভাবে যন্ত্রনা দিতে লাগলো।সারা দুনিয়া ঘুরে উঠলো।মনে হচ্ছে এখনই হয়তো প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে ওই দূর গগনে ডানা মেলে উড়াল দেবে।সারা শরীর অসাড় হয়ে দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে এলো।
রেজোয়ান চৌধুরী কেবলই বাজার সেরে বাসায় ফিরছেন।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বার বার কলিং বেল টিপে যাচ্ছেন কিন্তু কেউ দরজা খুলছেন না।এবার ভদ্রলোক বেশ চিন্তিত হলেন।
“নিশ্চয়ই তনুজা ঘরের এক কোনে বসে কাঁদছে।ছেলেটার জন্মদিন এলেই তনুজা এমন করে।এসব দেখার জন্য আর কতকাল বাঁচিয়ে রাখবে খোদা?
এদিকে বার বার কলিং বেলের শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে রাজ্যের।সামান্য জাগ্রত হয়ে ভাবতে লাগে
“কেউ দরজা খুলছে না কেনো?বাসায় কি কেউ নেই নাকি?
হঠাৎই তার বালিশের নীচে ফোন খানা ভো ভো শব্দে কাঁপতে থাকে।
তড়িৎ গতিতে ফোন বের করে স্ক্রিনে” বাবা” লিখা দেখে বেশ অবাক হয় রাজ্য।
ফোন কেটে যাবার আগেই ঝটপট ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই রেজোয়ান চৌধুরীর বিচলিত কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়।
“তাড়াতাড়ি দরজা টা খুলো।তোমার মা মনে হয় আজকেও কাঁদছে”
হঠাৎ ঘুম থেকে উঠার কারনে রাজ্যের ভোঁতা মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকলো না।তবুও তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দরজা খুলে অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
“সরে দাঁড়াও আমার সামনে থেকে”
কথা খানা বলে রাজ্যকে ঠেলে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলেন রেজোয়ান চৌধুরী।
এরপর চিন্তিত স্বরে ডেকে উঠলেন
“তনুজা”
বেশ কয়েকবার ডেকেও তনুজার হদিস পাওয়া গেলো না।পায়েসের গন্ধে পুরো লিভিং রুম মম করছে।গন্ধেই বলে দিচ্ছে কেবল রান্নাটা হয়েছে। চৌকস রাজ্য দৌড়ে কিচেনে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখতে পায় কেবিনেটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে পরে আছেন তিনি।
সাথে সাথেই রাজ্য চিৎকার করে উঠে
“মা!
*********
যুবরাজকে সাথে নিয়ে আজকে রায়াফের হসপিটালের যাবার কথা মানথলি চেকআপের জন্য।কিছুদিন ধরেই হুটহাট কাশি হচ্ছে সাথে বুকে ব্যাথা।লাঙস এর চেকআপ করাটা বেশ জরুরি।
যুবরাজ আগেভাগে তৈরি হয়ে রায়াফ কে তাগাদা দিলো।
‘তাড়াতাড়ি কর।ওই রাস্তাটায় একটু বেলা হলেই জ্যাম লেগে যায়।গরম আমার একদম সহ্য হয়না এটা তুই ভালো করেই জানিস।
কথা গুলো বলে যুবরাজ চলে যেতেই দ্রুত হাতে নিজের কাপড় চোপর পাল্টে নিলো রায়াফ।আজকে সকাল থেকেই তার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্চে।বেহুদা ভয় মনে বাসা বেঁধেছে।হৃদপিন্ড টা ধড়াস ধড়াস করে লাফিয়ে চলেছে সারাটাখন।
কিছুক্ষন পরেই কোনো রকম তৈরি হয়ে পার্কিং লটে যাবার উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুতে নিলেই আচমকা ফুলের টবের হোঁচট খেয়ে নখ উল্টে ফেললো রায়াফ।কাঁচা নখ ভেঙে তরতাজা লাল রক্ত বেরিয়ে এলো।ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে মেঝেতে বসে পড়লো সে।অজানা আতংকে না চাইতেও চোখ থেকে টসটসে অশ্রু দানা ঝরে পড়লো পায়ের উপর।
**********
গাড়ির স্টিয়ারিং এর উপর হাত রেখে উপুড় হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে যুবরাজ।পনেরো মিনিট ধরে জ্যমের মধ্যে পড়ে আছে তারা।আর সূর্যের ভালোবাসা দেখলে তো খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।নিজের সবটুকু উত্তাপ সযত্নে বিলিয়ে দিয়েছে ধরণীর মানুষের জন্য।
যুবরাজের পাশে বসে চারপাশে অস্থির দৃষ্টি বুলাচ্ছে রায়াফ।গরমে আর এসির গন্ধে তার পেট গুলিয়ে উঠছে বারবার।হঠাৎই পাশের কালো রঙের একটা প্রাইভেট কারে রাজ্যকে অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো রায়াফ।
যুবরাজকে কিছু বলতে যাবে ওমনি জ্যাম ছুটে গেলো।
জ্যাম ছুটাতে আরো উদ্বিগ্নতা বাড়ল রায়াফের।
“কালো রঙের ল্যান্ড ক্রুইজার টাকে ফলো কর।”
কথাটা বলেই নিজের কপালের দুই পাশে আঙ্গুল দিয়ে সমানে স্লাইড করতে লাগলো রায়াফ!
“গাড়ি ফলো করতে যাবো কোন দুঃখে?যাচ্ছি তোর চেকআপ করাতে”
ভাবলেশহীন ভাবে কথাটা বলে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো যুবরাজ।
“গাড়িতে রাজ্যকে বিচলিত লাগলো।কোথায় যাচ্ছে দেখা দরকার”
“আমার বউকে দেখেছিস আগে বলবি না?
স্কেলেটরে পা চেপে হুড়হুর করে স্পিড বাড়ালো যুবরাজ।সকল গাড়ি ছাড়িয়ে কালো রঙের গাড়িটির পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলো ফুল স্পিডে।
মিনিট দশেক পরেই স্কয়ার হসপিটালের গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো যুবরাজের গাড়ি।
যুবরাজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হসপিটালের ভেতর দৌড়ে ছুটে চললো রায়াফ।
ওয়ার্ড বয় এর সহায়তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে তোলা হচ্চে তনুজা চৌধুরী কে।
হঠাৎই সেখানে উদ্ভ্রান্তের মতো উপস্থিত হয় রায়াফ।সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে প্রশ্ন করে বসে
“উনার কি হয়েছে?
অপরিচিত আগন্তুক এর মাঝে পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে কেঁপে উঠেন বৃদ্ধ রেজোয়ান চৌধুরী ।
নিজের মাকে কোনো মতে স্ট্রেচারে তুলে দিয়ে রায়াফের দিকে গভীর অসহায় নেত্রে অপলক তাকিয়ে রয় রাজ্য।
#চলবে
#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_২৩
#সারিকা_হোসাইন
——
রায়াফের দিকে বিস্ময়ের ভাবে অশ্রু সিক্ত নয়নে পলক হীন তাকিয়ে আছে রাজ্য।এই অপরিচিত ব্যাক্তির কন্ঠস্বর হুবুহু তার দাদা ভাই এর মতো।শুধু তাই নয় শরীরের গড়ন থেকে শুরু করে উচ্চতা পর্যন্ত কাট কাট।তাহলে চেহারা টা কেনো আলাদা?
নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না রাজ্য।আহত কন্ঠে রায়াফের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“আমি কি আপনাকে একবার দাদা ভাই বলে ডাকতে পারি?
এই প্রশ্নের জবাব কি দেবে রায়াফ মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলো।তার দুই চোখ জলে ছলছল।জোর করে অশ্রু কণা দের আটকে রাখার কারনে চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে উঠেছে।।
রায়াফের উত্তরের আশা না করেই রাজ্য সিক্ত কন্ঠে ডেকে উঠলো
“দাদা ভাই”!
রাজ্যের করুন স্বরের দাদা ভাই কথাটা রায়াফকে পুরোটাই নাড়িয়ে দিলো ভেতর থেকে।বুক ভেঙে জলোচ্ছাস এর মতো ফুলে ফেঁপে উঠলো অশ্রু ফোয়ারা।সেটাকে কঠিন ভাবে নিপীড়ন রোধ করে শক্ত চোখে রাজ্যের পানে দৃষ্টি দিলো রায়াফ।
নিজের চোখের গড়িয়ে পড়া জল দুই হাতের উল্টো পিঠে দ্রুত মুছে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো রাজ্য।
“আম সরি,আসলে আপনাকে দেখে আমি বেশি আবেগী হয়ে পড়েছি।কিছু মনে করবেন না প্লিজ”
রায়াফ কোনো প্রতিত্তর না করে আহত দৃষ্টিতে শুধু রাজ্যের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে রাজ্যের অবলীলায় বলা কথা গুলো শুনে যাচ্ছে।এই মেয়েটিকে এমন বিধস্ত অবস্থায় দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছে।সব কিছু সহ্যের বাইরে লাগছে।দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে রায়াফ হাঁসফাঁস করতে লাগলো।
“হসপিটালের ভেতরে কি হচ্ছে একবার জানা দরকার।হঠাৎই হসপিটালে আসার মতো কি এমন ঘটলো?
রায়াফকে নির্বাক দেখে রাজ্য কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠলো
আমার একটা দাদা ভাই ছিলো।হুবুহু আপনার মতো শুধু চেহারা টা ভিন্ন।বাবা শখ করে বিদেশ পড়তে পাঠিয়েছিলো কারন দাদা ভাই ডক্টর হতে চেয়েছিলো।দাদা ভাই বিদেশ গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু আমাদের কাছে আর ফিরে আসেনি।শুনেছি কেউ তাকে মে*রে ফেলেছে।কিন্তু আমরা কেউই সেই লাশটা পর্যন্ত দেখিনি।দাদা ভাইয়ের হঠাৎ মৃত্যুর খবরে মা স্ট্রোক করে বসেন।এরপর থেকে নানান শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।উনার হার্টে সমস্যা হয়েছে।ডক্টর বলেছে যেকোনো সময় হার্ট এট্যাক হয়ে উনি মারা যেতে পারেন।
কথা গুলো বলতে বলতে রাজ্যের গলা ধরে এলো।বোবা কান্না গুলো দলা পাকিয়ে কন্ঠ রোধ করার পরিস্থিতি হলো।একমাত্র ভাইকে হারিয়ে ফেলার চিনচিনে ব্যাথায় বুক ভার হয়ে উঠলো,এখন যদি এই মা টাও হারিয়ে যায় তাহলে কি আকড়ে ধরে বেঁচে থাকবে তারা বাপ মেয়ে মিলে?
নিজের ভেতরের ঠেলে আসা কান্নাকে রোধ করতে কিছুক্ষন সময় নিয়ে রাজ্য মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।এরপর খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি পিটপিট করে বুক ভরে শ্বাস নিলো।
“আজকে দাদা ভাইয়ের জন্মদিন, মা পায়েস রান্না করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন।মা আজো বিশ্বাস করেন তার ছেলে একদিন ঠিক ফিরে আসবে ।বিগত পাঁচটি বছর ধরে দাদা ভাইয়ের জন্মদিন আসলেই মা এভাবে দাদা ভাইয়ের পছন্দের খাবার রান্না করেন আর সেই খাবার সামনে মেলে ধরে কেঁদে বুক ভাসান।
রায়াফ রাজ্যের কথা গুলো শুনে একটা পাথরের স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো।অবশেষে রাজ্যকে ওখানে ফেলেই দৌড়ে ইমারজেন্সি কার্ডিও কেয়ারে চলে গেলো।রায়াফের এমন অদ্ভুত আচরণের কোনো কারন খুঁজে পেলো না রাজ্য।
যুবরাজ দূর থেকে পুরো ঘটনা অবলোকন করে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশেপাশে নজর বুলাতেই দেখতে পেলো হসপিটালের গেট দিয়ে একটি কালো রঙের মার্সিডিজ গাড়ি ঢুকছে।গাড়িটি কার এটা বুঝতে বেশি বেগ পোহাতে হলো না তাকে।নিজের এলোমেলো হওয়া চুল গুলোকে একটা ইলাস্টিকের সহিত খোঁপা স্টাইলে বেঁধে মুখে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পদে শেরহামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
আকস্মিক যুবরাজকে এই হাসপাতালে দেখে রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো শেরহামের।দুই হাত মুষ্টি বদ্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
“ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে নিজ ইচ্ছেয় আত্মাহুতি দিতে চাইছিস নাকি?
প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে ভাবলেশ হীন ভঙ্গিতে যুবরাজ শ্লেষত্বক হাসলো।এরপর শেরহামের বুকের উপরে শার্টের খোলা বাটন টা লাগিয়ে দিয়ে বুকে চাপড় দিলো।
“কে বলেছে তুই বাঘ?তুই তো বাঘ নস তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে ভীতু অবলা প্রাণী।না হলে আমার পিছনে স্পাই লাগিয়ে ছবি তুলে সেই ছবি আমার বাবাকে পাঠিয়ে বাপ দিয়ে শাসন করতে চাস আমাকে?আমাকে কি তোর স্কুলে পড়া ছোট বাচ্চা মনে হয়?
যুবরাজের এমন তিরস্কার মুলক কথায় শেরহামের মাথার মগজে দপদপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।নিজেকে তার সদ্য খাঁচা থেকে মুক্তি প্রাপ্ত অভুক্ত সিংহ মনে হচ্ছে।তবুও যথা সম্ভব মেজাজ ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো।
“দেখ যুবরাজ এই মুহূর্তে তোর সাথে আমার কথা বলার একদম মুড নেই।আমি মিসেস তনুজা কে দেখতে এসেছি।শুনেছি তাকে এই হসপিটালে আনা হয়েছে।
শেরহামের মুখে এমন ভালো মানুষি কথায় হো হো করে হেসে উঠলো যুবরাজ।যুবরাজের হাসি দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সেরা জোকারের মুখে জোকস শুনছে সে।
“খুব হাসালি রে শেরু পিচাষ।তোর কথা গুলো ভুতের মুখে রাম নামের মতো ঠেকছে জানিস?একদম তোর ফর্মের সাথে যাচ্ছে না।
যুবরাজকে আর একমুহূর্ত ও সহ্য করতে পারছে না শেরহাম।মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো শেরহাম।
“আজ রাতেই তোকে আমি আমার শেষ রূপটা দেখাবো বাস্টার্ড”
শেরহামের মুখভঙ্গি দেখে ঠোঁট টিপে ঘোর লাগা চোখে হেসে উঠলো যুবরাজ।
“মিসেস তনুজাকে বলে দেবো নাকি তুই যে তার ছেলেকে বিভৎস ভাবে খু*ন করেছিলিস?
এবার যেন শেরহামের ক্রোধ মাত্রা ছাড়লো।চারপাশের পরিবেশ খেয়াল না করেই নাক ফুলিয়ে চোখ লাল করে শক্ত মুষ্টিতে যুবরাজের দিকে এক ঘুষি বসিয়ে দিতে উদ্দত হলো।
যুবরাজের উদ্দেশ্য যেনো সফল হলো।শেরহাম কে চূড়ান্ত রাগাতে এক পাশে সরে গিয়ে শীষ বাজাতে বাজাতে নিজের গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শেরহাম কে চোখ টিপে স্কেলেটর চেপে সাই সাই করে ছুটে চললো।
“তোর চোখ আমি উপড়ে ফেলবো যুবরাজ”
কথাটি বলে শেরহাম গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যুবরাজের পিছন পিছন ছুটে চললো।
সকল গাড়ি ছাড়িয়ে দুটো ব্র্যান্ডেড গাড়ি সাই সাই করে ছুটে চলেছে রাস্তার পর রাস্তা।না মানছে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল না মানছে জ্যাম।
সব কিছু পাড়ি দিয়ে শহর থেকে বেশ খানিক দূরের জঙ্গল ঘেরা পরিত্যক্ত একটা বল্ডিংয়ের সামনে এসে থামলো যুবরাজ।রাতের বেলা তো দূর দিনের বেলাতেও কেউ এখানে পা মাড়াতে আসে না।
তৃপ্তির হাসি মুখে ফুটিয়ে যুবরাজ সেই ঘরের ভারী কাঠের পাল্লার আধ ভাঙা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।
দিনের বেলাতেও ঘরের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।আলো থেকে হুট করে ঘরটাতে প্রবেশ করলে নিজের শরীর টা পর্যন্ত দেখা যায় না।ঘরে প্রবেশ করেই গুনে গুনে দশ কদম এগিয়ে পকেটে থাকা লাইটার বের করে আগুন জ্বালিয়ে সামান্য অন্ধকার দূর করলো।এরপর স্যাৎস্যাতে দেয়ালে আটকে রাখা মশাল দানি থেকে মশাল তুলে নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে কবরের ন্যায় কক্ষটাকে আলোকিত করলো পুরো দমে।ধীরে ধীরে সব গুলো মশাল জালিহয়ে সিংহাসন এর মত দেখতে পুরোনো একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে একটা সিগারেট জ্বালালো যুবরাজ।সেটাতে একটা সুখ টান স
দিয়ে আয়েশে চোখ বুঝে চেয়ারে হেলান দিলো।কক্ষ আলোকিত হতেই যুবরাজের শরীরের গন্ধে নিজের শিকল সমেত ঝনঝন শব্দ তুলে হিংস্র দাঁত বের করে দৌড়ে এলো সাদা কালো মিশেলের সাইবেরিয়ান হাসকি কুকুর।এসেই যুবরাজের পায়ের কাছে প্রভু ভক্ত কুকুরের ন্যায় লকলকে জিভ বের করে সবুজ হিংস্র চোখে তাকিয়ে রইলো।কারন শিকার ছাড়া এই অন্ধকার কুঠুরিতে যুবরাজ কখনো আসেনি।আর মানুষের মাংস এই প্রাণীটির অত্যাধিক পছন্দের।
মিনিট পাঁচেক পরে গাড়ির শব্দে সব গুলো দাঁত বের করে প্রশস্ত হাসলো যুবরাজ সাথে নেকড়ের ভয়ংকর আওয়াজে উ উ শব্দে ডেকে উঠলো কুকুরটি ।আয়েশী ভঙ্গিতে বার বার সিগারেট ফুকে সেগুলোর ধোয়া ঘরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে উটকো গন্ধে পুরো কক্ষ আলোড়িত করে ফেললো যুবরাজ।কীয়তখন বাদেই অকেজো আধ ভাঙা দরজার ঘরঘর শব্দ পাওয়া গেলো।তবুও যুবরাজের কোনো নড়াচড়া পরিলক্ষিত হলো না।কুকুরটি বারবার দাঁত খিঁচিয়ে গড়গড় শব্দ করছে শুধু।তার যেনো আর তর সইছে না।গত তিনদিনের অভুক্ত কিনা!
কক্ষে কারো উপস্থিতি টের পেতেই যুবরাজ বিশ্রী শব্দে হাসলো সেই সাথে চার পায়ে উঠে দাঁড়ালো সাইবেরিয়ান হাসকি।সেই হাসির শব্দ বিকট ভাবে প্রতিটা দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আরো ভয়ংকর সুর তুললো।হাসি শেষ হতেই বাদামি মনি যুক্ত চোখে দৃষ্টি মেলে এক পা চেয়ারের গদিতে তুলে আরেক পা লম্বা ভাবে মেলে দিয়ে হাঁটুতে হাতের ভর দিয়ে গালে হাত রাখল যুবরাজ।কুকুর আর যুবরাজ দুজন দুজনের দিকে ক্রুর দৃষ্টি মেললো।
“ওয়েলকাম,ওয়েলকাম ডিয়ার ব্রাদার শেরহাম।ওয়েলকাম টু মাই হেল এন্ড অলসো #ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড।
#চলবে
#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_২৪
#সারিকা_হোসাইন
———
বিশাল ঘন জঙ্গলের বড় বড় গজারি আর নাম না জানা উঁচু বৃক্ষের অন্ধকার পেরিয়ে একদম শেষ মাথায় সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত একটি প্রাসাদ তুল্য বাড়ি।দেখে মনে হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি।বাড়িটির খসে পড়া দালানে শেওলা আর পাহাড়ি বুনো লতায় ছেয়ে আছে।জায়গায় জায়গায় মাকড়ের বড় বড় জালের বিস্তার।মাথার উপরে থেকে থেকেই অদ্ভুত প্রাণীর ভয়ংকর ডাক শোনা যাচ্ছে।যদিও এখন প্রায় দুপুর কিন্তু মনে হচ্ছে ঘুটঘুটে সন্ধ্যা।মাঝে মাঝেই বিষাক্ত সাপের হিস হিস নিঃশ্বাসের শব্দ কর্ণ কুহরে এসে বাড়ি খাচ্ছে।কোনো সাধারন মানুষ তো দূরে থাক পৃথিবীর সর্বশেষ যেই সাহসী ব্যাক্তি অবশিষ্ট আছে সেও হয়তো এখানে পা মাড়াতে আপত্তি জানাবে।
প্রাসাদ তুল্য সেই বাড়ির বেজমেন্ট জুড়ে মানুষের পচে যাওয়া র*ক্ত আর মাংসের বিশ্রী উটকো গন্ধ।সেই গন্ধে এক সেকেন্ড টেকাও যেনো দায় হয়ে পড়েছে।কক্ষের মেঝেতে দেয়ালে কিছু কিছু রক্তের ছাপ একদম তরতাজা।দেখে মনে হচ্ছে কেবলই কোনো মানুষ বা প্রাণীর প্রাণ বধ করা হয়েছে।পুরো মেঝে জুড়ে মানুষের খাবলা খাবলা হাড় যুক্ত মাংস আর হাড় পড়ে রয়েছে।আলো বা রোদ কিছুই প্রবেশ না করার কারনে রক্ত গুলো শুকিয়ে যাবার বদলে জমাট বেঁধে পোকা জন্ম দেবার উপক্রম হয়েছে।
ভ্যাপসা গরম,স্যাৎস্যাতে পরিবেশ,অপরিচিত পোকামাকড় আর পচা গন্ধে যে কারো পেট গুলিয়ে বমি আসতে সেকেন্ড সময়ের ব্যাবধান ও লাগবে না।কিন্তু দুজন জলজ্যান্ত লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের সুদর্শন যুবক কোনো প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই দুজন দুজনের দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।ভাবখানা এমন তারা পরিস্কার তকতকে সুন্দর রণ ভূমিতে যুদ্ধের ঘোষণা করছে।
যুবরাজের সাইবেরিয়ান হাসকি কুকুরটা লাল টকটকে লম্বা জীভ খানা বের করে গড়গড় শব্দ করতে করতে শেরহামের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরে যাচ্ছে।যুবরাজ হুকুম করা মাত্রই যেনো সে তার বিষাক্ত চোখা দাঁত গুলো জায়গা মতো বসিয়ে ছিড়ে আনবে রক্তের নালি।
সিগারেট এর শেষ টান দিয়ে যুবরাজ উঠে দাঁড়ালো।এরপর শেরহামের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হো হো শব্দ তুলে কিছুক্ষণ হেসে মুহূর্তেই মুখে কাঠিন্য ভাব আনলো।,
“হাও ডু ইউ ফিল ইন মাই হেল ব্রো?ডিড ইউ লাইক দ্যা প্লেস?টেল মি হাও ক্যান আই সার্ভ ইউ?”
এমন জঘন্য পরিস্থিতি তে যুবরাজের এমন হেয়ালিপনা দেখে শেরহামের মাথায় যন্ত্রনা ধরে গেলো।মাথার মগজে কিলবিলিয়ে উঠা ক্রোধ কে জিহবার ডগায় এনে শেরহাম যুবরাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“এতো ভাবে তোকে মাটিতে মুখ থুবড়ে আছাড় খাওয়ালাম তবুও আমার সম্পর্কে তোর জ্ঞান বোধ কিছু হয়নি নাকি?
যুবরাজ ক্রোধিত নজরে শেরহামের হাত পাকড়াও করে মুহূর্তেই জোরে টান দিয়ে শেরহামের হাত থেকে একটা লোম টেনে তুলে ফেললো নিমিষেই।সেই লোম শেরহামের চোখের সামনে তুলে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বললো
“তুই আমার একটা বা*ল ও বাঁকা করতে পারিস নি ”
যুবরাজের কথা শুনে শেরহাম প্রচন্ড অদ্ভুত হাসলো।যুবরাজের হাত থেকে সেই টেনে তোলা লোম ফু দিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে ফিক করে হেসে দিলো।
“তোর প্রেয়সী ম্যাগান কে কিভাবে মেরেছিলাম জানিস?আশা করি তার এপার্টমেন্টে গিয়ে স্বচক্ষে দেখেছিস।শালী সেই একটা জিনিস ছিলো,রাত ভর আদর দিয়েছিলাম।তোর জন্যও রাখতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আমারই মন ভরছিলো না।।এজন্য তোকে ভাগ দিতে পারিনি।সরি রে!
বলেই আরেক চোট বিশ্রী হাসলো শেরহাম।
সহসাই নিজের শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে শেরহামের মুখ বরারব এক ঘুষি বসিয়ে দিলো যুবরাজ।সেই ঘুষির শক্তিতে সামান্য দূরে ছিটকে গেলো শেরহাম।
জমাট বাঁধা রক্তে স্লিপ খেয়ে হাটু মুড়ে নোংরা মেঝেতে বসে পড়লো শেরহাম।এরপর ঠোঁটে হাত দিতেই আঙুলের সাথে তরতাজা রক্ত উঠে এলো।চোখের সামনে সেই রক্ত মেলে ধরে জিভ দিয়ে চেটে ঠোঁটের রক্ত টুকু গিলে নিলো।এরপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেশাক্ত মানুষের মতো আঙুলের রক্ত গুলো চেটে চেটে খেতে লাগলো।
“রক্ত খেতে চাস?দেবো নাকি এক গ্লাস তরতাজা উষ্ণ রক্ত?
রক্তের কথা শুনতেই চক চকে চোখে কুকুরের মতো জিভ বেরিয়ে এলো শেরহামের।সেই লোভাতুর মুখশ্রী দেখে সশব্দে হাসলো যুবরাজ।
“আমি তোকে এভাবে মা*রবো না রে শেরহাম।কারন তুই একজন অসুস্থ পাগল,তুই রোগে আক্রান্ত।তোকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তবেই আমি চূড়ান্ত শাস্তি দিয়ে তোর পাপের খেলা সাঙ্গ করবো।
যুবরাজের মুখে নিজ সম্পর্কে এমন অমূলক কথা বার্তা শুনে রাগের পারদ চটে গেলো শেরহামের।সেটা দেখে যুবরাজ যেনো বেশ মজা পেলো।
“তোকে এ পর্যন্ত কেনো এনেছি জানিস?
শেরহাম কে কোন উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই শার্টের কলার ধরে টেনে তুললো যুবরাজ।বাধ্য দাসের ন্যায় শেরহাম উঠে দাঁড়াতেই যুবরাজ বলে উঠলো
“চল তোকে কিছু ট্রেইলার দেখাই”
শেরহাম কে কলার ধরে টেনে হিচড়ে নোংরা আবর্জনা যুক্ত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলেছে যুবরাজ।সাথে কুকুরটি বিশ্বস্ত পাহারাদারের ন্যায় তাদের পিছন পিছন সতর্ক দৃষ্টিতে হেটে চলেছে।
সিঁড়ি ধরে হাটতে হাটতে হঠাৎই তারা একটা দরজার সামনে এসে দাড়ালো।দরজাটি দেখে মনে হচ্ছে কিছুদিন আগেই বেশ যত্নের সহিত বানানো হয়েছে।যেই সেই দরজা নয় একদম লোহার তৈরি ভারী পোক্ত দরজা।আর সেই দরজার সামনে ঝুলানো হয়েছে বিশাল আকারের দুটো তালা।
রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে প্যান্টের পকেটে হাতড়ে বিশাল তলার জন্য বিশাল এক চাবির চড়া বের করে আনলো যুবরাজ।এরপর সেই চাবি দিয়ে তালা খুলতেই ভেসে এলো মানুষের আত্ম চিৎকার আর বিশ্রী গন্ধ।
“আমাদের ছেড়ে দাও,মুক্তি দাও।আর সহ্য করতে পারছি না।বেঁচে থেকেও মৃত্যু যন্ত্রনা আর সহ্য হচ্ছে না””
প্লিজ গিভ আস ফ্রিডম ফ্রম দ্যা হেল”
বাংলা ইংরেজি মিশেলে বিভিন্ন নারী পুরুষের আহাজারি পূর্ন চিৎকারে কান ভারী হয়ে এলো শেরহামের।দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে জোরে চিৎকার করে উঠলো
“প্লিজ স্টপ,আই সে স্টপ য়েলিং”
কিন্তু কারাগারের ন্যায় বন্দিদশায় থাকা মানুষ গুলো চুপ করার পরিবর্তে আরো জোরে জোরে শেরহামের নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলো।সেই চিৎকারের আওয়াজে যুবরাজ হা হা শব্দ তুলে হাসতে লাগলো।হাসি থামিয়ে শক্ত হাতের থাবায় শেরহামের চুলের ঝুটি ধরে প্রত্যেকটা বন্দির কাছে নিয়ে নিয়ে যুবরাজ তাদের চেহারা দেখিয়ে বলে উঠলো
“দেখে নে ভাই ভালো করে দেখে নে।এদের সাথে নিয়েই তো আমার গুছানো জীবন টা এলোমেলো করেছিলিস তাই না?দেখ আজকে আমি দিব্যি আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্তু তোর সাগরেদ রা আমার অন্ধকার নরকে বন্দি।
কথা গুলো বলতে বলতে যুবরাজের গলা ধরে এলো।ভেসে উঠলো চোখের সামনে অতীত স্মৃতি।সেই হাস্যজল দিন,গুছানো পরিপাটি জীবন নিজের বাবার চাইতেও আপন পিতৃতুল্য ফুপা।পিছু টান হীন স্বচ্ছ ভবিষ্যত।আর নিজের পছন্দের মানুষকে ভালোবেসে সুখের সংসার বাধার তীব্র বাসনা।
অতীত ভাবতে ভাবতে জল গড়িয়ে পড়লো যুবরাজের চোখ থেকে।নিজের চোখের জল গুলোকে আঙুলের সাহায্যে মুছে যুবরাজ হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো
“আমার ফুপাকে কেনো গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ছিলিস শেরহাম ?সে আমাকে সন্তানের মতো ভালোবাসতো এটাই তার অপরাধ ছিলো তোর কাছে?তাকে খু*ন করে খুব মজা পেয়েছিলিস না?কিন্তু জানিস মায়ের মতো ফুপুকে ওই সময় আমি কিভাবে সামলে নিয়েছি?সে তো আজ পর্যন্ত জানেইনা তুই যে তার স্বামীর খু*নি!
তোকে তো আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব না রে শেরহাম।দেখ যার সাহায্যে গাড়ি চাপা দিয়ে আমার ফুপাকে মে*রে ছিলি সেও আমার নরকের অতিথি।
কথাটি বলেই শেরহাম কে সেই ট্রাক ড্রাইভার এর সামনে এনে দাঁড় করালো।
শীর্ন লোকটিকে দেখে চিনতে বেশ বেগ পেতে হলো শেরহামের।কারন একেতো কক্ষে আলো কম তার মধ্যে লোকটি দাড়ি চুলে ভুতের মতো হয়ে রয়েছে।মোটা ফর্সা লোকটির শরীরের সমস্ত জৌলুস ঢাকা পড়েছে শীর্নতায়।চোখ দুটো গর্তে ঢুকে দৃষ্টি ঘোলা হয়ে রয়েছে।দেখে মনে হচ্চে কতো দিনের অনাহারী।
শেরহাম কে দেখে লোকটি বন্দি কক্ষের গ্রিল ধরে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো
“প্লিজ সেইভ মি ফ্রম দিস ডেভিল”
ডেভিল বলার সাথে সাথেই যুবরাজ ঝটপট তালা খুলে ভেটরে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো মাঝ বয়সী লোকটাকে।
ট্রাক ড্রাইভার মাটিতে লুটিয়ে জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত মারতে থাকলো যুবরাজ।লোকটি জ্ঞান হারাতেই সজোড়ে এক লাথি বসিয়ে দিলো বুক বরাবর এরপর বাইরে বেরিয়ে আবার তালা লাগিয়ে শেরহামের সামনে এসে হাপাতে হাপাতে বলে উঠলো
“ডু ইউ লাইক মাই হেল?
*********
সাদাফ শাহীরের কক্ষের দরজার সামনে বুকে দুই হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে সামিনা।নবনীতা মৃত্যুর পর থেকেই সাদাফ শাহীর খুবই কঠিন এবং সাধারণ জীবন যাপন করেন।কারো সাথে খুব একটা মিশন না বললেই হয়।প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে ওতো মাখামাখি কথাও বলেন না।বাড়ির চাকর বাকর প্রয়োজনীয় কাজ সারার জন্য তার কক্ষে আসেন।আর মাঝে মাঝে সামিনা আসেন তার খুঁজ খবর নেবার জন্য।আজো সামিনা এসেছে।তবে খুজ খবর নিতে নয় বরং নিজের ছেলের জীবনের হিসেব চুকাতে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সামিনা মনের মধ্যে কথা গুলো গুছিয়ে নিলেন।কথা গুছাতে গিয়েই টসটসে চোখের জলে গাল ভিজে উঠলো।সেগুলো দুই হাতের করপুটে মুছে ধীর কন্ঠে সামিনা বললো
“ভাইয়া আসবো?
রাতের খাবার শেষ করে রাতের ওষুধ পত্র খেয়ে সাদাফ শাহীর সবেই শুতে যাচ্ছিলেন।আজকাল তার সব কিছুতেই বিরক্ত লাগে।একমাত্র ছেলের চিন্তায় প্রাণ হাঁসফাঁস করে।তবুও তো সে মানুষ।সন্তান হোক আর যাই হোক অপরাধের উর্ধে গিয়ে সন্তানকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।
সামিনার কন্ঠ শুনে বিছানায় উঠতে নিয়ে থেমে গেলেন সাদাফ।টেবিল ল্যাম্প এর ক্ষীণ আলোয় সামিনার কাতর মুখশ্রী স্পষ্ট।
“এতো রাতে এলি যে?জরুরি কিছু বলবি?
ধীরপায়ে সামিনা সাদাফ শাহীরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন
“নবনীতার ভাইয়ের ছেলে আমার ছেলের জীবনটা এভাবে নরক বানিয়ে দিলো আর বাবা হয়ে তুমি সেটার খুজ পর্যন্ত নিলে না?কেমন বাবা তুমি?
সামিনার এমন অদ্ভুত ভয়ংকর কথায় চমকে উঠলেন সাদাফ।
“কি বলছিস তুই এসব সামু?
“ভুল কিছুই বলিনি ভাইয়া।আমার ছেলের হৃদয়ে যেই তুষের আগুন জলছে এটার খুজ কেনো তুমি একবারো নিলেনা?অন্যের কথা শুনে তো ঠিকই বাড়ি ছাড়া করলে আমার মানিক কে।তাহলে যার জন্য আমার ছেলে নরক যন্ত্রনা ভোগ করছে তাকে কেনো কিছু করলে না?
সাদাফ শাহীর সামিনার এসব কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে না পেরে অবুঝ বালকের ন্যায় তাকিয়ে রইলেন।
ভাইয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে সামিনা একে একে সব কিছু খুলে বললেন সাদাফ শাহীর কে।
পুরো ঘটনা শুনে সাদাফ শাহীর বুক চেপে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
“আমার বুকে প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে সামিনা।তুই এসব কি শোনালি আমাকে?আমি যে আমার মাতৃ হীন ছেলের প্রতি অবিচার করে ফেলেছি রে বোন।কবে কবে আমার অবুঝ ছেলেটা এতোটা বড় হয়ে গেলো?এতো বড় ঘটনার কিচ্ছুটি জানালো না আমাদের?
ছোট শিশুর ন্যায় কেঁদে উঠলেন সাদাফ।সাথে ডুকরে কেঁদে ওঠে বুক ভিজালেন সামিনা।
বেড সাইড টেবিল হাতড়ে নিজের মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলেন যুবরাজের নম্বর।
প্রথম রিং হতেই ফোন তুললো যুবরাজ।
কান্নার দমকে কথাই বলতে পারছে না সাদাফ শাহীর।শুধু ভাঙা গলায় ডেকে উঠলেন
“আমার আব্বা”!
#চলবে