কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৫+৬

0
135

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৫.

মাগরিবের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে দলেদলে বেরিয়ে আসলো যুবকেরা। ভার্সিটির কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ আদায় করে সবাই রওনা হলো নিজনিজ উদ্দেশ্যে। তাশদীদের নামাজ তখনে শেষ হয়নি। সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত শেষ করলো ও। প্রায় সবার শেষে বেরোলো মসজিদ থেকে। ওযুর পর খয়েরী পান্জাবীর বড় হাতাটা ছেড়ে দিয়েছিলো। সেটা আবারো গুটাতে গুটাতে দ্রুতপদে মেইনগেইটের দিকে এগোলো ও। হঠাৎই এক ছেলে এসে ওর বুকে হাত রেখে ওকে থামিয়ে দেয়। মৃদ্যু আওয়াজে বলে,

– তাশদীদ ভাই না?

ডিপার্টমেন্টের জুনিয়রকে দেখে অবাক হলো না তাশদীদ। একপলক আশপাশে তাকালো ও। পুনরায় সামনেরজনের দিক দৃষ্টি নিয়ে, ওর কাধে হাত রাখলো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মাথা ওপরনিচ করলো। ছেলেটা উত্তেজনা নিয়ে জরিয়ে ধরলো তাশদীদকে। ছেড়ে দাড়িয়ে আবারো বললো,

– আরেহ ভাই আছেন কেমন? ক্যাম্পাসে কখন আসলেন? বলেন নাই কেনো যে ক্যাম্পাসে আছেন?

– একটু কাজে বেরিয়েছিলাম রে। বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে জামায়াতের সময় পার হয়ে যাবে, তাই এখানেই পরলাম।

– ভালো করেছেন! চলেন ভাই! আজকে হলে চলেন! আপনার সাথে আড্ডা দেইনা অনেকদিন! আজকে প্রাণখুলে আড্ডা জমাবো চলেন!

তাশদীদ নিশব্দে হাসলো। ছেলেটা আবারো বললো,

– মাস্টার্সের ক্লাস কবে থেকে শুরু আপনাদের? ক্যাম্পাসে নিয়মিত হবেন কবে থেকে? জানেন তাশদীদ ভাই? আপনার ওভারহুয়েল্মিং বাস্কেটবল ইনিংস মিস করছি প্রচন্ড! অনার্সের চারবছরে আন্তঃবিভাগ বাস্কেটবল টুর্নামেন্টের চারটাই তো ডিপার্টমেন্টে দিয়ে গেছেন। মাস্টার্স দুবছরের দুইটাও কিন্তু আমাদেরই লাগবে!

তাশদীদ ছেলেটার উৎসাহ দেখছিলো। ওর চোখের তারায় তাশদীদকে নিয়ে যাওয়ার খুশির ঝলকানি। হবেই বা না কেনো? চারবছরের একাডেমিক ক্যারিয়ারে তাশদীদ রেজাল্টের সাথে আনন্দও কুড়িয়েছে। নিজের জন্য, সবার জন্য। বাসা থেকে ভার্সিটিতে যাতায়াত করলেও, হলের ছেলেদের সাথে পুরো ক্যাম্পাস চরিয়েছে ও। এই সুবিশাল সাতশ একরের একটাএকটা কোনা ওর চেনা। তাশদীদ ঠোঁটের হাসিটা আরো একটু বাড়িয়ে বললো,

– মাস্টার্স অন্য ভার্সিটি থেকে করছি। এখানকার কোনো টুর্নামেন্টে আমার আর থাকা হবেনা।

ছেলেটার চোখমুখের সবটুকো উচ্ছ্বাস খোয়া গেলো। তাশদীদ কাধ উচিয়ে উপায় নেই বুঝালো। ছেলেটা কিছুটা অভিমান নিয়েই বললো,

– কি? আমাদের এমন করে পর বানিয়ে দিলেন ভাই? কাজটা কি ঠিক হলো?

তাশদীদ ছেলেটার কাধে আবারো হাত রাখলো। বললো,

– জেনেবুঝে অবুঝ কেনো হচ্ছিস বলতো? ক্যাম্পাস আলাদা হলেই মানুষ পর হয়ে যায়?

– তবুও! অন্য ভার্সিটিতে যাচ্ছেন কেনো ভাই? এখানে ফ্যাসিলিটিজ কি কোনোঅংশে কম ছিলো?

– পয়তাল্লিশ ব্যাচের সবগুলোকে কাল হলে থাকতে বলিস। আমি যাবো।

প্রসঙ্গ পাল্টে দিলো তাশদীদ। ছেলেটা আর কথা বাড়ালো না। সৌজন্যে মাথা ওপরনিচ করলো। তাশদীদ ওর কাধে চাপড়ে পড়াশোনা নিয়ে আরোদুচারটে কথা বলে বেরিয়ে আসলো ক্যাম্পাস থেকে। মেইনগেইটে এসে মাথা থেকে টুপিটা খুললো। আঙুল চালিয়ে মাথার চুল উল্টে দিলো। বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়ে, পকেট থেকে বের করলো ফোনটা। তাশদীদের দৃষ্টি ফোনে ছিলো। হঠাৎ পাশ থেকে শুনতে পেলো,

– ভার্সিটিই বদলে দিলে তাশদীদ? বুদ্ধি মন্দ আটোনি৷ তবে আমার মনে হয় না এতে তোমার খুব একটা লাভ হবে।

তাশদীদ ফোন থেকে চোখ তুলে পাশে তাকালো। মধ্যবয়স্ক লোকটি ওর ডিপার্টমেন্টের স্যার। সৌজন্য হেসে ফোনটা পকেটে পুরলো তাশদীদ। ও কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক আবারো বললেন,

– আরেকবার ভেবে দেখতে পারতে।

তাশদীদ কপালের দিকটা একটু চুলকে হাসি আড়াল করলো। পরপরই দৃষ্টি তুলে বললো,

– ইটস ওকে স্যার। আমার মতো এক তাশদীদ আপনাদের আন্ডারে মাস্টার্স না করলে আপনাদেরও কোনো ক্ষতি হবে না। এরকম আরো অনেক তাশদীদ আসবে ক্যাম্পাসে।

ওর জবাবে আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তাশদীদ একপা এগোলো। উচ্চতায় কাধ বরাবর মানুষটার চোখে চোখ রেখে শীতলস্বরে বললো,

– কিন্তু আপনারা আর কোনো তাশদীদের মেধা চুরি করার সুযোগ পাবেন না। আসি। ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।

তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তাশদীদ। পেছন থেকে ওর চলে যাওয়া দেখলো ভদ্রলোক। যেনো এক দৈববাণী শুনতে পেলো সে, পশ্চিমের প্রান্তে সূর্য ডুবেছে। বিদায় নিয়েছে জ্বলন্ত নক্ষত্র। আরোবেশি তীব্রতা নিয়ে ফিরবে বলে…

ভোর সাড়ে চারটা। নির্ঘুম রাতের শেষপ্রহরেও চোখের কোনা বেয়ে জল গরালো তাথৈয়ের। এলোমেলোভাবে হাতপা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে আছে ও বিছানায়। পরনে গেন্জি, পাজামা। দৃষ্টি মাথার ওপরের ছাদের দিকে। ঘরের সমস্ত আসবাব পুনরায় ঠিক করে দিয়েছেন তৈয়ব আলফেজ। সময়ের সাথে ঠিক হয়ে গেছে বাকিসবকিছুই। শুধু ঠিক হয়নি তাথৈয়ের মন। যে মন ভেবেছিলো, অনেকবেশি ভালোবাসতে জানা অন্তু কখনো ওকে ছেড়ে যাবে না। সে মনকে ঠকিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে অন্তু। এই ঠকিয়ে শব্দটা ভাবতে গেলেও চারপাশ জ্বলে উঠছে ওর। তীরের মতো বিধছে মস্তিষ্কে। মাথার রগ দপদপ করছে। যেনো এই শব্দ অন্তুকে নয়, বরং ওকেই তাক করছে। তাথৈ উঠে বসলো। নাক টেনে, দুহাতে মাথার চুল উল্টে ধরলো। হাতের পিঠে চোখ মুছে, নেমে আসলো বিছানা থেকে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির সম্মুখদিকের ব্যালকনিতে এসে দাড়ালো। সূর্যোদয়ের সময় হয়নি এখনো। কিছুসময় পর তৈয়ব আলফেজ গাড়ি ঢুকলো অম্বুনীড়ে। পুনরায় রাগ হলো তাথৈয়ের। দ্রুততার সাথে নিজের ঘরে চলে আসলো ও। বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে, বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। সিড়িতে নামার সময় তৈয়ব আলফেজের মুখোমুখি হলো তাথৈ। ওকে আপাদমস্তক দেখে উনি বললেন,

– এসময় কোথায় বেরোচ্ছো?

– এসময় কোথ্থেকে আসছো, এমন কিছু আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি ড্যাড।

জবাব দিতে দিতেই বাবাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলো তাথৈ। দাড়ালো না, বাবার দিকে তাকালোও না। তৈয়ব আলফেজ আজও প্রতিত্তোর করলেন না। মেয়েকে বাসার বাইরে বেরোতে দেখে বুকপকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলেন উনি। সিগারেট ধরিয়ে মুখে নিয়ে পা বাড়ালেন নিজের ঘরের দিকে। করিডোরে তুল্যর ঘর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় দরজা থেকে একবার উকি দিলেন সে ঘরেও। বিছানায় উপুর হয়ে ঘুমোচ্ছে তুল্য। খালি গায়ে। মাথার পাশেই বইখাতা ছড়ানো ছিটানো। তৈয়ব সাহেব চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন তুল্যর পড়ার টেবিলে। সেখানে কিছু একটা দেখে মাথা নেড়ে চলে আসলেন তিনি। তুল্যর টেবিলের সামনে একটা কাগজ ঝুলানো। তাতে লেখা ‘Chapter 9=Club 9’ যার মানে, নবম অধ্যায় পড়া শেষে ক্লাব নাইন নামক বারে পার্টি করতে যাবে ও।

তাথৈ গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। শেষরাতের ফাকা রাস্তায় অতিদ্রুত ড্রাইভ করছে ও। কানে রিকশা, প্রাইভেট কার, ট্রাকের আওয়াজ আসছে। অসহনীয় লাগছে ওর এই আওয়াজগুলো। সামনে জনশুন্য রাস্তা দেখে আরো গতি বাড়িয়ে দিলো। উদ্দেশ্য, কোলাহলের বাইরে যাওয়া। একটাসময় পর তাথৈ হুট করেই ব্রেক কষে। চারপাশ কিছুটা পরিষ্কার হতে শুরু করলেও, তখনও আশপাশ লক্ষ করেনি ও। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের দিক তাকিয়ে থাকা অবস্থাতে ওর মনে হলো, ওর কানে এখন গাড়ির হর্ণ না, পাখির কলকাকলি বাজছে। কিচিরমিচির আওয়াজে ওর অশান্ত মনটা আস্তেআস্তে স্বস্তিতে ভরে উঠছে। আস্তেধীরে চোখ তুলে সামনে তাকালো তাথৈ। নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। রাস্তায় বাদিকটায় ওর গাড়ি। ঘনঘন বহুতল ভবন নেই ধারে। ডানপাশের দেয়ালের ওপারে সবুজ মাঠ। তাথৈ বা দিকে তাকালো। এদিকটায়ও দেয়াল তোলা। ওপারে কি আছে, দেখা যায় না। তবে বড়বড় গাছ আছে বোঝা যায়। দুরে একটাদুটো মানুষ যাচ্ছে। লোকজনের আনাগোনা সীমিত৷

গাড়ি থেকে নেমে আসলো তাথৈ। ভোরের বিশুদ্ধ বাতাস গা ছুইয়ে হৃদয় শীতল দিলো ওর। সবুজ চারপাশ ওর চোখের সমস্ত যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দিলো নিমিষেই। পাখিদের আওয়াজ যেনো কর্ণকুহরে স্বাগতবাণীর মতো কুন্জন তুললো। আশপাশ দেখতে দেখতে, খালি পায়ে ফুটপাত দিয়ে হাটতে লাগলো তাথৈ। অম্বুনীড়ের চারপাশে বা গুলশানের রাস্তাগুলোতে দালান আর বিলাশবহুল গাড়ি ব্যতিত কিছুই নজরে পরেনি ওর। বহুদিন নিজের সাথে লড়াইয়ের পর, আজকে এই জায়গাটা যেনো ওকে বুকভরে শ্বাস নিতে বলছে। তাথৈ ফুটপাতের ইটে খালি পা ঘষে। শান্তি পায় না। তবুও পা বাড়ায় সামনে। রাস্তাটা পুর্বমুখী। সুর্যোদয় হলে রোদ বরাবর মুখে লাগবে তাথৈয়ের। সে সময়টা দেখার জন্য আগ্রহী হয় তাথৈ। দালানের ফাঁকফোকড়ে উকি দেওয়া সূর্য আজ সবার আগে ওর চোখেমুখে লাগবে ভেবে এগোতে থাকে। কিন্তু কয়েকপা এগোতেই ‘আহ’ শব্দে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো ও। আস্তেধীরে চোখ খুলে ডানপা উচালো। উকি দিয়ে পায়েরদিক তাকিয়ে দেখে খালি পায়ে কাটা ফুটেছে। ব্যথার পরিবর্তে তাথৈয়ের তাচ্ছিল্য আসে নিজের ওপর। কতোদিন পর একদিন খালিপায়ে হাটতে বেরিয়েছে, কাটা ফুটে ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, তোর স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই। তাথৈ ওপরে তাকালো। তিনতলা ভবনের গা ছুয়ে বাগানবিলাস। ফুল ফুটে গোলাপী রঙে ছেয়ে আছে বাড়িটা। বাইরের গ্রিলে গোলাপ গাছও আছে। কাটাটা সেটারই। কানে আসলো ওপরতলা থেকে এক বৃদ্ধ স্বর গলা খেঁকিয়ে বলছে,

– বেলা বাড়লে মানুষজন আইবো। ফুলদানিগুলা এখনই পরিস্কার কইরা ফালা মফিজ। কাগজির গাছটাও বাইকা গেছে। একটু গ্রিলের পাশ থাইকা ছাড়ায়া দে।

তাথৈ নিচু হয়ে হাত বাড়ালো পায়ের কাটা বের করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার আগেই কেউ একজন ওকে জাপটে জরিয়ে ধরে। কোমড় জরিয়ে, শুন্যে তুলে ঘুরে ওঠে সে মানুষটা। ঠিক তখনই একটা গাছসহ মাটির ফুলদানি ওপর থেকে ওর পুর্বের অবস্থানে পরে, সশব্দে ভেঙে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় বাহাতে গলা আর ডানহাতে অজ্ঞাতজনের কাধের শার্ট খামচে ধরে তাথৈ। একপা উচিয়ে রাখায় শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সে মানুষটার ওপর। চোখ তুলে তাকায় ওকে জড়িয়ে রাখা মানুষটার দিকে। কিন্তু ভোরের প্রথম আলোতে তার চেহারা দেখেই মাথায় রক্ত চরে যায় ওর। ওকে জড়িয়ে নেওয়া মানুষটা অন্য কেউ নয়, সেরাতে ফ্লাইওভারে ওকে নানান কথায় প্রলোভিত করা যন্ত্রণা, তাশদীদ ওয়াসীর।

তাশদীদ স্তব্ধ। ও কল্পনাও করেনি ওর বাহুডোরে থাকা রমনী কোনোভাবে তাথৈ হতে পারে। সিনিয়র, জুনিয়র, ব্যাচমেটদের জন্য আগেররাতটা জাবির হলেই কাটাতে হয়েছে। সেখান থেকেই বাড়ি ফিরছিলো ও। লোকাল থেকে নেমে এখান থেকে অটোতে যেতে হয় ওদের বাড়ি। কিন্তু এতো সকালে অটো পাওয়া যায় না তেমন। তাই ভোরের সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করতে পায়ে হেটেই রওনা হয়েছিলো ও। হঠাৎ চোখে পরে ওর কিছুটা সামনে খালি পায়ে একটা মেয়ে হাটছে। পরনে কমলা রঙের গেন্জি, ঢোলা পায়জামা। সোজা চুলগুলো ছাড়া। পরিধান বাচ্চাদের মতো বলে, পেছন থেকে দেখে তাশদীদ বুঝে উঠতে পারলো না মেয়েটার বয়স কেমন হবে। হঠাৎই দেখে ওপরতলার একজন টব রেলিংয়ের ওপরে রেখেছে। বাগানবিলাসের বাকানো ডালটা গ্রিলের ফোকড় থেকে বের করার চেষ্টা করছিলো সে। অসাবধানতাবশত টবটায় লেগে ওটা নিচে পরে একদম মেয়েটার মাথার ওপরেই পরতে যাচ্ছিলো। কোনোমতে ছুটে এসে ওকে সরিয়ে নিয়েছে তাশদীদ। তখনও তাথৈয়ের চেহারা দেখেনি ও। কিন্তু কাধে নখের আঁচড়ের জন্য ব্যথা লাগতেই রমনীর মুখের দিকে তাকায়। আটকে যায় তার রুষ্ট দৃষ্টিতে।

ওপর থেকে গোলাপী বাগানবিলাস গায়েমুখে পরছিলো তাথৈ-তাশদীদের। ওটুকো সময়েই তাশদীদ অবাক হয়ে চেয়ে ছিলো তাথৈয়ের দিকে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অতি কাছে চলে আসা মেয়েটার বসে যাওয়া চোখে দৃঢ়তা, খোলা চুলে গাঢ় গোলাপী বাগানবিলাস আর রাগে একহাতে শক্তমুঠো করা ওর কলার। ঘুরে উঠে খানিকটা সরে এসেই তাথৈকে নামিয়ে ওর কোমড় ছেড়ে দিলো তাশদীদ। তাথৈ দাঁতে দাঁত চেপে ছলছল চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে। যার মানে, এই ভোরে, এই শহরে, তাশদীদের সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ চায়নি ও! তাশদীদ নিজেও বিমুঢ়। সারেন্ডার করার মতো করে দুহাত ওপরে তুলে নিলো ও। বললো,

– ওপস্। ভুল করে বাচিয়ে ফেলেছি।

তাথৈয়ের চোখ থেকে একফোটা জল গরায়। রাগে। পা তুলে পায়ের কাটা বের করে ও। তাশদীদ ওর পায়ের দিকে তাকালো। রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। ভেবে নিলো, সে ব্যথাতেই কাদছে তাথৈ। হাত নামিয়ে নিয়ে, ভ্রু কিছুটা কুচকিয়ে বললো,

– সামান্য কাটা ফোটার ব্যথায় কাদছেন৷ সুইসাইড করবেন কিকরে?

পুরোটা কানে গেলো তাথৈয়ের। আবারো তাশদীদের দিকে তাকালো ও। সূর্যোদয় হয়েছে। সকালের প্রথম রোদটাই মুখে পরেছে তাশদীদের। দুইপা এগিয়ে শক্তকন্ঠে বললো,

– আপনাকে বলেছিলাম আমার সামনে না আসতে।

– দেখুন ম্যাডাম, আমি জানতাম না এটা আপনি। আপনি যে পরিমানে সুইসাইডে আগ্রহী, তাতে এতোদিনে তো আপনার পোস্ট সুইসাইড খানাপিনার আয়োজন হয়ে যাবার কথা। তাছাড়া ঢাকার মধ্যে এতো সুন্দরসুন্দর ফ্লাইওভার থাকতে আপনি যে এই আশি বয়সের বুড়োর বারান্দার টবে মাথা ফাটিয়ে মরতে আসবেন, এটাই বা আমি কিকরে জানবো বলুন?

– আপনি…

– পৃথিবীর আটশ কোটির মানুষের মাঝে নিজেকে আর আপনাকে বাদ রেখে, বাকি সাতশ কোটি নিরানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার নয়শো আটানব্বই জনের মধ্যে একজনকে ভেবে আপনাকে বাচিয়ে ফেলেছি। এখন আপনি যদি এই হিউজ নাম্বারটাকে টক্কর দিয়ে আমার কোলে উঠে পরেন, সে দায় কার?

তাশদীদের স্বাভাবিক জবাব। তাথৈ কিছু বলতে যাবে, ওপর থেকে আওয়াজ এলো,

– শব্দ কিসের অইলো? কারো মাতায় পরলো নি টব? অ মফিজ? কারো মাতায় ফেললি নাকি?

চোখ তুলে ওপরে তাকালো তাথৈ। তৎক্ষনাৎ এক মাঝবয়সী লোকের মাথা সরে যেতে দেখে। উকি দিয়ে সে ওকে আর তাশদীদকেই দেখছিলো। তাথৈ চেচিয়ে বললো,

– এইভাবে কেউ টব রাখে? কেইস করবো আমি আপনার নামে! পুলিশ এসে কোমড়ে দড়ি দিয়ে টানতে টানতে পুলিশস্টেশনে নিয়ে যাবে, তখন জানবেন কারো মাথায় টব পরেছে কিনা!

তাশদীদ ঠোঁট টিপে হাসলো। ফুঁসে ওঠা মেজাজ নিয়ে তাথৈ ওরদিক ফিরতেই তৎক্ষনাৎ হাতজোড় করে বললো,

– আ্ আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন। আর কখনো ভুল করেও আপনাকে বাচাবো না। ইনফ্যাক্ট তার প্রয়োজনই পরবে না। সামনে একটা পথচারীদের ওভারব্রিজ আছে। সেখান থেকে বান্জীজাম্পিং ট্রাই করবেন চলুন। আসুন আপনাকে এগিয়ে…

কথা শেষ করার আগেই তাথৈ দুহাতে ধাক্কা লাগালো তাশদীদের বুকে। অপ্রস্তুত হওয়ায় ফুটপাত থেকে নিচে নেমে যায় তাশদীদ। তাথৈই হনহনিয়ে গিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। তাশদীদ ওর গাড়ির বরাবর দাড়ানো। উচু আওয়াজে বললো,

– জান বাচানোর বিনিময়ে জান লোগে কেয়া?

তাথৈ হাতের পিঠে ভেজা গাল ডলা মারলো। দম নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো ও। তাশদীদ হচকিয়ে যায়। দ্রুতগতির গাড়িটা কয়েকসেকেন্ডে একদম কাছে চলে আসে। কোনোমতে হুড়মুড়িয়ে সরে গিয়ে নিজেকে বাচিয়ে নেয় ও। তাথৈ কিছুটাদুরে গাড়ি থামায়। লুকিং মিররে দেখে তাশদীদ বড় দম নিচ্ছে। শার্টের গলার দিকের খোলা বাটনদুটো দিয়ে বুকে ফু নিলো। তাথৈ গাড়ি না ঘুরিয়েই উল্টোদিকে গাড়ি চালাতে লাগলো। তাশদীদের কাছাকাছি এসে গাড়িটা থামালো। তাশদীদ শার্ট ঠিকঠাক করছিলো। সামনে তাকাতেই তাথৈ শান্তভাবে বললো,

– আ’ম নট গোয়িং টু স্পেয়ার ইউ।

মুচকি হাসি দিলো তাশদীদ। তাথৈর গাড়িতে হাত ঠেকিয়ে বললো,

– আমারও মনে হয়না এই থৈ থৈ রাগ থেকে এতো সহজে রেহাই পাবো।

তাথৈ জানালার কাচ তুলে দিলো। হাত সরিয়ে পিছিয়ে দাড়ালো তাশদীদ। গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে ঢাকা অভিমুখে রওনা হলো ও। তাশদীদ কিছুক্ষণ প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে দ্রুতগতির গাড়িটা দেখলো। পরে হেসে, মাথা নাড়তে নাড়তে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৬.

অক্টোবরের ঘ্রাণ ছুটেছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে। শীতের আগমনী শহরের আনাচে কানাচে না পৌছালেও, নত তাপমাত্রা মাসের শুরুকে মনকাড়া করে তুলেছে। স্থির শান্ত পরিবেশে, পুবালী হাওয়া। বড়বড় অক্ষরের ‘মুক্তি ও গনতন্ত্র তোরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখাটা যেনো স্বপ্নের দুনিয়ায় প্রবেশপথ। যেখানে পথচারী হাজারো স্বপ্নবাজেরা। কার্জনের সামনের দাড়িয়ে আছে শার্লি আর রুমন। মুলত তাথৈ আসবে বলে অপেক্ষা করছিলো ওরা। শার্লি সাইকেলে বসে, রুমন পাশের নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে দাড়ানো। অনেকটা সময় পেরোলেও তাথৈয়ের খোজ নেই। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একপর্যায়ে শার্লি সাইকেল থেকে নেমে দাড়ালো। সাইকেল ঘুরাতে ঘুরাতে রুমনকে বললো,

– তুই দাড়া আমি আরেকটু এগিয়ে…

সাইকেল ঘুরানোর আগেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে থেমে যায় শার্লি। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে মেরুন টিশার্ট পরিহিত তুল্য ওর সামনে দাড়ানো। কাধে ব্যাগ, জিন্স, সাদা কেডস্। ওকে দেখেই তুল্য চেচিয়ে বললো,

– চোখ কই নিয়ে হাটিস তুই? সবসময় আমার গায়েই কেনো পরতে হবে তোকে?

‘একই প্রশ্ন আমিও তোকে করতে পারি তুল্য! সবসময় আমার গায়েই কেনো পরিস তুই?’
জবাব দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলো শার্লি। কিন্তু জবাব না পেয়ে রাগ হলো তুল্যর। পা দিয়ে ওর সাইকেলের চেইন চারা মারলো। খুলে পরে গেলো চেইনটা। ওটা দেখে শার্লির হুশ হলো, ও বাস্তবে কোনোপ্রকার জবাব দেয়নি তুল্যকে। যা বলেছে, কল্পনায়। দিবাস্বপ্নে। চেইন পরা সাইকেলটা দেখে কল্পনায়ই কয়েকটা ঘুষি ছুড়লো ও তুল্যর মুখে। রুমন পেছন থেকে হেলতেদুলতে বললো,

– ধাক্কাধাক্কি শেষ হলে একটু এদিকেও তো চোখ তুলে দেখো তুল্যবাবু? তোমায় দর্শন দেবে বলে দিনেরবেলা কার্জনে চন্দ্রমুখী ঘুরঘুর করছে যে!

– তোকে দেখার পর চোখ খুলে শহিদুল্লাহ হলের পুকুরে ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করছে। এই চেহারা নিয়ে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করা বন্ধ কর। খবিশমুখী কোথাকার!

একমুহুর্ত না দাড়িয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তুল্য। রুমন মাথা আর একহাত মাথার গাছে ঠেকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুর তুললো, ‘মিলন হবে কতো দিনে….’ শার্লি কিছুই বললো না। হাতঘড়িতে সময় দেখলো। সাইকেল আবারো দাড় করিয়ে, শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে বললো,

– শোন রুমন, অন্তু ভাইয়ের জন্য আজকেও যদি তাথৈ আমাদের ওপর রিয়্যাক্ট করে, আমি ঠিক করেছি আজ আমিও ওকে শুনিয়ে দেবো। ছাড় দেবো না! কি ভেবেছে টা কি ও? এক অন্তুর জন্য জীবনের সব সুখেরও অন্তিম সংস্কার করবে নাকি? হুদাই!

– আসছে মোর শিং ছাড়া সিংহাম!

শার্লি যতোটুকো আত্মবিশ্বাসে বলেছিলো, পুরোটাকে পরোটা বানিয়ে চিবিয়ে নিলো রুমন। শার্লি ওর দিক ফিরে মুখের হাতিয়ার ছুড়লো। জোর গলায় বললো,

– মার খাবি? না চুপ থাকবি?

– তুই চুপ থাক! যতোই বলিস তুই ছেলেদের মতো অনেক সাহসী ব্লা ব্লা, তাথৈয়ের সামনে ঠিকই ভিজেবিড়াল হয়ে যাস। সো আমাকে এসব শুনাতে আসিস না! হুহ!

রুমনের বিরক্তিভর জবাব। বিরক্তই বটে ও। কেননা তুল্য চলে যাবার সেকেন্ড বিশেকের মধ্যে অন্য নজরানায় আটকেছে ওর চোখ। তখন উঁকিঝুঁকি দিয়ে অন্য কাউকে দেখছিলো ও। হালকা নীল শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত এক সুঠামদেহী যুবক সবে পাশ কাটিয়ে গেছে ওদের। গলার পেছনে হাত বুলাতে বুলাতে, পেছন থেকে তার চলে যাওয়া দেখতে লাগলো রুমন। ওর গুরুত্বহীন জবাব শুনে শার্লি কঠোরচোখে তাকালো ওর দিকে। বললো,

– তুই আমাকে ভীতু বললি?

– তুই ওইটাই।

তেতে উঠে রুমনের পান্জাবীর কলার চেপে ধরে শার্লি। কম ওজনের বলে ওটুকেতেই পুরো শরীর ঝাকি দিয়ে ওঠে রুমনের। শার্লি ওর কলার ঝাঁকিয়ে, ঝাঝালো গলায় বললো,

– তোকে চুপ থাকতে বললে, চুপ থাকবি। বেশি বকবক করবি তো মুক্তিবেগে ছুড়ে একদম দুনিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দেবো। আর তুইও জানিস, ছোড়াছুড়িতে আমি কেমন। শোরুম আল হাসানের বোলিংও আমার ধারেকাছে নাই!

রুমন ঢোক গিললো। টের পেলো সত্যি বলাটা উচিত হয়নি ওর। নমনীয় হয়ে শার্লির হাত থেকে কলারটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। সামাল দিতে জোরালো হেসে বললো,

– ত্ তুই যদি সাহসীই হবি, তাহলে ওই ফার্স্টইয়ারের ছেলেটা কেনো তোকে ভয় পেলোনা? কেনো তোকে সালাম না দিয়ে ওমন ডোন্ট কেয়ার ভাবে চলে গেলো? যা পারিস সব আমার সাথেই না? ওটাকে ধর?

শার্লি রুমনকে ছেড়ে দিলো। তারপর ওর বলা ছেলেটার দিকে তাকালো। সত্যিই সে আঙুলের ওপর বই ঘুরিয়ে, মনের সুখে শীষ বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। শার্লির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বললো, শীষ বাজিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার মতো এতো সুখ, ও কেবল ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদেরই হয়। যেহেতু রুমন ওর সাহসের পরিচয় চাচ্ছে, সেটার জন্য ছেলেটাকে ডাক লাগাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো শার্লি। ফার্স্ট ইয়ার হয়েও ওদেরকে সালাম না দিয়ে পাশ কাটালো, সে দোষে ছেলেটাকে পাকড়াও করাই যায়। গলা উচিয়ে বললো,

– ওয় ফ্রেশার?

রুমন বাহাত বুকে গুজে ডানহাতে থুতনি চেপে ধরলো নিজের। বিরবিরিয়ে বললো, ‘পালাট!’ শার্লির উচ্চস্বরের পিছুডাক শুনে তাশদীদ থামলো। ঢাবিতে আজ ওর প্রথমদিন। ক্লাস শুরু আজ থেকেই। ভার্সিটির বাস থেকে শুরু করে কার্জন, পুরোটার জন্য এখনো মনপ্রাণ পুলকিত হয়ে আছে ওর। একদম অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ফিল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকেছে ও। দেরিতেই সই, ওউ এখন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থী৷ পরক্ষনেই তাশদীদের মনে পরলো, ও ফ্রেশার না। ও আগের সেশনের, মাস্টার্স করতে এসেছে। সুতরাং ওকে কেউ ফ্রেশার বলবে না। তাই হাতের সরু বইটা ডানহাতের শাহাদত আঙুলে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে, ঠোঁটে শীষ তুলে আবারো হাটা লাগালো তাশদীদ। ওর ওমন গা ছাড়া ভাব দেখে কপাল কুচকালো শার্লি। আরো জোরে চেচিয়ে বললো,

– ওয় নীল শার্ট? ডাক কানে যায় না?

তাশদীদ থামলো। নীল শার্ট মানে ওকেই ফ্রেশার বলা হচ্ছে। হেসে পেছন ফিরলো ও। তারপর সভ্য ছেলেটার মতো পা বাড়ালো শার্লি-রুমনের দিকে। ওকে দেখেই রুমন খপ করে শার্লির হাত ধরে ফেললো। জড়ানো কন্ঠে বললো,

– পোলা তো নয় যেনো আগুনের গোলা। একে কাছে ডাকিস না শার্লি। এই আগুন আমার থেকে দুরে রাখ। ঝলসে যাবো। পুড়ে যাবো। ছাই হয়ে যাবো।

শার্লি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর মাথায় ঠাস করে চড় লাগালো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রুমন কিছুটা দমে রইলো। শার্লি মারটা বেশ জোরে লাগিয়েছে। তাশদীদ এগিয়ে এসে খানিকটা নিচু হয়ে, অতি সুন্দরভাবে বললো,

– জ্বী আপু?

শার্লির কপাল শিথিল হলো। মানে তাশদীদের ভদ্রতা ওকে এটুক শান্তনা দিয়েছে যে, ওর কঠোরতায় যেকেউ ভয় পায়। রুমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাশদীদের দিকে। শার্লি তাশদীদের হাত থেকে বইটা নিলো। গলা ঝেরে, ভাব নিয়ে বললো,

– এহেম। ক্ কি নাম তোমার?

– তাশদীদ ওয়াসীর।

– দেওয়ানা হলাম ওই কিউট হাসির।

মুগ্ধস্বরে রুমনের কথাটা স্পষ্ট শুনলো তাশদীদ। শার্লি তৎক্ষনাৎ ওর পায়ে পারা লাগালো। আউচ শব্দে পা চেপে ধরে রুমন। ব্যথা লুকোতে, মুখ চেপে ধরে কাশি দেয় দুটো। তাশদীদ হাসি বর্ধিত করে, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

– কি মিষ্টি আওয়াজ, আপনার কাশির।

তাশদীদ কি বললো না বললো, তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই রুমনের। মন্ত্রপূত মানবের মতো তাশদীদের হাতে হাত রাখে ও। শার্লি দ্রুততার সাথে হাত ছাড়িয়ে দেয় ওদের। তাশদীদকে বলে,

– এ্যাঁই, একদম অতিভক্তি দেখাবা না! ক্ কোন ডিপার্টমেন্ট তুমি?

– আব্ প্রাণরসায়ন আপু। সবে এডমিট হয়েছি।

তাশদীদের জবাব শুনে খুশি হয়ে গেলো শার্লি। বললো,

– ও! ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র। শুনো! আমি তোমার ডিপার্টমেন্টেই। দুইব্যাচ সিনিয়র বুঝছো?

তাশদীদ ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। পরপরই অতি গম্ভীর মুখ বানিয়ে মাথা দুলালো। মানে ও সব বুঝেছে। তবে শার্লি ওর হাতের বইটা দেখে কিছুটা অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো। বললো,

– এইটা কোন সেমিস্টারের বই? ফার্স্ট সেমিস্টারে এসব ছিলো?

– পড়াশোনা করেছিস কিছু যে মনে থাকবে?

পেছন থেকে বিরবিরিয়ে বললো রুমন। তাশদীদ ঠোঁট চপে ধরে হাসি আটকাতে গিয়ে চোখও বন্ধ করে নিলো এবারে। শার্লি লক্ষ করলো, হাসি আটকানোর তীব্র চেষ্টারত সে। রাগী আওয়াজে বললো,

– হোই মহাশয়? তোমার সাহস তো কম না! একদিনে ক্যাম্পাসে এসেই সিনিয়রকে নিয়ে হাসছো?

তাশদীদ ভয় পাওয়ার মতো করে তৎক্ষনাৎ চুপ হয়ে যায়। শার্লি তীক্ষ্ম নজরে ওরদিক তাকিয়ে বললো,

– আপাতত যাও। তিনজন ফ্রেন্ড বানিয়ে, তাদের সাথে এসে বইটা নিয়ে যেও। বুঝেছো?

তাশদীদ মাথা ওপরনিচ করলো। নবীনদের স্বাগত জানানোর প্রক্রিয়া ওর অজানা না। আগের ক্যাম্পাসে চার চারটে ব্যাচ সামলে এসেছে ও। এইযে শার্লি ওকে আরো তিনজন বন্ধু সমেত আসতে বললো, এরমানে আরো তিনচারজনের কাছ থেকে আনুগত্য আর সম্মাননা চাই ওর। সেটা বুঝতে বাকি রইলো না তাশদীদের। ছোট একটা দম নিলো ও। যে শার্লি ওকে দুইবছরের সিনিয়র বলে এমন ডাঁট সাট দেখাচ্ছে, তিনঘন্টা পর যখন ওর সামনে ওরই দুই বছরের সিনিয়র হয়ে তাশদীদ দাড়াবে, তখন কি হবে? মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে তাশদীদ চলে গেলো ওখান থেকে। রুমন শার্লির কাছ থেকে বইটা নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। বললো,

– ভালো করেছিস আসতে বলে। হ্যান্ডসামের সাথে আরো একবার দেখা হয়ে যাবে।

রাগে রুমনের গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিলো শার্লি। তখনই পাশ থেকে আওয়াজ এলো,

– শার্ট জিন্সে তোকে অনেক মানায় শার্লি।

শার্লি পাশ ফিরলো। চার পাঁচটে ছেলে পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো ওদের। সবার সামনের ছেলেটার নাম আফিফ। বিশ্রি হাসিসমেত কথাটা ওই বলেছে। ওর কথায় বাকিরাও হাসছে। কিন্তু দু সেকেন্ডের মধ্যে চুপ হয়ে গেলো সব। হাটতে হাটতেই আফিফ মুখ থুবড়ে পরে গেছে ইট বিছানো পথে। শার্লি অবাক হলো। ছেলেগুলো কিছুটা সরে দাড়াতেই ওর চোখ পরলো ওপরপাশে দাড়ানো তাথৈয়ের দিকে। পরনে হাটুর ওপর অবদি লম্বা লাল সাদা রঙের গোলাকার কুর্তি, জিন্স। উচুতে ঝুটি করা। বুকে হাত গুজে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে ও। বিশ্বজয়ের হাসি দিলো শার্লি। ওর বুঝতে বাকি নেই, ওকে বাজে কথা বলার দায়ে তাথৈ আফিফকে পা বাঝিয়ে ফেলে দিয়েছে। বড়বড় পা পেলে আফিফের সামনে গিয়ে দাড়ালো ও। রুমনও এগোলো। তাথৈ বুক থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,

– শার্লির পায়ের নিচে তোকেও বেশ মানাচ্ছে আফিফ।

আফিফ ঠোঁটে আঙুল ছুইয়ে দেখে সেখানে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। মাটিতে পরে দাঁতের আঘাতে কেটে গেছে বোধহয়। রাগ নিয়ে উঠে দাড়ালো ও। উচ্চতায় বেশ বড় মানুষটাকে ওভাবে দাড়াতে দেখে রুমন শার্লির কিছুটা পেছনে গিয়ে দাড়ালো। আফিফ তাথৈয়ের দিকে আঙুল উচিয়ে বললো,

– তুই দিনকেদিন সীমাপার করছিস তাথৈ! এর জন্য একদিন প্রচুর পস্তাতে হবে তোকে। তোর…

আফিফের বলা শেষ করার আগেই ওর পাশেরজনের হাতের সিগারেটটা কেড়ে নিলো তাথৈ। আফিফের তাক করে রাখা আঙুলে ছোঁয়ালো সিগারেটের জ্বলন্ত ডগাটা। তৎক্ষনাৎ আঙুল নামিয়ে নিতে বাধ্য হলো আফিফ। তাথৈ একহাত বুকে বাঝিয়ে, তাতে সিগারেট ধরে রাখা হাতের কনুই ঠেকিয়ে, শান্তশিষ্টভাবে বললো,

– ডোন্ট ইউ ডেয়ার আফিফ। আমাকে তাক করা ভালো কথাকেও আমি ছাড় দেইনা। আর সেখানে তোর আঙুল তো…

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কিছুক্ষণ তাথৈয়ের দিকে চেয়ে রইলো আফিফ। তাথৈ বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলোনা৷ ঘাড় কাৎ করে, আগ্রহভরে তাকিয়ে রইলো আফিফের দিকে। আফিফ ওর দলবল নিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে। শার্লি বললো,

– এই ছয় ফুটের দানবটাকে একদিন বেধরক পেটাতে পারলে প্রচুর শান্তি লাগতো। শয়তান একটা!

রুমন হেসে বললো,

– ও তোর দ্বারা হবেনা। কিন্তু তুই একদম উচিত জবাব দিয়েছিস তাথৈ! তোর জবাবও তোর মতো! পার্ফেক্ট!

ওর কথা তাথৈয়ের কানে গেলো না। ও ওর হাতের সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে। কি সুন্দর ফোমের নলের মতো বস্তুটার ওপরিভাগ জ্বলছে। খালিচোখে দেখা যায় সেটা। যেখানে যাই কিছু জ্বলুক, তা সবার চোখে পরে। কিন্তু মনের ভেতর জ্বলা তুষের অনল, হৃদয়ের রক্তক্ষরন, বিষাক্ত জীবনে জ্বলা অঙ্গার, তা কারো চোখে পরে না। কেউ দেখে না সে দহন। কেউনা!
বই ফেরত নিতে এসে, কিছুটা দুরেই থেমে গেলো তাশদীদ। প্রথমসেকেন্ডে ও অবাক হয়েছিলো ক্যাম্পাসে তাথৈকে দেখে। কিন্তু পরেরমুহুর্তে আটকে যায় তাথৈয়ের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখে। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাথৈকে দেখে নিয়ে, পিছন ফিরলো তাশদীদ। জোরপূর্বক হাসলো ও। একপলক সাদামেঘের আকাশের দিকে তাকিয়ে, হাটা লাগালো নিজের ক্লাসের উদ্দেশ্যে। ওর আনমনা মনটা হয়তো বলে উঠলো, ‘শি ইজ নট ইওর টাইপ তাশদীদ। শি ইজন নট ইওর টাইপ এট অল!’

#চলবে…