#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ২০
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
অরোরার এনগেজমেন্ট খুব ঘটা করে করা হয়নি। ঘরোয়া ভাবে আয়োজন করে কিছু আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে করা হয়েছে। মূলতঃ ছেলে পক্ষই বলেছেন এনগেজমেন্ট, বিয়ে সাদাসিধা ভাবে করতে। রিসিপশন করা হবে ধুমধাম করে।
নিজের ঘরে এসে পরিধানের ভারী বস্ত্র খুলে হালকা ঢিলেঢালা একটা জামা পরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো জ্যোতি। জুবায়ের মাহিরার কাছে আছে সম্ভবত। কিছুক্ষণ এভাবে ফিট হয়ে থাকার পর দরজায় নক হলো। দরজা ভেজানোই ছিলো, তাই জ্যোতি উঠে বসে ভিতরে আসার অনুমতি দেয়।
মাহিরা জুবায়েরকে কোলে নিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।
জ্যোতিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার শরীর খারাপ করেছে নাকি? চোখ মুখ এমন শুকনো কেনো? খেয়েছো কিছু?”
জ্যোতি ক্লান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
“না, শরীর ঠিকই আছে, একটু কাহিল লাগছে আরকি। এতো ভারী জামা পরে এতক্ষণ ছিলাম, এজন্যই অস্থির লাগছে একটু। তোমার ভাইকে বারবার বলেছি, আমি এসব জামা পরে এতক্ষণ থাকতে পারবো না৷ তারপরও জোর করে পরিয়েছে। একটু যদি শোনে আমার কথা!”
মাহিরা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো,
“ভাবী, ভাইয়াকে আমিই এই জামাটা সিলেক্ট করে দিয়েছিলাম তোমার জন্য।”
জ্যোতি অপ্রস্তুত হয়ে যায় মূহুর্তেই। কোনোমতে সামাল দিতে বলে,
“এজন্যই তো বলি, তোমার ভাই মেয়েদের ড্রেস চেনা শুরু করলো কবে থেকে!”
মাহিরা এবার শব্দ করে হেসে ফেলে জ্যোতির বলার ভঙ্গি দেখে। হাসতে হাসতে বলে,
“তোমাদের দেখলে আমার সবসময় কী মনে হয় জানো? টম এন্ড জেরি। এক্কেবারে পারফেক্ট ডেফিনেশন, হা হা হা!”
জ্যোতিও হেসে ফেলে এই বেলা।
মাহিরা জুবায়েরকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,
“কিছু খেয়েছো?”
“না, পরে খাবো করে করে আর কিছু খাওয়া হয়নি।”
“এজন্যই চোখমুখ এমন শুকনো। দাঁড়াও, আমি খাবার আনতে বলি, আমারও খিদে পেয়েছে।”
মাহিরা চট করে বের হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার আনার নির্দেশ দিয়ে ফিরে এলো।
__________________°________________
শাহরিয়ার লাট হয়ে শুয়ে চোখ বুজে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“জ্যোতি লাইট অফ করো। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।”
জ্যোতি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে ময়েশ্চারাইজার লাগাচ্ছিলো। শাহরিয়ারের অস্পষ্ট কথা শুনে ঘুরে তাকিয়ে এক ভ্রু সামান্য উঁচিয়ে বললো,
“একদিনেই এরকম অবস্থা? আমাকে যেন কে বলেছিলো আমি ফার্মের মুরগী? এখন আপনি কী, শুনি?”
শাহরিয়ার চোখ খুলে কনুইয়ে ভর দিয়ে জ্যোতির দিকে তাকায়। ঘুম ঘুম ভাব উবে গেছে তার।
“টিটকারি করার কোনো সুযোগই দেখছি হাতছাড়া করো না!”
জ্যোতি বিনিময়ে একটা শয়তানি হাসি হাসলো।
“সেদিন তো এমন ভাবে কথাটা বলেছেন যেন আপনি কোথাকার কোন সাত মার পালোয়ান! একবারে সাতটাকে কুপোকাত করেন! এখন আপনাকে কী ডাকা উচিত?”
“কী আর ডাকবে? ফার্মের মোরগ বলে ডাকো। মুরগীর বর তো মোরগই হবে তাই না?”
জ্যোতি হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে বললো,
“কোনো ঘুম চলবে না। ঘুম টুম বাদ আজকে!”
শাহরিয়ারের চোখ চকচক করে উঠলো, দুষ্টুমি করে বললো,
“তাহলে কী করবো আজ?”
জ্যোতি কটমট করে তাকিয়ে বললো,
“জুবায়েরকে সামলাবেন!!”
শাহরিয়ার সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, যেন ভীষণ হতাশ।
জ্যোতির এত হাসি পেলো সেটা দেখে যে হাসি চাপতে গিয়ে খুক খুক করে কেশে ফেললো।
___________________°________________
কিচেনে চা বানাতে বানাতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে জ্যোতি। নিজের বিয়ের সময়কার কথা মনে পড়ছে তার। অনেক ইচ্ছে ছিলো নিজের বিয়েতে গুটিকয়েক যে বান্ধবী আছে তাদের সহ দিনটা আনন্দ করবে। গতকাল অরোরার এনগেজমেন্টে অরোরার বান্ধবীদের উচ্ছ্বাস দেখে নিজের কথাও মনে পড়ে গেলো। বান্ধবী ছিলোই তার হাতে গোণা দুই তিনজন। এরমধ্যে শুধু একজন আসতে পেরেছে। আরেকজন তখন এলাকাতেই ছিলো না। আর আরেকজন জ্যোতির বিয়ের কয়েকমাস আগেই একটা ঝামেলা করে ফেলেছিল বড় রকমের। এক ছেলেকে পছন্দ করতো। কিন্তু ফ্যামলি রাজি হচ্ছিল না দেখে ছেলের হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। এরপর ফ্যামেলি একপ্রকার ত্যাজ্য করে দিয়েছে মেয়েকে। জ্যোতি যেহেতু মেয়েটার বান্ধবী ছিলো তাই কিছু উত্তাপ ও রোষের মুখে তাকেও পড়তে হয়েছে। জান্নাতের ফ্যামিলি জ্যোতিকে ভীষণ আদর করতো। জান্নাত পালিয়ে যাওয়ার পর তার মা বাবা জ্যোতিদের বাড়িতে এসে জ্যোতিকে চেপে ধরেছিলো একপ্রকার। তাদের সন্দেহ ছিলো জ্যোতি জানতো আগে থেকে এই বিষয়ে। অথচ জান্নাত কখন এই সম্পর্কে জড়ালো, কী থেকে কী হলো এসবের তেমন কিছু জ্যোতি জানতো না। অনেক রাগারাগি করেছিলো জান্নাতের ফ্যামেলি তার সাথে। জ্যোতি যতদুর জানতে পেরেছিলো ফেসবুকের রিলেশন ছিলো তাদের। যাইহোক অনেকবার বলার পর জ্যোতির কথায় হয়তো আস্থা এসেছিল তাদের। কিন্তু সরাসরি হুমকি দিয়েছে জান্নাতের সাথে জ্যোতি যেন কোনো প্রকার যোগাযোগ না করে। যদি কখনো তারা জানতে পারে জ্যোতির সাথে জান্নাতের যোগাযোগ রয়েছে তাহলে তার পরিণাম ভালো হবে না।
এসব ঘটনার পর এমনিতেই জ্যোতির বাবা মা ক্ষিপ্ত ছিলেন। জান্নাতের সাথে তাকে যোগাযোগ এমনিতেও করতে দিতেন না তারা। এই ঝামেলার পর তো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছেন।
জ্যোতির মনে আছে, শুধু পালিয়ে যাওয়ার তিনদিন আগে জান্নাত তাদের বাড়ি এসেছিলো। তখন একপর্যায়ে মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে জ্যোতিকে দেখিয়েছিলো। ক্যামেরা কোয়ালিটি খুব একটা ভালো ছিলো না, তারপরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো বেঞ্চিতে একটা হ্যাংলা পাতলা ধরনের ছেলে বসা। জ্যোতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছিলো ‘কে এটা?’
জান্নাত তখন লাজুক হেসে বলেছিলো তার প্রেমিক। জ্যোতি অবাক হয়েছিলো ভীষণ।
পরে জেনেছে ওই ছেলের সাথেই পালিয়েছে সে।
জান্নাত পালিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর ভিন্ন একটা নাম্বারে কল করেছিলো তাকে। জ্যোতি সোজাসাপটা মানা করে দিয়েছিলো তার সাথে যোগাযোগ রাখতে। এরপর আর কথা হয়নি তার জান্নাতের সাথে।
ভাবতে ভাবতেই জ্যোতি হঠাৎ ভীষণ চমকে উঠলো। এতক্ষণে মনে পড়লো কেনো তার ভিতরটা এতদিন যাবত খুত খুত করছিলো! জান্নাত যেই ছেলের ছবি দেখিয়েছিলো সেটা রবিনেরই ছিলো! শুধু তখন স্বাস্থ্য ভীষণ কম ছিলো, এখন আগের তুলনায় স্বাস্থ্যবান হয়েছে। একে তো দেখেছেই একবার, তারপর উপর দৈহিক কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে, তাই জ্যোতি প্রথম দেখায় চিনতে পারেনি! কিন্তু মস্তিষ্কের এক কোণে ঠিকই আবছা ভাবে বিষয়টা আটকে ছিলো।
ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠলো সে। ওই ছেলের সাথে না জান্নাতের বিয়ে হয়েছে? তাহলে ওই ছেলে অরোরাকে ধরলো কীভাবে? জান্নাতের কী হয়েছে তাহলে?
এরমধ্যেই ফুটন্ত চা হাঁড়ি উপচে পড়ে বিকট এক গন্ধ ছড়ালো চতুর্দিকে। জ্যোতির হুশ এতক্ষণে ফিরলো। তড়িঘড়ি করে দ্রুত স্টোভ বন্ধ করে থম মেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
কোনো হিসেবই তো মিলছে না! রবিনের কোনো যমজ ভাই-ও নেই যে দুজন আলাদা ব্যক্তি হবে। জ্যোতি বুঝতে পারলো না এখন কী করবে। এত বড় একটা কথা সে গোপন রাখবে কীভাবে? এগুলো তো ছোটোখাটো বিষয় না! রবিন কি প্রতারণা করেছে জান্নাতের সাথে? জ্যোতির নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো। জান্নাতের সাথে যোগাযোগ রাখার দরকার ছিলো তার। হাজার হোক তার বন্ধু ছিলো। কিন্তু আব্বু আম্মুর কড়া নিষেধ , জান্নাতের ফ্যামেলির দুর্ব্যবহার, হুমকি ধামকি খেয়ে নাজুক জ্যোতির নিজেরও কোনো ইচ্ছে ছিলো না যোগাযোগ রাখার। রত্না নিজের সামনে জ্যোতিকে দিয়ে জান্নাতের নাম্বার ডিলিট করিয়েছিলেন। তাছাড়া জ্যোতির বিয়ের কিছুদিন আগেই সে নতুন ফোন, নতুন সীম নিয়েছিলো। এর আগে মায়ের অব্যবহৃত একটা সীম ব্যবহার করতো। মানে কোনোভাবেই জ্যোতির কাছে জান্নাতের নাম্বারটা নেই। থাকলে নাহয় জান্নাতের সাথে কথা বলে শিওর হওয়া যেতো।
জ্যোতির নিজেকে একপ্রকার পাগল পাগল লাগলো। কী করবে সে এখন? এসব বিষয় প্রমাণ ছাড়া বলাও বিপদ! কে বিশ্বাস করবে তাকে?
#চলবে……..
#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ২১
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
জুবায়ের সবে ঘুমিয়েছে। জ্যোতি বিছানায় এক পাশে ক্লান্ত হয়ে আধশোয়া হয়ে রইলো। মন ভালো নেই একদমই তার। মাথার মধ্যে অজস্র দুশ্চিন্তা হুটোপুটি খাচ্ছে লাগাতার। তারউপর ছেলেটাও ইদানীং অনেক জ্বালাচ্ছে। সব মিলিয়ে তার মুডের দফারফা অবস্থা।
এমন সময় শাহরিয়ার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। জ্যোতি সেদিকে তাকিয়ে দেখে শাহরিয়ারের হাতে ম্যাংগো আইসক্রিমের বক্স। কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্যোতির চোখে দ্যুতি খেলে গেলো। দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসলো খুশিতে। কিন্তু পরক্ষণেই কী মনে হতেই আবার হতাশা ভর করলো চেহারায়। করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আইসক্রিমের বক্সটার দিকে।
শাহরিয়ার জ্যোতির এত ঘন ঘন অভিব্যক্তি পরিবর্তন লক্ষ্য করে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো আইসক্রিমের বক্সের দিকে? তোমার জন্যই এনেছি। সারাদিন মাথা গরম থাকে, এটা খেলে যদি তোমার মাথা একটু ঠান্ডা হয়!”
জ্যোতি ঠোঁট ভেঙে করুণ স্বরে বললো,
“আপনি জানেন না আমার সাইনোসাইটিস আছে? ঠান্ডা জাতীয় কিছু খেলে নাক আর কপালের মাঝখানে তীব্র ব্যথা হয়, আমি খাবো কীভাবে?”
“ওহ এই সমস্যা? তাহলে খেয়ো না! আমি খেয়ে নিচ্ছি! এজন্য এভাবে ছুঁচার মতো তাকিয়ে থাকবে?”
জ্যোতি কড়া চোখে তাকালো তার দিকে। কী বদ!
“আমি ছুঁচা?”
শাহরিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জ্যোতিকে আরও ক্ষ্যাপানোর জন্য আইসক্রিম খেতে খেতে আপন মনে বললো,
“অবশ্য তোমার না খাওয়াই বেটার।”
তারপর জ্যোতির দিকে তাকিয়ে একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললো,
“মুটিয়ে গেছো তো তুমি, তাই!”
জ্যোতি ক্ষেপে গেলো এইবারে। একেবারে ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো মারমুখী হয়ে বললো,
“এখন আমি মুটিয়ে গেছি তাই না? তো আপনি বলতে চাচ্ছেন প্রেগন্যান্ট হওয়ার পরও আমার উচিত ছিলো ক্যাটরিনা কাইফের মতো ফিগার ধরে রাখা? ফাজলামো করেন আমার সাথে?”
জবাবে শাহরিয়ার গা জ্বালানো এক হাসি দিলো। রাগে অতিষ্ঠ হয়ে জ্যোতি বেলকনিতে চলে গেলো রেগেমেগে।
পরিস্থিতি গরম হয়ে গেছে বুঝতে পেরে শাহরিয়ারও দ্রুত পিছন পিছন গেলো। তাকে আসতে দেখে জ্যোতি রেগেমেগে বেলকনির দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলো, কিন্তু শাহরিয়ার একপ্রকার ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়লো ভিতরে।
বেচারা অসহায় কন্ঠে বললো,
“আরে আরে খেপছো কেনো? আমি তো মজা করেছি। মজাও বুঝো না।”
জ্যোতি তাও গাল ফুলিয়ে রইলো। মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়। মন মেজাজ কোনোটাই ভালো না এই মূহুর্তে তার।
শাহরিয়ার জ্যোতির মুড সুয়িং বুঝতে পেরে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদের স্বরে বললো,
“আচ্ছা, স্যরি না…! আর এমন মজা করবো না। এভাবে গাল ফুলিয়ে থেকো না প্লিজ। আসো, রুমে আসো।”
জ্যোতি একটু নরম হলো। আহ্লাদে কাজ হচ্ছে বুঝতে পেরে শাহরিয়ার আবার বললো,
“রুমে আসো, তারপর তোমাকে একটা গুড নিউজ দিচ্ছি।”
তারপর শাহরিয়ার একপ্রকার ঠেলেঠুলে জ্যোতিকে রুমে নিয়ে এলো।
জ্যোতি রুমে এসে কাঠকাঠ গলায় বললো,
“কী গুড নিউজ? শুনি?”
শাহরিয়ার রয়েসয়ে সোফায় বসতে বসতে বললো,
“আরে বসো। তারপর বলি।”
জ্যোতি বিছানায় বসে পড়ে।
“অরোরার বিয়ের ডেট ফিক্স করে ফেলা হয়েছে।”
জ্যোতি যেন গরম ছ্যাঁকা খেলো এমন ভাবে সটান দাঁড়িয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ!
ভীষণ অধৈর্য হয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করলো,
“সত্যি বিয়ের ডেট ফিক্স করে ফেলেছেন?”
শাহরিয়ার বিস্মিত হলো সহধর্মিণীর এমন আচরণে। জ্যোতির এমন প্রতিক্রিয়ার হেতু বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে বললো,
“হ্যাঁ, দশদিন পর রাখা হয়েছে। কিন্তু তোমার কী হয়েছে? এভাবে রিয়েক্ট করছো কেনো? আমি তো ভাবলাম খুশি হবে!”
জ্যোতি যেন শুনলোই না প্রশ্নটা। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে কী যেন চিন্তা করেই যাচ্ছে। মুখটাও কেমন শুষ্ক দেখাচ্ছে।
শাহরিয়ার আবার প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে তোমার? তুমি এতো ট্রেস নিচ্ছো কেনো?”
জ্যোতি না পেরে খুব অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
“আমার না ভালো লাগছে না এসব। ছেলেটাকে নিয়ে কেনো যেন আমার মন সায় দিচ্ছে না অরোরার জন্য। বারবার মনে হচ্ছে ঝামেলা হবে।”
শাহরিয়ার কিছুক্ষণ স্থির ভাবে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
“তুমি আমার পাশে এসে বসো তো একটু। কুইক।”
জ্যোতি কথামতো তাই করে। শাহরিয়ারের পাশে গিয়ে বসতেই শাহরিয়ার জ্যোতির মাথাটা আলতো করে বুকে চেপে ধরে।
তারপর মাথায় একটা উষ্ণ চুমু খেয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলে,
“তুমি অযথা টেনশন নিচ্ছো। আমি নিজে ছেলে আর তার ফ্যামিলির সাথে কথা বলেছি। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি ওদের নিয়ে, যথেষ্ট ভালো ফ্যামিলি। অরোরার অযত্ন করবে না। তাছাড়া অরোরা কি বানে ভাসা কচুরিপানা নাকি? আমরা আছি না? তুমি টেনশন ঝেড়ে ফেলো একদম মাথা থেকে।”
জ্যোতি আর্দ্র কন্ঠে বলে,
“ছেলের ব্যপারে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছেন তো?”
শাহরিয়ার জ্যোতির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ছোট্ট করে উত্তর দেয়,
“হু!”
জ্যোতির কান্না পায় ভীষণ। চুপচাপ পড়ে থাকে শাহরিয়ারের বুকে। কী খোঁজখবর নিলো তারা? ছেলের আগের কুকীর্তিই জানতে পারলো না! ইশশ! সে যদি সব খুলে বলতে পারতো তাকে! কিন্তু কিসের ভিত্তিতে বলবে সে? প্রমাণ সরূপ কী আছে তার কাছে? বিনা প্রমাণে এমন অভিযোগ করাও তো বোকামি! পরে না আবার তাকে ভুল বুঝে সবাই! এমনিতেই ঘরে তার অবস্থান নড়বড়ে। শ্বশুর আর শাহরিয়ারই একমাত্র খুঁটি হয়ে আছে তার পাশে। এছাড়া তার সমর্থন তো দূর্বল।
দীর্ঘ ক্ষণ এভাবেই থেকে জ্যোতি নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বললো,
“শুনুন, আমি একটু বাসায় গিয়ে আম্মু আব্বুর সাথে দেখা করে আসি। অনেক দিন দেখিনা তাঁদের।”
শাহরিয়ার বললো,
“উনারা তো এনগেজমেন্টেও আসলো না। আমি অনেক করে রিকুয়েষ্ট করেছিলাম আসতে। আঙ্কেল সম্ভবত এখনও আমাকে অপছন্দ করেন, তাই না?”
“আমি যা ভাবছেন সেটা না। আব্বু প্রেসারের রোগী, জানেন তো। প্রেসার অনেক হাই হয়ে গিয়েছিলো। আম্মু তো তাঁকে নিয়েই পেরেশান ছিলো। এ অবস্থায় কীভাবে আসবে?”
শাহরিয়ার আলতো করে জ্যোতির মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
“আচ্ছা, কখন যাবে আমাকে জানিও। আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো তোমাকে।”
__________________°__________________
অনেক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে শেষমেশ মুনিয়ার নাম্বারে ডায়াল করলো জ্যোতি। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো।
“হ্যালো? কে বলছেন?”
জ্যোতি অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দেয়,
“আমি,,, জ্যোতি। কেমন আছিস?”
ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নিরবতা বিরাজ করলো। তারপর বিস্মিত কন্ঠ ভেসে এলো,
“জ্যোতি? তুই? বাব্বাহ! এতদিন পরে মনে পরলো আমার কথা তোর?”
জ্যোতি আড়ষ্ট বোধ করলো। নিজের বান্ধবীদের কারো সাথেই তার যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন ধরে।
“না, মনে আছে ঠিকই। তুইও তো আর যোগাযোগ করিসনি। অন্য শহরে শিফট হলি সেটাও জানালি না, আমি বুশরার থেকে জেনেছি।”
এরপর টুকটাক মান অভিমান ভাঙানোর পালা চললো দুই বান্ধবীর।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর জ্যোতি আমতা আমতা করে আসল কথা পাড়লো,
“মুনিয়া, তোর জান্নাতের সাথে কথা হয়? ওর নাম্বার আছে তোর কাছে?”
ওপাশ হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর মুনিয়া বললো,
“আগে হতো মাঝে মধ্যে। এখন হয়না খুব একটা। কেনো, তোর হঠাৎ জান্নাতের কথা মনে পড়লো কী মনে করে?”
মুনিয়ার শেষ কথাটায় সূক্ষ্ম খোঁচা ঠিকই টের পেলো জ্যোতি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চিঁড়ে।
“এমনিই, খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। ওর সাথে সেই যে শেষ কথা হয়েছে তারও দুই বছর পার হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে মনে পড়ে ওর কথা।”
“ওহ আচ্ছা। তুই-ই তো ওকে তোর সাথে যোগাযোগ করতে মানা করে দিয়েছিলি।”
জ্যোতির নিজেকে অসহায় বোধ হলো। শুষ্ক কন্ঠে বললো,
“এমন ভাবে বলছিস যেন তুই জানিস না তখন কী ঝামেলা হয়েছিলো?”
মুনিয়া চুপ করে গেলো।
জ্যোতিই আবার বললো,
“ওর নাম্বার দিতে পারবি আমাকে?”
“ওর সাথে এখন কথা হয় না আমার। সত্যি বলতে লাস্ট কথাও হয়েছে প্রায় তিন চার মাস আগে। ওর বেবিকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আর….ওর নাম্বার নেই আমার কাছে। মেসেঞ্জারে কথা হতো আমাদের।”
জ্যোতি রুদ্ধশ্বাসে বললো,
“ওর বেবি আছে?”
“হুম, এক বছর বয়স।”
“ওর বেবি,হাসবেন্ডসহ কোনো ছবি আছে তোর কাছে?”
“না, নেই।”
“ওর ফেসবুক একাউন্টে আছে? ওখানে আপলোড করে?”
“আমি এড আছি ওর সাথে, সেখানেও ছাড়ে না। ওর হাসবেন্ডের পছন্দ না।”
“ওর হাসবেন্ডের নাম যেন কী?”
“কী জানি, আমার মনে নেই।”
“মনে করে আমাকে একটু বলতে পারবি?”
“আচ্ছা মনে পড়লে তোকে জানাবো৷ কিন্তু তুই হঠাৎ এরকম জেরা করছিস কেনো ওর ব্যপারে? কী হয়েছে?”
জ্যোতি থমকে গেলো। মনে হচ্ছে উত্তেজিত হয়ে বেশি বলে ফেলেছে। কিন্তু মুনিয়াকে আগ বাড়িয়ে এসব তো জানানো যাবে না। তাই কথার মোড় ঘুরিয়ে ফেললো কৌশলে।
_____________________°_________________
“কার সাথে কথা বলছিলি?”
রত্না আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন।
জ্যোতি উত্তর দিলো,
“মুনিয়ার সাথে।”
রত্না একটু অবাক হলেন।
“ওহ। কেমন আছে ও? অনেক দিন পর কথা বললি মনে হচ্ছে? ওরা এখান থেকে গিয়েছে তো প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে।”
জ্যোতি একথা সেকথা বলে প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে ফেলে। শাহরিয়ার আজকে সকালেই জ্যোতিকে এখানে পৌঁছে দিয়ে রত্নার সাথে একটু কুশল বিনিময় করেই কাজে চলে গেছে। রত্না অবশ্য মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন একটু এতে। জামাই এসেছে অথচ একটু আপ্যায়ন করার সুযোগও পেলেন না। জ্যোতি অবশ্য মাকে বুঝিয়ে বলেছে।
রত্না জুবায়েরকে নিজের কোলে নিয়ে নাতির সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জ্যোতি সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“আম্মু, আব্বু আসবে কখন?”
“সবসময় যেই সময়ে আসে, মাগরিবের একটু আগে।”
“ওহ। আব্বুর প্রেশারের এখন কী অবস্থা? কনট্রোলে আছে?”
“আগের থেকে ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ।”
“তারপরও, একবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেকআপ করিয়ে আসা দরকার।”
“হ্যাঁ আমিও বলছিলাম। আমার কথা তো শুনে না। দেখ তুই বলে, যদি রাজি করাতে পারিস!”
___________________°__________________
জ্যোতি ডোরবেল চেপে বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে সামনে দাঁড়ায় এক নারী। জ্যোতি রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির পানে। মেয়েটি দরজা খুলে বোরকা নিকাব পরা জ্যোতির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে , যেন চেনার চেষ্টা করছে।
হুট করেই চিনতে পেরে মেয়েটি দ্রুত দরজা আটকে দিতে গেলে জ্যোতি দ্রুত দরজা ধরে ফেলে।
করুণ মুখে বলে,
“জান্নাত!! ঘরেও ঢুকতে দিবি না?”
“তুই এসেছিস কেনো এখানে? আমার ঠিকানা তোকে কে দিছে? তুই না মানা করেছিলি তোর সাথে যোগাযোগ রাখতে? এখন তুই আসছিস কেনো?”
ভীষণ অভিমানী স্বরে কথাগুলো বলে জান্নাত। বান্ধবীর দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত সে অনুভূতির গাঢ়ত্বে।
জ্যোতি আকুল স্বরে আবেদন করে,
“ভিতরে তো অন্তত ঢুকতে দে? অনেক দিন তো কথাও হয় না আমাদের। ধীরেসুস্থেই কথা বলি? তখন যত ঝাল ছাড়ার ছাড়িস আমার উপর! কিচ্ছু বলবো না!”
জান্নাত আর বাঁধা দিতে পারলো না। যতই অভিমান থাকুক, বান্ধবীর প্রতি টান এখনও বহাল আছে। তাই সরে জায়গা করে দিলো জ্যোতিকে ভিতরে ঢোকার।
#চলবে…..