#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ২৫
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
পুরো ঘরে জিনিসপত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অগোছালো মেঝের দেয়াল ঘেঁষা এককোনে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে মেয়েটা। এলোচুলগুলো তাকে পাহারাদারের ভঙ্গিতে ঘিরে রেখেছে। থেমে থেমে কান্নার দমকে দেহটি বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে।
এই দুটো দিন অরোরা কীভাবে পার করেছে সেটা সে কাউকে বলে বুঝাতে পারবে না। যেই মানুষটাকে এতোটা বিশ্বাস করেছে সে, নিজের জীবনসঙ্গী বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে এক ঝলকের জন্য বিরূপ ধারণা আনতে দেয়নি, সেই মানুষটা এতো নির্মম ভাবে তাকে ঠকাতে পারে তা সে কল্পনাতেও ভাবেনি।
হঠাৎ ফোনের বিপ বিপ আওয়াজ হলো। অরোরা কিঞ্চিৎ স্থির হলো। পরক্ষণেই আবার। তারপর আবার…।
অরোরা মাথা তুলে তাকায় সামনে দূরে দরজার সাথে পড়ে থাকা ভাঙা স্ক্রিনের ফোনটার দিকে।
মেসেজের টোন একের পর এক বেজেই চলছে। অরোরা ভীষণ ক্ষিপ্ত হলো। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে, ফোনটা আজকে গুঁড়িয়েই দিবে সে!
ফোনটা হাতে নিয়ে আরো একটা আছাড় দিতেই যাবে তখন কী মনে করে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। তাকিয়ে তার ভ্রু কুঁচকে উঠলো। ভিতরের ক্রোধ যেন আরও একবার ফণা তুললো।
লক খুলে হোয়াটসঅ্যাপে আননোন নাম্বার থেকে আসা মেসেজগুলো দেখলো সে।
ভীষণ অনুনয় করছে এক বান্দা। তাকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে অরোরার সামনে। এমন অসংখ্য মেসেজ।
অরোরা বিষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মেসেজগুলোর দিকে।
তখনও সবুজ রঙে typing শব্দটা উঠে রয়েছে উপরে।
অরোরা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরা চোখের পানি উদ্ভ্রান্তের মতো মুছে নেয়। একটা কড়া কথা লিখে ব্লক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
ফোনটা হাতে নিয়ে লিখতেই যাবে এমন সময় ওপাশ থেকে আরও একটা মেসেজ আসলো।
“আমাকে বিশ্বাস করো জান, আমি কিচ্ছু করিনি। তোমার ভাবী আমাকে ফাঁসাচ্ছে যাতে তুমি আর আমি এক না হতে পারি। তুমি না বলতে, তোমার ভাবীর সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো না? ওই মহিলা এই কারণেই এখন এভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে!”
অরোরা থমকে মেসেজটার দিকে চেয়ে থাকে। এরপর সময় কত অতিবাহিত হয়েছে তার খেয়াল নেই, তবে তার মন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছে এরই মধ্যে। ডুবন্ত মানুষ যেমন কোনো খড়কুটো পেলে আঁকড়ে ধরে অরোরাও যেন তেমনি ভাবে এই সম্ভাবনাটাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো বাঁচার আশায়।
সত্যিই তো! এমনটা তো অসম্ভব কিছু নয়? জ্যোতি তার প্রতি আক্রোশের কারণে এমন চক্রান্ত তো করতেই পারে! প্রতিশোধপরায়ণ নারীর দ্বারা সম্ভব নয় এমন কাজের অস্তিত্ব পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
অরোরা দ্রুত টাইপ করলো,
“তুমি আমাকে ঠকিয়েছো রবিন! আমি কীভাবে তোমার কথা বিশ্বাস করবো?”
মেসেজ তাৎক্ষণিকভাবে সীন হলো। ওপাশ থেকে দ্রুত প্রতিত্তোর আসলো,
“তুমি আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দেও প্লিজ। আমি তোমাকে সব খুলে বলতে চাই। আমাকে খুব বাজে ভাবে ফাঁসানো হয়েছে!”
অরোরা দ্বিধান্বিত বোধ করলো। কোনটা বিশ্বাস করবে সে? কে সত্যি বলছে?
“বলো, আমি শুনছি আমি।”
“এভাবে মেসেজে বা কলে নয়। আমি তোমার সাথে সামনাসামনি দেখা করে সব বলতে চাই। প্লিজ আমাকে এই লাস্টবারের জন্য হলেও ট্রাস্ট করো! এরপর আমি তোমার কাছ থেকে আর কিছুই চাইবো না, ট্রাস্ট মি! সব শোনার পর যদি তোমার মনে হয় আমি সত্যি বলছি, আমি ভিক্টিম কিংবা আমি প্রতারক, তখন তোমার যা খুশি মন চায় আমার সাথে করতে পারো, আই হ্যাভ নো প্রবলেম জান!”
অরোরা ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে কি শেষবারের জন্য এই একটা চেষ্টা করবে? রবিন তো সব এক্সপ্লেইন করতে চাইছে? সুযোগ দেওয়া উচিত তাকে?
__________________°__________________
জান্নাত সবে রান্না শেষ করে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য বসেছে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে কতটা বিমর্ষ ভিতর থেকে। গত দুই দিনে কত কী হয়ে গেলো। জ্যোতি সকালে এসেছিলো তার সাথে দেখা করতে। একে একে বলে গেছে প্রতিটি ঘটনা। জান্নাত সেসব শুনে আরো বিমর্ষ হয়ে গেছে।
রবিনের সাথে তার কোনো রকম যোগাযোগ হয়নি গত দুই দিনে। দ্বিধায় ভুগে কয়েকবার কলও করেছে, কিন্তু ধরেনি। সত্যি বলতে জান্নাত ভিতরে ভিতরে ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। ঝোঁকের মাথায় নিজের সংসার বাঁচাতে কী থেকে কী করেছে তখন একদমই মাথায় খেলেনি। ঝড়ের তান্ডব শেষ হওয়ার পর যেন তার হুশ ফিরেছে। আসিফের অস্বাভাবিক নীরবতা তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। সে যদি তাকে ত্যাগ করে? এতো কিছু হয়ে গেছে আসিফ বুঝি টের পায়নি এসবে জান্নাতেরও হাত ছিলো? একবারও তার সাথে বোঝাপড়া করার জন্য এই দুইদিনেও সে আসার সময় পায়নি?
জ্যোতির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নাকি সত্যি সত্যিই প্রতারণার মামলা করেছে চৌধুরীর পরিবারের উপর।
এসব শোনার পর জান্নাতের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে।
এতসব ভাবনার মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে জান্নাত সচকিত হয়ে গেলো।
গায়ের ওড়না দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো সে দরজার দিকে,
“কে?”
জান্নাতের কন্ঠ অজান্তেই একটু কেঁপে উঠলো। কিন্তু তার প্রশ্নের বিপরীতে কোনো জবাব ভেসে এলো না ওপাশ থেকে। জান্নাত কন্ঠে জোর এনে আবার প্রশ্ন করলো,
“কে?”
একটু সময়ের নীরবতা, তারপরই ভেসে এলো শান্ত কন্ঠ,
“জান, আমি।”
জান্নাতের পুরো ভিত যেন নড়ে গেলো এই একটি কন্ঠে। ভিতরে অদ্ভুত এক শিহরণ টের পেলো। সে কি ভয় পাচ্ছে? জান্নাত সাহস সঞ্চয় করে সময় নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো।
সামনের মানুষটিকে দেখে তার পৃথিবী যেন দুলে উঠলো। নাকে স্প্লিন্ট লাগানো, কপালে, গালে কয়েক জায়গায় ওয়াইটাইম লাগিয়ে রাখা, চোয়ালে, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ কেমন লালচে হয়ে আছে। অদ্ভুত এবং বিভীষিকাময় লাগছে আসিফকে দেখতে! জান্নাতের চেহারায় অজান্তেই ভয় ফুটে উঠলো, পায়ে মৃদু কাঁপন অনুভব করলো সে।
আসিফ কেমন অদ্ভুত ভাবে আবেগপ্রবণ স্বরে ডাকলো,
“জান্নাত!”
জান্নাতের ভিতরে যেন তোলপাড় আরম্ভ হলো। মনে রইলো না জ্যোতির সতর্কবার্তা, সাবধানে থাকার উপদেশ! সব ভুলে বসলো সে ওই একটু মায়াভরা ডাকে।
অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে রইলো সে তার স্বামীর দিকে। আসিফ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জান্নাতকে জড়িয়ে ধরলো আচমকা। মেয়েটার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো সে।
জান্নাত টাল সামলাতে না পেরে কিছুটা পিছিয়ে যায়। কিন্তু আটকাতে পারে না নিজেকে। সেও জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে।
দীর্ঘক্ষণ পর আসিফ তাকে ছাড়ে, ইতোমধ্যে জান্নাত ফোপাঁতে আরম্ভ করে দিয়েছে। রবিন নাক টানতে টানতে বললো,
“আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি জান!”
জান্নাত ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।
রবিন কন্ঠে অপরাধবোধ ঢেলে বললো,
“আমাকে মাফ করে দেও প্লিজ।”
জান্নাতের কান্নার বেগ বেড়ে যায় এতে, শরীর কাঁপতে থাকে কান্নার দমকে।
রবিন আগলে নেয় জান্নাতকে, মেয়েটা স্বামীর বুকে আছড়ে পরে হুহু করে কাঁদতে থাকে।
কিছুটা সময় পর জান্নাত কিছুটা স্থির হয়। তবুও একইভাবে পরে রয় আসিফের বুকে।
আচমকা তার মাথাটা যেন ঝাঁকি খেয়ে পিছনে হেলে গেলো তীব্র গতিতে। ক্ষণকালের মধ্যেই টের পেলো চুলের গোড়ায় একটা শক্ত হাতের অস্তিত্ব।
আচম্বিত এমন ঘটনায় জান্নাত বিস্মিত হতেই ভুলে গেলো। তাকে আরও তাজ্জব করে দিয়ে রবিন হিসহিসিয়ে চাপা কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার সাহস তোকে কে দিছে ফকিন্নি? আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করার এত শখ? তোর শখ আমি এমনভাবে মিটাবো যে অন্য কোনো শখ পূরণ করার জন্য বাঁইচা থাকবি না! ফকিন্নি কোথাকার!”
জান্নাত হতভম্ব হয়ে গেলো। কিন্তু চুলের গোড়ায় টানটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তাই আর্তনাদ করে উঠলো সে,
“আঃ! আসিফ ছাড়ো! ব্যথা পাচ্ছি আমি!”
“তোরে আদর করার জন্য ধরছি নাকি শালী?”
আসিফ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে, সাথে চলতে থাকে চড়থাপ্পড়। জান্নাত ছটফট করতে থাকে তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য।
একটা পর্যায়ে আসিফ জান্নাতের চুল ধরে টেনে হিড়হিড় করে নিয়ে আসে দেয়ালের সামনে, মেয়েটা কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটার কপাল সজোরে ঠুকে দেয় দেয়ালে।
একবার… দুবার….. তিনবার…..
জান্নাতের মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠে, অতঃপর তীক্ষ্ণ একটা চিনচিনে ব্যথা তীব্রগতিতে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত নিউরনে। টের পায় ক্ষীণ উষ্ণ লহুধারা গড়িয়ে নামছে কপাল বেয়ে। যন্ত্রণায় মেয়েটা ককিয়ে উঠে, কিন্তু তার ব্যথাতুর ধ্বনি বেশিদূর যেতে দেয় না মুখে সাঁড়াশি মতো চেপে বসা আসিফের শক্ত হাত।
কানের কাছে শুনতে পায় আসিফের তীব্র হিসহিসানি,
“চুপ! একদম চুপ! একটা টু শব্দ হইলে তোরে এইখানেই গাড়ায়া ফেলবো মাতারী!
জান্নাতের মনে হলো তার চোখের সামনে কেয়ামত নেমে এসেছে, সব কেমন লণ্ডভণ্ড মনে হচ্ছে তার কাছে। কী থেকে কী হলো এখনো তার ঠিকঠাক বোধগম্য হচ্ছে না!
আসিফ তাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরের মাঝখানে নিয়ে এলো, তারপর সজোরে লাথি কষালো তার পেটে। জান্নাত আৎ্ শব্দ করে ককিয়ে উঠলো আঘাতের দরুন।
আসিফ লাগাতার অশ্রাব্য ভাষায় তাকে বকে চলছে তখনও, সেই সাথে সমানতালে হাত পা চালাচ্ছে।
আসিফ আচমকা ভীষণ জোরে একটা ঘুষি মেরে বসলো জান্নাতের গালে। জান্নাতের পুরো মুখ ঝনঝনিয়ে উঠলো তৎক্ষণাৎ। কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই তার মুখের ভিতরটা রঞ্জিত হয়ে উঠলো, জিভে ঠেকলো নোনতা স্বাদ। গালটা দাঁতে লেগে ভিতরে কেটেই গেছে বিশ্রী ভাবে!
“মেয়ে কই তোর?”
হঠাৎ অপ্রকৃতস্থের মতো বলে উঠে আসিফ। জান্নাতের অর্ধচেতন মস্তিষ্ক মূহুর্তেই সচেতন হয়ে উঠলো। ভয় যেন সাঁড়াশির মতো চেপে ধরলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে!
আসিফ রুমে যেতে নিলে জান্নাত হামাগুড়ি দিয়ে বাঁধা দিতে চায়, কিন্তু আসিফ নির্মম ভাবে তাকে লাথি মেরে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আফরাকে কোলে করে নিয়ে এলো, মেয়েটা ঘুমে চোখ কচলাচ্ছে। ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছে জানোয়ারটা!
জান্নাতের কাছে বসে আসিফ ঠান্ডা গলায় হুমকি দিলো,
“তোর মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি, জিম্মি হিসেবে। যদি কাউকে টু শব্দও কিছু বলিস, বা পুলিশের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করিস, বা তোর পিরিতের বান্ধবীকে জানানোর চেষ্টা করিস, তাহলে মনে রাখিস, এই-ই তোর মেয়েকে তোর শেষ দেখা। ইহজন্মে আর কোনোদিন চোখে দেখবি না এটাকে!”
জান্নাত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কী অবলীলায় আসিফ কথাকটি বলে ফেললো!
“চুপ! কোনো সাউন্ড না! আমার কথা শুনলে মেয়ে ফেরত পাবি। নয়তো…… ”
বাকিটা উহ্য রাখলো সে। কিন্তু প্রছন্ন হুমকি বুঝতে বেগ পেতে হলো না জান্নাতের।
“মেয়েরে কোথায় গিয়ে নিয়ে আসবি সেটা জানায়া দিবো। আর এইযে, তোর ফোন আমার কাছে। তুই তো আস্ত এক মাতারী, যার খাস, তারই হাঁড়ি ফুটা করোস। কখন কী করস কওয়া যায় না। তাই ফোন এইটা আমার কাছেই থাকুক৷ যা বলছি ঠিকঠাক মনে থাকে যেন। কথার একটু নড়চড় হইলে তোর মেয়ের কোনো গ্যারান্টি নাই, বুঝলি?”
জান্নাত হামাগুড়ি দিয়ে আসিফের পা ধরতে চায় বাঁধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে, কিন্তু আসিফ লাফ দিয়ে সরে যায়।
“আসিফ, এমন করছো কেনো? ওকে কই নিয়ে যাচ্ছো? ও তো তোমারও মেয়ে, কলজে কাঁপে না তোমার?”
আসিফের মুখে কুটিল এক হাসি ফুটে উঠে,
“তাই…না? আমার মেয়ে যেহেতু, সেহেতু ওর সাথে আমি যা ইচ্ছা করতে পারি, কী বলিস?”
জান্নাত বোবা হয়ে চেয়ে থাকে মানুষরূপী অমানুষটার চেহারায়।
আসিফ চলে যেতে নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর শেষবারের মতো জান্নাতের বুকে আরও একটা লাথি মেরে বসে। তার মুখের পৈশাচিক হাসিটা তখন দেখার মতো ছিলো! এতো বিভৎস!
জান্নাত রক্তাক্ত হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকে, আধো আধো চোখে দেখতে থাকে তার কলিজার টুকরোকে নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ারত অমানুষটাকে……
নিয়তি যেন তাকে দেখে ক্রুর এক হাসি হাসলো। বাহ্! ভালোবাসার যোগ্য প্রতিদানই পেয়েছে সে!
____________________°___________________
অরোরা হালকা প্রসাধনী ব্যবহার করে চেহারার বিমর্ষভাব আড়াল করে নিলো। রেডি হয়ে নিজের পার্স হাতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।
সিড়ি বেয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে ড্রয়িং রুমে ফারিয়া বসে আছেন। অরোরাকে দেখে তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো উঠে দাঁড়ালেন,
“কোথায় যাচ্ছো?”
অরোরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। রবিন বারবার বলেছে কাউকে কিছু জানাতে না। তার পুরো পরিবার ষড়যন্ত্র করছে তাকে আর তার ভালোবাসাকে নিয়ে। সে রবিনের সাথে দেখা করতে আসছে জানলে তাকে তারা মোটেও আসতে দিবে না।
তাই থেমে ঠান্ডা মাথায় বললো,
“আমি একটু বাইরে যেতে চাচ্ছি। একটু একা থাকতে চাই আমি।”
ফারিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এলো,
“এখন এই অবস্থায় তোমার বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।”
অরোরা শীতল কণ্ঠে বললো,
“কেনো? কোন অবস্থা? কী হয়েছে আমার?”
ফারিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,
“অরু, মা আমার। একটু শক্ত হও সোনা। এভাবে ভেঙে পড়ো না। জানি তোমার সাথে ভালো কিছু হয়নি, কিন্তু তাও নিজেকে সামলাও, আমরা আছি তো।”
“ওহ মা! তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেনো? কী হয়েছে আমার সাথে? কিছুই হয়নি। এমন ইন্সিডেন্ট প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ের সাথে হয়৷ আমি এতো দূর্বল চিত্তের না যে নিজেকে সামলাতে পারবো না। আমার এখন নিজেকে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন, একটু সময় দিলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো। তুমি টেনশন নিও না।”
ফারিয়া হকচকিয়ে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। এই অরোরা আর গত দুইদিনের অরোরার সাথে যেন আকাশপাতাল তফাত! বিষয়টা তাকে বিস্মিত করছে। তবুও একটু স্বস্তি বোধ করলেন মেয়ের ভিতরে স্থিতি দেখতে পেয়ে।
“মা, আমি যাই? একটু ঘুরেফিরে আসি বাইরে থেকে, বেটার ফিল করবো।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি–”
“লাগবে না মা, আমি একটু একা থাকতে চাই, বলেছিই তো।
অরোরা নরম গলায় বলে। ফারিয়া আর দ্বিমত করলেন না। তার নিকট মেয়ের মানসিক শান্তিই এই মূহুর্তে মূখ্য।
” ঠিক আছে, তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু সাবধানে থাকবে। কতক্ষণের জন্য বের হচ্ছো? বেশিক্ষণ বাইরে থাকার দরকার নেই।”
“এই দুই তিন ঘন্টা। আর আমাকে কল টল দিয়ে ডিসটার্ব করো না কেমন, আমি কিছুটা সময় সবার থেকে দূরে থাকতে চাই। তাই ফোনটা অফ রাখবো।”
ফারিয়া প্রতিবাদ করে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু অরোরা থামিয়ে দিলো,
“মা, প্লিজ! আমি একটু মানসিক শান্তি চাই! এখন তোমরা অন্তত আমাকে প্রেসার দিও না!”
ফারিয়া দমে গেলেন। মেয়েকে বাঁধা দেওয়ার সাহস হলো না তার।
অরোরা বেরিয়ে গেলো শাহবাজ ম্যানশন থেকে, কিন্তু বোকা মেয়েটি কল্পনাও করতে পারলো না তার সাথে কী হতে যাচ্ছে!
#চলবে……
#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ২৬
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
চোখ খোলার পর নিজেকে মাঝারি সাইজের আবদ্ধ একটা কামরায় বাঁধা অবস্থায় পেলো অরোরা। ঘরের সিলিংয়ে কম পাওয়ারি একটা টিউবলাইট জ্বলছে। কতক্ষণ চোখ পিটপিট করে চোখে এই আবছা আলোই সয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো সে।
মনে করার চেষ্টা করলো সে এখন কোথায় আছে। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছে না সে তাৎক্ষণিক ভাবে। ছাড়া পাওয়ার জন্য চেয়ারে বাঁধা দুটি হাত মোচড়ামুচড়ি করা আরম্ভ করে দিলো। কিন্তু হাতের চামড়া ছিলে যাওয়া ছাড়া কোনো লাভ হলো না।
একটু স্থির হওয়ার পর তার আবছা আবছা ভাবে মনে পড়তে শুরু করলো আগের ঘটনাগুলো।
সে তো রবিনের সাথে ছিলো। বাসা থেকে রিকশায় করে কিছুটা দূরে নেমে তার জন্য অপেক্ষারত রবিনের গাড়িতে উঠেছিলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।
রবিন কোথায়?
অরোরা অস্থির হয়ে “রবিন!রবিন!” বলে চিল্লিয়ে ডাকতে থাকে। কিন্তু কেউ আসে না তার চিৎকার শুনে। ধীরে ধীরে অরোরার মস্তিষ্ক বিপদ সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। কে নিয়ে এসেছে তাকে এখানে? রবিনকে কোথায় রেখেছে? তারা কি কিডন্যাপারদের চক্করে পড়েছে? ভয়ে অরোরা ফুঁপিয়ে উঠলো।
নিজেকে সামলে পুরো ঘরে চোখ বুলাতে থাকলো ভয়ার্ত ভাবে।
ঘরের দেয়ালের একপাশে অনেকগুলো লোহার রডসহ কী কী যেন রাখা। আরেকপাশে সিগারেটের বেশ কিছু উচ্ছিষ্ট, সাথে কয়েকটি প্লাস্টিকের বোতল খালি অবস্থায় পড়ে আছে। তার সম্মুখের লোহার দরজাটা সম্ভবত বাইরে দিয়ে আটকানো, পিছনে সাইড তো সে দেখতেই পারছে না পিঠ বরাবর হওয়ায়।
রুমের শ্রী দেখে তার ভয় যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।
এরপর কত সময় অতিবাহিত হয়েছে মনে নেই, তবে অরোরা আন্দাজ করলো দশ- পনেরো মিনিট পর বাইরে থেকে ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেলো সে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে ততক্ষণে দরজা খুলে কেউ একজন ঢুকেছে। হাতে একটা চেয়ার। চেয়ার ক্যাচক্যাচ শব্দে টেনে তার সম্মুখে বসলো লোকটা।
রবিন!
অরোরা প্রায় চিল্লিয়ে বললো,
“রবিন! এটা কী ধরনের ফাজলামো! আমাকে এখানে বেঁধে রাখার মানে কী? আমাকে তুমি বেঁধেছো? জলদি খুলো, নাহলে তোমাকে জবাই করে ফেলবো!”
রবিন শান্ত কন্ঠে বললো,
“খুলার উদ্দেশ্যেই তো বেঁধেছি। আমার কথা ঠিকঠাক শুনো, তাহলেই খুলে দিবো।”
“মানে? আর ইউ ম্যাড? আমার ভাই তোমাকে খুন করে ফেলবে যদি জানতে পারে তুমি আমার সাথে এমন কিছু করেছো!”
“সব নষ্টের গোড়া তো তোমার ভাই-ই!”
“মানে?”
“পানি খাবে ডার্লিং? পিপাসা পেয়েছে?”
অরোরা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“তোমার রক্ত খাবো! এতে যদি পিপাসা কিছুটা কমে আমার!”
রবিন শব্দ করে হেসে ফেললো।
“তোমার তেজ জিনিসটাও অদ্ভুত। এখনো কমে নাই। যদিও আমি তেজি মেয়ে পছন্দ করি না, পছন্দের লিস্টে অলওয়েজ ভোলাভালা বোকাসোকা মেয়ে মানুষ থাকে, কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে বিষয়টা ব্যতিক্রম। মাঝে মধ্যে টেস্ট বাড ব্যতিক্রম কিছু চায়।”
অরোরা শান্ত হয়।নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
“আমাকে কিডন্যাপ করেছো তুমি? এখন আমার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করবে, তাই তো?”
রবিন হাসতে শুরু করে কথাটা শুনে। অরোরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে থাকে সেটা।
“তোমার কি মনে হয় টাকাপয়সা কম আছে আমার? শেষ মেশ মেয়ে অপহরণ করে টাকা কামাইতে হবে আমাকে?”
অরোরা এবার কিছুটা ভীত হয়। কিন্তু নিজের মধ্যেই সেটা চেপে রেখে বললো,
“তাহলে কীসের জন্য আমাকে এখানে এনেছো?”
রবিন প্রত্যুত্তরে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে চোয়াল শক্ত করে অরোরার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“তোমার পরিবারকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সবার সামনে আমাকে, আমার ভাইকে মারধর করেছে। আমার বাবাকে গালমন্দ করেছে। তোমার ভাই আমাকে যা পেরেছে তাই বলেছে। আমার পরিবারের উপর মামলা করেছে তোমার পরিবার। তোমার মনে হয় এত কিছুর পরেও আমি ছেড়ে দিবো তোমাদের?”
অরোরা এবার ক্ষেপে যায়,
“আমার ভাই যা যা করেছে একদম ঠিক করেছে! তুমি ভালো? আমাকে ঠকাওনি তুমি? এক বাচ্চার বাপ হয়ে আমার সাথে সম্পর্কে জড়াওনি?”
রবিন হিংস্র হয়ে বলে,
“এত সব যখন বের করেছে তখন বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই কেনো বের করলো না? বিয়ের কথা সবাইকে জানানোর পর এই ধরনের ঢঙের কী মানে?”
অরোরা বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকে। এই ছেলে আদোও সুস্থ মস্তিষ্কের তো? অরোরার নিজেকে কষে কয়েকটা চড়থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলো। জেনে-বুঝে বিপদ বয়ে এনেছে ঘাড়ে করে!
“রবিন, আমাকে ছেড়ে দেও। আমি বিষয়টা চেপে যাবো। নয়তো তুমি কল্পনাও করতে পারবে না আমার বাবা ভাই তোমাদের কী হাল করবে।”
রবিন মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
“ঠিক আছে, ছেড়ে দিবো। আমার কথা শুনে নেও চুপচাপ। কোনোরকম ঝামেলা ছাড়া চুপচাপ বিয়ে করে নেও আমাকে। কাগজপত্রের ব্যবস্থা আমি করে নিয়েছি!”
“মানে!”
রবিন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
“নেহাৎ তোমার উপর মন এসে গিয়েছিলো আমার। তাই বিয়ে পর্যন্ত আগিয়েছিলাম পারিবারিক ভাবে। নয়তো আমার জন্য কি মেয়ের অভাব ছিলো?”
বলে থামে সে। তারপর হিংস্র ভাবে বললো,
“কিন্তু এখন আমার জেদ চেপে গেছে! তোমার ভাই আমাকে কীসব বলেছিলো যেন? লুচ্চা লাফাঙ্গা, জোচ্চর, আরো কী কী, তাই না? এখন যখন তার বোন এই লুচ্চা লাফাঙ্গাকেই বিয়ে করবে, তখন দেখবো সে কী করে! তার মুখের রঙ পরিবর্তনটা আমি অনেক আনন্দ নিয়ে দেখবো। আমার পরিবারের উপর মামলা করেছে তাই না? সব শুধে আসলে মিটিয়ে দিবো হারামীটাকে! কোথাও মুখ দেখানোর অবস্থায় রাখেনি আমাদেরকে!”
অরোরাও দাঁত কিড়মিড় করে হিংস্র ভঙ্গিতে বললো,
“আমার বাবা তোকে তো খুন করবে করবেই, সেই সাথে আমাকেও করবে এমন কিছু হলে! এখনো চিনিসনি আমার বাপ ভাইকে! আমি তোকে বিয়ে করে নিবো আর আমার ফ্যামলি আমাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিবে, তাই না? রিডিকিউলাস! মরে গেলেও তো আমি তোকে বিয়ে করবো না এখন!”
“ওকে ফাইন! না কর বিয়ে। যতক্ষণ না নিজ ইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিস ততক্ষণ এইখানেই পড়ে থাক! সেটা হোক একঘন্টা, হোক একদিন, অথবা হোক এক বছর! তোরে আমি এমনে এমনে ছাড়তাছি না! তোর ফ্যামেলির তেজ আমিও দেখে ছাড়বো!”
“আমাকে হয়তো এতক্ষণে খোঁজা শুরুও হয়ে গেছে। তোরে একবার পাইলে ছিঁড়ে খাবে দেখিস!”
“ওহহো, ভালো কথা মনে করছিস। তুই আমার কাছে আসছোস এটা তো কেউ জানে না। তাহলে আমাকে সন্দেহ করার তো কোনো লজিকই নাই। এরমধ্যে যদি তোর বাপের নাম্বারে সুইসাইড নোট পাঠাই তাহলে তো আর তোরে খুঁজবে, তোর লাশ খুঁজবে তোর ফ্যামেলি, কী বলোস? তোর ফোনটাও তো আমার কাছে, পাসওয়ার্ডও জানি। আমার কাজ আরও ইজি হয়ে যাবে।”
অরোরা তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়লো। কতক্ষণ গালমন্দ করে বললো,
“আমি আমার প্যারেন্টসকে কিছু বলিনি বলেছি। কিন্তু আমার ভাবীকে ঠিকই বলে এসেছি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভাবী ভাইয়াকে বলেও দিছে!”
রবিন পরিহাসের হাসি হেসে বললো,
“মিথ্যুক কোথাকার! কথা ঘুরিয়ে লাভ নাই, আগেই বলে ফেলছোস সত্যি কথা। আচ্ছা, তুই থাক এইখানে, মশার কামড় খা। আমার কাজ আছে!”
বলে রুবিন শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। পিছন থেকে অরোরা রাগে চেচামেচি করতে থাকলো।
_____________________°____________________
অরোরা গিয়েছে প্রায় চার ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে। বাসার সবাই দুশ্চিন্তা শুরু করে দিয়েছে। সোহাইল সাহেব বিরক্ত হয়ে স্ত্রীকে বললেন,
“তুমি কি পাগল? ওকে এই অবস্থায় একা ছাড়লে কেনো? একবারও আমাদেরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? দিনদিন বুদ্ধি হাঁটুতে নামছে! বেকুব কোথাকার!”
ফারিয়া বিমর্ষ হয়ে নত মুখে বসে থাকেন।
শাহরিয়ার পায়চারি করতে করতে অরোরার নাম্বারে ডায়াল করে। কিন্তু কল কানেক্ট হচ্ছে না, সুইচড অফ বলছে বারবার। গত পনেরো বিশ মিনিট ধরে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাকিরাও চেষ্টা করছে, কিন্তু ফলাফল একই।
“বাবা, কল যাচ্ছে না তো!”
শাহরিয়ার অস্থির হয়ে বললো।
সোহাইল সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন। ভিতরে দুশ্চিন্তা তার পাহাড়সম হয়ে আছে।
কতক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ফারিয়াকে বললেন,
“ওর ফ্রেন্ডদের বাসায় গিয়েছে? নাম্বার আছে তোমার কাছে কারো?”
ফারিয়া করুণ ভাবে মাথা নাড়লেন।
“ও বলছিলো একা থাকতে চাচ্ছে কিছুটা সময়।”
সোহাইল দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড় করলেন,
“ইডিয়ট!”
“বাবা, মিসিং রিপোর্ট করবো?”
মাহিরা বলে উঠলো,
“আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে ভালো হতো না?”
সোহাইল খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
“ও ফোন রিসিভ করছে না, ফোন বন্ধ। আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয়? শাহরিয়ার, গাড়ি বের করো। থানায় যাচ্ছি আমরা।”
শাহরিয়ার বাবার কথামতো কাজ করলো, পনেরো মিনিটের মাথায় গাড়ি নিয়ে বাবা ছেলে কিছু জরুরি কাগজপত্র সমেত বেড়িয়ে গেলেন।
জ্যোতি সবার অস্থিরতা দেখছিলো। তার নিজেরও চিন্তা হচ্ছে। জুবায়েরকে মিতুর কাছে রেখে এসেছে সে।
ফারিয়াকে দেখলো হাতের আঁজলায় মুখ ঢেকে ফোঁপাচ্ছেন। মাহিরাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ভীষণ খারাপ লাগছে তার এই পরিস্থিতিতে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে শাশুড়ীর পাশে বসলো। প্রথমে দ্বিধা বোধ করলো ভীষণ, তারপর দ্বিধা ঝেড়ে আলতো হাতে শাশুড়ীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো,
“টেনশন করবেন না আন্টি, আল্লাহর কাছে দুআ করেন যেন অরু সহিসালামতে বাসায় ফিরে আসে।”
এমন উষ্ণ সহানুভূতিতে ফারিয়ার কান্নার তোড় আরও তীব্র হলো। ফোপাঁতে ফোপাঁতে কান্নাজরিত কন্ঠে বললেন,
“সব আমার দোষ! আমি কেনো ওকে যেতে দিলাম! আল্লাহ জানে আমার মেয়েটা কোথায় কোন বিপদে আছে।”
জ্যোতি সব ভেদ ভুলে ফারিয়া জড়িয়ে ধরলো, আর্দ্র কন্ঠে বললো,
“ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। অরোরা ফিরে আসবে। নিজেকে দোষারোপ করবেন না প্লিজ।”
মাহিরাও এগিয়ে এসে মাকে সান্ত্বনা দিলো।
_____________________°_____________________
কলিং বেলের ঘনঘন আওয়াজে জান্নাত ভীষণ কষ্টেসৃষ্টে মাথা তুললো। কপাল ফুলে তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে, শরীরে, মুখে বিভিন্ন জায়গায় কালশিটে দাগ, গাল ফোলা৷ শোকে, ব্যথায় গত কাল থেকে জ্বরের ঘোরে আছে সে।
মেয়েকে হারানোর শোক যেনো ব্যথার উপরেও প্রকট হয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তার ভিতর অবশিষ্ট নেই আর কিছু।
কলিং বেলের এমন হুংকারে ব্যথায়, শোকে জর্জরিত দেহ নিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।
কে এসেছে? একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও বোধ করলো না। গায়ে ওড়না জড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে সামনে তাকালো।
মনে হলো সে যেন স্বপ্ন দেখছে।
আফরা! তার বুকের মানিক! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো রবিনের কোলে থাকা আফরার দিকে। আফরা মাকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। ঝাপিয়ে পড়তে চাইলো কাঁদো কাঁদো মুখ করে মায়ের কোলে, কিন্তু রবিন আটকে ফেললো। মেয়েটা কাঁদতে আরম্ভ করলো মায়ের কোলে যেতে না পারার ব্যর্থতায়। জান্নাত হুশ ফিরতেই উদ্ভ্রান্তের মতো মেয়েকে কোলে নিতে চাইলে রবিন তাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়।
জান্নাত হুহু করে কাঁদতে থাকে।
“আমার কোলে দেও ওকে! কী হাল করেছো একদিনেই তুমি ওর! ওর চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
বলে নিজেই কেড়ে নিলো মেয়েকে রবিনের কোল থেকে। নিজের ভগ্ন দেহ উপেক্ষা করে মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো।
রবিন হাতদুটো আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে দৃশ্যটা দেখতে থাকে কঠিন মুখে।
কিছুক্ষণ পর জান্নাতকে কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন করে,
“মেয়েকে লাগবে তোর? নাকি নিয়ে যাবো আমি?”
জান্নাত জলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় মানুষটার দিকে।
“মেয়েকে একদিন ঠিকমতো রাখতে পারোনি, নেওয়ার কথা কোন মুখে বলছো বেশরম?”
রবিন রাগে জান্নাতকে মারতে এগিয়ে যায়, জান্নাত ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ। রবিন থমকে গিয়ে লক্ষ্য করে মেয়েটার সুন্দর মুখের বিভৎস রূপ। পুরো মুখ জুড়ে আঘাতের চিহ্ন, এবং সেগুলো তারই দেওয়া। ডাক্তার দেখায়নি মেয়েটা? ভিতরে অদ্ভুত এক শিহরণ টের পেলো সে। মারার জন্য উঠানো হাতটা নামিয়ে নেয় আস্তে করে, তারপর কঠিন কন্ঠে বলে,
“আমার সাথে মুখ সামলে কথা বলবি। কে বেশরম? আমি? তুই অনেক লজ্জাবান তাই না? এজন্যই তো প্রেমিকের হাত ধরে বাপ মা ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলি!”
জান্নাত যেন বোবা হয়ে যায়। কেমন বোবা দৃষ্টিতে তাকালো রবিনের দিকে। সে তাকে মাত্র কী কথাটা বললো? তার পালিয়ে আসা নিয়ে খোঁটা দিলো সে মাত্র?
জান্নাতের আজ অনেক দিন পর চোখের সামনে বাবা মায়ের চেহারা ভেসে উঠলো। মায়ের কান্নারত মুখটা ভাসতেই তার ভিতরে কান্না দলা পাকিয়ে উঠলো। সে কোন মরিচীকার জন্য নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে এসেছে?
ঘৃণাভরা দৃষ্টি হানলো সে ওই মানুষটার দিকে, মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারণ করতেও তার রুচিতে বাঁধলো।
রবিন সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো,
“তোর মেয়েকে তোর কাছে দেবো,তবে শর্ত আছে। তোর আর আমার মধ্যে যাই হয়েছে সেটা তুই কাউকে বলতে পারবি না। যদি বলোস, জান্নাত তুই আমাকে চিনোস না, পাতাল থেকে হলেও তোকে খুঁজে বার করবো, তারপর চিঁড়ে দুই ভাগ করে ফেলবো! তোকেও, তোর মেয়েকেও!”
জান্নাত চোয়াল শক্ত করে হুমকিটুকু শুনলো। তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমার মেয়েকে আমার কাছেই দিচ্ছো তাহলে?”
“শর্তে রাজি থাকলে।”
“মঞ্জুর। আমার ফোন?”
“ওটা আমি ভেঙে ফেলেছি, তারপর কোথাও একটা ফেলে দিয়েছি, মনে নেই।”
জান্নাত শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সম্মুখে। সে এখন যে কোনো অনুভূতির উর্ধ্বে চলে গিয়েছে।
“মনে থাকে যেন সব।”
বলে রবিন চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে জান্নাত পেছনে থেকে ডাকে,
“তুমি তাহলে আমাকে ত্যাগ করছো?”
রবিন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
“কোনো সন্দেহ আছে?”
জান্নাত একটা দম নেয়। তারপর ভীষণ শীতল কণ্ঠে বলে,
“তাহলে ধর্ম মতেও আমাকে ত্যাগ করো! তোমাকে ছাড়া বাঁচা এতো কঠিন কিছু না সেটা আমি বুঝে গেছি। যেভাবেই হোক আমি আমার মেয়েকে নিয়ে দিন পার করে ফেলতে পারবো।”
রবিনের ভিতরটা শিরশির করে উঠলো ওই কন্ঠে।
তারপর বললো,
“যেমন তোমার ইচ্ছে!”
তারপর একটু ভাবলো কিছুক্ষণ, অতঃপর বড় করে শ্বাস টেনে নিয়ে উচ্চারণ করলো,
“তালাক, তালাক, তালাক!”
জান্নাতের টলটলে চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
“আর আইনীমতে?”
“আইনি ঝামেলায় পড়বে না তুমি, ওসব আমি আগেই ক্লিয়ার করে ফেলেছি!”
জান্নাত তীব্র তিরস্কারের ভঙ্গিতে মেঝেতে থুতু ফেললো। চেহারায় তার স্পষ্ট উপহাস। রবিনের কোনো ভাবান্তর হলো না এতে।
“তোমার কাছে টাকা পয়সা আছে? না থাকলে আমি কিছু দিয়ে যেতে পারি।”
“তোর টাকা তুই খা! আপাতত আমার বাসা থেকে বের হো, আর কিছু লাগবে না আমার।”
রবিন কাচুমাচু ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো ছোট্ট এপার্টমেন্টটা থেকে। তার অনুভূত হতে লাগলো যেন তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে!
__________________°_________________
“কত বড় গর্দভের দল এগুলা! বলে চব্বিশ ঘণ্টা পর মিসিং ফাইল করতে! আমার মেয়ে নাকি ঘুরতে বেরিয়েছে কোনো বন্ধুর সাথে! তখন যে ঘুষি মেরে নাকমুখ ফাটিয়ে দেইনি এটাই ওই গর্দভের সাত পুরুষের ভাগ্য!”
শাহরিয়ার গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,
“আচ্ছা, বাবা থামো এবার। রিপোর্ট তো করে এসেছি তাই না? পেয়ে যাবো ওকে, চিন্তা করো না। দোয়া করতে থাকো।”
সোহাইল সাহেব উদ্বিগ্ন মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর হোয়াটসঅ্যাপে কল এলে দেখেন মাহিরা কল দিয়েছে।
মাহিরার সাথে সংক্ষেপে কথা সেরে ফোন কেটে দেন তিনি। তারপর হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে কী মনে করে ঢুকে প্রায় চমকে উঠেন। অরোরার একাউন্ট থেকে প্রায় দুই ঘন্টা আগে মেসেজ এসেছে। আশ্চর্য! আগে কেনো দেখলেন না উনি এটা! দ্রুত মেসেজ দেখে উনি থমকে যান।
শাহরিয়ার বাবার অভিব্যক্তি দেখে অবাক হলো, উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো,
“বাবা, কী হয়েছে?”
সোহাইল সাহেব কিছু বলছে না দেখে নিজেই ফোনটা হাতে নিলো।
মেসেজটা বের করাই ছিলো,
“তোমরা আমার এসব সাথে ঠিক করলে না। একটা মানুষকে ভালোবেসেছিলাম, বিয়ে করতে নিয়েছিলাম। ওকেও অপমান করে তাড়িয়ে দিলে। তোমাদের কাছে আমার গুরুত্ব কতটুকু সেটা আমি বুঝে গেছি। আমার সাথে এরপর যা কিছু হবে তারজন্য দায়ী থাকবে শুধু তোমরা। আমি মরি, বাঁচি যা হয়ে যাই না কেনো এরজন্য তোমরাই দায়ী। আমাকে খুঁজো না, লাভ নেই। আমার লাশও যেন তোমাদের কপালে না জোটে। বাই।”
শাহরিয়ার হতবাক হয়ে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এটা অরোরা পাঠিয়েছে?
সোহাইল অদ্ভুত থমথমে মুখে বসে রইলেন। তার ভিতরের টানাপোড়েন যেন স্পষ্ট টের পাচ্ছে শাহরিয়ার। এজন্যই নিজের ভিতরে তীব্র ভয় টের পেলো সে। এবং তার ভয়টাই যেন সত্যি হলো!
(গত পর্বে একটা বিষয় ভুল করেছিলাম। রবিনের মেসেজ অরোরা যেদিন পেয়েছে তার পরেরদিন অরোরা রবিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। অর্থাৎ তিনদিন পর। আমি ভুলে দুইদিন উল্লেখ করেছিলাম।)
#চলবে……