কার্নিশ ছোঁয়া অলকমেঘ পর্ব-৭+৮

0
200

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৭.

ক্যাফেটেরিয়ায় একটা গোল টেবিলে জড়োসরো হয়ে বসে আছে শার্লি। ওর সামনের চেয়ারে আয়েশে বসে আছে আরো দুটো ছেলে৷ এদেরকে চেনে ও। ফার্স্টইয়ারে এসে যাদের কাছে পরিচয় দিতে দিতে মুখে ফেনা উঠে যেতো, এরা সেই সিনিয়র ভাই। শান্ত আর টিটু। ঠিক পাশের টেবিলটায় পা ঠেকিয়ে, বুকে হাত গুজে দাড়ানো তাশদীদ। শান্ত ওর কলেজের বন্ধু। আর টিটুর সাথে পরিচয় ঢাবিতে আসার পর। আগেরদিন শার্লি যে বইটা নিয়ে রেখেছে, সে বইটা নেবার ওদেরকে সাথে করে এসেছে তাশদীদ। শার্লি টেবিলে থাকা বইটার দিকে অসহায়ভাবে তাকালো। তারপর মনেমনে নিজেই নিজেকে গালি দিলো। ওর মোটা মাথায় যদি আগেরদিন ঢুকতো, এই বই অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের না, মাস্টার্স পড়ুয়াদের বই, তাহলে ও কখনো তাশদীদকে পাকড়াও করতো না। ভুল করেও তাশদীদকে বলতো না, আরো দুটো বন্ধুসমেত দেখা করে বই নিয়ে যেতে। তাশদীদ মিটমিটিয়ে হাসছে। ছেলেদের মতো বেশভুষার মেয়েটার ভীতুভীতু মুখটা দেখার মতো। শার্লি শুকনো ঢোক গিললো। হাত বাড়ালো টেবিলের ওপরের ওর ফোনটার দিকে। টিটু ছোঁ মেরে ওর ফোনটা সরিয়ে নিলো। আর শান্ত কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,

– আপু কি জুনিয়রদের সামনে স্ট্রেসড ফিল করছেন? কফি খান। ইউ’ল ফিল বেটার।

আবারো ঢোক গিললো শার্লি। এই মুহুর্তে ওর তাথৈকে খুব মনে পরছে। রুমন তাথৈ একটাও এখনো ভার্সিটিতে আসেনি। ও হলে থাকে বলে আগেআগেই চলে এসেছে ক্যাম্পাসে। ক্যাফেতে বসে ছিলো। হঠাৎ করেই শান্ত আর টিটু এসে ওর সামনে বসে যায়৷ ওদের সাথে তাদশদীদকে দেখে শার্লির বুঝতে বাকি রইলো না, ওরা জুনিয়র না, সিনিয়র হিসেবে ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। রুমন কাধের কাপড়ের ব্যাগটা ঠিক করতে করতে ক্যাফেতে ঢুকলো। সেইসাথে গুনগুনিয়ে গানও গাইছে, ‘বাতাসে গুনগুন…এসেছে ফাগুন…’ আচমকা একটা সার্ভবয়ের সাথে ধাক্কা লাগে ওর। ছেলেটার হাতে খালি প্লেট ছিলো কিছু। ‘সরি ভাই’ বলে ছেলেটা রুমনকে পাশ কাটায়। রুমন পেছন থেকেই ছেলেটাকে দেখতে দেখতে, কানের পেছনের চুলে আঙুল ঠেলে গাইলো, ‘বুঝিনি তোমার…শুধু ছোঁয়ায়, এতো যে…’

– আগুন!

উচ্চআওয়াজে কেবল আগুন শব্দটা শুনে সবাই রুমনের দিকে তাকালো। আর ওর দৃষ্টি তাশদীদের দিকে। কালো প্যান্ট, ইন করা হালকা নীল শার্ট, গুটানো বড় হাতা, টেবিলে ঠেস দিয়ে বসা তাশদীদকে নজরে পড়তেই আগুন শব্দটা জোরেই বেরিয়ে গেছে ওর মুখ দিয়ে। রুমন কারো চাওনিকে গুরুত্ব দিলো না। দেখলো, শার্লির সাথে দুজন ছেলে বসা। ওদের দেখেই খুশি হয়ে গেলো রুমন। শার্লি ইশারায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে বুঝাচ্ছে, ‘আসিস না, আসিস না!’ কে শোনে কার কথা! রুমন এগিয়ে এসে ব্যাগটা টেবিলে রাখলো। শার্লির চেয়ার কনুই ঠেকিয়ে, দাড়িয়ে শান্ত আর টিটুর উদ্দেশ্যে বললো,

– কি? তোমরাও জুনিয়র?

– জ্বী ভাইয়া। আমি শান্ত, আর ও টিটু।

অতি মাসুম একটা হাসি দিয়ে বললো শান্ত। ওদের নাম শুনে চেয়ার থেকে কনুই ফসকে যায় রুমনের। এই নামের সিনিয়দের নিয়ে শার্লি নিয়ম করে বদনাম গায়। রোবটের মতো শার্লির দিকে তাকালো ও। শার্লি নির্বাক হয়ে বসে। টিটু উঠে দাড়িয়ে শার্ট টেনে ঠিক করলো। আর শান্ত শার্লির ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

– কাইন্ডলি ফোনের লকটা খুলেন আপু। আপনার আইডি থেকে একটা ছোট্টখাট্টো পোস্ট দিবো।

শার্লি বিস্ফোরিত চোখে চাইলো। শান্ত একপলক তাশদীদের দিকে তাকালো। শার্লির ভীতগ্রস্ত চেহারা দেখে দুজনেই নিশব্দে হাসছে। শার্লি বললো,

– ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া। আ্ আর এমন হবেনা।

– ভুল যখন করেছেন, মাশুল দিন আপু। আর হবে কি হবেনা সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে না এখানে।

– ভাইয়া প্লিজ, আমি…

– লক খুলুন! নইলে আমি আরো ভয়াবহ স্টেপ নেবো!

শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে বললো শান্ত। আর কিছু বলার সাহস হলো না শার্লির। রুমন বুঝলো, পরিস্থিতি সামাল দিতে তাথৈকে কল করা প্রয়োজন। বিরবিরিয়ে কাধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগটায় হাত ঢুকাতে যাচ্ছিলো ও। কিন্তু খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে টিটু। হাত মুড়িয়ে ওরই পিঠে ঠেকাতেই, ‘আহ!’ আওয়াজ করে ওঠে রুমন। টিটু পুরাই বোকাবনে। রুমনের মুখনিঃসৃত এই আহ আওয়াজটা মোটেও ব্যথাতুর আওয়াজ ছিলো না। তৎক্ষণাৎ রুমনের হাত ছেড়ে দিয়ে দুপা সরে দাড়ালো ও। শান্তকে বললো,

– এটা কি জিনিস?

শান্ত নিজের কপাল চেপে ধরে চেহারা আড়াল করলো। শার্লিকে ভয় দেখাতে এসে ওদের নিজেদেরই নাকমুখ ডুবছে। শার্লি লক খুলে ফোনটা আবারো শান্তর দিকে বাড়িয়ে দিলো। এতোক্ষন চুপ থাকলেও তাশদীদ সোজা হয়ে দাড়ালো এবারে। এগিয়ে গিয়ে শার্লিকে থামিয়ে বললো,

– হয়েছে। ফোন দিতে হবেনা আর।

শার্লি অবাক চোখে চাইলো। তাশদীদ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললো,

– কোনো পোস্টটোস্ট দেবে না ও। জাস্ট ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলো। বাই দা ওয়ে, তোমাকে দেখে তো অনেক সাহসী মনে হয়। আমি সত্যিই গতদিন তোমার কথায় আর এটিচিউডে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাহলে আজ তুমি এটুকোতেই ভয় পেয়ে গেলে কেনো?

পাশের চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিলো তাশদীদ। শার্লি চেয়ে দেখে শান্ত উঠে একদম দরজার কাছে চলে গেছে। টিটুর সাথে দাড়িয়ে কফি খেতে খেতে কথা বলছে। তাশদীদ টেবিলের বইটা নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো,

– এনিওয়েজ! আই সাজেস্ট, সাহসটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেখানোর জন্য তুলে রাখো। জুনিয়রকে বদার করে, শুরুতেই ভয় দেখিয়ে মুষড়ে দেওয়ার কাজে না। বিশ্ববিদ্যালয় অনেকের অনেক সাধনার জায়গা। প্রতিটা স্টুডেন্ট হাজারো স্বপ্ন নিয়ে এ আঙিনায় পা রাখে। সো ওদেরকে সযত্নে স্বাগত জানাতে শেখো। র‍্যাগিংয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে না। হুম?

বলা শেষ হতে না হতেই একটা সার্ভবয় তাশদীদের পাশে এসে দাড়ায়। তার হাতে বিলের কাগজ। ছেলেটা কাগজটা তাশদীদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ভাইয়া আপনার বিলটা।

চব্বিশশো টাকার বিলের কাগজ দেখে তাশদীদ ভ্রু কুচকালো। কফি ছাড়া এখনো কিছুই খায়নি ওরা। কিঞ্চিত বিস্ময়ে বললো,

– কিন্তু আমিতে কেবল তিনটা কফি…

– হ্যালো সিনিয়র ভাইয়া?

আওয়াজ শুনে পাশে তাকালো তাশদীদ। একটা কোকা কোলার কাচের বোতল হাতে ওদের দিকেই এগোচ্ছে তাথৈ। পরনে হালকা গোলাপী রঙের কুর্তি আর কালচে নীলাভ ধূতি। তাশদীদ দৃষ্টি সরালো। প্রয়োজন হোক বা না হোক, তাথৈয়ের ওড়না না পরার বিষয়টা ওর মোটেও ভালো লাগে না৷ ওদিকে তাথৈয়ের শরীরে রক্তের পরিবর্তে যেনো রাগের উষ্ণ প্রবাহ। শান্ত যখন শার্লির ফোন নিচ্ছিলো, তখনই এসেছে ও। তারপর সবটা দেখে, শুনে ওর বুঝতে সময় লাগেনি কি ঘটেছে। শার্লিকে ভয় দেখাচ্ছে ওরা। প্রতিত্তোরে তাশদীদের নাম করে চারটে টেবিলের খাবার অডার করে দিয়েছে ও। এগিয়ে এসে তাশদীদের ঠিক সামনের চেয়ারটায় বসলো তাথৈ। শক্ত গলায় বললো,

– জুনিয়রের ফোনের লক খুলাতে পারেন, আর জুনিয়রকে ট্রিট দেবেন না, তা কি করে হয় বলুন? মহামান্য সিনিয়র ভাই! মিস্টার তাশদীদ ওয়াসীর!

তাশদীদ চোখ তুলে তাকালোও। বিলের কাগজটা নিয়ে পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট পুরে দিলো সেখানে। ঠোঁটে পুনরায় সেই চমৎকার হাসি ফুটিয়ে সার্ভবয়কে বললো,

– একশো এক্সট্রা আছে। আরেকটা কোক দিয়ে এর মাথা ঠান্ডা করাও। ম্যাডাম ইজ অন ফায়ার!

শেষ কথাগুলো বলার সময় তাথৈকে আপাদমস্তক দেখেছে তাশদীদ। সেই সাথে তাথৈয়ের সর্বাঙ্গে আগুনও ধরিয়ে দিয়েছে যেনো। তাশদীদ কাধে ব্যাগ নিয়ে, শার্লি আর রুমনকে হাসিমুখে বাই বলে চলে গেলো। তাথৈ টেবিলে রাখা হাত শক্তমুঠো করে নেয়। শক্ত হয়ে বসে তাকিয়ে রয় তাশদীদের চলে যাওয়ার দিকে। তাশদীদের অন ফায়ার কথাটার জবাব না দেওয়া অবদি ওর শান্তি নেই, স্বস্তি নেই!

ক্লাসশেষে ক্লাসের বাইরে বেরোতেই বাইরের ঝুম বৃষ্টি চোখে পরে তাশদীদের। বৃষ্টির বেগ দেখে, আপনাআপনি কপালে হাত চলে যায় ওর। কাছে ছাতা নেই। শুধু বাস অবদি যাওয়া দরকার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবলো তাশদীদ। পরে পকেট থেকে রুমালটা বের করে, মাথায় দিলো। কপালের দিকটায় হাত রেখে, বড়বড় পায়ে পেরিয়ে আসলো বিভাগের সামনের মাঠঠা। পরে দৌড় লাগালো মুলসড়কের দিকে। সারি ধরে ভার্সিটির দ্বিতল লাল বাসগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির মাঝে একাধিক বাসের ভীড়ে নির্দিষ্ট বাসটা খুজছিলো তাশদীদ। না পেয়ে ফুটপাতের যাত্রীছাউনিতে উঠতে যাবে, ঠিক সে সময়েই একটা গাড়ি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভিজিয়ে দিয়ে যায় ওকে। তাশদীদ বাকা হয়ে নিজের বুকের দিকে তাকালো। এমনিতেও বৃষ্টির জন্য অনেকটা ভিজে আছে ও। তারওপর রাস্তার পানি রীতিমতো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরেছে। তীব্র বিরক্তিতে তাশদীদ কয়েকহাত দুরের ছাইরঙা ল্যাম্বরগিনি হিউরাক্যান গাড়িটার দিকে তাকালো। চেচিয়ে বললো,

– হো স্মোকি নাগাটার বংশোধর! ভার্সিটি এরিয়ায় এতো জোরে গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই, জানেননা?

ব্রেক কষে গাড়ি থামালো তাথৈ। ইচ্ছে করেই গাড়িটা দ্রুত চালিয়েছে ও। ফ্রন্টসাইড সিটে তুল্য কানে হেডফোন গুজে মোবাইলে ব্যস্ত ছিলো। বোনকে গাড়ি থামাতে দেখে ও ফোন থেকে চোখ তুললো। ক্লাসশেষে টংয়ে দাড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিলো তুল্য। হুট করেই তাথৈ এসে ওর সিগারেট কেড়ে, ড্রেনে ছুড়ে মারে। কারন? বৃষ্টির জন্য অম্বুনীড় থেকে তুল্যর জন্য গাড়ি আসবেনা আজ। তুল্য ড্রাইভ করা পছন্দ করে না। ড্রাইভারই গাড়ি করে ওকে আনা নেওয়া করে। অন্যদিকে গাড়ি আর ড্রাইভিং তাথৈয়ের প্রাণ। তাথৈ সবখানে নিজে ড্রাইভ করে চলাচল করে। তৈয়ব আলফেজ তাই তাথৈকে বলে দিয়েছেন, আজ তুল্যকে নিয়ে বাসায় ফিরতে। যেহেতু তাথৈ ওর গাড়িতে সিগারেটের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারবে না, তাই তুল্যর এখন সিগারেট খাওয়া চলবে না৷ উপায়ন্তর না দেখে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসেছে তুল্য৷ এখন গাড়ি থামিয়ে, তাথৈ শক্ত চোখে লুকিং মিররের দিকে তাকিয়ে আছে। তুল্য বললো,

– হোয়াট? গাড়ি থামালি কেনো?

– ইচ্ছে হয়েছে, থামিয়েছি।

নির্বিকারচিত্ত্বে জবাব দিলো তাথৈ। ওর দৃষ্টি তাশদীদের দিকে। গাড়িটাকে থামতে দেখে তাশদীদ আর কিছু বললো না। ফুটপাতের যাত্রীছাউনিটাতে দাড়িয়ে, রুমাল মাথা থেকে নামিয়ে পানি ঝেরে, শার্ট ঝারতে লাগলো ও। তুল্য কিছু বলতে যাবে, তাথৈ নিজের সিটবেল্ট খুলতে খুলতে লাগলো। কপাল কুচকে আসলো তুল্যর। এমনিতেও তাথৈয়ের জেদ বুঝতে ওর সময় লাগেনা। ওকে বৃষ্টির মাঝেই গাড়ি থেকে নামতে দেখে আরো গাঢ় হলো ওর ধারনা। তুল্য বৃষ্টির বেগ দেখে নিলো৷ অনেকবেশি বৃষ্টি। বললো,

– এই বৃষ্টিতে নামছিস কেনো? বাসায় চল! আমার তাড়া আছে।

– আমি আটকাইনি তোকে। চলে যা।

স্পষ্ট জবাব দিয়ে গাড়ি থেকে নামলো তাথৈ। শব্দ করে লাগিয়ে দিলো গাড়ির দরজাটা। সে আওয়াজ কানে আসে তাশদীদের। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে, গাড়ির পাশে দাড়িয়ে ভিজছে তাথৈ। ওর ভেজা চুল এলোমেলোভাবে ছরিয়ে আছে। তাশদীদ কিছুটা অবাক হলো। গাড়িটা তাথৈয়ের হবে, ভাবতে পারেনি ও। তাথৈ পায়ের উচু হিলটা খুলে হাতে নিলো। তারপর খালি পায়ে পিচঢালা পথে এগোলো তাশদীদের দিকে। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো তাশদীদ। ভিজতে ভিজতে একদম ওর সামনে এসে দাড়ালো তাথৈ। ছাউনির বাইরেই দাড়ালো ও। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– আমার গাড়ি। আমি যেভাবে খুশি, সেভাবে ড্রাইভ করবো। আমাকে স্পিড শেখানোর তুমি কেউ নও!

তাশদীদ চরম বিস্ময়ে চোখ তুললো। ঠিক,-ভুল, সিনিয়র-জুনিয়র, ভদ্রতা-ব্যবহার, রাগের বশে সব ভুলে বসেছে এই মেয়ে। বুঝলো তাথৈ প্রতিশোধপরায়ন মুডে আছে। ফু দিয়ে শ্বাস ছেড়ে, নিজেকে সামলে নিলো তাশদীদ। বললো,

– তুমি ভুলে যাচ্ছো, আমি তোমার সিনিয়র।

– সেটা ক্যাম্পাসের ভেতরে। ক্যাম্পাসের বাইরে, তুমি কেউ না!

আঙুল উচিয়ে কিছু একটা দেখালো তাথৈ। ওর আঙুল বরাবর তাকিয়ে, তাশদীদ নিজের কপাল চেপে ধরলো। এদিকওদিক ঘুরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। মুলত তাথৈ ওকে একটা সাইনবোর্ড দেখিয়েছে। সেখানে লেখা, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়া’ যার মানে, ওরা এখন ক্যাম্পাসের বাইরে। কয়েকপা এগোলেই ক্যাম্পাস। এটুক দুরুত্বে এসেই যে মেয়ে বলে ‘তুমি ক্যাম্পাসের বাইরে। তাই এখন তুমি আমার সিনিয়র নও।’ এমন পাগল মেয়ে দুনিয়ায় আর দুটো আছে বলে ওর মনে হয়না। কথা বাড়াবে না বলে তাশদীদ লম্বা দম নিয়ে, স্থির হয়ে দাড়ালো। বললো,

– কি চাও?

তাথৈ আটকে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিলো ও। বুঝে উঠতে পারলো না, ওর ঠিক কি চাই। কি মনে করে পরমুহূর্তেই চোখ তুলে তাকালো তাথৈ। চেচিয়ে বললো,

– তাথৈ আলফেজের কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এন্ড ইউ! লিসেন! আমাকে কিছু দেবার মতো যোগ্যতাও তোমার নেই! গট ইট?

তাথৈ চলে আসছিলো। দুপা এগোতেই পেছন থেকে অকস্মাৎ ওর সামনে এসে দাড়ায় তাশদীদ। বৃষ্টিতে পুনরায় ভিজে উঠতে শুরু করে ওর হালকা নীল শার্টটা। তাথৈ চোখ তুলে চায় ওর চোখে। তাশদীদ আরেকপা এগিয়ে বললো,

– আমি তোমাকে কি দেবার যোগ্যতা রাখি, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া আবাউট দ্যাট মিস তাথৈ আলফেজ।

– ইউ….!

তাথৈ তীব্র রাগে আঙুল উচিয়ে কিছু বলতে উদ্যত হয়েছিলো। কিন্তু ওকে সুযোগ দেয়নি তাশদীদ। তার আগেই, একদম হুট করে তাথৈয়ের মুখের ওপর কিছু ছুড়ে মারলো ও। ঘাড় ঘুরিয়ে, চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো তাথৈ। পরে চোখ খুলে দেখে, ওর কাধের ওপরে ভেজা চুলে দুটো শিউলী ফুল লেগে আছে। অগ্নিচক্ষু করে তাশদীদের দিকে তাকালো ও। বরাবরের মতো আজও সে চাওনিকে পাত্তা দিলো না তাশদীদ। বরং তাথৈয়ের দিকে আরেকটু এগিয়ে, কিঞ্চিৎ ঝুকে, বললো,

– রাগ কমাও রাগান্বিতা। রাগ, মনের জন্য হানীকারক।

বলাশেষে একমুহুর্ত দেরি করে নি তাশদীদ৷ ঠিক ওইসময়েই ওর কাঙ্ক্ষিত বাস যাচ্ছিলো রাস্তা দিয়ে। লাফিয়ে ফুটপাত থেকে নেমে, চলমান বাসে উঠে পরলো ও। বৃষ্টির প্রকোপে, তাথৈয়ের রাগমিশ্রিত অশ্রু দেখা গেলো না। তুমুল বৃষ্টিতে দাড়িয়ে, দুহাত মুঠো করে ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দ্বিতল লালবাসের সামনের গেইটে। কিন্তু সেখানে দাড়ানো বেপরোয়া মানুষটার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই ওর চাওনিতে। একহাতে গেইটের হাতল ধরে, আরেকহাতে মাথার ভেজাচুল উল্টে দিলো তাশদীদ। কি মনে করে, তাকালো তাথৈয়ের দিকে৷ বৃষ্টির মাঝে দাড়ানো মেয়েটার রাগী, জেদী অনড় অবস্থা আটকে দেয় ওর দৃষ্টিকে। তাশদীদ শক্তমুঠো করে নেয় বাসের দরজার হাতল। বাসের পেছনের গেইটে ছেলেগুলোর গলায় তখন সমস্বরের গান,
‘একগুচ্ছ, কদম হাতে,
ভিজতে চাই, তোমার সাথে।
এক গুচ্ছ, কদম হাতে
ভিজতে চাই তোমার সাথে…’

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৮.

প্রায় পাঁচমিনিট যাবত তুল্য অনবরত হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাথৈ ওভাবেই বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে। একচুল নড়ছে না ও। অন্যকোনো উপায় না দেখে ড্রাইভিং সিটে বসে, গাড়ি স্টার্ট দিলো তুল্য। উল্টোদিক চালিয়ে, তাথৈয়ের পাশে এনে দাড় করালো গাড়িটা। আরো দুইবার হর্ণ দিয়েও তাথৈয়ের হেলদোল পেলো না ও। তুল্য গাড়ির জানালার কাচ নামালো। গা ছাড়াভাবে বললো,

– ছেলেটা যেভাবে তোর সেল্ফ-অবসেশনকে পিষে দিয়ে গেলো; তোর ড্যাডের আলিশান বাড়ির, আলিশান ওয়াশরুমের শাওয়ার তোকে ঠান্ডা করতে পারবে বলে আমার তো মনে হচ্ছে না। তারচেয়ে বরং তুই এই বৃষ্টিতে এভাবেই মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে থাক। ওপরওয়ালার রহমতের পানিতে যদি তোর মাথা ঠান্ডা হয়।

তাথৈয়ের কর্ণগোচর হয় কেবল প্রথম লাইনটা। ‘তাশদীদ ওর আত্নবোধকে পিষে দিয়ে গেছে।’ মস্তিষ্ক শিরশিরিয়ে ওঠে ওর। ক্ষিপ্ত বাঘিণীর মতো জানালা দিয়েই তুল্যর টিশার্টের কলার চেপে ধরলো তাথৈ। ওর এ হেন কাজে, তুল্য পুরোপুরিভাবে হচকিয়ে যায়। বড়বড় চোখে তাকায় কলার মুঠো করে রাখা তাথৈয়ের হাতের দিকে। তাথৈ বললো,

– ড্রাইভিং সিটে বসার সাহস কি করে হলো তোর?

– কলার ছাড় তাথৈ!

– না ছাড়বো না! হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মাই কার এন্ড হাউ ডেয়ার ইউ টু ড্রাইভ ইট ড্যাম ইট! হাউ ডেয়ার ইউ!

চেচিয়ে উঠলো তাথৈ। বৃষ্টির জন্য ওর চোখের জল দেখা না গেলোও, তুল্য ওর গলা শুনেই বুঝলো, রাগ সহ্য করতে না পেরে তাথৈ কাদছে। অথচ তুল্য এটাও জানে, এতোবেশি রাগের মতো কিছু ঘটেই নি এখানে। তাথৈ নিজেই ছেলেটার গায়ে বৃষ্টির পানি ছিটিয়েছে। ছেলেটা যদি চাইতো, অনেক বাজেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। উল্টো মুঠোভর্তি ফুল ছুড়ে গেছে তাথৈয়ের চেহারায়। আর এ সবটুকোতে তাথৈয়ের রাগের একমাত্র কারন, ছেলেটা ওর আত্মকেন্দ্রিকতায় ঢুকে পরেছে। ‘আমিই সঠিক’ এর বাইরে ভাবতে না জানা তাথৈ আলফেজকে প্রতিত্তোর করেছে। তুল্য ঝারা মেরে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিলো তাথৈয়ের হাত থেকে। তারপর সরে গিয়ে পাশের সিটে বসে, জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টিক্ষেপ করলো। তাথৈ ভেজা শরীরে গাড়িতে চরে বসে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেরে অম্বুনীড়ে। গাড়ির বাইরে পা রেখেই মুখে সিগারেট গোজে তুল্য। লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে মুখভর্তি ধোয়া ছাড়লে। তৈয়ব আলফেজ কোমড়ের পেছনে দুহাত গুজে দরজায়ই দাড়িয়ে ছিলেন। তুল্য বাসায় ঢোকার আগে একবার চোখ উল্টিয়ে তাকালো বাবার দিকে। মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে তাচ্ছিল্যে বললো,

– অম্বুনীড়ে আবার বজ্রপাত হবে।

তুল্য ভেতরে চলে যায়। ওর হাসিটা দেখে তৈয়ব আলফেজের বুঝতে সময় লাগলো না, তাথৈ আজ আবারো ক্ষেপেছে। চোখ বন্ধ করে নিলেন উনি। তাথৈ গাড়ি থেকে নেমে, নাক ডলতে ডলতে বাসায় ঢুকলো। দু দন্ডের মধ্যে ভাঙার আওয়াজ আসে ভেতর থেকে। তৈয়ব আলফেজ ভেতরে এগোলেন। তাথৈ সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে এগোচ্ছে। যাওয়ার আগে ড্রয়িংরুমের বড় ফুলদানিটা ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে গেছে ও। ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলেন তৈয়ব আলফেজ।
ঝড়-ঝঞ্ঝার রাত পেরিয়ে ভোর হয়। ভোর গরায় বেলা এগারোটায়। তুল্য ভার্সিটি যাবে বলে বেরোয় রুম থেকে। ব্যাগ কাধে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামছিলো ও। ড্রয়িংরুমে তাকিয়ে দেখে আগেরদিন তাথৈ যে বড় ফুলদানিটা ভেঙেছে, সেখানেই নতুন আরেকটা ফুলদানী এনে রাখা হয়েছে। ডাইনিংয়ে তাকিয়ে দেখে সেখানে বসে জুসের গ্লাস নিয়ে তৈয়ব আলফেজ ফাইল দেখছেন। তুল্য নিচে নেমে বললো,

– তোমার মেয়ে বেরিয়েছে?

– না।

নিজের কাজে ব্যস্ত থেকে বললেন তৈয়ব আলফেজ। তুল্য ঘৃণাসূচক চাওনিতে তাকালো বাবার দিকে। অম্বুনীড়ের একটা সুতো নষ্ট হলেও তৎক্ষনাৎ সেটা ঠিক করে নেয় এই লোকটা। অথচ তার নিজের ছেলেমেয়েদুটোই যে নিঃশেষ হতে চলেছে, তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। রাগ নিয়ে সামনের চেয়ারটায় লাথি মারলো তুল্য। আবারো ওপরে গিয়ে তাথৈয়ের ঘরের সামনে দাড়ালো। বন্ধ দরজার এপার থেকে ডাক লাগালো,

– তাথৈ? ভার্সিটি যাবিনা? মিড আছে আজ।

জবাব এলো না। তুল্য আবারো ডাকলো,

– তাথৈ? ক্যাম্পাসে যাবিনা?

এবারো জবাব এলো না। তুল্যর কপালে ভাজ পরে। ‘তাথৈ?’ বলে দরজায় হাত রাখতেই টের পায়, দরজা খোলা। কিছুটা অবাক হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে চোখ বুলায় ও। কিন্তু ভেতরের অবস্থা দেখেই মাথা ঘুরে ওঠে ওর। তাথৈ বিছানায় হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে, চোখ বন্ধ করে মেঝেতে বসে আছে। আগেরদিন ও যে জামা পরে ভিজেছিলো, সেই জামাই ওর পরনে। তুল্য ‘ড্যাম’ বলে কাধের ব্যাগ মেঝেতে ছুড়ে মারে। ছুটে এসে হাটুতে বসে যায়। তাথৈয়ের গায়ে হাত দিতেই টের পায়, ওর শরীরে অসহনীয় উত্তাপ। জ্বরে গা পুড়ে যাওয়া অবস্থা। তুল্য দিশেহারা হয়ে যায়। চিৎকার করে ওঠে,

– মিস্টার আলফেজ!

নিচতলায় বসা অবস্থায় কেপে ওঠেন তৈয়ব আলফেজ। হন্তদন্ত হয়ে পা বাড়ান তাথৈয়ের ঘরের দিকে। অকস্মাৎ উষ্ণতার আবেশ পেতেই কাপতে শুরু করে দেয় তাথৈ। উচ্চস্বর শুনে বিরবির করে কিছু বলতে থাকে। তুল্য কি করবে ভেবে পায় না। নিজের ফোন হাতে নেয়। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সের নম্বর নেই ওর কাছে। রাগে চোখ ফেটে জল গরায় তুল্যের। নিজেকে ওর তীব্র অসহায় লাগছে। তাথৈ চোখ বন্ধ রেখে জ্বরের ঘোরে বলে চলেছে,

– যেও না মম। মম প্লিজ যেও না। তুল্য প্লিজ মমকে আটকা। ড্যাড মমকে থামাও। যেতে দিও না। মম! মম!

তুল্য থেমে যায়। সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া শিশু যদি কথা বলতে জানতো, তাহলে হয়তো আজ ওরা মা ছাড়া হতো না। এভাবেই হয়তো আর্তনাত করে করে ওই মহিলাকে আটকে দিতো তাথৈ। তাথৈ আবারো বলে,

– তুল্য প্লিজ যাসনা। প্লিজ যাসনা তুল্য। আমি একা হয়ে যাবো। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না! প্লিজ!

তুল্যর চোখ বেয়ে জল গরাতে লাগলো। বিরামহীন। তাথৈ বড়বড় দম নেয়। ওর বন্ধ চোখের কোনা বেয়ে জল গরাচ্ছে। শরীর জ্বলছে। তবুও অতিকষ্টে চোখ মেললো ও। জলভরা আবছা চোখে ভাইকে দেখে, লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললো,

– মম টাকার লোভে দ্বিতীয়বিয়ে করলো, আমাকে অতিরিক্ত ভেবে ফেলে চলে গেলো। ড্যাড নিজের স্বার্থে আমাকে বাচিয়ে রাখলো। তুইও নিজের স্বার্থ খুজতেই বিদেশ গেলি। অন্তু আমাকে কোনোদিনও ছাড়বেনা লোভ দেখিয়েছিলো। বেটার অপশন পেয়ে চলে গেলো ওউ। তোরা সবাই স্বার্থপর। সবাই। সবাই….

বলতে বলতেই জ্ঞান হারায় তাথৈ। তুল্য স্তব্ধ। তৈয়ব আলফেজ ততোক্ষণে দরজায় এসে দাড়িয়েছেন। দেখলেন রুমে তাথৈ তুল্যর কোলে অজ্ঞান অবস্থায় পরে আছে। ভেতরে না এসে পান্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করলেন উনি। হসপিটালে কল লাগালেন এ্যাম্বুলেন্সের জন্য।

বিকেল চারটা। তিনতলা বাড়িটার দোতালায় ড্রয়িংরুমে বসে আছে তাশদীদ। ওর সামনের টি টেবিলে চারপ্রকারের মিষ্টান্ন-পিঠা, ছয়প্রকারের ফলসহ হরেক রকমের ব্যন্জন সাজানো। বাড়ির মালিক সৈয়দ সাহেব ওর পাশের সোফায়ই বসে। তিনদিন ক্লাসের পর, আজকের দিনটা অফডে ছিলো তাশদীদের। ওয়াসীর সাহেব তাই আজই ওকে সৈয়দ সাহেবের বাসায় পাঠিয়েছেন। রিংকিকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। খুব বেশি হলেও মিনিট পাঁচেক হলো বাসায় ঢুকেছে তাশদীদ। এরমাঝেই মিসেস সৈয়দ ট্রে ভর্তি করে এসব সাজিয়ে দিয়ে গেছেন ওর সামনে। সৈয়দ সাহেব নিজেও ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। খাবারের মধ্য থেকে এটাওটা তাশদীদকে এগিয়ে দিচ্ছেন আর নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছেন। সৌজন্য দেখাতে তাশদীদ জোরালো হাসি দিয়ে বারন করছে বা কোনো কোমোটা একটুএকটু করে সবই মুখে তুলছে। সৈয়দ সাহেব জার্মানিতে বসবাসরত ছিলেন। ওখানকার কথা বলতে বলতেই পাস্তার হাফপ্লেটটা তাশদীদের দিকে এগিয়ে দিলেন উনি। তাশদীদ আর খাবে না বলে এবারে বারন করতে উদ্যত ছিলো। সৈয়দ সাহেব আগের কথা থামিয়ে বললেন,

– ওহ তাশদীদ? এই পাস্তাকে কিন্তু মানা করো না। এটা স্পেশাল। খেয়ে দেখোতো কেমন হয়েছে?

তাশদীদের আর বারন করা হয়ে উঠলো না৷ ও নিজেও জানে, নির্দিষ্ট কারনে ভদ্রলোক ওকে অনেকবেশি ভালোবাসে। আর তাশদীদ চায় সে কারন খন্ডন করতে। শুধুমাত্র উনি মুখে কিছু বলেননি বলে বলা হয়ে ওঠেনি ওর। পাস্তার প্লেট হাতে নিলো তাশদীদ। হেসে বললো,

– আন্টি বানিয়েছে, নিসন্দেহে ভালোই হয়েছে। তবে এসবের কিন্তু কোনো দরকার ছিলো না। তোমরা এরকম ব্যস্ত কেনো হচ্ছো বলোতো?

– ব্যস্ত হয়নি। কারন এসব আম্মু একা বানায়নি তাশদীদ।

তাশদীদ চোখ তুলে চাইলো। রিংকির বড় বোন রোজি ওর সামনে এসে দাড়িয়েছে। রোজি কলেজে তাশদীদের ক্লাসমেট ছিলো। বিয়ে হয়েছে কলেজে থাকতেই। স্বামী সরকারী চারকিজীবি। আপাতত সন্তানসম্ভবা। সৈয়দ সাহেব বিদেশ থাকতেই ভালো পাত্র পেয়ে রোজির বিয়ে দিয়ে দেন। গর্ভাবস্থার শেষ সময়টার জন্য বাবার বাড়িতে এসেছে রোজি। আর ঠিক এসময়টাতেই দেশে ফিরেছেন সৈয়দ সাহেব। তাশদীদ হাতের পাস্তার হাফপ্লেট সামনের টিটেবিলে রাখলো। হাসিমুখে বললো,

– আরেহ! রোজি! কেমন আছো?

রোজি একপলক বাবার দিকে তাকালো। তারপর পেটে হাত বুলিয়ে, মলিন হেসে বললো,

– যেমন দেখছো, আছি তেমনই।

তাশদীদ দ্রুততার সাথে ওকে বসতে ইশারা করলো। বাবার পাশে গিয়ে বসলো রোজি। তাশদীদ বললো,

– অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে। বদলে গেছো অনেক।

– তোমাকেও অনেকদিন পর দেখলাম। তবে তুমি একটুও বদলাওনি।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো রোজি। তাশদীদের হাসিটা কমে আসলো। রোজির মলিন হাসিটায় কেমন একটা আক্ষেপ। তাশদীদ সেটাকে মনের ভুল ধরে নিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। বললো,

– আমার কথা ছাড়ো। তুমি কবে এসেছো সাভার? দুলাভাই কেমন আছে?

– আছে ভালোই।

উত্তর দিয়েই রোজি দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। এমন অভিমানী জবাব শুনে আবারো কিছুটা থেমে যায় তাশদীদ। সৈয়দ সাহেব এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুললেন। গমগমে গলায় বললেন,

– আরে তাশদীদ, পাস্তা খাচ্ছো না যে? এটা কিন্তু রিংকি বানিয়েছে। খেয়ে দেখোনা কেমন হয়েছে?

তাশদীদ আবারো পাস্তা হাতে নিলো। বাবার দিকে তীব্র অভিমানী দৃষ্টিক্ষেপ করলো রোজি। ও ছোটবেলা থেকেই অনেক চাপা স্বভাবের মেয়ে। এতোবেশি চাপা স্বভাবের যে, ওর নিজের বাবা-মাও কোনোদিন ধারনা করে উঠতে পারেনি, একসাথে স্কুল কলেজ পেরোনো তাশদীদ ওর কিশোরী মনের প্রথম প্রেম। টাকা আর চাকরী দেখে কলেজে থাকতেই রোজির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন সৈয়দ সাহেব। রোজির জন্য এটা কতোবড় ধাক্কা ছিলো, তা কেবল ওই জানে। আর সেসময় তাশদীদও কলেজপড়ুয়া। বাবার কাছে নিজের অনুভূতি বলার সাহস হয়ে ওঠেনি রোজির। ও ভাগ্য মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু বরাবরের মতোই, ভাগ্য ওর সহায় ছিলোনা। বড়লোক ঘর কেবল ওকে মাথা গোজার ঠাই দিয়েছে, সংসার দেয়নি। টাকাওয়ালা বর কেবল ওকে বিলাসবহুল জীবন দিয়েছে, ভালোবাসা দেয়নি। অথচ ও চেয়েছিলো প্রীতিকার্নিশের মতো একটা সুখের নীড়, তাশদীদের মতো একটা উচ্ছ্বল, হাসিখুশি মানব। হয়নি কোনোটাই।

কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এমনই যে, সেই তাশদীদকেই ওরই ছোট বোনের জন্য ঠিক করতে ওর বাবা-মা উঠেপরে লেগেছে। অবশ্য পরবেই বা না কেনো? রিংকি তো আর রোজি নয়। রিংকি কিছু চেয়েছে আর পায়নি, এমন ঘটনা খুবই বিরল। ও জানে, ওর বাবা-মা সবসময় ওর সব জেদ পুরনে উদ্যত। ক্লাস টেনের মডেল টেস্ট পরীক্ষার আগে ও বাসায় জানায়, তাশদীদকে ওর পছন্দ। শুধু জানায় বললে ভুল হবে। রীতিমতো ধমকি দিয়েছিলো রিংকি। তাশদীদকে না পেলে ও নাকি সুইসাইড করবে। সৈয়দ সাহেব দেশের বাইরে ছিলেন। মেয়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলো না তার। এমনিতেও তাশদীদকে বেশ পছন্দ করেন তিনি। তাই দ্বিমত করেননি। তবে তারও শর্ত ছিলো। তাশদীদের চাকরি না হওয়া অবদি ওয়াসীর সাহেবকে বিয়ে নিয়ে কিছুই বলবেন না। ততোদিন তাশদীদের সাথে সম্পর্ক গাঢ় করার উদ্দেশ্যেই মুলত রিংকিকে পড়াতে বলেছেন তিনি। রিংকির মতো জেদী হতে পারলে, হয়তো আজ রোজির জীবনটাও অন্যরকম হতো। এমনটা ভাবতেই টুপ করে চোখ বেয়ে একফোটা জল গরায় রোজির। সবার অগোচরে তৎক্ষণাৎ ও চোখের জল মুছে ফেললো। কান্না মানায় না ওকে। তাশদীদ ওর প্রেমিক ছিলো না। যাকে একতরফা ভালোবেসেছে, বিয়ের পর তার আক্ষেপে ফেলা চোখের জলের নাম কলঙ্ক। রোজি চোখ তুলে তাকালো তাশদীদের দিকে। হাসিমুখে সৈয়দ সাহেবের সাথে কথা বলছে সে। পাশ থেকে আওয়াজ এলো,

– ওমা তাশদীদ? পাস্তা খাওনি তুমি?

মিসেস সৈয়দের গলা শুনে সামনে তাকালো তাশদীদ। ভদ্রমহিলার হাসিমুখ দেখে ওর হাসি প্রসারিত হচ্ছিলো। কিন্তু পাশে দাড়ানো রিংকির হাসিটা দেখে হাসি কমে আসলো তাশদীদের। পরনে ভারি কারুকাজকরা থ্রি পিস আর ঘাড় বাকিয়ে তাকিয়ে থাকা রিংকির চেহারায় এক অদ্ভুত হাসি। চোখাচোখি হতেই তাশদীদ চোখ সরিয়ে নিলো। আবারো মিসেস সৈয়দের কি তাকিয়ে, হেসে বললো,

– খেয়েছি আন্টি। ভালো ছিলো।

– কেমন আছেন তাশদীদ ভাই?

তাশদীদ আবারো তাকালো রিংকির দিকে। স্বাভাবিকভাবে বললো,

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো রিংকি?

– জ্বি। আপনাকে দেখে বেশ ভালো আছি।

রিংকির কথায় বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না তাশদীদ। রিংকি আগ্রহের সাথে বললো,

– পাস্তাটা কিন্তু আমি বানিয়েছি তাশদীদ ভাই। পছন্দ হয়েছে আপনার?

– পছন্দ কেনো হবেনা? আমার ছোট্ট বোনটা রান্না করেছে বলে কথা! ওয়াও ছিলো।

মিসেস সৈয়দ অপ্রস্তুত হয়ে যান। রিংকিকে তাশদীদের এমন আহ্লাদী ‘ছোট্ট বোন’ সম্বোধনের জন্য সৈয়দ সাহেব নিজেও তৈরী ছিলেন না। গলা খাকারি দিলেন উনি। রোজি বোনের দিকে তাকালো। তাশদীদের কাছে বোন কথাটা শুনেও রিংকির কোনোরুপ হেলদোল নেই। রোজি বেশ বুঝলো, বোনের চেয়ে ওয়াও শব্দটা বেশি শুনেছে রিংকি। মনেমনে ভাবতেও শুরু করেছে, আরো কতোভাবে তাশদীদের মুখ থেকে ‘ওয়াও’ শব্দটা বের করানো যায়। মিসেস সৈয়দ কিছু বলতে চাইছিলেন। রিংকি মাকে বললো,

– আমি রুমে যাচ্ছি। ওনাকে ভেতরে পাঠাও?

মাথা ঝাকালেন মিসেস সৈয়দ। রিংকি হেলেদুলে ভেতরে চলে গেলো। সৈয়দ সাহেব আর তার মিসেস মিলে তাশদীদের সাথে কথা বললেন আরো কিছুক্ষন। তাদের কথার মাঝে তাশদীদ ডানহাতের দু আঙুলে কপাল ডললো দুবার। জীবনে অনেকরকমের ঝামেলা মিটিয়েছে ও। তবে প্রথমবারের মতো এমন উদ্ভট বিষয় ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রিংকির ব্যবহার সুবিধার না। ব্যাপারটা সহজে মিটবে বলে ওর মনে হচ্ছে না।

#চলবে…