কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
131

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪০.

তাথৈ ভেজা শরীরে ড্রাইভ করছে। পেছনের সিটে বসে রুমন কানে হেডফোন গুজে মোবাইল দেখছে আর সামনের সিটে শার্লি কপাল চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে। তাথৈকে ঝাপ দিতে দেখে থমকে গিয়েছিলো ওরা। শার্লি ছুটে যায় কিনারায়। রুমন বুদ্ধি করে তাথৈয়ের গাড়িতে থাকা দড়ি ফেলেছে। তারপর সেটা দিয়ে টেনে ওকে নদী থেকে তুলেছে। এর আগমুহূর্ত অবদি ওদের ঠিক কতোটা ভয় করছিলো, তা ওরাই জানে। ডাঙায় ওঠার পর তাথৈ নিজেও কিছুটা শকে ছিলো। সেটাও বড়জোর সেকেন্ড বিশেকের জন্য। পরপরই স্বাভাবিক হয়ে গাড়িতে চরে বসেছে ও। শার্লি কপাল থেকে হাত সরালো। অধৈর্য্য নিয়ে তাথৈকে বললো,

– তুই সুই’সাইড করতে সাভার এসেছিলি?

– সুই’সাইড করার হলে দড়ি ধরতাম না।

– তাহলে ঝাপ কেনো দিলি নদীতে?

– হুঁশে ছিলাম না।

স্পষ্ট জবাব দিলো তাথৈ। শার্লি বিমূঢ়। ওর মুখ দিয়ে আর কথাই বেরোচ্ছে না। রুমন পেছন থেকে বললো,

– তো হুঁশ হারানোর কি কারন? অবশ্যই নদীর জলে তাশদীদ ভাই ছিলো না তাইনা?

– আই ইমাজিনড সো।

তাথৈয়ের জবাব শুনে রুমনের হাতের ফোন পরে যাওয়ার জোগার হয়৷ কান থেকে হেডফোন খুলে, ও উঁকি দিলো তাথৈয়ের দিকে। শার্লিও অবাক। বিস্ময় নিয়েই বললো,

– ইমাজিন করেছিস মানে?

– আমার ওই মুহুর্তে মনে হয়েছিলো ওই নদীর জলকে ছুঁয়ে দেওয়া মানে তাশদীদকে পাওয়া। তাই ঝাপ দিয়েছি। টিনি ইন্সিডেন্ট। ডোন্ট মেক ইট ইস্যু।

– টিনি ইন্সিডেন্ট? ভাই তুই সাতার জানিস না! আমরা না আসলে তুই পানিতে ডুবে মরে যেতি! আর তুই বলছিস ডোন্ট মেক ইট ইস্যু? আর কি করে ক্ষান্ত হবি তুই? কি করা বাকি আছে তোর?

চোখ কপালে তুলে বললো রুমন। তবে সে কথায় তাথৈয়ের হেরফের হলো না। ওর ভেজা চুলের ডগা থেকে পানি গরাচ্ছে। জামাকাপড়ও ভেজা। রুমনের প্রশ্ন শুনে গাড়ির স্পিডটা বাড়িয়ে দিলো ও। ড্রাইভিং করতে করতে বললো,

– নেশায় বুদ হওয়া মাতাল যেমন সব করতে পারে, আমার অবস্থা ঠিক সে মাতালের মতো। তাশদীদ ওয়াসীর নিরাময়হীন এক নেশার মতো আমায় দিকশূন্য করে দিয়েছে। মাতাল সব পারলেও মিথ্যে বলতে পারে না। বিশ্বাস কর রুমন, আমিও একবিন্দু মিথ্যে বলছি না! আমার হৃৎস্পন্দন যেমন সত্য, আমি তাশদীদকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি, তাও তেমন সত্য। আর সৃষ্টিকর্তা যেমন চিরন্তন সত্য, আমি তাশদীদকে ভালোবেসে সব করতে জানি, তাও ঠিক তেমনি ধ্রুব সত্য! এর কোনো সীমারেখা নেই। এসবের ইতি ঠিক কোথায়, তা আমি জানি না।

শার্লি রুমন হা করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। অনেকটাসময় পর গাড়ি ব্রেক কষলো তাথৈ। হুশে ফেরে ওরা দুজনে। তাথৈ রুমনকে বললো,

– ক্যাশগুলো কি শুকিয়েছে?

– হু? ন্ না না।

– কার্ডটা দে।

সিটের ওপর ভেজা টাকা, পার্সের যাবতীয় জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে। তাথৈকে কার্ড এগিয়ে দিলো রুমন। তাথৈ কার্ড নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। জায়গাটা শপিং কমপ্লেক্স। ভেজা শরীর নিয়ে অম্বুনীড় অবদি ফেরা সম্ভব না বলে জামা কিনতে থেমেছে ও।
তাশদীদ একই কমপ্লেক্সের একটা খাবারের দোকানে বসা ছিলো। ওর সামনে এক জীর্ণশীর্ণ দেহের বয়স্কা মহিলা লেগপিস খাচ্ছে। তাশদীদের দৃষ্টি মোবাইলে থাকলেও মনোযোগ নেই। সামনেরজনের তৃপ্তির খাওয়া ওর মনপ্রাণে যে প্রশান্তি দিচ্ছে, ও কেবল সেটাই ভাবছে। প্রীতিকার্নিশ ফেরার পথে গাড়ির জন্য দাড়িয়েছিলো ও। সেখানে ভিক্ষা করতে থাকা মহিলা ওর কাছে খাবার খাওয়ার জন্য টাকা চায়। তাশদীদ আর সাতপাঁচ ভাবেনি। তাকে নিয়ে ঢুকে গেছে রেস্ট্রুরেন্টটায়। আবেগে চোখের জল ফেলেছে সে। তাশদীদের ইচ্ছে করছিলো মহিলার তৃপ্তি নিয়ে খাওয়াটা চেয়েচেয়ে দেখতে। কিন্তু তাতে মহিলা অস্বস্তিবোধ করতে পারে তাই মোবাইলে চোখ রেখেছে ও। কিছুসময় পর মহিলা আড়ষ্ট ভঙিতে বাকেট এগিয়ে দিলো তাশদীদকে। বললো,

– বাবা তুমি তো খাইলা না। নাও একটা?

তাশদীদ চোখ তুলে চাইলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলো ও। চমৎকার হেসে, টেবিলের দিকে এগিয়ে বসে ও হা করলো। যার অর্থ, খাইয়ে দিন। মহিলা আটকে যায়। তাশদীদ যে তার হাতে খেতে চাইবে, আন্দাজে ছিলো না তার। আবারো চোখ জলে ভরে ওঠে মহিলার। হাসিমুখে একটা লেগপিসের কিছুটা ছিড়ে তাশদীদের মুখে পুরলো সে। চিবোতে চিবোতে আবারো চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতে যাচ্ছিলো তাশদীদ। তখনই ওর নজরে আসে সামনের দোকানে তাথৈ জামা হাতে এগোচ্ছে। তাশদীদ অবাক হলো। ঠিকমতো দেখার পর বুঝলো, তাথৈয়ের চুল আধভেজা, জামাও ভেজা। যেখানে যেখানে পা রাখছে, সেখানের টাইলসে পানি। মানে ওর সর্বাঙ্গ ভেজা।

– খালা একটু বসোতো। আমি আসছি।

তাশদীদ উঠে দাড়ালো। তাথৈকে অনুসরন করতে করতে এগোচ্ছিলো ও। হঠাৎই এক সেলসবয় এসে বুকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় ওকে। তাশদীদ একবার বুকে থাকা হাত আরেকবার ছেলেটাকে দেখলো। ছেলেটা কর্কশ আওয়াজে বলে ওঠে,

– কি ভাই? লেডিস ট্রায়াল রুমের দিকে কেনো?

ছেলেটার কথা শুনে তাথৈ পেছনে ফেরে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাশদীদকে দেখে ওর ভেতরে যেনো অদ্ভুত সুখের পায়ড়া ডানা ঝাপটায়। এদিকে তাশদীদ অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে। তাথৈ এগিয়ে আসলো। তাশদীদের বুকে থাকা সেলসবয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,

– আপনার ভাই আপনার ভাবীকে ফলো করছিলো। কোনো সমস্যা?

সেলসবয় কোনোমতে ‘সরি স্যার, সরি ম্যাম’ বলে, সম্পূর্ন বিনয় দেখিয়ে স্থানত্যাগ করলো। তাশদীদ প্রসারিত চোখে চাইলো তাথৈয়ের দিকে। বুকে দু হাত গুজে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে সে। আধভেজা চুল, সিক্ত চোখের পাপড়ি, শুকনো ঠোঁট। তাশদীদ দৃষ্টি সরায়। আবারো তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আমার জানামতে সাভারে আজ কোনো সুইমিং কম্পিটিশন ছিলো না। এখানে কেনো তুমি? আর এই অবস্থা কি করে হলো?

– আমার জানামতে আপনিও সেলসবয়ের ভাই নন, আমিও তার ভাবী নই। তবুও আমার মিথ্যে জবাব শুনে আপনি চুপ কেনো? এই মিরাকলটা কিকরে হলো?

তাথৈয়ের প্রশ্নবানে তাশদীদ একদন্ড আটকে রইলো। পরপরই একপা এগিয়ে তাথৈয়ের একহাত ধরলো ও। মাঝের দুরুত্ব অনেকবেশি কমে যাওয়ায় তাথৈ কিছুটা ভরকে যায়৷ হাত বুকে গোজায় নতুন জামাটাও ভিজে উঠছিলো ওর। তাশদীদ ওর হাত নামিয়ে দিয়ে বললো,

– চেঞ্জ করে আসো, দিচ্ছি জবাব।

তাথৈ চাওনি বদলায়। কি হলো ওর, ও ছুটে চলে গেলো ট্রায়ালরুমের দিকে। সেখানে একাকী বড়বড় দম নিলো কয়েকটা। এমনটা না তাশদীদ প্রথমবার ওর এতো কাছে এসেছে। তবে এরআগে রাগ, জেদের জন্য সে কাছে আসারা গুরুত্ব না পেলেও, আজ তাশদীদ কাছে আসায় ওর দম বন্ধ লাগছিলো। দ্রুততার সাথে চেঞ্জ করে বাইরে উঁকি দিলো তাথৈ। তাশদীদ কিছুটা দুরেই উল্টোপাশ হয়ে ফোনে কথা বলছে। আবারো ঢোক গিলে গলা ভেজালো তাথৈ। গুটিগুটি পায়ে, চোরের মতো বেরিয়ে আসলো শপিংমল থেকে। গাড়িতে একপ্রকার ছুটে এসে বসেছে ও। রুমন ব্যাকসিটে ঘুমিয়ে গেছে। শার্লি সামনের সিটে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো। তাথৈকে ওমন হন্তদন্ত দেখে বললো,

– আবার এমন অস্থির হচ্ছিস কেনো?

– তাশদীদ…!

অস্থিরচিত্ত্বে গাড়ি স্টার্ট দিলো তাথৈ। তাশদীদ এখানে কোত্থেকে আসবে এটা ভেবে কিয়দক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো শার্লি। পরপরই কল্পনায় নিজের গালে কষিয়ে কয়েকটা চড় মারলো ও। সে চড়ের ঠাস ঠাস শব্দের সাথে ছন্দ তুলে, আপনমনে বললো,
‘তাশদীদ ভাই ছাড়া তোর জীবনে আর কোনো কারন নাই। আমার প্রশ্ন করাই বুল হয়চে তাথৈ। খমা করে দে!’

মাঝে পেরোলো আরো দুদিন। ক্লাসটাইমের আগেই ক্যাম্পাসে পৌছায় তাথৈ। ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে দেখে শার্লি বার্গার খাচ্ছে। তাথৈ এগিয়ে গিয়ে ওর সামনের চেয়ারটায় বসলো। ব্যাগ কাধ থেকে নামিয়ে বললো,

– রুমন ক্লাসে?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো শার্লি। তাথৈ ব্যাগ থেকে বই বের করলো একটা। তারপর গিয়ে একটা কোল্ডড্রিংক নিয়ে আসলো। শার্লি পানীয় কেনার কথা ভুলে গেছে। সবেমাত্র হিচকি তুলতে যাবে, তাথৈ এসে ওর সামনে কোল্ডড্রিংক রাখলো। কয়েকঢোক খাওয়ার পর স্বাভাবিক হয় শার্লি। একটা দম ছেড়ে বললো,

– তোর এই কেয়ারিংয়ের জন্যই ভরসা পাই।

– তুল্য তোকে উঠতেবসতে আছাড় দেবে আর আমি তোকে বাচাবো, এমন ভয়-ভরসা কোনোটারই প্রয়োজন নেই। তুল্য নিজেই অনেক কেয়ারিং। ব্যস কাউকে বুঝতে দেয়না।

বার্গারে কামড় দিতে গিয়েও আটকে যায় শার্লি। তাথৈ একদমই স্বাভাবিকভাবে বসে। শার্লির আগেরদিনের কথা মনে পরে যায়। রাস্তায় দাড়িয়ে একটা আইসক্রিম সাবাড়ের পর আরেকটা নিতে যাচ্ছিলো ও। সেটা বোধহয় কোনোভাবে আলফেজ পুত্রর চোখে পরেছিলো। সে তৎক্ষনাৎ ওকে কল করে ধমকি দিয়েছে, ‘আইসক্রিম কেনো দুইটা খেতে হয়? পেট ভরতে? নাকি সর্দিতে নাক ভরতে? কাল ক্লাসে যদি একবারও তুই হাইচ্চু দিয়েছিস শার্লি, আমার কনসেনট্রেশানে যদি তোর জন্য এতোটুকোও ব্যাঘাত ঘটেছে, তোকে আমি ক্লাসের জানালা দিয়ে ফেলে দেবো! মাইন্ড ইট!’
শার্লির আর দ্বিতীয় আইসক্রিমটা খাওয়া হয়নি। তখন রাগ হলেও পরে ওর অনুভব হয়, হুটহাট তুল্য যে ধমকিগুলো দেয়, তা মুলত ওর ভালোর জন্যই। তাথৈ বই পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে। শার্লি দেখলো ওর পেছনে শান্ত, টিটু আর তাশদীদ আসছে। তাশদীদ আর শান্ত মিলে খোচাচ্ছে টিটুকে। ওরা এসে কিছুটা পেছনের টেবিলটাতে বসে যায়। তবে উল্টোপাশ হয়ে বসা তাথৈকে দেখেনি বা শার্লিকেও খেয়াল করেনি। শার্লি যেনো কথা ঘোরানোর সুযোগ পেয়ে গেলো। এগিয়ে বসে ফিসফিসিয়ে বললো,

– তাশদীদ ভাই এসেছে তাথৈ।

– স্কাইব্লু শার্ট। আমাদের টেবিলের দুই টেবিল পেছনে। জানি।

শার্লি চমকায়। তাথৈ পেছন ফেরেনি। তবুও গরগর করে সব বলছে। নিশব্দে হাসলো তাথৈ।
তাশদীদের গলা শুনেছে ও। আর ওর হাতঘড়িতে তাশদীদের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। শার্লি বললো,

– প্রেমে পরে জ্যোতিষী হয়ে যাচ্ছিস নাকি?

তাথৈ জবাব দিলো না৷ শার্লি বাহানার মতো করে বললো,

– এ ভাই তুই তাশদীদ ভাইকে বলে দিচ্ছিস না কেনো বলতো? বলে দে না! আমার কত্তো শখ, তোদের দুটোকে চুটিয়ে প্রেম করতে দেখবো! অনেকদিন তো হলো! এখনো কেনো বলছিস না?

– প্রেমটেম আমার দ্বারা হবে না। সোজা বিয়ে করে নেবো।

মোবাইল থেকে চোখ তুলে টিটুকে জবাব দিলো তাশদীদ। মনটা ভালো আছে ওর। সৈয়দ সাহেব দুদিন আগে কল করেছিলেন ওকে। রিংকির ব্যবহারে ক্ষমা চেয়েছেন উনি। যোগাযোগ না বাড়ালেও, তাদের অনুধাবনে খুশি হয়েছে তাশদীদ। প্রীতিকার্নিশেও স্বস্তি মিলেছে। কিন্তু আজ ক্যাম্পাসে এসে দেখে টিটুর অবস্থা খারাপ। তার তিনমাসের প্রেমিকার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। ও আর শান্ত যতোই ওকে শান্তনা দিতে যাচ্ছে, ততোই বেচারা হাউকাউ করে উঠছে। একসময় টিটু তাশদীদকে বলেই উঠেছে, ‘প্রেম তো করিস নি জীবনে! তুই প্রেমের কি বুঝবি?’ তার জবাবটাই দিয়েছে তাশদীদ।
তাথৈ শার্লির দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো একটা। তারপর বুকে হাত গুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। মাথা নেড়ে মুচকি হাসলো শার্লি। আস্তেকরে বললো,

– তুই যাই বলিস, তোর আর তাশদীদ ভাইয়ের কানেকশন তো আছে! প্রশ্ন করি তোকে, জবাব দেয় তাশদীদ ভাই।

তাথৈ নিশব্দে হাসলো। শান্ত টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে পরেছে। টিটু তাশদীদকে জ্ঞান দেওয়ার মতো করে বললো,

– বিয়ের জন্যই প্রেম করতে হয়। ভালোবাসতে হয়।

– আমি নাহয় বিয়ে করেই প্রেম করবো। ভালোবাসবো।

তাথৈয়ের চেহারা মলিন হয়।নিরস দৃষ্টিতে শান্ত-টিটু একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তাশদীদ টিটুর কাধে চড় মেরে বললো,

– এসব ছাড়! তোর শোক কিসে মিটবে টিটু? যা খাবি খা! আজ আমি পে করবো।

– আমার প্রেমিকার বিয়ে হইছে ব্যাটা! পে করবি অন্যকোথাও পে কর! এইখানে ধরে আনলি ক্যান? প্রেমিকার বিয়ের শোকে আমি এখন রুহ আফজা খাবো খাকি?

শান্ত শব্দ করে হেসে দিলো। তাশদীদও হেসে বললো,

– ভালো বলেছিস। তোর রুহের জন্য এখন রুহ আফজাই বেস্ট! কিন্তু এখানে তো রুহ আফজা নেই। চল বাইরে যাই। যতো বোতল চাস, খাবি চল!

টিটু আহম্মক হয়ে যায় ওর কথায়। শান্ত উচ্চস্বরে হেসে ওকে বগলদাবা করলো। তাশদীদও ওকে ধরে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
ওরা বেরিয়ে যেতেই উঠে দাড়ায় তাথৈ। হনহনিয়ে চলে যায় তাশদীদরা যে টেবিলটাতে বসেছিলো, তার পরের টেবিলটাতে। টেবিলের কোনায় একপা তুলে বসলো ও। চেয়ারে বসা মেয়েদুটো হচকিয়ে যায়৷ ওরা অন্য কেউ নয়, তাথৈয়ের সেই পিকনিকের সিনিয়র রুমমেটরা। তাথৈ হাসিমুখে একজনকে বললো,

– কেমন আছেন আপু? তাশদীদ ওয়াসীরকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখার স্বভাব যায়নি আপনার এখনো?

– ম্ মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুইজ তাথৈ!

অপ্রস্তুত জবাব দিলো মেয়েটা। তাথৈ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার দিকে। ও খেয়াল করেছে, পিকনিক থেকে আসার পরও এই মেয়ে তাশদীদকে দেখলেই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে। ও বলার পর হয়তো তাশদীদের সামনে গিয়ে ওকে বিরক্ত করে না, তবে তাকিয়ে থাকে। তাথৈ তেমনি সুমিষ্ট গলায় বললো,

– তোতলাচ্ছেন কেনো? আমি তো কিছু বলছি না আপনাকে। যতো খুশি দেখুন ওকে। হ্যান্ডসাম ছেলে! দেখতেই পারেন! এজন্য তো আর আপনার চোখ তুলে নিতে পারিনা বলুন?

ব্যস এটুকো বলেই তাথৈ চলে আসলো। ব্যাগ নিয়ে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলো ও। ও ভেবেছিলো, কেউ তাশদীদকে বিরক্ত করলে সেটা ওর সহ্য হবে না। কিন্তু সত্যি তো এটাই, কোনো মেয়ে তাশদীদকে দেখলে সেটাও ওর সহ্য হচ্ছে না। তাথৈয়ের রাগ হচ্ছে। প্রথমক্ষেত্রে নিজেকে সামাল দেওয়ার কথা ও ভাবেনি। কিন্তু দ্বিতীয়ক্ষেত্রে ওর নিজেকে সামলানো প্রয়োজন, এমনটা ভেবে জোর করে নিজেকে স্থির রাখলো ও।
আফিফ এসেছিলো ক্যান কিনতে। কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে তাথৈয়ের বলা কথা কিছুটা শুনেছে ও। বিষয়টা যে তাশদীদ, এ নিয়ে ওর কোনো সন্দেহ নেই। সন্দেহ দুর করতে আফিফ সিনিয়র মেয়েটার দিকে আগালো। জিজ্ঞেস করলো তাশদীদকে নিয়ে তাথৈ কি বলে গেলো। মেয়েটা তীব্র বিরক্তিতে ওকে জানিয়ে দেয়, তাথৈ তাশদীদকে পছন্দ করে। জবাব শুনে কুটিল হাসলো আফিফ৷ সে হাসির মানেটা হয়তো এমন, তাথৈ এ অবদি ওকে যতোবার যতোভাবে অপমান-অপদস্থ করেছে, সবকিছুর জবাব হিসেবে ওর একটা দুর্বলতা জানা প্রয়োজন ছিলো। আর সেটা ও পেয়ে গেছে। তাথৈ আলফেজের দুর্বলতার নাম, তাশদীদ ওয়াসীর।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪১.

অডিটোরিয়ামে উপন্যাস মঞ্চায়নের প্রস্তুতি চলছে। ইংরেজী উপন্যাস, Pride and Prejudice. রুমন অভিনয় করবে সেখানে। ওর ব্যস্ততা থাকায় তাথৈ আর শার্লি ক্লাসশেষে চলে এসেছে। একসাথে খেতে যাবে তিনজনে। ফাঁকা দর্শকসিটের প্রথম সারিতে বসে, ওরা দুজনে স্টেজে অপেক্ষা করছে কখন রুমনের ব্যস্ততা শেষ হবে। অবশ্য অপেক্ষা করছে বললে ভুল হবে। শার্লি গা ছেড়ে দিয়ে সিটে আধশোয়া হয়ে আছে, তাথৈ সিটের ওপর পা তুলে বসে বই পড়ছে। তাশদীদ, টিটু আর শান্ত ওখান দিয়েই পাশ কাটাচ্ছিলো। দরজা বরাবর যাওয়ার সময় সামনের সারিতে শার্লিকে চোখে পরে শান্তর। ও থেমে যায়৷ হাটতে হাটতে থামে তাশদীদ-টিটুও। তাশদীদ দরজা দিয়ে স্টেজের দিকে উঁকি দিলো। সেখানে সবার রিহার্সেলের ব্যস্ততা। রুমনকে চোখে পরলো তাশদীদের। ক্লাস না থাকায় ও শান্তকে বললো,

– নাট্যকলার রিহার্সেল। দেখবি?

– পেছন থেকেই দেখি। সামনে যাবো না।

তাশদীদ দ্বিমত করলো না। এককোনে দাড়িয়ে গেলো তিনজনে। তাশদীদ, টিটু স্টেজে তাকিয়ে থাকলেও শান্ত পেছন থেকে শার্লিকে দেখছিলো। কিছুটা সময় পর স্টেজে দুটো ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করে বলডান্স শুরু করে। তাশদীদ কিছুটা আফসোস বুঝিয়ে, মাথা নেড়ে বললো,

– পশ্চিমা সংস্কৃতি!

– পড়াশোনার জন্যই এগুলো করতে হচ্ছে।

– উপন্যাসে বলডান্স আছে বলেই বলডান্স করতে হবে? স্কিপ করা যায় না?

– যদি টিচাররা স্কিপ করতে না দেয় তো? ওরা আর কি করতে পারে?

– এমন মাত্রাতিরিক্ত হাত ধরাধরি না করেও বলডান্স করা যায়।

তাশদীদের টিটু কপাল কুঁচকালো। তাশদীদ অশালীনতার সপক্ষে না সেটা ও আগে থেকেই জানে। কিন্তু জুটি বেধে নাচা, বলডান্স কেউ না ছুঁয়ে কি করে করতে পারে?
ওদের ঠিক পেছনের দরজা দিয়ে এক মেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তাশদীদের কথা পুরোটা কানে যায় ওর। সংস্কৃতমণা মেয়ের মনে হয়, তাশদীদ সাহিত্যকে অসম্মান করছে, ওদের মঞ্চায়নকে কটুদৃষ্টিতে দেখছে। এগিয়ে এসে বেশ নম্র আওয়াজে বললো,

– ভাইয়ারা কোন ডিপার্টমেন্ট?

– বায়োকেমিস্ট্রি।

টিটু জবাব দিলো। মেয়েটা তাশদীদকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,

– ও আচ্ছা। আপনি কতো সেশনের ভাইয়া?

তাশদীদ জবাব দেয়। তাশদীদ এক সেমিস্টারের জুনিয়র জানতেই মেয়েটার চোখমুখ পুরোদমে পাল্টে যায়৷ সেখানে দাড়িয়েই সে চেচিয়ে ডাক লাগালো,

– সোহান?

নাচ, রিহার্সেল থামিয়ে স্টেজের সবাই দর্শকসারির পেছনে তাকায়। সাথে সামনের সিটে বসা শার্লি, তাথৈও। পেস্ট রঙের শার্টে গুটানো হাতার তাশদীদকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয় তাথৈ। তবে কিছু বললো না। শান্ত, টিটু বুঝে উঠতে পারে না কি ঘটেছে। মেয়েটা আবারো চেচিয়ে বললো,

– এই জুনিয়র জ্ঞানী ভাইয়া বলছে তোরা নাকি অশ্লীলভাবে নাচানাচি করছিস? বলডান্স নাকি তোদের মতো ছোঁয়াছুঁয়ি না করেও করা যায়?

পরিস্থিতি অহেতুক ঝামেলাপূর্ণ হচ্ছে বুঝে তাশদীদ কপাল চেপে ধরলো। শান্ত প্রচন্ডপরিমানে বিরক্ত হলো মেয়েটার কথায়। ফোন বের করে নিজের দলের ছেলেপেলেদের ডাকতে যাচ্ছিলো ও। তাশদীদ বাধা দেয়। এখানে ইতিমধ্যে ওর কথাকে বাড়িয়ে বলা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখালে সেটা আরো বাজে হয়ে যাবে। তাথৈ শুধু আগ্রহভরে দেখছে। ও জানে, তাশদীদ এমন কিছু বলেনি। বললেও সেভাবে বলেনি, যেভাবে মেয়েটা বলছে। স্টেজ থেকে দুইতিনটা ছেলে এসে তাশদীদের সামনে দাড়ালো। বেশ কড়া কন্ঠে বললো,

– খুব জাজমেন্টাল হতে এসেছিস, আমরা শ্লীল না অশ্লীলভাবে নাচছি। চল সামনে চল! ওঠ!

– ওই…

শান্ত উঠে দাড়াচ্ছিলো। তাশদীদ আবারো ওকে থামিয়ে দিলো। বিনয় বজায় রেখে বললো,

– আপনারা আপনাদের মতো চলছেন, চলবেন। আমি জাজমেন্টাল হলে তো আর আপনাদের প্লানে চেইন্জ আসবে না। যদিও আমি আপুর বলা অশ্লীল শব্দটা ব্যবহার করিনি, স্টিল, আ’ম সরি।

– তুই কি বলেছিস বলিসনি সেটা ম্যাটার করে না। আমরা কি বলছি, সেটা ম্যাটার করে। চল সামনে চল! স্টেজে!

ছেলেরা ধমকাধমকি শুরু করেছে। তাশদীদ বাধ্য হলো এগোতে। রুমন অসহায়ভাবে তাকিয়ে ইশারায় ওকে সরি বললো। তাশদীদও ইশারায় বোঝালো, ব্যাপার না। শান্ত শুধু হজমের চেষ্টা করছে। স্টেজে নিয়ে গিয়ে একটা ছেলে তাশদীদকে বললো,

– তুই এখন আমাদের ধরাছোঁয়া ছাড়া বলডান্স করে দেখাবি। নে! চুজ কর! কার সাথে ধরাছোঁয়ার ছাড়া বলডান্স শেখাবি, চুজ কর!

তাশদীদের নিজের কপালও কুচকে আসে এবারে। ও ভেবেছিলো হয়তো ওকে সামনে এনে কয়েকটা কটু কথা শুনিয়ে বিষয়টা মিটিয়ে নেবে। কিন্তু এ তো অন্যকিছুই বলছে। ছেলেটা স্টেজের একপাশে দাড়ানো সাত আটটা মেয়েকে বললো,

– এই তোরা কেউ ওর সাথে আমাদের বলডান্স শেখাতে পারবি? ধরাছোঁয়া ছাড়া বলডান্স!

স্টেজে দাড়ানো সুঠামদেহী সুদর্শন যুবকের সাথে নাচার ইচ্ছা মনেমনে সবগুলো মেয়েরই ছিলো। কিন্তু এখানে সম্মতি দিলে পরবর্তীতে বিভাগীয় ভাইয়ের অপমান সহ্য করতে হতে পারে এজন্য কেউই মত দিলো না। তাশদীদ কিছু বলতে যাবে, সামনের সারির সিট থেকে তাথৈ উঠে দাড়িয়ে হাত উচু করলো।
স্টেজের সবাই চকিত দৃষ্টিতে চায় ওর দিকে। খয়েরী শার্ট, সাদা-খয়েরী মিশেল স্কার্ট পরিহিত তাথৈকে দেখে তাশদীদও অবাক হলো। সেদিন শপিংমল থেকে রীতিমতো উবে গিয়েছিলো।মেয়েটা। তারপর আর দেখাও হয়নি ওরসাথে। এভাবে দেখা হবে, সেটাও কল্পনাতীত। প্রশ্নকারী ছেলেটার রাগ হলো। ও চায়নি এখান থেকে কেউ সম্মতি দিক। খিঁচে উঠে বললো,

– কোন সেশন?

– থার্ড ইয়ার।

তাথৈয়ের জবাব শুনে আর কিছু বলার পেলোনা ছেলেটা। চাপা রাগ নিয়ে স্টেজ ছেড়ে দেয় সবাই। তাথৈ তাশদীদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে স্টেজে হাজির হয়। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয় কিছুক্ষণ। তাশদীদ বললো,

– পারবে?

তাথৈ অদ্ভুতভাবে হেসে ফেললো। এই মানুষটা যদি জানতো, ওর জন্য তাথৈ আলফেজ সব পারে, তাহলে এতো সুন্দরমতো ‘পারবে?’ বলে প্রশ্ন করতো না। তাশদীদ সময় নিয়ে ওর হাসিটা দেখলো। ওর মনে হলো, এমন হাসি উপন্যাসের মেয়েদের হয়। বাস্তবে কোনো মেয়ের হাসি এতো সুন্দর হয় না। তাথৈ আলফেজ নামক রাগান্বিতার তো কোনোমতেই হওয়া সম্ভব না। কিন্তু কক্সবাজার থেকে ফেরার পর আজ আরো একবার ওর মনে হলো, ওর মায়ের পর, তাথৈয়ের হাসিই পৃথিবীর সব মেয়ের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর হাসি। তাথৈ হাত উচিয়ে বললো,

– তাথৈ আলফেজ সব পারে।

তাশদীদ দুরুত্ব রেখে ওর হাত ছোঁয়ার ভঙিমা করলো। কয়েক সেকেন্ড পর ব্যাকগ্রাউন্ডে Taylor Swift এর ‘Lover’ গান। শুরু হয় তাথৈ-তাশদীদের স্পর্শবিহীন নাচ। তাথৈ যেনো স্বপ্নের কোনো দুনিয়ায় হারিয়ে যায়। প্রতিটা শব্দ নিজেকে উৎসর্গ করতে থাকে ও। নাচতে নাচতে উচ্চস্বরে গেয়ে ওঠে,

‘Ladies and gentlemen,
will you please stand?
With every guitar string,
Scar on my hand.
I take this magnetic
Force of a man, To be my…Lover!

My heart’s been borrowed and
Yours has been blue.
All’s well that ends well to
End up with you.
Swear to be over
Dramatic and true, to my…Lover!

পুরোটা সময় মুগ্ধচোখে চেয়ে, নেচে শেষের ‘Lover’ উচ্চারণ করে তাশদীদের গালের দিকে হাত বাড়াতে উদ্যত হয় তাথৈ। তাশদীদ তৎক্ষনাৎ ওর হাত ধরে ফেললো। গান থেমে যায়। তাথৈ চমকে উঠে অনুধাবন করে, আত্ননিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে ও। তাশদীদ ওর হাত ধরে রেখে কিছুক্ষণ ওর চোখে চেয়ে রইলো। হয়তো তাথৈয়ের মনের কথাকে বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। নাচের সময় মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকা তাথৈ আর এখন চকিত তাথৈয়ের চোখের চাওনিতে হাজারো তফাৎ। নিজেকে দ্বন্দে না রেখে তাশদীদ ওকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলো,

– ডু ইউ লাভ মি তাথৈ?

‘ *** সেশনের মাস্টার্স পড়ুয়া তাশদীদ ওয়াসীর একজন প্রতারক। পূর্ববর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্নাতকের ছাত্র থাকাকালীন তার পরীক্ষণ জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছিলো। টরেন্টোতে পড়াশোনারত বাংলাদেশোদ্ভোত এক শিক্ষার্থীর পরীক্ষণপত্র হুবহু নকল করে নিজের পরীক্ষণ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো সে। জৈবপ্রযুক্তির যে আবিষ্কার বর্তমান বিশ্বে বহুল সাড়া ফেলেছে, টরোন্টোতে সে জিনোম সিকোয়েন্সে বিক্রিয়া ঘটিয়ে অভিনব এক সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছিলো জেইন। আর ওর সিকোয়েন্সিং পোর্টালে জমা দেওয়ার পরপরই সেটাকে ছাপিয়ে নিজের বলে দাবী করে তাশদীদ ওয়াসীর। এতোবড় প্রতারণার জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় চেয়ারম্যান তার ছাত্রত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত অবদি নিয়েছিলেন। ভয় পেয়ে সেসময় তাশদীদ নিজের ভুল স্বীকার করে এবং ক্ষমা চায়৷ অনেকরকম আকুতি মিনতির পর ওকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষের সুযোগ দেওয়া হয়।

এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে তাশদীদ বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দেয়। সৌভাগ্যক্রমে টিকেও যায় পরীক্ষাতে। তবে এখানে আসার পর থেমে থাকেনি সে। চোরা পেপার্সে নাম করার চেষ্টা বর্তমানেও বলবৎ আছে তার। যতোদুর আমি শুনেছি, নতুন ক্যাম্পাসে এসে শুরুতে সে তার তিন বছর জুনিয়র *** সেশনের সাথে প্রজেক্ট শুরু করে। যেখানে সিলেবাস বহির্ভূত অনেককিছুই করানো হয়েছে। এছাড়াও বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীনপ্রকৌশল বিভাগেও নাকি তার চলাফেরা জারি আছে। জানিনা তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকদের মধ্য থেকে কে বা কারা জড়িত। একটা হায়ার স্টাডি শেষ না করা, কোনোরুপ পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া শিক্ষার্থীকে এভাবে সাচ্ছন্দ্যে প্রজেক্টে রাখা হচ্ছে কেনো? কোনোরকম মেইনটেইনেন্স ছাড়া একজন টিচারের রেফারেন্সে ল্যাবগুলোতে অবাধে যাতায়াত করতে দেওয়া হচ্ছে কেনো? যে সুযোগটা অন্যান্য শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না, তা আলাদাকরে তাশদীদ ওয়াসীরকে কেনো দেওয়া হচ্ছে? কে বা কারা দিচ্ছে ওকে এই সুবিধা? একটা কুৎসিত অধ্যায় ওর আগের বিদ্যাপিঠ প্রত্যক্ষ করে এসেছে। দেশসেরা বিদ্যাপিঠেও একই ইতিহাস কেনো গরাচ্ছে? হুয়াই?

(নোট: এই সম্পর্কিত প্রমাণাদির ডক ফাইলের লিংক আমি কমেন্টে এটাচ করে দিচ্ছি। জেইনের পেপার, তাশদীদের পেপার, ওর পেপার ব্যান হওয়া, ক্ষমা চেয়ে আবেদন, বিভাগীয় চেয়ারম্যানের নোটিশ সবই দেওয়া আছে সেখানে। এবার আপনারাই সত্যটা যাচাই করে দেখুন।)’

মাস্টার্সে ভর্তির পর এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে, তা আগে থেকেই জানতো তাশদীদ। কিন্তু এসবকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজে পোস্ট হবে, এটা ওর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। তাশদীদ সেকেন্ড দশেক চোখ বন্ধ রেখে নিজেকে সামলালো। কদিন হলো ওর মানসিক অবস্থা এমনিতেও ভালো নেই। তারওপর এমন একটা ঘটনা। চোখ খুলে মোবাইলটা চেক করলো আরেকবার৷ ইতিমধ্যে ওর মোবাইলে ত্রিশের অধিক কল এসেছে। রুমের দরজায় নক পরে এরমাঝে। ওয়াসীর সাহেব বাইরে থেকে ডাকলেন তাশদীদকে। তাশদীদ উত্তর নিয়ে নিজেই বেরোচ্ছিলো। ওয়াসীর সাহেব মোবাইল হাতে রুমে ঢুকলেন। কিছুটা চিন্তিত স্বরে শুধালেন,

– এসব কি তাশদীদ? তোমাকে নিয়ে এসব রিউমার কে ছড়াচ্ছে?

বাবার কথায় তাশদীদ সন্তুষ্ট হলো। ও জানতো, ডকফাইল কেনো, স্বয়ং ও নিজেমুখে স্বীকার করলেও এমন জঘণ্য মিথ্যা ওয়াসীর সাহেব কখনোই মানবেন না। এগিয়ে গিয়ে বললো,

– আমি জানিনা বাবা। তবে তুমি চিন্তা করো না। আমি সামলে নেবো।

– তুমি সামলে নেবে সেটা আমি জানি। কিন্তু কথা হলো তুমি এতোভালো একটা রেজাল্ট নিয়ে একাডেমিক ইয়ারগুলো শেষ করলে, এখন এই বানোয়াট কথাগুলো কেউ কেনো ছড়াচ্ছে? তোমার সাথে কারো কিসের শত্রুতা?

তাশদীদ জবাব দিলো না। দুচারটে কথা বলে বাবাকে আস্বস্ত করলো ও। ওয়াসীর সাহেব উত্তেজিত না হলেও চুপ রইলেন না। তাশদীদকে আইনি ব্যবস্থা নিতে বললেন তিনি। স্থানীয় ইনচার্জ তার চেনাজানা। উপায়ন্তর না দেখে তাশদীদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো বাবার কথায়। মিসেস ওয়াসীর প্রীতিকার্নিশ নেই। দুদিনের জন্য তামজীদকে নিয়ে বাবার বাসায় গিয়েছেন তিনি। মোবাইলে ওনার কল দেখে ওয়াসীর সাহেব রুম থেকে বেরোলেন। তাশদীদ শান্তর নম্বরে কলব্যাক করলো। সেখান থেকে আঠারোটা মিসড কল এসেছে। রিং বাজতেই তৎক্ষনাৎ রিসিভ হয় কলটা। ওপাশ থেকে শান্ত ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,

– তোর মিনিমাম সেন্স আছে কি নেই তাশদীদ? কতোবার কল দিয়েছি তোকে! ফেইসবুকে…

– পেইজ এডমিন কে বা কারা কিছু জানিস?

শান্ত থেমে যায়। তাশদীদের ধীরস্থির কন্ঠস্বরের কাছে ওকে হার মানতেই হয়। একটুখানি চুপ থেকে শান্ত জবাব দিলো,

– প্রায় সাড়ে চার বছর হলো চলছে পেইজটা। ভালোমন্দ সবকিছুই ওখানে পাব্লিশ হয়। নিসন্দেহে ওটা ভার্সিটির অথোরিটি চালায় না। পেইজে সত্যিটা পাব্লিশ করতে গিয়ে অনেক ক্ষমতাধর নাটের গুরুদের পক্ষে বিপক্ষে বলতে হয়। নিরাপত্তাজনিত কারনেই বোধহয় এডমিন নিজেকে আড়াল রেখেছে।

তাশদীদ চুপ রইলো। শান্ত আবারো বললো,

– পোস্টে কোনো কার্টেসি নেই। মানে যে ডকুমেন্টগুলো পেইজে পাব্লিশের জন্য দিয়েছে, সেও আড়াল থাকতে চায়। তুই ডকফাইলগুলো দেখেছিস?

– কপি আমার কাছেও আছে। ওগুলো তো আর নকল না।

তাশদীদের জবাবে এবারে খিঁচে উঠে দাড়িয়ে যায় শান্ত। সামনে থাকা চেয়ারটা লাথি মেরেছে ও। রুমে একটা জুনিয়র ছেলে বসেবসে পড়ছিলো। শান্তকে রাগতে দেখে বই নিয়ে সুড়সুড়িয়ে বেরিয়ে গেলো ও রুম থেকে। শান্ত চেচিয়ে বললো,

– নকল না মাই ফুট! এক কু*রবাচ্চা তোকে ঠকিয়েছে। এখন এখানকার কোন জানো’য়ার সেগুলো ঘেটে তোর এখনকার প্রজেক্টেও ঝামেলা করছে! তোর কি বুঝে আসছে না এতে আমাদেরই ক্ষতি হচ্ছে? একটা জাতিকে শেষ করে দিতে মেধাচুরির চেয়ে বড় অস্ত্র আরকিছু আছে? এই শিক্ষিত লম্পটদের জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক কোথায় নামছে বুঝতে পারছিস না তুই?

– আমি বলেছি ডকফাইলগুলো নকল না। কিন্তু ওগুলো সত্যিও না। ওরা যখন বিষয়টাকে আবারো টেনেছে, এবার সত্যিটাকে দেখানোর দায় আমার।

তাশদীদ নিজেকে স্থির রেখেই শান্তর সাথে কথা বললো। শান্ত কোমড়ে হাত রেখে দম ফেললো। তাশদীদের কথাগুলো মনোযোগের সাথে শুনে বললো,

– ওকে। মনেকর কাজ হয়ে গেছে।

কল কেটে ফোন বিছানায় রাখলো তাশদীদ। হাটুতে দুহাত ঠেকিয়ে, নখ ভাজে একত্র রেখে ও চোখ তুলে তাকালো রুমের জানালার দিকে। ওর ভেতরে যে ঝড় চলছে, আপাতদৃষ্টিতে কারো চোখে পরার মতো না তা। তাশদীদের চোখ ভরে ওঠে। অদ্ভুত শূণ্যতায় বুক ভারী হয়। মনে হয়, ওর দমবন্ধ লাগছে। ওর কাউকে কাছে দরকার, পাশে দরকার। যার কোলে মাথা রেখে সব ভুলে যাওয়া যাবে। যাকে জরিয়ে ধরলে সব দুঃখ হার মানবে। নাম না জানা এক যন্ত্রনায় চোখ বন্ধ করে নেয় তাশদীদ। অদ্ভুতবাবে ওর বন্ধ চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে সে অনাকাঙ্ক্ষিত রমনী। তাথৈ আলফেজ, আর তার জবাব। ‘না!’

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪২.

‘অনার্সেই পরীক্ষণ চুরির দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন তাশদীদ ওয়াসীর। মাস্টার্সে ভর্তির পর পুনরায় একই অভিযোগ। বাদ যাননি অন্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপকও।’
ক্যাপশনটা দেখেই আপাদমস্তক শিরশিরিয়ে ওঠে তাথৈয়ের। ফোন ছেড়ে, বিছানা থেকে সোজা বারান্দায় চলে আসে ও। ব্যালকনির ডানদিকের পার্শ্বদেয়ালে একটা গোলাকার কাচের শো পিস। নিচে বড়বড় তিনটে পালক ঝুলানো। তাথৈ বাহাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে নিচদিক তাকালো। তারপর ডানহাতে আঘাত করলো শো পিসটায়। আওয়াজ শুনে বুজো ছুটে আসে বারান্দায়। এসে দেখে তাথৈ কাদছে আর অনবরত শো পিসটায় হাত ছুড়ছে। কাচের হওয়ায় সেটি আওয়াজ করে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে লাগলো। জিনিসটার সাদা ফ্রেমে রক্তের ছোপ বসে যাচ্ছে। ভাঙা কাচ তাথৈয়ের হাতে ফুটছে, হাত রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে হুঁশ নেই ওর। বুজো কয়েকবার জোরেজোরে আওয়াজ করলো। তাথৈয়ের আশপাশে ছোটাছুটি করে নিজের অস্থিরতা বুঝালো। কিন্তু তাথৈ বুঝলো না। ও সেভাবেই দাড়ানো। ওর মস্তিষ্কে কেবল এটুকোই, এই পোস্ট দেখার পর তাশদীদ ভালো নেই। আর কোনো না কোনোভাবে এই পোস্ট হওয়ার জন্য দায়ী ও!
তাথৈয়ের চোখ জ্বলছে। ওর জলভরা চোখের সামনে অস্পষ্টভাবে ভাসছে দুদিন আগের তাশদীদের আগ্রহভরা চোখ, কানে বাজছে ওর আগ্রহভরা প্রশ্ন। ‘ডু ইউ লাভ মি তাথৈ?’
তাথৈ দাঁতে দাঁত চেপে পুনরায় দেয়ালে ঘুষি ছোড়ে। হাতে লেগে থাকা কাচের টুকরো বসে যায় গভীরে। তীব্র যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে নিতেই ওর মনে পরে নিজের জবাব, ‘না।’ আর কানে আসে,

– অন্তু তো তোকে ঠকিয়েছিলো। এ তো অন্তুর চেয়েও এক লেভেল ওপরে দেখছি। প্রজেক্ট ইনচার্জ সেজে আমাদের গোটা ব্যাচকে…

তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে পেছন ফেরে তাথৈ। ওর রক্তজমা চোখ, বিধ্বস্ত চেহারা আর ক্ষিপ্ত দৃষ্টি দেখে দমে যায় তুল্য। কথা শেষ করতে পারে না। বোনের রাগ ওর কাছে নতুন না। কিন্তু তাথৈয়ের এমন ভয়াল রুপ বোধহয় ওরকাছে নতুন ছিলো। বুজো তুল্যর পায়ের নিজে ঘুরছে আর কুইকুই আওয়াজ করছে। তুল্য একটা ঢোক গিলে বোনের দিকে এগোলো। ওর রক্তাক্ত হাত দেখে নিয়ে, তাতে ব্যান্ডেজ জড়াতে জড়াতে বললো,

– লোকটাকে ভালো মনে হয়েছিলো বলে তোকে এতোদিন কিছু বলিনি। কিন্তু আজ বলছি। এবারো ভুল মানুষের প্রেমে পরেছিস তুই তাথৈ। অন্তুর মতো ওই লোকটাও তোর যোগ্য না। তাশদীদ ওয়াসীর একটা ঠ্…

শেষ করার আগেই তুল্যর কলার চেপে ধরে তাথৈ। বিমুঢ় হয়ে কলার ধরে থাকা রক্তাক্ত হাত দেখে তুল্য। ও মানতে চায় না, ওরই ছোট বোন তাথৈ ওর কলার ধরেছে। তাথৈয়ের হাতের রক্ত তুল্যর শার্টে লেগে যায়। পাহাড়সম অবিশ্বাস নিয়ে তুল্য আবারো বোনের দিকে তাকায়। তাথৈয়ের লাল হয়ে থাকা চোখজোড়া বেয়ে টুপটাপ জল গরাচ্ছে। ভাইয়ের বিস্মিত মুখপানে চেয়ে, তাথৈ কাটকাট গলায় বললো,

– আমি জানি আমি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বোন। কিন্তু ওই নামে আর একটা নোংরা শব্দ জুড়লে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটা হয়ে যাবো তুল্য! বিশ্বাস কর!

আরো দুফোটা চোখের জল ঝরিয়ে তুল্যকে ছেড়ে দেয় তাথৈ। বিছানায় পরে থাকা ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পরে। বুজো ওর পিছু নিচ্ছিলো। শব্দ করে রুমের দরজা লাগিয়ে চলে যায় তাথৈ। রুমে আটকা পরে আওয়াজ করতে থাকে বুজো। তুল্যও পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে রয়। তাশদীদের প্রতি তাথৈয়ের ভালোবাসাকে শার্লির প্রতি নিজের অনুভূতির সাথে তুলনা করে কুল পায়না ও। যেখানে ও শান্তর নামে উঠতেবসতে শার্লিকে কথায় কাজে আঘাত করতে পিছপা হয়না, সেখানে তাশদীদের বিপরীতে এমনসব প্রমাণ দেখেও তাথৈয়ের পিছু হটার নাম নেই। উল্টো এক তাশদীদকে বিশ্বাস করে তাথৈ সেখানেই স্থির। এমনকি আপন বড় ভাইয়ের সাথেও অভূতপূর্ব এক ব্যবহার দেখিয়েছে ও। তুল্যর বুঝে আসে না, অসীম প্রেমের নামে এমন অগাধ বিশ্বাসকে ঠিক কি নাম দেওয়া যায়। অলকচুম্বী প্রেম? নাকি অন্ধবিশ্বাসের প্রেম?

টেবিলে থাকা একগাদা কাগজপত্র পড়ার পর চোখ তুলে তাকালেন ইন্সপেক্টর। তাশদীদ কেবিনের জানালার দিকে উল্টোপাশ হয়ে দাড়ানো। শান্ত সোফায় কপাল চেপে ধরে বসে আছে। টিটু বিনয়ের সাথে ইন্সপেক্টরকে বললো,

– সবই তো পড়লেন। এবার আপনিই বলুন। এদের সাথে ঠিক কি করা যায়।

তাশদীদ কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরালো। শান্ত এগিয়ে এসে নমনীয় স্বরে বললো,

– আমি চাইলেই পলিটিক্যালি বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারতাম ইন্সপেক্টর। একটা সাইনে ওই লোকের চারিত্রিক সনদের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারতাম আমি। কিন্ত তাশদীদ এমনটা চাইছে না। ও চাইছে এসবের একটা আইনি তদন্ত হোক। সবটা আইনের হাতে সমাধা হোক। এজন্যই আপনার কাছে আসা। আশা করি আপনি আমাদের নিরাশ করবেন না।

ইন্সপেক্টর উঠে দাড়ালেন। এগিয়ে এসে, তাশদীদের কাধে হাত রেখে বললেন,

– ফার্স্ট অফ অল, আ’ম সরি তাশদীদ। আমি জানি না ঠিক কতোটা হার্ড ওয়ার্কিং হলে, কতোটা সময়, কতোটা শ্রম দিলে এমন অসাধারণ পরীক্ষণে সফলতা পাওয়া সম্ভব হয়। আর ঠিক সেখানেই ভরসার মানুষগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা কতোটা যন্ত্রণার হয়।

– বাট আই প্রমিস ইউ, এই সিস্টেমের যে বা যারা যারা তোমার মেধার সাথে এই জোচ্চুরিটা করেছে, তাদের প্রত্যেককে আমি রিভিইল করবো৷ যে করেই হোক।

তাশদীদ তারদিক ফিরলো। স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– কতো সময় লাগবে আপনার?

ইন্সপেক্টর দমে যায়। তাশদীদের জন্য তার সহমর্মিতা আছে। কিন্তু সত্যি তো এটাই, ছ মাসের বেশি সময় পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার সুতো ধরতেই তার অনেক সময় লাগবে। সমাধা তো আরো দুরের বিষয়। তাশদীদ তার চেহারা দেখে অবাক হলো না। কেবল বললো,

– টেক ইওর টাইম ইন্সপেক্টর। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ভরসা উঠলেও আইনের ওপর থেকে আমি এখনো ভরসা হারাই নি। আসছি।

তিনজনে মিলে বেরিয়ে আসলো পুলিশস্টেশন থেকে। বাইরে বেরিয়েই সিগারেট ধরালো শান্ত। ধোঁয়া উড়িয়ে বললো,

– যাক। এদিকটা ক্লিয়ার। এদিক থেকে আর কোনোরকম ঝামেলা হবে না আশা করি। এবার শুধু এই মুখোশধারীগুলোকে গর্ত থেকে টেনে বের করার পালা।

তাশদীদ শার্টের হাতা ভাজ দিতে দিতে এগোচ্ছিলো। একসময় হাতের গতি কমে আসে ওর। হাতা ঠিকঠাক ভাজ দিয়ে, পকেটে একহাত গুজে বরাবর আকাশে তাকালো তাশদীদ। শান্তশিষ্ট ভঙিতে বললো,

– দেশে ফের জেইন। তোর মাতৃভুমি তোর সব চোরামোর হিসাব নেবে বলে অপেক্ষায় আছে।

রাত সাড়ে এগারোটা। বাসা থেকে বেরিয়ে, কয়েকবার গাড়ির চাবি শূণ্য ছুড়ে, তা হাতের মুঠোয় লুফে নিয়ে গাড়ির দিকে এগোলো আফিফ। চুইংগাম চিবাতে চিবাতে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। ফোন পাশের সিটে রেখে কাউকে কল লাগালো ও। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে, ফোন লাউডস্পিকারে রেখে বললো,

– আজ সারারাত পার্টি করবো। চলে আয়।

কল কেটে গাড়িতে উচ্চ আওয়াজে গান বাজাতে শুরু করে আফিফ। ড্রাইভিংয়ের সাথে রীতিমতো নাচছে ও। গানের তালেতালে তাথৈয়ের পরিস্থিতি আর নিজের পৈশাচিক আনন্দকে স্মরন করতে থাকে আফিফ। হাসতে থাকে আপনমনে। এই সুখ ওর সূদুরপ্রসারী, নিখুঁত পরিকল্পনার ফল। যেদিন থেকে আফিফ জানতে পেরেছে তাথৈ তাশদীদ ওয়াসীরকে ভালোবাসে, সেদিন থেকেই তাশদীদকে লাঞ্ছিত, অপমানিত করার উপায় খুজতে থাকে ও। ও জানতো, তাথৈ আলফেজকে হেনস্তা করতে তাশদীদই মুখ্যম মাধ্যম। এরচেয়ে ভালো উপায় আর দুটো হয়না। এজন্য অবশ্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি ওকে। আপনমনে খুশি হয়ে ড্রাইভ করছিলো আফিফ। অকস্মাৎ ডানদিকের রাস্তা থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে ওর গাড়িতে। কোনোমতে স্টেরায়িং ঘুরিয়ে বামে গাড়ি থামায় ও। ব্রেক কষায় আফিফের মাথা গিয়ে বারি খায় স্টেরারিংয়ে। ব্যথায় কপালের ডানদিক চেপে ধরে মাথা তোলে ও। জানালা দিয়ে মুখে থাকা চুইংগাম ফেলতে গিয়ে টের পায় থুতুর সাথে রক্তও বেরিয়েছে। যার মানে, দাঁতের সাথে মুখের ভেতরের দিকটা কেটে গিয়েছে ওর।

রাগের বশে মুখ ডলা মারে আফিফ। অশ্রাব্য এক ভাষায় গালি দিতে দিতে গাড়ি থেকে নামছিলো ও। কিন্তু তার আগেই ওর চোখ যায় গাড়ির লুকিং মিররে। সেখানে দৃশ্যমান অবয়ব দেখে পুরো প্রতিক্রিয়াই উল্টে যায় ওর। ওর গাড়িকে ধাক্কা দেওয়া গাঢ় খয়েরী রঙের গাড়িটার সামনের হেডলাইট জ্বলছে, নিভছে। ভেতরের মৃদ্যু আলোতে স্পষ্ট দৃশ্যমান হয় ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানবীর চেহারা। মেরুন রঙের কামিজ পরনে, খোলা চুলগুলোর কিছু গলার আগেপরে, ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী লিপস্টিক, আর ফর্সা গলায় জ্বলজ্বল করতে থাকা সেই উজ্জ্বল লকেট, তাথৈ!
তাথৈ শক্তহাতে স্টেয়ারিং ধরে নিজেকে সংবরনের চেষ্টা করলো। ওর চোখ ভরে উঠেছে। তীব্র রাগ, আক্রোশে ওর ইচ্ছে করছে সামনের গাড়িটাকে পিষে ফেলার। অতিকষ্টে স্থির রইলো ও। মোবাইলে নম্বর ডায়াল করে, কানে গোজা হেডফোনে বললো,

– কাগজগুলো তোকে কে দিয়েছে আফিফ?

আফিফের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। জানালার কাচ তুলে দিয়ে দ্রুততার সাথে গাড়ি স্টার্ট দেয় ও। তাথৈয়ের কল কাটতে যাবে, ওপাশ থেকে তাথৈ বললো,

– আমারটা প্রিমিও জি। স্পিডটা তোর ভেহেকের চেয়ে কয়েকগুন বেশি। রেস করবি?

আফিফ কল কেটে দেয়। গাড়ি চালাতে চালাতে লক্ষ্য করলো পেছনে তাথৈয়ের গাড়িটাও আছে। ড্রাইভিং সিটে তাথৈ আলফেজের শক্ত চোখমুখ স্পষ্ট দেখা যায়। আবারো ফোন বাজে আফিফের। কল কেটে দেয় আফিফ। এবারে ভয়েজ টেক্সট আসে ওর নম্বরে। শুকনো ঢোক গিলে ভয়েজ ওপেন করে আফিফ। সেখানে তাথৈ আলফেজের দীপ্ত স্বর,
‘আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুই পরপারেও যেতে পারবি না আফিফ। সো কাম টু দ্য কল।’
আবারো ফোন বাজে আফিফের। এবার আর কল কাটলো না আফিফ। কল রিসিভ করে বললো,

– আ্ আমার পেছনে কেনো পরেছিস তুই?

– ভার্সিটির পেইজ মডারেশনে থাকা সাতজনের একজন তাথৈ আলফেজের নামে একঢোক পানি বেশি খায়। তোর কি মনে হয়, সেই পেইজের ইনবক্সে তাশদীদ ওয়াসীরের এগেইনিস্টে পোস্ট, ডকুমেন্টস কে পাঠিয়েছে, সেটা জানা আমার জন্য কঠিন হবে?

তাথৈয়ের কথা শুনে আফিফ যেনো শূণ্যে ভেসে থাকা অবস্থাতে আছাড় খায়। ওর ধ্যানজ্ঞান লোপ পেতে থাকে। সামনে থেকে একটা চলন্ত গাড়ি কোনোমতে ওকে পাশ কাটিয়ে যায়। দুর্ঘটনা ঘটতে ঘটতেও কোনোরকমে বেচে যায় আফিফ। তাথৈয়ের গাড়িটা পেছন থেকে ওর গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে বলেই দূর্ঘটনা এড়িয়েছে। তাথৈ ফোনে বললো,

– বললাম তো। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুই পরপারেও যেতে পারবি না। তোর ফেইক একাউন্ট ধরতে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা আর পনেরো মিনিট সময় খরচ হয়েছে। টাকাটা বিষয় না। কিন্তু আমি তোর পেছনে আর সময় নষ্ট করতে চাইছি না। সো আন্সার মি। ডকুমেন্টগুলো কে দিয়েছে তোকে?

– ত্ তুই ক্ কিসের কথা বলছিস তাথৈ? আমি কিছুই করিনি।

– আমার ধৈর্যের সীমা পরখ করতে যাস না আফিফ।

– দ্ দেখ তাথৈ! আমি এসবের কিছু জানিনা। তুই কিন্তু অহেতুক আমার সাথে ঝামেলা করছিস।

– অহেতুক? কেউ আমার পেছনে পরলে আমি তা হ্যান্ডেল করতে পারি। কিন্তু কেউ তাশদীদের পেছনে পরলে, আই কান্ট টলারেট। এন্ড ইউ’ভ ডান দ্য সেকেন্ড।

তাথৈ আফিফের গাড়িতে ধাক্কা লাগালো। আফিফ পেছনে তাকিয়ে চেচিয়ে বললো,

– কি করছিস টা কি তুই? পাগল হয়ে গেছিস?

– পাগল হয়েছি কিনা জানিনা। কিন্তু তুই আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে আমি নির্ঘাত খু’নী হয়ে যাবো।

– এই ‘খুনী’ বিশেষণ আমার চাই না আফিফ। আমাকে বাচা প্লিজ! আমার প্রশ্নের উত্তর দে। শেষবারের মতো অনুরোধ করছি তোকে!

আফিফের নিজের কাছে নিজেকেই এবার পাগলপাগল লাগছে। এই মেয়ে ওকে মেরে ফেলার ধমকি দিয়ে ওকেই বলছে, আমাকে বাচা! আবার বলে অনুরোধ করছে! প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেয়ে এ মুহুর্তে তাথৈয়ের সীমার বাইরে যাওয়াটাই আফিফের উত্তম বলে মনে হলো। গাড়ির গতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়িয়ে দিলো ও। কিন্তু একসময় আকস্মিক ব্রেক কষতে বাধ্য হয় আফিফ। কিছুটা পেছনে তাথৈয়ের গাড়িও থেমেছে। আফিফের গাড়ির সামনে চলন্ত ট্রেন। আর রাস্তাটার একমাত্র গতিপথ এই রেল ক্রসিং পাড় করা। ক্রসিংয়ে কোনোরকম গতিরোধক নেই। পাশে একটা সাদা সাইনবোর্ডে লালরঙে লেখা, ‘এই রেল ক্রসিংয়ে নির্দিষ্ট গেইটম্যান নেই। নিজ দায়িত্বে ক্রসিং পার হবেন।’
আফিফ একদন্ড সময় নেয়। ভেবে নেয়, পেছনে তাথৈও স্থির হয়েছে। কিন্তু ঠিক তার পরমুহুর্তেই ভুল ভাঙে ওর। পেছন থেকে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ কানে এসেছে। আফিফ বিস্ফোরিত চোখে গাড়ির আয়নায় তাকায়। পেছনের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা তাথৈ চোখে সানগ্লাস পরতে পরতে বললো,

– ওকে আ’ম ডান। গেট রেডি আফিফ। ইটস শো-টাইম নাও।

#চলবে…