#কন্ট্রোললেস
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৩২ ]
” বাচ্চা নাও না কেন?স্বামীরে বশ করার মূলমন্ত্র হইলো বাচ্চা-কাচ্চা বিয়ের এত বছরেও বুঝ নাই?”
পান চিবুতে চিবুতে কথাটি বলল প্রতিবেশি একজন বৃদ্ধা।তিনি এসেছেন বসেছেন টুকটাক আলাপচারিতা করেছেন ইদানীং এই বাড়িতে যে ঝামেল লেগেই আছে এসব ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছেন।উক্ত কথাটি বলেই তিনি ঘোমটা টেনে চলে গেলেন আনিকা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধার পানে।রাবেয়া হতাশার শ্বাস ছাড়লেন আনিকাকে দোষারোপ করে বলেন,
” বিয়ের এত বছর হলো বাচ্চা নিলা না কেন?বাচ্চা ছাড়া কি পুরুষ মানুষের সংসারে মন ভরে?বিয়ের এক বছরেই তো বাচ্চা নিতে হয়।”
” আম্মা আপনার ছেলেই তো বলল বাচ্চার নাম যেন দুই বছরেও না তুলি।”
” দুই বছর করে যে আরো কত বছর পার করলা সেটা কি আমার ছেলের দোষ?”
” আল্লাহ আমার গর্ভে সন্তান না দিলে আমি কি করতে পারি আম্মা?”
” তর্ক করবা না।”
” তর্ক না করে আর কতকাল থাকব?আমি বলি নাই ডাক্তার দেখাতে?আপনার ছেলে পাত্তাই দিল না।আপনিও কোন গুরুত্ব দিলেন না।”
” আমার ছেলে কেন যাবে ডাক্তারের কাছে?সমস্যা তোমার, তোমার গর্ভে বাচ্চা আসেনা তাহলে আমার ছেলে কেন ডাক্তারের কাছে যাবে?”
” আম্মা আপনি এই যুগে এসেও অবুঝের মতো কথা বললেন!”
” এই আমারে যুগের দোহাই দিবা না।এখন তো স্বামী হাত থেকে ছুটছে কি করবা করো।”
রাবেয়া প্রস্থান করলেন।এমন ভাবে কথাগুলো বললেন যেন সব দোষ আনিকার।বাচ্চা না হওয়া নিয়ে ঠিক কয়েক মাস আগেও চিন্তায় থাকলেও এখন আর চিন্তা আফসোস কিছুই করে না বরং সময়ের সাথে সাথে মনে হচ্ছে বাচ্চা না হয়ে সে বেঁচেই গেছে এই অসভ্য বর্বর লোকটা নিশ্চিয়ই নিজের বাচ্চাকেও ছাড়তো না।একটা অসুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠত কোমল শিশুটি।যা হবার হবে যা হবার দেখা যাবে।
রাশেদ ইদানীং রাতে বাড়ি ফেরে না, সৈয়দ ইসমাইল কি করবেন নিজেই ভেবে পাচ্ছেন না।তিনি সবার শালিস বৈঠকে যান এলাকার সম্মানীয় ব্যক্তি তিনি অথচ তার ঘরেই চলছে নিন্দনীয় কাজ-কারবার এসব শুনলে কি মানুষ হাসবে না?অবশ্যই হাসবে উপহাস করবে।যেদিন আনিকাকে মেরে হসপিটাল পাঠিয়েছিল সেদিনি এলাকার লোক নানান কথা তুলেছে নানা সমালোচনা হয়েছে।তার একমাত্র ছেলে যেন এক টুকরো নরক নিজের মেয়ে জামাইকে এক বেলা আদর আপ্যায়নে খাওয়াতে পারেননি কত রাত কেটে গেছে এই ছেলের চিন্তায় শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না।ব্যবসায় যাও হাত লাগিয়েছিল ইদানীং তাও ছেড়ে দিয়েছে অথচ টাকা টাকা করে নিয়মিত ঝগড়া করছে।বয়স তো বেড়েছে আর কতকাল কুলাঙ্গারটার এসব সহ্য করবেন?ছেলেটাকে এতটা উগ্র আচরণের মূল কারণ তার মা।মায়ের আশকারায় ছেলেটা ছোট থেকেই অন্যায় কাজে প্রশ্রয় পেয়েছে সাহস পেয়েছে সব মিলিয়ে এখন তার অন্যায় সহ্যের বাইরে চলে গেছে।যে ছেলে মায়ের কথায় চোখের পলক ফেলত সেই ছেলে এখন মায়ের কথা এক কানে ঢুকায় তো আরেক কান দিয়ে বের করে।
রাতের খাবার খেয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে আনিকা তার পাশেই শুয়ে আছে রাশেদ।এক বিছানায় থাকলেও মনের দিক দিয়ে বিশাল দূরত্বে তারা।কাঁদতে কাঁদতে আনিকার চোখের পানিও ফুরিয়ে এসেছে যে ছেলেটাকে ভালোবেসে গৃহ ত্যাগ করেছে সেই ছেলেটাই আজকাল তাকে তালাক দেওয়ার হুমকি দেয়।
ভালোবাসা এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়!কাকে ভালোবাসলো আনিকা?জীবনের হিসাব কষলে মনে হয় জীবনটা তার ভুলে ভরা।আবার পড়াশোনা শুরু করবে আবার সাজাবে জীবনটা কিন্তু কোথা থেকে কি যে শুরু করবে।
” ওই শুন।”
রাশেদ আচমকা হেঁচকা টেনে কাছে আনল আনিকাকে।মেয়েটা ভয় পায় শারিরীক মেলামেশা ইদানীং তাদের হয়না বললেই চলে যতবার রাশেদ তার কাছে এসেছে তাকে মারতেই এসেছে।
” ছাড়েন আমারে।”
” এত দেমাক কিসের?”
“ছাড়েন আপনার ছোঁয়া আমার বিষের মতো লাগে।”
” নতুন নাগর জুটছে নাকি?”
” ছি লজ্জা লাগে না?সবাইকে কে কি নিজের মতো ভাবেন?”
” কথা কম বল।তোর ননদরে ফোন লাগা।”
” ক..কেন?”
” বিশ হাজার টাকা দিতে বল।তুই বললে এমনেই টাকা বের হবে।”
” আপনি ভাবলেন কি করে আমি রুমুর কাছে টাকা চাইব!”
” চাইবি না কেন?উজ্জ্বল যে পরিমান ইনকাম করতেছে তোর ধারণা আছে?”
” সে তার পরিশ্রম সততা দিয়ে ইনকাম করতেছে আপনার জুয়া খেলার জন্য আমি তার কাছে টাকা চাইব?ভুল ভাবলেন।”
আচমকা আনিকার চুল টেনে ধরল রাশেদ।টনটনে ব্যথায় দাঁত মুখ খিচে রইল মেয়েটি।
” তোরে তালাক দিব বেশি গ্যাঞ্জাম করলে আজ রাতেই দিব।”
” দেন তালাক দেন।ভয় পাই না আমি।”
” কি পাস না?”
” ভয় পাই না।”
দৃঢ় কণ্ঠে বলল আনিকা।রাশেদ যেন আরো রেগে যায় টেনে ধরে মেয়েটার চুল।যে স্বামীর হাতে ভালোবাসার ছোঁয়া ছিল আজকাল সেই স্বামীর হাতে যন্ত্রণার ছোঁয়া।
” খা** নাগর পাইছিস নতুন নাগর পেয়েই তোর গলার আওয়াজ এত ধারালো হইলো।”
” চুল ছাড়েন অনেক সহ্য করছি আর না।”
” কি করবি তুই?”
” পুলিশের কাছে যাব।”
রাশেদ হো হো শব্দে হেসে উঠল।তাদের কুৎসিত হাসিতে গায়ে কাটা তুলল আনিকার।মেয়েটা এবার ভয় পেল এই ভয়ার্ত চাহনিটা ঠিকি ধরে ফেলল রাশেদ।
” পুলিশ তোর নতুন নাগর নাকি?”
শেষোক্ত কথাটি বলেই আনকাকে বিছানা থেকে ছুড়ে ফেল দিল নিচে।আনিকা উঠে বসার আগেই মাটির বড় ফুলদানিটা ছুড়ে ফেলল তার মাথায়।নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ফুলদানি ভাঙার শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।চিনচিন ব্যথায় দ্রুত মাথায় হাত রাখল আনিকা রক্তে ভেসে যাচ্ছে কপাল।এই রক্তাক্ত শরীর দেখে রাশেদের মায়া হয় না বরং একে একে গালি ছুড়তে থাকে আনিকাও আর সহ্য করতে পারে না ছোট টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাস দিয়ে মাথায় বারি মা র ল রাশেদের।আনিকা এমন কাজ করতে পারবে স্বপ্নেও ভাবেনি রাশেদ তার মাথা না ফাটলেও প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে।
.
উজ্জ্বল আজ ভীষণ ব্যস্ত তার রেস্টুরেন্টটা সম্পূর্ণ আবারো সাজানো হয়েছে বাড়ি ঘর সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের কাজ চলছে তার বন্ধু দেশে আসবে।উজ্জ্বলের পাশাপাশি রুমুও ভীষণ আগ্রহের সহিত কাজ করছে কিন্তু তার কাজের গতিক থেমে যায় আনিকার সহিত কথা বলে।রাশেদ যে দিনকে দিন তার অত্যাচার বাড়িয়ে দিচ্ছে এসব আর মানা যাচ্ছে না এর একটা সমাধান দরকার।সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত দেহ টেনে বিছানায় শুলো উজ্জ্বল রুমু এসে বসল তার পাশেই।
” উজ্জ্বল আপনার সাথে কথা আছে।”
” বল।”
” আনিকা ভাবীর কিছু একটা করা উচিত রাশেদ জানোয়ারটা তাকে গতকালো মেরেছে।”
” কি করবি তুই?তুই নিজেই তো মার খাবি।”
” আমি একা তো পারবো না আপনিও আমার সাথে থাকবেন।আজকাল নাকি তালাক দেবে বলে হুমকি দেয়।”
” তো দিচ্ছে না কেন?মেয়েটা অন্তত বেঁচে যায়।”
” আমিও তাই চাই।”
” সেসব পরে হবে।সারাদিন অনেক কাজ করেছিস এখন রেস্ট কর।”
” আপনার বন্ধুরা কখন আসবে?”
” ঢাকায় এসে তো পৌঁছে গেছে কালকেই এখানে আসবে।”
উজ্জ্বল হঠাৎ চুপসে গেল কিছু বলবে করেও বলার সাহস পায় না।রুমু তার চোরা চাহনিটা ঠিকি ধরে ফেলে।
” উজ্জ্বল আপনি কি কিছু বলবেন?”
” ইয়ে মানে রুমু তোর ভাই একটা মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়েছে তাকে নাকি বিয়েও করবে।”
” কে সেই মেয়ে?”
” মেয়েটার নাম ময়না ডিভোর্সি।”
” তবে ওই মেয়ের কাছেই চলেন।মেয়েটাকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাশেদের সঙ্গ ছাড়বে।”
” লাভ নেই মেয়েটা সব জানে।”
” কি বেয়াদব মেয়েরে বাবা হাতে ধরে নিজের বিপদ ডাকছে।”
” এসব মেয়েকে বলেও লাভ নেই রুমু জেনে শুনে যখন এমন করছে নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনবে না।”
” হুম তা ঠিক।”
রুমু উঠে দাঁড়াল কিছু ভেবে ফিরে আসল পুনরায়।ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে বসল উজ্জ্বলের পাশে।
” কিরে ছুরি আনলি কেন?”
” আনিকা ভাবীর সংসার তছনছের পেছনে মূল কারণ বিয়ের এত বছরেও বাচ্চা না নেওয়া এতে নাকি রাশেদ ভাই বিগড়ে গেছে সংসারে মন হারিয়েছে।”
” তোর ভাই কি বিয়ের আগে খুব ভালো ছিল?”
” কথা শেষ করতে দিন।”
” বল।”
” পাশের বাসার চাচি এটাই বলল।আজ আমাকে পরামর্শ দিয়ে গেল এই বছরেই যেন বাচ্চা নিয়ে ফেলি তা না হলে আপনিও সংসারে মন হারাবেন।”
রুমু আচমকাই উজ্জ্বলের গলায় ধারাল ছুরিটা চেপে ধরল।উজ্জ্বল হাসবে নাকি কাঁদবে তার প্রতিক্রিয়া বোঝাতে ব্যর্থ।
” তুই দেখি আজকাল পাড়া প্রতিবেশির কথা খুব শুনিস।”
” আজ শেষ বারের মতো দেখিয়ে যাচ্ছি শুধু আমার ভালোবাসায় আঘাত দেন গলা কে টে ফেলব মাইন্ড ইট।”
” ওকে ওকে।সেম টু ইয়ু ওকে?”
” বাচ্চা কি নিব?”
” আগে বাচ্চা বানান কর তারপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।”
চলবে…