কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
148

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৩.

তাশদীদ বাস্কেটবল কোর্টের এককোনে পেছনে হাত রেখে বসে। কোর্টের মাঝে ওদের দল হৈ হুল্লোড় করছে। আনন্দের মাত্রাটা ওদের একটু বেশিই। অবশ্য তার কারনও আছে। প্রথমার্ধের খেলায় যে দল ১৬-৯ ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলো, সেই দলই দ্বিতীয়ার্ধের পর ২১-৩২ এ এগিয়ে যাবে, তা কারোরই কল্পনায় ছিলো না। কিন্তু সেটাই হয়েছে। তাও আবার কার জন্য? যে তাশদীদ প্রথমার্ধে একটা বলও বাস্কেট করেনি, সেই তাশদীদের জন্য। দ্বিতীয়ার্ধে হওয়া ২৩ টা বলের ১৭ টা বাস্কেট তাশদীদ একাই করেছে। ওদের টিমের ক্যাপ্টেন ছিলো শান্ত। জয়ের আনন্দে সবাই মিলে কোর্টে নাচানাচি করছে। তাশদীদ নিচে বসে জুতা খুললো। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে তাথৈ-তুল্যকে খুজলো। দুই ভাইবোন পুরোটা খেলা দেখেছে। ওর জয়টা যে ওদের দুজনের কারো হজম হয়নি, সেটা খুব ভালোমতোই জানে তাশদীদ। অগ্নিশর্মা মুখদুটো দেখার খুব ইচ্ছে করছিলো ওর। কিন্তু দুভাইবোনের একটাও নেই আশেপাশে। হঠাৎই পাশ থেকে আওয়াজ এলো,

– জিতে তো গেলেন ভাইয়া। এবার?

তাশদীদ ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। কমলা রঙের পান্জাবী পরিহিত রুমনকে দেখে কপাল কুচকে একটা জোরালো হাসি দিলো ও। বললো,

– হ্যাঁ? কিছু বলতে চাও তুমি?

প্রশ্নটা শুনে রুমনের হাসি সবটুকো গায়েব হয়ে যায়। গলার দুপাশে ঝুলানো খয়েরি সরু চাদরটা টেনে বরাবর করে ও। এরইমাঝে টিটু এগিয়ে আসে। রুমনকে দেখে হেসে বলে,

– কিরে সুন্দরী কমলা? তুই তাথৈয়ের বান্ধবী না?

তাশদীদ কিছুটা শাষনমিশ্রিত চাওনিতে ওর দিকে তাকালো। টিটু সামলে যায়। গলা ঝেড়ে আবারো বললো,

– কিরে রাজকুমার কমলালেবু? তুই তাথৈয়ের বন্ধু না?

– হ্যাঁ।

জবাব দিয়ে মুখ ভেঙচালো রুমন। বুকে হাত গুজে অন্যদিক তাকালো। টিটু শব্দ করে হেসে দিলো ওর ভঙিমা দেখে। তাশদীদ কোনোমতে হাসি আটকে পাশ থেকে পানিরবোতল ছুড়লো ওর দিকে। ইশারা করলো কোর্টে যেতে। টিটু হাসতে বোতলটা ক্যাচ করে নিয়ে চলে গেলো। তাশদীদ উঠে দাড়ালো। রুমনকে বললো,

– তুমি তাথৈয়ের ফ্রেন্ড? তাহলে তো মনেহয় তুমি তুল্যরও ফ্রেন্ড?

হুট করেই লাজুকলাজুক ভঙি দেখাতে শুরু করে রুমন। কানের পিঠে চুল গোজার মতো করে বলে,

– হুম। তুল্যবাবুরও ফ্রেন্ড আমি।

– আর তোমার এই দুই ফ্রেন্ড কোথায়? কিছুক্ষণ আগেই তো খেলা দেখছিলো।

– ওরা চলে গেছে।

তাশদীদ মৃদ্যু হাসলো। নিচে থাকা ব্যাগটা তুলে কাধে নিলো। তারপর রুমনের কাধে হাত রেখে বললো,

– ওকে। ভালো থেকো তবে। আমাকে যেতে হবে এখন।

রুমন মাথা ওপরনিচ করলো। তাশদীদ আগে কোর্টের মাঝে গেলো। সবার সাথে সেকেন্ড পাঁচেক নাচানাচি করে ড্রেসিং রুমে চেইন্জ করে নিলো। চেইন্জ করতে গিয়ে আবারো বুকের দাগটা চোখে পরে ওর। তাশদীদ নিশব্দে হেসে নিজেনিজেই বললো, ‘আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে আঘাত করতে আসলে আমি ভালোবেসে আঘাত করতে জানি ম্যাডাম। তোমার দেওয়া আঘাত ক্ষণস্থায়ী। বাট ট্রাস্ট মি, আমার দেওয়া আঘাত হবে এভারলাস্টিং। চিরস্থায়ী।’
মাগরিবের কিছুটা আগে তাশদীদ বাড়ি পৌছালো। ঘরে না ঢুকে বারান্দায় ব্যাগটা রাখলো ও। তামজীদ তখন ওয়াশরুমে ওযু করছিলো। ওযুশেষে বেরিয়ে দেখে তাশদীদ ভেতরে না ঢুকে টিশার্ট গ্রিলে ঝুলাচ্ছে। তামজীদ তোয়ালেতে হাতমুখ মুছতে মুছতে বললো,

– বাইরে কেনো চেন্জ করছিস?

– পুকুরে যাবো। আজ পুকুরে গোসল করবো।

– কি এমন হয়েছে টিউশনিতে যে তোর বাসায় ফিরেই গোসল করতে হবে?

তাশদীদ কেবল একটা লুক দিলো। তামজীদের আর জবাবের প্রয়োজন হলো না। বিরবিরিয়ে ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ পরে আবারো ওয়াশরুমের দিকে এগোলো ও। ওযু করতে। বাহ্যিক ওযু না ভাঙলেও ওর মনের ওযু ভেঙে গেছে। তাশদীদ গলা উচিয়ে বললো,

– মা? বাবার পলিশ করা জুতাটা বের করে রেখো।

তামজীদ কুলি করতে করতে ট্যাপের পানিই কয়েকঢোক খেয়ে নিলো। আজ আর রক্ষে নেই। পলিশ করা জুতা আজ কপালে নাচছে ওর। তাশদীদ বাড়ির পেছনদিকটায় চলে আসলো। সন্ধ্যের আগের লাল আভায় গোটা পশ্চিম আকাশ ভরে আছে। সিড়ি বেয়ে নেমে, ঝাঁপ দিলো ও পুকুরের পানিতে। তামজীদ ওযু শেষ করে বেরোতেই শোনে বারান্দায় থাকা ব্যাগে, তাশদীদের ফোনটা বাজছে। হাতমুখ মুছে ফোনটা বের করে ও। কিন্তু নম্বরটা দেখেই খিচে চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলে, ‘আরেক আসতাগফিরুল্লাহ!’ তামজীদ ফোন হাতে মায়ের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললো,

– মা? রিংকি আপু ফোন করেছে।

মিসেস ওয়াসীর জামাকাপড় ভাজ দিচ্ছিলেন। ছেলের কাছ থেকে ফোন নিলেন উনি। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে রিংকি বললো,

– আজকে পড়াতে আসবেন না তাশদীদ ভাই?

– আব্ রিংকি? আমি আন্টি বলছি। কেমন আছো?

– ওহ আন্টি? স্লামালাইকুম। কেমন আছেন?

– হ্যাঁ মা আছি ভালোই। তেমার বাসার সব ভালো?

– জ্বী আন্টি। আন্টি তাশদীদ ভাই?

– তাশদীদ তো গোসলে। সবেই ফিরেছে বাসায়।

– ও। আচ্ছা আন্টি। ভাইকে একটু বলবেন আমি কল করেছিলাম।

– হ্যাঁ। বলবো। আর তোমরা সময় করে এসো প্রীতিকার্নিশ। অনেকদিন আসোনা।

‘খাল কেটে কুমির’ আনা ব্যাপারটা চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে তামজীদের মুখ বড়সর হা হয়ে যায়। মাকে থামাতে যাবে, পরপরই ওর পলিশ করা জুতার কথা মনে পরে। আর মাকে বারণ করলো না তামজীদ। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে টুপিটা নিয়ে রওনা হলো মসজিদের দিকে। মনেমনে মনেমনে বলতে লাগলো, যেহেতু মারের হাত থেকে বেচে গেছি, আজকে দু রাকাত নফল বেশি পরবো। ওপাশে রিংকিও খুশি হয়ে যায়। উচ্ছল কন্ঠে বলে,

– বলছেন প্রীতিকার্নিশ আসতে?

– হ্যাঁ। আর বলতে হবে কেনো? যখন ইচ্ছে করে চলে আসবে।

– ঠিকাছে আন্টি।

কল কেটে ফোন কান থেকে নামিয়ে নিলো রিংকি। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবলো ও। পরে গলা উচিয়ে ডাক লাগালো মাকে। রিংকির মা তখনতখন ছুটে আসলো। এসে দেখে রিংকি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করছে। লিপস্টিক দেওয়া শেষে মাকে দেখে রিংকি বললো,

– রেডি হও। প্রীতিকার্নিশ যাবো।

– এখন? এখন প্রীতিকার্নিশ কেনো?

– আজকে তো তাশদীদ ভাইয়ের পড়াতে আসার কথা। উনি আসলেন না। তাই আমিই দেখা করতে যাবো।

– কিন্তু তোর বাবা তো বাসায় নেই। বাসায় রোজি একা।

– কই ও?

– ঘুমাচ্ছে।

– ঘুমাতে দাও। ও ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই আমরা চলে আসবো।

– কিন্তু রিংকি…

রিংকি মায়ের কথাকে পাত্তা দিলো না। পার্স আর মোবাইলটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বললো,

– তুমি না গেলেও সমস্যা নেই। আমি একাই যেতে পারি। যদি যাও পাঁচমিনিটে নিচে আসো।

রিংকি বেরিয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা পরলেন মহাবিপাকে। রিংকিকে ছোটবেলা থেকে স্কুলকলেজে তিনিই আনা নেওয়া করেছেন। বেলা ডুবেছে। মাগরিবের আযান পরবে। এসময় মেয়েকে একা ছাড়া মোটেও তার পক্ষে সম্ভব না। এদিকে রোজিকেও একা বাসায় ছাড়া যাবেনা। উপায়ন্তর না দেখে স্বামীকে কল লাগালেন তিনি।

সন্ধ্যেবেলা তৈয়ব আলফেজ বাসায় ঢুকে দেখেন তুল্য ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে টম এন্ড জেরি দেখছে আর সিগারেট টানছে। সামনের টি টেবিলে এ্যাশট্রে। সেখানে শেষ হওয়া ছয় সাতটা সিগারেট। পুরো ড্রয়িংরুম সিগারেটের গন্ধ ভরে আছে। দুবার কাশি দিলেন তৈয়ব আলফেজ। ঘাড় উচিয়ে তাকালো তুল্য। হাতের সিগারেট নিভিয়ে, পাশ থেকে এয়ার ফ্রেশনার নিলো ও। সোফায় বসে আশেপাশে স্প্রে করলো ওটা। তারপর উঠে এলোমেলো পায়ে বাবার পাশে আসলো। হেলতেদুলতে বাবার আশেপাশেও স্প্রে করলো কয়েকবার। তারপর কয়েকপা পিছিয়ে আতকে ওঠার মতো করে বললো,

– ওপস্! তৈয়ব আলফেজের তো সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয়না। এবার ঠিকাছে মিস্টার আলফেজ? আর স্মেল পাচ্ছেন সিগারেটের?

তৈয়ব আলফেজ জবাব দিলেননা। তুল্যর খোচাটা গায়েও লাগালেন না। কেননা দৈনিক তুল্যর সমসংখ্যক সিগারেট তিনি নিজেও শেষ করেন। ভারী গলায় বললেন,

– তাথৈ কোথায়?

– হেহ! আমার সামনে নাটক করবেন না তো মিস্টার আলফেজ। ফর গডস সেক! আমার সামনে নাটক করবেন না। মেয়ের খবর নেওয়ার ঢংটা আমার সামনে না দেখালেও চলবে!

তাচ্ছিল্য করে বললো তুল্য। আবার গিয়ে বসলো সোফায়। টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়ে স্প্রাইটের কাচের বোতলে চুমুক দিলো। তৈয়ব আলফেজ পুরো অম্বুনীড় কাপিয়ে হুংকার ছাড়লেন,

– রফিজ?

মধ্যবয়স্ক একটা লোক ছুটে আসলেন। তৈয়ব আলফেজ তাকে বললেন,

– তাথৈ ফেরেনি?

– ফিরেছিলো ভাই। এসে দেখে ওর গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। গাড়ি নিয়ে আবার বেরিয়েছে।

এটুক শুনে আর দাড়ালেন না তৈয়ব আলফেজ। সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন তিনি। তুল্য টিভির দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ওর মন অন্যত্র। তাশদীদের খেলার পদ্ধতি ওর মাথায় চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্প্রাইটের বোতলে চুমুক দিতে দিতে মনেমনে ভাবতে লাগলো, ফাইনালে গেইমপ্লান কি রাখবে। এটাক নাকি ডিফেন্ড। ঠিক সেসময়েই কল আসে ওর নাম্বারে। সেখানে থাকা নামটা দেখে মেজাজ আরো বিগড়ে যায় তুল্যর। আফিফ। পড়াশোনা বা অন্যকোনো কারনে তুল্যর তেমন কারো সাথে যোগাযোগ নেই। কিন্তু বাস্কেটবল টিমে আছে বলে ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। কল রিসিভ করলো তুল্য। ওপাশ থেকে আফিফ বললো,

– এই মুহুর্তে আমার নাম্বারে পনেরো হাজার টাকা সেন্ড মানি কর তুল্য। তোর বোন আমার গাড়ির পেছনের দুটো হেডলাইটই ভেঙে দিয়েছে।

বলা শেষ করার আগেই আবারো কাচভাঙা আওয়াজ আসে আফিফের কানে। চমকে উঠে গাড়ির সামনের দিকটায় তাকায় ও। স্কেটিং স্টিক মাটিতে ঠেকিয়ে, একপায়ে আরেকপা মুড়িয়ে দাড়িয়ে আছে তাথৈ। সামনের হেডলাইটদুটোও ভাঙা আফিফের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। তাথৈ স্বাভাবিক গলায় বললো,

– পনেরো হাজার আরো এড কর। তোর গাড়ির সামনের হেডলাইটদুটোও…

বলা শেষ না করে শীষ বাজিয়ে শেষ বুঝায় তাথৈ। ওর গলা শুনেই তুল্য কল কেটে দেয়। আপনাআপনিই কান থেকে ফোন নেমে আসে আফিফের। তাথৈ বললো,

– তুই আমার গাড়িতে হাত লাগাবি, আর আমি তোর গাড়িকে ছেড়ে দেবো, তা কি করে হয় বলতো আফিফ?

– আ্ আমি তোর গাড়ি ধরতে যাবো কেনো?

প্রশ্ন করে বিচলিত হয়ে পরে আফিফ। তাথৈ সোজা হয়ে দাড়ায়। এগিয়ে এসে ওর গাড়ির জানালায় স্টিক ঠেকায়। আস্তেআস্তে ঠুকাতে ঠুকাতে বলে,

– ধরিসনি?

– তুই করিসনি? তাহলে কে করেছে? তোর ছুটকো চেলা নয়ন?

আফিফ বিস্ময়ে তাকালো। নয়ন নামক এক মেকানিককে দিয়ে তাথৈর গাড়িতে সাতপাঁচ ওই করিয়েছিলো। আর সত্যিটা তাথৈ জানে এটাতে আর সন্দেহ নেই ওর। তাথৈ কিছু করার আগে ওই দ্রুততার সাথে বললো,

– দ্ দেখ তাথৈ…

তাথৈ ওকে সুযোগ দেয়না। জোরেসোরে বারি লাগায় গাড়ির কাচে। গাড়ির জানালা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো আফিফ। আজকের দিনের ওর সবচেয়ে ভালোলাগা ছিলো তাথৈকে ক্যাম্পাসে গাড়ি ছাড়া দেখা। মনের সুখে লংড্রাইভে বেরিয়েছিলো ও। কিন্তু এখন ওর গাড়িটারই বেহাল দশা৷ তাথৈ ওর হতভম্ভ অবস্থাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলো না। গিয়ে নিজের গাড়িতে ওঠে ও। ড্রাইভ করে আফিফের পাশে এসে থেমে বললো,

– লোকে বলে ইটটা মারলে পাটকেলটা খেতে হয়৷ এসবে বিশ্বাস করে আমাকে ইট মারতে আসিস না আফিফ। ইট খেয়ে আমি তোকে ইটের টুকরো ছুড়তে যাবো না৷ আমার জবাবের পরিধি আরো বিস্তর। বি কেয়ারফুল আফিফ। ইট মারার দায়ে, পুরো ইটের দালানটাই না তোর ওপর ধ্বসে পরে।

চোয়াল শক্ত করে গাড়ি স্টার্ট দিলো তাথৈ। তীব্র গতিতে গাড়ি চালাতে লাগলো। সবই ঠিক আছে। তারপরও কোথাও কিছু একটা ঠিক নেই। সত্যিই তো এটাই, ওর জবাবের পরিধি আর বিস্তর নেই। ওর অজান্তেই সে সীমার ব্যতিক্রম ঘটেছে। আর সে ব্যতিক্রমী সীমার নাম, তাশদীদ ওয়াসীর।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৪.

তাশদীদ মাথায় তোয়ালে চালাতে চালাতে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। কিন্তু ঘরের ভেতর রিংকিকে দেখেই থেমে গেলো ওর হাত। পড়ার টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটায় পিঠ ঠেকিয়ে, বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে রিংকি। কালো ট্রাউজার আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত তাশদীদকে আপাদমস্তক দেখে নিলো ও। তারপর সোজা হয়ে দাড়ালো। ওর চাওনি দেখে প্রচন্ড পরিমানে বিরক্ত হয় তাশদীদ। হালকা ভেজা তোয়ালেটা ওয়ারড্রোবের ওপর রেখে, বিছানা থেকে টিশার্ট হাতে নিলো ও। গায়ে পরে স্পষ্ট গলায় বললো,

– তুমি এসময় এখানে কেনো?

– আন্টি বলেছে আমার এ বাসায় আসতে কারন লাগবে না। আপনার রুমে আসতে আমার কারন লাগবে কিনা, সেটা জানতে এসেছি তাশদীদ ভাই।

– কারো রুমে আসতে কারন লাগে না, রুমের মালিকের অনুমতি লাগে। পরেরবার থেকে এই আদবটা মনে রেখো। সে যার রুমেই যাও না কেনো।

মেজাজ পুরোদমে খারাপ নিয়ে জবাব দেয় তাশদীদ। ওর চেহারা দেখে বুঝলো রিংকি। যে ছেলে হাসি ছাড়া কারো সাথে কথা বলেনা, তার রাগী চেহারাটা চোখে পরার মতোই হয়। তবুও পুর্ন আত্নবিশ্বাস জুটিয়ে বললো,

– আম্মু এসেছে। আন্টির সাথে নাকি দরকার আছে তার। একা আসবে না তাই আমাকে সাথে নিয়ে এসেছে।

নামাজের টুপি আর ওয়ালেট হাতে নিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলো তাশদীদ। বারান্দায় এসে দেখে ওর মায়ের সাথে মিসেস সৈয়দ বসে আছে। তাশদীদ তাকে সালাম দিলো। ভদ্রমহিলা উত্তর নিয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তাশদীদ বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,

– এসে কথা বলছি আন্টি। বসো।

চলে গেলো ও। রিংকি রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে গেলো। সেখান থেকে ড্রাইফ্রুটের বয়াম নিয়ে এসে মায়ের সোফার হাতলে বসলো। মিসেস ওয়াসীর হাসিমুখে বললেন,

– কিছু খাবে বলে কিচেনে গিয়ে, তুমি খুজেখুজে এটা নিয়ে আসলে রিংকি? আমিতো বললাম কি খাবে বলো, আমি এনে দিচ্ছি।

– আ’ম ডান আন্টি।

বাইরেরদিক তাকিয়ে বললো রিংকি। ওর ঠোঁটে মুচকি হাসি।
তাশদীদ নামাজ শেষে দ্রুতপদে বাসার দিক এগোচ্ছিলো। তামজীদ মসজিদ থেকে বেরিয়ে হুড়মুড়িয়ে জুতা পরলো। তাশদীদের পাশে হাটতে হাটতে বললো,

– এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছিস? স্টুডেন্ট পড়াতে?

– না। বাবার আরেকটা জুতা পলিশ করতে।

ভাইয়ের জবাব শুনে তামজীদ থেমে যায়। শুকনো ঢোক গেলে একটা। আবারো ছুটে এসে তাশদীদের সাথে পা বাড়িয়ে বলে,

– বিশ্বাস কর ভাইয়া, আমি মাকে বলেছিলাম রিংকি আপুকে অহেতুক দাওয়াত না দিতে! জানতাম ও মার কথাকে সিরিয়াসলি নেবে! আমি আটকেছিলাম মাকে! বিশ্বাস কর!

একপলক ভাইয়ের দিকে তাকালো তাশদীদ। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবারো হাটা লাগালো। আপাতত ওর মাথায় একটা বিষয়ই ঘুরছে, রিংকির বিষয়ে ওর মা-বাবাকে জানানো। যেহেতু আজ মিসেস সৈয়দ প্রীতিকার্নিশ এসেছেই, ও আজই বলবে তাকে, রিংকির চিন্তাভাবনা ঠিক না। ও আর ওকে পড়াতে যাবে না। বাসায় ঢুকে তিন নারীকে নিজের ঘরেই পেলো তাশদীদ। রিংকি আর ওর মা বিছানায় বসে কথা বলছে। সামনের ট্রে তে ফলের টুকরো, চানাচুর, বিস্কিট। রিংকি পড়ার টেবিলের এটা ওটা ধরছে, দেখছে, আবার যথাস্থানে ঠিকঠাকমতো রেখে দিচ্ছে। তামজীদ ভাইয়ের চেহারায় মোটেও সন্তুষ্টি খুজে পেলো না। আগেআগে ভেতরে ঢুকে ট্রে থেকে আপেলের টুকরো মুখে পুরলো ও। মিসেস ওয়াসীর বললেন,

– এসেছিস? তোর বাবা তো গেছে একজায়গায়, তোরাও দু ভাই যার যার মতো। প্রীতিকার্নিশে সন্ধ্যা মানেই আমার একাকীত্ব। আজকে ভাবী এসেছে, ভালোই লাগছে। তোদের বাসায় না ফিরলেও চলতো।

– জানোই তো আমরা দু ভাই কতোটা মা পাগল। তোমাকে ছাড়া ভাল্লাগেনা কিছুই। এ স্বভাবের জন্য বউ পালতে পারবো না দেখো।

বলতে বলতে তামজীদ মায়ের কোলে শুয়ে পরলো। মিসেস ওয়াসীর মার লাগালেন ওকে। হেসে দিলেন মিসেস সৈয়দ। রিংকি পেছন তাশদীদকে দেখে হাতের পেপারওয়েটটা টেবিলে রেখে দিলো। মায়ের কাছে গিয়ে বসলো ও। তাশদীদ ভেতরে ঢুকে ওয়ারড্রোবে হেলান দিয়ে দাড়ালো। বুকে হাত গুজে বললো,

– আন্টি? রিংকি বলছিলো তোমার নাকি দরকার বলে প্রীতিকার্নিশ এসেছো? ইমারজেন্সি কোনো?

মিসেস সৈয়দ হচকিয়ে যান। জবাব না খুজে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি। মিসেস ওয়াসীর বললেন,

– এসব কি কথা তাশদীদ? প্রীতিকার্নিশ আসতে দরকার কেনো থাকতে হবে ওনাদের?

– আমি বলিনি এটা। রিংকিই বলেছে।

সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো তাশদীদ। রিংকি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে, নিস্পলক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একপা পেছনে ঠেকিয়ে বাকা হয়ে দাড়িয়েছিলো তাশদীদ। রিংকির হাসিটা দেখে এবারে সোজা হয়ে দাড়ালো ও। রিংকিকে নিয়ে মিসেস সৈয়দকে কিছু বলতে উদ্যত হবে, তখনই ফোন বেজে ওঠে ওর। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে সেটা রোজির নাম্বার। তাশদীদের ভ্রু কুঁচকে আসে। সামনে মিসেস সৈয়দকে বলে,

– তোমার ফোন কোথায় আন্টি?

– ফ্ ফোন? আমারটা…ও ওটা মনেহয় তোমাদের বারান্দার সোফার ওপর। কেনো তাশদীদ?

তাশদীদ জবাব না দিয়ে কল রিসিভ করলো। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে রোজি বড়বড় দম নিতে নিতে বললো,

– ত্ তাশদীদ…আ্ আমার প্রচন্ড ক্ কষ্ট হচ্ছে। ব্ বাসায় কেউ…কেউ নেই…আমি…

ওর আওয়াজ শুনেই মস্তিষ্ক ফাকা হয়ে যায় তাশদীদের। ‘রোজি!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে ও। মিসেস সৈয়দ বসা থেকে দাড়িয়ে গেলেন তৎক্ষনাৎ। ওপাশের সাড়াশব্দ না পেয়ে ফোন কান থেকে নামিয়ে নেয় তাশদীদ। কল কেটে গেছে। তাশদীদ মিসেস সৈয়দকে উচ্চস্বরে বললো,

– তোমরা রোজিকে একা রেখে এ বাসায় চলে এসেছো?

– ন্ না। ওর বাবা তো…কি হয়েছে রোজির তাশদীদ? রোজির…

তাশদীদ সময় নেয়না। তামজীদের সাইকেলের চাবিটা নিয়ে ছুট লাগায় ও। ফোন নিয়ে কল করে কাউকে। রিসিভ হলে বলতে থাকে,

– হ্যালো শুভ? আন্টিকে নিয়ে এক্ষণ সৈয়দ আঙ্কেলের বাসায় যা। ও বাসায় রোজি একা। ওর মনেহয় লেবার পেইন শুরু হয়েছে। আমি পাঁচমিনিটে আসছি।

ওপাশ থেকে কিছু একা শুনে তাশদীদ আবারো বললো,

– না না। এ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে। আমি সমরেশ কাকাকে বলছি সিএনজি নিয়ে আসতে। তুই আন্টিকে নিয়ে এক্ষণ যা!

তাশদীদ সাইকেল নিয়ে প্রীতিকার্নিশ থেকে বেরিয়ে আসছিলো। মিসেস সৈয়দ ইতিমধ্যে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। মিসেস ওয়াসীর ওনাকে ধরে আছেন। ওদিকে রিংকি প্রতিক্রিয়া-বিহীন। বরাবরের মতো এখনো যেনো ওর দেখার একমাত্র বিষয়, কোন পরিস্থিতিতে তাশদীদ কি করে। তাশদীদ তামজীদকে বললো,

– ওদের নিয়ে ডিরেক্ট হসপিটাল চলে আয়। আমি রোজিকে নিয়ে যাচ্ছি।

দ্রুত মাথা ওপরনিচ করলো তামজীদ। তাশদীদ বেরিয়ে গেলো। মিসেস সৈয়দ কাদতে কাদতে রিংকির বাবার কথা বলতে লাগলেন। রিংকি হাতের ফোনটা নিয়ে কিছুটা সরে দাড়ালো। কল লাগালো বাবার নম্বরে। রিসিভ হলে বললো,
‘আম্মু তোমাকে বলেছিলো না জলদি বাসায় ফিরতে? ফেরো নি কেনো? আপু বাসায় একা ছিলো, ওর লেবার পেইন শুরু হয়েছে। তাশদীদ ভাই হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। যতো দ্রুত পারো হসপিটাল পৌছাও। তাশদীদ ভাইয়ের একা দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।’

ব্রেক কষে তীব্র বেগের গাড়িটা থামিয়ে দেয় তাথৈ। দম ফেলে, একদন্ড সময় নিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো, মুহুর্তের ব্যবধানে ঠিক কি ঘটে গেলো। দ্রুতগতিতে একটা রিকশাকে বা দিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো ও। কিন্তু সেসময়েই রিকশাটা কিছুটা বামে চলে আসে। ফলশ্রুতিতে হুডের সাথে গাড়ির লুকিং মিরর লেগেছে। সেটাও বেশ জোরেসোরে। নক পরে গাড়ির জানালায়৷ তাথৈ সরি বলার উদ্দেশ্যে শ্বাস নেয়। কিন্তু জানালার কাচ নামিয়ে পাশ ফিরতেই থমকে যায় ও। খয়েরী পান্জাবী পরিহিত অন্তু ওর গাড়ির বাইরে। তাথৈ অন্তুর পেছনে তাকালো। রিকশায় সোহা বসে। ওর পরনে খয়েরী রঙের শাড়ী। তাথৈয়ের চোখ জ্বালা করতে শুরু করলো হঠাৎ। সম্পর্ক থাকতে অন্তু ওকে অনেকবার বলেছে, বিয়ের পর আমরা রিকশায় করে রাতের শহর ঘুরবো। গায়ে মাখেনি ও৷ কিন্তু আজ সেই একই জায়গায় সোহাকে দেখে বুকের ভেতরে অচেনা ব্যথা অনুভব হলো ওর। তাথৈ বুঝলো, এর নাম ঈর্ষা। দৃষ্টি সরিয়ে নিজেকে সংবরন করে ও। তখনই অন্তু বললো,

– ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছো?

তাথৈ বিস্ফোরিত চোখে চায়। অবুঝের মতো তাকিয়ে রয় অন্তুর দিকে। অন্তু আবারো বললো,

– সোহা যেদিন ক্যাম্পাসে গিয়েছিলো, তুমি সেদিন ওকে অপমান করেছিলে তাথৈ?

– বিয়ের দিন তো তুমি স্বাভাবিকই ছিলে। বিশ্বাস করো, আমার কোনো অপরাধবোধ নেই। আমি জানি, না তুমি আমায় ভালোবেসেছো, না আমার বিয়েতে তোমার কোনো কষ্ট আছে। আর তুমিও জানো, এটাই সত্যি। তবুও দিনকেদিন এমন টক্সিক হয়ে উঠেছো কেনো? সোহা আমার স্ত্রী বলে?

তাথৈ স্টেয়ারিং মুঠো করে রাগ সামলানোর চেষ্টা করলো। বড়বড় দম ফেলছে ও। অন্তু আবারো কিছু বলতে যাবে, গাড়ির দরজা খুলে দেয় ও। অন্তু সরে দাড়ায়। তাথৈ গাড়ি থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে স্পষ্ট গলায় বললো,

– আমার গাড়ি ডানে এসেছে নাকি তোমার গাড়ি বামে গিয়েছে মামা?

ওর ঝাঝালো গলা শুনে রিকশাওয়ালা থতমত খেয়ে যায়। অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলে,

– হ্ হ মামা। রিকশা আমিই ডাইনে আনছি। আ্ আমারই ভুল।

চোখ বন্ধ করে নেয় অন্তু। ও জানে তাথৈ কেমন। সোহা এর আগেও তাথৈয়ের বিপরীতে ওকে বলেছে। সেদিন কথাটাকে গুরুত্ব দেয়নি বলে একদফা ঝগড়াও হয়েছে ওদের। আজকে তাথৈয়ের গাড়িটা রিকশাকে ধাক্কা দেওয়ার পর সোহা প্রতিক্রিয়া করেছে। কথাগুলো তাথৈকে না বললে সোহা আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পরতো। অন্তু আপাতত ওর বৈবাহিক জীবনে কোনো ঝামেলা চায় না। তাই তাথৈ ইচ্ছাকৃত করেনি জেনেও কথাগুলো বলেছে ও। তাথৈ একপলক সোহার দিকে তাকালো। ওর আপাদমস্তকে নতুন বউয়ের সাজ। পাশের রিকশার হুডটাও দেখে নিলো ও। আবারো রিকশাওয়ালাকে বললো,

– হুডে কোনো সমস্যা হয়েছে?

– না মামা। ওইডা তো নামানোই। হয়নাই কিছুই।

ফিরে এসে গাড়ির দরজা খুললো তাথৈ। কি মনে করে আবারো থেমে গেলো। অন্তুর দিকে তাকিয়ে বললো,

– আমার সামনে এসো না অন্তু। আমি তোমাকে ভালোবাসিনা।

– আমাকে কেনো, তুমি কাউকেই ভালো বাসো না।

একপ্রকার চাপা কষ্ট নিয়ে বললো অন্তু। কি করেনি ও এই মেয়েটার জন্য? সম্পর্কটাকে বাচাতে আদর্শ প্রেমিকের একটাএকটা ভূমিকা পালন করেছিলো ও। বিনিময়ে ভালোবাসা পায়নি। কেবল পেয়েছিলো তাথৈয়ের আশেপাশে থাকার সুযোগ। অন্তুর প্রতিত্তোরে তাথৈয়ের ভেতরটা যেনো এঁফোড় ওঁফোড় হয়ে যায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও অন্তুর দিকে। অন্তু একটা ঢোক গিলে বললো,

– অভিশাপ দিচ্ছি তাথৈ, আমার মতো যন্ত্রণা তোমারও হোক। অস্পর্শী প্রেম তোমার জীবনে এসে তোমাকে উন্মাদ করে দিক। গর্বের সাথে উচ্চারন করা ‘তাথৈ আলফেজ’ নামটা কারো জন্য শুধু ‘তাথৈ’ এ নেমে আসুক। অম্বুনীড় নামের ওই জমকালো বাসা ছেড়ে, কারো হৃদয়ে একটুখানি জায়গা পাবার জন্য তুমি দিশেহারা হও। আমার মতো তুমিও কারো একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উদ্ভ্রান্ত হও। একটুখানি তার কাছে থাকা, পাশে থাকার জন্য তুমিও পাগলামি করো। পরিশেষে কারো না সূচক উত্তর, তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিক। এই সব যন্ত্রণা তোমার হোক তাথৈ। অভিশাপ দিচ্ছি তোমাকে। এই সব যন্ত্রণা তোমার হোক!

তাথৈ শক্ত হয়ে দাড়িয়ে কেবল শুনলো। অন্তু বলা শেষে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। দেখলো তাথৈর চোখ ছলছল করছে। কিন্তু কাদছে না ও। বা হাতে মুখ মোছার মতো করলো ও। সোহা ততোক্ষণে রিকশা থেকে নেমে ওর হাত ধরেছে। ‘চলো’ বলে অন্তুর হাত টানলো সোহা। তাথৈ একটা বড়সর দম নিয়ে বললো,

– ‘তাথৈ আলফেজ ভালোবাসতে জানেনা।’ কথাটা প্রথমদিনই তোমাকে বলেছিলাম অন্তু। ভুলে গেছো?

অন্তু জবাব দিলো না। কান্না লুকোতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে, অন্যদিক তাকিয়ে রইলো। তাথৈ আর কিছু বললো না। গাড়িতে করে চলে গেলো ও। অন্তু চোখ বন্ধ করে সামলালো নিজেকে। ওর মন হয়তো তখন ওপরওয়ালার কাছে প্রার্থনারত, ‘আমার অভিশাপকে দুয়া হিসেবে কবুল করো ইয়া রব। তাথৈ বড়লোক বটে। কিন্তু ওর অনেক অভাব। ভালোবাসার অভাব।’
মাঝরাতে ডোরবেল বাজলো অম্বুনীড়ে। আওয়াজ শুনে চোখ মেললো তুল্য। আশপাশ দেখে বুঝলো, ড্রয়িংরুমের সোফাতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো ও। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, রাত দুটো বাজে। সহকারী একজন এসে দরজার দিকে যাচ্ছিলো। তুল্য ডাক লাগালো,

– রফিজ চাচা?

লোক থেমে যায়। তুল্য কোলে থাকা কুশন পাশের সোফায় ছুড়ে মেরে সরিয়ে উঠে দাড়ালো। গেন্জিটা টেনে ঠিকঠাক করে এগোলো দরজায়। দরজা খুলে দিলে তাথৈ ভেতরে ঢোকে। তুল্যকে না দেখার মতে করে পা বাড়ায় নিজের ঘরের দিকে। তুল্য বললো,

– আফিফ যে পনেরো হাজার টাকা চাইলো, ওইটা কি আমাদের জয়েন্ট একাউন্ট থেকে দেবো, নাকি আমার একাউন্ট থেকেই দেবো? সেকেন্ডটা করলে, তুই যে আমাকে পে ব্যাক করবি আমার সেটার একটা গ্যারান্টি চাই।

তাথৈয়ের কাধে ব্যাগ ছিলো। ব্যাগটা সেন্টার টেবিলে ফেলে দেয় ও। সেখানে থাকা ফলভর্তি সিরামিকের বাটিটা সাথেসাথে মেঝেতে পরে ভেঙে যায়। তাথৈ গুরুত্ব দিলো না। তুল্যর দিক ফিরে বললো,

– আমাকে দেখলে টাকা আর প্রোপার্টি ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনা তোর?

– তোর মাথায় ভাঙচুর ছাড়া আর কিছু আসে?

তাথৈ থামলো। তুল্য খেয়াল করলো, ওর তেজী চেহারায় চোরা কষ্ট এসে ভর করেছে। কিন্তু ঠিক পরমুহূর্তেই বদলে যায় সে চেহারাটা। তাথৈ চোখ তুলে ভাইয়ের দিক তাকিয়ে বললো,

– আমি, এমনই! এন্ড আ’ম নট গোয়িং টু চেন্জ!

ওপরে চলে গেলো তাথৈ। তুল্য ওর চলে যাওয়ার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিজেনিজেই বললো, ‘আর এজন্যই অন্তু ভেগেছিলো।’

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৫.

তাশদীদ ফজর নামাজটা শেষ করেই রওনা হলো হসপিটালের দিকে। গত রাতটা যে ওদের জন্য কতোটা ভয়ংকর গেছে, তা কেবল ওরাই জানে। প্রায় মাঝ রাতের দিকে রোজির মেয়ে হয়েছে। সিজারিয়ান অপারেশন। তবে বহু জটিলতা তৈরী হয়েছিলো। তাশদীদ রিংকিদের বাড়ি পৌঁছে রোজিকে খুবই গুরুতর অবস্থায় পায়। সিএনজিতে তৎক্ষনাৎ হাসপাতাল নেওয়া হলেও ডাক্তার রোজির অবস্থা নিয়ে শংকায় পরে যায়। অপারেশনের সময় রক্তের প্রয়োজন পরে। পরিস্থিতি এমন দাড়ায়, বাচ্চা অথবা মা, যেকোনো একজনকে বাচানোই তাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পরে। সৌভাগ্যক্রমে রোজির সাথে তাশদীদের ব্লাডগ্রুপ ম্যাচ করে যায়। রোজিকে হসপিটালে ভর্তি থেকে শুরু করে রক্ত দেওয়া, সম্পূর্ণটাই তাশদীদ নিজে সামলেছে। অস্থিরতা নিয়ে ছোটাছুটি করেছে রাতভর। রোজির মা কান্নাকাটিতে ব্যস্ত ছিলো, ওর বাবা ছিলো বাড়ি না ফেরার অপরাধবোধে দিশেহারা। বিপদে পরে দ্বিকবিদিক হারিয়ে ফেলেন তিনি।

এতোসবের মধ্যেও হুশে ছিলো কেবল রিংকি। তবে ওর দৃষ্টি ওটির দরজা কিংবা মা-বাবার দিকে ছিলোনা। ওর সবটুকো আগ্রহ ছিলো তাশদীদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে। একটা ছেলে কারো এমন বিপদে কতোরকমভাবে ছুটতে পারে, চাক্ষুষ দেখে নিয়ে নিজের পছন্দের ওপর শুধু গর্ব অনুভব করেছে ও। বাচ্চাকে ওটি থেকে বের করার পর শুরুতে রোজির মায়ের কোলে দেওয়া হয়। সেসময় রিংকি ছিলো রেস্টিংরুমের বাইরে। রক্ত দেবার পর তাশদীদ কেমন আছে, তা দেখতে। খানিকটা সুস্থ হতেই তাশদীদ রোজির খোঁজ লাগায়। রেস্টিংরুম ছেড়ে এসে কোলে তুলে নেয় রোজির মেয়েকে। ছোট্টছোট্ট আঙুল, হাত, পা, চোখ, তোয়ালে মোড়ানো ছোট্ট শরীরটার মুখ দেখে মুহুর্তেই সব ক্লান্তি ভুলে যায় তাশদীদ। রোজির বাবা-মা সেসময়ে ধন্যবাদের ঝুলি খুলে বসেছিলো। তবে কিছুই কানে যায়নি তাশদীদের। নতুন প্রাণকে আদর দিয়ে, রোজির সাথে দেখা করে প্রীতিকার্নিশ ফেরে ও। ফজর পরে আরেকবার রোজি আর বাচ্চার খোঁজ নিতে কেবিনে নক করলো তাশদীদ। ধীর আওয়াজে বললো,

– রোজী? ঘুমোচ্ছো?

– না তাশদীদ। ভেতরে আসো।

তাশদীদ দরজা ঠেলে ভেতরে যায়। রোজি বেডে আধশোয়া হয়ে আছে। ওর বাচ্চা পাশেই ঘুমোচ্ছে। আর পাশের সোফায় রোজির মা ঘুমাচ্ছেন। তাশদীদ হাসিমুখে এগোলো। উঁকি দিয়ে বাচ্চার ঘুমন্ত মুখটা দেখে রোজীকে বললো,

– এখন কেমন আছো মা-মেয়ে? আমি যাওয়ার পর সমস্যা হয়েছিলো কোনো?

মাথা দুলিয়ে না বোঝায় রোজী। কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর ওকে যখন বেডে শিফট করা হয়, রিংকি তখন এসেই বলতে শুরু করে দিয়েছিলো, ওর জন্য তাশদীদ কতো ছোটাছুটি করেছে, ব্লাড দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো রিংকি গর্ব করেই বলছিলো। রোজি কেবল অবাক হয়ে দেখছিলো, ওর এই অবস্থায় ওর নিজের বোন ওর খোজ না নিয়ে, বাচ্চার খোজ না নিয়ে তাশদীদকে নিয়ে কতোটা ব্যস্ত। রোজির মা বাচ্চাকে নিয়ে ছিলেন। রিংকি ওর বাবার সাথে বাসায় চলে যায়। তাশদীদ ঝুকে দাড়িয়ে বাচ্চার ছোটছোট চোখমুখ দেখছিলো আর হাসছিলো। রোজি বললো,

– আমি তোমার চিরকৃতজ্ঞ তাশদীদ।

তাশদীদ রোজির দিকে তাকালো। মৃদ্যু ঘাড় নাড়িয়ে আবারো বাচ্চার দিক তাকিয়ে বললো,

– এসব বলতে নেই। বেবির নাম কি দিয়েছো?

– ভাবিনি এখনো।

– সেকি কথা। এখনো কেনো ভাবোনি? আর ওর বাবা কি বলেছে? আসছে কখন সে?

রোজির মুখ কালো হয়ে যায়। এমনিতেই স্বামীসুখ খুবএকটা ওর কপালে নেই। আল্টাসনোতে মেয়ে বাচ্চা দেখার পর থেকে ওর স্বামীর ব্যবহার আরো অস্বাভাবিক। ভদ্রলোক হয়তো ছেলে বাচ্চা চেয়েছিলেন। কল করে তাকেমেয়ে হওয়ার খবর জানিয়েছে ওর বাবা। কিন্তু সে বিষয়ে খুব একটা সুখ, আগ্রহ দেখায়নি সে। বলেছে এখন আসলে ছুটি নেই। কিছুদিন পর ছুটি নিয়ে আসবে। রোজি এমন প্রতিত্তর করেনি। যেনো ও জানতো, সে এমনটাই বলবে। মেয়ের জন্য ওকে একাই হতে হবে, তা বেশ ভালোমতোই বুঝেছে ও। জবাব না পেয়ে তাশদীদ সোজা হয়ে দাড়ালো। কিছুটা গভীরভাবে রোজিকে দেখে আবারো বললো,

– সব ঠিকাছে রোজী?

– হু? হ্ হুম তাশদীদ। ঠিকাছে সব। তুমি বরং এখন বাসায় যাও। অনেক ধকল গেছে। তোমার রেস্ট নেওয়া দরকার।

আনমনে জবাব দিলো রোজী। তাশদীদ একদন্ড চুপ রইলো। একটু ভেবে কিছু বলতে যাবে, তখনই বাবাকে নিয়ে কেবিনে ঢোকে রিংকি। রিংকির হাতে খাবারের বক্স। দরজার আওয়াজে চমকে ওঠে বাচ্চাটা। ঘুম ভেঙে যায় রোজীর মায়েরও। তাশদীদের মেজাজ খারাপ হলেও ও সেটা প্রকাশ করলো না। রিংকি একপাশে এসে দাড়ালো। ওর বাবা তাশদীদকে বললেন,

– কালরাতে তুমি যা করলে তাশদীদ…

– দায়িত্ব পালন করেছি আঙ্কেল। আর কিছুই না।বারবার এটা বলে আমাকে মহাত্মা সাজাতে চাইছো?

– আপনি মহৎ আত্মাই বটে। সেটা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখেনা তাশদীদ ভাই।

রিংকির হেয়ালিপূর্ণ কথা এবার তাশদীদের সহ্যসীমা অতিক্রম করে। এমনিতেও ওর ওপর রাগ আছে ওর। ওর বুঝতে বাকি নেই, রিংকিই জোর করে ওর মাকে নিয়ে রোজিকে বাসায় একা রেখে প্রীতিকার্নিশ এসেছিলো। রোজি আর ওর বাচ্চার যে সমস্ত কমপ্লিকেশন তৈরী হয়েছিলো, পুরোটার জন্য দায়ী রিংকির এই হেয়ালীপণা। তাশদীদ হাত মুঠো করে দম নেয়। রিংকির বাবাকে বলে,

– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো আঙ্কেল। আলাদাকরে।

– আলাদাকরে কি কথা তাশদীদ?

– জরুরিই৷ বাইরে এসো। কথাগুলো বলেই আমি বেরোবো। ভার্সিটি যেতে হবে।

তাশদীদ বাইরে চলে গেলো। একনজর রিংকির দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালো ওর বাবাও। রিংকিও বেরোলো না। কেবিনের দরজার থাকা চারকোনা স্বচ্ছ জায়গাটুক দিয়ে দেখলো, তাশদীদ বেশ গুরুত্বের সাথে ওর বাবাকে কিছু বুঝাচ্ছে। শুরুতে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছিলো ওর বাবা৷ কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতিয়ে আসে সে। ঠোঁটের কোনের হাসি বাড়ে রিংকির। কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে ও। তাশদীদ থামলো। রিংকির বাবা দমেছেন। কিন্তু তার মেয়ের হাসিটা এবারও ওর পছন্দ না। একটা ছোট্ট দম নিয়ে ও এগিয়ে আসলে। কিছু বলতে যাবে, রিংকি হাসিমুখে ঘাড় কাৎ করে বলে উঠলো,

– আপনি আর আমাকে পড়াবেন না তাশদীদ ভাই?

বিব্রতবোধ বিস্ময়ে পরিনত হয় তাশদীদের। কিছুটা অবাক চোখে চায় ও রিংকির দিকে। পরপরই নিজেকে সামলে বললো,

– ভালো হয়েছে তুমি নিজেই ব্যাপারটা রিয়েলাইজ করেছো। হ্যাঁ। আমি আর তোমাকে পড়াতে যাবোনা।

– আমার রিয়েলাইজেশন আপনার ভালোলেগেছে তাশদীদ ভাই?

তাশদীদ কিছুটা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। রিংকি উচু করে বাধা চুলের ঝুটি খুলে দিলো। আয়েশে হেয়ার ব্যান্ডটা কবজিতে ঢুকিয়ে বললো,

– আমি আপনাকে পছন্দ করি। আপনি আপনার অপছন্দের দিকগুলো আমাকে বলতে পারতেন তাশদীদ ভাই। আমি শুধরে নিতাম নিজেকে। কিন্তু আপনি ডিরেক্ট আব্বুকে বলছেন আমাকে আর পড়াবেন না। আপনার জানা উচিত তাশদীদ ভাই, আপনি না পড়ালে, আমি পড়াশোনা করবো না। আর পড়াশোনা আমার লাইফে না থাকলে আমিও বেচে থাকবো না। আপনাকে পছন্দ করার পরিনতিতে, ক্যারিয়ার শুরুর আগে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে তাশদীদ ভাই।

মেয়ের মুখে এতো বড়বড় কথা শুনে রিংকির বাবা নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তবে বিচলিত হলো না তাশদীদ। বুকে হাত গুজে দাড়ালো ও। স্পষ্ট গলায় বললো,

– কি চাও?

– পড়াশোনা করতে চাই। বাচতে চাই। আপনি আগের মতোই আমাকে পড়াতে যাবেন। বিনিময়ে আমি আমার সব পছন্দ বিসর্জন দেবো।

তাশদীদ চুপচাপ দেখতে লাগলো, একটা মেয়ের জেদ কি পরিমানে তৈরী হলে সে এমন হাসিমুখে, স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর কথা বলে? রিংকি জবাবের জন্য চোখ তুলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তাশদীদ একবার ওর বাবার দিকে তাকালো। বুঝেও অসহায়, নিরুপায় হওয়ার ভঙ্গিমা ভদ্রলোকের চেহারায় স্পষ্ট। একটা ছোট্ট দম ফেললো তাশদীদ। বুক থেকে হাত নামিয়ে বললো,

– ওকে দেন। পড়াবো তোমাকে আমি। কিন্তু একটা কথা মাথায় রেখো, তুমি তোমার থাকার মর্যাদা রাখলেই আমি আমার কথার মর্যাদা রাখবো। নইলে…

কথা শেষ না করে বড়বড় পা ফেলে চলে যায় তাশদীদ। রিংকি ওর চলে যাওয়া দেখে নিজেনিজেই বললো,
‘আপনার সব ইচ্ছাও আমার পছন্দের তাশদীদ ভাই। কথার মর্যাদা রাখতে গেলে, সেগুলোকেও আমার বিসর্জন দিতে হবে। আর আমি সেটাই করলাম। আপনার ইচ্ছাকেই ত্যাগ দিলাম। তবুও আপনাকে ছাড়তে পারবো না। আপনি আমার অপরিহার্য। আপনাকে আমার লাগবেই।’

তাথৈ মাথা নিচু করে প্রক্টরের কেবিনের এককোনে দাড়িয়ে আছে। ওয়াশরুমের বেসিনের আয়না ভাঙার দায়ে মাঝক্লাস থেকে ডেকে আনা হয়েছে ওকে। আলো চুপ করে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে, আর শার্লি পায়চারী করছে। প্রক্টর কিছু কাগজপত্র দেখা শেষে টেবিললর একপাশে ফাইল রাখলেন। চোখের চশমা খুলে, বেশ নম্রভাবেই তাথৈকে বললেন,

– শুনেছি এর আগে তুমি অন গার্ড টিচারকে ইনসাল্ট করেছিলে। কথা সত্য?

– কাল তুমি আফিফের গাড়ির হেডলাইটও ভেঙেছো।

– অল আসাইড! ভার্সিটির সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি কবে থেকে ভাবতে শুরু করেছো তাথৈ?

তাথৈ তখনো জবাবহীন। ওভাবেই মাথা নিচু করে আছে ও। প্রক্টর আবারো বললেন,

– জবাব দাও তাথৈ। ইউ আর আনসারেবল। বায়োকেমের মেধাবী মুখ তুমি। ডোন্ট ইউ নো? ক্যাম্পাসের যেকোনো কিছু নষ্ট করার দায়, টিচারদের সাথে অগ্রহনযোগ্য আচরন মুহুর্তেই তোমার এই জ্বলজ্বলে রেজাল্টকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে জানে। জানো না তুমি এটা?

তাথৈ এবারো জবাব দিলো না। প্রক্টর উঠে দাড়ালেন। ওনাকে দাড়াতে দেখেই দরজা থেকে আলো ‘ম্যাম!’ বলে ডেকে উঠলো তাকে। ক্লাসের আরেক মেধাবীকে চিনতে সমস্যা হলো না প্রক্টরের। আলোকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন তিনি। আলো কিছুটা জড়সড় পায়ে ভেতরে ঢুকলো। ওর পেছনপেছন শার্লিও ঢুকলো।আলো একটা ঢোক গিলে বললো,

– ম্যাম ঘটনাটা আপনি যেমন ভাবছেন, তেমন না। আসলে ওয়াশরুমের পার্টিশন দেয়ালে ওইসময় একটা কিছু ঝুলছিলো। ওটাকে সরু সাপ ভেবে শার্লি অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। আর তাথৈ ওই মোমেন্টে হাইপার হয়ে…

– তাথৈকে আমি চিনি আলো। তাথৈ কোনো মোমেন্টে হাইপার হয়, নাকি হাইপার হয়েই সব মোমেন্ট পার করে, সেটা তোমাকে বলতে হবে না।

আলো থেমে যায়। জবাব দেওয়ার কিছু খুজে পায়না। এবারে মুখ খুললো তাথৈ। শক্তপোক্ত আওয়াজে বললো,

– ভবিষ্যতে আর এমন হবে না ম্যাম। যাই কিছু হয়ে যাক, আমি ক্যাম্পাসে কোনোরকম ভায়োলেন্স ক্রিয়েট করবো না। আমার ব্যক্তিগত আক্রোশ কখনোই এই ক্যাম্পাসের জন্য ক্ষতিকারক হবে না।

প্রক্টর মাথা নেড়ে ওদের বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। একপলক শার্লি-আলোর দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে তাথৈ। শার্লি পরনে থাকা জ্যাকেটসদৃশ কটিটা ধরে, তাড়াহুড়ো করে ছুট লাগায় ওর পেছনপেছন। কিন্তু বারান্দার বাক পেরোতে গিয়েই কারো সাথে ধাক্কা লেগে ফ্লোরে পরে যায় ও। বিপরীতের মানুষটাকে না দেখেই ‘তুল্যর বাচ্…’ বলে চেচিয়ে ওঠে ও। একইসময় ওর কানেও ভেসে আসে, ‘শার্লির বাচ্…’
বলা শেষ না করে থেমে যায় দুজনেই। শার্লি কাধের দিকটা ডলতে ডলতে উঠে দাড়ালো। উচ্চস্বরে বললো,

– তুই আরেকদিন আমার সাথে ধাক্কা খাবি তো আমি তোর নামে নির্যাতনের মামলা ঠুকবো তুল্য!

– তুি কি করে মামলা ঠুকবি? পুরুষ নির্যাতনের তো মামলাই হয়না। আমিও পরেছি বিপদে। তোর এগেইনিস্টে যে কেইস ফাইল করবো, ছদ্মবেশী পুরুষের কাছে নির্যাতিত হয়েছি শুনলে লোকে আমার ওপরই হাসবে।

জবাব শুনে শার্লির কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। ও রাগ নিয়ে তুল্যর বুকের দিকে দুহাত বাড়ায় ওকে ধাক্কা দেবে বলে। কিন্তু নিমিষেই ওর হাত মুচড়ে ধরে তুল্য৷ উল্টোদিক দাড় করিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

– তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। এই আলুথালু হাত কিনা তুই তুল্য আলফেজের সিক্স প্যাকের দিকে বাড়িয়েছিস? কয়টা কলিজা তোর এইটুক শরীরে বলতো? তোর কি মনে হয়, এই হাতদুটো ভেঙে পিঠের ব্যাগে তুলে দিতে আমি দুবার ভাববো? হু?

শার্লি মৃদ্যু ব্যথায় কুকড়ে উঠলো। গলা ঝারার শব্দে ওকে ছেড়ে দিলো তুল্য। শার্লি তৎক্ষনাৎ সরে দাড়ালো। আলো মাথা নিচু করে পাশ কাটায় ওদের। তুল্য শার্লির দিকে এগিয়ে এসে পুনরায় রাগ নিয়ে বললো,

– এখনো সময় আছে, ভালো হ। তুল্য আফফেজের রাগ সহ্য করার ক্ষমতা তোর নেই।

তুল্য চলে যায়। শার্লি দাড়িয়ে দাড়িয়ে বড়বড় দম ফেলতে ফেলতে আপনাআপনিই বললো,
‘হ্যাঁ। আমার তো ক্ষমতা নেই। তোদের দুই ভাইবোনের রাগ তো ভূতে এসে সহ্য করে যায়। মন্জুলিকা, চন্দ্রমুখী ওরাই এসে…’ আটকে যায় শার্লি। চন্দ্রমুখী বলতে গিয়ে রুমনের কথা মনে পরেছে ওর। যেহেতু সবে তাথৈ প্রক্টরের সাথে দেখা করে ক্লাসে গেছে, এখন তাথৈয়ের কাছে ভেরাটা ওর জন্য মোটেও সুবিধের হবে না। শার্লি পা বাড়ালো নাট্যকলার দিকে। নিজে কিছু বলতে পারেনি তো কি হয়েছে? রুমনকে দিয়েই তুল্যকে চেতাবে ও।
তুল্য ব্যাগ টানতে টানতে ক্লাসে এসে দেখে পুরো ক্লাস দাড়িয়ে আছে। ডায়াসে সব মাস্টার্সপড়ুয়া সিনিয়র ভাই-আপু। সবার আগে সর্বডানের অফ হোয়াইট শার্ট পরিহিত তাশদীদকে চোখে পরে ওর। সাথে শান্ত, টিটুও আছে। তাশদীদ বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে। পুরো ক্লাসে চোখ বুলাচ্ছে। তুল্য বোনের দিকে তাকালো। তিননম্বর বেঞ্চে বসা তাথৈ নিচদিক তাকিয়ে। তুল্য গলা উচিয়ে বললো,

– শান্ত ভাই? আসবো?

হাসিমুখে ওকে আসতে বলে শান্ত। সর্ব সিনিয়র ব্যাচের এক ছেলে ডায়াসের মাঝে এসে দাড়ালো। একহাত টেবিলে ঠেস দিয়ে বাকা হয়ে দাড়িয়ে বললো,

– ফার্স্ট ইয়ারে ডিপার্টমেন্টাল ট্যুরে গিয়েছিলেন কে কে?

এক চতুর্থাংশ হাত উচু করে। তাথৈ হাত তোলেনি। আগেরবার ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ও বা তুল্য, কেউই যায়নি। তাশদীদ হাত নামিয়ে রাখা মুখগুলো দেখলো। ওদের দু ভাইবোনকে চোখে পরলো ওর। ডায়াসের ছেলেটা সোজা হয়ে দাড়ালো। ট্যুরের উপকারিতা নিয়ে দুই প্যারা ভাষন দেওয়া শেষে জিজ্ঞেস করলো, এ বছর কে কে যেতে চান ট্যুরে। ইচ্ছুকদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ছেলেটা ব্যাচের তিন টপারকে দাড়াতে বললো। আলো, তুল্য, তাথৈ, তিনজন বাধ্য শিশুর মতো দাড়িয়ে গেলো এবারে। ছেলেটা বললো,

– হ্যালো টপার্স? গতবছরও কেউ যাননি, এবারও যাবেন না তাইতো? তা পড়াশোনাঘটিত কারনে ট্যুরে যাবেন না? নাকি অন্য কারনে?

– জ্বী। এক্সাম আছে সামনে।

তাথৈ স্পষ্ট জবাব দিলো। তবে আলোর জবাবটা ছিলো অর্থসংকট। আর তুল্য চাইছিলো না তর্কে যেতে। শান্ত এগোলো এবারে। তাশদীদকে দেখিয়ে বললো,

– সত্যি বলার জন্য থ্যাংকিউ। এবার শুনুন আপনারা যা করবেন, আপনারা এই তাশদীদ ভাইয়ের সাথে আজ কালের মধ্যেই পার্সোনালি আলোচনায় বসবেন। ওনার ট্যুর ভার্সেস পড়া যুক্তিখন্ডন করবেন। যদি পারেন, তাহলে আমি ট্যুরের জন্য আপনার এক্সাম পিছিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবো। আর যদি তা না পারেন, তাহলে বিনাবাক্যে নির্দিষ্ট ডেইটেই আপনাদের ট্যুরে যেতে হবে৷ সর্বপরি আপনারা তিনজন যাচ্ছেন ট্যুরে। বাই হুক, অর বাই ক্রুক। আপনারা এই পুরো ক্লাসকে প্রেজেন্ট করেন। আপনারাই যদি না যান, বাকিরা ভাববে ওরা ট্যুর বাদ দিয়ে পড়ে বলেই টপ করে। যেটা কুসংস্কার পর্যায়ে চলে যায়। এন্ড আই কান্ট লেট দ্যাট হ্যাপেন। বুঝেছেন ব্যাপারটা?

স্পষ্টভাবে আটকে দিয়ে চলে যায় শান্ত। একেএকে বেরিয়ে যায় বাকি সবাই। তাশদীদ পকেটে হাত গুজে দাড়িয়ে ছিলো। সবাই বেরিয়ে গেলে, ও ডায়াস থেকে নিচে নামলো। তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে একটা চমৎকার হাসি দিয়ে বললো,

– আমার মনে হয়না তোমার আমার সাথে কোনো আলোচনায় বসার কোনো দরকার আছে। ইউ নো না? তাশদীদ ওয়াসীর ইজ আ ফুলস্টপ ফর ইউ, রাইট?

তাথৈ ফুসতে থাকে। তাশদীদ মুঠো করা ডানহাত বাড়িয়ে দেয় তুল্যর দিকে। তেমনই হেসে বলে,

– বাস্কেটবল ফিনালেতে দেখা হচ্ছে চ্যাম্প! অল দ্যা বেস্ট!

তুল্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুঠো ছোঁয়ায় তাশদীদের মুঠোতে। বেরিয়ে যায় তাশদীদ। তাথৈ টের পেলো, ওর আপাদমস্তক জ্বলছে। আর ওর কানে কেবল একটা কথাই বাজছে, ‘বাধভাঙা তাথৈকে তাশদীদ থামিয়ে দিতে জানে। তাশদীদ ওকে আটকাতে জানে, দমাতে জানে। ওর ছন্নছাড়া চলনে, এক এবং একমাত্র বিরামচিহ্নের নাম, তাশদীদ ওয়াসীর।’

#চলবে…