ওহে প্রিয় পর্ব-১৫+১৬

0
1913

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৫

১০.
আমাদের গ্রাম্য ভাষায় একটি বাক্য রয়েছে ‘ যার সাথে যার ভাব তাঁর পাছা দেখলেও লাভ ‘। যেমন আমি নির্মলকে কাছে পাচ্ছি না পাশে পাচ্ছি না অথচ তাঁর খুব কাছের গোপন জিনিস কে পেয়েই সুখ সুখ অনুভব করছি। বাড়ির অশান্তি কে তুচ্ছ করে রাতের খাবার খেয়ে রুমে দরজা লাগিয়ে দিলাম। বরাবরই মেজাজ আমার বেশী৷ এতো কটুবাক্য শুনে মেজাজ প্রচন্ড খিটখিটে হয়ে গেছে৷ একদিকে চাচি অন্যদিকে আব্বা মাথা আর কান ঝিম ঝিম করছে। একটা ফোন থাকলে নির্মলকে ফোন করে ওর সাথে কথা বলে মাইন্ড ফ্রেশ করা যেতো৷ কিন্তু ফোন নেই তাতে কি? ঢাকা থেকে আসার আগে চুরি কি এমনি এমনি করেছি নাকি? হ্যাঁ চুরি করেছি নির্মলের কালো মলাটের একটি ডায়েরি চুরি করেছি। এই ডায়েরিটার ওপর নজর পড়েছে বেশ কয়েক মাস ধরেই। নির্মলের কাছে জিগ্যেস করায় হন্তদন্ত হয়ে ডায়েরিটা ছিনিয়ে নিয়েছিলো। তারপর আর ডায়েরিটা দেখিনি৷ নির্ঝরের কাছে শুনেছিলাম গত দু’বছর ধরে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলেই নির্মল ডায়েরি আর কলম নিয়ে বসে। আমার ভীষণ কৌতুহল জাগে মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে এই লোক ডায়েরি নিয়ে বসে কেনো? কিই বা লিখে ডায়েরিতে? সেই কৌতুহল থেকেই নির্ঝরকে দিয়ে চুরি করাই ডায়েরিটা৷ বেশ হয়েছে যে’কদিন গ্রামে আছি বেচারা বেশ অশান্তি তে থাকবে। আর আমি অশান্তি কে ভুলবো এই ডায়িরির একেকটা পাতা মুখস্থ করে।

মানুষ টা দূরে তাতে কি তাঁর মনকথা গুলো যে এতোদূরে বসেও জানতে পারবো। কাছে থেকে যতোটা জেনেছি তাঁকে দূরে বসে বেশীই জেনে যাবো হয়তো। এর থেকে বড় পাওয়া হয় নাকি? ডায়েরির কয়েক পাতা উল্টাতেই স্পষ্ট লিখা ভেসে ওঠলো চোখদ্বয়ে। তাঁর শতশত না বলা বুলি, শুনে নিলাম। জেনে নিলাম তাঁর স্বপ্নকে, আশাকে।
___
আমার জীবনে শরৎকালে বসন্ত এনে দেওয়া নারী তুমি। প্রেম কি? ভালোবাসা কি? সেসবে জ্ঞানলাভ করতে পারি শুধুই তোমারই আগমণে। প্রেম,ভালোবাসায় সঠিক জ্ঞানলাভ যার জন্য করেছি তাঁকে ছাড়া প্রেম,ভালোবাসা হয় কি করে? যে ভালোবাসা শেখায় তাঁরই ভালোবাসাটা প্রাপ্য তাহলে বুঝোনা কেনো প্রিয়? এতো অবুঝতা কি তোমায় মানায়? তোমার ঐ ধারালো দৃষ্টি তে কতোবার খুন হওয়া যায় প্রিয় একবারও কি নিজে খুন হতে পারো না? কবে হবে তুমি আমার দৃষ্টি তে খুন? কবে ঝলসে যাবে আমার স্পর্শে তোমার সারা দেহ? এতো প্রেম এতো ভালোবাসার সমাদর কবে হবে প্রিয়?

“আমার কাছে প্রেমের সংজ্ঞা অনুভূতি। আর আমার সব অনুভূতির নামই হচ্ছে সাবা”

“তাঁর কাজল কালো দুটি চোখই হলো আমার সর্বনাশের মূল”

“সে রূপবতী কিন্তু রূপের জালে আমায় আঁটকাতে পারেনি তাঁর রূপকে তাচ্ছিল্য করলেও তাঁর গুণকে তাচ্ছিল্য করার উপায় নেই। আর মায়া কাটানোর সাহস নেই অন্তরে যে বড্ড কম্পন ধরে৷ সে যে মায়াবতী তাঁর মায়ার জালে ঠিক আমাকে আঁটকে ফেলেছে ”

“সে কি জানে না প্রেম যদি হয় অভিশাপ ভালোবাসা তবে আশীর্বাদ? তাঁকে ভালোবাসার আমন্ত্রণ জানিয়েই না প্রেম দিতে চেয়েছি তাহলে কিসের এতো দেমাগ তাঁর “?

“পাষণ্ডময়ীদের জন্য কোন এওয়ার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে ঐ নিষ্ঠুর, পাষাণ নারীকেই সেরা এওয়ার্ড টা দিতাম। পুরুষের চোখের জলেও তাঁর মন গলে না। সে কি জানে না অতিকষ্ট বিহীন পুরুষ কাঁদে না “?

আজ লিখবো ভিন্ন কিছু অনুভূতি নিয়ে। আমার পাষণ্ড কুমারীকে নিয়ে অভিযোগের ঝুলি অনেক ভারী করে ফেলেছি। এবার তাঁকে নিয়ে স্বপ্নের ঝুলি ভারী করার পালা।

“সে যখন প্রখর মনোনিবেশ করে রান্না করে তাঁর দুষ্টু চুলগুলো ভীষণ দুষ্টুমি করে। কখনো কপাল,কখনো চোখ,কখনো বা ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়৷ সে কি জানে? তাঁর কেশের চেয়েও দ্বিগুণ দুষ্টুমি করতে চাই আমি। তাঁর অবাধ্য চুলের থেকেও বেশী অবাধ্য আমি হতে চাই। সে কি খুব রেগে যাবে? রাগুক না আমিতো সেটাই চাই৷ সে খুব রেগে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। আর আমি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়িয়ে তাঁর রাগ ভাঙাবো। সে তো জানে না রোজ রোজ রান্নাঘরে তাঁর পিছু কেনো নেই। তাঁর করা প্রত্যেকটা উপকরণ যে খুব নিখুঁত ভাবে আয়ত্ত করে ফেলেছি৷ শুনেছি বউরা রেগে গেলে স্বামীদের কপালে অন্ন জুটে না। সব বউ তো আর সাবা হবে না সব স্বামীতো আর নির্মল হবে না৷ বিয়ের পর রাগিনী যখন রেগে যাবে রান্না করে খাওয়াতে হবে না? বউ আমার ভীষণ দেমাগি। সব কিছুর ঊর্ধ্বে দেমাগ তাঁর ষোল আনার এক আনাও কম না৷ আমার তো তাতে কোন সমস্যা নেই। তবুও কেনো সে বুঝেনা? এমন বর কোথায় পাবে সে? রান্নার দায়িত্ব থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব নিতেই এই নির্মল প্রস্তুত৷ সে যদি চায় তাঁর হাঁটার দায়িত্বটাও আমি নিবো। সর্বক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরবো। বউ যে বড় আদরের জিনিস। সে আমার অনেক বেশীই আদরের। খুব বেশীই প্রিয় ”
_____
ডায়েরি পড়তে পড়তে কখন যে চোখে জল এসে গেছে টেরই পায়নি আমি৷ পরের পৃষ্ঠা তে তাঁর দুঃখের কথা গুলো লিখা ছিলো। তাঁর প্রিয়র সাথে অভিমানের কথা লিখা ছিলো একটু দেখেই মন খারাপ হয়ে গেলো তাই আর পড়লাম না৷
আলতো হেসে বুকের বা পাশে এক হাত চেপে ধরে ডায়েরিটা পাশে রেখেই চোখ বুজে ফেললাম।
১১.
সকাল হতে না হতেই আব্বার চিল্লাচিল্লি তে ঘুম ভেঙে গেলো। দরজা খুলতেই ক্ষিপ্ত হয়ে রুমে ঢুকেই আমার চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে বিশ্রি গালিগালাজ করতে থাকলো। কারণ আমি পড়াশোনার নাম করে শহড়ে গিয়ে নষ্টামি করছি। বড় চাচা আর চাচি এসবই বলেছেন আব্বাকে। বড় চাচার দুই মেয়েকে ফাইভ পাশ করতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়৷ আমার বড় বোন ভালো স্টুডেন্ট থাকা সত্ত্বেও এইট পাশ করার পর আর নাইনে ভর্তির সুযোগ পায় নি। চাচা চাচিই আব্বাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে বিয়ের বন্দবস্ত করায়। আমি নাইন থেকেই বেশ যুদ্ধ করে পড়াশোনা করছি। চাচা, চাচির মেয়েরা পড়ালেখা করতে পারেনি এটা কি আমার দোষ? তাঁরা নিজেরাই পড়াশোনা করায়নি লেখাপড়ায় খুব একটা আগ্রহও ছিলোনা ওদের তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। অথচ তাঁরা হিংসার বশিভূত হয়ে আমার বড় বোনের পড়াশোনা নষ্ট করেছে এবার আমার পড়াশোনা সহ জীবনও নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ইশু হিসেবে গতকাল রাতে আম্মাকে বলা কথাটাই বেছে নিয়েছে। এবং আব্বাকে নিয়ে পরিকল্পনা করেছে এবার আর শহড়ে যেতে দেবে না আমায়। তিনদিনের মধ্যেই বিয়ের বন্দবস্ত করবে৷ আব্বা ভালো করেই জানতো আমি ভীষণ ত্যাড়া এবং নিজের সিদ্ধান্তে সর্বদা অটল। তাই অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে পাড়ার সব পিশাচিদের। সকাল হতেই চিল্লাচিল্লি করা, আমাকে মারধর করে লোকসম্মুখে বেইজ্জতি করা সবই ছিলো বড় চাচা,চাচির পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার যথার্থ মূল্যায়ন দেয় আব্বা।

মাথা ব্যাথায় কোঁকড়াতে থাকি আমি। আব্বা টেনে হিঁচড়ে ওঠানে নিয়ে যায়। আম্মা আব্বার পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। পুরো বাড়ি শুরু করে পুরো পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে যায়। সকলের সামনে আব্বা আমাকে আর আম্মাকে নির্মমভাবে মারধর করে। দাদি ফেরাতে আসলে বড় চাচি দাদিকে আটকায়। আব্বার নির্দয়তা সহ্য করতে না পেরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আব্বাকে ধাক্কা মারি ফলে ছিটকে পড়ে মাটিতে। পাড়াসুদ্ধ মহিলারা নিজের বড় মেয়ে,শিক্ষিত মেয়ের গায়ে হাত তোলার জন্য ছিঃ ছিঃ করেনি অথচ মারতে আসলে ফেরাতে গিয়ে ধাক্কা দিতেই ছিঃ ছিঃ শুরু করে। এক মহিলা বলে,

-‘ বাবা গো বাবা কেমন মেয়ে মানুষ হায় হায় রে বাপের গায়ে হাত তুলছে দেখছো দেখছো এই জন্যই কই মেয়ে মানুষের অতো পড়াশোনা কইরা কাম নাই। একটু শিক্ষা পাইয়া এরা সাপের পাঁচ পা দেহে। বাপেরে বাপ কয় না। আগেই কইছিলাম এই মেয়ে শহড়ে থাকে ভালো কইরা খোঁজ খবর নেও না জানি কোন জায়গায় বেশ্যাগিরি কইরা বেড়ায়। নয়তো বিয়াই করবার চাবোনা কে বাপের গায়েই হাতই বা তুলবো ক্যাঁ ‘?

আমি হিংস্র হয়ে ওঠি কথাগুলো শুনে রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে তেড়ে যাই মহিলার দিকে। কিন্তু একা আমি আর মা ওদের সাথে কি করে পারবো? যেখানে আমার নিজের বাবাই ওদের পক্ষপাতিত্ব করছে? আব্বা পিছন থেকে টেনে ধরে বড় চাচার সহায়তায় টেনে হিঁচড়ে ঘরে ধাক্কা মেরে ফেলে দরজা আঁটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এবং সকলের সামনে গলা উঁচু করে বলে আমার পড়াশোনা বন্ধ এবং তিনদিনের ভিতরেই আমার বিবাহ সম্পন্ন করবে। সন্তান ভুল করলে ভুল শুধরে দেওয়াই পরিবারের উচিত। আমিও দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে গলা ফাটিয়ে বলি,

-‘ আমি বিয়ে করবো না। তোমাদের মতো জানোয়ারদের জন্য আমার নিজের জীবন আমি বলি দেবো না৷ কেমন বাবা তুমি? নিজের মেয়েকে অন্যের প্রোরোচনায় এভাবে আঘাত করতে তোমার বিবেকে বাঁধে না? পাড়ার সম্মুখে আমার সম্মান নষ্ট করতে তোমার বুক কাঁপে না? নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নিজের মেয়েকেও ব্যবহার করতে পারো তুমি ছিঃ ‘।

সকাল পেড়িয়ে রাতও কেটে যায়। পরেরদিন সকালে আম্মা তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই আম্মাকে জরিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠি৷ আম্মাও আমাকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। অনেক সময় মা মেয়ে একে অপরকে জরিয়ে বসে থাকি। প্রচন্ড খিদে পেয়েছিলো আম্মাকে বলতেই আম্মা আমাকে নিয়ে টিউবওয়েল পাড়ে নিয়ে গেলো। ব্রাশ করে হাত,মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছে বিছানায় বসতেই আম্মা এক বাটি পান্তা ভাত আর কলা মাখিয়ে খাওয়িয়ে দিলো। আর ফিসফিস করে বললো,

-‘ যে করেই হোক তোর পালাতে হবো সাবা শুক্রবার চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে তোর বিয়ে ‘।

আম্মার কথা শুনে খাবার গলায় আঁটকে গেলো আমার। দ্রুত পানি পান করে ক্রন্দনরত কন্ঠে বললাম,

-‘ আম্মা আমি অনেক বড় ভুল করেছি এখানে এসে। তুমি আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করো আম্মা ‘।

-‘ চিন্তা করিস না মা যে কইরাই হোক তোরে আমি পালাতে সাহায্য করমু ‘।

সেদিন পুরোটা কেটে যায়। সকালের পর আম্মা আর আমার কাছে আসেনা৷ ভিতর থেকেই শুনতে পারি আম্মার কাছ থেকে চাবি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিয়ের আগ পর্যন্ত আম্মা আমার সাথে দেখা করতে পারবে না। রাতের খাবার বড় চাচি দিয়ে যায়।
পাগল পাগল হয়ে যাই আমি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে অস্থিরতা বেড়ে যায়৷ মাথাটা যেনো চৌচির হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ বুকের ভিতর বাজতে থাকে আর্তনাদের উচ্চধ্বনি নির্মল, নির্মল। পালানোর উপায় কোনভাবেই হলো না৷ বাধ্য হয়ে চিঠি লিখতে বসলাম। নির্মলের কাছে শুধু আমার একটা খবর পৌঁছানোর অপেক্ষা। এই বিপদ থেকে নির্মল ছাড়া কেউ বাঁচাতে পারবে না আমায়। বড্ড আফসোস হচ্ছিলো নির্মল কতোবার বলেছিলো ‘সাবা একটা ফোন রাখো নিজের সাথে বিপদে আপদে কাজে দেবে ‘ কিন্তু আমি ওর কথা শুনিনি। আজ একটা ফোন সাথে থাকলে হয়তো এতো কষ্ট করতেই হতো না। রাত তখন নয়টা এিশ আরো আধাঘন্টা পর আমার চাচাতো ভাই সাব্বির বাড়ি ফিরবে। আমি যে ঘরে রয়েছি সে ঘরের পাশ দিয়েই প্রতিরাতে বাড়ি ফেরে সাব্বির৷ জানালা দিয়ে ওর সাথে কথা বলে সাহায্য চাওয়া যাবে। ওর কাছেও কোন ফোন নেই। যদি থাকতো এতো কষ্ট করতে হতো না। দোকান থেকে ফোন নিয়ে আসা বা সাব্বির কে নাম্বার লিখে দিলেও কাজ হতো কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে সেসব না করে সেদিন আমি চিঠি লিখে সাব্বিরকে দিয়ে পাঠিয়ে দেই নির্মলের ঠিকানায়৷ “একটি জীবন ধ্বংস হওয়ার জন্য শত ভুলের প্রয়োজন পড়ে না একটি ভুলই যথেষ্ট ” সেই একটি ভুল আমি করেছিলাম৷ কি দরকার ছিলো শেষ অবদি চেষ্টা না করে ব্যাকুল হয়ে চিঠি পাঠানোর?

চলবে…

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৬

১২.
ফজরের আজানের পূর্বমুহূর্ত ঘুম ভেঙে গেলো আমার। এমনি এমনি নয় অদ্ভুত এক ক্রন্দনধ্বনিতে পা থেকে মাথা অবদি শিউরে ওঠে ঘুম ভেঙে যায়। হাঁটু থেকে পা অবদি থরথর করে কাঁপছে আমার। এমন কান্না আজ অবদি শুনিনি। ভৌতিক সিনেমায় অতৃপ্ত আত্মারা যেভাবে মাঝরাতে বিদঘুটে অন্ধকারে বসে থমথমে পরিবেশে কান্না করে। যেই কান্নায় থাকে একরাশ ক্লেশমিশ্রিত অনুভূতি। অসহনীয় ব্যাথায় কাতরাতে থাকা অনুভূতি। ঠিক তেমনি ক্রন্দনধ্বনি ভেসে আসছিলো। শক্রবার পড়েছে তাঁর মানে আজকেই আমার বিয়ে। একদিকে বুকের ভিতর তোলপাড় সৃষ্টি অন্যদিকে সেই কান্না। আপু পাশে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে। নির্মলকে চিঠি পাঠিয়েছি একদিন কেটে গেছে হাতে পেলে নিশ্চয়ই বসে থাকতো না। তাঁর মানে আমাকেই কিছু একটা করতে হবে৷ আপুকে ফিসফিসিয়ে ডাকতে শুরু করতেই আপু ঘুমজড়ানো কন্ঠে জিগ্যেস করলো,

-‘ সকাল হয়ে গেছে ‘?

-‘ না আপু তাড়াতাড়ি ওঠ দেখ কে যেনো কান্না করছে। এই আপু ওঠনা ‘। বলেই ঝাকাতে শুরু করি।

আপুর কানে যখন কান্নাটা স্পষ্টতর হয় আপুও ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তাই বললো পানি দিতে। আপুকে পানি দিয়ে নিজেও এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। আপু দ্রুত টর্চ নিয়ে জানালা খুলে পুকুরের দিকে আলো ধরলেন। আমি চোখ বড় বড় করে চেয়ে দেখি একটি কালো কুকুর বসে কাঁদছে। আপু দেখা মাএই আঁতকে ওঠলো এক ঢোক গিলে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

-‘ সাবারে গভীর রাতে কুকুর নেহায়ে নেহায়ে কান্না করা তো ভালো লক্ষণ না। নিশ্চয়ই কোন অঘটন ঘটবো। আম্মার কাছে শুনছি দাদা মরণের আগেও মাঝরাতে বাড়ির পাশে কুকুর এসে কাঁদতো ‘।

আপুর কথাটা আমি হেলায় ফেলায় ছেড়ে দিয়ে বললাম,

-‘ ধূর কি যে বলিস আপু এসব কুসংস্কার এগুলো মানতে হয় না। কুকুরের কান্নার সাথে মানুষ মরার কি সম্পর্ক যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা। তবে কান্নাটা খুবই ভয়ংকর দেখ আমার হার্টবিট কতো দ্রুত ওঠানামা করছে ‘

আপু আমার বুকে হাত চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর আবার শুয়ে পড়লো বিছানায়। কিন্তু আমার চোখে আর ঘুম ধরা দিলো না। ফজরের আজান দিতেই নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ শেষে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসে রইলাম। ভাবতে থাকলাম হয় পালাবো নয়তো বিয়ে করে নিবো। তাই বলে সংসার করবো না। কারণ আমি জানতাম বিয়ে হোক যাইহোক না কেনো নির্মল জাষ্ট একটা খবর পেলেই যে ভাবেই হোক আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। সময় যেনো খুব দ্রুত সড়ে যাচ্ছিলো। দুপুর হতেই আপু শাড়ি,গয়না নিয়ে আমাকে সাজাতে শুরু করলো। আকাশের অবস্থা সুবিধার না। যে কোন সময় বৃষ্টি ঝড়ে পড়বে। বরপক্ষরা তাই আগে ভাগেই আসবে দ্রুত বিয়ে পড়িয়ে বউ নিয়ে যাবে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সাজগোজ করতে হলো আমাকে। বৈশাখ মাসের শেষের দিক। সময়ে অসময়ে আকাশ বাজনা বাজিয়ে জলের স্রতোধারা নামিয়ে দিতে শুরু করে পৃথিবীর বুকে। বৃষ্টি কখনো কান্না হয়ে ঝরে কখনো বা হাসি। দিনের ফুটফুটে আলোকে বিদঘুটে অন্ধকারে পরিণত করে দিতে কয়েক মিনিটও সময় নেননি সৃষ্টিকর্তা। চারদিকে অন্ধকারে মাখামাখি। প্রবল বাতাসের বেগে গাছপালা ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। তীব্র বাতাসে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মানুষের কোলাহল হয়ে যায় অতি নগন্য। সেই সুযোগ টাকেই কাজে লাগাই আমি। ত্বরান্বিত হয়ে গায়ের সব গহনা খুলে ব্যাগপএ আর কিছু টাকা নিয়ে আপুকে রুমে রেখেই বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেই। ভিতর থেকে আপু কি বলছিলো সেগুলো শোনার জন্য সময় নষ্ট না করে ব্যাগ বুকে জড়িয়ে খালি পায়ে ভিজতে ভিজতেই দেই দৌড়। কেউ দেখেছে? কেউ ডেকেছে? এসব দেখা বা ভাবার সময়টুকুও নিইনি। কখনো শাড়ির সাথে পা বেজে পড়ে যাওয়ার পূর্বমূহর্তেই নিজেকে সামলে নেই। কখনো বা বড়সড় আঘাত পেলেও সেই আঘাতকে অতি তুচ্ছ করে দেখি। এই ঝড়, বৃষ্টি তে আমার পিছু নেওয়ার জন্য কেউ বসে থাকবে না নিশ্চয়ই। বাবা,চাচারা বাজারে গেছেন। মা চাচি রান্না ঘরে নিশ্চয় বাটা ঘষা করছিলো। অল্পসংখ্যক আত্মীয় তাঁরাও ঝড়,বৃষ্টি দেখে অন্য ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তবুও আমি তরান্বিত হয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম। বুকের ভিতর ধড়ফড় ধড়ফড় ধ্বনি টা বোধহয় কলহ শুরু করে দিয়েছে আজ। তাণ্ডবের সূচনা শুধু পৃথিবীর বুকেই ঘটেনি। আমার বুকেও তাণ্ডবের সূচনা হয়েছিল তখন। খালি পায়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড়াচ্ছিলাম। বেজে পড়লাম তো পড়লাম সেই কাকাতো ভাই সাব্বিরের সাথেই বেজে পড়লাম। দুহাত ভর্তি বাজার করে বাড়ি ফিরছিলো বেচারা। আমাকে দেখেই এক চিৎকার দিয়ে বললো,
-‘ সাবারে তুই কই যাস ‘।
আমি ওকে ধাক্কা দিয়েই আবার দৌড় লাগাই। মাগরিবের আজানের পূর্বমুহূর্ত চারদিকে যেমন আবছা আলো থাকে সে সময়টিতে চারপাশ ঠিক তেমনি ছিলো। যে কজন মানুষ সামনে পড়েছে তাঁরা কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরছিলো আশেপাশে তেমন দৃষ্টি ফেলার সময় তাঁদের হয়নি। কিছুলোকের দৃষ্টি পড়লেও পাত্তা দেয়নি। আর সাব্বির সে তো আমার ধাক্কা খেয়েই থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দূর থেকে চিল্লিয়ে শুধু বলে দিলাম,
-‘ ভাই আমার বাড়ি যা আম্মাকে বলে দিস আমার জন্য চিন্তা না করতে আমি শহড়ে ফিরে যাচ্ছি ‘।
.
লাল শাড়ি পরিহিত আমি বিধ্বস্ত মুখশ্রীতে বসে আছি বাসে। পৃথিবীর বুকে সুনামি হওয়ার পর পরিবেশ যেমন থমথমে থাকে আমার মুখশ্রীতে তেমন একটি ভাব৷ কিন্তু বুকে বয়ে চলেছে অসহনীয় ব্যাথা৷ আবার সে ব্যাথায় স্বস্তিও বোধ করছিলাম। জিতেছি যে ভালোবাসার জিত হয়েছে। আমার নির্মলের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। প্রথম দর্শনে খানিক চমকালেও শেষ হাসিটা আজ সে হাসবেই। বাসের কনট্রাক্টর থেকে শুরু করে প্রতিটি যাএীই আড় চোখে তাকাচ্ছিলো। অনেকে আবার কানাঘুষাও করছিলো। করবে নাইবা কেনো? বিধ্বস্ত মুখশ্রীতে বিয়ের কনে সাজে বসে আছি৷ বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছি তা আমার সাজসজ্জা আর মুখশ্রীতেই ফুটে ওঠেছে। কিন্তু এতে আমার জায় আসেনা। পুরো পৃথিবীর সম্মুখে আজ আমি কলঙ্কিত তবুও নেই কোন আপত্তি। সকল দুঃখ,সকল বেদনা, সকল বদনাম,সকল কলঙ্ক গায়ে মেখেই আমি ছুটে চলেছি আমার প্রিয়র নিকটে।

সকল ব্যাকুলতার অবসান ঘটিয়ে আটটার দিকে ঢাকায় পৌঁছালাম আমি। বাস থেকে নামতেই শরীর অকর্মণ্য হয়ে গেলো। কয়েক পা ফেলতেই মাথাটা ঘুরে গেলো। সারাদিন না খেয়ে ছয়ঘন্টা জার্নি করার ফল ছিলো। তারওপর পায়ের বিভিন্ন অংশ ছিলে গেছে। খালি পায়ে বেশ অনেকটুকু রাস্তা হাঁটতে হয়েছে যে৷ কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রিকশায় ওঠে পড়লাম। বৃষ্টিভেজা রাতের শহর। পরিবেশ টা কেমন ভ্যাপসা। রাতের শহরও কোলাহল পূর্ণ। রাতের শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে জনমানব শূন্য হতে থাকবে। রাস্তার এক পাশে ড্রেনের ওপারেই কয়েক জোরা কাক ডাকছে। কাকের কর্কশ ডাকে আমার কর্ণকুহরে রক্তপাত ঘটিয়ে ফেলার উপক্রম। ভ্রু কুঁচকে গলায় স্বাভাবিক স্বর ফিরিয়ে আনার তীব্র চেষ্টা করে আধভাঙা আওয়াজে রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-‘ মামা তারাতাড়ি চলুন ‘।

১৩.
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ি প্রবেশ করি। আশ্চর্য সদর দরজা খোলাই ছিলো। রাত বাজে আটটা পঁচিশ এ সময় দরজা খোলা? এই নির্মল, নির্ঝর কে নিয়ে আর পাড়া যায় না। ছেলেদুটো বড্ড বেখেয়ালি। নিশ্চয়ই মামিরা আসেনি তাই এই অবস্থা বাড়ির। বিরবির করতে করতে মামির রুমের তালা খুলে ঢুকে ব্যাগপএ রেখে উপরে গিয়ে নির্মলের রুম চেক দিলাম। নাহ রুমে নেই কিন্তু রুমটা বড্ড অগোছালো। বিছানা থেকে নির্মলের শার্টগুলো গুছিয়ে কাবার্ডে রেখে দিলাম। ছেলেটা একটা শার্ট পড়ার জন্য একশটা অগোছালো করে তবেই পড়ে আর গোছানোর নাম নেয় না। তয়ালে রশিতে ঝুলিয়ে দিলাম। বালিশগুলো ঠিক করতেই নির্মলের বাটন ফোনটা চোখে পড়লো। বিরক্ত হয়ে ওর ফোন নিয়ে নির্ঝরকে ফোন দিয়ে কানে ফোন ধরেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকলাম৷ কি বেআক্কেল ছেলে ফোনটাও সাথে রাখেনা রুমে রেখে দিয়েছে। টেলিফোন থেকে যদি ফোন দিতাম তাহলেতো পেতামই না। মশাই রুমে ফোন রেখে বাইরে টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো। এইদিকে আমি যে পুরো একটা বিশ্ব জয় করে ফিরেছি সে খবর কি সে জানে? এই তাঁর ভালোবাসার নমুনা হুহ! বাসায় আসুক আজ সব সুধে আসলে মিটিয়ে নিবো। আরেকদফা আশ্চর্য হলাম। এই নির্ঝরটাও ফোন ধরছে না। দুই ভাইয়ের কাহিনী কি হুম? মেজাজ খারাপ করে সোফায় বসতে যেতেই কিছুতে পাড়া লাগলো। দেখার জন্য ঝুঁকতেই ভীতিকর বিস্ময় নিয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিলাম৷ হ্যাঁ এটা সেই কাগজটাই হ্যাঁ এখানে সেই লিখাগুলোই রয়েছে গত দুদিন আগে লেখা যে কাগজটি আমি সাব্বির কে দিয়ে নির্মলের ঠিকানায় পাঠিয়েছি। ওহ মাই গড তাঁর মানে নির্মল চিঠিটা পেয়েছে। তাহলে সে কোথায়? চিঠি পেয়ে উন্মাদ হয়ে গ্রামে চলে যায় নি তো? পুরো শরীরে ঘাম ছেড়ে দিলো আমার। নির্ঝরও ফোন ধরছে না। একহাতে পুরো মুখ মুছে ডায়নিং টেবিল থেকে একগ্লাস পানি খেয়ে আবারো নির্ঝরকে ট্রাই করতে থাকলাম আর পুরো ড্রয়িংরুমে পাইচারি শুরু করে দিলাম। হঠাৎই মেঝের একপাশে চোখ পড়লো। পা থেকে মাথা অবদি পুরো গা শিউরে ওঠে হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো আমার ।

চলবে..