কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
283

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪৩.

– স্টপ দ্যা কার তাথৈ! থাম! প্লিজ থাম!

আফিফের গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে তাথৈ। থেমে থাকা গাড়িটার সামনের দিক গিয়ে লেগেছে চলন্ত ট্রেনে। আফিফ উচ্চস্বরে চেচাতে থাকে। বারবার তাথৈকে থামার জন্য বলতে থাকে। ওর গাড়ির সামনের অংশটুকো দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ এভাবে রাখা হলে নিসন্দেহে ইন্জিনে আগুন লেগে যাবে, আর তখন পুরো গাড়িটা ব্লাস্ট হবে। একবুক আতঙ্ক নিয়ে নিজের গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পেছনে নেবার চেষ্টা করে ও৷ কিন্তু পারে না। মৃত্যুভয়ে আফিফ আরো জোরে আওয়াজ তোলে,

– তাথৈ গাড়ি থামা! থামা! গাড়ি ব্লাস্ট হলে আমরা দুজনেই মরবো। ইটস্ ক্র্যাশিং ড্যাম!

– ইট শুড।

নির্বিকারচিত্তে জবাব দিয়ে তাথৈ আরেকদফা গতি বাড়ায়। আফিফের গাড়ি আর ট্রেনের ঘর্ষনে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ ওর সানগ্লাসে প্রতিফলিত হচ্ছে। শব্দের তীব্রতায় চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়েছে আফিফ। চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে। ওর চিৎকার যেনো স্বস্তি দেয় তাথৈকে। সেখানে যে ওর নিজেরও মৃত্যুভয় আছে তা ভুলে যায় তাথৈ। কয়েকমাস আগে ভার্সিটির পেইজটা থেকে ‘রক্ত চাই’ শিরোনামে পোস্ট চোখে পরেছিলো ওর। তৎক্ষণাৎ সেখানে যোগাযোগ করে এক বড়ভাইয়ের স্ত্রীকে রক্তদান করেছিলো তাথৈ। আবেগী হয়ে সে লোক আচমকা বলে ফেলে, ‘পেইজ মডারেশনে থাকাটা প্রথমবারের জন্য ব্যক্তিগত জীবনে কাজে দিয়েছে।’
তার সাথে পরিচয় হওয়াটা কাজে দিয়েছে তাথৈয়েরও। তাশদীদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়া পোস্ট পেইজে কে দিয়েছে, তা জানতে সময় লাগেনি ওর। আর সে ফেইক আইডির ইউআরএল থেকে তার আসল মালিককে বের করাটা কেবল ছিলো টেকনোলজি ব্রাঞ্চে টাকার খেলা।

তাথৈ জানতো, তাশদীদের জীবনের ছমাসেরও বেশি সময় আগের ঘটনার প্রেক্ষাপট লিখে, ডকুমেন্ট জোগার করে পেইজে দেওয়াটা আফিফের একার কাজ হতে পারে না। তাই শুরুতে সমস্ত রাগটা আফিফের ওপর ঝারতে চাইলেও পরে ওর মুখ থেকে কথা বের করানোর সিদ্ধান্ত নেয় তাথৈ। খানিকটা সময় এমন মারাত্মক মুহুর্তের সাক্ষী থেকে একচুল পিছিয়ে আসলো ও। আফিফ সুযোগ পেতেই পিছিয়ে আসে। জবাব না দিয়ে নিজেকে বাচাতে গাড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করে ও। ওর এই চেষ্টাটুকো তাথৈয়ের সহ্য হয় না যেনো। আবারো গতি বাড়িয়ে গাড়ি সামনে এগিয়ে দেয় ও। ট্রেন আর গাড়িতে পুনরায় সংঘর্ষ শুরু হয়। আফিফ আবারো চিৎকার শুরু করে দেয়। তাথৈ বললো,

– জাহান্নামকে বলিস, তাশদীদকে ব্যাকস্টেপ করা তোর সঙ্গী-সাথিও সেখানে দ্রুতই আসছে।

প্রচন্ড শব্দ করে আফিফের গাড়ির সামনের একাংশ খুলে পরে। উন্মুক্ত হয়ে পরে ইন্জিন। তাথৈ আরো গতি বাড়াতে উদ্যত হচ্ছিলো। লোকে বলে মৃত্যুপূর্বে মানুষের অনুধাবন তীব্রতর হয়। আফিফও হয়তো কোনোভাবে বুঝতে পারে, আলফেজ কন্যা নিজের মাঝে নেই। ওর সাথে আগামী কয়েকমুহুর্তে যা খুশি করতে পারে সে। দুহাতে কান ঢেকে চোখ বন্ধ করে নেয় আফিফ। চিৎকার করে বলে ওঠে,

– ওগুলো সব প্রফেসর সুবোধের দেওয়া! উনি তাশদীদের আগের ভার্সিটির প্রফেসর। জেইনের বাবা!

জবাব দেওয়ার কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িতে প্রচন্ডরকমের একটা ধাক্কা অনুভব করলো আফিফ। ধাক্কাটা এতোটাই বেশি ছিলো যে, আবারো স্টেয়ারিংয়ে মাথা লেগেছে ওর। দুদন্ড পর আস্তেধীরে মাথা তুললো ও। আধখোলা চোখে আশপাশ চেয়ে যা বুঝলো, ওর গাড়ি রাস্তার পাশের সীমানা ভেঙে গাছের সাথে গিয়ে ঠেকেছে। কপাল কেটে রক্ত বেরোচ্ছে আফিফের। চোখ, শরীর টলছে। কোনোমতে ঘাড় ঘুরিয়ে, আধখোলা চোখে পেছনের গাড়িতে তাকালো ও। সে গাড়ির ভেতরের হলুদাভ আলোয় দেখা যায়, তাথৈয়ের চোখ টলমল করছে। সানগ্লাস খুলেছে ও। রাগ, জেদে চোখ ভরে উঠেছে ওর। আফিফকে পেছন ফিরতে দেখে তাথৈ বললো,

– ওপরওয়ালা লাইফলাইন দিয়েছে একটা। আমিও ভুল শোধরানোর ওই একটাই সুযোগ দেই আফিফ। কথাটা মাথায় রাখিস।

আফিফের কপাল বেয়ে রক্ত গরায়। একহাতে কপাল চেপে ধরে, আরেকহাতে গাড়িতে চাবি ঘোরালো ও। কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিলো না। আফিফ আবারো চেষ্টা করতে যাচ্ছিলো। তাথৈ বললো,

– তোর গাড়ি স্টার্ট নেবেনা। একটু ওয়েট কর, এ্যাম্বুলেন্স আসছে। নিয়ে যাবে তোকে।
আর হ্যাঁ, হসপিটালে বসেবসে তোর ফেইক আইডিটার যত্ন নিস। তাশদীদ ওয়াসীরের এগেইনিস্টে পোস্টটা যখন তুই করেছিস, কাউন্টার পোস্টটাও তোরই করা লাগবে।

চোখে সানগ্লাস তুলে দিয়ে, গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো তাথৈ। শুনশান প্রান্তরে, ধ্বংসপ্রায় গাড়িতে, একাকী, আহত অবস্থায় পরে থাকা আফিফের চোখ ফেটে জল গরায় এবারে। একটা মেয়ে ওকে এমন বাজেভাবে নাজেহাল করে গেলো ভাবলেই নিজের ওপর রাগ হচ্ছে ওর। কিন্তু সে রাগের কোনো প্রতিকার নেই। আফিফ নিরুপায়। তাথৈ আলফেজের দেওয়া বিপদসংকেতের কাছে ও সত্যিই নিরুপায়।

প্রীতিকার্নিশের টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা ছন্দ তুলেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে বিকেল থেকে। মাঝেমাঝে ঘরের ওপরের গাছটার ডাল টিনে আওয়াজ করছে। মিসেস ওয়াসীর তাশদীদের বিছানায় বসে গুনগুনিয়ে কোরআন পড়ছেন। আর তার কোলে মাথা গুজে, চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে তাশদীদ। বৃষ্টির জন্য আসরের নামাজটা বাসায়ই সেরেছে এ বাড়ির ছেলেরা। তামজীদ ভাইয়ের ঘরেই পড়ার টেবিলে বসেবসে পড়ছে। মিসেস ওয়াসীর কোরআন পড়া শেষ করে বইটায় চুমু খেলেন। সেটা পাশে সরিয়ে রেখে তাশদীদের চুলে আঙুল চালিয়ে বললেন,

– ইন্সপেক্টর কি বলেছে তাশদীদ?

তাশদীদ চোখ মেললো। মায়ের কোলে আরো বেশি করে লেপ্টে গিয়ে জবাব দিলো,

– ইন্সপেক্টর বলেছে তাশদীদ ওয়াসীরের মা কে চিন্তা করাটা মানায় না৷ সে কি জানে না তার ছেলে সব সামলে নেবে?

মিসেস ওয়াসীরের বুক হাহাকার করে ওঠে। মাত্র দুইদিনের জন্য প্রীতিকার্নিশ ছিলেন না তিনি। এরমাঝে এতোকিছু হয়ে যাবে কল্পনাতেও ছিলো না তার৷ যে ছেলে বেয়াদবী হবে ভেবে কখনো কারো ছায়াটাও মাড়ায় না, তার সেই ছেলের বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতোবড় কুৎসা কে বা কারা রটালো, বুঝে আসে না মিসেস ওয়াসীরের। তামজীদ এ অবদি চুপ ছিলো। ওর স্কুল-কোচিংয়ে যে তাশদীদকে নিয়ে কানাঘুষা হচ্ছে, তা বুঝতে ওকে বেগ পেতে হয়নি। হয়তো ভয়ে কেউ ওকে সামনা-সামনি কিছু বলেনি, কিন্তু বলাবলি ঠিকই করেছে। মাকে করুনচোখে তাশদীদের চুলে হাত বুলাতে দেখে মুখ খুললো তামজীদ। বললো,

– আচ্ছা ভাইয়া, তুই বলছিস কাগজগুলো ভুয়া না। তাহলে ছমাস আগে যে তোর সাথে এসব ঘটেছে, সেগুলো তুই আমাদের জানাসনি কেনো?

মিসেস ওয়াসীর ছোটছেলেকে চোখের ইশারায় শাসালেন। বেয়াদবী বুঝে তামজীদ চোখ নামিয়ে নিলো তৎক্ষণাৎ। তাশদীদ চোখ মেলে অতি নরম আওয়াজে বললো,

– বাবা এসব জানলে কখনোই চুপ থাকতো না। তখন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের হওয়া টাইপ ঘটনা ঘটতো। আমি চাই নি আমার একার পরিস্থিতির জন্য পুরো একটা ভার্সিটির নাম খারাপ হোক। তাই চুপচাপ অন্য জায়গায় এডমিশন নিয়েছিলাম। বুঝলামনা এরা ব্যাপারটাকে আবারো কেনো ঘাটাচ্ছে।

তামজীদ হাতের কলম ছেড়ে কপাল চেপে ধরে। প্রশ্নটা করাই ওর ভুল হয়েছে। ওর জানা উচিত ছিলো, তাশদীদ কখনো ঝামেলার ঝ তেও থাকে না। মাঝেমাঝে তামজীদের সন্দেহ হয়, ও আদৌও এই তাশদীদের আপন ভাই কি না৷ এরমাঝে ওয়াসীর সাহেব দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকলেন। তাশদীদ মায়ের কোল ছেড়ে উঠে বাবু হয়ে বসলো। ওয়াসীর সাহেব একটা টুল নিয়ে বসে, চিন্তিত স্বরে বললেন,

– এ কদিন তুমি ভার্সিটি গেলে না। পুলিশের কাজে কোনোরকম গতি নেই বললেই চলে। সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে না তো তাশদীদ?

বহুদিন পর বাবার চোখমুখে চিন্তার রেশ দেখে তাশদীদের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে। তবুও ও নিজেকে স্থির রাখে। এগিয়ে এসে বাবার হাত মুঠো করে, আস্বস্তের হেসে বললো,

– আমি একটা সুষ্ঠু নিষ্পত্তি চাইছি বাবা। এজন্যই সময় লাগছে। তবে তুমি চিন্তা করো না। আসল সত্যিটা দ্রুতই সবার সামনে আসবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

তামজীদের জেদ হলো ভাইয়ের কথা শুনে। এইভাবে হেনস্তা হবার পরও ওর ভাই কিকরে এমন স্থির থাকতে পারে? ওয়াসীর সাহেব মাথা নেড়ে ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললেন। কল আসায় ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেলো তাশদীদ। বারান্দায় দাড়িয়ে ওপাশের বৃষ্টির আওয়াজ মিশেল কথাগুলো শুনলো। মৃদ্যু হেসে জবাব দিলো,

– ভাগ্যের টুকো কেউ নিতে পারে না। তবে আমার মতে, এসব মিটমাটের আগে জেইন দেশে ফিরলে ভালো হতো। টরেন্টোর জেলে নানারকমের শাস্তিভোগের চেয়ে, দেশের জেলে ঘানি টানাটা বোধহয় ওর জন্য সহজ হতো।

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে আরতি থামালেন প্রফেসর সুবোধ। রাতের এগারোটা বাজছে। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। সেইসাথে বজ্রপাতও আছে। এমন অসময়ে কারো তার বাসায় আসার কথা না। ধুপকাঠি যথাস্থানে গুজে রেখে, ধর্মীয় সরু চাদরখানা গলার দুপাশে ঠিকঠাক করে দিয়ে দরজার দিকে এগোলেন তিনি। দরজার ছিদ্রে চোখ রাখলে মেয়েলী অবয়ব চোখে পরলো তার। বাইরের রমনী কে হতে পারে, প্রফেসর বুঝে উঠলেন না। গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– কে?

– জেইনের গার্লফ্রেন্ড।

দরজা তৎক্ষনাৎ খুলে যায়। যার মানে, প্রফেসর এমন জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। দরজা খুলতেই তার চোখে পরে তার সামনে কালো জিন্স, জ্যাকেট, সাদা টিশার্ট পরিহিত এক মেয়ে। মাথায় ক্যাপ, মুখে মাস্ক, একহাতে বড় কালো ছাতা, আরেকহাতে বুট। সাদা গেন্জি আর লুঙ্গি পরিহিত প্রফেসরকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মাস্কের আড়ালে মেয়েটা হয়তো হাসলো। অস্ফুটস্বরে বললো,

– ধর্মপ্রাণ চোর!

শব্দদুটো হয়তো প্রফেসর ধরতে পারলো না। উঁকি দিয়ে পাশের ইউনিটের বন্ধ দরজা দেখে নিলো সে। বললো,

– কে তুমি?

– উত্তর যদি ভেতরে বসে বলি, তাহলে শুধু আপনাকে বলবো। আর যদি এখানে দাড়িয়ে বলি, পাশের ইউনিটের লোকজনকেও জানাবো। আপনি কোনটা প্রেফার করেন?

প্রফেসর সরে দাড়িয়ে মেয়েটাকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলেন। সে কাদামাখা বুট বাইরে রেখে বাসার ভেতরে ঢুকলো। চারদিক চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,

– নিজের মান সম্মানের প্রচুর ভয়। অথচ অন্যকে মিথ্যা বদনাম করতে আপনার কলিজা কাপে না।

– শাট আপ! অনেকক্ষণ হলো তোমার যা তা কথা শুনছি। জেইন চারবছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে। তুমি ওর পরিচিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কে তুমি? কি চাইছো? এখানে কেনো এসেছো?

বাজ পরার আওয়াজ আসলো বাইরে থেকে। এতোগুলো উচু আওয়াজের কথা শুনে তাথৈ ঘাড় বাকিয়ে তাকালো লোকটার দিকে। এমন উচুস্বরে তৈয়ব আলফেজও ওর সাথে কথা বললে ও ছাড় দিতো না। মুচকি হেসে সোফায় গিয়ে বসলো তাথৈ। আসার আগে এ বাসার কলকাঠি নেড়েই এসেছে ও। প্রফেসর আপাতত একা মানুষ। তার স্ত্রী গেছেন মেয়ের শশুড়বাড়ি। ছেলে জেইনকে পড়াশোনার জন্য টরেন্টোতে পাঠিয়েছে সে। ওকে নির্দ্বিধায় সোফায় বসতে দেখে প্রফেসরের রাগ তরতরিয়ে বাড়লো। দ্রুতপদে এগিয়ে আসলো সে। তাথৈ তার প্রতিক্রিয়া পরখ করে তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,

– উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আসুন শান্তিতে বসে কথা বলি। আমার পরিচয়টা এখানে কোনো ফ্যাক্ট না। তবে হ্যাঁ! আমি আপনার ছেলেকে চিনি না, এটা সত্য।

তাথৈ একটু থামলো। পরপরই উচ্ছ্বাসে বললো,

– কিন্তু আমি আফিফকে চিনি স্যার! আপনিও চেনেন আফিফকে। রাইট?

প্রফেসর পুরোপুরিভাবে দমে যায় এবারে। আফিফকে গতরাত থেকে কলে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়টা তার জন্য চিন্তার ছিলো। ফলে অজ্ঞাত মেয়েটার মুখে আফিফের নাম শুনে যতোটা উত্তেজিত হয়ে সে এগোচ্ছিলো, ততোটাই নমনীয় হয়ে যায় তার অঙ্গভঙ্গি। তাথৈ ইশারায় তাকে সামনের সোফায় বসতে বললো।হাটুতে দু হাতের কনুই ঠেকিয়ে কিছুটা ঝুকে বসে বললো,

– রাইট! সো উই হ্যাভ মিউচুয়াল পিপল। আই গেইস এখন আমাদের কনভারসেশন হতে আর কোনো বাধা নেই।

– কি চাও?

– সু-বোধ! বোধশক্তি সুন্দর না হলেও, আপনার ধূর্তামি, ভন্ডামি এসব বোধ যে অনেক বেশি, সেটা আমি জানি। সো আমার এখানে আসার ফ্যাক্ট যে তাশদীদ ওয়াসীর, আর সেটা আপনি ধারনা করতে পারছেন না, এখন আবার এটা বলবেন না প্লিজ! তাহলে আমার চোখে আপনার ধূর্ততার লেভেলটা নেমে যাবে।

প্রফেসরের চেহারা শক্তপোক্ত হতে থাকে। হাত মুঠো করে নেয় সে। তাথৈ একপলক দেখলো তার মুঠো করা হাত। তারপর শান্তশিষ্ট ভঙিতে বললো,

– তাশদীদ ওয়াসীর ইস্যুতে আমি আপনার নামটা জেনে গেছি সেটা আফিফ কেনো আপনাকে কিছু জানায় নি, এ নিয়ে ওকে দোষারোপ করে লাভ নেই স্যার। কয়েকমিনিটের মধ্যে আপনি যতোটা নিরুপায় হয়ে পরতে চলেছেন, আফিফ ঠিক ততোটাই নিরুপায়।

– হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি কি বাড়ি বয়ে আমাকে ধমকি দিতো এসেছো?

– জ্বি। সে প্রসঙ্গেই আসছি। আচ্ছা প্রফেসর? ছ মাস আগে তাশদীদ ওয়াসীর কি ইনভেন্ট করেছিলো, সেগুলো নিয়ে আপনি কি কি কাহিনী রটিয়েছেন, কিভাবে তাশদীদের ইনভেনশন নিয়ে আপনার ছেলে পৃথিবীখ্যাত হয়ে গেলো, এসব আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই?

প্রফেসর বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তাথৈয়ের দিকে। তাথৈ উঠে দাড়ালো। ছাতাটা হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিকওদিক হাটতে হাটতে বললো,

– অবশ্য মনে না থাকলেও সমস্যা নেই। আপনাকে সেগুলো মনে করাতেই আমার এখানে আসা। আজ রাতভর আপনি সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ মনে করবেন, দেন কাল সকাল এগারোটায় প্রেস কনফারেন্স করে তাশদীদের ইনভেনশন আর নিজের চোরামোর সব সত্যিটা বলবেন। সহজ স্বীকারোক্তি যাকে বলে আরকি।

তাথৈয়ের এমন মিষ্টিভাষা শুনে প্রফেসর খুশি হলেন না। তবে এটুকো বুঝলেন, পেইজে পোস্টদাতার ফেইক আইডি থেকে আফিফকে খুজে বের করা, ওর মুখ থেকে তার নাম উগড়ে নেওয়া, এরপর তারই বাসায় এসে তাকেই মিষ্টিভাষায় ধমকি দেওয়া মেয়েটা সাধারণের দলে না। তাশদীদের আগেপরে ওর মা ব্যতিত কোনো মেয়ে আছে বলে প্রফেসরের মনে পরলো না৷ তবুও সেদিকে ভাবতে গিয়ে সময় নিলেন না তিনি। গলা থেকে চাদরখানা নামিয়ে তিনি উঠে দাড়ালেন। গম্ভীরস্বরে বললেন,

– আর যদি তা না করি?

– দেন আ’ম গো’না শ্যুট ইউ…

অত্যন্ত সুমিষ্ট স্বরে জবাব দিয়ে, হাতের লম্বা ছাতাটার ডগা প্রফেসরের বুকের ডান পাশে ঠেকালো তাথৈ। ওর কর্মকান্ড দেখে লোক হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো একদন্ড। পরপরই তাথৈয়ের বোকামোর কথা ভেবে তাচ্ছিল্যে হাসলো। এই মেয়ে ছাতা তাক করে তাকে শ্যুট করার ভয় দেখাচ্ছে। প্রফেসরের তাচ্ছিল্যের হাসি দেখে তাথৈও আরেকদফা মুচকি হাসলো। ছাতাটা তেমনি ধরে রেখে বললো,

– ওভাবে হাসবেন না প্লিজ! আমি মজা করি না। তাছাড়া আপনার আমার মজা করার সম্পর্কও না। ছাতাটা স্পেশালি আপনার জন্যই অর্ডার দিয়ে বানানো। মেকানিক একটা ছাতা বানাতে আটহাজার টাকা নিয়েছে। আমার কথা না শুনলে, আমি সত্যিই আপনাকে শ্যুট করে দেবো। রাম নাম নেবারও সুযোগ পাবেন না।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪৪.

‘ তাশদীদ ওয়াসীর কোনোরকম প্রতারণা করেনি। স্নাতকের ছাত্র থাকাকালীন তার পরীক্ষণ জালিয়াতির যে প্রমাণ মিলেছিলো, তা সমস্তই আমার তৈরী। জেইনের মডিফিকেশনকে সে নিজের পরীক্ষণ বলে চালিয়ে দেয়নি। বরং সে বিক্রিয়াগুলো তারই আবিষ্কার। জেইন এসব পোর্টালে জমা দেওয়ার আগেই সেটাকে ডিপার্টমেন্টের কাছে হস্তান্তর করেছিলো তাশদীদ। জেইনের পেপার, তাশদীদের পেপার, ওর পেপার ব্যান হওয়া, ক্ষমা চেয়ে আবেদন, বিভাগীয় চেয়ারম্যানের নোটিশ নিয়ে যে ডক ফাইলগুলো ভাইরাল হয়েছিলো, সেগুলো পুরোটাই আমার পরিকল্পনার অংশ। নিজের ছেলের নামডাকের জন্য ছেলের সমতুল্য শিক্ষার্থীর এতেগুলো দিনের পরিশ্রম, মেধাকে আমিই চুরি করেছিলাম। এসবের জন্য আমিই দায়ী।’

বলা শেষ করার সাথেসাথে একটা জুতা উড়ে এসে কপালে লাগে প্রফেসর সুবোধের। আক্রোশে ফেটে পরেছে সামনে দাড়ানো শিক্ষার্থীরা৷ গণমাধ্যম কর্মীরা কোনোমতে নিজেদের মাইক-ক্যামেরাসমেত গা বাচানোর চেষ্টা করছে। ভার্সিটির বিভাগীয় ভবনের সামনে প্রফেসর প্রেস কনফারেন্স করছেন জেনে পুলিশও এসেছে। তারাও চেষ্টা করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থামানোর। ফাটা কপাল চেপে ধরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালেন প্রফেসর। চেচাতে থাকা শিক্ষার্থীদের দেখে তার আগেররাতের কথা মনে পরে যায়। মনে পরে যায় এতোবছরের জীবনে প্রথমবার কারো হুমকিতে দূর্বল হয়ে পরার বিভীষিকার কথা।

আগেররাতে তাথৈয়ের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে ফোন হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রফেসর সুবোধ। তাথৈ সময় নেয়নি। ঘাড় বরাবর ধরে, ছাতার হাতলের কোনো বোতাম টিপে দিলো ও। লোক মৃদ্যু আর্তনাৎ করে, আরেকহাতে ঘাড় চেপে ধরলেন। লক্ষ্য করলেন, তার আঙুলের ডগায় লালচে তরল। অর্থাৎ ছাতার ডগা থেকে সূচালো কিছু বেরিয়ে তার ঘাড়ের চামড়া ভেদ করেছে। কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে তার সারা শরীরেও কম্পন ধরতে শুরু করে। ফোন কানে ধরে রাখা হাত নেমে আসলো কাপতে কাপতে। তাথৈ ছাতা সরিয়ে নিলো। ছাতার ডগায় বেরিয়ে থাকা সূচের রক্ত আঙুলে মুছতে মুছতে একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

– ওয়ার্নড্ ইউ।

লোক বোধহয় রাগ নিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন। তবে মুখ খোলার চেষ্টা করেও সেটা পারলেন না তিনি। টের পেলেন স্বরযন্ত্রও নিস্ক্রিয় হয়ে পরেছে। টালমাটাল হয়ে ধপ করে গিয়ে সোফায় বসে পরলেন তিনি। তাথৈ ছাতা মেঝেতে ঠেকিয়ে একপা ভাজ দিয়ে দাড়ালো। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললো,

– রিল্যাক্স স্যার! এই ধড়ফড়ানি সাময়িক। একটুপরেই ঠিক হয়ে যাবে। যাইহোক! এবার বলুন। আপনি প্রেস কনফারেন্স করছেন? কি না?

লোক বিচিত্র মুখভঙ্গি দেখালো। প্যারালাইজড রোগীর মতো কোনোমতে ঘাড় দুলিয়ে না বুঝালো। তাথৈ ঘাড় চুলকালো। জ্যাকেটের চেইন খুলে কোমড়ের পেছনদিক থেকে একটা ফাইল বের করে টি টেবিলে রাখলো ও। কলমের হেড খুলতে খুলতে বললো,

– আপনার এই না খুব বেশিক্ষণ না থাকবে না স্যার।

প্রফেসর তাথৈয়ের দিকে অবুঝের মতো করে চায়। মাস্কের আড়ালে তাথৈ মুচকি হাসলো। ফাইল খুলে তিনটে কাগজ বের করলো ও। একটা একটা দেখিয়ে বললো,

– পেপেরোমিয়ায় বায়োলুমিনিসেন্স তৈরীর সব রিয়্যাকশন, মোডিফিকেশন আপনার ছেলে পোর্টালে জমা দেওয়ার আগে তাশদীদ ডিপার্টমেন্টে, আপনার কাছে জমা দিয়েছিলো। আর আপনি ওর দেওয়া ডিটেইলস চুরি করে নিজের ছেলে জেইনকে পাচার করেছেন। এটা তার স্বীকারোক্তি।
তাশদীদের এগেইনিস্টে আপনি বিভাগে চুরির অভিযোগ করেছিলেন, এটা তার প্রত্যাহারপত্র।
আর এটা আপনার তরফ থেকে চেয়ারম্যান স্যারের কাছে আবেদনপত্র। চেয়ারম্যান তাশদীদকে রাস্টিকেট করার যে ওয়ার্নিং পেপার পাঠিয়েছিলো, সেটা প্রত্যাহার আর তাশদীদকে ওর আবিষ্কারের জন্য সম্মাননা দেওয়ার বিষয়ে।

প্রফেসর বড়বড় চোখে তাকায়। অজ্ঞাত মেয়েটার এমন সূদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনা তার মাথায় ঢুকে তাকে যেনো আরো এলোমেলো করে দিলো। তাথৈ কাগজগুলো গোছাতে গোছাতে বললো,

– নাও ইউ হ্যাভ টু অপশনস স্যার। আপনি যদি প্রেস কনফারেন্সের জন্য হ্যাঁ বলে দেন, তাহলে শুধু এই তিনটে কাগজে সাইন নিয়ে আমি বিদায় নেবো। আর আপনি যদি আমার কথায় রাজি না হন, তাহলে স্যার এই বাদবাকি কাগজগুলোতেও আপনার সাইন উঠতে চলেছে। বলে রাখি, এগুলো কিছু অবৈধ কাজকর্মের ডকুমেন্ট। অবৈধ বলতে ঠিক কি পরিমাণে অবৈধ, সেটা আপনি কাল সকালে পড়লেই বুঝতে পারবেন। ও হ্যাঁ! এরসাথে আপনার কিছু আপত্তিকর ছবি ভিডিও-ও কাল সকাল নাগাদ ভাইরাল হবে। এন্ড ট্রাস্ট মি! সেগুলোর কোনোটাই ভুয়া অথবা এডিটেড হবে না। কেননা মিনিট দুয়ের মধ্যে আপনি আর আপনি থাকবেন না। লাইক জ্ঞানে থাকবেন, তবে স্বজ্ঞানে থাকবেন না। এই ইনজেকশন আপনাকে এমন একটা স্টেটে নিয়ে যাবে যে, তখন আপনি যা তা করে ফেলতে পারেন। আর আপনাকে দিয়ে সেই যা তা টা আমি করাবো।

এতোক্ষণ নরম গলায় কথা বললেও তাথৈয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে এবারে। কাগজ একপাশে রেখে, ঝুকে বসে প্রফেসরের গেন্জির কলার মুঠে করে নিলো ও। শক্তকন্ঠে বললো,

– আপনি বুঝতে পারছেন স্যার, আপনার না আপনার ওপর কেমন ইফেক্ট করতে চলেছে?

বাইরে আলোর ঝলকানি আর বজ্রপাতের শব্দ হয় আবারো। সে আলোতে প্রফেসরের চোখে পরে, তাথৈয়ের রক্তলাল চোখজোড়া। চারপাশ ঝিম ধরে আসে তার। এর পরবর্তী ঘটনা বলতে মনে পরে সকালে বিছানায় নিজেকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় খুজে পাওয়া। আর ঠিকঠাক জ্ঞান ফিরতেই মোবাইলে মেইলের নোটিফিকেশন। ওপেন করতেই বোঝা গেলো, অজ্ঞাত মেয়ে যা যা বলে গিয়েছিলো, তাই তাই সে মেইলে। অবৈধ বলতে সে এমনসব অবৈধ কাজকর্মে তার সাইন নিয়ে গেছে যে, সেগুলো পড়ে প্রফেসরের গা শিরশিরিয়ে ওঠে। তারওপর ছবি, ভিডিও-ও আছে। সেগুলো দেখে প্রফেসর বুঝতে পারলেন, ইনজেকশনের জন্য কোনোরকম আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিলো না তার। এসব ভয়ংকর জিনিসের সাথে মেইলে লেখা ছিলো, ‘কনফারেন্স করলে আপনাকে প্রথম তিনটে ডকুমেন্ট পাবলিশ করতে হবে। না করলে আমি নিজ দায়িত্বে এই সবগুলো পাবলিশ করবো। গুড ডে স্যার।’

প্রেস কনফারেন্স করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিলো না প্রফেসর সুবোধের। তাথৈয়ের দেওয়া প্রথম শর্ত মেনে কনফারেন্স ডাকেন তিনি। স্বীকার করেন সমস্তটা। তার চোরামোর কথা শুনে একপ্রকার জ্বলে ওঠে শিক্ষার্থীরা। ক্ষীপ্ত ছাত্রছাত্রীদের মাঝ থেকে দ্রুততার সাথে সরিয়ে নেওয়া হয় তাকে। শিক্ষার্থীদের দাঙ্গায় পরে তৎক্ষনাৎ বিভাগ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, প্রফেসর সুবোধকে বহিস্কার করা হয়েছে।

টিভিতে সবটা সরাসরি সম্প্রচার দেখে কপালে ভাজ পরলো তাশদীদের। অবিশ্বাসের ক্ষীণ রেশ দেখা গেলো ওর চোখেমুখে। আলহামদুলিল্লাহ বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন মিসেস ওয়াসীর। তামজীদ সোফায় বসে বারান্দার দেয়ালে বল ছুড়ে আবারো ক্যাচ করে নিচ্ছিলো। খবরটা দেখে ওউ খুশি হয়ে গেলো। তাশদীদের ফোনে কল আসে। বাবার নম্বর দেখে সালাম দিলো ও। ওপাশ থেকে ওয়াসীর সাহেব সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,

– নিউজ দেখেছো?

– হ্যাঁ বাবা।

– দেরিতেই সই, সে লোক যে তার ভুল বুঝতে পেরেছে, এই অনেক। বাকিটা পুলিশ দেখে নেবে। তুমি আর এসব নিয়ে চিন্তা করো না। বাড়ি এসে কথা বলছি।

কল কাটলো তাশদীদ। মিসেস ওয়াসীর বললেন,

– এই লোক প্রীতিকার্নিশ এসেছিলো তাশদীদ। যদি জানতাম উনি তোর এতোবড় ক্ষতি করতে চাইছে, তাহলে…

তাশদীদ কিছু বললো না। ওর মাথায় ঢুকছে না প্রফেসর নিজে থেকে সবটা স্বীকার করে নিলো কি করে? যখন ওর ধারনা ছিলো পেইজের ডকুমেন্টগুলো তারই দেওয়া। আবারো মোবাইল বাজে তাশদীদের। শান্তর কল। কল রিসিভ করতেই শান্ত বললো,

– নিউজ দেখেছিস?

– হুম। কিন্তু শান্ত…

– পেইজে তোর স্বপক্ষে কাউন্টার পোস্ট করা হয়েছে। ওটা দেখেছিস?

তাশদীদ আরেকদফা অবাক হয়। কল কেটে তৎক্ষনাৎ ফেসবুক খুলে পোস্টটা দেখে নিলো ও। আগের পোস্টটার প্রতিটা শব্দের বিপরীতে জবাব লেখা সেখানে। সাথে ওর আগে মোডিফিকেশন শেষ করার প্রফেসর সুবোধের স্বীকারোক্তি। সে পোস্টেও কার্টেসি নেই। পুরো বিষয়টা হজম হয়না তাশদীদের। তৎক্ষনাৎ পোস্টকারী কে জানতে চেয়ে পেইজ ইনবক্সে ম্যাসেজ করে ও। ওপাশ থেকে উত্তর আসে,
‘পোস্টকারী কে সেটা বলার নিয়ম নেই। কিন্তু আগের পোস্ট যে আইডি থেকে এসেছিলো, কাউন্টার পোস্টও একই আইডি থেকে এসেছে। আর দ্বিতীয় পোস্টে আসল সত্যিটা বেরিয়ে আসায় আগের পোস্ট ডিলিট করা হয়েছে।’

নিউজফিডে ছড়িয়ে পরা তাশদীদের পক্ষের কাউন্টার পোস্টটা দেখে চোখ কপালে ওঠে তুল্যর। চোখ তুলে দেখে টিভিতেও একই নিউজ। সোফায় বসা থেকে বোনের ঘরের দিকে একপ্রকার ছুট লাগায় ও। তৈয়ব আলফেজ ছেলেকে চলে যেতে দেখলেন একপলক। সিগারেটে টান দিয়ে আবারো মনোযোগ দিলেন টিভিতে। তুল্য বোনের রুমের দরজায় এসে দেখে তাথৈ ড্রেসিংটেবিলের বসে হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাচ্ছে। নিজেকে স্থির করে ও ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

– নিউজ দেখেছিস?

তুল্য থামে। তাথৈ আয়নায় ভাইয়ের দিকে তাকালো একবার। আবারো নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো ও। কাজ শেষ করে হেয়ার ড্রায়ার টেবিলে রাখলো তাথৈ। তারপর এগোলো তুল্যর দিকে। মাথা উচু করে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

– তোর মনে হয় আমার নিউজ দেখার প্রয়োজন আছে?

তুল্য জবাব দিতে পারে না। তাশদীদকে নিয়ে অটুট বিশ্বাস তাথৈয়ের চোখের তারায় তারায়। সেটা আগেই অনুভব করেছে ও। বুজো বারান্দায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলো। সেখান থেকেই আওয়াজ করলো ও। তুল্য চুপচাপ বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। তাথৈ বিছানা থেকে হেডফোন, ফোন আর ওয়েন্টমেন্ট হাতে নিয়ে বারান্দায় এগোলো। চেয়ারসদৃশ দোলনায় বসে গিয়ে হেডফোন কানে গুজলো। গ্রিলে পা ঠেকিয়ে বসে, মুগ্ধ চোখে হাতের কাটাছেড়া দেখতে দেখতে বললো,

– ডু ইউ লাভ মি তাথৈ?

তাথৈ হেসে ফেললো। অয়েন্টমেন্ট হাতে ছুইয়ে দিতেই চোখ ভরে ওঠে ওর। ও একাএকাই বলতে থাকে,

– কি করে তোমায় ভালোবাসি বলতাম তাশদীদ? জেনেবুঝে নিজেকে রিংকির পরিস্থিতিতে আমি কি করে ঠেলে দেই বলো? ভালোবাসি বলার পর, তোমার ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা আমার সহ্য হতো না। তাই হয়তো আমার সাহস হয়নি। পুরো পৃথিবীর সাথে লড়ে যেতে পারলেও, তোমার সামনে নিজেকে এতোটুকো সাহসী করে তুলতে পারিনি আমি। তোমায় ভালোবেসে তোমার সামনে ক্রমশ ভীতু হয়ে পরেছি, পরছি!
কিন্তু তুমি তো সাহসী তাশদীদ! তুমিই না হয় আমাকে বলো, তুমি আমায় ভালোবাসো! ‘ডু ইউ লাভ মি তাথৈ?’ এর পরিবর্তে তুমি না হয় আমাকে জিজ্ঞেস করো, ‘উইল ইউ ম্যারি মি তাথৈ?’ এন্ড আই প্রমিস ইউ তাশদীদ! আই প্রমিস ইউ সেদিন আর কোনো লুকোচুরি না, কোনো ভয় না। আমি নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায়, পুরো পৃথিবীকে জানাবো, আই লাভ ইউ! আমি তোমায় ভালোবাসি তাশদীদ ওয়াসীর! আমি তোমায় ভালোবাসি!

তাথৈয়ের চোখ বেয়ে জল গরায়। কাদতে কাদতে ক্ষতগুলোতে মলম লাগাতে থাকে ও। কানে গোজা হেডফোনে বেজে চলেছে,
‘Ye ishq tum na karna,ye roog hi lagaye
Dafan khudh kare hai,phir sokh bhi manaye…’

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪৫.

ফজর নামাজ থেকে ফিরে প্রীতিকার্নিশের বারান্দায় বসলো তাশদীদ। ঘরের ভেতর থেকে মিসেস ওয়াসীরের ক্ষীণ তেলাওয়াত শোনা যাচ্ছে। ওয়াসীর সাহেব হাটতে গিয়েছেন। তামজীদ কোচিংয়ে। তাশদীদ হাটুতে দুহাতের কনুই ঠেকিয়ে কপালে ভাজ ফেলে বসে রইলো। সবটা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসলেও কেটে যাওয়া দিনগুলোর কথা মাথা থেকে নামছেই না ওর। কি ভেবে ঘরে গিয়ে মানিব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পরলো তাশদীদ। সবে প্রীতিকার্নিশের বাইরে পা রাখতে যাবে, খাকি পরা এক মধ্যবয়স্ক লোক সাইকেল নিয়ে দাড়ালো ওর সামনে। ওকে দেখে বললো,

– তাশদীদ ওয়াসীর?

মাথা ওপরনিচ করে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো তাশদীদ। লোক তার ব্যাগ থেকে একটা খাম ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। খামের ওপরের বিভাগীয় সিল দেখে তাশদীদের বুঝতে বাকি রইলো না, ওটা চেয়ারম্যানের তরফ থেকে এসেছে। ভেতরে কি থাকতে পারে এ নিয়ে আন্দাজ আছে ওর। তবুও বারান্দায় বসে খামটা খুললো তাশদীদ। ওর ধারনা মিলে যায়। ওর ছাত্রত্ব বাতিল নিয়ে যে সতর্কবানী ওকে পাঠানো হয়েছিলো, ওখানে তার প্রত্যাহারপত্র। সাথে সম্মাননা সনদ গ্রহনের জন্য দাওয়াতের কার্ড। আক্ষেপসূচক একটা চিঠি ছিলো সেখানে। বাকি কাগজদুটো সরিয়ে চিঠিটা হাতে নেয় তাশদীদ। লক্ষ্য করলো চিঠিতেও আরেকটা কাগজ সংযোজন করা আছে। ওর সাথে হওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে পুরো বিভাগ লজ্জিত। আর সে গ্লানি কিছুটা লাঘব করতে, মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরপরই ওর চাকরীর জন্য চিঠিতে বলা হয়েছে। তাশদীদ সংযোজন পত্রটা দেখলো। নিশব্দে হেসে কাগজটা টি-টেবিলে রাখলো। তাশদীদ দুহাত একসাথে মুঠো করে। তাতে থুতনি থেকে কিছুক্ষন সে কাগজটার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকে। তারপর দুটো সাইন করে, কাগজদুটো ঘরে রেখে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরলো ও।

ডোরবেল শুনে দরজা খুললেন প্রফেসর। দরজায় দাড়ানো তাশদীদকে দেখেই শরীর রীতিমতো জ্বলে ওঠে তার। তাশদীদ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই দরজা লাগিয়ে দিতে উদ্যত হন প্রফেসর সুবোধ। তাশদীদ একপ্রকার থাবা মারলো দরজায়। শীতলস্বরে বললো,

– বেশিক্ষণ নেবো না আপনার। আমার শুধু একটা প্রশ্নের জবাব চাই।

– তোমার জন্য আমার এতোগুলো বছরের শিক্ষকতার জীবন কলঙ্কিত তাশদীদ! তোমার জন্য আমার ছেলে বিদেশে নিজের সম্মান, ছাত্রত্ব সব হারিয়ে জেলে দিন কাটাচ্ছে! আর তুমি এক্সপেক্ট করো আ’ম গোয়ানা আন্সার ইউ?

– আমার জন্য?

প্রফেসরের রাগ বাড়ে। দরজা আরো জোরে ঠেলতে থাকে সে। তাশদীদও এবার ধাক্কা লাগালো। দরজা পুরোপুরিভাবে খুলে যায়। প্রফেসর টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেলেন। তাশদীদ ভেতরে ঢুকলো। দুহাত প্যান্টের পকেটে গুজে, আরামে দাড়িয়ে বললো,

– আমি জোর দেখাতে শুরু করলে আপনি টিকতে পারবেন না স্যার। তারচেয়ে বরং সোজা শব্দে আমার প্রশ্নের জবাব দিন। কনফারেন্সের আগে কি এমন ঘটেছিলো যে আপনি এতো সহজে সবটা স্বীকার করে নিলেন? আপনার এমন আমূল পরিবর্তনের কারন কি?

প্রফেসর কিঞ্চিত অবাক হয়। এক হাটুরবয়সী মেয়ে এসে আগেররাতে তাকে যে ধমকি দিয়ে গেছে, সে মেয়েকে খুজতে ওনারই তাশদীদের কাছে যাওয়ার কথা। অথচ তাশদীদ নিজেই এসেছে তার খোজ নিতে। বিস্ময় সামলে প্রফেসর রাগ নিয়ে বললেন,

– ভয় পেয়ে কিছুই না জানার ভান করছো তাশদীদ? আমার কাছে ভালোমানুষি দেখাচ্ছো? আমার কাছে?

– ভাগ্যিস ভালোমানুষিটাই দেখাচ্ছি! এটা আপনার জন্য বাড়তি নয়কি?

রাগে প্রফেসরের চোখ ভরে উঠলো এবারে। একরাশ আক্রোশ নিয়ে বললেন,

– শোনো তাশদীদ! যতোই নাটক করো। তুমি চেনো বা না চেনো, ওই মেয়েকে আমি ঠিক খুজে বের করবো! তারপর আমার আর আমার ছেলের এক একটা অপমানের হিসেব তুলবো তোমাদের কাছ থেকে। মাস্কের আড়ালে সে রাতে আমার বাসায় কে এসেছিলো, তা জানতে আমার খুবএকটা সময় লাগবে না। ওকে এতো সহজে আমি ছাড়বো না! মাইন্ড ইট!

কেবলমাত্র ‘মেয়ে’ শব্দটাতেই আটকে যায় তাশদীদ। প্রফেসরের বলা কথাগুলো সাজিয়ে বুঝতে পারে, কোনো মেয়ে আগেররাতে তাকে বাড়ি বয়ে ধমকি দিয়ে গেছে। মাস্ক পরিহিত ছিলো। মানে এরচেয়ে বেশিকিছু যে প্রফেসরের কাছে নেই, সেটাও বুঝলো ও। হাত মুঠো করে নেওয়ার দরুন তাশদীদের চেহারার ভাবটা প্রকাশ পেলো না। তবুও সে অভিব্যক্তি বোধহয় বুঝলেন প্রফেসর সুবোধ। তাশদীদ বললো,

– আমার চেনা হোক বা অচেনা, সে সত্যিটাই সবার সামনে এনেছে। কোনো অপরাধ করেনি। তাই তাকে ছাড়া তো দুর, ধরা, এমনকি ছোঁয়ার কথাও মাথাতে আনবেন না স্যার। তাশদীদ ওয়াসীরের তরফ থেকে এটা আপনার জন্য প্রথম এবং শেষ সতর্কবাণী রইলো। দয়া করে মনে রাখবেন।

প্রখর এক চাওনি রেখে দ্রুতপদে বেরিয়ে যায় তাশদীদ। যাওয়ার আগে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যায় ও। অপমানে, ক্ষোভে হাতের গ্লাস ছুড়ে মারলেন প্রফেসর সুবোধ। সে রাতে ওই অচেনা মেয়ে এসে প্লিজ বলে ওনাকে হুমকি দিয়ে গিয়েছিলো। আজ তাশদীদও দয়া করতে বলে ওনাকে হুমকি দিয়ে গেলো। রাগে কাপন ধরে যায় প্রফেসরের শরীরে। টরেন্টোর জেলে ছেলের অবস্থা কল্পনা করে চোখ ফেটে জল গরাতে থাকে তার।

প্রায় সপ্তাহখানেক পর ক্যাম্পাসে এসে সোজা বিভাগীয় শিক্ষিকার কেবিনে নক করে তাশদীদ। ভেতর থেকে জবাব আসলো, ‘কাম ইন।’ তাশদীদ কেবিনে ঢুকলো। ওকে দেখেই খুশি হয়ে যান শিক্ষিকা। হাতের কাগজপত্র সরিয়ে রাখলেন তিনি। তাশদীদ সালাম দিয়ে বিনীত স্বরে বললো,

– কেমন আছেন ম্যাম?

– আরেহ তাশদীদ! তুমি! বসো বসো! ফার্স্ট অফ অল, কনগ্রাচুলেশনস! আমি জানতাম তোমার এগেইনিস্টে ওঠা অ্যালিগেশনস্ জলদিই সলভ হবে। সো হ্যাপি ফর ইউ!

তাশদীদ চেয়ার টেনে বসলো। কাধের ব্যাগ থেকে কয়েকটা ফাইল বের করে, টেবিলে রেখে বললো,

– থ্যাংকিউ ম্যাম। একটু ইমার্জেন্সি নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। সময় হবে আপনার?

– আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি তাশদীদ, আ’ম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ। বলো কি বলতে চাও।

– ** ব্যাচের সাথে আমি যে প্রজেক্টটা শুরু করেছিলাম, সেটা আমি কন্টিনিউ করছি না ম্যাম।

স্পষ্টভাবে বলে দিলো তাশদীদ। শিক্ষিকা প্রসারিত চোখে চাইলেন ওর দিকে। একটু সময় আটকে থেকে, জোরপূর্বক হেসে বললেন,

– ক্ কি বলছো তুমি? প্রজেক্ট কন্টিনিউ করবে না মানে?

– আপনি ঠিকই শুনেছেন ম্যাম।

– কিন্তু তাশদীদ, প্রজেক্টের এক্সপেরিমেন্টাল পোর্শন শেষ। মডিফিকেশনের লাস্ট স্টেজ চলছে। বায়োকেম-জেনেটিকের সবচেয়ে ডিসায়ার্ড প্রজেক্ট এটা। আর তুমি এইসময় এসে বলছো তুমি প্রজেক্ট কন্টিনিউ করবে না? যখন কিনা এখনই তোমার প্রজেক্টে আরো লেগেপরে কাজ করার কথা। তোমার প্রিভিয়াস ইনস্টিটিউশন থেকে অলরেডি একটা ইনভেনশনের জন্য অনার্ড তুমি।

তাশদীদ সবই শুনলো। কিন্তু ওর চেহারার কোনো বদল ঘটলো না। শিক্ষিকা বুঝলেন, ও ওর সিদ্ধান্তে অটল। একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে তাশদীদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন তিনি। বললেন,

– এই মোমেন্টে এসে কেনো পিছিয়ে যাচ্ছো? জানতে পারি?

– আমি সবাইকে জানিয়ে প্রজেক্টটা করতে চাইনি। কিন্তু এখন সবাই যখন জেনে গেছে আমি এই প্রজেক্টে আছি। তাই আমার পক্ষে এটা আর কন্টিনিউ করা পসিবল না ম্যাম। আ’ম সরি।

শিক্ষিকা বলার কিছু পেলেন না। এই প্রজেক্ট তাশদীদ স্বেচ্ছায় শুরু করেছিলো। সেই ওই যদি নিজে থেকে তা ছেড়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে কারো কিছু বলার থাকে না। কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো তাশদীদ। ওর মাথায় আপাতত কেবল একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ওর আড়াল থেকে কে প্রফেসর সুবোধকে শাষিয়েছে। কেই বা পেইজে পোস্টকারীকে কাউন্টার পোস্ট লিখতে বাধ্য করেছে। হাজারো ভাবনা ভাবতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পরে তাশদীদ। ক্লাসের বাইরের করিডোর পার করতে গিয়ে অকস্মাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে পিছিয়ে যায় ও। সরি বলার আগেই সামনেরজন নম্র আওয়াজে বললো,

– সরি।

তাশদীদ তাথৈকে দেখে অবাক হয়। তারচেয়ে বেশি অবাক হয় ওর বলা ‘সরি’ শুনে। সরি বলার আদব তাথৈয়ের ছিলো না। তারওপর আজ দোষটা তাশদীদেরই ছিলো। সেখানে তাথৈ নিজে সরি বলছে, ব্যাপারটা হজম হলো না ওর। তাথৈ কুর্তির পকেটে একহাত গুজে, তাশদীদকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। এরপর স্বাভাবিক স্বরে বলে,

– কনগ্রাচুলেশনস।

– ফর?

জবাবের পরিবর্তে তাথৈ মৃদ্যু হেসে ওকে পাশ কাটাচ্ছিলো। তাশদীদ দ্রুততার সাথে বললো,

– সেদিন অডিটোরিয়ামে ওভাবে প্রশ্ন করার জন্য সরি।

থেমে গিয়ে পেছন ফেরে তাথৈ। তাশদীদ একপা এগিয়ে বললো,

– আমার মনে হয়েছিলো তুমি…

– আমি আপনাকে ভালোবাসি।

প্রসারিত চোখে চায় তাশদীদ। একমুহুর্তের জন্য মনে হয় তাথৈ স্পষ্টভাবে ওকে নিজের মনের কথা জানান দিলো। ওকে ওমনভাবে তাকাতে দেখে তাথৈ আবারো হেসে ফেললো। বললো,

– আপনার মনে হয়েছিলো আমি আপনাকে ভালোবাসি?

তাশদীদ জবাব খুজে পায় না। কিন্তু ও দমেও রইলো না। কি ভেবে আরো একপা এগোলো ও তাথৈয়ের দিকে। সাহসী কন্ঠে প্রশ্ন করে বসা তাথৈ যেনো এটুকোই নিতে পারলো না। একপা পিছিয়ে গেলো ও। তাশদীদ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো ওকে। মুখে কিছু না বললেও, ওর চোখজোড়া হয়তো বলছিলো,
‘শুধু একবার! একবার একটা সুদৃঢ় কারন খুজে পাই, তারপর তোমার প্রতিটা পদক্ষেপের জবাব আমি দেবো তাথৈ আলফেজ।’
কিছুটা দুর থেকে টিটু ডাক লাগালো তাশদীদকে। একপলক তাথৈকে দেখে নিয়ে চলে যায় ও।
মুচকি হাসলো তাথৈ। শার্লিও তখন ব্যাগের মধ্যে কিছু খুজতে খুজতে ওরদিকেই এগোচ্ছিলো। তাথৈয়ের কাছাকাছি পৌছে ব্যস্তভাবে বললো,

– কখন এসেছিস? এ কয়দিন যা গেলো! আমিতো ভয়ই পেয়েছিলাম যে তাশদীদ ভাই সত্যিসত্যিই হয়তো…

শার্লি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাথৈকে দেখে থেমে যায় ও। তাথৈয়ের সামনে তাশদীদকে দোষী ধারনা করার বিষয়ে বলাটা সমাচীন মনে হলো না ওর। তাথৈ নিশব্দে হেসে বললো,

– দুজনেই এক হয়েছিস।

ক্লাসে ঢুকে গেলো তাথৈ। শার্লি অবুঝের মতো তাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো। সেকেন্ড পাঁচেক সময় নিয়ে কথাটা বুঝলো ও। এরমানে তুল্যও হয়তো তাশদীদকে নিয়ে বিপরীতই ভেবেছিলো। ঠিক সেসময়ই বল ড্রিবলিং করাতে করাতে ক্লাসে ঢুকছিলো তুল্য। ওকে দেখে শার্লি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,

– চল তুল্য, দুজনে এক হই?

চমকে দাড়িয়ে যায় তুল্য। শার্লির দিকে তাকাতেই ও হচকিয়ে যায়। জিভ কেটে চোখ বন্ধ করে নিলো শার্লি। তুল্যর কি হলো, ঠাস করে শার্লির মাথায় চাটি মেরে দিলো ও। মুখ বাকিয়ে বললো,

– টেনেটুনে পাশ করা সিজিলেস মেয়ে! যোগ শেখাতে এসেছে আমাকে! দুজনে এক হবে! যা ভাগ!

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তুল্যর দিক চেয়েই ক্লাসে ঢুকলো শার্লি। রাগ হলো ওর। তুল্যর জবাব কিংবা মারের জন্য না! নিজে থেকে ওকে প্রেমমুলক কথা বলতে গেছে, এজন্য। রাগে নিজের চুলই টানলো শার্লি। গাল ফুলিয়ে বসে গেলো শেষ বেঞ্চে।
আলো দরজার কাছের বেঞ্চটাতেই বসেছিলো। শার্লির প্রশ্ন আর তুল্যের জবাব, ও দুটোই শুনেছে। তুল্যের জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে, জানালা দিয়ে বাইরে একপলক উঁকি দিলো আলো। ফাঁকা করিডোরে দাড়িয়ে বল ড্রিবলিং করছে তুল্য। ওর মুখচোখ জুড়ে এক অদ্ভুত সুখ। ভালোবাসার থেকে ভালোবাসাময় কথা শোনার সুখ!

মাঝে আরোকিছু দিন গরালো। তাশদীদদের মাস্টার্সের ক্লাস এখন প্রায় শেষের দিকে। একারনে ক্লাস বাদ দিচ্ছে না কেউই। দুপুরের বিরতিতে টিটুর সাথে সাইকেলে করে ওর হলের দিকে যাচ্ছিলো তাশদীদ। দুজনে কথা বলতে বলতে লক্ষ্যই করেনি সামনের গাড়িটা বাদিকেই এগোচ্ছে। না চাইতেও তাশদীদের সাইকেলে ছোটখাটো একটা সংঘর্ষ হয়ে যায় অত্যাধুনিক গাড়িটার সাথে। পরে যাওয়া থেকে কোনোমতে নিজেদের বাচিয়ে নেয় তাশদীদ, টিটু। সাইকেল পাশ কাটিয়ে দ্রুত গাড়ি ব্রেক কষলো টেরেন্স। গাড়ি থেকে নেমে তেড়ে এগোলো তাশদীদ, টিটুর দিকে। এসে সোজা তাশদীদের বুকে ধাক্কা লাগিয়ে বললো,

– দেখে চলতে পারো না ইউ ইডিয়ট?

বুকে ধাক্কা পেয়ে একপা পিছিয়ে যায় তাশদীদ। টিটু পুরোই আহম্মক হয়ে গেছে। যে তাশদীদ ওয়াসীরের নাম দেশের কোনে কোনে ছড়িয়ে গেছে, সে তাশদীদকে কোথাকার কে এসে ‘ইডিয়ট’ বলে সম্বোধন করছে। উপরন্তু ওর গায়েও হাত তুলেছে। তাশদীদ বুকের দিকের শার্ট ঝেরে চোখ তুলে তাকালো। কাটাছেড়া জামাকাপড় বিশিষ্ট ছেলেকে দেখে বুঝলো সে পশ্চিমা বেশভুষার জীবনযাপন করে। একগাল হেসে বললো,

– সরি ব্রো। বুঝতে পারিনি তুমি এদিকেই গাড়ি পার্ক করবে। সরি সরি।

টিটু অবাকচোখে চায় ওর দিকে। এতো সহজভাবে সরি বলা কেউ তাশদীদের কাছে শিখুক। টেরেন্স ঘুরেঘুরে নিজের গাড়ি দেখলো। সাইকেল লেগে গাড়ির একাংশে একটুখানি রঙ ছড়ে গেছে। তা দেখে যেনো মেজাজ আরো বিগড়ে যায় টেরেন্সের। উচু গলায় তাশদীদকে বললো,

– দেখো তোমার সস্তা সাইকেল আমার গাড়ির কি অবস্থা করেছে দেখো!

– ও, ও! আসলেও তো…!

গাড়ির দিকে তাকিয়ে আফসোস নিয়ে বললো তাশদীদ। উচ্চতায় কিছুটা খাটো হওয়ায় টেরেন্স ঘাড় উচিয়ে দেখলো ওর আফসোস। তাশদীদ কোমড়ে হাত রেখে করুণস্বরে বললো,

– এখন উপায়?

– উপায় মানে? তোমার এগেইনিস্টে আমি কমপ্লেইন করবো! ক্যাম্পাসের মধ্যে সাইকেল নিয়ে ছোটাছুটি করো! গুন্ডাদের মতো…

– ওই ফটিক চাঁন! মুখ সামলে! তুই কে বে? অনেকক্ষণ হলো ফটরফটর করছিস দেখছি! কোত্থেকে ল্যান্ড করলি?

শান্তর গলা শুনে হাত কপালে নিলো তাশদীদ। কপাল চুলকে হাসিটা লুকালো। শান্তকে দেখে টেরেন্স কিছুটা দমে যায়। শান্ত ললিপপ হাতে এগোলো ওর দিকে। ললিপপ মুখে পুরে হাটুগেরে বসলো গাড়ির সামনে। গাড়ির রঙচটা জায়গা দেখে নিয়ে টিটুকে বললো,

– কিরে? কি হয়েছে?

– কিছু হয়নি। চল ক্লাসে চল।

কাধে হাত রেখে শান্তকে তুলে দাড় করালো তাশদীদ। টিটুকে ইশারা করে একপ্রকার বগলদাবা করে নিয়ে গেলো ওকে। টিটু ফোকলা হেসে টেরেন্সকে বললো,

– বেটা গাড়ি ছাড়ো, গুগলে তাশদীদ ওয়াসীর লিখে একটু সার্চ করো। তারপর এসো ওকে ইডিয়ট বলতে কেমন? শালার ***!

শেষে ছোটগলায় একটা গালি দিয়ে স্থানত্যাগ করলো টিটু। টেরেন্স নিজেই এবার বিমুঢ়। বুকভরা কষ্ট নিয়ে গাড়ির রঙওঠা জায়গাটা দেখতে লাগলো ও। কিছুটা দুরের কনফেকশনারি দোকানটায় কোল্ডড্রিংক হাতে দাড়িয়ে ছিলো তাথৈ। স্ট্র তে চুমুক দিতে দিতে পুরো ঘটনাটা দেখছিলো ও। হাতেরটা শেষ করে আরো একটা কোল্ডড্রিংক কিনলো তাথৈ। আচমকাই দুর্বোধ্য এক হাসি ফোটে ওর ঠোঁটের কোনে।

#চলবে…