কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৫৫+৫৬

0
286

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৫৫.

ইউনিকেয়ার। শহরের উন্নতমানের সেবাপ্রদানকারী হাসপাতালগুলোর একটি এটি। সিনএনজি থেকে দ্রুততার সাথে নেমে সোজা রিসেপশনে গেলো শান্ত-শার্লি। রিসেপশনিস্ট কেবিননম্বর বলতেই শার্লি শাড়ীর কুচি ধরে ছুট লাগালো। শান্তর জন্য একদন্ড অপেক্ষাও করলো না। ‘সাবধানে!’ কথাটা ঠোঁটেই আটকে রইলো শান্তর। অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে এটুকো বলতে চেয়েও বলার সুযোগ পেলো না ও। পা বাড়ালো শার্লির পেছন পেছন। লিফট চারতলায় থামতেই অস্থিরতা নিয়ে ওদিকওদিক তাকাতে থাকে শার্লি। তখনই চোখে পরে করিডোরে বসে থাকা আলোকে। এতোগুলো দিন পর আবারো সে চেনা মুখটা দেখে বুক অজানা ব্যথায় ভরে ওঠে শার্লির। ও সামনে পা বাড়ায়। বিক্ষিপ্ত চেহারা, বসে যাওয়া চোখমুখ নিয়ে আলো একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে শার্লির বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করতে শুরু করেছে। কয়েকপা এগোতেই পেছন থেকে নিজের নাম শুনে দাড়িয়ে গেলো ও। অপ্রস্তুত হয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে রুমন এসেছে। সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এসেছে ও। সিড়ি বেয়ে ওঠার দরুন হাপাচ্ছে। রুমনের কাধে ব্যাগ, পরনে জিন্স, আকাশী রঙের টিশার্ট। শার্লির চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। রুমন মৃদ্যুবেগে দৌড়ে শার্লির কাছে আসলো। শান্ত দেখলো, ওদের দুজনেরই চোখে জল। কিছু না বলেও হাজারো অভিযোগ করে চলেছে যেনো ওরা। একে অপরকে, নিজেকে। দ্রুত পলক ফেলে জোরালো হেসে নিজের বন্ধুত্বকেও একবার স্মরণ করে নিলো শান্ত। সবকিছুর মাঝে যে যন্ত্রণা তাশদীদ ভোগ করছে, তা তো ওরও প্রাপ্য না। শার্লির চোখ বেয়ে জল গরায়। রুমন বৃদ্ধাঙ্গুলে তা মুছে দিয়ে বললো,

– মিসড ইউ ইয়ার।

কান্না করে ফেললো শার্লি। রুমন শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ভালো আছেন?

শান্ত জবাব দেওয়ার মতো কিছু পেলো না। নাক টেনে রুমন শার্লিকে এগোতে বললো। আলো তখনো সেভাবেই নিথর হয়ে বসে। ওকে দেখে শার্লির গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। কিচ্ছুটি বলতে পারলো না ও। রুমন ডাক লাগালো আলোকে। আলো সাড়া দিলো না। শান্তও দুবার ডাক লাগালো। তাতেও কোনোরকম প্রতিক্রিয়া করলো না ও। এরমাঝে কিছু কাগজপত্র হাতে তৈয়ব আলফেজ আসলেন সেখানে। তাকে দেখে প্রসারিত চোখে চাইলো শার্লি। সবসময় রাজকীয় ভাবসম্পন্ন মানুষটার মাঝে আজ কোনোরকমের আভিজাত্য নেই। সবসময় স্যুটবুটে থাকা মানুষটার পরনে আজ মলিন সাদা৷ পায়জামা-পাঞ্জাবি। শার্লি, রুমন, শান্তকে দেখে দৃষ্টি সরালেন তৈয়ব আলফেজ। অন্যদিক তাকিয়ে থেকে বললেন,

– ওকে ডেকে লাভ নেই। গত দুদিন হলো ওভাবেই আছে ও। কারো কথাতেই রেসপন্স করছে না।

শার্লি শান্তর শার্টের হাতা খামচে ধরলো। রুমন দেখলো তৈয়ব আলফেজের পেছন থেকে আরো একজন আসছে। চেহারা দৃষ্টিগোচর হতেই প্রসারিত হয় ওর চোখ। হালকা বেগুনী রঙের ইন করা শার্ট, কালো প্যান্ট, পুরোপুরি ফর্মাল পোষাকের সে মানব আর কেউ নয়, তাশদীদ। কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে। সাথে টিটুও আছে। তাশদীদকে যেনো চেনা যায় না। তার আগের মতো হাসিখুশী মুখটা আর নেই। চেহারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আগের সুদর্শন শব্দটা এখন বিধ্বস্ত শব্দে বদলি হয়ে গেছে যেনো। রুমনের ভেতরে গ্লানিবোধ হয়। তাশদীদের এমন অবস্থার জন্য কি ও দায়ী নয়? তাথৈ যে তাশদীদকে কতোটা ভালোবাসে, ও হারিয়ে যাওয়ার পর আক্রোশে তাশদীদকে সেটা বলেছিলো রুমন। অথচ দেড়বছর আগের সে রাতে তাশদীদ যখন তাথৈয়ের খোঁজ চেয়েছিলো, তখন বলেনি। ওর কি তখন বলে দেওয়া উচিত ছিলো না? কেনো বলেনি ও? তাথৈ তামজীদকে ভাবী ডাকতে নিষেধ করেছিলো বলে? যে তাথৈ কিনা তাশদীদ নামে পাগল ছিলো, তার এইটুকো শুনে ও কি করে ধরে নিলো তাথৈ হয়তো চাইছে না তাশদীদের দিকে এগোতে? এতোবড় ভুলটা কি করে করলো ও? কি করে? সেদিন যদি তাশদীদ জানতো, তাথৈ ওকে কতোটা ভালোবাসে, তাশদীদ কেবলমাত্র ওর মুখের কথায় কখনোই ছাড়তো না ওকে। না সেদিন তাথৈ হারাতো, নাইবা আজ এ দিনটা ওদের দেখতে হতো। যে তাথৈ রুমনের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো, যে তাশদীদ ওর জীবনটাই পাল্টে দিলো, সেই দুজনের বিচ্ছেদে দায়ী ও।
চোখ মোছে রুমন। তাশদীদ এসে সবাইকে দেখে নিলো একপলক। বাচ্চাটাকে টিটুর কোলে দিয়ে, এগিয়ে গেলো তৈয়ব আলফেজের দিকে। তার হাতের ফাইল নিয়ে করিডোরের টেবিলে রাখলো। অতঃপর তৈয়ব আলফেজকে ধরে এনে আলোর পাশে বসালো। নিজে তার সামনে বসে গিয়ে হাতজোড়া মুঠো করে নিয়ে বললো,

– একটাবার জানাতে পারতেন।

তৈয়ব আলফেজের কলিজা যেনো মুচড়ে ধরে কেউ। অনুভব করলেন, লক্ষলক্ষ টাকার চেয়ে এইটুকো শান্তনা তার বেশি প্রয়োজন ছিলো। আর সেটা বলার জন্য কেউ ছিলোনা তার। দেড়বছর হলো তাথৈ নিখোঁজ। তুল্য ওকে খুজতে পাগলের মতো এদিকওদিক ছুটেছে। লাভ হয়নি। এই দেড়টা বছরে মেয়ের অভাব তৈয়ব আলফেজকে যেমন সেকেন্ডে সেকেন্ডে মেরেছে, তুল্যর কথাতেও প্রতিমুহূর্তে মরেছেন তিনি। উনি নিজেও দিশেহারার মতো খুঁজেছেন মেয়েকে। তুল্য জানেনি তা। রাতের আধারে যখন নিঃস্বর মতো দুই বাপ ছেলে আলাদা আলাদা করে অম্বুনীড়ে ঢুকতো, তাদের ছোটাছুটির সাক্ষী ছিলো কেবল আলো। নিজের পড়াশোনা গুছিয়ে সে প্রতিরাতে ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতো, কখন তার স্বামী, শশুড় আসবে। তাদেরকে মুখে খাবার তুলতে দেখে, বউ, বউমার দায়িত্ব পালন করেছে বলে হয়তো নিজেকে শান্তনা দেবে।

কিন্তু সেটাও হয়নি। আশ্রয় ব্যতিত অম্বুনীড়ে কিছুই পায়নি আলো। সম্মান তো আরো না। আলফেজ পুরুষদের অবহেলায় দেড়টা বছর ওই সংসারহীন বাড়িটায় কাটিয়ে দিয়েছে ও। পড়াশোনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেয়েছিলো। পারেনি তাও। কোনো এক অদৃশ্য মায়ার তাড়নায় ভার্সিটি থেকে ফিরেই কিচেনে ঢুকে দৈনিক রান্না করতো ও। কখনো তৈয়ব আলফেজের ঘর গুছাতো, তার এ্যাশট্রে পরিষ্কার করতো, কখনো বা না পাওয়া জিনিস হাতের সামনে এনে অস্ফুটস্বরে ডাকতো, ‘বাবা’।
বাবাহীন মেয়ের এমন আবেগপূর্ণ বাবা ডাকটাও তাকে টলাতে পারছে না, এমনটা ভেবে তৈয়ব আলফেজ প্রায়শই নিজের ওপরই বিষিয়ে যেতেন। কিন্তু তাথৈয়ের কথা মনে পরলে একমুহূর্ত কারো সামনে নিজেকে ধরে রাখতে পারতেন না তিনি। তার মেয়েকে হারানোর ক্ষত কেবল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। আর এরই মাঝে হাজির হলো আরেক ঘূর্ণি। তৈয়ব আলফেজ তাশদীদের হাতে থাকা হাত আকড়ে হুহু করে কেদে উঠলেন। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন,

– যা আমিই জানতাম না, তা তোমায় কি করে জানাবো তাশদীদ? কি করে জানাতাম? দেড়বছরে এমন কোনো রাত নেই যে ও নেশা করে অম্বুনীড়ে ঢোকেনি। ড্রিংক করা নিয়ে সবরকমভাবে অপমান করেছি, বারন করেছি। শোনেনি। পরশু সকালে আলোর চিৎকারে যখন ওর ঘরে গেলাম, আমার ছেলেটা মেঝেতে অজ্ঞান পরে ছিলো তাশদীদ। ওর ঠোঁট, মুখ, হাত, মেঝের চারপাশে তাজা রক্ত। এখানে আনার পর ডক্টর অনায়াসে বলে দিলো, তুল্য নাকি আর বাচবে না। লাস্ট স্টেজ অফ ক্যান্সার। এই রোগ অনেক আগে থেকেই নাকি শরীরে বয়ে বেরাচ্ছে ও। কাউকে কিচ্ছুটি জানায়নি। কিচ্ছুটি না।

তৈয়ব আলফেজকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো তাশদীদ। ওর নিজেরও চোখ বেয়ে জল গরাচ্ছে। শার্লি শান্তর বুকে মুখ গুজে কাদছে। বিয়ের আগে ও অনেক কেদেছে, অনেক। ও চেয়েছিলো তুল্য শাস্তি পাক। ওদের সম্পর্কটাকে নিছকই, কিছু না বলার শাস্তিটুকো পাক। কিন্তু এই দিনটা তো ও কখনো চায়নি। এতোবড় শাস্তি কখনোই কামনা করেনি ও। তাহলে এমন কেনো হলো? তৈয়ব আলফেজ অস্থির হয়ে পরেছেন। তুল্যর কথা জানিয়ে শার্লি-রুমনকে লেখা আলোর লেখা চিঠিগুলো তিনি নিজে কুরিয়ার করেছিলেন। সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে অক্ষম বাবা তিনি। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

– মেয়েটাকে তো হারিয়ে ফেলেছি। আমার ছেলেটাও আর বাচবে না তাশদীদ! আমার ছেলেটাও আর বাচবে না!

তাকে জড়িয়েই রাখলো তাশদীদ। পাশে বসা আলো তখনো প্রতিক্রিয়াবিহীন। ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় চুপচাপ উঠে চলে যাচ্ছিলো ও। কিন্তু টিটুর কোলে থাকা বাচ্চাটা আলোর ওড়না টেনে ধরে। আলো একপলক বাচ্চাটার দিকে তাকালো। ওড়না ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে শান্তভাবে বললো,

– ছাড়ো। নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে।

আলো চলে যায়। তৈয়ব আলফেজ কাদছেনই। তাশদীদ আঙুলের পিঠে নিজের চোখ মুছলো। টিটু আস্তেকরে শান্তকে বললো,

– ডক্টর দেখা করতে দিচ্ছে না?

– ডক্টর হাত গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার সময় বলেছে দেখা করে নিতে। কিন্তু তুল্য দেখা করতে চাইছে না। তাথৈ না আসা অবদি কেবিনে কাউকে ঢুকতে বারন করেছে ও।

তৈয়ব আলফেজ জবাব দিলেন। তাথৈয়ের নাম শুনতেই তাশদীদের বুকজুড়ে আরেক যন্ত্রণা হানা দেয়। নিজের অজান্তে ও তাথৈকে ভালোবেসেছিলো। অথচ সেই তাথৈ ওকে ভালোবেসে, ওর অজান্তে কি কি করেছে, তা জানতে দেরি হয়ে গেছে ওর। এতোটাই দেরি যে, ততোদিনে অলকচুম্বী প্রেম আকাশ ছোঁয়া অভিমান-অভিযোগে ভরে উঠেছে। তাথৈ সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে। ভালোবাসার মানুষগুলোর থেকে সরে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে যায় তাশদীদ। নিজেকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষটা। যে কিনা একআকাশ ভালোবাসা পেয়েও পায়নি। তাথৈয়ের প্রেম দুর আকাশের মেঘের মতো ওর মতো নগন্যের কার্নিশ ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু ও তা ধরে রাখতে পারেনি।
আলো ফিরে এসে একদম আগের জায়গাতেই বসে গেলো। শার্লি ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। সবার নিরব কান্নায় পেরিয়ে যায় বেশ কিছুক্ষণ। অকস্মাৎ কারো পায়ের আওয়াজ শুনে চোখ তুলে চায় সবাই। আলো, তাশদীদ বাদে। সামনেরজনের উপস্থিতিতে চোখের জল আরো বাধভাঙা হয়ে পরে প্রত্যেকের। হালকা সবুজাভ ফতুয়া, কালো ধুতি আর চপ্পল পরিহিত রমনী কোনোদিক না তাকিয়ে সোজা কেবিনে ঢুকে গেলো। ওকে দেখে বিস্মিত-বিহ্বল বাকিসবও কেবিনে ঢোকে। বাইরে স্থির হয়ে বসে রয় কেবল আলো, তাশদীদ। কালো শু পরা একজোড়া পা এসে তাশদীদের সামনে থামে। তাশদীদ দু হাটুতে দুহাতের কনুই ঠেকিয়ে নিচদিক তাকিয়ে বসে ছিলো। সামনেরজনের চেহারার দিকে না তাকিয়েই বললো,

– থ্যাংকিউ। যদি আমার বন্ধুত্বের দায় পালন করে থাকিস, সেজন্যও; যদি ওর প্রেমিকের দায় পালন করে থাকিস, সেজন্যও।

তাথৈ বুকে দুহাত গুজে, জলভরা চোখে বিছানা বরাবর দাড়িয়ে আছে। কেবিনের একপাশে রুমন, টিটু, শান্ত, শার্লি আর তৈয়ব আলফেজ দাড়ানো। তাদের সবার চোখে জল। দেড় বছর পর তাথৈকে দেখছে ওরা। অথচ খুশি হতে পারছে না। তাথৈ ফিরেছে ঠিকই। কিন্তু এমন এক সময় ফিরেছে, যখন ওরই ভাই মৃত্যুশয্যায়। কেবিনের সবাই আগে তাথৈকে আপাদমস্তক দেখলো। তাথৈ আর তাথৈ নেই। শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে সে। কোমড়ের চুলগুলো কাধে চলে এসেছে। শরীর দৃশ্যমান সব জায়গায় অযত্নের প্রমাণ। অন্যদিকে তুল্য। বেডে আধশোয়া হয়ে বসে হাসছে সে। চোখের নিচে কালি, হাতপায়ে কালশিটে ভাব, সিগারেটে পুড়ে কালচে হয়ে ওঠা ঠোঁট, এলোমেলো চুল, সবমিলিয়ে এ এক অন্য তুল্য। তুল্য আলফেজ না। হাসপাতালের বেডে থাকা কোনো মানুষ এমন হাসতে জানে, জানা ছিলো না রুমনের। তুল্য দু কামড় খাওয়া হাতের আপেলটা বেডের পাশের তাকে রাখলো। তেমনি হাসতে হাসতে তাথৈকে বিছানা দেখিয়ে বললো,

– আয়। এদিকে বস।

দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তাথৈ। ওর চোখ বেয়ে টুপটাপ জল গরালো। তুল্য আবারো বললো,

– আয় না! ওখানে দাড়িয়ে কাদছিস কেনো?

– কিরে? আয়? আমি দুইদিন হলো ওষুধ, ফ্রুটস নিয়ম করে খাচ্ছি আর শক্তি জোগাচ্ছি যে তুই আসলে আমার কথা বলার জোর লাগবে। আর তুই ওখানে দুরে দাড়িয়ে। এদিকে আয়! আয় ঝগড়া করি দুজনে। বহুদিন ঝগড়া করিনা তোর সাথে।

ঘুরে এসে বিছানায় বসে গেলো তাথৈ। তুল্যর পরনে হাসপাতালের পোষাক। সেটার গলার দিকটা একহাতে মুঠো করে বললো,

– তোদের জীবনে আমিই ছিলাম সব সমস্যার মুল। তাই তোদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। আমাকে ছাড়া যাতে তোরা মরে যাস, এজন্য যাইনি তুল্য!

– দেড়বছর তোকে ছাড়া আছি বলে মরে যাচ্ছি, সেটা তোকে কে বললো? লার্জটাইম নেশার সঙ্গে আছি বলে মরে যাচ্ছি ডাফার।

ভাইয়ের জবাব শুনে তাথৈ দুহাতে ওর জামার গলার দিকটা খামচে ধরলো এবারে। চোখের জল ঝরিয়ে বললো,

– কেনো এমনটা করলি?

– আমি কিছুই করিনি। আগের ছোটখাটো সিম্পটমগুলোকে পাত্তা দেইনি। চার পাঁচমাস আগে এক বারে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। ওখানকার কেউ একজন ডক্টরের কাছে রেখে গেলো। সেদিন জানতে পারি লাস্ট স্টেজে আছি। তখন আর কি চিকিৎসা করাতাম? মনে পরলো, এটুকো জীবদ্দশায় যা যা পাপ করেছি, সৃষ্টিকর্তা তার ফল দিয়ে দিলো। ব্যস আর ভাবিনি এ নিয়ে। ওপরওয়ালার লেখা তকদীরের ওপর তো আর কলকাঠি নাড়া যায়না বল?

খুবই গা ছাড়াভাবে জবাব দেয় তুল্য৷ ও যে নিজের রোগ সম্পর্কে অবগত ছিলো না, সাবলীলভাবে সে মিথ্যেটাই বললো। তাথৈয়ের কান্নারা বাধ ভাঙে। কাদতে কাদতে ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পরলো ও। হাসিমুখে ওকে জড়িয়ে ধরলো তুল্য। অতঃপর কেবিনের বাকিসবের দিকে তাকালো। বাবাকে দেখে বললো,

– কি ড্যাড? দেড়বছরে যতো ওজন কমেয়েছিলে, এ দুদিনে দেখি তারচেয়ে বেশি কমিয়ে ফেলেছো। খাওয়াদাওয়া করো নি নাকি?

তৈয়ব আলফেজ ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। ওর মাথায় চুমো দিয়ে কাদতে থাকেন অঝোরে। তুল্য কাদলো না। কেনো কাদবে ও? ও এখন ওর বাবার বাহুডোরে। আর তাথৈ ওর বুকে। এমন সুখকর পরিস্থিতি ওর জীবনে কখনো আসেনি। কিছু একটা ভেবে তুল্য বললো,

– আলো কোথায় ড্যাড?

– বাইরে।

রুমন জবাব দিলো। তুল্য ওকে দেখে আরেকটু হেসে বললো,

– আরে রুমন! বিদেশে থেকে হ্যান্ডসাম হয়ে গেছিস। মেয়েটেয়ে পটেছে কিনা ওখানকার?

– তোমাকে ছাড়া আরকাউকে পটানোর ট্রাই করিনি তুল্যবাবু। সে মেয়ে বলো বা ছেলে।

তুল্য হাসে। ওর হাসিতে আরো দম আটকে আসে বাকিসবের। হাসি কমিয়ে এবার শান্ত-শার্লিকে দেখলো তুল্য৷ দুজনকে বেশ মানিয়েছে। শাড়ী পরিহিত শার্লিকে আরেকবার দেখে নিয়ে শান্তকে বললো,

– এটা বিয়ের পর শাড়ী পরা শুরু করেছে?

শান্ত আস্তেকরে মাথা ওপরনিচ করলো। তুল্য শব্দ করে হেসে ফেললো। শার্লিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– কিরে বাঙালী বধূ? পড়াশোনা শেষ না করে যে উবে গেলি, তোকে শান্ত ভাই বিয়ে না করলে কি উপায়টা হতো বল?

শার্লি জবাব দিলো না। চেয়ে রইলো তুল্যর দিকে। তুল্য শুকনো ঢোক গিললো। আবারো জোরপূর্বক হেসে বললো,

– কিরেহ? আগে তো মুখে খই ফুটতো। এখন কথা নেই কেনো? বিয়ের পর কথা বলা ভুলে গেছিস?

– আ’ম সরি।

অস্ফুটস্বরে বললো শার্লি। তুল্য হোহো করে হেসে উঠলো। শার্লি হয়তো আরো কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু সুযোগ পেলো না। তুল্য দিলো না সুযোগ। ও চায় না অন্যকারো ঘরণী আজ ওকে নিয়ে এমন টান দেখাক, যাতে তাদের সংসারে খারাপ প্রভাব পরে। তুল্য বাবার বুক থেকে মাথা সরিয়ে বললো,

– ড্যাড? তাশদীদ ভাই?

তাথৈ তুল্যর বুকে পরে থেকে কাদছিলো। তাশদীদের নাম শুনে ভাইয়ের জামা পুনরায় খামচে ধরলো ও। তৈয়ব আলফেজ বললেন,

– আছে বাইরে।

– আলোকেও ডাকো।

রুমন বেরিয়ে এসে তাশদীদকে ডাকলো। তাশদীদ বসা থেকে উঠে দাড়ালো। আলোকে বললো,

– তুল্য তোমাকে ভেতরে যেতে বলেছে আলো।

আলো এতোক্ষণে চোখ তুলে তাকায়। অস্থিতিশীলভাবে ভেতরে ঢুকে এককোনে দাড়িয়ে যায় ও। তাশদীদ ভেতরে আসতেই টিটুর কোলে থাকা বাচ্চাটা ওর কোলে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরলো। তাশদীদ আগে কোলে নিলো মেয়েকে। দেখলো তাথৈ তুল্যর বুকে পরে আছে। তাশদীদকে দেখে তুল্য একটা দম নিলো। ইশারা করলো বিছানার ওপরপাশে এগোতে। তাশদীদ করলোও তাই। তাথৈয়ের কোনো হেলদোল নেই। তুল্য বোনের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে তাশদীদকে বললো,

– প্রতিটা মেয়ের জীবনে সুখের পেছনে তিন পুরুষের ভূমিকা থাকে। বাবা, ভাই, বর। বাবা, ভাই থাকা সত্ত্বেও আমার বোনটা কোনোকালে সুখী ছিলো না তাশদীদ ভাই। এখন সামনে আমি থাকবো না। ড্যাডের ওপর আমার ভরসা নেই। তাথৈয়ের সুখের দায়ভার আমি কাকে দিয়ে যাই বলুন?

ভাইয়ের বুকে মুখ গুজে তাথৈ শক্ত হয়ে রইলো। তুল্যকে কিছু বলা থেকে নিজেকে দমালো। তাশদীদ জবাব দিলো,

– অসুখে তো আমি নিজেও তুল্য। এ দায় নেওয়ার ক্ষমতা হয়তো আমার নেই।

তুল্য নিশব্দে হাসলো। নড়েচড়ে বসে তাথৈকে বললো,

– এই ছাড়তো। কান্না করার জন্য অন্যকারো বুক খুঁজে নে যা।

তাথৈ যেনো কিছুই শুনলোনা। আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরলো তুল্যকে। তুল্য তাশদীদের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আমার আলোর সাথে কথা আছে। কিন্তু এটাকে বুকে রাখতে গিয়ে অস্থির লাগছে, কথা বলতে পারছি না। আপনি বরং শেষবারের মতো আমার একটা উপকার করুন তাশদীদ ভাই। ওকে কান্না করার জন্য একটু নিজের বুকে জায়গা করে দিন প্লিজ। প্লিজ!

ভাইয়ের কথা শুনে তাথৈ বিমূঢ় হয়ে মাথা তুলে তাকালো। তাশদীদ উঠে এসে বাচ্চাটাকে টিটুর কোলে দিলো আবারো। হাতে দুটো গোলাকার খেলনা দিয়ে বললো,

– বাবাই এখানেই আছে।

মেয়েটা আর বায়না করলো না। বাধ্য সন্তানের মতো টিটুর কোলে খেলনাদুটো দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। তাথৈয়ের কানে গেলো সবটাই। অকস্মাৎ তাশদীদ এসে হাত চেপে ধরলো ওর। গায়ের জোর খাটিয়ে, ওকে তুলে দাড় করালো। তাথৈকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না। তাশদীদ একহাতে ওকে জড়িয়ে, আরেকহাতে ওর মাথা চেপে ধরলো নিজের প্রশস্ত বুকের মাঝখানটায়। শক্তকন্ঠে বললো,

– কান্না করো। এটলিস্ট যতোক্ষণ তুল্য চাইছে।

দ্বিতীয় বাক্যটা আস্তেকরে বলেছে তাশদীদ। তাথৈ আরো জোরে কেদে উঠলো। ও তাশদীদের বুক ঠেলছে, ছাড় চাইছে। কিন্তু পারছে না। তাশদীদের জোরালো বাধনের কাছে ওর ছোট্ট দেহটা খাঁচায় থাকা কোনো বন্দিনীর মতোই। তুল্য মুচকি হাসলো। অতঃপর ঘাড় কাৎ করে তাকালো সর্বপেছনে দাড়ানো আলোর দিকে। ডাক লাগালো,

– আলো?

তুল্যর মুখে নিজের নাম শুনে চোখ তুলে তাকালো আলো। দুবার চোখের পলক পরলো ওর। এমন না এ দেড়বছর বিয়ের ঘটনার জন্য ও তুল্যকে কেবল ঘৃণাই করে গেছে। আবার স্ত্রী ধর্ম মানতে ও যে তুল্যের পায়ের নিচে পরে থেকেছে, এমনও না। ঘর গোছানো, ঘরে খাবার এনে দেওয়া, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা, ঘরের তাপমাত্রা বুঝে এসি কমানো বাড়ানো, মেঝেতে মাতাল হয়ে পরে থাকা তুল্যকে টেনেটুনে বিছানায় নেওয়া, গায়ে চাদর তুলে দেওয়া, তুল্য বাইরে থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পরলে জুতা খুলে রাখা, হাতের কাছে ওর চাওয়ার সবকিছু এনে দেওয়া, এই টুকটাক কাজগুলো করতো, এই যা। এর বাইরে তুল্য যেমন ওকে অধিকার দেয়নি, তেমনই ওউ পারেনি অধিকার আদায় করতে। ও তো কেবল চেষ্টা করে গেছে মানুষটাকে বাচিয়ে রাখতে। অথচ ওপরওয়ালা ওর সে চেষ্টাটুকোও কবুল করলো না। তুল্য একটা বড় দম নিলো। আলোকে উদ্দেশ্য করে মলিন স্বরে বললো,

– এতোগুলো দিন সয়েছো। আর দুটো মিনিট আমাকে দেওয়া যায় না?

আলো এগোলো। তুল্যর সামনে গিয়ে বিছানায় বসলো ও। তুল্য চোখভরে দেখলো ওকে। মেয়েটাকে কখনো সেভাবে খুটিয়ে দেখা হয়নি ওর। তবে যতোদুর মনে পরে, আলোর মন চেহারা যতই বিধ্বস্ত থাকুক না কেনো, ওর মাথা থেকে কখনোই ওড়না সরে না। এখনো হালকা গোলাপী আর সাদার মিশেলে ওড়না দেওয়া ওর মাথায়। দৃষ্টি নত। তুল্য বললো,

– বিয়েটা যেমন আমার উদ্ভ্রান্ত মস্তিষ্কের পাগলামো ছিলো, তোমাকে ডিভোর্স না দেওয়ার সিদ্ধান্তও আমি ততোটাই ভেবেচিন্তে নিয়েছিলাম আলো। অনেক আগেই মুক্তি দিতে পারতাম তোমাকে। কিন্তু তাতে আমাদের দুজনকেই অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো। রিয়েলাইজ করলাম ডিভোর্স আমাদের সমাজে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। মেয়েদের এ নিয়ে লোকমুখে অনেক কথা শুনতে হয়। আমি চাইনি আমার কারনে তোমার নামের পাশে আজীবন ডিভোর্সি ট্যাগ বসে যাক। লোকজন তোমাকে আরো কটু কথা শোনাক। বাইরের হাজারটা মানুষের কথা শোনার চেয়ে, অম্বুনীড়ে আমার মতো অমানুষের উপেক্ষায় বাচা ভালো।

আলোর নামিয়ে রাখা চোখ বেয়ে জল গরাতে থাকে। তুল্য মুঠো করা হাত মুখের কাছে নিয়ে একবার কাশি দিলো। গলা ঝেরে আবারো বললো,

– যখন জানলাম লাস্ট স্টেজ চলছে, কি পরিমানে স্বস্তি পেয়েছিলাম, তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। মরতে তো একদিন না একদিন হতোই। এতোগুলো জীবন নষ্টের দায়ে যখন আমি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মারা যাচ্ছিলাম, ঠিক সে সময় এমন সুসংবাদ পেয়ে যাবো, আশা করিনি। তাছাড়া এ মুক্তি তো কেবল আমার না। তোমারও। তালাকপ্রাপ্ত নারীকে সমাজ অনেক হেনস্তা করে। কিন্তু স্বামী মারা গেলে স্ত্রী দিকে কোনো প্রশ্নতাকের সুযোগ থাকে না। আমি সেদিকটাই ভাবলাম। সর্বোচ্চ উপায়ে অপমান করেছি তোমাকে। ডিভোর্সের সাথে তাতে আরো যোগ না করি। ডিভোর্সি ট্যাগের চেয়ে তুমি বরং একেবারে বিধবা…

আলো আঁতকে উঠে চোখ তুলে চাইলো। তুল্য আটকালো ওর জলভরা চোখ দেখে। একপলক শার্লির দিকে চেয়ে পুনরায় আলোর দিকে তাকালো ও। একটুখানি হেসে বললো,

– শার্লিকে যখন বলেছিলাম, আমি তোমায় বিয়ে করে নিয়েছি, ও তখন কি বলেছিলো জানো? ও বলেছিলো, অন্যকেউ হলে তোমাকে অভিশাপ দিতো। কিন্তু তোমার ওর অভিশাপের প্রয়োজন নেই। কারন আমিই তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।

বলতে বলতেই গলা ধরে আসে তুল্যর৷ চোখ ভরে আসে জলে। শার্লি শান্তর হাতা খামচে ধরে আছে। তাথৈ তখনো তাশদীদের থেকে ছাড় চাইছে, তবে পারছে না। তুল্য একটা ঢোক গিলে কোনোমতে বললো,

– ও ঠিকই বলেছিলো আলো। আমি সত্যিই তোমার জীবনে অভিশাপ। একটা সময় দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। এই সুন্দর পৃথিবী সবার নামে প্রেম লিখবে। জীবনের কোনো না কোনো প্রাপ্তিকে আকড়ে ধরে সবাই ভালো থাকবে। সবার ইচ্ছেগুলো পূর্ণতা পাবে। কিন্তু এসবের মাঝে অপুর্ন থাকবে কেবল তুমি। ভালো থাকবে না কেবল তুমি। আজীবন তুল্য আলফেজ নামক কালো অধ্যায় তোমাকে তাড়া করে বেরাবে। এ নাম তোমাকে যাতনায় জর্জরিত করে রাখবে। মরে গিয়েও…

আলোর আর সহ্য হলো না। যে তুল্যর নামে ও অজস্র ভালোবাসা এঁকেছিলো, ছোট্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি সেই তুল্যর নামেই ওর জীবনে ঝড় তুলেছিলো। হয়তো তুল্যকে ক্ষমা করতে পারেনি ও। কিন্তু ওর মন জানে, ও তুল্যকে ভালো না বেসেও থাকতে পারেনি। যতোটুকো করার অধিকার ওকে দেওয়া হয়েছিলো, আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে দায়িত্বপালন বলে মনে হবে, তা আলো ভালোবেসেই করেছিলো। দুদিন আগে যখন এই মানুষটাকে রক্তাক্ত মুখ নিয়ে মেঝেতে পরে ছিলো, ওর পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আজকে মরার কথা বলে সে পৃথিবীতে আবার ঝড় তুলে দিয়েছে তুল্য। তুল্যর মুখ চেপে ধরে ওকে থামিয়ে দিলো আলো। মাথা ডানেবামে নাড়িয়ে না করতে করতে শব্দ করে কাদতে থাকলো। তুল্য চোখ বন্ধ করে চোখের জল ফেলে। আলোর হাত ভিজে যায় সে নোনাজলে। তুল্য চোখ মেলে, ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,

– সুখ দেওয়া তো দুর, আমি তোমায় কেবল অসুখে মেরেছি আলো। ক্ষমা চাওয়ার কোনো যোগ্যতা আমার নেই। আবার ভালোবাসি বলারও ক্ষমতা নেই। কিন্তু তুমি তো অনেক বুঝদার। এখন তুমিই বলে দাও, এসময় কি করা উচিত আমার? পরপারে তো সুখী হতে পারবো না। কি করলে অন্তত শান্তিতে মরতে পারবো বলতে পারো? কি করলে জীবনের এই শেষ মুহুর্তটায় একটুখানি শান্তি মিলবে? বলতে পারো?

আলো হাত ছাড়িয়ে নিলো। অবুঝ শিশুর মতো হুমড়ে পরলো তুল্যর বুকে। গায়ের সবটুকো জোর খাটিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। যেনো আলগা দিলেই তুল্য হারিয়ে যাবে। ওর অকস্মাৎ কাজে একমুহূর্ত থেমে রয় তুল্য। আলো উচ্চস্বরে কাদতে কাদতে বলতে থাকে,

– তুমি আমার কতো সুখময় অসুখ, তা যদি তুমি জানতে তুল্য! তা যদি তুমি জানতে! তোমার মতো অসুখ আমার দ্বিতীয়টি ছিলো না। কোনো কালে ছিলো না। সে অসুখে আমি হাসতে হাসতে মরতে জানতাম। গ্লানির পরিবর্তে, তোমাকে আমি সে অসুখের প্রতিকার বানিয়ে রাখতে পারতাম। এসব যদি তুমি জানতে তুল্য! যদি তুমি জানতে!
তোমার কোনো যোগ্যতা লাগবে না। ভালোবাসতে হবে না। তুমি শুধু আমাকে একটু ভালোবাসার সুযোগ দাও প্লিজ। কথা দিচ্ছি, যতোটা আত্মহংকারী হয়ে তোমায় দুরে রেখেছি, তার শতসহস্র গুন বেশি অবজ্ঞা, বেশি অপমান সয়ে আমি তোমায় পায়ের নিচে পরে থাকবো। ব্যস তুমি শুধু আমায় সেটুকোর সুযোগ দাও! ভিক্ষে চাইছি তুল্য! আমাকে একটাবার তোমাকে সামনে থেকে ভালোবাসতে দাও প্লিজ! শুধু একবারের জন্য বলো, ‘আমায় ভালোবাসো।’ এরপর আমি এই পৃথিবীর কারো কাছে, কোনো অভিযোগ রাখবো না! তোমার জন্য সামান্য আত্মাভিমান কেনো, রবের সৃষ্ট এই কায়নাতকে ত্যাগ করতেও আমি দুবার ভাববো না তুল্য! দুবার ভাববো না!

আলো নিঃস্বের মতো হাউমাউ করে কাদছে। কেবিনের বাকিসব নিরবে কাদছে। তুল্য অনুভূতিশূণ্য। ওর চোখ বেয়ে আবারো জল গরায়। মনে হয়, আলোর এ চাওয়া কেবল একদিনের হতে পারে না। জীবনের সর্বোচ্চ ঘৃণা করা মানুষটিকে এভাবে মুহুর্তের ব্যবধানে ভালোবাসা যায় না। এমনকি তার মৃত্যুশয্যাতেও না। কাপাকাপা হাতজোড়া আলোর মাথা আর পিঠে রাখলো ও। আলোর কান্নার বেগ আরো বাড়লো। তুল্য নিজেও এবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আলোকে। কয়েকফোটা অশ্রু ঝরিয়ে বললো,

– আমায় ভালোবেসোনা আলো। তোমার ভালোবাসা না এখন আমাকে বাচাতে পারবে, না তোমাকে। আমায় ভালোবেসোনা।

আলো তুল্যর বুক থেকে মাথা তুলে বড়বড় চোখে চাইলো। দুবার কাশি দিলো তুল্য। ওর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। আলো তীব্র কষ্টে পুনরায় ফুপিয়ে কেদে ফেলে। তুল্যর গলার দিকের জামা মুঠো করে ধরে ওকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে আবারো। একনাগাড়ে বলতে থাকে,

– আমাকে ক্ষমা করো তুল্য! এ মহাবিশ্বের সমস্ত সত্যিকে আমি অস্বীকার করতে পারবো, কেবল আমার জীবনের চরম সত্যিকে অস্বীকার করতে পারবো না৷ আর সে সত্যি এটাই, আমি তোমাকে ভালোবাসি! যবে থেকে ভালোবাসা শব্দটা বুঝেছি, তবে থেকে। ছুঁতে পাবো না জেনেও আমি যেমন আকাশের চাঁদকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি, কাছে পাবো না জেনেও আমি তেমন তোমায় ভালোবেসেছি। আমার কুড়েঘরে প্রলয় হানা ঝড় যেমন আমার অতিপ্রিয়, তোমার বেপরোয়া ভাব ঠিক সেভাবেই আমার ভালোবাসা। সব জ্বালিয়ে রাখ করে দেওয়া আগুন আলোর যতোটা আপন, তোমার রাগকে অলংকার ভেবে আমি সেভাবেই ভালোবেসেছি তুল্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি তুল্য! আমি তোমাকে ভালোবাসি!

আলো কাদছে। ওর আহাজারি শুনে কাদছে বাকিসবও। আর তুল্যর চোখ ঘোলাটে হয়ে আসছে ক্রমশ। সবার দিক চোখ ফিরিয়ে দেখে কেউই ওর চোখে চোখ মেলাচ্ছে না। সবাই কাদতে ব্যস্ত। আস্তেকরে সরি উচ্চারন করে তুল্য।
কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে পিঠে তরলের উপস্থিতি অনুভব করে আলো। টের পায়, তুল্যর শরীর নেতিয়ে এসেছে। ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে ওর। কিছু বলার আগেই কানে অস্ফুট আওয়াজ আসে, ‘শান্তি…’
বিমূঢ় হয়ে কাধ থেকে তুল্যর থুতনি সরিয়ে, ওকে সামনে আনে আলো। সঙ্গেসঙ্গে ঢলে পরে তুল্যর নিস্তেজ শরীর। ওর চোখ বন্ধ, ঠোঁটের আশেপাশে রক্ত। আলোর সমস্ত পৃথিবী ধাঁধিয়ে যায়। স্বামীর নিথর দেহটাকে ও জড়িয়ে ধরে সর্বশক্তিতে। ‘তুল্য!’ বলে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে। তাথৈ এতোক্ষণ তাশদীদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু আলোর আর্তনাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ও। তাশদীদের চোখ বেয়ে জল গরায়, হাতের বাধন আলগা হয়ে আসে। থমকে গেছে চারপাশ। ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো, কেবিনের জানালার বাইরের আমগাছে বসে থাকা বাবুই পাখিটা…

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৫৬.

– আমি তাথৈয়ের প্রেমিক নই তাশদীদ। এ দেড়বছরে, ও কখনো আমাকে প্রেমিকের চোখে দেখেনি৷ ইনফ্যাক্ট…দেখেই নি!

তাশদীদ নিরবে সামনেরজনের হাসিমিশ্রিত কথা শুনলো। তৈয়ব সাহেবের কথায় অম্বুনীড়ে এসেছিলো ও। তুল্যর গত হবার পর থেকেই অম্বুনীড়জুড়ে জমকালো আধার। গার্ডেনের লাইটগুলোতেও যেনো অন্ধকার ঘুরে বেরাচ্ছে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোতে সামনেরজনকে দেখলো তাশদীদ। স্যুটব্যুট পরা ছেলেটা ওর আগের ভার্সিটির বন্ধু, নোমান। বর্তমানে একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। দেড়বছর আগে তাথৈ নিখোঁজ হওয়ার পর তুল্য, তৈয়ব আলফেজের মতো তাশদীদও খুঁজেছে তাথৈকে। পায়নি। তুল্যর অসুস্থতার ঘটনা জানার পর নোমান নিজে ওকে কল করে জানায়, তাথৈ ওর কাছে আছে। ও নিয়ে আসছে তাথৈকে। তাশদীদ ভেবেছিলো, তাথৈ হয়তো নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। ওকে চুপ দেখে নোমান আবারো হাসলো। বললো,

– তাথৈ আমার কাছে ছিলো না তাশদীদ। বাড়ি যাওয়ার সময় ওকে সেন্সলেস অবস্থায় রাস্তায় পেয়েছিলাম। ওসময় পুলিশকে কিছু বললে ব্যাপারটা কোনদিক না কোনদিক যায়, এ ভেবে আর কাউকে কিছু বলিনি। ওকে গ্রামে নিয়ে যাই। ভয়ে ছিলাম এজন্য বাড়িতে কি না কি ফেইস করতে হবে। তাথৈয়ের জ্ঞান ফেরার পর সিদ্ধান্ত নিলাম তাথৈয়ের বাড়ির লোকজনকে জানাই। কিন্তু তাথৈ বারণ সাধলো। আর ওর জেদ! কি বলবো ভাই!

তাশদীদ দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। তাথৈয়ের রাগ, জেদ, ওরচেয়ে ভালো আর কে জানে? নোমান বলে চলেছে,

– গ্রামে মাস্টার চাচা ছিলেন নিঃসন্তান মানুষ। তিনি জানালেন, তাথৈকে তিনি মেয়ে হিসেবে তার কাছে রাখবেন। তারপর আর কি? তাথৈ তার কাছেই ছিলো। চাচার স্কুলে পড়িয়েছে, ওদের সাথেই থেকেছে। মাঝে আমি দুবার বাড়ি গিয়ে ওর সাথে দেখা করেছিলাম, এই যা!

তাশদীদ একপা এগোলো। নোমানের চোখে চোখ রেখে বললো,

– তুই তাথৈকে ভালোবাসিস না?

নোমান এবার আরো জোরে হাসলো। বললো,

– ধুরু! যা-তা বলিস তুই! আমি কেনো ওকে ভালোবাসতে যাবো? যখন আমি জানি ও অন্যকাউকে ভালোবাসে। তাথৈ ভাই ডাকে আমাকে। ও নিজে কখনো কারো খোঁজ নেয়নি৷ তবে আমাকে বলতো সবার খোঁজ নিতে। তুই বাদে! আমাকে বলেছিলো, ও কাউকে ভালোবাসে। এরপর একসময় নিউজে দেখলাম তোর ইনভেশনে ওরও সম্পৃক্ততা আছে। তখন বুঝলাম, তোদের মাঝে কিছু তো একটা ছিলো। আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি, সব ঠিক হয়ে গেছে, সবাই তোমাকে মিস করে, ফিরে যাও। তাথৈ মানেনি। কিন্তু যখন জানলাম তুল্য আলফেজ মৃত্যুমুখী, তখন তো ওকে ফিরতেই হতো। ওর বিষয়ে আগে তোকে জানালাম। এরপর ওকে নিয়ে আসলাম এখানে। এইতো!

– তাথৈ আলফেজকে আমি এটুকোই চিনি তাশদীদ। এরবাইরে কিছুই নেই আমাদের মাঝে। তাথৈ গ্রামে আমাকে বিয়ে করে নিয়েছে, এই ভুলধারনা থেকে তুই বের হ। জীবন গোছানো তো দুর, তোকে ছাড়া ওর জীবন জীবনই না। এ সহজ কথাটা আমি বুঝে গেলাম, অথচ তুই এখনো বুঝলি না!

তাশদীদ চুপ রইলো। নোমান হাতঘড়িতে সময় দেখলো। তাশদীদের কাধে হাত রেখে তাড়াহুড়ো করে বললো,

– আমার যেতে হবে রে। অনেক রাত হয়ে গেছে। তুই আর মেয়েটাকে দুরে যেতে দিস না। ভালোবাসার জোরে বেধে ফেলিস। আসছি।

হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো তাশদীদ। নোমান বাকিসবের থেকে বিদায় নেবে বলে গার্ডেন থেকে অম্বুনীড়ের ভেতরে যায়। শান্ত তাশদীদের কাছে আসতে আসতে ওকে ভেতরে ঢুকতে দেখলো। নোমান অম্বুনীড়ে ঢুকে দেখে সাদা থ্রিপিস পরিহিত আলো অম্বুনীড়ের ড্রয়িংয়ে মেঝেতে বসে আছে। ওর মা ওর পাশেই বসে। আলফেজ পুরুষেরা যে কখনোই আলোকে মানেনি, সেকথা এ দেড়বছরে আলো একবারের জন্যও মাকে কখনো বুঝতে দেয়নি। কিন্তু তুল্যর চলে যাওয়ার পর তৈয়ব আলফেজের কান্নারত স্বীকারোক্তি শুনে সবটা বুঝে এসেছে তার। মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আলোকে নিয়ে যাবেন তিনি। মায়ের মনের কথা হয়তো আলোর বুঝে আসলো। ও একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছিলো। একসময় বললো,

– আমি তোমার সাথে যাচ্ছি না মা।

মহিলা অবাক হলেন না। তার না বলা কথা বুঝে যাওয়ার স্বভাব আলো অনেক আগে থেকেই রপ্ত করেছে। একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে বললেন,

– এখন যেতে হবে না।

– কখনোই যাবো না মা। অম্বুনীড় ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা।

ভদ্র মহিলা এবারে মেয়ের দিকে অবাকচোখে চাইলেন। তার এই মেয়েই এ বাড়িতে আসতে রাজি ছিলো না। অথচ দুইপুরুষের অবহেলা সয়ে এবাড়িতে পরে ছিলো ও। এমনকি এখন স্বামীহারা হয়েও থাকতে চাইছে। কিছু বলতে যাবেন, সেসময়ই কানে আসে,

– তোমার গোটা জীবন পরে আছে আলো।

আলো চোখ তুলে একপলক তাথৈকে দেখলো। ওর যুক্তিখন্ডনে জবাব দিলো,

– আর সে পুরো জীবন কাটাতে আমার কেবল তুল্যকেই দরকার ছিলো তাথৈ।

– এখন ও নয়, ওর স্মৃতিই সই। যাই কিছু হয়ে যাক, আমি অম্বুনীড় ছাড়বো না, ছাড়তে পারবো না। তোমরা এ নিয়ে আর কথা বাড়িও না।

আলোর ততোটাই নিস্প্রভ জবাব। তাথৈ কথা বাড়ালো না। নোমান এগিয়ে এসে আগে তৈয়ব আলফেজের কাছে বিদায় নিলো। অতপর তাথৈকে বললো,

– আসছি তাথৈ। নিজের আর সবার খেয়াল রেখো।

– নোমান ভাই…

তাথৈ উঠে দাড়ালো। নোমান ওকে আশ্বস্ত করে সৌজন্যতার সাথে বিদায় নিলো। ও বেরিয়ে যেতেই সবার চোখে পরে দরজায় দাড়ানো তৈয়ব আলফেজের প্রাক্তন স্ত্রীকে। তার পরনে অফ হোয়াইট রঙের কারুকাজবিহীন শাড়ি। মুখচোখের জৌলুশ আগের মতোন নেই। তাথৈয়ের কাধে হাত রাখলো শার্লি। মহিলা ভেতরে ঢুকলেন। তৈয়ব আলফেজ তাকে দেখেও বাধা দিলেন না। মহিলা তাকে নরম কন্ঠে বললেন,

– তুল্য আমাকে এতোবেশি ঘৃণা করেছে যে ওর শেষসময়েও ও আমাকে ওর কাছে যেতে দেয়নি। নিজের পেটের ছেলেকে শেষ দেখাটা আমাকে দুর থেকে দেখতে হয়েছে তৈয়ব। ঘন্টাখানেক পর আমার ফ্লাইট। আবারো ইউকে চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিন বিডিতে আসা হবে না। শেষবারের মতো ইচ্ছে করলো একবার তাথৈকে দেখে যাই। তাই এসেছি। তোমার অমত আছে?

তৈয়ব আলফেজ জবাব দিলেন না। টাকার পরিবর্তে এই মত অমতের হিসাবটা যদি তাদের মাঝে আগে থাকতো, তাহলে হয়তো আরপাঁচটা সাধারন পরিবারের মতো তারও একটা হাসিখুশি পরিবার হতো। মহিলা তাথৈয়ের দিকে এগোলেন। বললেন,

– আমি জানি তাথৈ, তুল্যর মতো তুমিও আমাকে কখনো মা বলে মানো নি। ভবিষ্যতেও মানতে পারবে না। তবে তুল্যর মতো তুমি আমাকে এতোটা ঘৃণা করোনি, আজ তোমার সামনে দাড়াতে দিচ্ছো, কথা বলতে দিচ্ছো, এজন্য থ্যাংকিউ। জানি আমার জন্য অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে তোমাদের। ব্যস এটুকো বলার ছিলো, আমি চলে যাচ্ছি। আর কখনো তোমাদের জীবনে দখলআন্দাজ করতে আসবো না৷ ভালো থেকো।

– ভালো রাখতে চাইলে ভালোবাসতে হয়, ভালোবেসে কাছে থাকতে হয়। আর সেটা তুমি আজও বুঝলে না মম। আমার মতো বোকাটিই রয়ে গেলে।

মহিলার চোখ জলে চিকচিক করে ওঠে। মেয়েকে সে কি করে বলবে, এই ভালোবাসা, কাছে থাকার বুঝ হয়েও আজ তিনি নিরুপায়। তৈয়ব আলফেজের পরিবর্তে অন্যকারো সহধর্মিণী। অতীতের সাথে পুনরায় সম্পর্ক জুড়ে দেওয়া তাকে মানায় না। তাছাড়া এতোকিছুর পর এ সংসার তার প্রাপ্যও না। মহিলা কান্না লুকিয়ে জোরালো হাসলেন। তাথৈয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,

– তোমার মুখে মম ডাক শুনে অনেক শান্তি লাগছে তাথৈ। তাশদীদের কথায় সাহস করে আমার এখানে আসাটা বিফলে যায়নি। যাইহোক, আসছি।

ভদ্রমহিলা যতোটা আস্তেধীরে ভেতরে এসেছিলেন, চোখ মুছতে মুছতে ততোটাই দ্রুততার সাথে বেরিয়ে গেলেন। তৈয়ব আলফেজ এতোক্ষন দুরে থাকলেও এবারে মেয়ের পাশে বসে গেলেন। তাথৈয়ের মাথায় হাত বুলালেন আস্তেকরে। হুট করেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। কেমন একটা হাহাকার। বুকজুড়ে কেবল শুন্যতা। তাথৈ আস্তেকরে বাবার বুকে মাথা গোজে। হয়তে বাবাকে বুঝালো, ‘আমি আছি ড্যাড। তোমার ফাঁকা বুকটায় আমি আছি।’
শার্লির ফোন বাজলো এবারে। ও দেখলো শান্তর নম্বর। কল রিসিভ করলে, ওপাশ থেকে শান্ত কিছু একটা বললো ওকে। কল কেটে পুনরায় তাথৈয়ের কাধে হাত রাখলো শার্লি। বললো,

– তাশদীদ ভাই চলে যাচ্ছে তাথৈ।

– সে যাতে এগিয়ে যায়, দেড়বছর আগে এজন্যই তাকে ছেড়েছিলাম।

– এগিয়ে যায়? তোর মনে হয় তাশদীদ ভাই এগিয়েছে?

তাথৈ জবাব দেয় না। শার্লি আবারো বললো,

– দেড় বছরে কেনো, তোকে ছাড়া সারাজীবনেও এককদম এগোতে পারবে না সে তাথৈ!

– ভালোই তো আছে সে। বাচ্চা নিয়ে, বউ ন্…

– ওই বাচ্চা তাশদীদের না। নাইবা তাশদীদের জীবনে কোনো নারীর অস্তিত্ব আছে।

মাথা তুলে বাবার দিকে প্রসারিত চোখে চাইলো তাথৈ। তেমন বিস্ময়েই চাইলো শার্লি-রুমন-আলোর দিকে। সবাই নিস্প্রভ। কিছুই বুঝে আসলো না তাথৈয়ের। তৈয়ব আলফেজ মেয়ের মাথায় মাথা ঠেকালেন। ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

– দেড়বছর হলো তাশদীদও আমাদের মতোই যন্ত্রণায় রে মা। কলেজের লেকচার, বাচ্চা, পরিবার সামলে ওউ পাগলের মতো খুজেছে তোকে। তোর ভার্সিটির চেনাজানা থেকে শুরু করে, ছেলেটা আমার কাছেও ছুটেছুটে আসতো। আত্মীয়স্বজনের ঠিকানার জন্য।

রুমন মুখ খুললো এবারে। বললো,

– বাচ্চাটা রিংকির বোন রোজির মেয়ে। মেয়ে বলে বাচ্চাটাকে রোজির শশুড়বাড়ির কেউ মানতে পারছিলো না। ওরা রোজিকে আর ওর মেয়েকে অনেক বাজেভাবে ট্রিট করতে থাকে। সহ্য করতে না পেরে রোজি বাবা মায়ের কাছে ফেরত আসে। কিন্তু এখানে আসার কিছুদিন পর মেয়েটা নিজের বাবা মায়ের কাছেও যেনো বোঝা হয় যায়। ওনারা রোজিকে প্রেশারাইজ করতে থাকে, মেয়েকে এডপশনে দিয়ে বা অনাথ আশ্রমে দিয়ে আবারো বিয়ে করে নিতে। যখন দেখলো তাদের কথায় রোজি কোনোমতেই রাজি হচ্ছে না, ওই নির্দয় মানুষদুটো ওর নিস্পাপ মেয়েটাকে চুরি করে অনাথআশ্রমে পাঠিয়ে দিলো। রোজি মেয়েকে খুজে মা পেয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যায়৷ ঠিক হয়ে যাবে ভেবে ওর বাবা মা ওকে ঘরবন্দি করে দেয়। এইসব সহ্য করতে না পেরে রোজি একসময় সুইসাইড করে। খবর পেয়ে তাশদীদ ভাইও সেখানে গিয়েছিলো। পুলিশ রোজির সুইসাইড নোট পায়। সেখানে এই সম্পুর্ন ঘটনা লেখা ছিলো। সাথে এও লেখা ছিলো, যদি রোজির মৃত্যুর পর ওর বাচ্চাকে খুঁজে পাওয়া যায়, ওর মেয়ে আর যেখানেই মানুষ হোক, যেনো ওর বাবা-মায়ের কাছে না থাকে। মেয়ের মৃত্যুর পর রিংকির বাবা মার হয়তো অনুশোচনা হয়, বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবে তারা। কিন্তু বাধ সাধেন তাশদীদ ভাই। রোজীর শেষ ইচ্ছের কথা ভেবে বাচ্চাটাকে সে নিজেই এডপ করে নেয়। দেড়বছর হলো তাথৈ তার কাছেই মানুষ। প্রীতিকার্নিশেই বড় হচ্ছে ও।

রুমনের কথায় জামা খামচে ধরলো তাথৈ। ও চেয়েছিলো সবাই ভালো থাকুক। এজন্যই সবার থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছিলো ও। ফিরিয়ে দিয়েছিলো তাশদীদকে। অথচ সত্যি তো এটাই, কেউ কোথাও ভালো নেই। ওকে ছাড়া কেউ ভালো ছিলো না। আলো বললো,

– সে এগিয়েছে কিনা, সে হিসেব বাদ। তাকে ছেড়ে তুমি এগিয়েছো তাথৈ? পেরেছো অন্য কাউকে ভালোবাসতে? পারবে কখনো?

– তুমি তো ঘৃণা করেও তুল্যকে ভালোবাসা থেকে নিজেকে আটকাতে পারোনি আলো। আমি ভালোবেসে কি করে ভালোবাসা বাদ দেই বলো?

তাথৈয়ের জবাবে আলো তাচ্ছিল্যে হাসলো। বললো,

– তাহলে ভালোবাসাকে ভালোবাসো তাথৈ। সময় থাকতে, বেচে থাকতেই ভালোবাসাকে ভালোবাসো। নইলে জীবন বরই অনিশ্চিত। এখানে কে কখন কাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যায়, তা কেউ বলতে পারে না। কেউনা!

আলোর যন্ত্রনা চেপে বলা কথাটা সোজা তাথৈয়ের হৃদপিন্ডে আঘাত করে যেনো। এক মুহুর্তের জন্য আলোর জায়গায় নিজেকে দেখে ওর সর্বাঙ্গের কর্মক্ষমতা হারিয়ে যায়। দুনিয়া ওলটপালট হয়ে আসতে থাকে। চোখ বেয়ে জল গরায়। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে দাড়িয়ে যায় তাথৈ। চোখমুখ মুছে, দিশেহারার মতো এদিকওদিক তাকিয়ে খুজতে থাকে কিছু একটা। তখনই ওর সামনে গাড়ির চাবি তুলে ধরেন তৈয়ব আলফেজ। তাথৈ চাবি হাতে নিতে নিতে, কয়েকফোটা অশ্রুবিসর্জন দিয়ে বাবাকে জবাব দিলো,

– ভালোবাসা থেকে দুরে থাকার যন্ত্রণা, ভালোবাসা আগলে না নেওয়ার শাস্তি, ভালোবাসা হারানোর আঘাতে আমি পিষ্ট ড্যাড। শেষ হয়ে গেছি। আমার আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই।

খুশি হয়ে যায় উপস্থিত সবাই। শার্লি রুমন চোখের জল মোছে। তৈয়ব আলফেজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে, ওর কপালে চুমো দিলেন একটা। দ্রুতপদে অম্বুনীড় থেকে বেরিয়ে আসলো তাথৈ। বাবার গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে, গাড়ি স্টার্ট দিলো ও।

গাড়ি থামার আওয়াজ কানে আসতেই পা থামে তাশদীদের। অদ্ভুত এক অনুভব হয় ওর। নাকে আসে এক চেনা ঘ্রাণ। ওর মন বলতে থাকে, তাথৈ এসেছে। ওর চারপাশে এখন তাথৈয়ের উপস্থিতি। কিন্তু মস্তিষ্ক সায় দেয় না বলে পেছন ফেরার আত্মবিশ্বাস পায় না তাশদীদ। এই জনমানবশূন্য রাস্তায় তো তাথৈয়ের থাকার কথা না।
ওপরদিকে তাশদীদকে থামতে দেখে অস্থিরতার পারদ ক্লান্তিতে নেমে আসে তাথৈয়ের। কেমন যেনো মিঠে যন্ত্রণা আর অসহনীয় স্বস্তিতে ভরে ওঠে চোখ। সিটবেল্ট খুলে তাথৈ বেরিয়ে আসলো গাড়ি থেকে। যুবকের সাদা পাঞ্জাবী, প্রশস্ত কাধ, পেছনদিকের চুলের ছাঁট, কনুইয়ে ভাজ দেওয়া হাতা দেখে তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না তাথৈয়ের। এটা তাশদীদই। অন্য কেউ নয়। তাথৈয়ের কাতর কন্ঠনালী দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বেরোয়,

– তাশদীদ…

তাশদীদ তাথৈয়ের থেকে বেশ অনেকটাই দুরে দাড়ানো ছিলো। কিন্তু নিঝুম রাত আর নির্জন পথের সুযোগ নিয়ে এটুকোও কানে পৌছে যায় ওর। আর আঘাত হানে একদম বুকের ভেতরটায়। ঠিক নাকি ভুল শুনলো সেটা ভাবতে সময় নেয় তাশদীদ। আস্তেধীরে পেছন ফিরতেই তাথৈকে চোখে পরে ওর। তাথৈয়ের পেছনে গাড়ির হেডলাইট জ্বলছে, নিভছে। রাস্তায় অনবরত জ্বলা হলুদ নিয়নের গাঢ় নীল ফতুয়া, পায়ের পাতা অবদি লম্বা সাদা স্কার্ট পরিহিতা তাথৈয়ের মুখ পরিপূর্ণভাবে দেখা যায়। তাশদীদের মন ওর নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে চায়না। স্তব্ধ, বিমূঢ় পায়ে এগোতে থাকে ও তাথৈয়ের দিকে। টের পায় ওর চোখ জলে ভরে উঠছে। টুপ করে কয়েকফোটা অশ্রু বেরিয়েও আসে তাথৈয়ের চোখ থেকে। একে ওপরের দিকে এগিয়ে এসে সামনাসামনি দাড়ালো। একহাত দুরুত্বে দাড়িয়ে অশ্রসজল চাওনিতে চাওনি পরলো দুজনার। দুজনেই নিশ্চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তবু মনে হয়, কিচ্ছুটি না বলেও যেনো দুজোড়া চোখ অনেককিছুই বলছিলো। তাদের মাঝে যেনো গোটা এক জন্মের কথা, অভিমান, অভিযোগ, ভালোবাসা বিনিময় হচ্ছিলো।

তাথৈ সে নিরবতাকে ভাঙতে চাইলো। সবে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই পাশ থেকে লোহার দন্ডের বারি পরে তাশদীদের চেহারায়।
মুখ থুবড়ে রাস্তায় পরে যায় তাশদীদ। তাথৈ আঁতকে ওঠে। বিমূঢ় চোখে চেয়ে রয় একপাশ হয়ে রাস্তায় পরে থাকা তাশদীদের দিকে। তার কপালের এপাশ থেকে রক্ত গরিয়ে নিচে পিচঢালা পথে পরছে। সে উঠে দাড়ানোর জন্য হাত দিয়ে মাটি ঠেলছে, নিমীলিত আঙুলগুলো মুঠো করার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে লম্বা কোট পরিহিত এক ছেলে এসে দাড়ালো তাশদীদের মাথার কাছে। উঁকি দিয়ে ওকে পরখ করে বললো,

– তাশদীদ ওয়াসীর। একচুয়াল ইনভেন্টর অফ বায়োলুমিন্যন্ট-নন বায়োলুমিন্যান্ট সিকোয়েন্সিং এন্ড মডিফিকেশন। হা?

তাশদীদ মুখ দিয়ে দম ফেললো। উড়ে উঠলো ওর মুখের সামনের ধুলো। অপরদিকে তাথৈয়ের মস্তিষ্ক অচল। জলে ভরা চোখে কেবল তাশদীদের কপাল গরিয়ে পরা রক্তই দেখছে ও। আর কিছুই যেনো বুঝে আসছে না ওর। তাশদীদকে আঘাত মানুষটা এবার ওরদিক ফিরলো। আপাদমস্তক তাথৈকে দেখে নিয়ে, বাকা হেসে বললো,

– এন্ড ইউ…তাথৈ আলফেজ। ইন এ্যাসোসিয়েশন উইথ, তাশদীদ ওয়াসীর। রাইট?

মুহূর্তের ব্যবধানে মাথায় থাবা পরে লোকটার। তাথৈ আবারো চমকে উঠে একপা পেছোয়। লোকটা নিচে পরে গেছে। এতোটাই জোরে পরেছে যে, মাথা একবার রাস্তায় লেগে, শুন্যে উঠে, পুনরায় মাটিতে পরেছে। ঠোঁটও কেটে গেছে তার। মাথা ধরে, ব্যথায় মৃদ্যু আওয়াজে কাতরাচ্ছে সে। এতোক্ষণে মানুষটার চেহারা দেখে চিনতে পারে তাথৈ। এটা অন্য কেউ নয়, প্রফেসর সুবোধের টরোন্টোবাসী ছেলে, জেইন। চোখ তুলে আবারো তাশদীদের রক্তজড়ানো চেহারার দিক তাকালো তাথৈ। সে বা হাতে মাথা চেপে ধরে। দাড়িয়ে থাকতে গিয়ে টলছে, অথচ ডানহাতে জেইনকে বেশ জোরালোই আঘাত করেছে। একহাতে মাথা ধরে রেখে, তাশদীদ শুকনো ঢোক গিললো। তারপর উবু হয়, জেইনকে টেনে তুলে দাড় করালো। আবারো মার লাগাতে যাবে, তখনই কানে আসে,

– এইযে তাশদীদ দ্য সেভিয়ার ভাই, মার খেয়েও মার দেওয়ার জোরটা যে আপনার গায়ে আছে, সেটা একটু পরে দেখান। তারআগে এদিকটাতেও একটু তাকান?

তাশদীদ ঘাড় ঘুরালো। ঝাপসা চোখে দেখতে পায়, আশেপাশে আরো পাঁচজন ছেলে। তারমধ্যে দুজন তাথৈকে ধরে আছে। একজন তাথৈয়ের পেছন থেকে ওর গলায় চাকু ধরে আছে। তাথৈ নড়চড় করে ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করছিলো। ফলশ্রুতিতে কিঞ্চিৎ কেটেও গেছে ওর গলা। এমনিতেও শরীর নেতিয়ে আসছিলো তাশদীদের। তারওপর তাথৈকে আটক দেখে করনীয় ভুলে বসলো ও। আর সে সুযোগটাই ব্যবহার করে জেইন। হাতে থাকা লোহার দন্ড দিয়ে তাশদীদের উরুতে আঘাত করে সে। পা চেপে ধরে তাশদীদ আবারো নিচে পরে যায়৷ তাশদীদের নাম ধরে চেচিয়ে ওঠে তাথৈ। জেইন ডলা মেরে নিজের ঠোঁটের রক্ত মুছলো। কয়েকটা বারি মারলো তাশদীদকে। ওর থুতনি বরাবর লোহাটা ঠেকিয়ে, উচিয়ে লক্ষ্য স্থির করলো দুবার। তাথৈ না না করছে, কিন্তু তাশদীদের চেহারায় কোনো ভয়ডর নেই। কি ভেবে, মারতে গিয়েও ওকে মারলো না জেইন। তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে, কিঞ্চিৎ অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

– রুডিকে কাবু করা মানুষটার গায়ের জোর এতো কম হবার কথা না। তুমিই ওর দুর্বলতা রাইট?

– লিভ হিম! প্লিজ!

– রাইট!

নিশ্চিতের মতো মাথা দুলিয়ে বললো জেইন। ওর হাসি দেখে আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে ওঠে তাথৈ। ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো চেচায়। জেইন ওর প্রতিক্রিয়া দেখে হাতের দন্ডটা ঘোরালো। এরপর তাশদীদের হাতের কনুই আর মুখে বারি লাগালো দুটো। মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে তাশদীদের। কাশি দিয়ে মুখের রক্ত বের করে দেয় ও। তাথৈ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, হাউমাউ করে কান্না করছে। ওর কান্না দেখে জেইন মজা পায় যেনো। হেসে বলে উঠলো,

– টু মাচ লাভ! আ’ম ইমপ্রেসড ম্যাডাম তাথৈ! বুঝতে পারছি, সত্যিই তুমি অনেক ভালোবাসো তাশদীদকে। অনেক!

– আর ওকে ভালোবাসো বলেই তুমি আমার বাবাকে থ্রেট দিয়েছিলে, তার সাজানো গোছানো ক্যারিয়ারটা শেষ করে দিয়েছিলে। তোমার এই ভালোবাসার জন্যই আমার মোডিফিকেশন কপি বলে প্রমাণ হয়েছে, আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে, টরোন্টোর জেলে গোটা দুইটা বছর পঁচতে হয়েছে আমাকে!

তাথৈ অস্থির, দিশেহারা, উন্মাদের মতো করতে থাকে। ওদিকে তাশদীদ চোখ মেলে রাখতে পারছে না। জেইন গিয়ে কলার ধরলো তাশদীদের। ওকে টেনে দাড় করালো। দুজন পুরুষের কাছে গায়ের জোর কাজে দিচ্ছে না তাথৈয়ের। তাশদীদ টলছে, দাড়িয়ে থাকতে পারছে না। প্রচুর পরিমানে রক্তক্ষরণের দরুন মুখচেহারা একপ্রকার রক্তে ছেয়ে গেছে ওর। তাথৈ চিৎকার করে কাদতে কাদতে এক পর্যায়ে ভিখিরীর মতো আকুলভাবে বলে ওঠে,

– ওকে ছেড়ে দাও প্লিজ! ওকে ছেড়ে দাও! যা করেছি, আমি করেছি। ও এসবের কিছু জানতোও না। ওকে ছেড়ে দাও জেইন! প্লিজ! প্লিজ ওকে ছেড়ে দাও!

– তাথৈকে যেতে দে জেইন। ও যা করেছে, আমার জন্য করেছে। তোর হিসেব আমার সাথে। ওকে যেতে দে।

টালমাটালভাবে বললো তাশদীদ। জেইন সাইকোর মতো হাসলো। ঘাড় কাৎ করে, বেশ মজা নিয়ে বললো,

– ওয়াও তাশদীদ। তুইও তো অনেক ভালোবাসিস ওকে।

– তোরা আমার আর আমার বাবার সাথে সাথে যা করেছিস, আমি কিন্তু তোদের দুটোকেই মারবো ভেবেই দেশে এসেছিলাম তাশদীদ। মেয়েটাকে পাইনি বলে পুরো তিনটে মাস শুধু তোকে ফলো করছি। ভেবেছি একসাথে পেলে দুটোকেই…

কিন্তু না! এখন দেখছি তোদের দুজনকে মারলে ব্যাপারটা ঠিক জমবে না। কাহিনী তখন বেশি এক্সাইটিং হবে, যখন আমি তোদের দুজনের একজনকে আরেকজনের সামনে মারবো। একজন মরবে, আরেকজন তার মৃত্যুতে দৈনিক মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করবে, তার কথা ভেবে ভেবে, প্রতিমুহূর্তে মারা যাবে। দ্যাট উইল বি মোর ইন্টারেস্টিং রাইট?

ধাক্কা মেরে তাশদীদকে আরোদুটো ছেলের হাতে ছেড়ে দেয় জেইন। ওরা হাত ধরে দাড় করিয়ে রাখে তাশদীদকে। তাথৈ হাত পা ছুড়ছে, গায়ের সমস্ত জোরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। জেইন ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,

– এবার বল, কাকে মারি? তোকে? নাকি মেয়েটাকে?

তাথৈ বিস্ফোরিত চোখে জেইনের দিকে তাকালো। তাশদীদ নিরত্তর। ও কেবল তাথৈয়ের দিকে চেয়ে আছে। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড পরও জবাব দেয়না ও। ফলশ্রুতিতে হাসিমুখটা রাগে পরিনত হয় জেইনের। তাশদীদকে আরেকটা বারি লাগালো ও। চিৎকার করে ওঠে তাথৈ। আর ওর প্রতিক্রিয়ায় জেইন যেনো পুনরায় মজা ফিরে পায়। জোরালো হেসে বললো,

– ও আচ্ছা। এদিকের টান বেশি!

চোখ বন্ধ করে চোখের জল ফেললো তাশদীদ। আর তাথৈ এতোবেশি নড়চড় করছে যে দুজন জোয়ান ছেলেরও ওকে ধরে রাখা দায় হয়ে পরেছে। ওকে এমন অস্থির হতে দেখে জেইন শয়তানী হাসলো। তারপর রাস্তার ধারে থাকা ওর ব্যাগটা থেকে একটা চাকু বের করলো। চকচকে ধারালো বস্তুটা দেখতেই তাথৈ স্তব্ধ হয়ে যায়। ভয়ার্ত কন্ঠে না করতে থাকে জেইনকে। জেইন তাথৈয়ের ভয় দেখে মজা নিলো। তারপর এসে তাশদীদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

– তোর কপালের জোর আছে বলতে হচ্ছে তাশদীদ। প্রেমিকের নাম খারাপ হচ্ছে বলে দুনিয়া উল্টেপাল্টে দেবে, এতোবেশি ভালোবাসতে জানা প্রেমিকা সবার কপালে থাকে না। কোটিতেও কারো এমন প্রেমিকা জোটে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সেই প্রেমিকার প্রেমই তোর জন্য হানিকারক। তার প্রেমই তোকে মেরে ফেলছে। স্যাড! ভেরি স্যাড!

– যাকগে। জীবনে অনেক ভালো কাজ করেছিস৷ এ দুনিয়ায় তোর আর থাকার দরকার নেই। যা জান্নাতে গিয়ে আরাম আয়েশ কর। যে মোডিফিকেশন দিয়ে তুই আমার ক্যারিয়ার শেষ করেছিস, আশাকরি সেখানে তারচেয়েও সুন্দর জিনিসের দেখা পাবি। এই জনমের জন্য, টা টা!

তাশদীদের পেটে ছুড়ি চালিয়ে জেইন গায়ের সমস্ত রাগ মেটায়। রক্তে ভিজে ওঠে তাশদীদের সাদা পান্জাবীটা। তীব্র যন্ত্রণার প্রলয় বয়ে যায় ওর সমগ্র শরীরজুড়ে। তবুও মুখ অবদি আসা আর্তনাদকে থামিয়ে দিলো ও। চোখের সামনে এ দৃশ্য দেখে গগনবিদারী চিৎকারে কেদে ওঠে তাথৈ। ছেলেদুটো ছাড়তেই হাটুতে বসে পরলো তাশদীদ। ওর মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোলো না। তাথৈয়ের দিকে চেয়ে থেকে, আস্তেকরে ঢলে পরলো পিচঢালা রাস্তায়।

#চলবে…