কারণ আমি মেয়ে পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
42

#কারণ_আমি_মেয়ে
(পর্ব ৯ শেষ)
#সমুদ্রিত_সুমি

মা ফোন দিয়ে বলে,

“রাবেয়া তোর বাবার অবস্থা খুব খারাপ কি করবো বুঝতে পারছি না।”

“কি হয়েছে বাবার?”

“জানি না, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কথাও বলতে পারছে না ঠিকমতো।”

“হঠাৎ কি হলো মা?”

“আমি জানি না আর কি করবো, বুঝতেও পারছি না তুই কিছু একটা কর।”

“মা তুমি ফাতেমার কাছে দাও।”

“আচ্ছা।”

ফাতেমা ফোন ধরতেই আমি বললাম।

“ফাতেমা এখনি রাজ কাকুকে খবর দে।”

“আপু, রাজ কাকু ঘরে নেই ডাকতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে কোথায় গেছে কেউ জানে না।”

“আচ্ছা তুই পাশের কোন ডাক্তার ডেকে আন।”

আমি ফোন কেটে দিয়ে টাইম দেখলাম! সময় পৌনে বারোটা এতো রাতে আমি একা কোন ভাবেই যশোর থেকে আলম নগর যেতে পারবো না। আজ এখনো সোহাগ বাড়ি ফেরেনি ও না আসা অবধি আমায় অপেক্ষা করতে হবে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। কি করবো কিছুই মাথায় আসছে না বাবার হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারছি না। এঘর ওঘর করে পায়চারী করছি, নিজেকে কোন ভাবেই স্থির রাখতে পারছি না। রাত বারোটা এতো রাতে একা একটা মেয়ে যশোর থেকে কোন ভাবেই ওতোদূর যা-ও সম্ভব না। একে তো এতো রাত তার উপর মেয়ে আর গাড়িও পাওয়া দুস্কর। এক ঢাকা থেকে আসা গাড়ি ছাড়া কোন গাড়ি পাবো না। তারপর আমি আবার মা-কে ফোন দিলাম।

“হ্যালো মা বাবার কি অবস্থা?”

“বুঝতে পারছি না মা, আমার খুব ভয় করছে।”

“তুমি চিন্তা করো না আমি কিছু একটা করছি।”

ফোন কেটে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বাহিরে এলাম। দরজার কাছে অধির আগ্রহ্য নিয়ে অপেক্ষা করছি সোহাগের। ওকে ফোন দিচ্ছি ফোন টাও রিসিভ করছে না। মাথার মধ্যে উল্টো পাল্টা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ দরজায় বেল বেজে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম। সোহাগ এসেছে দেখে আমার প্রাণে পানি এলো।

“সোহাগ আমার সাথে চলো।”

“তোমার সাথে যাবো মানে কোথায়?”

“বাবার শরীরটা খারাপ, খুবই অসুস্থ বাবা, মা ফোন করেছিলো।”

“তোমার বাবা তো রোজই অসুস্থ হয় এ আর নতুন কি?”

“প্লিজ আজ তর্ক করো না বাবা সত্যি খুব অসুস্থ।”

“তো আমি কি করবো? তোমাকে তো ধরে রাখিনি যাও।”

“সোহাগ তুমি টাইম দেখো, রাত পৌনে একটা বাজে। তোমার কি মনে হয় এতো রাতে একা একটা মেয়ে এতোটা পথ যেতে পারবো?”

“এখানে আমার কি করার আছে?”

“তোমার বাইকটা বের করো আর চলো।”

“আমি পারবো না। দেখো রাবেয়া আজ আমি এমনই অনেক ক্লান্ত আমার পক্ষে এখন বাইক ড্রাইভ করা সম্ভব না।”

“সোহাগ আমার বাবা অসুস্থ আর তুমি তোমার শরীর নিয়ে পরে আছো।”

“তোমার বাবা অসুস্থ হলে তোমার মাথা ঠিক থাকে না। আর আমি অসুস্থ তোমার গায়ে লাগছে না।”

৳সোহাগ আমি তোমার সাথে ঝগড়া করার মুডে নেই প্লিজ চলো।”

এতো রিকোয়েস্ট করার পরেও সোহাগ কোন কথা বললো না। তাই দেখে আমি সোহাগের পা জড়িয়ে ধরলাম।

“প্লিজ সোহাগ চলো, প্লিজ আমাকে দয়া করো, কেন জানি আমার মনটা আজ মানছে না। তুমি একবার আমার সাথে চলো, দিন হলে আমি একাই চলে যেতাম।আমি এখনো একা যেতে পারি কিন্তু আমার গাড়ি খুঁজতেই অনেক সময় চলে যাবে।”

কিন্তু সোহাগ বললো,

“দেখো আমি যাবো না যখন বলেছি যাবো না। আমি আমাদের পাশের ওই শরিফুল কে ওর অটোরিক্সা বের করতে বলছি তুমি ওটায় করেই যাও।”

ও যাবেনা কিন্তু কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এতেই আমি খুশি।

তারপর আমি শরিফুলের অটোরিক্সায় রওনা হলাম। তখন সময় একটা ত্রিশ। যশোর থেকে ফুলবাড়ি গেট আসতেই পুলিশ আমাদের গাড়ি আঁটকে দাঁড়ালো। পুলিশ কে সব বুঝিয়ে বেরিয়ে আসতে লেগে গেলো প্রায় পনেরো মিনিট। তারপর আর কোথাও গাড়ি থামায়নি শরিফুল। প্রায় সোয়া দুইটায় আমি বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাই কিন্তু গিয়ে বাবা কে পাইনি। কারণ রাজ কাকু বাবাকে নিয়ে খুলনা মেডিকেল হাসপাতালে চলে গেছে। ছুটে গেলাম সেখানে, মাকে অনেক বার ফোন দিলাম কিন্তু কেউ ফোন ধরলো না। বুকের ভেতরটা ক্রমোশো ভারি হয়ে এলো! কোথাও মনে হচ্ছিলো, কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে বুকটা খালি খালি লাগছিলো। তারপর বাড়ি থেকে হাসপাতালে পোঁছাতে আমার সময় লাগলো এক ঘন্টা দশ মিনিট। হাসপাতালে পৌছানোর পর হন্নে হয়ে খুঁজতে রইলাম ওদের। কিন্তু পাচ্ছি না, হাসপাতালের এমাথা থেকে ওমাথা সব খুঁজলাম কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। চোখে যেনো অন্ধকার দেখতে থাকলাম, হাত-পা আস্তে আস্তে কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। হঠাৎ কারো সাথে আমার ধাক্কা লাগতেই সরি বলে উপরে তাকাতেই দেখলাম রাজ কাকুকে।
রাজ কাকুকে দেখে স্বস্তি পেলাম।

“কাকু বাবা, মা, ফাতেমা কোথায়?

“আছে ওরা সবাই আছে।”

“তুমি জানো আমি তোমাদের খুঁজে না-পেয়ে কতটা অস্থির হয়ে পরেছি।”

“চলো চলো, আচ্ছা কাকু বাবার কি অবস্থা? কি হয়েছিলো হঠাৎ বাবার ডাক্তার কি বললো?”

“রাবেয়া”

“হে কাকু, বলো”

নিশ্চয়ই বাবার প্রেশারফল করেছিলো, নাকি অন্য কিছু? এই ফাতেমাকে দিয়ে কিছুহবে না। এবার আমি কিছুদিন থেকে বাবাকে সুস্থ করে তারপর বাড়ি ফিরবো।

“রাবেয়া!”

“হে বলো না কাকু”

“রাবেয়া, তোর বাবা আর নেই।”

এতো কষ্ট করে এসেও বাবার জীবিত মুখটা দেখতে পাইনি। এই কষ্টটা বুকটা এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছিলো। কথাটা আমার ভেতর বাহির সব পুড়িয়ে দিলো। তাই তো আমি সইতে পারিনি। রাজ কাকুর মুখের সেই পাঁচ শব্দের কথাটা, পুরোপুরি শোনার আগেই আমি লুটিয়ে পরেছিলাম হাসপালের মাটির বুকে। যখন চোখ খুললাম তখন শুনতে পেলাম মায়ের বোনের আহাজারি। মায়ের সেই গলাফাটা চিৎকার।

“ওগো, আমায় এভাবে কেন একা করে চলে গেলে। আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো? আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে যাও।”

বোনের বুক ফাঁটা কান্না।

“আব্বু গো ও আব্বু তুমি কই গেলা।”

শুধু কাঁদতে পারছিলাম না আমি। আমি অনেক চেষ্টা করলাম কাঁদার কিন্তু পারিনি। মায়ের সামনে বসতেই মা বুকে জাপ্টে ধরে আহাজারি করলো।

“মা রে ও মা তুই আর দেখতে পেলি না তোর আব্বুর জীবিত মুখটা। ওমা তোকে নিয়ে কতো কথা আমারে বলতো ও মা ও মা কি কইরা গেলো তোর বাপ। একা কইরা রাইখা গেলো আমাদের।”

তবুও আমি কাঁদতে পারলাম না। আমার মন আত্মা চিৎকার করে কাঁদছে, কিন্তু মুখ থেকে কোন শব্দ উচ্চারণ হলো না। তারপর বাবার গোসল হলো। জানাজার জন্য যখন নিয়ে যাচ্ছিলো বাবাকে, তখন আমার সেই মন আত্মার কান্না পুরো পাড়া শুনতে পেলে। বাবা বলে চিৎকার দিয়ে চলে যাই বাবাকে ধরার জন্য। কিন্তু তখন তো বাবা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেলো। চেয়েও ধরতে পারিনি বাবাকে। সেই কষ্ট মনে পরলে আজও বুক ফেটে কান্না আসে। সেদিন প্রথম আমার আফসোস হয়েছিলো আমি মেয়ে না-হয়ে ছেলে হলে বাবাকে শেষবারের জন্য হলেও ছুঁতে পারতাম।”

কথা গুলো শেষ করেই রাবেয়া নিজের চোখের জল গুলো মুছে নিলো।

মিস্টার সুমন রহমান নিজের চোখে আসা জল মুছে নিলেন রুমাল দিয়ে। তার সামনে বসা রমনীকে আর কিছু জিঙ্গেস করার ইচ্ছে নেই, তবুও একটা প্রশ্ন না করলেই নয় তাই তিনি প্রশ্নটা করেই বসলেন,

“সোহাগ?”

“স্যার সে এসেছিলো আমাকেসহ আমার পরিবারকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে। কেন জানি সেদিন তাকেও আমার মনে হয়েছিলো সে অপরাধী, সে যদি আমার সাথে ওতো তর্ক না করে আমাকে নিয়ে আসতো হয়তো আমি আমার বাবার জীবিত মুখটা দেখতে পেতাম। আমি জানি আমার ভাগ্যে নেই বাবার জীবিত মুখটা দেখার, তবুও ঐ যে বলে মানুষের মন, তাই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তারপর মা, বোনকে নিয়ে চলে আসি ঢাকায়। চাকরির ইন্টারভিউ দেই এবং সফলও হই। তারপর চাকরি বেশ এখানেই গল্প থেমে গেছে। আজ টাকা আছে বাড়ি আছে, কিন্তু সেই সুখটা নেই যেটা আমাদের সেই গোলপাতার ঘরে ছিলো। আজ তো চাইলেই গরুর গোশ খাসির গোশও খেতে পারি, কিন্তু সেই সুখটা নেই যেটা আমার বাবার রক্ত পানি করে আনা পান্তা নুনে ছিলো।”

“জানেন স্যার সেদিন চাইলেই আমি একা একা বেরিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু পারিনি কেন জানেন? কারণ আমি মেয়ে”

“সেদিন চাইলেই আমি ওদের অত্যাচারের বিচার করতে পারতাম, কিন্তু পারিনি।
কারণ আমি মেয়ে।”

“সেদিন সমাজের কথায় আমাকে আমার মায়ের বিয়ে দিতে হতো না, হয়েছে
কারণ আমি মেয়ে।”

“সেদিন আমি চাইলেই বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে পারতাম কিন্তু পারিনি। কারণ আমি মেয়ে।”

“হ্যাঁ, স্যার কারণ আমি মেয়ে।”

কথা গুলো বলেই রাবেয়া বেরিয়ে গেলো।
তার দিকে একমনে চেয়ে রইলো সুমন রহমান।

“তার যে বলতে ইচ্ছে করছে তুমি যে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছো তার একমাত্র কারণ হচ্ছে তুমি মেয়ে।”

~~সমাপ্তি~~