কমলা রঙের রোদ পর্ব-৩৫+৩৬

0
3

#কমলা_রঙের_রোদ [৩৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

বিকেলে ওদের ঘুরতে বের হবার কথা ছিল। রাতে বাইরে খেয়ে বাড়ি ফিরবে। খুশবুই সবথেকে বেশি এক্সাইটেড ছিল। রাতের বেলা ঘোরাঘুরি ওর কাছে স্বপ্নের মতো। যে স্বপ্ন বিয়ের আগে মার জন্য কখনও পূরণ হয়নি। খুশবু খুশির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

-বিকালে কী পরবি?

খুশি স্মরণের ওয়ারড্রব গোছাচ্ছে। একটা মানুষ এতটা অগোছালো হয়ে কীভাবে থাকত? কাপড়চোপড় সব একসাথে গাদা করে রেখে দিয়েছে। খুশি কাজ করতে করতেই বলল,

-সবসময় যা পরি।

-থ্রিপিস?

-হুম।

খুশবু কপালে ভাঁজ ফেলে নাক কুঁচকিয়ে ফেলল।

-তুই কি সারাজীবন একরকমই থাকবি? বিয়ের পর তো মানুষ একটু পরিবর্তন হয়। বরের সাথে প্রথম বার ঘুরতে বের হচ্ছিস। একটু শাড়ি টারি পরলে কী হয়?

-তোর মন চাইলে তুই পর।

-একসাথে যাব। তুই পরবি না আমি একা পরলে কেমন লাগবে? তুইও পর না। প্লিজ প্লিজ।

-খুশবু বিরক্ত করিস না তো।

-আমি তোকে বিরক্ত করছি?

-হ্যাঁ করছিস।

খুশবু রেগেমেগে দাঁড়িয়ে গেল। এই শয়তানের থেকে ভালো কিছু আশা করাই গাধামি। খুশবু রাগ দেখিয়ে বলল,

-তুই আসলেই একটা শয়তান। শুধু শয়তান না, শয়তানের নানী শাশুড়ি।

খুশবুর ঘুরতে যাওয়ার এত শখ, শখই রয়ে গেল। বিকালেই জানতে পারল আজ তার শাশুড়ী মা দেশে ফিরবেন। খুশবু নিজেই সানকে বলল,

-আমাদের তো তাহলে এখনই বাড়ি ফেরা উচিত। মা কতদিন পর আসছেন।

সান এই ব্যাপারটা খেয়াল করল না খুশবু এতদিন ‘আপনার মা’ করে কথা বলত। এখন নিজেই মা ডাকছে।

-হুম ফেরা তো উচিত। আমাদের জন্য ওদের প্ল্যানও খারাপ হলো। মা আজ আসবে আগে জানালে একসাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করতাম না।

-ওদের প্ল্যান কেন খারাপ হবে? ওরা যাবে। আমরা অন্য কোনদিন যাব।

এতদিন বাড়িতে ছিল। আজ চলে যাওয়ার সময় খারাপ লাগবে এটাই স্বাভাবিক। মা দাদীর থেকে বিদায় নিতে গিয়ে খুশবুর চোখ জ্বালা করতে শুরু করল। তাই সে তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। সান এক এক করে সবার থেকে বিদায় নিল। পরী বানু সানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-আবার আইসো ভাই। তোমরা চইলা গেলে বাড়িটা খালি হয়ে যাবে।

স্মরণের সাথে তার সম্পর্ক স্ত্রীর বড় ভাইয়ের থেকে গড়িয়ে বন্ধুত্বে গিয়ে পৌঁছেছে। স্মরণের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

-আসি তাহলে।

স্মরণ ওকে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,

-পাগলিটার খেয়াল রেখো। মন খারাপ করে আগেই গিয়ে গাড়িতে বসে আছে।

সান এসে ড্রাইভিং সিটে বসলেও খুশবু কিছু বলল না। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আপনজনদের পেছনে ফেলে যেতে খুশবুর কান্না পেয়ে গেল।সান খুশবুকে দেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। অনেকটা পথ কেউ কিছুই বলেনি।

-মন খারাপ?

সানের প্রশ্ন শুনে খুশবু ওর দিকে তাকাল। মন খারাপ না লুকিয়ে স্বীকার করে বলল,

-হুম।

-আমার বউয়ের মন ভালো করার জন্য কী করতে পারি?

-কিছুই না।

-তাহলে কি বউ মন খারাপ করেই থাকবে?

-না। মন এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। খুশির ভাগ্য কত ভালো, না? বিয়ে করে ওকে কোথাও যেতে হচ্ছে না। নিজের বাড়িতেই থাকতে পারবে।

-আমি কি ঘরজামাই চলে যাব? যদিও ঘরজামাই হয়ে থাকতে আমার কোন আপত্তি নেই।

খুশবু সানের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। ওকে হাসতে দেখে সানও হাসল।

-আপনি আপনার মায়ের একমাত্র সন্তান। ঘরজামাই চলে গেলে মা কাকে নিয়ে থাকবে?

-মাকেও সাথে নিয়ে যাব।

খুশবু হাসতে হাসতে বলল,

-হয়েছে, থাক। মাকে নিয়ে আপনার ঘরজামাই থাকতে হবে না। এর থেকে ভালো আমিই আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকব।

🌸

শাশুড়ি মার মন জয় করার জন্য খুশবু এতদিন তেমন বিশেষ কোন চেষ্টাই করেনি। এবাড়িতে সে নিজের মতো থাকত। কিন্তু এখন অনেক কিছুই পাল্টেছে। শাশুড়ি মার মন জয় করার জন্য আজ দুপুরের রান্না সে নিজে করেছে। ভালো রান্না খাইয়ে যে কোন মানুষের মন জয় করা যায়। কথাটা দাদী বলত। সান খুশবুকে খুঁজতে খুঁজতে নিচে এসে খালাকে জিজ্ঞেস করল,

-খালা আমার বউটাকে দেখেছ?

খালার সাথে সানের সম্পর্ক অনেকটা মা ছেলের মতো। মা নানান কাজে বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকত। বলা যায় খালাই তার সব আবদার পূরণ করেছে।

-তোমার বউ আমারে রান্নাঘর থেকে বের করে দিছে। সেই কখন থেকে নিজে কী করতাছে কে জানে?

সান ভ্রু উঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমার বউ রাঁধতেছে!

-হ।

সান রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। খুশবু এদিকে না তাকিয়েই ভাবল হয়তো খালা আবার এসেছে।

-খালা আমি বলেছি তো আমার রান্না প্রায় শেষ। সাহায্য লাগবে না। আমি রান্নাবান্না পারি। হাত-পা কিছুই পোড়াব না।

সান নিঃশব্দে খুশবুর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল। কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

-যদি পুড়িয়ে ফেলো? আমি কিন্তু আমার চাঁদের মতো বউয়ের গায়ে দাগ সহ্য করব না।

ওদের সম্পর্ক আগের থেকে অনেকটাই সহজ হয়েছে। কিন্তু খুশবু এখনও সানের এতটা কাছে আসায় অভ্যস্ত হয়নি। বিনা কারণে বেচারির বুকের ভেতর এত জোরে জোরে ধকধক শুরু হয়ে গেল যে মুখ দিয়ে কোন কথাই বেরোল না।

-বাই দ্য ওয়ে, কী রাঁধছ?

খুশবু এখনও জমে আছে। লোকটা তাকে এভাবে ধরে রাখলে সে মনে হয় নিঃশ্বাসও নিতে পারবে না।

-আমাকে খুশি করতে তোমাকে এত কষ্ট করে রাঁধতে হবে না। আদর করে তুমি একটা চুমু খেলেই আমি হাসতে হাসতে জীবন দিয়ে দিতে রাজি হয়ে যাব।

খুশবু নাক উঁচিয়ে কিছু শুঁকতে লাগল। নাকে পোড়া গন্ধ আসতেই ঝাড়ি মেরে সানকে দূরে সরিয়ে দিল। তাড়াহুড়ো করে চুলা বন্ধ করে দিয়ে সানের দিকে ফিরে রাগী কন্ঠে বলল,

-দিলেন তো আমার সব পরিশ্রম মাটি করে?

পোড়া গন্ধ সানও পেয়েছে। অপরাধী মুখে সে বলল,

-সরি।

-আপনার সরি দিয়ে এখন আমি কী করব? পোড়া রান্না কাকে খাওয়াব?

-আমি তোমার পোড়া রান্নাই খাব। তুমি তো আমার জন্যই রাঁধছিলে।

-জি না। কে বলেছে আমি আপনার জন্য রাঁধছিলাম?

সান আহত গলায় বলল,

-আমার জন্য না! তাহলে কার জন্য?

-আমার শাশুড়ি মায়ের জন্য।

সান কতক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

-শাশুড়িকে ইমপ্রেস করার ধান্ধা!

-জি। এখন আপনি এখান থেকে দূর হোন। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।

খাবার টেবিলে এসে এত আইটেম দেখে মিসেস সুলতানা রাজিয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,

-আজ এতকিছু! কেউ আসবে নাকি?

-কেউ আসবে না আপা। এইসব আপনার জন্যই করা হইছে। আপনার বৌমা নিজের হাতে সব রানছে।

তখনই খুশবু রান্নাঘর থেকে ফিরনির বাটি নিয়ে চলে এলো। মিসেস সুলতানা ওকে দেখেও কিছু বলল না। এতক্ষণে সানও এসে গেছে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

-তোমার বৌমা তোমাকে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে। এরকম ভাগ্য কয়জন শাশুড়ির হয়?

মিসেস সুলতানা একনজর টেবিলের উপর চোখ বোলালেন। সবই তার পছন্দের আইটেম। নিশ্চয় রাজিয়া জানিয়েছে। সান খুশবুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসে পড়ো।

-না। আমি পরে খাব।

-পরে কেন? আমাদের সাথে বসলে সমস্যা কী?

শাশুড়ির সামনে যেহেতু তার ছেলেকে ধমক দিতে পারবে না। তাই চোখে ইশারা করে সানকে চুপ থাকতে বলল। সান উত্তরে ঠোঁট ওলটাল। মা ছেলে খাওয়া শুরু করেছে। খুশবু ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে। না জানি কেমন রান্না হয়েছে।
সান প্রথম লোকমা মুখে নিয়েই বলল,

-উম, অমৃত! আমার বউয়ের রান্নার হাত তো মা-শা-আল্লাহ। মন চাচ্ছে এক্ষুনি রাঁধুনির হাতে চুমু খাই।

এই ঠোঁটকাটা লোকের কথা শুনে খুশবুর কান দিন ধোঁয়া বের হওয়া শুরু করল। মায়ের সামনেও এমন কথা কে বলে? মিসেস সুলতানা কোনরকম প্রতিক্রিয়াই দেখালেন না। রাজিয়া কাছাকাছিই ছিল। সানের এই কথা শুনে শব্দ করে হাসতে লাগল।

খাওয়া শেষ হলে মিসেস সুলতানা উঠে দাঁড়িয়ে খুশবুর উদ্দেশ্য বললেন,

-একটু পরে আমার রুমে এসো।

কথাটা বলে তিনি চলে গেলেন। এদিকে খুশবুর আত্মা কাঁপতে শুরু করেছে। সে ভয়ে ভয়ে সানকে জিজ্ঞেস করল,

-মা কেন ঘরে যেতে বললেন?

সান হাত চেটেপুটে খেতে খেতে জবাব দিল,

-তোমার রান্না মার এতই ভালো লেগেছে মনে হয় তোমার হাত কেটে মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখার প্ল্যান করেছে। এজন্যই একা ঘরে ডাকছে। তুমি কিন্তু যেও না।

সে ভয়ে মরছে। এদিকে এই বাজে লোক মজা করছে। ফোঁস করে দম ফেলল খুশবু। সানের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে ছিল। কিন্তু সান জানাল, তার পেট ভরেছে কিন্তু মন ভরেনি। এখানে বসে থেকেই জিরিয়ে একটু পর আবার খাবে। খুশবু চাইলে শাশুড়ির ঘরে যেতে পারে। দোয়া দুরুদ পড়ে বুকে ফু্ঁ দিয়ে খুশবু শাশুড়ির ঘরের সামনে এসে হাজির হলো। ভেতরে ঢোকার আগে অনুমতি নিলো। মিসেস সুলতানা বললেন,

-এসো। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

ধীর পায়ে খুশবু ভেতরে ঢুকলো। মিসেস সুলতানা আগেই বক্সটা নামিয়ে রেখেছিল। খুশবুকে বলল,

-হাত দাও।

খুশবু ভয় পেয়ে গেল। সানের কথা মতো সত্যি সত্যিই হাত কেটে নিবে নাকি? মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে হাত বাড়িয়ে দিল। মিসেস সুলতানা স্বর্ণের বালা দু’টো খুশবুর হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন,

-এই বালা দু’টো আমার শাশুড়ির চিহ্ন। উনি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি আজ আমার ছেলের বউকে দিলাম।

খুশবু এমনকিছু কল্পনা করেনি। সে কথা হারিয়ে ফেলে বোকার মতো তাকিয়ে আছে।

-তোমাকে আমি পছন্দ করে বিয়ে করিয়ে এবাড়িতে আনিনি। কিন্তু তুমি আমার ছেলের পছন্দ। সান আমার একমাত্র সন্তান। ওর পছন্দকে আমি অপছন্দ করতে পারি না।

শাশুড়ির ঘর থেকে বের হয়েও খুশবু এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। তার এক রান্নাতেই কাজ হয়ে যাবে কে জানত? এত তাড়াতাড়ি শাশুড়ি তাকে মেনে নিয়েছে! খুশবু ভাবছে, তার রান্না কি এতই মজা হয়েছে? রুমে গেলে সান জানতে চাইল,

-কেন ডেকেছিল তোমার শাশুড়ি?

খুশবু মুখে কিছু না বলে হাত দু’টো বাড়িয়ে দেখাল। বালা গুলো সানের চেনা। দাদী মাকে দিয়েছিল। মা তার বউকে দেওয়ার জন্য তুলে রেখেছিল।
খুশবু অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

-আপনার মা আমাকে এগুলো দিয়েছে।

সান খুশবুর কাছে এগিয়ে এলো। হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল,

-এগুলো দিয়ে মা তোমাকে ছেলের বউয়ের স্বীকৃতি দিয়েছে।

খুশবুর ঠোঁটে হাসি ফোটে উঠেছে। সান ওকে আরেকটু কাছে টেনে ঝুঁকে কপালে গভীরভাবে চুমু খেলো।

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [৩৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশবুর সুখ দুঃখ, ভালো মন্দ পেটের কথা শেয়ার করার মতো একজন মানুষই আছে। কিন্তু এই সময় তো স্মরণ ভাই অফিসে হবে। খুশিরও ফোন নেই। তাই খুশবু মায়ের ফোনে কল দিল। মার সাথে কতক্ষণ কথা বলে খুশিকে দিতে বলল। খুশি ফোন নিয়ে হ্যালো বলার সাথে সাথে খুশবু গদগদ গলায় বলে উঠল,

-জানিস আজ কী হয়েছে?

-তুই এখনও বলিস নি। বললে জানতে পারব।

-আজকে আমি রান্না করেছি।

খুশবু পুরো কথা বলে শেষ করার আগেই খুশি বলল,

-এটা কোন বড় কথা না। মানুষের খাওয়ার যোগ্য হয়েছে কি-না ওটা বড় বিষয়।

-তুই আমাকে কী মনে করিস হ্যাঁ? মানুষের খাওয়ার যোগ্য কেন হবে না?

খুশি এপাশে হাই তুলল। খুশবু যে কতবড় রাঁধুনি এটা তার থেকে ভালো কে জানবে?

-শাশুড়ি মা আমার হাতের রান্না খেয়ে খুশি হয়ে আমাকে উনার শাশুড়ির বালা উপহার দিয়েছে।

-ভালো কথা।

খুশবু এত বেশি এক্সাইটেড থাকলে কী হবে তার বোন মনে হয় কথাটা বুঝতেই পারেনি।

-আমার কাছে এখনও সব কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

-বুঝলাম। পরে?

-পরে কিছু না।

-এই কথা বলার জন্যই ফোন দিয়েছিস?

-এটা কি কোন ছোটখাটো কথা নাকি?

-অনেক বড়ো কথা কিন্তু তোর জন্য। আমার কাছে ছোট ঘটনাই মনে হচ্ছে।

বোনের সাথে নিজের খুশি শেয়ার করে সেই খুশিকে আরও বাড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন এর সাথে কথা বলে মেজাজ খারাপ হচ্ছে।

-তুই আমার সাথে সবসময় এমন করিস কেন?

-কেমন করি?

-তুই আমার সুখ দেখতে পারিস না, না?

খুশি বুঝতে পারছে এই মেয়ে কী চাচ্ছে। তাই গলায় এক বালতি ন্যাকামি ঢেলে বলল,

-ও মা খুশবু, সত্যিই তুই এত ভালো রান্না করেছিস! তোর শাশুড়ি তোর হাতের রান্না খেয়ে খুশি হয়ে বালা উপহার দিয়েছে। ও বাবা, কত ভালো একটা কথা শোনালি! আমার যে কী আনন্দ লাগছে। আনন্দের ঠেলায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

খুশবু মুখ বাঁকাল। এতটাও বোকা সে না। খুশি তার সাথে মজা করছে বুঝতে পেরে রাগ করে কলই কেটে দিল। খুশবু কল কেটে দিয়েছে দেখে এদিকে খুশি হাসতে শুরু করল।

-পাগল একটা।

🌸

মাঝখানে অনেকগুলো মাস কেটে গেল। কয়েকদিন ধরেই খুশি নিজের ভেতর কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ প্রথম কয়েকদিন বুঝতে না পারলেও এখন পারছে। কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতে পারছে না। পরী বানুর অভিজ্ঞ চোখেও খুশির পরিবর্তন এড়ায়নি। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। মেয়ের অসুস্থতা নিয়ে মানছুরা চিন্তিত। কী হলো মেয়েটার। কয়টা দিন ধরে বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারছে না।

-খুশিকে কি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত মা?

পরী বানু বাঁকা চোখে তাকালেন। মানছুরা কি এখনও বুঝতে পারছে না।

-মেয়েটার যে কী হলো! না জানি ভেতরে ভেতরে কোন রোগ বেঁধেছে।

-কোন রোগ-টোগ হয় নাই। এই সময় একটু এইরকম হইবোই।

মানছুরা অনুসন্ধানী চোখে শাশুড়িকে দেখছেন। তার চোখের প্রশ্ন বুঝতে পেরে পরী বানু বললেন,

-তুমি যে এত বেকুব হইবা জানতাম না। নিজেও তো মা হইছো। এর পরেও বুঝবার পারো না তোমার মাইয়ার কী হইছে!

মানছুরার অবিশ্বাস্য চাহনি মুহুর্তেই বাঁধ ভাঙা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। খুশি ঠিকমতো খেতে পারে না। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। একদিন বমিও হয়েছিল। সে কেন বুঝতে পারল না। মানছুরা মেয়ের কাছে ছুটে গেল। খুশি ঘরে শুয়েছিল। মাকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করলে মানছুরা এসে ধরে বসালো।

-তুই আমাকে আগে কেন বলিস নি মা?

খুশি বুঝতে পারছে না মাকে সে কী বলেনি। তবে মা সচারাচর কখনও তাকে ‘মা’ বলে সম্মোধন করে না। আজ করছে।

-আমি কীভাবে বুঝলাম না।

মানছুরা সস্নেহে মেয়ের কপালে চুমু খেলো। খুশি এবার কিছুটা ধারণা করতে পারছে। মা কী তাহলে বুঝে গেছে? খুশির কিছুটা লজ্জাও করছে।

-এত বড় একটা খুশির খবর আমি খুশবুকে জানিয়ে আসি।

মানছুরা উঠতে গিয়েও আবার প্রশ্ন করল,

-স্মরণ জানে?

খুশি লজ্জায় মুখ নিচু করে মৃদু স্বরে বলল,

-না। আমি এখনও নিশ্চিত না মা।

-নিশ্চিত না হওয়ার কোন কারণ নেই। তোর দাদীর চোখ কখনও ধোঁকা দিবে না।

খুশি এতদিন মনে মনে ধারণা করেছিল এরকম কিছুই হয়তো হবে। মা হওয়ার অনুভূতি এত মধুর, এত সুখের হবে ধারণাও বাহিরে ছিল।
খুশি নিজের থেকেও বেশি স্মরণের কথা ভাবছে। খবরটা শুনলে কি স্মরণ খুশি হবে? এখনই বাবা হওয়ার জন্য কি তৈরি সে। নাকি খুশির উপর রাগ করবে কেন এমন হলো?
মাথা ঝেড়ে আজেবাজে চিন্তা গুলোকে তাড়িয়ে দিতে চাইল খুশি। স্মরণকে নিয়ে সে এরকমটা ভাবছেই কীভাবে! নিশ্চয় তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

🌸

শাশুড়ি মায়ের সাথে আজ উনার বান্ধবীর পার্টিতে যাওয়ার প্ল্যান হয়েছে। যদিও খুশবু জানিয়েছে সে জীবনে কোনদিনও পার্টিতে যায়নি।

-মা আমি না গেলে হয় না?

মিসেস সুলতানা চশমার গ্লাস মুছতে মুছতে বললেন,

-কেন? তোমার কি যেতে ইচ্ছে করছে না?

খুশবু ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে বলল,

-ইচ্ছে করছে না এমন না৷ কিন্তু আমি জীবনের কখনও কোন পার্টিতে যাইনি। পার্টিতে গিয়ে মানুষের সাথে কেমন আচরণ করতে হয়, কী কথা বলতে হয় কিছুই জানি না। আমাকে নিয়ে গেলে উল্টো আপনি লজ্জায় পড়বেন। বড়োলোকি আদবকায়দা আমি এখনও কিছুই শিখতে পারিনি।

খুশবু কথাগুলো এমন সিরিয়াস মুখে বলেছে কিন্তু তারপরও মিসেস সুলতানা হাসতে লাগলেন। খুশবু চোখ উল্টে ভাবছে এখানে হাসির কী হলো? এই মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে তার সময় লেগেছে। মেয়েটাকে না চেনার আগে ভেবেছিল গরিব ঘরের লোভী মেয়ে তার ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু বৌমার সাথে সময় কাটানোর পর মিসেস সুলতানা বুঝতে পেরেছেন তিনি মনের মধ্যে কতবড় ভুল ধারণা পুষে রেখেছিলেন। খুশবুর মতো সহজসরল স্পষ্টভাষী মেয়ে তিনি খুব কমই দেখেছেন। এই মেয়ের পেটে যা মুখেও তা।

-হাসছেন কেন মা?

-আমার ছেলের বউয়ের পাগলামি কথা শুনে হাসছি। তোমাকে বড়লোকি আদবকায়দা শিখতে কে বলেছে? আমার ছেলে বা আমি বলেছি? তোমার বিশেষত্ব কী জানো? তুমি যা নও তা দেখাতে চাও না। তুমি যেমন তেমনই থাকো। তবে আমি তোমাকে এতটা ট্রেনিং দিব যাতে আমার পরে আমার জায়গা তুমি নিতে পারো।

প্রথমদিকে শাশুড়ি মাকে মনে মনে কম অভিশাপ দেয়নি। এখন দোয়া করে তার সেই অভিশাপ গুলো যেন না লাগে। এই মানুষটা বাইরে থেকে রিনা খান মনে হলেও উনার ভেতরে একজন মমতাময়ী মা লুকিয়ে আছে।

খুশবু ঘরে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখল মা কল করেছিল। ঘরে ছিল না তাই তুলতে পারেনি। আজ বাড়ির কারো সাথে কথাও হয়নি। খুশবু কল ব্যাক করল। মার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল,

-কী! সত্যি বলছো?

মা তাকে এত ভালো একটা খবর শুনিয়েছে! খুশবু খুশি ধরে রাখতে পারছে না। বিছানা উপর উঠে লাফাতে লাফাতে চিল্লাচিল্লি করে যাচ্ছে। এমন সময় সানও ঘরে এসেছে। খুশবুকে এরকম পাগলামি করতে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছে বেচারা। ভেতর এসে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,

-কী হয়েছে খুশবু? তোমার চিল্লানি নিচে থেকে শোনা যাচ্ছে।

খুশবু এই মুহূর্তে এত বেশি খুশি যে সে হুঁশই হারিয়ে ফেলল। সানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সান সামলে না নিলে দু’জনই নিচে পড়ত।

-আজ আমি অনেক বেশি খুশি। এত খুশি মনে হয় কোনদিনও হইনি।

সান খুশবুকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। এখনও যেভাবে হাত-পা ছুঁড়ছে। পড়ে গেলে কোমর ভাঙবে।

-খুশির কারণটা তো বলবে। আমিও শুনি আমার বউয়ের এত খুশি কেন লেগেছে।

-কারণ আমি খালা হতে চলেছি। জীবনের প্রথমবার খালা হবো, ভাবতে পারছেন!

কথাটা শুনে সানও খুশি হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মুখ গম্ভীর করে ফেলল। খুশবু এতক্ষণে মেঝেতে পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সানের মুখ দেখে বলল,

-আপনার আবার কী হলো?

-এটা কি ঠিক হয়েছে?

খুশবু ভ্রু কোঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

-কোনটা ঠিক হয়নি?

-এইযে আমাদের বিয়ে আগে হলো অথচ আমরা এখনও এমন কোন খুশির খবর শোনাতে পারলাম না। খালু হওয়ার আগে আমার বাবা হওয়ার কথা ছিল।

খুশবু কতক্ষণ বিরক্তি নিয়ে সানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

-সরুন তো। সারাক্ষণ খালি বাজে কথা।

মুখ মোচড়ে খুশবু ঘর থেকে চলে গেল। আজ পার্টিতে যাওয়া হবে না। বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য শাশুড়ি মার থেকে অনুমতি নিতে যাচ্ছে।

🌸

স্মরণকে কেউ জানায়নি। অফিস থেকে ফিরে বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব দেখে ভাবল, কী ঘটেছে আজ? খুশবু এসেছে দেখে মনে করল হয়তো ওর জন্যই এত আয়োজন। খুশবু স্মরণকে দেখে দৌড়ে কাছে গেল। হাসি হাসি মুখে বলল,

-মিষ্টি খাওয়ার টাকা দাও স্মরণ ভাই।

স্মরণ কিছুই বুঝতে পারছে না। এই পাগল আজ আসবে কেউ তো তাকে বলেনি।

-তোর বরের কি টাকার অভাব পড়েছে? আমার কাছে কেন চাচ্ছিস?বরের কাছে চা গিয়ে।

-বরের এখনও মিষ্টি খাওয়ানোর সময় আসেনি। তোমার এসেছে। তাই তুমিই টাকা দিবে।

-জ্বালাস না তো। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছি। একটু জিরোতে দে।

পরী বানু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

-স্মরণ আইছে?

খুশবু গলা উঁচিয়ে বলল,

-হ্যাঁ দাদী।

-নাদানরে এই ঘরে লইয়া আয়।

খুশবু খপ করে স্মরণের হাত ধরে ফেলল। টানতে টানতে দাদীর ঘরে নিয়ে যেতে লাগল।

-তোদের আজ কী হয়েছে রে?

-এখনও হয়নি। হতে আরও নয় দশ মাস অন্তত লাগবে।

-সবাই মিলে এমন আজব ব্যবহার কেন করছিস?

-উফ! এত কথা কেন বলো। একটু চুপ থাকতে পারো না।

এটা ভালো। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তবুও তাকে চুপ করে থাকতে বলছে।

চলবে