কারন আমি মেয়ে পর্ব-০৪

0
37

#কারন_আমি_মেয়ে
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৪

পরেরদিন আবার সেই ছেলের সাথে দেখা হলো। আমার পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে বললো,

“আমার উত্তর?”

“আমি বললাম প্লিজ আপনি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।”

“ওকে।”

ছেলেটার বলার ধরন, হাঁটার স্টাইল সব ছিলো একটু অন্য রকম। সে সেদিনের পর থেকে আমাকে আর কখনো বিরক্ত করেনি। সে রোজ আমাদের মোড় থেকে আমার কাজের জায়গা পর্যন্ত ফলো করতো। আবার রাতে ফেরার সময় একি ভাবে ফলো করতো। এটাই দেখতো আমি সেফলি বাড়ি পৌছাই কিনা। ছেলেটার মাঝে আমি কোন বিশেষ কিছু খুঁজে পেতাম না। কিন্তু কিছু ছিলো, কিছু একটা ছিলো যা ওর প্রতি আমাকে টানতো। হে খুব করে টানতো। ও কখনো আমাকে গোলাপ বা কোন গিফট দেয়নি বা কখনো জোরও করেনি আমার ব্যাপারে জানার। ওর শুধু কাজ ছিলো আমার যাতায়াতের খোঁজ খবর নেওয়া
এতোটুকু। এক সময় ওর ওতোটুকু খেয়াল করা থেকেই আমি ওকে ভালোবেসে ফেললাম। এটা কেমন ভালোবাসা আমি জানি না। শুধু জানি আমি ওকে ভালোবাসি হে খুব ভালোবাসি। ও আমার পরিবার সম্পর্কে সব জানতো, কিন্তু কিছুই আমি ওকে বলিনি। কোথা থেকে কিভাবে জেনেছিলো তাও আমি জানি না। ওর আর আমার প্রেমটা ছিলো একদম ভিন্ন। আমরা কেউ কাউকে সময় দিতাম না। কেউ কাউকে কখনো গিফট কিনবা, ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথাও বলতাম না। শুধু আমাকে ও এক নজর দেখার জন্য রোজ আমাদের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আর তার বিনিময়ে আমি একটু মুচকি হাসতাম। ব্যাস, এতোটুকুতে আমাদের ভালোবাসা সীমাবদ্ধ। আমি শপে পৌঁছে গেলে ও আবার ফিরে আসতো। আর ফেরার দশ মিনিট আগে শপে পৌঁছে যেতো। এটাই ছিলো আমাদের ভালোবাসা। আমি ওর চোখে আমার জন্য সত্যি কারের ভালোবাসা দেখতে পেতাম যেটা ও আমায় বাসতো। একদিন আমায় খুব রিকোয়েস্ট করলো ওর সাথে দেখা করার জন্য। আমি সময় নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে যাই। তখন আমার অর্নাসের ৩য় বর্ষ চলছে। এই প্রথম ওর সাথে দেখা করবো, কিছু না দিলে কেমন হয়।তাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ি একটা টিশার্ট কিনলাম।

শীতের মাঝামাঝি চলছে, বিকালের ঠান্ডা হাওয়া এক নিমিষেই মন শীতল করে দেয়। পার্কের একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছি। ও টাইম দিয়েছে সাড়ে তিনটা, আমি একটু আগেই চলে এসেছি। চারিদিকে চোখ বুলাতেই দেখতে পেলাম, অনেক কপোত-কপোতী তাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে হাজার কথার মেলা বসিয়েছে। এগুলো দেখে আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। এই প্রথম তাকে এতোকাছ থেকে দেখবো। কেমন হবে এই অনুভূতিটা, ভাবতেই শরীর বেয়ে বয়ে গেলো এক শীতল বাতাস। এই বিকালের ঠান্ডা হাওয়ার মাঝেও আমি একটু ঘামছি, হয়তো একটু বেশি টেনশন করার জন্য। মানুষটা সবার থেকে ভিন্ন এটা আমি জানি। তবুও যদি সে আমার হাত ধরতে চায়, কি বলবো আমি তখন? এমন উল্টো পাল্টা চিন্তা যখন মাথায় চলছিলো, ঠিক তখন পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। তাকিয়ে দেখি খুব মনোযোগ দিয়ে ও আমায় দেখছে। ওর ওমন চাহনি দেখে আমি একটু বিব্রতবোধ করলাম। ও আমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারলো তাই হাতে রাখা একটি প্যাকেট বেঞ্চের মাঝখানে রেখে তার পাশে বসে পরলো।

“কেমন আছেন?”

আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম, “আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

তারপর আর কিছু খুঁজে পেলাম না বলার মতো। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বললো,

“আপনি জানেন, আপনার কোন দিকটা আমার বেশি ভালো লাগে?”

এমন একটা প্রশ্ন শুনে আমি খানিক’টা নড়েচড়ে বসলাম। তিনি আমার অবস্থা দেখে উচ্চস্বরে হেসে দিলো।

“এতো ভয় পাচ্ছেন কেন! আমি বাঘ না ভাল্লুক?”

“না, না তেমন কিছু না।”

“আপনি সব ধরনের পরিস্থিতিতে আপনার ঐ ঠোঁটের মুচকি হাসিটা দিতে পারেন। যেটা আমার খুব ভালো লাগে।”

আমি কথাটা শুনে জোর করে নিজের ঠোঁটের হাসিটা চওড়া করলাম। সেটা দেখে তিনি বললেন।

“উঁহু এমন হাসি নয়, এটা আপনি জোর করে আপনার ঠোঁটে রাখছেন। এটা নয়, ঐ কথায় কথায় যে মুচকি হাসিটা আপনি হাসেন।”

“ধন্যবাদ।”

“জানতে চাইবেন না আপনাকে কেন ডেকেছি?”

আমি মাথাটা নিচু করে বললাম।

“দরকার ছাড়া নিশ্চয়ই এতো জরুরি করে দেখা করার কথা বলতেন না।”

“ঠিক ধরেছেন জরুরি কথা বলার জন্যই, দেখা করা।”

“কি জরুরি?”

“দেখুন আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না। তাই যা বলার সরাসরি বলছি। কাল বা পরশু বাবা-মা আপনাদের বাড়িতে যাবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আপনার মা-বাবা কে তৈরি থাকতে বলবেন। আর হ্যাঁ, তৈরি থাকতে বলতে আমি কিন্তু খাবার দাবারের আয়োজনের কথা বলিনি। কথার পিঠে কথা বলার জন্য তৈরি থাকতে বলেছি।”

উনার কথা শুনার পর আমার হার্টবিট হয়তো তিন গুণ বেড়ে গিয়েছিলো। ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁপছিলো, আমি ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম।

“এতো তারাতাড়ি কিসের জন্য?”

আমার এই কথা শোনার সাথে সাথেই সে হঠাৎ করে দ্রুত বেগেই আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

“দেখুন আমি আর দেরি করতে চাই না। আমার ভয় হয় যদি আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলি? আর আমি চাই আমাদের সম্পর্কের একটা নাম হোক। যাতে করে আপনার পরিবারের জন্য কিছু করার জন্য আমাকে দু’বার ভাবতে না হয়। আমি তাদের জামাই না ছেলে হতে চাই। আপনার বোনের দুলাভাই না, তার বড় ভাই হতে চাই। আর আপনার সুখের নয় দুঃখ গুলোর সঙ্গী হতে চাই।”

“কিন্তু…”

আমার এই কিন্তুটা তার পছন্দ হয়নি। তাই সে কিঞ্চিৎ আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

“আমি আপনার অনুমতি নিতে আসিনি। এসেছি আপনাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাতে।”

এই কথা বলেই আমাদের মাঝে থাকা সেই প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললো,

“বাবা-মা আপনার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার পরের দিন ঠিক এই সময়ে এইখানে আমরা দেখা করবো। সেদিন এই ভেতরের পোশাকটা আপনি পরে আসবেন। আর ভেতরে চিরকুট আছে, সেভাবেই সেজে আসবেন। আর এটা আমার আমি জানি, আপনি এটা আমার জন্যই এনেছেন। তাই আমার’টা আমি নিয়ে গেলাম। আর শুনুন আমার জিনিস কি করে আদায় করতে হয় সেটা আমি জানি। যেটা আমার সেটা আমারি।”

কথা গুলো বলে সে আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না, চলে গেলো। তার এই অধিকার নিয়ে বলা কথা গুলো আমার ভালো লাগার সীমানা ছাড়িয়ে গেলো।

আমি ভাবতাম এই মানুষটা এতো ভালো না জানি তার বাবা-মা কতো ভালো। সব ভালোর শুরু তো বাবা-মার থেকেই হয়। মা’কে সব খুলে বলতেই তিনি খুব খুশি হলেন। বোনটাও সেদিন প্রাণ খুলে হেসেছিলো। বাবার চোখে দেখতে পেয়েছিলাম উচ্ছ্বাস। কিন্তু আমার সব চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো তার বাবা-মা। তারা তেমনটা ছিলো না যেমনটা আমি ভেছিলাম। তারা আমার চিন্তার ঊর্ধ্বে ছিলো। তাদের কথায় ছিলো বিষ মাখানো, তাদের হাসিতে ছিলো ঘৃণা। তাদের ব্যবহারে ছিলো গরীব বড়লোক বিচার করার মতো পার্থক্য। হাসিতে হাসিতে বলবো কথা, কলিজায় তোমার লাগিয়ে দিবো ব্যথা, ঠিক তেমনটা। তারা আমাদের সবাইকে আঘাত করেছিলো।

তাদের কথার কিছু নমুনা দিচ্ছি আপনাকে-

১/ তা আফা বলুন তো আমার ছেলেকে নিয়ে কতজন ছেলের বাবা-মা এসেছিলো আপনার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে?

২/ ভাইজান আমরা তো ভেবেছিলাম আমার বোনের মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিবো। তারা ঘরের ফার্নিচার থেকে শুরু করে ঘরের এসিটা দিতে রাজি। কি আর করার ছেলের শেষে কিনা আপনার মেয়েকে পছন্দ।

৩/ আমার ঘরে’তো আমার কথাই শেষ কথা, সে ছেলে হোক বা ছেলের বাবা।

৪/ জানেন আফা, ছেলে যেদিন সরকারি চাকরি পেলো সেদিন থেকেই ভালো ভালো ঘর থেকে সমন্ধ আসতে শুরু করলো।

৫/ আফা আমার একটু গ্যাসের সমস্যা আছে তাই নিজের ঘর ছাড়া বাহিরে খাবার খাইনা, আজ উঠি।

এই কথা গুলো যথেষ্ট ছিলো আমার বাবা-মা কে অপমান করার জন্য। তারা শুদ্ধ ভাষায় আমাদের অপমান করেছিলো। বাবা-মা আমার আড়ালে চোখের জল মুছে বলেছিলো, ছেলের পরিবার মাশাআল্লাহ, এখানে রাবেয়া মা তুই অনেক সুখি হবি। কিন্তু আমি সব বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলাম বাবা-মায়ের সামনে। আর বললাম হুম।

পরের দিন কথা মতোই আমি ঠিক করলাম ওর সাথে দেখা করবো। নিজের ঘরে গিয়ে ওর দেওয়া সেই প্যাকেট’টা খুললাম। যেখানে গোলাপি রঙের একটি শাড়ি। হাজার বুটিক দিয়ে পুরো জমিন টায় কাজ করা। সব বুটিক গুলো বিভিন্ন কালারের। সবুজ, হলুদ, কালো, নীল এমন হাজার রঙের রঙিন ছিলো শাড়িটা। আর আঁচলটা ছিলো পুরো সোনালি রঙের, সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট।

যেখানে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা।


আপনাকে কি নামে ডাকা উচিৎ জানিনা। আপনাকে দেখলে আমার মনে হয় সদ্য ফোঁটা কোন শিউলি বা কদম। সন্ধ্যা রাতের প্রদীপের মতো কখনো উজ্জ্বল কখনো আবার ভোর রাতের আঁধার ভেদ করা আলো। কেন আমার এমন মনে হয় জানেন আপনি? আমি কিন্তু জানি না। এই উত্তরটা আপনার জানা থাকলে আমাকে প্লিজ জানাবেন।

আপনাকে খোলা চুলের চাইতে হাত খোঁপায় বেশি সুন্দর লাগে। খোঁপায় যদি থাকে কোন তরতাজা ফুলের মালা তাহলে তো কোন কথাই নেই। আপনার ওই ঠোঁটে কোন ব্র্যান্ডের লিপস্টিকে নয়, শূন্য ঠোঁটটাই বেশি সুন্দর, কারণ যখন আপনি আমার সামনে আসবেন আপনার ওই গোলাপি ঠোঁটটা কাঁপবে সেটা দেখতে আরো বেশি মোহনীয় লাগবে। আপনার চোখে আইশ্যাডো বা আইলাইনার কিছুর প্রয়োজন নেই। একটু গাড় কাজলেই সুন্দর লাগে। নাকে যদি একটা ছোট্ট পাথরের নাকফুল হয় তাও আবার সাদা তাহলে সব কিছু ছাড়িয়ে যাবে আপনার ওই নাকের সৌন্দর্যে কে! আর কপালে ছোট্ট একটি কালো টিপ দিলে মন্দ হবে না।

ইতি,,,
উদাস

চলবে….