কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
302

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪৬.

গাড়ির অল্পখানি রঙচটা অংশ নিয়ে দিনে তারা দেখছে টেরেন্স। ওর কপালের চারপাচটা ভাজ বলে দিচ্ছে, এইটুকোর জন্য যেনো ওর মানসম্মান সবটুকো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। টেরেন্স ফোন বের করে কল লাগালো কাউকে। পাইচারী শুরু করে দিলো। ওর চিন্তার বহর পরখ করে দোকান থেকে বেরোলো তাথৈ। টেরেন্স ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ির একটা দরজা খুলে বাহাত রাখলো। অকস্মাৎ ওর হাত চাপা পরে দরজায়। তীব্র যন্ত্রণায় গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে ও। মুহুর্তের ব্যবধানে ওর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। ঘোলাটে চোখে পাশে তাকাতেই দেখে তাথৈ গাড়ির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ানো। শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়েছে ও। টেরেন্স ব্যথায় চিৎকার করে তাথৈয়ের নাম উচ্চারণ করলো। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র হেলদোল হলো না তাথৈয়ের। স্ট্র তে চুমুক দিতে দিতে নির্বিকারচিত্ত্বে টেরেন্সের চোখের জল আর ব্যথার কারনে মুখের অভিব্যক্তি দেখতে লাগলো ও। সহ্যের বাধ ভাঙে টেরেন্সের। চেচিয়ে বললো,

– দরজা ছাড়ো তাথৈ!

– এতো লাউড?

গাল ফুলিয়ে বললো তাথৈ। টেরেন্স চোখমুখ খিচে নিজেকে সামলালো। এই অবস্থায় কার না উচুস্বর বেরোবে? তবুও কাতরতা নিয়ে আবারো বললো,

– গাড়ির দরজা ছাড়ো তাথৈ।

– কিন্তু আমিতো তোমার গাড়ির দরজা ধরে নেই টেরেন্স!

মাসুম মুখ করে জবাব দিলো তাথৈ। নিরুপায় হয়ে টেরেন্স নিজেই নিজের হাত টান লাগাতে লাগলো। তাথৈ সব ভণিতা ছেড়ে এবার গম্ভীর গলায় বললো,

– এ হাতেই তাশদীদের বুকে ধাক্কা লাগালে না তুমি?

টেরেন্স অবুঝের মতো করে চায়। আর তাথৈ তৃপ্তি নিয়ে ওর বিধ্বস্ত চেহারাটা দেখতে থাকে। চোখের পানিতে টেরেন্সের চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। তাথৈ দরজা থেকে সরে দাড়ালো। ছাড় পেতেই ডানহাতে বাহাতটা চেপে ধরলো টেরেন্স। তীব্র ব্যথায় মুখচোখ কুঁচকে এসেছে ওর। তাথৈ লক্ষ্য করলো, টেরেন্সের আঙুলের চাপ লাগা অংশগুলো ক্রমশ কালশিটে হয়ে উঠছে। আর সে লোক ঠোঁট কামড়ে ধরে কষ্ট লাঘবের চেষ্টা চালাচ্ছে। হাতে থাকা ঠান্ডা পানীয়র কাচের বোতলটা ও টেরেন্সের আঙুলে ছোঁয়ালো। টেরেন্স একবার ওরদিক তাকিয়ে নিজেই বোতলটা ধরলো। তাথৈ সানগ্লাস চোখে পরে আবারো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়ালো। মোবাইল বের করে স্ক্রল করতে করতে বললো,

– অনেক তো হলো এইডিং। এখন আমি তোমার হাতচাপা কেনো দিলাম, তার সারমর্ম শোনো?

টেরেন্স অবাক চোখে চায়। একমুহূর্তের জন্য হলেও ও ভেবেছিলো হয়তো তাথৈ ভুলে গাড়ির দরজা বন্ধ করেছিলো। কিন্তু তাথৈয়ের কথায় স্পষ্ট, ও জেনেবুঝেই ওকে আঘাত করেছে। ওকে অবাক হতে দেখে তাথৈয়ের প্রতিক্রিয়া বদলায় না। সানগ্লাস খুলে টেরেন্সের হাত থেকে পানীয় নিয়ে নিলো ও। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

– যারতার গায়ে হাত দিতে নেই টেরেন্স। বিশেষ করে তাথৈ আলফেজের পছন্দের মানুষটার গায়ে তো একদমই না।

টেরেন্স বাকরুদ্ধ। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাশদীদকে খুজলো ও। পেলোনা। ব্যথার মাঝেও জোরালো হেসে বললো,

– হ্ হুয়াট? তোমার পছন্দের মানুষ?

তাথৈ মুখে কিছু বললো না। ওর নিমীলিত চাওনি দেখে টেরেন্সের তাচ্ছিল্য রয়েসয়ে আসলো। বুঝতে বাকি রইলো না, তাথৈ তাশদীদের বিষয়ে কতোটা সিরিয়াস। টেরেন্স নিজেকে সামলালো। স্বর খাদে নামিয়ে বললো,

– দ্যাট গাই? তোমার ওই ছেলেটাকে পছন্দ?

– ইন এভরি ইউনিভার্স।

– ইউ লাভ হিম তাথৈ?

– ইন এভরি ওয়ে ওয়ান ক্যান।

টেরেন্স ক্ষেপে যায়। তাশদীদের ওই ঘামে ভেজা শার্ট আর ভাঙাচুরা সাইকেল দেখেই ও ধরে নিয়েছে ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। সেখানে আলফেজ গ্রুপের উত্তরসূরী তাথৈ আলফেজ কিনা তার প্রেমে পরবে, এমনটা কিকরে হতে পারে ভাবনায় আসেনা ওর। হাতের ব্যথা ভুলে গেলো ও। খেঁচানো আওয়াজে বললো,

– হোয়াট ননসেন্স! হি’জ জাস্ট আ কমন ম্যান! কোথায় তুমি আর কোথায় ওই ছেলে! ও তো…

হাত তুলে টেরেন্সকে থামিয়ে দিলো তাথৈ। কোল্ড ড্রিংকের বোতল গাড়ির ওপর রেখে, বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে বললো,

– তাশদীদের এগেইনিস্টে কথা বলতে আমি কাউকে এলাও করি না টেরেন্স। প্রথমবার বলে হাতের ব্যথা দ্রুত ভুলে গেছো। পরেরবার একই ভুল করলে হয়তো এমন কিছু হবে, যেটা তোমাকে সারাজীবন মনে রাখতে হবে।

– বাট তাথৈ, তোমার মমি…

– দেয়ার ইজ নো বাট! এন্ড লিসেন টেরেন্স! ওই মহিলা আমার মা না! সে নিজের লাভের জন্য তোমাকে একপ্রকার আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে এনশিওর করছি, এতে তোমার কোনো লাভ হবেনা। এরপরও আমার পেছনে পরে থেকে নিজেকে মেরুদন্ডহীন প্রমাণ করো না৷ আমার অন্যরুপ দেখার আগেই তুমি বরং অন্যরাস্তা মাপো। বেটার ফর ইউ।

তাথৈ আঙুল উচিয়ে বললো। গাড়ির ওপর থেকে বোতলটা হাতে নিয়ে, চোখে সানগ্লাস পরে চলে আসছিলো ও। কি ভেবে আবারো পেছন ফিরে বললো,

– আর হ্যাঁ। তাশদীদ থেকে দুরে থাকো। কেউ আমার পেছনে পরলে আমি সামলে নেই। কিন্তু কেউ তাশদীদের পেছনে পরলে আমার সহ্য হয় না। হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড।

স্ট্র তে চুমুক দিতে দিতে স্থানত্যাগ করলো তাথৈ। নিজের গাড়ির কাছে এসে ব্যাকসিটে কাধের ব্যাগটা রাখলো। বুজোর গলার বেল্ট ছেড়ে দিয়ে, ফোন বের করে রাস্তার জ্যামের অবস্থা দেখতে লাগলো। কিছুসময়ের মধ্যে আলো আসলো সেখানে। মৃদ্যুবেগে দৌড়াচ্ছে ও। পরনে সুতির থ্রিপিস, হাতে চাকরীর বই। ওকে দেখে তাথৈ মোবাইল পকেটে পুরলো। সানগ্লাস খুলে হাসিমুখে বললো,

– আরে! আলো? তুমি এখনো ক্যাম্পাসে? বাসায় যাওনি?

– হ্ হ্যাঁ ওই তোমার সাথে একটু আলাদাকরে কথা ছিলো। তাই…

– আমার সাথে আলাদাকরে কথা? কি কথা? ক্লাসে বলোনি কেনো?

প্র্য়ন করে ভ্রু কুচকালো তাথৈ। আলো কখনো এভাবে ওরসাথে কথা বলে না। কখনো এমন আড়স্টতা দেখায় না। বরং উল্টো এই আলোই সবসময় ওকে সামলেছে। আলো কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,

– কথা বলতে, আবদারই বলতে পারো।

– হ্যাঁ বলোনা!

– ত্ তুমি পরশু একবার আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে তাথৈ?

তাথৈ আবারো অবাক হয়। তবুও বিস্ময় আড়াল করে জোরালো হাসলো ও। বললো,

– কি ব্যাপার আলো? তিনবছরে এই প্রথমবার আমাকে দাওয়াত করছো! এনিথিং স্পেশাল?

আলোর চোখমুখে আরোবেশি অস্বস্তি দেখা গেলো এবারে। তাথৈ উঁকি দিলো ওর মুখের দিকে। বললো,

– কি হয়েছে আলো? কোনো সমস্যা?

– আ্ আসলে ওইদিন আমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। যতোদুর শুনছি, ছোটখাটো করে ওইদিনই হয়তো বিয়েটাও…

– ওয়াও আলো! তুমি বিয়ে করে নিচ্ছো?

– এতোটাও উত্তেজিত হয়ো না তাথৈ। তুমি ছাড়া আরকাউকে বলছি না।

তাথৈয়ের উত্তেজনাকে থামিয়ে দেয় আলো। তাচ্ছিল্যে হেসে মলিন করে নেয় চেহারাটা। ধরাছোঁয়ার বাইরের, এই তাথৈয়ের জমজ ভাইয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে পরার মতো বোকামোর কথা মনে পরে ওর। মনে পরে যায় তুল্যর সঙ্গ পাওয়া সে দুএকটা মুহুর্ত। আগেপরে হলেও ওকে তো সে মায়া কাটাতেই হতো। এই ভেবে আবারো মলিন হাসলো আলো। তাথৈয়ের সবটুকো উত্তেজনা মোমবাতির মতো নিভে যায় নিমিষেই। আলো মাটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

– তুমি তো জানো তাথৈ আমার পরিবারের অবস্থা কেমন। পরিবারের হাল না ধরে এসময় বিয়ে করার ইচ্ছে আমারও নেই। কিন্তু সুমি ম্যাম নিজে গিয়ে মাকে বলেছেন, ছেলের বাবার আমাকে পছন্দ। উনি নাকি এটাও বলেছেন, যদি বিয়েটা হয়, তাহলে বিয়ের পর আমার পড়াশোনার সমস্তটাই ওনাদের দায়িত্ব। তার কাছে ছেলে, ছেলের পরিবার সম্পর্কে জেনে মা দ্বিমতের সুযোগ পায়নি। তারমতে আমার মতো নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েকে ওমন দৃঢ় ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন লোক তার ছেলেরবউ বানাতে চেয়েছেন, এটাই নাকি অনেক। সবদিক ভেবে মা নিজেও রাজি হয়ে গেছে, আর আমাকেও…

তাথৈ বুঝলো আলোর মন খারাপের কারন। মেয়েটা পরিবারের কথা ভেবে যোগ্য ছেলে পেয়েও মন থেকে বিয়েতে মত দিতে পারছে না। মৃদ্যু হেসে আলোর হাত ধরলো তাথৈ৷ বললো,

– দেখো আলো, এতো চিন্তা করো না। বিয়ে তো এক না একদিন তোমাকে করতেই হতো। তুমি দু চারবছর পর যাকে বিয়ে করবে, সে যে তোমার প্রতি, তোমার ফ্যামিলির প্রতি সাপোর্টিভ হবে, তার কি গ্যারেন্টি আছে বলো? তারচেয়ে বরং রিস্কটা এখনি নিয়ে ফেলো। সুমি ম্যাম অনেক ভালো একজন মানুষ। উনি যদি তোমার জন্য কাউকে ভেবে থাকেন, সে যে নিসন্দেহে তোমার যোগ্য হবে, এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

– ম্যামের পছন্দ করা মানুষটাকে নিয়ে আমারও সন্দেহ নেই তাথৈ। খুব কাছ থেকে না চিনলেও, তাকে যতোটুকো দেখেছি, যতোটুকো শুনেছি, আমার মনে হয়না সে আমার পরিবারকে কখনো হেয় করবে।

– তুমি চেনো তাকে? আমাদের ক্যাম্পাসের?

ঝলোমলো চোখভরা আগ্রহ নিয়ে শুধালো তাথৈ। ওর প্রশ্নে আলো হাত কচলাতে শুরু করে দেয়। তাথৈয়ের দিকে না তাকিয়ে, একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বললো,

– হ্ হ্যাঁ। ক্যাম্পাসেরই। মাস্টার্স ফাইনালের টপার। তাশদীদ ওয়াসীর।

তাশদীদের নামের সাথে গাড়ির সংঘর্ষের বিকট শব্দ কানে আসে তাথৈয়ের। কিন্তু ও পাশে তাকালো না। আকাশসম বিস্ময়ে আলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। তাথৈয়ের চোখ বেয়ে নোনাজল গরায়। চারপাশ ঝিম ধরে যায়। শ্বাস আটকে আসার উপক্রম হয়। আওয়াজ শুনে আলো রাস্তার দিকে তাকিয়েছে। পিচঢালা পথে রক্তের দাগ। সামনেই তীব্রগতিতে একটা সিএনজি ছুটছে। তার পেছনপেছন দুজন ছাত্রও ছুট লাগিয়েছে। দুচারজন পথচারী, রিকশাওয়ালা দৌড়ে এগোচ্ছে মাঝরাস্তায়। সেখানে পরে থাকা প্রাণটা কোনোমতে শ্বাস নিচ্ছে যেনো। তার ধবধবে লোমশ শরীরটা রক্তাক্ত। সে দৃশ্য দেখে আলোর চোখ ভরে ওঠে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বের হয়,

– বুজো…

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪৭.

আলোর অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করা ‘বুজো’ শব্দটায় হুঁশে ফেরে তাথৈ। মাঝরাস্তায় পরে থাকা ধবধবে সাদা লোমের ছোট্ট শরীরটা রক্তাক্ত, নির্জীবপ্রায়। একটা ছেলে সে শরীর জরিয়ে ধরে ‘সিএনজি ডাক!’ বলে চেচাচ্ছে। ছেলেটার হাতেও রক্ত লেগে শুকিয়ে উঠছে। তাথৈয়ের শরীর অচল হয়ে পরেছে যেনো। ও দুর থেকেই দেখলো, প্রায় নিস্প্রাণ হয়ে আসা চোখজোড়া ওর দিকেই৷ কোলে তুলে নিতেই গলার ‘বুজো’ লেখা বেল্ট চোখ পরে তাথৈয়ের। তাথৈ সব ভুলে যায়। ‘বুজো!’ বলে পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে। ছুট লাগায় সেদিকে। আলোও কাদতে কাদতে ওর পেছনপেছন ছুটলো। তাথৈ বুজোর কাছে পৌছে ওকে ঝাকিয়ে অনবরত বলতে থাকে,

– এই বুজো? কি হয়েছে তোর? তোর কিছু হবেনা! ইউ’ল বি কমপ্লিটলি ওকে! একদম ভাবিস না হু? তুইতো আমার ভালো বুজো তাইনা? ডুড? এইযে দেখ? আমি আছিতো! দেখ বুজো? বুজো? এইযে আমি!

অতি নিভৃতে হলেও বুজো তখনো শ্বাস নিচ্ছিলো। ওমন পাগলামি দেখে বাকিরা তাথৈকে সরিয়ে দেয়। আলো বারবার করে বলছিলো, বুজো তাথৈয়ের পোষ্য। কেউ কানে তোলেনি। নিজেরাই সিএনজি নিয়ে যায় হাসপাতালে। হাতপা ছেড়ে দিয়ে রাস্তার মাঝে বসে, অবুঝের মতো ওদের চলে যাওয়া দেখলো তাথৈ। ওকে ওমন অসহায়ের মতো করে বসে থাকতে দেখে আলো শব্দ করে কেদে দিলো। কয়েকবার ডাকলো তাথৈকে। কোনো সাড়া নেই। তাথৈ কাদছেও না। আলো নিজেও ওর সামনে বসে গেলো এবারে। তাথৈকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কম্পিতস্বরে বললো,

– ত্ তাথৈ? ব্ বুজোর কাছে যাবে না?

তাথৈ যন্ত্রমানবীর মতো করে মুখ তুলে চায়। আলো কোনোমতে বললো,

– পেট ক্লিনিকে।

তাথৈ যেনো প্রাণ ফিরে পায়। দিশেহারার মতো এদিকওদিক দেখে উঠে দাড়ায়। আলো রিকশা ডেকে ওকে সাথে করে পৌছায় হাসপাতালে। পুরোটা রাস্তা আলো লুকিয়েলুকিয়ে কেদেছে আর প্রার্থনা করেছে, বুজোর যাতে কিছু না হয়। কিন্তু তাথৈ অস্থির। হাসপাতালের গেইটে রিকশা থামলে ও ছুটে নেমে যায়। আলো ভাড়া মিটিয়ে পেছন ফিরতেই দেখে করিডোরে বুজোকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে ওর। ক্যাম্পাসের যে ছেলেদুটো বুজোকে হাসপাতালে এনেছিলো, ওরা একপাশে ব্যর্থ যোদ্ধার মতো দাড়ানো। তাথৈ একপা দুপা করে এগোচ্ছে। হয়তো ওর পা চলছে না। শরীরভরা ক্লান্তি। এগিয়ে গিয়ে বুজোর গায়ের চাদর সরিয়ে ওকে দেখে নিলো তাথৈ। বুজোর চোখ বন্ধ। গলার বুজো লেখা বেল্টের নিচটায় জখম। সারা শরীরে শুকনো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। এতোসব দেখেও তাথৈ কাদলো না। আস্তেকরে বুজোর শরীরে হাত বুলিয়ে ওর নাম ধরে ডাকলো। গলার বেল্ট খুলে, বুজোর কানের কাছে মুখ নিয়ে, ফিসফিসিয়ে বললো,

– আমি তোকে ছেড়ে অনেক ছোটাছুটি করতাম বলে তোর রাগ হতো তাইনা বুজো?
চোখ খোল ডুড। আমি যেখানেই যাই না কেনো, ইউ’ল বি অলওয়েজ দেয়ার। আই প্রমিস। তুই শুধু একটাবার চোখ খোল? একটাবার?

বুজো চোখ খোলে না। তাথৈ বুঝলো, বুজো আর চোখ খুলবে না। আলোর চোখ বেয়ে আবারো জল গরাতে থাকে। ছেলেদুটোর একজন মাথা নিচু করে বললো,

– সরি আপু। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু…

তাথৈ তাদের দিকে তাকালোও না। বুজোকে জরিয়ে ধরে বসে রইলো। এক এপ্রোন-মাস্ক পরিহিত লোক কাগজ হাতে এসে বললেন,

– কাগজগুলোতে সাইন করে দিন। ওয়ার্ডবয় এসে নিয়ে যাবে বডি।

তাথৈ চোখ তুলে তাকালো ডাক্তারের দিকে। তারপর কাগজগুলোতে সাইন করে দিলো। টু শব্দটাও করলো না। আরেকবার বুজোর গায়ে হাত বুলিয়ে চলে আসার জন্য পা বাড়ালো ও। একদিকে তাথৈ আলোকে পাশ কাটিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসলো, আরেকদিকে ওয়ার্ডবয় এসে বুজোর শরীর কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে গেলো। আলো করনীয় ভেবে পায় না। তাথৈকে রাস্তায় আসতে দেখে চোখের পানি মুছে ওউ আসে। পাশে আলোর উপস্থিতি বুঝলো তাথৈ। ওরদিক না তাকিয়ে বললো,

– আমি ঠিক আছি আলো। তুমি একটু আমার থেকে দুরে থাকবে প্লিজ?

– কিন্তু তাথৈ…

– প্লিজ!

আলো আটকায়। তাথৈকে সামলাতে সময় অসময়ে ওর কাছে এসেছে ও। এমনকি অন্তুর সাথে বিচ্ছেদের পরও। কিন্তু কখনো একটাবারের জন্যও তাথৈ ওকে বলেনি, আমার থেকে দুরে থাকো। আজ প্রথমবার তাথৈ এমনটা বলেছে। তাই আলোর সাহস হয়নি পা বাড়ানোর। কিন্তু ভয় হলো। প্রথমবার আলোর ভয় হলো এটা ভেবে, তাথৈয়ের সাথে ওর দুরুত্ব তৈরী হয়ে গেছে। তবে কি তাথৈ ধরে নিয়েছে বুজোর মৃত্যুর জন্য ও দায়ী? তখন ওরসাথে কথা বলতে গিয়েই তো তাথৈ বুজোর খেয়াল রাখতে পারেনি। আর এজন্যই এমন অঘটন…মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে কেদে উঠলো আলো। টের পেলো, তাথৈয়ের এই অবস্থা ওকে আত্মগ্লানিতে মেরে ফেলতে চলেছে। তাথৈয়ের এমন এলোমেলো পায়ে চলে যাওয়া ওর চারপাশে ঘূর্ণিঝড় তুলে দিয়ে যাচ্ছে। আর আত্মগ্লানির সে ঘূর্ণি সহ্য করার চেয়ে, মরে যাওয়া ভালো।

ছুটতে ছুটতে অম্বুনীড়ে ঢুকলো রুমন-শার্লি। তৈয়ব আলফেজ স্যুটবুট পরে ব্যাগ হাতে করে অফিসের জন্য বেরোচ্ছিলেন। বেরোনোর সময় শার্লির সাথে ধাক্কা লাগে তার। প্রচন্ড বিরক্তবোধ করলেন যেনো তিনি। শার্লি নিজেকে সামলে সরি বলতে যাবে, তার আগেই তিনি স্যুট ঝাড়তে ঝাড়তে ঝাঝালো আওয়াজে বলে উঠলেন,

– এখনো বাচ্চাদের মতো ছোটাছুটি করো? বড়ো হওনি?

শার্লি চমকে ওঠে। আজ ক্লাসে ঢুকতেই আলো ওর কাছে তাথৈয়ের অবস্থা জানতে চেয়েছিলো। আগেরদিন ক্লাস শেষে তাথৈ-রুমনের সাথে আড্ডা দিয়েই তো ও হলে গেলো। একদিনের ব্যবধানে তাথৈয়ের কি হয়েছে এ নিয়ে কিছুটা অবাক হলো শার্লি। কিন্তু যখন আলো আগেরদিন ক্লাস শেষের ঘটনা বললো, শার্লি আর একমুহূর্ত দাড়ায় নি সেখানে। রুমনকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ অম্বুনীড়ে চলে এসেছে। তৈয়ব আলফেজের ধমকে গলার স্বর কমে যায় শার্লির। কোনোমতে বললো,

– স্ সরি আঙ্কেল। আসলে তাড়াহুড়োয়…আঙ্কেল তাথৈ কেমন আছে? কোথায় ও?

– নিজের ঘরেই আছে। ঘুমোচ্ছে হয়তো। গতরাতে অনেক দেরিতে ফিরেছে। জানিনা কাদের সঙ্গে দিনকেদিন আরো স্বভাব বিগড়াচ্ছে ওর।

বলা শেষ করেই চলে গেলেন তৈয়ব আলফেজ। শেষ বাক্যটা যে তিনি শার্লি-রুমনকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন, তা বুঝতে বাকি থাকে না ওদের। কিন্তু সেটা কানে নেয়না ওরা। মেয়ের প্রতি বাবার উদাসীনতা দেখে বরং আরেকদফা অবাক হয়। আবারো ছুট লাগায় দুজনে। সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে আসে। কিন্তু তাথৈয়ের রুমের দরজায় দাড়াতেই পা থেমে যায় রুমন-শার্লির।
বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে, মেঝেতে বাবু হয়ে বসে আছে তাথৈ। ওর দৃষ্টি মেঝেতেই স্থির। বারান্দা দিয়ে আসা মৃদ্য বাতাসে বিছানায় থাকা কাগজদুটো নড়াচড়া করছে। তাথৈয়ের এলোমেলো চুলগুলো পেছনে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। কিন্তু তার বেশিরভাগই সামনে। তারা বিচ্ছিন্নভাবে উড়ছে, ওর মুখ, গলায় আটকে আছে। তাথৈয়ের চোখমুখ শুকনা। দৃষ্টি নির্জীব। রুমন শার্লির চোখ জলে ভরে ওঠে। ওরা ভেতরে ঢুকতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনই হুট করে আসা দমকা বাতাসে বিছানার কাগজ উড়ে গিয়ে পায়ের নিচে পরে শার্লির। রুমনের দিক চেয়ে কাগজটা হাতে নেয় শার্লি। ওটা দেখে টুপটাপ চোখ বেয়ে জল গরাতে থাকে ওর। রুমনও পাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো কাগজটা। একই অবস্থা ওরও। শার্লি কোনোমতে ডাক লাগালো,

– তাথৈ?

তাথৈ আস্তেধীরে ঘাড় ঘুরায়। শার্লির হাতে থাকা কাগজ দেখে বুকফেটে আর্তনাদ আসতে চায় ওর। অশ্রুতে চোখ ভরে উঠলেও তাথৈয়ের চোখ দিয়ে পানি বেরোয় না একফোঁটা। একদৃষ্টিতে ও তাকিয়ে রইলো কাগজগুলোর দিকে। একটু সময় নিয়ে চোখ সরালো। বললো,

– যা এখান থেকে।

– তাথৈ…

– যা!

উচু আওয়াজে বললো তাথৈ। রুমন-শার্লি এবারেও চমকে ওঠে। রুমন একপা পিছিয়েও যায়। শার্লি চোখ মুছলো। কাগজটা বিছানায় রাখলো। যাতে উড়ে না যায় সেজন্য সেটার ওপর বুজোর গলার বেল্টটা রাখতে যাচ্ছিলো ও। তখনই তাথৈয়ের সাথে বুজোর খুনশুটিগুলোর কথা মনে পরে যায় শার্লির। ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকালো ও। রুমের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে গেলো রুমনের সাথে। তাথৈ ওর কাছ থেকে সরতে বলেছে। অম্বুনীড় থেকে না। তাই যতোক্ষণ না তাথৈ স্বাভাবিক হচ্ছে, ওরা এ বাসা থেকে একচুলও নড়বে না। বাইরে দাঁড়িয়ে তুল্যকে ম্যাসেজ করলো শার্লি,
‘কোথায় তুই?’

তুল্য ক্লাসে ছিলো। শার্লির ম্যাসেজ দেখে ভ্রু কুচকায় ও। বেরোনোর সময় অম্বুনীড়ে তাথৈয়ের গাড়ি না দেখে ও ধারনা করে নিয়েছিলো তাথৈ ভার্সিটিতে চলে এসেছে। এসে তাথৈয়ের গাড়ি পার্ক করা জায়গাটাতেই দেখেছে। ওকে ক্লাসে না দেখে অবাক হলেও অতো ভাবেনি ও। ম্যাসেজের উত্তরে লিখলো,
‘আমি তোর মতো গরু না যে ক্লাস বাদ দিয়ে ক্যাম্পাস চরে বেড়াবো। ক্লাসে আছি।’

অন্যসময় হলে শার্লির অপমানবোধ হয়ে শুধু রাগ হতো। কিন্তু আজ এমন জবাবে তুল্যর ওপর ক্ষোভ অনুভব করলো ও। নিজের বোনের এই অবস্থায় কোন ভাই এভাবে কথা বলে? তীব্র শার্লি আক্রোশে জবাব লিখলো,
‘আমার মতো গরু হতেও হবে না তোকে! বোনের খোঁজ নিয়ে একটু ভাই হয়ে দেখা!’

রাগে ফোন বন্ধ করে ফেললো শার্লি। বুকে হাত গুজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো করিডোরে। বেশ কিছুটাসময় পর রুমন চিন্তিত স্বরে বললো,

– তোর মনে হয়না শার্লি? অনেক হয়েছে? তাথৈ অনেক সয়েছে? এখন এটলিস্ট তাশদীদ ভাইকে সবটা জানানো উচিত?

শার্লি চোখ তুলে তাকালো রুমনের দিকে। দুজনের দৃষ্টিই যেনো একমত। সেসময়ই রুমের ভেতরে ফোন বাজে। রুমন শার্লি খোলা দরজা দিয়ে দেখলো তাথৈ ফোনের দিকে তাকিয়েছে।
একদৃষ্টিতে নম্বরটা দেখে চলেছে ও। দুবার রিং হয়ে কেটে যায় কল। তৃতীয়বারে কল রিসিভ করলো তাথৈ। ওপাশ থেকে অস্থিরতাপুর্ণ আওয়াজ এলো,

– ভাবী? কোথায় ছিলে তুমি? কল কেনো রিসিভ করছো না?

– আমি তোমার ভাবী নই তামজীদ। সংযত হয়ে কথা বলো।

তাথৈয়ের জবাব শুনে রীতিমতো বাজ পরে রুমন-শার্লির মাথায়। তাথৈ স্থির। ওপাশ থেকে তামজীদ আরো জোর দিয়ে বললো,

– কি বলছো তুমি এসব? পাগলটাগল হয়ে গেছো নাকি? শোনো ভাবী…

– আমি বলেছি আমি তোমার ভাবী নই।

– মানে কি ভাবী? তুমি…

– বিহেভ ইওরসেল্ফ তামজীদ!

তাথৈয়ের ধমকে তামজীদ আটকে যায়। তাথৈ চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলালো। বললো,

– এ মুহুর্ত থেকে তুমি আমাকে চেনো না তামজীদ। এতোদিন যা ছিলো ছিলো। কিন্তু এরপর থেকে তুমি আর আমাকে কল করবে না। ভালো থাকো। রাখছি।

কল কেটে নম্বর ব্লক করে দিলো তাথৈ। বড় একটা দম নিয়ে বসে রইলো ওভাবেই। রুমের বাইরে থমকে দাড়িয়ে রইলো রুমন শার্লি। কি থেকে কি হচ্ছে, কিছুই বুঝে আসছে না ওদের। কিছু বলে, বুঝে ওঠার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় তাথৈয়ের মা। চিকন হাতার ব্লাউজ আর পাতলা শাড়ি পরিহিত মহিলা গটগট করে তাথৈয়ের রুমে ঢুকে যাচ্ছিলেন। শার্লি তার পথ আটকে দিয়ে বললো,

– আন্টি…তাথৈ এখন অনেকবেশি…

– আমার মেয়ের সাথে আমি কথা বলে নেবো। তোমার মাঝখানে নাক গলাতে হবেনা। স্টেপ আসাইড!

মহিলার কাটকাট কথা শুনে আরকিছু বলার পেলো না শার্লি। সরে দাড়ালো ও। মহিলা দ্রুতপদে ভেতরে ঢুকলো। মেঝেতে বসে থাকা তাথৈয়ের সামনে দাড়িয়ে উচুকন্ঠে বললো,

– টেরেন্সকে কি বলেছো তুমি তাথৈ?

তাথৈ চোখ তুলে চাইলোও না। বাইরে দাড়ানো শার্লি কপাল চেপে ধরলো নিজের। রুমনেরও রাগ হচ্ছে। কিন্তু ওরাও নিরুপায়। মহিলা আবারো বললো,

– আন্সার মি তাথৈ! টেরেন্সের সাথে মিসবিহেভ কেনো করেছো তুমি? আর কি কি বলেছো ওকে? ওর হাতও নাকি গাড়িচাপা দিয়েছো?

তাথৈ এবারো নিরুত্তর। ওর নিরবতায় মহিলা আরোবেশি ক্ষিপ্ত হলেন যেনো। এদিকওদিক তাকাতেই বিছানার ওপর থাকা বুজোরবেল্ট আর হাসপাতালের কাগজ চোখে পরে তার। সেটা হাতে নিয়ে পড়ে বুঝতে পারেন, বুজো আর নেই। প্রতিক্রিয়া আরো কঠোর হয় তার। কাগজদুটো তিনি তাথৈয়ের মুখের ওপর ছুড়ে মেরে বললেন,

– ব্যস? বুজোকেও মেরে দিয়েছো তুমি? এবার শান্তি?

এতোক্ষণে চোখ তুলে তাকালো তাথৈ। বাইরে দাড়ানো রুমন-শার্লিও বিস্ফোরিত চোখে চায় মহিলার দিকে। ওদের জলভরা চোখে বিস্ময়। এটা কি মা? নাকি অন্যকিছু? মহিলা কোনোকিছুর বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে বললেন,

– গেলো তো ওউ? হাহ! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো, তোমার সাথে এটাই হবে!

তাথৈ আস্তেধীরে উঠে মায়ের মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো৷ ঘাড় কাৎ করে চেয়ে রইলো। মহিলা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে চলেছেন,

– প্রথমে…প্রথমে তোমার ওই এক্স, এরপর টেরেন্স, নাও…নাও বুজো। আমিই এক নির্লজ্জের মতো ফিরে আসতে চেয়েছিলাম তোমার কাছে। ফর ইওর বেটারমেন্ট। বাট নাও আই রিয়েলাইজ, তুমি আসলে কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই না! ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ। তুমিতো…

আরকিছু বলার আগেই মহিলার হাত ধরে ফেলে কেউ। মহিলা কিছুটা চমকে পাশে তাকালেন। তারপাশে রাগে লাল হয়ে তুল্য দাড়ানো। মায়ের হাত ধরে রেখে তুল্য শক্ত গলায় বললো,

– আপনি কি নিজে বেরিয়ে যাবেন? নাকি আমি আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো?

– ভাই বোন দুটোই বেয়াদব হয়েছো। ঠিক বাবার মতো! গো টু হেল!

চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ঝারা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো মহিলা। একপলক তাথৈকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। তুল্য শার্লির দিকে এগিয়ে, হিংস্র পশুর মতো গর্জে উঠে বললো,

– তোরা থাকতেও ওই মহিলা তাথৈয়ের কাছে গেলো কিকরে?

তুল্যর ধমক শুনে শার্লির চোখ বেয়ে জল গরায়। অথচ তুল্যর রাগ কমে না। ও তেমনি ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। রুমন এগিয়ে এসে বললো,

– কারন উনিও আমাদের ঠিক এমনই ব্যবহার দেখিয়েছেন। আমরা বাইরের লোক বলে।

তুল্যর রাগ কমার পরিবর্তে বাড়ে। ও আরো জোরে চেচিয়ে বললো,

– তো বাইরের লোক বাসার ভেতরে কি করছিস? যা বের হ বাসা থেকে! লাগবে না তোদের! বেরো!

আরো দুফোঁটা চোখের জল পরতেই দৌড়ে চলে গেলো শার্লি। রুমন ওকে যেতে দেখে একটা ছোট শ্বাস ফেললো। ভেতরে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা তাথৈকে দেখে নিয়ে নিমীলিত কন্ঠে বললো,

– আমাদের না লাগলেই ভালো। তাথৈকে দেখো।

রুমনও চলে যায়। ও চোখের আড়াল হলে তুল্যর হুঁশ ফেরে। ও অনুভব করে, বেশিই বলে ফেলেছে ও। আসার সময় আলো ওকে বলেছে বুজোর কথা। বলার সময় কান্নাও করেছে মেয়েটা। তুল্যর নিজেরই বুজোর জন্য খারাপ লাগছিলো। কিন্তু ও এও বুঝেছিলো, তাথৈ ভালো নেই। অম্বুনীড় এসে মাকে দেখে আরো মেজাজ বিগড়ে যায় ওর। আর সে রাগটাই এখন দেখিয়ে ফেলেছে ও। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেললো তুল্য। আপাতত ওর তাথৈকে সামলানো দরকার। কিন্তু অন্তুর বিয়ের সময়ও ওর যে বোনকে সামলাতে হয়নি, সে বোনকে এখন পোষ্য হারানোর জন্য কি বলে সামাল দেবে, ওর বুঝে আসেনা। তবুও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঘরে ঢোকে তুল্য।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪৮.

রাত সাড়ে বারোটা। একহাতে সিগারেট, আরেকহাতে ম’দের গ্লাস নিয়ে ফ্লোরে বসে আছে তুল্য। ঘন্টাখানেকের মাঝে কমপক্ষে গোটাবিশেক সিগারেট শেষ করেছে ও। একের পর এক গ্লাসও শেষ করে চলেছে। চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। চোখের কোনে রক্তজমা অবস্থা। তুুল্য কাচের গ্লাসের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে শার্লির চেহারা। ওদের ঝগড়াগুলো, শার্লির শাড়ি পরা, ওর কপালে টিপ পরানো, দু একসময় ওর লাজুক হাসি, আড় চাওনি, শান্তকে নিয়ে হিংসায় কয়লার মতো পুড়তে থাকা, পাগলামোর সবটা মনে পরতে থাকে তুল্যর। কানে বাজতে থাকে হেলায় শার্লিকে আঘাত করে বলা প্রতিটা কথা। তুল্যর সহ্যশক্তি লোপ পায়। হাতের গ্লাসটা ছুড়ে মারে ও। চোখ বন্ধ করে মাথার চুল উল্টে ধরে দিশেহারার মতো। ফের তাকায় ভাঙা কাচের টুকরোগুলোর দিকে। সেদিকে চোখ যেতেই তাথৈয়ের কথা মনে পরে যায় ওর। বুকজুড়ে শুরু হয় আরেক যন্ত্রণা। তাথৈ ভেঙে গেছে। ওমন কাচের মতোই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে ওর বোন!

শার্লি রুমন চলে যাওয়ার পরপরই তাথৈয়ের ঘরে ঢোকে তুল্য। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বোনের সামনে যেতেই ইতস্তত শুরু হয় ওর। তুল্য এদিকওদিক তাকিয়ে, অস্বস্তি নিয়ে বললো,

– আ্ আরেকটা পেট নিয়ে আসবি তাথৈ?

– কি লাভ? ওউ তো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

তাথৈ মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জবাব দিলো। তুল্য আর কি বলবে ভেবে পায় না। কি করবে তাও বুঝে উঠতে পারে না। তবুও সাহস জুগিয়ে, একটা শুকনো ঢোক গিলে, কাপাকাপা হাতটা তাথৈয়ের মাথায় রাখলো ও। তাথৈ ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে চায়। ওর জলভরা চোখ দেখে তুল্যর ভেতরটাও যেনো চুরমার হয়ে আসতে থাকে। তাথৈ অশ্রুসজল নয়নে, নিস্পলকভাবে চেয়ে থেকে বললো,

– সমবেদনা জানাতে এসেছিস?

তুল্য এবারো জবাব খুঁজে পায় না। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, তাথৈকে বুকে জড়াতে জড়াতে বললো,

– আ্ আমি তোর ভাই তাথৈ। সমবেদনা কেনো জানাবো? আমি তো তোকে ভালো…

– বাসিসনা ভালো! কারো ভালোবাসা চাইনা আমার! কারো ভালোবাসা চাইনা!

এক ঝটকায় তুল্যর বাহুদ্বয়ের মাঝ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় তাথৈ। তুল্য কিছুটা আতংকিত হয় ওর ব্যবহারে। তাথৈ চিৎকার করে বলতে থাকে,

– তোরা খবরদার কেউ আমাকে ভালোবাসবি না! আমিও কাউকে ভালোবাসি না! শুনলি না? শুনলি না ওই মহিলা কি বলে গেলো? আমি কারো ভালোবাসা ডিজার্ভ করি না! আমি কারো ভালোবাসার যোগ্য নই! আমার সাথে কারো ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে না। আমি যাকেই ভালোবাসবো, সেই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে! সব চলে যাবে আমাকে ছেড়ে! সব!

– কি বলছিস কি তুই এসব?

– ঠিকি বলছি! ওই মহিলাও ঠিকি বলেছে! আমি ভালোবাসলেই সবাই হারিয়ে যায়। ত্ তুই দুরে থাক! কাছে আসবি না! একদম কাছে আসবি না! আমি তোকে ভালোবাসি না! আমি ড্যাডকেও ভালোবাসিনা! একদমই ভালোবাসিনা!

তাথৈ উন্মাদের মতো করতে থাকে। অস্থির হয়ে পরে। বোনের অবস্থা দেখে তুল্যর চোখ ফেটে জল গরায়। জোরপূর্বক তাথৈকে বুকে আঁকড়ে ধরে ও। ওকে শান্ত হতে বলে।
ভাইয়ের উষ্ণ আলিঙ্গন যেনো তাথৈয়ের ভেতরের সবটুকোকে আগ্নেয়গিরির মতো স্ফুরন ঘটায়। শিশুর মতো হাউমাউ করল কান্না শুরু করে দেয় ও। তুল্যর বুকে কিল-ঘুষি ছুড়তে থাকে। গলা ফাটিয়ে কাদতে কাদতে বলতে থাকে,

– আমার কি দোষ ছিলো তুল্য? কি দোষ করেছিলাম আমি? আরপাঁচটা মেয়ের মতো আমি তো শুধু আমার জন্মদাত্রীকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম, পাশে চেয়েছিলাম। অথচ সে জন্মের পরপরই আমাকে ছেড়ে চলে গেলো! মাকে হারানোর পর আমি ড্যাডকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। ওই মহিলার গর্ভজাত ছিলাম বলে সেও আমাকে দুরে ঠেলে দিলো! ড্যাডের অবহেলা সহ্য করে আমি তোকে আশ্রয় করেছিলাম তুল্য! আর তুইও…তুইও আমাকে ছেড়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলি। এরপর নিজের মতো করে বাচতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু সেখানেও ভালোবাসা নামক হাতিয়ার নিয়ে অন্তু হানা দেয়। আমার অগোছালো জীবনটাকে ক্রমশ গুছিয়ে দিতে থাকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, যাই কিছু হোক না কেনো, ও কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। সেও অন্তুও একসময় হার মেনে নেয় তুল্য! সেই অন্তুও হারিয়ে গেলো! আমার স্বীকার করা ভালোবাসা ছেড়ে ও আরেকজনকে বিয়ে করে নিলো। মানুষ হারাতে হারাতে একসময় বুজোকে আমি আপন করে নিলাম। ওকেও শেষপর্যন্ত মরতে হয়েছে। ভালোবাসার সব পর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে, নিজের অবাধ্য স্বভাবকে প্রশ্রয় দেওয়ার সময়গুলোতে যখন আমি তাশদীদকে ভালোবাসলাম, ওর জন্য সব করতে শিখলাম, সেই তাশদীদও কাল অন্যকাউকে আপন করে নিচ্ছে তুল্য! কাল তাশদীদ অন্যকারো হয়ে যাচ্ছে! আলোর সাথে কাল ওর বিয়ে!

তাথৈ কাদতে কাদতে মেঝেতে লুটিয়ে পরে। ওকে সামাল দিতে তুল্যও বসে যায়। তাথৈয়ের বলা পুরো কথাটা শুনে তুল্য যতো না কষ্ট পেয়েছে, শেষ দুইলাইন শুনে সে সব কষ্ট রাগ আর বিস্ময়ে পরিনত হয় ওর। তাথৈয়ের সবটুকো যন্ত্রণা এতোক্ষণে বুঝতে পারে ও।
তাথৈ ভাইয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রয় অনেকটাসময়। শরীর নেতিয়ে আসে ওর। দুগাল ধরে ওর মুখ উচু করে ধরে তুল্য। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– তুই কার কাছে কি শুনেছিস আমি জানিনা তাথৈ। কিন্তু কাল আলোর সাথে তাশদীদ ওয়াসীরের বিয়েটা হবে না।

তাথৈয়ের হুঁশ হয়, ও কোথায় কি বলে ফেলেছে। বলা যে উচিত ছিলো না, সেটাও বুঝতে পারে। তাথৈ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো না। তুল্য ওকে তুলে দাড় করানোর চেষ্টা করলো। তাথৈ ভাইয়ের টিশার্টের কলার মুঠো করে নিয়ে বললো,

– বিয়েটা হবে তুল্য। তুই কিছু শুনিস নি।

তুল্য পাত্তা দেয় না। আবারো তাথৈকে দাড় করানোর চেষ্টা করে ও। তাথৈ ওর কলার আরো শক্তমুঠো করে বললো,

– এই পৃথিবীতে যেমন তাশদীদ ওয়াসীর আর দ্বিতীয়টি নেই, তেমনি আলোর মতো পারফেক্ট মেয়েটাও আর দ্বিতীয়টি নেই। দে ডিজার্ভ ওয়ান আনাদার। ওদের বিয়েটা হবে!

তুল্য বোনকে বিছানায় আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। তারপর ওষুধের বক্স থেকে একটা ওষুধ আর পানি এগিয়ে দিলো। তাথৈ ওষুধ আর পানি হাতে নিয়ে বললো,

– অন্তুকে হারানোর পর সুইসাইড এটেম্প্ট করেছিলাম। তাশদীদকে না পেয়ে আমি এমন কিছু করবো না তুল্য। নিশ্চিত থাক। কিন্তু যদি কেউ আলো, তাশদীদ বা ওদের পরিবারের কারো কাছে আমার বিষয়ে কিছু বলে, আই সোয়ার আ’ইল কিল মাইসেল্ফ। আই সোয়ার!

তাথৈয়ের কথায় তুল্যর অষ্টদিক বন্ধ হয়ে যায় যেনো। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ও। ওষুধ খেয়ে শান্ত শিশুর মতো শুয়ে পরলো তাথৈ। চুপচাপ দাড়িয়ে ওকে গভীর ঘুমে তলাতে দেখলো তুল্য। তারপর বেরিয়ে আসলো ও ঘর থেকে। নিজের ঘরে বসে ড্রিংক করতে লাগলো ইচ্ছামতো। তাথৈ যে ওকে ঠিক কতোটা অসহায় করে দিয়েছে, তা ও ছাড়া কেউ জানে না।
অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছিলেন তৈয়ব আলফেজ। কি ভেবে আশপাশ দেখলেন উনি। করিডোরে কাউকে না দেখে তাথৈয়ের ঘরের দিকে এগোলেন তিনি। দরজা খানিকটা খুলতেই দেখেন তাথৈ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমে আছে ভেবে উনি পা বাড়ালেন নিজের ঘরে। কিন্তু তুল্যর ঘর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তীব্র গন্ধে দরজায় দাড়িয়ে গেলেন তৈয়ব আলফেজ। জানালার পর্দার সরু ফাক দিয়ে ঘরে তাকাতেই দেখলেন পুরো ঘর ধোয়ায় ভরে আছে। ঘরের এককোনে বসা তুল্য। ওর সামনে তিনচারটে খালি বোতল, আরো কিছু ভরা। তৈয়ব আলফেজ উচু গলায় বললেন,

– বাসায় বসেবসে এইসব করার জন্য হাতখরচা দেই তোমাকে?

তুল্য চোখ তুলে তাকালো। বাবার কথার কেবল ‘বাসায় বসেবসে’ শব্দদুটো মাথায় ঢুকলে ওর। সাতপাচ না ভেবে দুটো বোতল, গাড়ির চাবি আর ফোন হাতে নিয়ে, বেরিয়ে পরলো বাসা থেকে।

আলো বিছানায় হাটু জড়িয়ে বসে। নিরবে কাদছে ও। সেই সন্ধ্যে থেকে ঘুমোনোর চেষ্টা করছে। রাত বেড়ে মধ্যরাত হলেও একফোঁটা ঘুম নামেনি ওর চোখে। লোডশেডিংয়ের জন্য ঘরের ড্রিমলাইটটাও বন্ধ। থাকার মধ্যে আছে টিনের বেড়ার ওপরের ফাঁকা দিয়ে আসা জোছনার আলো। এরইমাঝে দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজ কানে আসে আলোর। চমকে ওঠে ও। পড়ার টেবিলের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সেখানে প্রায় দুইটা বাজছে। আবারো দরজায় আওয়াজ হয়। দ্রুততার সাথে চোখ মুছলো আলো। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বললো,

– ক্ কে?

জবাবের বদলে কাঠের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে বাইরের মানুষটা। আলো ওড়না ঠিকঠাক মাথায় তুলে দিয়ে ঘর থেকে বেরোলো। দরজার কাছে এসে আবারো শুধালো,

– কে?

– তুল্য আলফেজ।

চেনা পুরুষালি আওয়াজে আলো যতো না অবাক হয় তারচেয়ে বেশি অবাক হয় তুল্যর মুখে ওর নাম শুনে। হতবিহব্বল হয়ে তৎক্ষনাৎ ছিটকিনি খুলে দরজার একপাল্লা খুললো ও। বাইরে দৃষ্টি রাখতেই দেখে তুল্য দরজার পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। টিনের চাল আর চাঁদের আলোর ঢেউতোলা ছায়া ওর কপালে পরেছে। রাতের গহীনতা মনে পরতেই আলো দরজার পাল্লা বেশকিছুটা ভিড়িয়ে দাড়ালো। বিস্ময়ে তবে নোয়ানো স্বরে বললো,

– তুল্য? তুমি? এ্ এখন? এখানে?

তুল্য দেখলো, দরজার পাল্লাদুটোর ফাঁক দিয়ে আলোর অর্ধেক চেহারাটাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওর চোখদুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দরজায় হাত রাখলো তুল্য। তবে জোর খাটালো না। আলো যেনো সেটুকোতেও ভরসা পেলো না। গায়ের জোর খাটিয়ে দরজার পাল্লা আরেকটু ভিড়িয়ে দিলো ও। তুল্য তাচ্ছিল্য করে বললো,

– কেউ বাড়ি বয়ে আসলে এভাবে আপ্যায়ন করো তাকে?

– তাথৈ কেমন আছে?

– আমার প্রশ্নের জবাব দাও! আমি আগে প্রশ্ন করেছি!

– আপ্যায়ন কে আসছে আর কখন আসছে তার ওপর নির্ভর করে।

তুল্যর জোরালো প্রশ্নে সহজাত জবাব দিলো আলো। পরপরই মাথা নিচু করে নিলো। এভাবে চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা ওর স্বভাব বহির্ভূত। নিজের ভুল স্বীকার করে কিঞ্চিৎ অনুতপ্তও হলো হয়তো। মিনমিনে স্বরে বললো,

– তুমি এখানে কেনো এসেছো জানিনা। বাড়িতে কেউ নেই তুল্য। এতোরাতে তুমি আমার ঘরের দুয়ারে, এটা কেউ দেখে ফেললে বদনাম রটাবে। তুমি চলে যাও প্লিজ। যা বলার…

কথা শেষ করার আগেই তুল্য দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ওর ধাক্কায় দরজা ছেড়ে দুপা পিছিয়ে গেলো আলো। ওড়না পরে গেছে ওর মাথা থেকে। তুল্য ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভেতরটা দেখলো। হাতের ডানে ছোট্ট বসার ঘর। একপাশে লম্বালম্বিভাবে ছোট চৌকি রাখা। চৌকি সামনের মেঝেতে একটা গোল মাদুর আর বরাবর জানালা। চাঁদের আলো ঘরে আসছে সেখান দিয়ে। চৌকির দু প্রান্তে মুখোমুখি দুটো কাঠের চেয়ার, সামনে একটা কাঠের টুল, তিনচারটে পিড়ি একটার ওপর আরেকটা উচু করে রাখা। হাতের বামে রান্নাঘর। বরাবর তাকলে কবুতরের খোপের মতো দুটো রুম। শোবার ঘর। আলো ওড়না আবারো মাথায় তুলে দিলো। ছুটে দরজার কাছে এসে বাইরে উঁকি দিলো একবার। আবারো ছুটে তুল্যর কাছে গেলো। কিছু বলতে যাবে, তুল্য বলে উঠলো,

– শুনলাম তোমার কাল বিয়ে?

আলো অবাক হয়। তাথৈকে বলা কথাটা তুল্যর জানার কথা না। ও এতোক্ষণে লক্ষ্য করলো, তুল্যর গা থেকে ম’দের বিদঘুটে গন্ধ আসছে। ওড়নায় নাক চেপে ধরলো আলো। বললো,

– তুমি ড্রাংক তুল্য। প্লিজ চলে যাও এখান থেকে। নয়তো…

এবারো আলোকে কথা শেষ করতে দেয়না তুল্য। ছুটে এসে ওড়না সরি রুমাল চেপে ধরে আলোর নাকে। আলো বড়বড় চোখে চায়, ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয়না। পুরুষালি হাতজোড়ার বাধনের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। ক্রমশ আবছা হয়ে আসতে থাকে ওর চারপাশ। তুল্যর চোখও অশ্রুতে ভরা। আলোর একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে ও ফিসফিসিয়ে বললো,

– আ’ম সরি…

ভোরের আলো ফোঁটার আগেই সোরগোল কানে বাজে আলোর। টিনের বেড়ায় চড় থাপ্পড়ের আওয়াজে ঘুম কেটে যায় ওর। আলো নিজের অবস্থান পরখ করতে করতে আস্তেধীরে উঠে বসে। বুঝতে পারে ও বসার ঘরে কাঠের চেয়ারে বসে। পিঠের নিচে বালিশ দেওয়া৷ আশপাশে চোখ বুলাতেই আলোর আগে চোখে পরে চৌকিতে খালি গায়ে বসে থাকা তুল্যকে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট আর কেবল প্যান্ট পরিহিত সে মানব যেনো ওর নিদ্রাভঙ্গের অপেক্ষাই করছিলো। আলো চমকে ওঠে। তাড়াহুড়ায় চেয়ারের হাতলে ঝুলানো ওড়না ছাড়াতে গিয়ে চেয়ারসমেত মেঝেতে পরে যায় ও। বাইরে থেকে কোনো এক বৃদ্ধ কন্ঠ হাঁক ছাড়ে,

– কিরে আলো? দরজা না খুইলা ভেতরে নাগর নিয়া কি ভাঙচুর করতাসোস? তুই কি দরজা খুলবি? নাকি আমরাই দরজা ভাঙ্গুম?

আলো চাদরের মতো করে ওড়না জড়ায় গায়ে। অসহায়ের মতো তুল্যর দিকে তাকায়। ওর চোখ পানিতে টলমল করছে। সে চোখের তারায় অবিশ্বাস আর বিস্ময়। কি ঘটেছে ওর সাথে? কেনো এমনটা করলো তুল্য? তুল্য সিগারেটে একটানা কয়েকটান দিয়ে শেষ করলো ওটা। দাঁড়িয়ে গিয়ে, অবশিষ্টাংশ মেঝেতে ফেলে পায়ে পিষলো। আলোর মনে হলো, যেনো ওর সম্মানটাই পায়ে পিষলো তুল্য। ইচ্ছাকৃতভাবে। চোখ বেয়ে টপাটপ জল গরায় আলোর। অস্ফুটস্বরে গলা দিয়ে বের হয়,

– কেনো করছো এসব?

তুল্য ওরদিক ফিরেও তাকালো না। সোজা এগোলো দরজার দিকে। আলো কিচ্ছু ভাবতে পারে না সেসময়। ছুটে এসে দুহাত ছড়িয়ে, তুল্যর পথ আগলে দাড়ালো ও। কাদতে কাদতে, হাত জোর করে বললো,

– প্লিজ তুল্য! এটা করো না প্লিজ! প্লিজ! কেনো এমন কুৎসা রটাচ্ছো? তুমি কি চাও বলো? তুমি যা চাও আমি তাই করবো! প্লিজ এটা করো না! প্লিজ!

– আমি এটাই চাই আলো।

আলো নিথর হয়ে যায়। তুল্য নির্বিকার চিত্তে ওকে পাশ কাটায়। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলতে থাকে,

– এজন্যই রাত দুটোয় আসার সময় জনেজনে তোমার বাড়ির লোকেশন জিজ্ঞেস করে এসেছি।

চোখ বেয়ে আবারো জল গরায় আলোর। প্রথমবার নিজের ভালোলাগাদের প্রতি ঘৃণা হয় ওর। তুল্যর মাঝে কোনোকালেই ভালো বলতে কিছুই ছিলোনা। নিজের পরিবারের সব দায়িত্ব শুষে পালন করতে থাকা ও কখন এই দায়িত্বজ্ঞানহীন, ছন্নছাড়া ছেলেটাকেই ভালোবেসেছে, তা আলো নিজেও জানেনা। সিগারেট, মদ, টাকা ওড়ানো, অসতর্ক, সম্পর্কে যত্নহীন, উগ্র স্বভাব, রাগী মেজাজ সবকিছু অতিরিক্ত নিয়ে তৈরী মানুষটাকে ভালোবেসে আলোর কখনো মনে হয়নি, ও ভুল মানুষের জন্য অনুভূতি জমাচ্ছে। কিন্তু আজ যখন সেই মানুষটাই ওর সম্মানের অন্তরায়, ঘৃণায় শরীর বিষিয়ে উঠছে আলোর। কেনো প্রশ্নটাও ওর মস্তিষ্ক ছাপিয়ে বেরিয়ে গেছে। তুল্য কোনোদিক না তাকিয়ে দরজা খুলে দিলো। হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকে দুজন বৃদ্ধ, এক মধ্যবয়স্ক। তুল্য দেখলো বাইরে আরো জনা দশেক মানুষ। খালি গায়ে দাড়ানো তুল্যকে দেখে হৈচৈ গুনগুনানিতে পরিনত হয়। বৃদ্ধ দুজনের একজন নাক ছিটকে আলোকে বললো,

– কিরে আলো? এই আছিলো তর বাপের শিক্ষা? এই তুই ভালো ভাসসিটিতে পড়োস? মায়ে বোইনে একটা রাইত বাড়িতে নাই, তুই মাইঝ রাইতে ঘরে নাগর লইয়া আইছোস হু?

চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় আলো। ও জানে, এখানে ও যাই বলুক না কেনো, কেউ কিছুই মানবে না। আশপাশ থেকে আরো জঘণ্য কথা কানে আসতে থাকে ওর। তুল্যর ভাবান্তর নেই। ও যেনো শুনছেই না কে কি বলছে। গা ছাড়া ভাবে এসে চৌকি থেকে গেন্জি নিয়ে গায়ে পরলো ও। কিছুসময়ের মধ্যে এক মধ্যবয়স্কা মহিলা ঘরে ঢোকে। আশপাশ দেখে অবাক চোখে। আলো ঘরের মাঝখানটায় দাড়িয়ে কাদছে। মহিলা আস্তেকরে ডাক লাগালেন ওর নাম ধরে। তার গলা শুনে আলো চোখ তুলে চাইলো। ছুটে এসে মায়ের বুকে মুখ গুজলো ও। আরো শব্দ করে কাদতে কাদতে বললো,

– বিশ্বাস করো মা, আমি কিছু করিনি! ওরা ভুল বুঝছে আমাকে! আমি কিছুই করিনি!

আলো ফুপাতে থাকে। মহিলা মেয়েকে দুহাতে আগলে নিলেন। আলোর ছোট বোনেরাও ছিলো সেখানে। তুল্য নিশ্চিন্তে দাড়ানো। আলোর মা একপলক দেখলো তুল্যকে। তার চোখমুখে ক্ষোভ। আশপাশের সবকিছু উপেক্ষা করে মহিলা বৃদ্ধকে উচু গলায় বললেন,

– আপনারা যা বলছেন, দেখছেন, আমার মেয়েকে আমি সেভাবে মানুষ করিনি কাকা। আলো যখন বলেছে ও নির্দোষ, ও নির্দোষ! কিছুই হয়নি এ বাড়িতে। আপনারা আসুন!

তুল্য সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলো। ভদ্রমহিলার কথা শুনে লাইটারে আগুন জ্বালিয়েও নিভিয়ে ফেললো সেটা। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে এগোলো তার দিকে। একদম স্বাভাবিক গলায় বললো,

– কিছুই হয়নি মানে? আপনার মেয়ের সাথে আমার বাসর হয়েছে। আর এতোবড় ঘটনাটাকেও আপনি কিছুই হয়নি বলছেন? আপনি তো দেখছি আমার প্রাক্তন মায়ের চেয়েও বেশি মর্ডান! বাহ!

তুল্যর গালে সশব্দে চড় পরে। থমকে রয় জায়গাটা। তুল্য আলফেজের গালে কেউ চড় মেরেছে। আর সে চড়টা আলো দিয়েছে। গালে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয় তুল্য। বিধ্বস্ত আলো বড়বড় দম নিতে নিতে চেচিয়ে বললো,

– আর একটাও নোংরা কথা না তুল্য! আর একটাও নোংরা কথা না!

তুল্য প্রতিক্রিয়া করলো না। এই প্রথম কেউ ওর গায়ে হাত তুললো আর ও প্রতিক্রিয়া করলো না। আলোর দিক তাকিয়েই দুপা পিছিয়ে, প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো তুল্য। কিছু টাকা বের করলো সেখান থেকে। ঘরে দাড়ানো একটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলের হাতে দিয়ে বললো,

– যা তো! কাজি ডেকে আন।

আলোর চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। একই অবস্থা ওর মা বোনেরও। তুল্য মুরুব্বি দুজনার সামনে গিয়ে বললো,

– বিয়ে না করে বাসর করে পাপ করে ফেলেছি। এখন বিয়েটা করে পাপমুক্ত হতে চাই। আপনারা কি বলেন?

তুল্যর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবে লোকজন সব বিমুঢ় হয়ে রয়। এমন পরিস্থিতিতে মুলত ছেলেরাই গা বাচাতে চায়। সেখানে এই ছেলে নিজে থেকেই বিয়ের কথা বলছে। কেউ কিছু বলার আগেই আলো এগিয়ে আসলো। একপ্রকার হিতাহিত বোধ হারিয়েছে ও। সবার সামনে তুল্যর কপার চেপে ধরলো আলো। তীব্র জেদ নিয়ে বললো,

– কিসের বাসর? কিসের বিয়ে হ্যাঁ? কিসের বিয়ে? কিচ্ছু হয়নি আমাদের মাঝে! কোনো বিয়ে হবেনা এখানে তুল্য! আমি করবো না তোমাকে বিয়ে! বেরিয়ে যাও তুমি! চলে যাও এখন থেকে!

আলো ধাক্কা লাগায় তুল্যর বুকে। তুল্য একপা পেছালো। তবে তারপর একচুলও নড়লো না। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে আরো আয়েশে দাড়ালো ও। আলোর এমন জোরালো স্বভাব দেখে ওউ অবাক হয়েছে। কিন্তু তা প্রকাশ করলো না। বরং ওর ভাবখানা এমন, ‘গলার জোর, গায়ের জোর, মানসিক জোর, যাই খাটাও না কেনো আলো, তুল্য আলফেজকে স্বামী রুপে স্বীকার করা ছাড়া তোমার কাছে দ্বিতীয় কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই।’

#চলবে…