ওহে প্রিয় পর্ব-১৯

0
2096

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৯
____________
সকালের নাস্তা শেষে বেডে বসে মনের সুখে ফোনে গেম খেলছিলো হ্যাভেন৷ তখনি একজন দেহরক্ষী ভেতরে প্রবেশ করলেন৷ হ্যাভেন তাঁকে দেখে মুচকি হেসে জিগ্যেস করলো,

-‘ গুড মর্নিং শহীদুল সাহেব নাস্তা হয়েছে ‘?

শহীদুল সাহেব সৌজন্যতা সূচক হাসি দিয়ে বললেন,

-‘ জ্বি স্যার। আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। আপনি অনুমতি দিলে ভেতরে পাঠাবো ‘।

একজন সংসদ সদস্যকে শত্রু পক্ষরা মার্ডার করার ষড়যন্ত্র করেছিলো। গুরুতর আহত অবস্থায় হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে দুদিন আগে। আজ তাঁর শারীরিক অবস্থার বেশ উন্নতি ঘটেছে। এ খবর বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল,নিউজ পেপারে ছড়াছড়ি। সেই সাথে এসব ষড়যন্ত্রের পিছনে মেইন কালপ্রিটকে চিন্হিত করার জন্য চলছে তদন্ত। ইতিমধ্যে অনেক বড় বড় নেতাবৃন্দরা ফুলের তোড়া নিয়ে এসে দেখা করে গেছেন। হয়তো তাঁদের পক্ষেরই কেউ। তবুও হ্যাভেন প্রশ্ন করলো,

-‘ পরিচয় কি ‘?

-‘ একজন ভদ্রমহিলা এসেছেন স্যার ‘।

-‘ বয়স কেমন ‘?

– ‘ বাইশ,তেইশ হবে ‘।

চোখ দুটো আলোকিত হয়ে ওঠলো হ্যাভেনের। মুখে ফুটে ওঠলো দুর্বৃত্ত প্রসন্নময় এক হাসি। বির বির করে বলতে থাকলো, ‘ কোন রমণী ছুটে এলো এই কৃষ্ণমানবের দরবারে যেই আসুক এলেম আছে বলতে হবে প্রাণে গভীর অনুভূতিও আছে ‘ অট্রস্বরে হেসে ওঠে স্পষ্ট ভাষায় বললো,

-‘ নাম কি ‘?

-‘ রূপসা আহমেদ ‘।

মেজাজ বিগরে গেলো হ্যাভেনের বেডের একপাশে থুথু ফেলে বিশ্রি এক গালি দিলো রূপসাকে উদ্দেশ্য করে। শহীদুল সাহেব লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। হ্যাভেন নিজেকে সামলানোর তীব্র চেষ্টা করছে। কপাল বেয়ে তরতর করে ঘাম ঝড়তে থাকলো তাঁর। বাহ্যিক এই অস্থিরতাই তাঁর ভিতরের অস্থিরতা কে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই অস্থিরতার কারণ কি? রূপসা তাঁর প্রথম ভালোবাসা ছিলো। মন প্রাণ উজার করে প্রথম যে নারীটিকে ভালোবেসেছিলো সেই নারীটি রূপসা। অসংখ্য দিন ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছিলো মেয়েটাকে। আদর,যত্ন, ভালোবাসা, সম্মান কোন কিছুরই কমতি রাখেনি। মেয়েটা যদি বিশ্বাসঘাতকতার মতো জঘন্য কাজে নিজেকে যুক্ত না করতো এতো দিনে তাঁদের সংসারটা বেশ রমরমা হতো। চোখ বুজে কয়েকদফা শ্বাস নিলো আর ছাড়লো। দুচোখে তীরের মতো বিঁধতে থাকলো অনাবৃত দুটি দেহের আলিঙ্গনের মূহুর্তটুকু। রক্তিম চোখ দুটো মেলে বিমর্ষ গলায় বললো,

– ‘ ভিতরে পাঠিয়ে দাও ‘।

শহীদুল সাহেব বেরিয়ে যেতেই হ্যাভেন হ্যারিকে ম্যাসেজ করে আহিকে আধাঘন্টার মধ্যে হসপিটালে নিয়ে আসতে বললো। সম্পূর্ণ প্রটেকশন দিয়ে যেনো নিয়ে আসা হয় এও বলে দিলো। কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করলো রূপসা। গুটিগুটি পায়ে বেডের পাশের মোড়ায় গিয়ে বসলো। হ্যাভেন একরাশ ঘৃণ্য দৃষ্টি ফেললো তাঁর দিকে। আগাগোড়া বেশ ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করে বিদ্রুপের হাসি দিলো। আগের তুলনায় চেহেরার উজ্জ্বলতা অনেক কমে এসেছে রূপসার। স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটেছে যার ফলে পঁচিশ ছাব্বিশ বয়সী মেয়েটার বাইশ,তেইশ বলে ধারনা করেছে শহীদুল সাহেব।

জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে রূপসা কখনো কখনো চোখ তুলে তাকাচ্ছে আবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। একসময় কতো কথাই হতো দুজনের অথচ আজ কতো জড়তা। যে চোখে একসময় ভালোবাসার মহা সমুদ্র দেখতে পেতো আজ সে চোখে শুধুই ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে রূপসা। পাবে নাইবা কেনো ঘৃণ্য কর্মের জন্য ঘৃণাই তো প্রাপ্য। পবিএ একটি সম্পর্ককে অপবিএ করেছে সে। নিষ্পাপ,নির্মল মনটাকে বিষিয়ে দিয়েছে সে। পানির মতো সহজ জীবনটাকে বরফের ন্যায় কঠিন করে তুলেছে। এসব কিছুর জন্য সে দায়ী প্রাচুর্যের লোভে দিশেহারা হয়ে যে ভুল সে করেছে সেই ভুলেরই প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছে আজ। তাঁর চোখের ভাষা কি পড়তে পারছে হ্যাভেন? দেখতে পারবে তাঁর দুচোখ ভরা অনুশোচনার আগুনকে ? মনের প্রশ্নগুলো গুছিয়ে রেখে নীরবতা ভেঙে জড়ানো গলায় বললো,

-‘ কেমন আছো ‘?

-‘ বেশ ভালো আছি। কেনো ডেডবডি দেখার আশায় ছিলে বুঝি ‘?

-‘ নাহ এসব কি বলছো? তোমার এই খবরটা শুনে আমার মনের ওপর দিয়ে কি গেছে শুধুই আমি জানি হ্যাভেন। আমি ঠিক নেই একদম ঠিক নেই। তোমার সুস্থতা কামনা করছি খুব ‘।

-‘ ইশরে কি কপাল আমার জিসান আহমেদের ওয়াইফ আমার সুস্থতা কামনা করছে এও সম্ভব ‘?

-‘ আমি জিসানকে ডিভোর্স করে দিব হ্যাভেন। আমি বুঝতে পেরেছি জীবনে অর্থ সুখ বয়ে আনতে পারেনা। সুখ জিনিসটা অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। ভালোবাসার উপরে কোন সত্য নেই ‘।

-‘ বেড পারফরম্যান্স ভালো হয়না নাকি? একদম অকেজো হয়ে গেছে ‘? বলেই চোখ মারলো হ্যাভেন।

লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো রূপসা। কিন্তু হ্যাভেনের প্রতি তাঁর রাগ হলোনা। সে যা করেছে তারপর হ্যাভেন যে তাঁর সাথে দেখা করতে কথা বলতে রাজি হয়েছে এই অনেক। তাই এসব অপমানকে তুচ্ছ করে দেখলো সে।

-‘ শুনলাম বিদেশ গিয়ে ট্রিটমেন্ট করিয়েছে তবুও কাজ হয়নি? ভেরী বেড’। বলেই ঠোঁট জোড়া চৌকা করে তাচ্ছিল্যভরা চুচু শব্দ করতে থাকলো।

রূপসা নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। বসা থেকে ওঠে হ্যাভেনের পায়ের কাছে বসে দুপা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

-‘ আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও হ্যাভেন। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি নিজের অনুভূতি কে। আমি কখনোই জিসানকে ভালোবাসিনি আমি আজো তোমাকেই ভালোবাসি। দিনশেষে তোমাকে নিয়েই ভাবি তোমার কাছেই ফিরে এসেছি। প্লিজ আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না। আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি ‘।

দুহাত শক্ত মুঠ করে ফেললো হ্যাভেন। চোখ দুটোতে ভয়ংকর রক্তিম আভা ফুটে ওঠেছে। চোয়াল দুটো শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

-‘ ডোন্ট টাচ মি ‘।

ভয়ে হাত সড়িয়ে ফেললো রূপসা। আবারো আগের স্থানে বসে কাঁদতে থাকলো এবং বলতে থাকলো,

-‘ আমি জানি হ্যাভেন তুমি আজো আমায় ভালোবাসো। আজো তোমার মনের কোঠায় সন্তর্পণে আমারই নাম লেখা আছে। আহিকে তুমি জেদের বশে আমাকে দেখানোর জন্যই বিয়ে করেছো। এই বিয়ের কোন ভিত্তি নেই। তুমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দাও হ্যাভেন। আমি তোমার কাছে চলে আসবো। অনেক অনেক ভালোবাসবো তোমাকে বিলিভ মি। আই লাভ ইউ, আই ওয়ান্ট টু লিভ উইথ ইউ হ্যাভেন’।

নির্লজ্জ,কলঙ্কিত নারী বোধ হয় একেই বলে। কিছু নারী জঘন্যরকমের মাতাল হয়। জঘন্য নেশায় আসক্ত থাকে তাঁরা। কখনো তাঁদের প্রচুর অর্থের নেশা জাগে কখনো বা দেহের খোরাক মেটাতে উন্মাদ হয়ে যায়। আজ জিসান অঁচল হয়ে পড়েছে। তাঁর এই অঁচলতার জন্য দায়ী এই রূপসাই। অর্থের নেশা, ক্ষমতার বড়াইয়ের জন্য একদিন এই রূপসা হ্যাভেনকে ছেড়ে জিসানের কাছে গিয়েছিলো। আজ দেহের খোরাক মিটাতে পারছেনা বলেই হয়তো হ্যাভেনের কাছে এসেছে। এমন কালনাগিনী কে সেকেন্ড টাইম বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠেনা। সুস্থ থাকলে জায়গা মতো আঘাত করে শখ মিটিয়ে দিতো৷ কিন্তু ভাগ্য বোধ হয় আজ রূপসার সহায় হয়েছে। তাই বিশ্রি কয়টা গালি দিতে উদ্যত হয়েছে এমন সময় দরজায় চোখ পড়লো হ্যাভেনের৷

নিষ্প্রাণ হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে আছে আহি। রূপসার বলা শেষ কথা গুলো শুনে নিয়েছে সে। বুকের ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তাঁর। এক ঢোক গিলে মাথা নিচু করে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই হ্যাভেন গলা উঁচিয়ে বললো,

-‘ কি গো বউ ফিরে যাচ্ছো কেনো? কাম হেয়ার। বলেই ইশারা করলো হ্যাভেন।

বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে আহির। ভুল সে ভুল। হ্যাভেন তাঁকে নয় আজো রূপসাকেই ভালোবাসে। মনের কোঠায় সন্তর্পণে আজো রূপসারই নাম রয়েছে। তাহলে সে কেনো ফিরে এলো? কোন আশায় ফিরলো হ্যাভেনের কাছে? মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো আহি। রূপসা বেশ অস্বস্তি তে ভুগতে থাকলো৷ আহির উপস্থিতি একদম সহ্য করতে পারছেনা সে। হ্যাভেনের মুখে বউ ডাকটা শুনে বুকটা হুহু করে ওঠেছে তাঁর। এতো আদরমেখে তাঁর সামনে অন্য কাউকে বউ ডাকতে একটুও দ্বিধা হলো না হ্যাভেনের? আহির রূপ দেখে যেমন হিংসায় গা জ্বলছে তেমনি আহির নমনীয়তা দেখেও সারা অঙ্গ জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তাঁর। আহি বেডের কাছে যেতেই রূপসার সামনেই আহির হাত টেনে একদম নিজের কাছে বসালো হ্যাভেন। রূপসা ভীষণ ইতস্তত বোধ করতে লাগলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে এদিক সেদিক তাকাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সে। আহিকে একদম সহ্য হচ্ছে না তাঁর। আহির গায়ে এতো দামি শাড়ি, গয়না দেখে মাথায় রক্ত ওঠে গেলো৷ আবার তাচ্ছিল্য করে ভাবলো, ‘ আজকাল কেউ এমন সং সেজে বসে থাকে নাকি? ছোটলোক থেকে বড়লোক হলে যা হয় আর কি। এক ঢাকি রূপ দিয়ে আমার হ্যাভেনকে বশ করেছিস তা কি আমি বুঝিনা। আমার জায়গা কিভাবে ফেরত নিতে হয় জানা আছে আমার ‘।

-‘ হ্যাভেন আমার কথা শেষ হয়নি। আমার সময় চাই তোমার থেকে ‘।

কথাটা শোনামাএই হ্যাভেনের হাত ছিটকে সড়িয়ে দূরত্ব বজায় রেখে বসলো আহি। হ্যাভেনের ঠোঁটের কোনে ভেসে ওঠলো দুষ্টু হাসি। আহির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই উত্তর দিলো,

-‘ পরে মিট করে নেবো এখন আসতে পারো। বউয়ের সাথে রোমান্স করার সময় অন্য কিছুতে এটেনশন দিতে চাইনা ‘। বলেই আহিকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নিলো।

রূপসা রাগে,ক্ষোপে গজগজ করতে করতে ওঠে চলে গেলো। আহি হাত মোচড়ামুচড়ি করছে। হ্যাভেন আহির অবস্থা দেখে এবার না হেসে পারলো না। অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো সে। বললো,

-‘ বিয়ে মানো না, স্বামী মানো না স্বামীর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে পালিয়েও যাও। আবার ফিরেও আসো আবার হাজব্যান্ডের এক্সকে দেখে মারাত্মক অভিমানও করো। এতো রহস্যময়ী কেনো সুন্দরী ‘?

ভয়ে গা শিউরে ওঠলো আহির৷ বাড়ির লোকজন তাঁর পালানোর কথাটা তাহলে জানিয়েই দিলো। চোখ উপচে অনবরত অশ্রু ঝড়তে শুরু করলো। গায়ের কাঁপুনি ভাবটাও টের পেলো হ্যাভেন৷ হাত ছেড়ে কোমড়ে শক্ত করে চেপে ধরে কাছে টেনে নিলো। মাথার ঘোমটা সড়িয়ে ঘর্মাক্ত গলায় নাক ডুবিয়ে দিলো। বললো,

-‘ সাবা ম্যাম অমায়িক একটা মানুষ সুন্দরী। সকাল,বিকাল তাঁর কাছে গেলেও আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমাকে ছেড়ে পালানোর উদ্দেশ্যে কোথাও গেলে ঘোর আপত্তি রয়েছে। আমি বলেছিলাম বাসা থেকে বের না হতে তবুও তুমি বের হয়েছো। শুধু তাই নয় চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বের হয়েছো এর মানে দাঁড়ায় তুমি আমাকে ছেড়ে পালাতে চাইছো ‘। নাক ঘষতে ঘষতে কথা গুলো বলেই সাজোরে এক কামড় দিলো গলায়। ব্যাথায় মা বলে কুঁকিয়ে ওঠলো আহি। দুহাত দিয়ে আলতো ধাক্কা মেরে সড়িয়ে দিলো হ্যাভেন কে।

হ্যাভেন সড়ে যাওয়ার পরপরই আবারো কাছে টেনে নিলো আহিকে। দুগালে দুহাত চেপে ধরে চিবুকে চুমু খেলো। বললো,

-‘ ১০০% শাস্তির ৫০% কেটে দিয়েছি ফিরে আসার জন্য তাঁর থেকে ২৫% কেটে দিয়েছি সাবা ম্যামের বাসায় অবস্থান করার জন্য। বাকি ২৫% এর ১০% ছিলো এই কামড়টায় বাকি ১৫% শাস্তি পাবে ধীরে ধীরে। বলেই একহাতে পিঠ চেপে ধরে অন্যহাতে চুলের পিছন দিয়ে ঘাড় চেপে ওষ্ঠ চুমোয় ব্যাস্ত হয়ে ওঠলো ‘।

চলবে…