কমলা রঙের রোদ পর্ব-২৯+৩০

0
5

#কমলা_রঙের_রোদ [২৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

বাড়িতে বিয়ের আমেজ লেগেছে। বিয়ের কেনাকাটার দায়িত্ব পুরোটাই খুশবুর উপর পড়েছে। নিজের বিয়ের সময়ও খুশবুর কাজ করতে হয়েছে। তখন অবশ্য জানত না ওটা তার নিজের বিয়ে। শেষ মুহূর্তে এসে বউ বদল হলো। এখন খুশির বিয়ের কাজও তাকে একাই করতে হচ্ছে। বর কনেকে দিয়ে নিশ্চয় কাজ করানো যাবে না। শপিংয়ে খুশবু খুশি আর স্মরণকেও সাথে নিল। নিজের বিয়ের গহনা শাড়ি নিজের পছন্দের কেনাই ভালো। সান কার ড্রাইভ করছে। খুশবু তার পাশের সিটে। পেছনে স্মরণ খুশি। খুশবু ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দু’জনকে দেখে বলল,

-এখনও নাটক চালিয়ে যেতে হবে? এবার থাম না বোন! আর কত নাটক দেখাবি।

খুশি রাগী চোখে তাকালেও কাজ হলো না। খুশবুকে চুপ করানোর সাধ্য কার আছে?

-এত বছর প্রেম করেছিস। এখন পারিবারিক ভাবে বিয়ে হচ্ছে। তারপরও তোরা যে নাটক করছিস বাবা! মনে হচ্ছে তোদেরকে জোর করে ধরে বেঁধে বিয়ে দিচ্ছে। স্মরণ ভাই তবুও একটু কম। আমার বোনটা পাক্কা অভিনেত্রী।

-তুই কিন্তু আমার হাতে থাপ্পড় খাবি খুশবু। বেশি কথা বলছিস।

-তোমরা ঢঙ করতে পারবে, আমি বললেই যত দোষ।

দুই বোনের খোঁচাখুঁচি দেখে সান হাসছে। স্মরণ এদের মাঝে কথা বলার সাহস করল না। একটার পক্ষ নিতে গিয়ে আরেকটাকে ক্ষেপিয়ে দিবে। তার থেকে নিরপেক্ষ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

মা যে টাকা দিয়ে দিয়েছে সেই বাজেট খুবই কম। অনেক দামে দামি শাড়ি হয়তো কেনা যাবে না৷ কিন্তু সান ওদের যে মলে নিয়ে এসেছে এর সাজসজ্জা দেখেই তো খুশবুর চোখ কপালে উঠে গেল। এখান থেকে কেনাকাটা করলে এরা গায়ের চামড়া ছিঁড়ে রেখে দিবে। খুশবু সানের হাত ধরে টেনে খুশি স্মরণের থেকে একটু দূরে নিয়ে এসে কানে কানে বলল,

-এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? এদের মলের সাজসজ্জা দেখেই তো ভয় লাগছে। জামা কাপড়ের দামও নিশ্চয় অনেক রাখবে। আমি আপনার মতো এত বড়লোক না৷ আমার বাজেট কম। অন্য কোথাও চলুন।

খুশবু ভীত চোখে চারপাশে দেখছে। সান ঝুঁকে খুশবুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

-এদের একটা নিয়ম আছে। কেউ একবার ভেতরে চলে এলে কিছু না কিনে যেতে পারবে না।

খুশি চোখ ওলটাল। এটা কেমন নিয়ম! তার এই লোককে ভরসা করাই ঠিক হয়নি। গাড়িতে বসিয়ে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে জাহান্নামে ঢুকে গেছে। কাছাকাছি ওদেরকে দেখতে না পেয়ে খুশি চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।

-কোথাও গেল ওরা?

জবাবে স্মরণ বলল,

-পালিয়ে যাবে না। কাছাকাছিই কোথাও আছে হয়তো।

খুশবু শুকনো মুখে খুশিদের কাছে ফিরে এসেছে। মনে মনে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে বেচারি। খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়েই খুশি বুঝে ফেলল। কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে।

-কী হয়েছে রে?

-কিছু না।

-কিছু না হলে তোর মুখে চিন্তার ছাপ কেন?

-আরে কোথায় চিন্তার ছাপ? তুই একটু বেশি বুঝিস চল এখন।

দেখে মনে হচ্ছে এখানের স্টাফেরা সানকে আগে থেকেই চিনে। স্যার স্যার বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। কেউ কেউ তো কোল্ড ড্রিংকসের কথাও জিজ্ঞেস করে ফেলেছে।

-স্যার, কী নিবেন?

-উনাদের জন্য অ্যামেরিকানো।

-আর আপনি?

-আমি কিছু নেব না।

খুশবু সহ বাকি দু’জনও অবাক। এরা তাদের এত খাতিরযত্ন করছে কেন? নাকি এখানে যারা আসে সবাইকেই এমন খাতির করে। খুশবু মিনমিন করে সানের কানে বলল,

-আমরা কি এখানে খেতে এসেছি?

সান হেসে উত্তর দিল,

-খাওয়া শপিং দুটোই একসাথে হলে সমস্যা কী?

খুশবু এই লোকের হেয়ালি কথা একদম নিতে পারছে না। একেতো পকেটে যথেষ্ট টাকা নেই। তার উপর আবার এদের সেবাযত্ন গ্রহণ করছে। আজ কপালে কী আছে আল্লাহই জানেন।

সান শাড়ি লেহেঙ্গা দুটোই দেখাতে বলেছিল। কিন্তু খুশবু শুধু শাড়ি দেখানোর কথা বলল। খুশিও এতে সাই দিল। খুশি নিজেও ভয় পাচ্ছে। স্মরণ খুশবু নিজের মানুষ। সানের সামনে যেন লজ্জায় পড়তে না হয়। খুশির সবচেয়ে বেশি রাগ লাগছে খুশবুর উপর। এখানে কেন আসতে গেল? খুশি স্মরণের কানে কানে বলল,

-অন্য কোথাও গেলে হয় না? এখানের সবকিছু অনেক দামি মনে হচ্ছে।

-ভয় কেন পাচ্ছিস? নাকি আমাকে এখনও বেকার ভাবছিস?

-বেকার ভাবছি না। কিন্তু…

যে শাড়ি গুলো বের করে ওদের দেখাচ্ছে একেকটার গায়ের প্রাইস ট্যাগে লেখা দাম দেখে খুশবুকে হার্ট অ্যাটাক করতে হচ্ছে। সত্যিই কি এত দাম লেখা নাকি সে চোখ ভুল দেখছে? এক লাখ, দেড় লাখ, কয়েকটা দুই লাখও! এখানে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার আগে খুশবু বলল,

-আমাকে বাঁচাতে চাইলে এখান থেকে নিয়ে যান। শুধু শুধু এদের সময় নষ্ট করার জন্য এরা আমাদের জেলেও দিতে পারবে।

কার কথা কে শুনে? খুশবু চলে যাওয়ার জন্য এমন অস্থিরতা দেখাতে শুরু করলেও সান নড়ল না। যার কারণে খুশি স্মরণও উঠতে পারছে না। প্রথম মাসের বেতন আরও কিছু মিলিয়ে স্মরণের কাছে পঁয়ষট্টি হাজার টাকাই আছে। ভেবেছিল এতেই হয়তো হয়ে যাবে। খুশবু হার্টের রোগীর মতো পড়ে আছে। সান ওকে কিছু বলল না। কিন্তু খুশিকে শাড়ি পছন্দ করতে বলল। ছোট বোনের বরের মুখের উপর খুশি কিছু বলতেও পারছে না। অনিচ্ছা সত্বেও বাধ্য হয়ে তাকে শাড়ি পছন্দ করতে হলো। শুধু বউয়ের জন্য নিলে তো হবে না বরের জন্যও নিতে হবে। সানের চাপাচাপিতে স্মরণকেও শেরওয়ানি পছন্দ করতে হলো। সান খুশবুকেও নিজের জন্য পছন্দ করতে বললে খুশবু এমন ভাবে সানের দিকে তাকাল যেন চোখ দিনেই খু’ন করে ফেলবে। তাই সান খুশবুর পছন্দ জানতে না চেয়ে নিজে যেটা ভালো মনে করল নিয়ে নিল। খুশবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। না জানি কত কোটি টাকা বিল এসেছে! এরা নিশ্চয় এবার পুলিশ খবর দিবে। ওরা ভেতর থেকে ব্যাগগুলো প্যাক করে এনে নিজেরাই এগিয়ে গিয়ে সানের গাড়িতে তুলে দিয়ে দিল। সানকে দাঁড়াতে দেখে ভয়ে ভয়ে খুশবুও উঠে দাঁড়াল। সানকে চলে যেতে দেখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ও মা, এ লোক দেখি চলে যাচ্ছে! খুশবুর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করল। সান চলে গেলেও সে তো আর যেতে পারবে না। একজন স্টাফের কাছে বিল কত এসেছে জিজ্ঞেস করলে লোকটা হেসে খুশবুকে জানাল,

-আপনাকে পেমেন্ট করতে হবে না ম্যাম। আপনি যেতে পারেন।

এরকম অবাক খুশবু জীবনে হয়নি। এরা কি তাদের ফ্রি-তে ওদের শাড়ি পাঞ্জাবি দিয়ে দিবে!

-পেমেন্ট করতে হবে না! কেন?

লোকটার ঠোঁটে সামান্য হাসি। বিনীত গলায় লোকটা বলল,

-কার থেকে বিল নেব ম্যাম? এই মলের মালিক তো স্যার নিজেই। আ’ম রিয়েলি স্যরি ম্যাম। প্রথমে আপনাকে চিনতে পারিনি। আপনি স্যারের ওয়াইফ। সে হিসেবে এখন আপনিও মালিক। আপনার থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাহলে যে আমাদের চাকরি থাকবে না।

খুশবু হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে। ইতর লোক এতক্ষণ কেন বলল না উনিই এখানকার মালিক। টেনশনে টেনশনে আরও হার্টের রোগী হয়ে গিয়েছিল। ওরা চলে আসার সময় স্টাফরা তাদের বিদায় জানিয়ে আবার আসতে বলল। বাইরে বেরিয়ে খুশবু নিঃশ্বাস নিতে পারল। খুশি এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।

-তোর বর এখানকার মালিক?

-জানি না।

-তোর শ্বশুরবাড়ি কতটা বড়লোক এটাও জানিস না?

-কীভাবে জানব? আমি কী এসব নিয়ে বসে ছিলাম? জানতাম শ্বাশুড়ি মা বিজনেস উইমেন। কিন্তু উনার বিস্তর যে এতটা জানা ছিল না।

সান ওদের শপিং করিয়ে দেওয়ার বিষয়টা স্মরণ সহজ ভাবে নিতে পারছে। তার যতটুকু সামর্থ্য ছিল তা দিয়েই খুশিকে বউ সাজিয়ে ঘরে তুলতো। স্মরণ খুশবুকে বলল,

-আমরা এসব নিতে পারব না খুশবু। তোর বর হয়তো খুশি হয়েই দিয়েছে। কিন্তু আমি চাই আমার বউকে আমার উপার্জনের টাকা দিয়ে শাড়ি গহনা কিনে দেব।

খুশবু জানে স্মরণ ভাই কেমন মানুষ। কখনও কারো দয়া গ্রহণ করবে না। লোকটার কী প্রয়োজন ছিল এসব করার? উনি কত বড়লোক এটা দেখাতে চেয়েছেন? টাকাপয়সা দিয়ে এভাবে স্মরণ ভাইকে অপমান করার অধিকার ওই লোকের নেই।

সান আগেই গাড়িতে এসে বসে ছিল। খুশবু এসে পেছনের সিটে বসে বলল,

-চলুন।

সান ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বলল,

-বাকিরা কোথায়?

-ওরা পরে আসবে।

-তাহলে তুমি পেছনে বসেছ কেন? সামনে আসো।

খুশবু সানের উপর রেগে আছে। রাগ প্রকাশ করতে পারছে বলেই ভালো ভাবে কথাও বলছে না।

-কেন? এখানে বসলে কী সমস্যা?

-কোন সমস্যা না। আমি চাই না ড্রাইভ করার সময় আমার মনোযোগ অন্য কোথাও থাকুক। তুমি পেছনে বসলে আমার মনযোগ তোমার উপরই থাকবে।

খুশবু কতক্ষণ কঠিন চোখে তাকিয়ে দেখে সামনে এসে বসল। খুশবুর আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করে সান বলল,

-আমার দ্বারা কি কোন ভুল হয়েছে বেগম সাহেবা?

-ভুল! অন্যায় হয়েছে।

সান অবাক হওয়ার ভাব করে বলল,

-সে কী! কী অন্যায় করেছি আমি?

-আপনি কেন ওদের বিয়ের শপিং করে দিতে গেলেন? আপনার অনেক টাকা আছে এটাই দেখাতে চেয়েছিলেন তো? আপনি বড়লোক আমরা জানি। আপনাকে পদে পদে তা প্রমাণ করতে হবে না। স্মরণ ভাই কত কষ্ট পেয়েছে আপনার ধারণা আছে?

খুশবুর কথা শুনে সান হতবাক হয়ে বসে আছে। সে এসব কিছুই ভাবেনি। ওদের ওরকম একটা আনন্দদায়ক মুহূর্তকে নষ্ট করার তার কোন উদ্দেশ্যই ছিল না। স্মরণ খুশি কি তাকে ভুল বুঝেছে? ওরা ভুল বুঝতেই পারে। কিন্তু খুশবুও কি তাকে ভুল বুঝছে! এতদিনে এইটুকুও চিনেনি তাকে?

-তুমি কি সত্যিই ভাবছো এসব আমি জেনেশুনে করেছি?

সানের কন্ঠে কিছু একটা ছিল। খুশবু ফিল করতে পারল। কতক্ষণ সানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

-না। আমার বিশ্বাস আপনি আর যা-ই করেন কখনও কাউকে ছোট করার জন্য কিছু করবেন না।

খুশবুর এই বিশ্বাসটাই যথেষ্ট। সবাই তাকে ভুল বুঝলেও খুশবু যেন তাকে বুঝে।

-ওদের বিয়ের গিফট হিসেবে আমি ওদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। এর বেশি কিছুই ভাবিনি। তারপরও আমার এই কাজে যদি ওরা কষ্ট পেয়ে থাকে তাহলে আমি দু’জনের কাছেই ক্ষমা চেয়ে নেব।

-আপনি যদি অপরাধ না করেন তাহলে ক্ষমা কেন চাইবেন?

-অপরাধ না করি ভুল তো করেছি।

-ভুলটাও তো জেনে-বুঝে করেননি।

খুশবু তার পক্ষ নিচ্ছে দেখে সান মনে মনে খুশি হলো।

-তাহলে আমার কী করা উচিত তুমিই বলে দাও।

-আমি স্মরণ ভাইকে বোঝাব আপনার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। আপনি একটু বেশি ধনী, তাই আমাদের মতো সাধারণ চিন্তাভাবনা করতে পারেন না।

খুশবুর শেষ কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে সান বলল,

-মানে?

-মানে কিছু না। আপনি আমাদের মতো সাধারণ না এটাই বোঝাতে চেয়েছি। এবার গাড়ি ছাড়ুন তো। দেখা যাবে স্মরণ ভাই খুশিকে নিয়ে আমাদের আগে বাড়ি পৌঁছে বসে আছে। আমরা গাড়ি নিয়েও পেছনে পড়েছি।

-ওরা এখন সময়মত বাড়ি না ফিরলে সমস্যা হবে। কিন্তু আমরা রাত হয়ে গেলেও না ফিরলেও কেউ কিছু বলবে না। এর কারণ তুমি তোমার বরের সাথে আছো।

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [৩০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আজকে খুশির গায়ে হলুদ। পাড়ার কাকীরা উঠানে বসে পান খেতে খেতে গীত গাইছে। পাশেই একজনকে হলুদ বাটতে বসিয়ে দিয়েছে। হলুদ বাটতে বসে পুরোটা সময় কোন কথা বলা যাবে না। এর মাঝে তাকে যত অত্যাচারই করা হোক। খুশবু হলুদের ডালা সাজাচ্ছে। ডালায় পান, চিনি কী কী রাখতে হয় দাদী তাকে বলে দিচ্ছে। মুখ ফুলিয়ে খুশবু বলল,

-আমার বিয়েতে তো এসব কিছুই হলো না দাদী। কেউ আমাকে একটু হলুদও লাগাল না।

-তোরও নতুন কইরা বিয়া করবার শখ উঠছে নি?

-খুশির বেলায় সবকিছু দুইবার করে হচ্ছে। আমার বেলায় একবারও হলো না।

-দোষ তো তোরই। তুই-ই তো সব গোপন করছস।

দোষ যে তার না এটা দাদীকে কেন কাউকেই বোঝাতে পারবে না। দোষ সব ওই ত্যাঁদড় লোকটার। উঠানেই ছোট করে হলুদের স্টেজ বেঁধেছে। আগের বার খুশি কোনকিছুই মন থেকে করেনি। এবার ওকে সাজাতে গিয়ে খুশবু বলল,

-এইবার অন্তত মুখে হাসি রাখ আমার বোন। তোকে দেখে মনে হচ্ছে এই বিয়েটাও জোর করেই দিচ্ছে।

খুশি এই দিনটার জন্য কত অপেক্ষা করেছে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না৷ সৃষ্টিকর্তা তার প্রর্থনা কবুল করেছেন। খুশবু খুশিকে সাজাতে সাজাতে জিজ্ঞেস করল,

-তোর কেমন অনুভূতি হচ্ছে?

-বোঝাতে পারব না।

খুশবু জানে তার বোনটার জীবনে এটাই সবথেকে খুশির মুহূর্ত। খুশবু খুশিকে অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। কাঁচা ফুলের মালা দিয়ে গহনা বানিয়ে পরিয়ে দিল। আজ যেন স্মরণ ভাই খুশির উপর থেকে চোখ সরাতে না পারে।

স্মরণ সত্যিই খুশিকে দেখে চোখ সরাতে পারল না। অন্য আরেক জনও যে কিছুতেই বউয়ের উপর থেকে চোখ সারতে পারল না সে সান। চট করে একটা জিনিস চোখে পড়ল তার বউয়ের সাজ এখনও পরিপূর্ণ হয়নি।

যেহেতু বর কনে দু’জন এক বাড়িতেই থাকে তাই দু’জনের জন্য আলাদা করে স্টেজ বাঁধা হয়নি। দু’জনকে একসাথেই বসানো হলো। স্মরণ খুশির কানে কানে বলল,

-আজ থেকে ঘাড়ত্যাড়া মেয়ের আরেক নাম কুলকন্যা।

খুশি একপলক স্মরণের দিকে তাকিয়েও চোখ সরিয়ে নিল। আজকের আগে স্মরণের চোখে তাকাতে তার কোনদিন এত লজ্জা কাজ করেনি। আজ সব কিছুতেই কেমন সুখ ও লজ্জা মিশে আছে।

খুশবু কোন একটা কাজে ঘরে এসেছিল। হঠাৎ ঘাড়ের পেছনে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ঝট করে পেছনে তাকিয়ে সানকে দেখে স্বস্তি পেল।

-ওহ আপনি!

সান চোখ ছোট ছোট করে ফেলে বলল,

-অন্য আর কাকে ভেবেছিলে?

খুশবু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,

-অন্য আর কাকে ভাববো?

সান ভয় পেল, এই রে অজান্তে পাগল খেপিয়ে দিলাম নাকি? খুশবুকে রাগ বা আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে এক কদম এগিয়ে খুশবুর আরও কাছে চলে এলো। এখন ওদের মধ্যে কয়েক আঙুলের দূরত্ব মাত্র। খুশবু ড্যাবড্যাব চোখে সানের দিকে তাকিয়ে রইল। সান খুশবুর দিকে আরেকটু ঝুঁকে পেছনের টেবিলের উপর দুই হাত রেখে খুশবুকে আটকে ফেলল যেন পালিয়ে যেতে না পারে। সানকে এতটা কাছে দেখে বেচারীর নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে। বোবা জিভটাকে ঠেলে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারল তা-ও আবার অস্পষ্ট।

-ক-কী ক-করছেন?

-তুমি কেন সাজোনি?

-সেজেছি তো!

-কোথায়? আমি তো দেখতে পারছি না।

এই লোক যদি এখন তার সাজ না দেখে এতে সে কী করতে পারবে!

-ফুল শেষ হয়ে গিয়েছিল?

প্রশ্নটাই খুশবু বুঝলো না। ওকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সান ভাঙিয়েই বলল,

-তুমি কেন ফুলের গহনা পরোনি?

-আমি তো বউ না।

-তুমি আমার বউ। এবং আমি চাই এই মুহূর্তে আমার বউকে আমি নিজ হাতে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিব।

সান খুশবুর পেছনের টেবিলের উপর থেকে ফুলের ঝুড়িটা হাতে নিয়ে খুশবুর থেকে কিছুটা সরে এলো। খুশবু এবার দম ভরে শ্বাস নিল। ঝুড়ির দিকে চোখ পড়তে খুশবু অনেকটাই অবাক হলো। এই ফুলগুলো তো বাড়িতে ছিল না। এগুলো কোত্থেকে এলো? ভ্রু কুঁচকে ভাবছে এটা কি এই লোকের কাজ! সান প্রথমে খুশবুর ডান হাত ধরল। দু’হাতে মালা পরানো শেষ হলে এবার গলায় চলে এলো। খুশবু তখন কিছু বলার শক্তি না পেলেও এবার সানের হাত ধরে ফেলে প্রশ্ন করল,

-এই ফুলগুলো কি আপনি আনিয়েছেন?

সান হেসে জবাব দিল,

-না। এগুলো ঘরের চাল ফুটো করে আসমান থেকে পড়েছে।

-এগুলো কেন এনেছেন?

-যাতে আমার বউকে সাজাতে পারি।

সানের স্পষ্ট জবাব শুনে খুশবু থতমত খেয়ে গেল। বেচারি কিছু বলবে তার আগেই বইয়ে থেকে তার ডাক পড়ল।

-কিরে খুশবু, খুশিরে বসাই রাইখা কই গেলি?

তাকে ডাকছে বুঝতে পেরে খুশবু যাওয়া ধরলে সানের হাতের বাঁধনে আটকা পড়ল। কঠিন চোখে সানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমাকে ডাকছে। যেতে দিন।

-তাড়াতাড়ি যেন যেতে পারো সেজন্যই লক্ষী মেয়ের মতো দুইটা মিনিট চুপচাপ দাঁড়াও। আমার কাজ আমাকে করতে দিলেই আমিও তোমাকে যেতে দেব।

এ কেমন পাগলামি? কেউ তাকে খুঁজতে খুঁজতে এঘরে চলে এলে ইজ্জতের ছিটেফোঁটা যেটুকু বাকি আছে তা-ও শেষ হয়ে যাবে।

-কেউ চলে আসবে।

-তাই তো বলছি চুপ করে দাঁড়াতে।

খুশবু বুঝল পাগলের পাল্লায় পড়েছে সে। তাই আত্মসমর্পণ করে বলল,

-ঠিক আছে। যা করার তাড়াতাড়ি করুন।

সান খুশবুর চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুষ্টুমি হাসি ঝুলিয়ে বলল,

-অন্য কিছু করতে চাইলেও কি করতে দিবে?

খুশবু তাড়াতাড়ি আগের বাক্য সংশোধন করে বলল,

-মালা গুলো দিন। আমি নিজেই পরে নিতে পারব।

-এটা তো হবে না।

খুশবু বিরক্ত হয়ে বলল,

-ঠিক আছে তবে আপনিই পরিয়ে দিন। জলদি করুন প্লিজ।

খুশবু ঘর থেকে বেরোবার আগে বলে এসেছে সান যেন তার পেছনে পেছনেই বেরিয়ে না যায়। সে চলে যাওয়ার একটু পর যেন যায়। কারণ এতক্ষণ তারা একসাথে ছিল জানতে পারলে সবাই অনেক ক্ষেপাবে। খুশবু দেখে খুশি সহ সবাই ভীষণ প্রশংসা করল।

-বাহ খুশবু! তোরে তো অনেক সুন্দর লাগতেছে।

স্মরণ নতুন বর হলেও খুশবুকে ক্ষেপানোর সুযোগ মিস দিল না।

-ফুলের বাগান হয়ে ঘুরছিস দেখি! আজ তোর জন্য ঢাকা শহরে ফুলের অভাব দেখা দিবে।

খুশবু ঠোঁট চোখা করে বলল,

-আজ শুধু তোমার বিয়ে বলে কিছু বললাম না।

সবাই এক এক করে খুশি স্মরণকে হলুদ মাখাতে লাগল। খুশবুর পালা এলে সে দু’জনকেই হলুদ মাখিয়ে প্রায় ভূত বানিয়ে ফেলল। খুশবুকে এখন পর্যন্ত কেউ হলুদ মাখায় নি। সান এসবের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পরী বানু সানকে ঠেলে সবার সাথে আনন্দ করতে পাঠিয়ে দিল। সান প্রথমে স্মরণ খুশিকে একটু করে হলুদ মাখাল। আড়চোখে খুশবুর অবস্থান লক্ষ্য করে মুঠ ভর্তি হলুদ নিয়ে আচমকা খুশবুর মুখে মাখিয়ে দিল। খুশবু প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে ছিল। খুশবুর এমন দশা দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেউ একজন বলল,

-এবার ঠিক আছে। তোর বরই আমাদের প্রতিশোধ নিয়ে নিল।

সান তার সাথে এমনটা করেছে! খুশবু কতক্ষণ রাগে ফুসল। এর বদলা না নেওয়া অব্দি শান্তি পাবে না। খুশবু হলুদের বাটি থেকে দুই মুঠ ভর্তি করে হলুদ নিয়ে সানের দিকে এগোচ্ছে। ঘটনা বুঝতে পেরে সান দৌড়ে পালাল। কিন্তু খুশবু তো এত সহজে হার মানার পাত্রী না। খুশবুও সানের পেছনে ছুটল। সান এর ওর মাঝ দিয়ে ছুটছে। অনেকে সানকে বাঁচাতে খুশবুকে আটকাচ্ছে। খুশবু তাকে ধরতে পারবে না এটা জেনেই সান বলল,

-ধরতে পারবে আমাকে? ঠিক আছে। তুমি যদি আমায় ধরতে পারো তাহলে আমি স্বইচ্ছায় হলুদে গোসল করব।

মানছুরা এদের ছেলেমানুষী দেখে নিঃশব্দে হাসছেন। পরী বানু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

-পাগলে পাগলে মিলছে। এই পাগল নিয়া আমার চিন্তার শেষ আছিল না। ভয় করতাম কার ঘরে জানি যায়, কেমন মানুষ জানি পায়। এদের দুইটারে দেইখা আমার সব চিন্তা দূর হইয়া গেল। দুইটাই সমান পাগল। এরা সারাজীবন এমনই থাকুক। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া। এদের চার জনের জীবনই সুখে শান্তিতে কাটুন। এই জীবনে আমার আর কিছু চাওয়ার নাই।

চলবে