কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-২২+২৩+২৪

0
267

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২২.

সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কোট পরিহিত তুল্যকে গাড়ি থেকে বেরোতে দেখে দুরে দাড়িয়ে কানের পিঠে চুল গুজলো আলো। নিজের দিকে তাকিয়ে সবুজাভ শাড়িটা পরখ করলো। কপালের টিপটা ছুঁয়ে দিয়ে আরো একবার ঠিকঠাক করলো। ভাইভার জন্য আজ মায়ের শাড়ি পরেছে আলো। আসার সময় বোন বলেছে, ওকে টিপে মানাবে। তাই টিপও পরেছে। আর যেহেতু এটুকো সাজগুজ করেছে, আলোর খুব ইচ্ছে হলো তুল্যকে এই সাজটুকো দেখাতে। ও জানে, ওর সীমা সীমিত। তুল্য আলফেজ, ওর সীমাবহিস্থ। তাই তার চাওনি বাদে, বাড়তি কোনো চাওয়া নেই ওর। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকেই তুল্যকে খুজছে আলো। তুল্যকে আসতে দেখে চোখ ঝলমলো হয়ে ওঠে ওর। ভেতরটা অদ্ভুত খুশিতে পুলকিত হয়ে ওঠে। শাড়ির আঁচল দুহাতে একমুঠো করে, ও ঠায় দাড়িয়ে রয় তুল্যর চাওনি পাবার আশায়। তুল্য বুজোকে বের করলো। এতোটাসময় গাড়িতে থাকার পর ছাড় পেতেই ছুট লাগায় বুজো। সোজা এসে আলোর পা শুকতে থাকে। আলো মুচকি হেসে বুজোকে কোলে তুলে নেয়। আর বুজো নড়চড় করতে থাকে। তুল্য এগিয়ে এসে দাড়ালো আলোর সামনে। চোখের সানগ্লাসটা খুলে বললো,

– ও কোলে থাকবে না। ছেড়ে দাও।

আলোর উজ্জ্বল চোখ নিমীলিত হয়ে আসে। জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে, আস্তেকরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝায় ও। বুজো নেমে যায়। তুল্যও আর দাড়ালো না। চলে গেলো ওখান থেকে।
আলো তাচ্ছিল্যে হাসলো। নিজের অসম্ভব আশার ওপর, ওর নিজেরই করুণা হয়। নিজেকে সামলে, ধীরপায়ে পা বাড়ালো ডিপার্টমেন্টের দিকে। সেখানে কোটসুট পরিহিত ছেলেরা আর শাড়িপরা মেয়েরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। মেয়েরা প্রায় সবাই শাড়ী পরে এসেছে। তাথৈ ব্যতিত। তার পরণে গাঢ় খয়েরী গোলাকার শর্ট কুর্তা, ধুতি। সবাই যেখানে রিলস, ভিতিও বানাতে ব্যস্ত, একপাশে একা দাড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছে সে। সবার মাঝে বুজো তাথৈকেই যেনো আগে দেখতে পায়। ছুটে গিয়ে তাথৈয়ের পায়ের নিচে ঘুরঘুর করতে থাকে ও। পায়ে শিরশির অনুভূত হতেই তাথৈ চোখ বন্ধ করে নিলো। দম নিয়ে, নিজেকে সামলালো। চোখ মেলে তুল্যকে বললো,

– তুই কি চাস আমি ওর একটা ক্ষতি করে দেই?

– ডোন্ট ইউ ডেয়ার তাথৈ। বুজোর দায়িত্ব এখন আমি নিয়েছি। সো মাইন্ড ইট! তাছাড়া ও বেধে রাখার জিনিসও না যে আমি বেধে রাখবো।

এটুকো বলে তুল্যও বাকিসবের সাথে ছবি তুলতে চলে যায়। ভাইয়ের বেখেয়ালিপনায় বরাবরের মতো রাগ হয় তাথৈয়ের। চোখমুখ শক্ত করে বুজোকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা লাগায় ও। তুল্য সে দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। ও জানে, তাথৈ আর যাই হোক, বুজোকে আঘাত করবে না।
তাথৈ বুজোকে নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে এসে সোজা চায়ের টংয়ে ঢুকলো। সেখানে সবাই যারযার মতো চা-আড্ডায় মত্ত্ব। আশপাশ তাকিয়ে, একটা বেঞ্চের ওপর কাচের কাপ ভর্তি ট্রে চোখে পরে তাথৈয়ের। কপাল শিথিল হয় ওর। কোলে থাকা বুজোকে ঠিক পাশটায় নামিয়ে দেয় ও। তারপর ইচ্ছে করে ট্রে টা নিচে ফেলে দিলো। ঝমঝমিয়ে আওয়াজ করে আটটা কাচের গ্লাস নিচে পরে যায়। দোকানসহ আশপাশের পুরো জায়গার ছেলেমেয়েরা চমকে তাকায় সেদিকে। দোকানী আহাজারি করে বলে উঠলো,

– আয়হায়রে! আমার সবগুলা কাপ ভাইঙ্গা দিলো এই কুত্তাডা! হায়হায় রে!

তাথৈ বুজোর দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো একটা। তারপর বুকে হাত গুজে দাড়ালো। বুজো ওরদিক চেয়ে চুপচাপ বসে। একদম ভদ্র, শান্ত বাচ্চার মতো। তবে ওর ভদ্রতায় যেনো তাথৈ সন্তুষ্ট হলো না। হাসি কমিয়ে, রাগ নিয়ে বুজোর দিকে আঙুলতাক করলো ও। উচুস্বরে দোকানীকে বললো,

– ওর নাম বুজো! আপনার কাপ ওই ভেঙেছে!

দোকানদার ইচ্ছামতো বকতে লাগলো বুজোকে৷ শুরুতে মজা পেলে, একটুপর আর ব্যাপারটা ভালো লাগছিলো না তাথৈয়ের৷ দোকানীকে থামাতে ও বললো,

– আ্ আচ্ছা হয়েছে! যেহেতু ওকে কিছু বলে লাভ নেই, আপনার কথা যা শুনানোর, তা ওর মালিককে শুনাবেন। ওর মালিক ভাইভা দিতে গেছে। ও এলেই ওকে কথা শুনাবেন ওকে?

– মালিকরে তো কথা শুনাইমু পরে! আগে তো এইডারে…

দোকানদার এবার বুজোর দিকে এগোতে যায়। তাথৈ তৎক্ষনাৎ ব্যাগ থেকে হাজারটাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলো তারদিক। দোকানী থেমে গেলো। তাথৈ বললো,

– এটা আপনার কাপের টাকা। ওকে কিছু বলবেন না। যা বলার, ওকে নিতে আসলে ওর মালিককে বলবেন। বুঝেছেন?

দোকানী টাকা হাতে নিলো। জোরেজোরে ঘাড় ঝাকিয়ে বুঝালো, তাই হবে! তাথৈ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেঞ্চে বসা বুজোর দিকে তাকালো। বাহাত হাটুতে রেখে কিছুটা ঝুকে দাড়ালো ও। বুজোর দিকে ডানহাতের আঙুলতাক করে বললো,

– স্টে এওয়ে ফ্রম মি। আন্ডারস্ট্যান্ড? এবার তো শুধু কাপ কেইসে ফাসিয়েছি, পরেরবার এরচেয়ে ভয়ানক কেইসে ফাসিয়ে দেবো বলে রাখলাম।

বুজো জবাব দিলোনা। ওভাবেই চুপটি করে বসে রইলো। ওর এমন সভ্যতায় তাথৈয়ের যেনো আরো রাগ হলো। হনহনিয়ে চলে গেলো ও ওখান থেকে।
পুরো ঘটনাটা চায়ের দোকানের কোনার চেয়ারটায় বসেবসে দেখে, হেসে দিলো তাশদীদ। কারো মাঝে কতোটা ছেলেমানুষি থাকলে এইভাবে পোষ্য কুকুরকে অবদি ফাঁসিয়ে দেয়? অথচ এই মেয়েই তার রাগে দুনিয়া ভস্ম করতে জানে। এগিয়ে এসে বুজোর সামনে দাড়ালো তাশদীদ। প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে দাড়িয়ে, তাথৈয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

– ভালোবাসা প্রকাশ করতে চায় না। এর কাছ থেকে ‘ভালোবাসে’ শোনার চেয়ে, ‘ভালোবাসে’ অনুভব করাটা বেশি ইন্টারেস্টিং হবে। রাইট বুজো?

বলাশেষে বুজোর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো তাশদীদ। বুজো কি বুঝলো, লেজ নেড়ে, আওয়াজ করে উৎফুল্লতা প্রকাশ করতে লাগলো অনবরত।

– শার্লি?

ভাইভা শেষে করিডোরে দাড়িয়ে ছিলো তাথৈ। সামনেরজনের মুখে অস্ফুটস্বরে শার্লির নাম উচ্চারণ শুনে, তার চাওনি অনুসরণ করে পেছন ফিরলো ও। তাতে যা দেখলো, একমুহূর্তের জন্য বাস্তবতাকেও ওর দিবাস্বপ্ন বলে মনে হলো যেনো। সাদা পারের মিষ্টিরঙা শাড়ি পরিহিত শার্লিকে চিনতে বাড়তি দু দন্ড সময় নিলো তাথৈ। যে মেয়েটা ঢোলাঢালা লম্বা শার্ট আর জিন্স পরে ক্যাম্পাসে আসে, তার পরনে সাদা ব্লাউজে কাধে ভাজেভাজে আটকে দেওয়া শাড়ীর আঁচল, ঘাড়ের কিছুটা নিচ অবদি কেটে রাখা চুলগুলো ছাড়া, বা হাতে কাঠের চুড়ি। সবমিলিয়ে অপরুপ দেখাচ্ছিলো শার্লিকে। শার্লি ভেতরের অস্বস্তিকে জোরালো হাসিতে আটকে দিয়ে করিডোর দিয়ে এগোলো। তাথৈয়ের চেহারায় বড়সর হাসির রেশ ফুটে উঠলো এবারে। শার্লি ওর কাছাকাছি আসলে আরো একবার ওকে আপাদমস্তক দেখে নিলো ও। খুশির সাথে বললো,

– কি মিষ্টি দেখাচ্ছে তোকে!

শার্লি হেসে নিজের দিকে তাকালো। কেনো যেনো, কখনো ওর ইচ্ছে করেনি, আরপাঁচটা মেয়েদের মতো সাজতে। বরং ছোটথেকেই মেয়েদের সাজসামগ্রী দেখলেই ওর বিরক্ত লাগতো। আর ছেলেদের মতো সোজাসাপ্টা চলাফেরা, কথাবার্তা ভালো লাগতো। অথচ আজ এই শাড়ি গায়ে জড়ানোর পর থেকেই অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে শার্লির। শরীরের চারপাশে থাকা পিনগুলোর জন্য এতোটুকোও অস্বস্তি হচ্ছে না। বরং এই শাড়ি-সাজের জন্য ওকে যখন কেউ ‘ভালো দেখাচ্ছে’ বলছে, ওর ভালোই লাগছে। শার্লি বললো,

– শাড়ি ক্যারি করা এতোটাও কঠিন না।

তাথৈ হেসে ওর হাতে হাত রাখলো। শার্লি আবারো বললো,

– জানিস তাথৈ? আমার ভাইভা ভালো গেছে আজ!

– আমি জানতাম তুই ভাল করবি। এবারের ভাইভা নিয়ে বেশ সিরিয়াস ছিলি তুই। বাইদাওয়ে, তুই শাড়ি পরবি, একবারো বলিস নি।

– আমি নিজেও শিওর ছিলাম না। ইভেন আমারতো পরার পরপরই খুলে ফেলার প্লান ছিলো। কিন্তু পরার পরে দেখলাম, ইটস ওকে, ক্যারি করতে পারছি, তাই আর খুলিনি। তখন আর তোকে বলিনি। একেবারে সামনাসামনি দেখাবো বলে।

– ভালো করেছিস। ভাইভায় কনফিডেন্ট হওয়া অনেক জরুরি। আর কনফিডেন্ট হতে গেলে গেটআপ অনেক ম্যাটার করে। এটা বল শাড়ি পরার আইডিয়া কোথায় পেলি তুই? এটা তোকে পরিয়ে দিয়েছে কে?

– ভাইভা কেমন দিলে শার্লি?

তাশদীদের আওয়াজ শুনে পাশে তাকায় তাথৈ। ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলিয়ে শার্টের হাতা ভাজ দিতে দিতে ওদের পাশ কাটাচ্ছিলো তাশদীদ। তবে দাড়ালো না ও। শার্লি সালাম দিয়ে বললো,

– বেশ ভালো গেছে তাশদীদ ভাই! এন্ড থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনি…

– গুড। ওকে তোমরা কথা বলো, আমি আসছি। থার্ড ফ্লোরে আমার ক্লাস আছে। বাই।

তাশদীদ সময় নিলোনা৷ চলে গেলো। ও চোখের আড়াল হলে তাথৈ শার্লির দিকে ফিরলো। বললো,

– এনাকে থ্যাংকস দিচ্ছিলি কেনো?

– তুই জিজ্ঞেস করছিলি না, শাড়ী পরার আইডিয়া কার? আইডিয়াটা তাশদীদ ভাইয়ের ছিলো। একচুয়ালি আমার ভাইভা ভালো যাওয়ার সব ক্রেডিট তোর আর তাশদীদ ভাইয়ের। তুই তো টপিক বলে দিয়েছিলি। আর ভাইভা ম্যানার শেখার জন্য গতদিন প্রভা আপুর কাছে ক্যাম্পাসে এসেছিলাম আমি। কিন্তু মহিলা অত্যন্ত নিচু মানসিকতার। আমাকে হেল্প করতে নারাজ ছিলো। তখনই তাশদীদ ভাইয়ের সাথে দেখা। তাকে বললাম, সে সাজেস্ট করলো গেটআপ হিসেবে শাড়ী পরতে। কথাটা শোনার পর আমার অবস্থা কি ছিলো, তা কেবল আমিই জানি। হয়তো তাশদীদ ভাই বুঝেছিলেন ব্যাপারটা। তাই আমাকে তার বান্ধবীর সাথে কথা বলতে বলেছিলেন। তো ওই আপুর সাথে কথা বলতে তার হলে যাই আমি। গত রাতটা হলে তারকাছেই ছিলাম। আপু আমাকে পড়িয়েছেও, বুঝিয়েছেও, আর এইযে রেডিও করে দিয়েছে। শাড়ি, চুরি সবকিছু তারই। এন্ড ফাইনালী, আমার ভাইভা বেশ ভালো গেছে।

শার্লির কাছে তাশদীদের কথা শুনে অজান্তেই হাসি ফুটলো তাথৈয়ের ঠোঁটে। রাগের জন্য যে মস্তিষ্ক ওকে এক জিনিস দুবার ভাবার সুযোগ দেয়না, সেই মস্তিষ্ক খুবই অদ্ভুতভাবে ওর মনে মুগ্ধতা সৃষ্টির সুযোগ করে দিতে থাকে। আড়চোখে তিনতলার সিড়ির দিকে চেয়ে রইলো ও। শার্লি শাড়ির কুচিটা ধরে বললো,

– আচ্ছা তুই ভাইভা শেষ কর, আমি একটু ওই আপুর সাথে দেখা করে আসছি। পাশের বিল্ডিংয়েই।

কথা কানে যায় না তাথৈয়ের। ও সেভাবেই সিড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। শার্লিও ওকে খেয়াল না করে পা বাড়ায়।
তুল্য দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে। ওর ভাইভা শেষ। সাদা শার্টের সর্বওপরের দুটো বোতাম খোলা। টাইয়ের গিট বুকের কাছে ঝুলছে। বা হাতে ভাইভার জন্য পরে আসা কালো কোটটা ঝুলানো। বা পায়ের কালো সু এর সামনেরদিকে পা ঢোকালেও পুরোপুরি পরেনি। একহাতে কোক ধরে রেখে, আরেকহাতে মোবাইল ঘাটছে ও। বুজো পাশে গাড়ির ওপর চুপচাপ বসে আছে। ভাবখানা এমন, সে আত্মগ্লানিতে আছে। তার জন্য তুল্যকে দোকানীর অহেতুক ক্যাচক্যাচ শুনতে হয়েছে৷ কিন্তু তুল্যর সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কারন ও জানে, বুজোকে নিয়ে তাথৈ বেরিয়েছিলো। আর কাপ ভাঙার মহৎ কাজটা তাথৈ ছাড়া আর কে করবে? জুতার আওয়াজ শুনে বেখেয়ালিভাবে ফোন থেকে একপলক সিড়িতে তাকালো তুল্য। আবারো ফোনে তাকাতেই ওর মনে হয়, দৃষ্টি সরিয়ে অনেকবড় ভুল করে ফেলেছে ও। তুল্য আবারো তাকালো সিড়ির দিকে। শাড়ী পরিহিত শার্লিকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে, আস্তেধীরে দেয়াল থেকে সরে সোজা হয়ে দাড়িয়ে যায় ও।
তুল্যকে তাকাতে দেখেই শার্লির গতি কমে আসে। সিড়ির রেলিং শক্ত করে চেপে ধরে, একটা শুকনো ঢোক গিললো ও। এতোক্ষণ সবার চাওনি, প্রসংশা ওকে আনন্দ দিয়েছে। কিন্তু এ মুহুর্তে সামনে দৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে থাকা তুল্যর নিস্পলক চাওনি ওকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। ওর মনে হলো, তুল্য কিছু বললেই ওর শরীর ছেড়ে দেবে। ওদিকে তুল্য যেনো পলক ফেলা ভুলে গেছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে শার্লি। নিচে নেমে তুল্যকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো ও। অকস্মাৎ তুল্য বলে উঠলো,

– শার্লি শোন?

হৃদৎস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার মতো শব্দজোড়া কর্নগোচর হতেই চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো শার্লি। তুল্য চুপচাপ ওর সামনে এসে দাড়ালো। টের পেলো, শার্লি স্থির নেই। শশব্যস্তর মতো এদিকওদিক দেখছে ও। তুল্য নিজের বা হাত উচু করে। সেখানে ঘড়িতে আটকে রাখা ছোট্ট কালো টিপটা হাতে নেয়। আলোর কোল থেকে নামার পর বুজোর লোমে টিপটা লেগে ছিলো। আর তুল্য সাতপাঁচ না ভেবেই সেটা ঘড়িতে আটকে রেখেছিলো। সেই টিপটাই যে এভাবে কাজে দেবে ওর, ও ভাবেনি। আলতোকরে শার্লির কপালে টিপটা পরিয়ে দিলো তুল্য। ওর স্পর্শ পেতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকালো শার্লি। তুল্য বললো,

– এবার পার্ফেক্ট লাগছে।

দোতলায় ভাইভা দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছিলো। বেরোনোর সময় কপালে হাত দিয়ে ও অনুভব করলো, ওর টিপটা নেই। ওখানেই পরেছে ভেবে কিঞ্চিৎ ঝুকে টিপটা ফ্লোরে খুজতে লাগলো ও। শান্ত ঠিক সে সময়েই ক্লাসের জন্য করিডোর দিয়ে এগোচ্ছিলো। আলোকে দেখে দাড়িয়ে যায় ও। হেসে বললো,

– আরেহ টপার জুনিয়র! ভাইভা কেমন গেলো?

ছেলেদের সাথে কথা বলে অভ্যস্ত না বলে আলো কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। জোরপূর্বক হেসে সালাম দিলো ও শান্তকে। ঘাড় নাড়িয়ে ‘জ্বী ভালো’ বলে টিপ খুজতে মনোযোগী হলো। শান্ত ভ্রু কুচকে বললো,

– কি সমস্যা আলো? কিছু খুজছো?

– আমার টিপ….

আনমনে এটুকো বলেই আলো থেমে গেলো। আরোবেশি অস্বস্তিতে পরে গেলো এবারে। একটা টিপ ও এইভাবে ফ্লোরে খুজছে, সিনিয়রকে এটা বলার চেয়ে অস্বস্তির আর কি হতে পারে? এবার এই লোক নির্ঘাত ওকে পচাবে। হলোও তাই। শান্ত শব্দ করে হেসে দিলো ওর কথা শুনে। হাসতে হাসতে বললো,

– তোমরা মেয়েরা পারোও। একটা টিপ এভাবে…

একুকোতেই শান্তও থেমে যায়। আলো মাথা নিচু করে ছিলো। শান্তর হাসি থামতে দেখে চোখ তুলে তাকায় ও। শান্ত একদৃষ্টিতে নিচতলায় তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আলোও এগিয়প এসে নিচে থাকায়। সেখানে তুল্য দাড়ানো, শার্লির কপাল স্পর্শ করে। মুহুর্তেই চোখ পানিতে ভরে ওঠে আলোর। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে ওর। শান্তও বোধহয় কোনো এক চাপা কষ্ট লুকিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো। শার্লি-তুল্যর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,

– কার কপালের টিপ, কার হয়ে যায়। হা?

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২৩.

অম্বুনীড়ে ঢুকে তুল্য তাথৈকে সিড়িতে বসে মোবাইল ঘাটতে দেখলো। ট্যুরের জন্য আজকেই বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। রাতের ট্রেন। তাই বুজোকে ওর এক বন্ধুর বাসায় রেখে আসতে গিয়েছিলো ও। ভাইকে দেখে ভাবান্তর হলো না তাথৈয়ের। তুল্য সিগারেট ফেলে দিয়ে বললো,

– ট্যুরে যাবি সেটা ড্যাডকে বলেছিস?

– বেরোনোর আগে জানিয়ে দেবো।

জবাব দিয়ে উঠে বাসার ভেতরে চলে যায় তাথৈ। তুল্য হতাশার শ্বাস ফেলে। নিজেকে নিয়ে ওর আফসোস নেই। ওর ধারনা, তাথৈয়ের এমন হওয়ার কারন ওই। বোনকে একা ছেড়ে বিদেশ পড়তে যাওয়াটা সত্যিই ওর উচিত হয়নি। এই অনুধাবন থেকেই দেশে ফিরেছিলো ও। কিন্তু লাভটা কি হলো? তাথৈ ওকে ততোটাই ঘৃণা করে, যতোটা ওর মাকে করে। তুল্য হার মেনে নেয়। যাকে ভালোভাবে বললে ত্যাড়া কথা বলে, খারাপভাবে বললে তেজ দেখায়, সেই মেয়েকে কি করে ঠিক করবে ও? নিজের রুমে চলে আসে তুল্য। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিচে নেমে দেখে তৈয়ব আলফেজ সোফায় বসে। হয়তো সবেই অফিস থেকে এসেছেন তিনি। তুল্যর হাতে ব্যাগ দেখে বললেন,

– কোথাও যাচ্ছো?

– ডিপার্টমেন্টাল ট্যুর।

জবাবটা তাথৈ দিয়েছে। তৈয়ব আলফেজ দেখলেন তার মেয়েও তৈরী হয়ে ব্যাগ নিয়ে নিচে নামছে। ভদ্রলোক বাড়তি আর একটা কথাও বললেন না। গম্ভীরভাবে বললেন,

– এক গাড়িতে যাও দুজন। এক ড্রাইভার স্টেশন থেকে দুজনের গাড়ি পিক করতে পারবে না।

বাবার ব্যবহার দেখে কিছুটা অবাক হয় তুল্য। তবে তাথৈ অবাক হয় না। ও জানে, তৈয়ব আলফেজের কাছে ওদের নিয়ে ভালোমন্দ বলার সময় নেই। দু ভাইবোন বেরোলো স্টেশনের উদ্দেশ্যে। রাত দশটার দিকে স্টেশনে এসে গাড়ি থামলো ওদের। তাথৈ ব্যাকসিট থেকে নেমে ট্রলি নামাতে চলে গেলো। তুল্য ফ্রন্টসিটে বসে ছিলো। নামতে গিয়ে একপলক সামনে তাকালো ও। ওদের গাড়ির বরাবর শার্লি দাড়িয়ে। পরীক্ষা, ভাইভার পর এ কয়দিনে আর ক্যাম্পাসে যায়নি কেউই। তাই আর দেখাও হয়নি ওদের। শার্লির পরনে সুতির কামিজ। ওর কপালের টিপটাও তুল্যর চোখে পরলো। শার্লি দু হাত কচলাতে কচলাতে, একদম আস্তে করে ঘাড় নেড়ে বুঝালো, ‘ঠিক আছে?’
তুল্যর ঠোঁটের কোনে মৃদ্যু হাসি ফোটে। মাথা ওপরনিচ করে হ্যাঁ বুঝায় ও। একদফা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নেয় শার্লি। তুল্য হেসে গাড়ি থেকে নামে। ততোক্ষণে তাথৈ ট্রলি নিয়ে এগিয়েছে। শার্লি ওরদিক এগোলো। উত্তেজনা নিয়ে বললো,

– ফাইনালী তুই এলি! আমরা ট্যুরে যাচ্ছি তাথৈ! ট্যুরে!

– অন্যকোনো অপশন ছিলো?

তাথৈয়ের ত্যাড়া জবাব শুনে নিমিষেই চুপসে গেলো শার্লি। তাথৈয়ের যাওয়ার যে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, তা ও ভালোমতোই জানে। তুল্য নিজের ট্রলি নিয়ে ওদের পাশ কাটাতে কাটাতে বললো,

– আর কয়েক মিনিট এখানে দাঁড়িয়ে অপশন চেইক কর। ট্রেন মিস করে অম্বুনীড়ে ফেরা একমাত্র অপশন পাবি তখন।

পা বাড়ালো তাথৈ-শার্লি। এগোতেই একঝাঁক ব্যাচমেট, জুনিয়র সিনিয়রকে দাড়িয়ে থাকতে চোখে পরে ওদের। হাজারো উত্তেজনা নিয়ে কক্সবাজার এক্সপ্রেসের সামনে সবাই। মাঝে দাড়িয়ে শান্ত কিছু বলছে, সবাই আরো উত্তেজিত হয়ে পরছে, আর টিটু ভিডিও করছে। আলো এককোনে চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো। না এসে উপায় ছিলো না ওর। কল করে আগেরদিন বারণ করায় ওকে অনেক কড়া কথা শুনতে হয়েছে শান্তর। শান্তর এক কথা ছিলো ও না গেলে তুল্য তাথৈ কেউই যাবে না। আর টপাররা না গেলে বাকিরাও যাবেনা। তাই বাধ্য হয়ে এসেছে আলো। একসময় তুল্যকে চোখে পরে ওর। লাল টিশার্টের ওপর জিন্সের সোয়েটার, পায়ে লাল কেডস। ট্রলি হাতে এগোচ্ছে সে। আলোর ঠোঁট মৃদ্যু হাসিতে প্রসারিত হওয়ার আগেই চোখ পরলো পেছনে শার্লির ওপর। পরবেই না কেনো? শার্লির পরিবর্তনটা তো চোখে পরার মতোই। চাপা কষ্টে হাসলো আলো। মনেমনে বললো, ‘আমার শখের পুরুষের জন্য তোমার সাজ-শখেরা চিরস্থায়ী হোক শার্লি।’
তাথৈ আলোর দিকে এগোলো। বললো,

– কখন এসেছো?

– প্রায় বিশমিনিট। তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে শার্লি।

তাথৈকে জবাব দিয়ে আলো পরমুহুর্তে শার্লির প্রশংসা করতে ভুললো না। শার্লি মৃদ্যু হেসে ‘থ্যাংকস’ বললো। আলোর সম্পুর্ন স্বাভাবিক ব্যবহার ছিলো। টুকিটাকি কথা বলতে লাগলো ওরা। একটুপরেই ট্রেনে উঠে বসতে ডাক লাগালো শান্ত। চমকে উঠে ত্রিশজনের মতো ছেলেমেয়ের দিকে তাকালো তাথৈ। ওর অজান্তেই ওর চোখজোড়া খুজতে শুরু করলো কাউকে। শান্তর কথামতো জিনিসপত্র সমেত ট্রেনে উঠে বসে প্রত্যেকে। শোভন চেয়ারের একটা পুরো বগি বুক করা হয়েছে ওদের। শার্লির ধাক্কায় হুশে ফেরে তাথৈয়ের। স্টেশনটায় আরেকদফা চোখ বুলিয়ে উঠে পরে ট্রেনে।

মাত্র আধঘন্টার মাঝে ট্রেনটা দুটো স্টেশন পেরোয়। আর একটুকোতেই বিরক্ত হয়ে উঠলো তাথৈ। আওয়াজ থেকে বাচতে ও ইচ্ছে করে পেছনের উইন্ডো সিটে বসেছে৷ পাশের সিটটায় শার্লি। সামনের জানালার সিটে আলো, পাশে আরেকজন মেয়ে। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই সবার মাঝে কলরব পরে গেছে। সামনেরদিকে গানবাজনা, হুল্লোড়, ভিডিও রিলস করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সব। এতো কলরব অপছন্দের বলে তাথৈ শুরুতেই কানে হেডফোন গুজে দিয়েছিলো। কিন্তু এভাবে আর কতোক্ষণ? শার্লি উঁকিঝুকি দিয়ে সামনের সারির সিনিয়র জুনিয়রের গলা ছেড়ে গান গাওয়া দেখছিলো। বিরক্তি নিয়ে কান থেকে হেডফোন টেনে খুলে ফেললো তাথৈ। গায়ে থাকা হুডিটাও খুলে ফেললো। আলো বললো,

– হুডি খুলছো কেনো তাথৈ? অনেক ঠান্ডা! অসুস্থ হয়ে পরবে!

– এই আওয়াজের মধ্যে থাকলে পাগল হয়ে যাবো!

এটুক বলেই সিট থেকে বেরিয়ে আসলো তাথৈ। বগির পেছন দিকের দরজায় এগোলো। সেখানে গিয়ে দেখে আফিফ বন্ধ দরজার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে। তাথৈকে দেখে ও বললো,

– কিছু বলবি?

– স্মোকিং শেষ করে সরে দাড়া। আমি দরজায় দাড়াবো।

আফিফ সোজা হয়ে দাড়ায়। এগিয়ে এসে তাথৈয়ের সামনে দাড়ালো ও। ফু দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বললো,

– যদি না সরি?

– আমার সাফোকেশন হচ্ছে।

– এটা ট্রেন! তোর বাপের সম্পত্তি না যে তোর কথায় আমার সরে দাড়াতে হবে! তাছাড়া ট্রেনে আবার সাফোকেশন কিসের?

মুহুর্তের ব্যবধানে নিজেকে দরজায় আটকানো অবস্থায় পেলো আফিফ। শ্বাস আটকে দিতে চলা মাফলার টেনে ধরে কোনোমতে। ওর গলার মাফলারটা দরজার হাতলে পেচিয়ে, তাতে ফাঁস সৃষ্টি করেছ তাথৈ। ওর চেহারাজুড়ে রাগ। আফিফ কেশে উঠলো। জোর খাটাতে যাচ্ছিলো ও। তাথৈ শক্ত আওয়াজে বললো,

– ঠিক এইরকমই সাফোকেশন হচ্ছে আমার!

আফিফ মাফলার টেনে বের হওয়ার চেষ্টা করলো। উল্লাসী আওয়াজ শুনে নমনীয় হলো তাথৈ। বগির ভেতরে একপলক দেখে নিয়ে, আফিফের মাফলার ছেড়ে দিলো ও। বললো,

– পরিস্থিতি তোকে ছাড় দিচ্ছে আফিফ। কিন্তু তুই তার সুযোগ নেওয়ার মতো ভুল করিস না। কারন গোটা মহাবিশ্ব ছাড় দিলেও, আমি ছাড় দেই না। তাথৈ আলফেজ ছাড় দিতে জানে না। সেদিন আমাকে অপমানের জবাব পাওনা আছে তোর। তাশদীদ ওয়াসীরের দেওয়া একটা চড় এনাফ ছিলো না তোর জন্য।

আফিফের তাশদীদের দেওয়া চড়টার কথা মনে পরে যায়। চড়টা যথেষ্ট ছিলো কি ছিলো না, তা কেবল যে খেয়েছে, সেই জানে। পুরো একদিন একরাত কানে শুনতে পায়নি ও। তীক্ষচোখে চেয়ে , ওখান থেকে চলে আসলো আফিফ। তাথৈ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ট্রেনের দরজা খুলে দিলো। চোখ বন্ধ করে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ালো। হিমশীতল বাতাসে প্রচন্ড ঠান্ডা অনুভব করলেও একচুল নড়লো না তাথৈ। কিছুটা সময় পর ট্রেনের গতি কমে আসে। তাথৈ বুঝলো, সামনে স্টেশন। চোখ মেলে দেখলো, বিমানবন্দর স্টেশন। এ বগিতে আরকেউ উঠবে না বলে তাথৈ দরজা থেকে সরলো না। বেখেয়ালি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্টেশনের দিকে। হঠাৎই ‘শান্ত!’ ডাকটা কানে আসে ওর। পরিচিত স্বর শুনতেই হরিণীর মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে তাথৈয়ের চোখজোড়া। পিপাসু চাওনিতে প্লাটফর্মের শত মানুষের ভীড়ে কাউকে খুজতে থাকে ও। কিন্তু কাউকে পায়না। এরমাঝেই ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার জন্য হুইসেল দেয়। ভেতরেভেতরে অস্থির হয়ে পরে তাথৈ। একআকাশ অস্থিরতা নিয়ে আরো বেশিকরে খুজতে থাকে সেই আওয়াজধারীকে। ট্রেন ছেড়ে দেয়। তাথৈ দরজা দিয়ে মুখ বারিয়ে বগির সামনের দরজায় তাকালো। টিটু সামনের দরজায় ঝুলছে। শান্ত ওর গায়ের ওপর ভর করে চেচালো,

– তাশদীদ???

ওদের দৃষ্টি অনুসরন করে তাথৈ তেমনি অস্থিরচিত্ত্বে পেছন ফেরে। ওর চোখে পরলো, ওদের পরের বগির সামনে বসে জুতার ফিতে বাধছে তাশদীদ। পরনে কালো হুডি, কাধে ব্যাগ, পাশে একটা ওয়ানটাইম গ্লাসে চা। শান্তর ডাক শুনে একবার মাথা তুললো ও। খুবই ধীরস্থিরভাবে ‘আরে’ বলে জুতোর ফিতে বাধা শেষ করলো ও। এদিকে ট্রেনের গতির তারসাথে তাথৈয়ের উদ্বেগও বাড়ছিলো। কিন্তু তাশদীদের ওমন নিশ্চিন্ত ভাব দেখে কপাল কুচকে আসে ওর। ট্রেন ছাড়তে দেখেও কোন মানুষটা উঠে দৌড়ানোর পরিবর্তে জুতার ফিতে বাধায় মনোযোগ দেয়? শান্ত আবারো চেচালো,

– ভাই তোর জুতার ফিতা আমি বেধে দিচ্ছি! আগে ট্রেনে তো ওঠ!

তাশদীদ ফিতে বাধা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিলো। কথা ছিলো সাভার থেকে কমলাপুর না এসে সোজা এই স্টেশন থেকেই উঠবে। কিন্তু তামজিদের যন্ত্রণায় প্রীতিকার্নিশ থেকে বেরোতে দেরী হয়েছে ওর। এখন ট্রেনটাও ছেড়ে দিচ্ছে। ওকে চায়ের কাপ ধরতে দেখে তাথৈয়ের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। এই লোক জানে তাকে দৌড়াতে হবে, তারপরও সে চায়ের কাপ হাতে নিচ্ছে? সামান্য চায়ের মায়া ত্যাগ করতে পারলো না? তাশদীদ দৌড়াতে দৌড়াতে দেখলো ট্রেনের সামনের দুইটা বগি প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে গেছে। উপায়ন্তর না দেখে চেচিয়ে বললো,

– তোরা যা, আমি পেছনের বগিতে…

ঠিক সে সময়েই ওদের বগির পেছনের দরজায় তাথৈকে চোখে পরে তাশদীদের। বরাবরের মতো আজও ওর পরনে কুর্তা। কিন্তু সেটা সবুজ রঙের বলে গাড়ির রঙ না জামার রঙ তা খেয়াল করতে পারেনি তাশদীদ। এতোক্ষণ ভেবেছিলো হয়তো পেছনের দরজা খোলা না৷ তাথৈকে পেছনের দরজায় একা দাড়াতে দেখে তাশদীদ হাসলো। চায়ের কাপটা ফেলে দিলো ও। ডানহাতের ব্যাগটা কাধে ঠেকিয়ে আরেকটু বেগ বাড়িয়ে দৌড় লাগালো। চলন্ত ট্রেনের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে বললো,

– হাতটা তো দিচ্ছো না! ব্যাগটা ধরো।

তাথৈ প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই ব্যাগ ওর কোলে ছুড়ে মারে তাশদীদ। আকস্কিকতায় ব্যাগটা ক্যাচ ধরার মতো করে দুহাতে জাপটে ধরলো তাথৈ। তাশদীদ কোনোমতে দরজার হাতল ধরে ট্রেনে ওঠে। কিন্তু সমস্যা হয় অন্যত্র। ঝোঁক সামলাতে না পেরে ও অনেকটা কাছে চলে আসে তাথৈয়ের। তাথৈয়ের পেছনে হাত রেখে দুরুত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলো তাশদীদ। পারেনি। ব্যাগ বুকে আকড়ে ধরে তাথৈ চোখ তুলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তাশদীদের দৃষ্টিও ওর চোখে স্থির রয় দু দন্ড। সামনে থেকে টিটুর চেচিয়ে বললো,

– তাশদীদ? উঠেছিস তুই?

মুদ্যুস্বরে হু বলে আস্তেধীরে তাথৈর হাত থেকে ব্যাগটা নিলো তাশদীদ। কোনোরকম শীতের জামাকাপড় না পরে দরজায় দাড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে নোয়ানো আওয়াজে প্রশ্ন করে বসলো,

– শীত করছে না?

তাথৈ ওভাবেই তাকিয়ে রইলো। জবাব দিলো না৷ অকস্মাৎ নিজের হাতের উল্টোপিঠ তাথৈয়ের উন্মুক্ত গলায় ছোয়ালো তাশদীদ। চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে, দেয়ালে আরো লেপ্টে দাঁড়িয়ে গেলো তাথৈ। তাশদীদ সেকেন্ডের ব্যবধানে হাত সরিয়ে নিলো। ব্যাগসমেত বগির সামনের দিকে ছুট লাগিয়ে বললো,

– হ্যাপি শীত! এন্ড থ্যাংকিউ মিস গ্রিন ফ্ল্যাগ।

তাথৈ ‘গ্রিন ফ্ল্যাগ’ শব্দদুটোকে নিজের সাথে মেলাতে পারলো না। কেবল নিরবে দেখলো, এক দুরন্ত মানব ওকে থামিয়ে দিয়ে, ওর রাগকে জমিয়ে দিয়ে সামনে গিয়ে হৈচৈ বাধিয়ে দিয়েছে। তাশদীদ যেতেই ছেলে মেয়ে সবাই মিলে হৈ হৈ করে উঠেছে। ব্যাগটা টিটুর দিকে ছুড়ে মেরে বাকিসবের সাথে তাশদীদ নিজেও চেচাচ্ছে, নাচছে। গুটিগুটি পায়ে নিজের সিটের দিকে আসলো তাথৈ। হুডিটা পরে চুপচাপ বসে পরলো সিটে। ও টের পেলো, ওর শরীর প্রচন্ডরকমভাবে কাঁপছে। শ্বাসপ্রশ্বাস গাঢ় হচ্ছে। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তো ওর শীত করছিলো না। তাহলে? হঠাৎ এমন কম্পনের কারন কি। শীত? নাকি শিহরন? রাগ? নাকি রোষানলকে প্রশমিত করতে জানা শীতলতা?

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২৪.

‘চলন্ত ট্রেনের দরজায় তাথৈয়ের অনেকটা কাছে দাড়ানো তাশদীদ। অকস্মাৎ গলায় ছুয়েছে ওর।’
চোখে এমন দৃশ্যপট ভেসে উঠতেই সর্বাঙ্গ ঝাঁকি দিয়ে ঘুম ভেঙে যায় তাথৈয়ের। চোখ মেলে নিজের অবস্থান আর আশপাশ পরখ করলো ও। মৃদ্যু আলোতে দেখলো, ট্রেনের সবই ঘুমোচ্ছে। নড়েচড়ে বসে পাশের জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে দিলো তাথৈ। জানালার কাচে ঘেমে ওঠার মতো পানিকনা জমেছে। ঘড়িতে দেখলো ভোর পাঁচটা চল্লিশ। বাইরে তখনো অন্ধকার। আস্তেধীরে সিট থেকে বেরিয়ে আসে তাথৈ। ওয়াশরুম থেকে ফেরার পথে ওর চোখে পরলো, সামনের দিকের একটা সিটের একজনের মাথার ওপরিভাগ ডানেবামে নড়াচড়া করছে। যখন সবাই ঘুমোচ্ছে, এ সময় না ঘুমিয়ে কেউ জেগে আছে কেনো? তাথৈয়ের অহেতুক আগ্রহ জাগে। কপাল কিঞ্চিৎ ভাজ করে একপা দুপা করে এগোতে থাকে ও। কাছাকাছি গিয়ে দেখলো, সিটটায় তাশদীদ বসে। পশ্চিমমুখো হয়ে বসে, হাটুতে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে সালাম ফেরাচ্ছে সে। তাথৈ অবিশ্বাসী চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে। এতো মানুষের ভীড়ে, এই একটা মানুষের এতোসব দিক কেনো ওরই সামনে আসে? কেনো নিগ্রহ স্বভাব বদলে, শুধুমাত্র তাশদীদ ওয়াসীর নামটায় ওর আগ্রহ জুড়ে যাচ্ছে? মুগ্ধতা একটা সাধারণ শব্দ থেকে ওর কাছে অনুভূতিতে রুপান্তরিত হচ্ছে কেনো?
সালাম শেষ করে চোখ মেলতেই হাতের বামে তাথৈকে চোখে পরলো তাশদীদের। মৃদ্যু হাসলো ও। ওর হাসিটা দেখে তাথৈয়ের ধ্যান ভাঙে। নিজেকে সংযত করে নেয় তৎক্ষনাৎ। তাশদীদ পাশের ঘুমন্ত টিটুকে দেখে নিয়ে ফিসফিসয়ে বললো,

– ঘুম আসছে না?

তাথৈ জবাব দিলো না। স্তব্ধ পায়ে আবারো নিজের সিটে এসে বসলো ও। পায়ের জুতা খুলে, দু পা সিটের ওপরে তুললো। তারপর দুহাতে হাটু জড়িয়ে বন্ধ করে নিলো চোখ। ওর মনে হতে লাগলো, ওর ঘুম পাচ্ছে, প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। যে ঘুম কারো শীতলতার স্পর্শ এসে ভেঙে দিয়ে গিয়েছিলো, কারো কথার আবেশ যেনো তারচেয়ে অনেকবেশি উষ্ণতায় ওকে নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিচ্ছে।
আলোর ডাকে সকালে ঘুম ভাঙলো তাথৈয়ের। ফ্রেশ হয়ে এসে মোবাইল চেইক করলো ও। রুমন ম্যাসেজ করেছে। শার্লিকে ম্যাসেজগুলো দেখিয়ে, খুশি হয়ে গেলো দুজনে। ওদের সকালবেলার খাবারটা ট্রেনেই দেওয়ার কথা। যেহেতু সবটার দায়িত্বে শান্ত ছিলো, ও, তাশদীদ, টিটু আর ওদের আরো দুজন বন্ধু মিলিয়ে সবাইকে খাবার সার্ভ করতে লাগলো। শান্ত আর তাশদীদ তাথৈদের পেছনদিক থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো দিচ্ছিলো। তাথৈদের সিটে এসে শার্লিকে চোখে পরে ওর। তাথৈ, আলোকে প্যাকেট দিয়ে, শার্লিকে খাবার দেওয়ার সময় শান্ত হেসে বললো,

– বা শার্লি! তোমার ড্রেস সেন্স আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়ে গেছে দেখছি!

শার্লি কিছুটা অস্বস্তিতে পরে প্যাকেট হাতে নেয়। আলো নিজের ঠোঁটের জোরালো হাসিটা ঠিক রাখলো। মনেমনে হয়তো বললো, ‘হতেই হতো।শার্লিকে চুজ করা মানুষটাও তো…’ তাশদীদ শান্তর ওপরপাশে ছিলো। প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে, সিটের হাতলের ওপর বসে থেকে হেসে বললো,

– এন্ড শি ইজ লুকিং বিউটিফুল!

শার্লি মৃদ্যু হেসে বললো, ‘থ্যাংকিউ তাশদীদ ভাই’। শান্ত নিজের হাতের প্যাকেটগুলোর দিকে মলিন হাসলো। পা বাড়ালো সামনে। নিচদিক তাকিয়ে থেকে হাতের মাঝে থাকা প্যাকেটটা শক্ত করে মুঠো করে নেয় তাথৈ। মচমচ শব্দ করে ওঠে প্যাকেটটা। তাশদীদ উঁকি দিয়ে আওয়াজের উৎস দেখলো। তারপর চলে গেলো শান্তর সাথে। শান্ত তুল্যর কাছে এসে খাবারের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরলো। তুল্য সিটের হাতলে হাত রেখে শক্ত করে হাতল ধরে রেখেছিলো। শান্তর দিকে চেয়ে হেসে, তবে রাগ নিয়ে বললো,

– জুনিয়র মেয়েদের ড্রেস সেন্স আপনার ভালোই মনে থাকে দেখছি শান্ত ভাই! তবুও আপনার সিজি খারাপ কেনো? পড়া মনে থাকেনা?

সবার সামনে কথাটা শুনে শান্তর হাসিটা গায়েব হয়ে যায়। আত্মসম্মানে আঘাত লেগে চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে ওর। শার্লির পরিবর্তন প্রাণরসায়নের যে কারো চোখে পরার মতো। তাই তুল্য কথাটা যেভাবে বলেছে, সেটা শোনার মতো সহ্যশক্তি ওর নেই। ঝামেলা করতে উদ্যত হচ্ছিলো ও। তাশদীদ পাশেই ছিলো। ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই ও পাশ থেকে বলে উঠলো,

– ঠিকি বলেছো তুল্য। জুনিয়র ছেলেরা দৈনিক কয়টা সিগারেট খেয়ে টপ করে, সেটাও ওর মনে থাকে। শুধু পড়াই মনে থাকে না। বাই দা ওয়ে, এনি সাজেশন ফ্রম ইউ?

শান্ত এগোতে গিয়েও থেমে যায়। তুল্য জবাব পেয়ে খাবারের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে অন্যদিক মুখ করে রইলো। তাশদীদের দিকে চেয়ে হাসলো শান্ত। প্রতিত্তোরে চোখ টিপে হাসলো তাশদীদও। নিজেদের কাজ শেষ করলো দুজনে। খাওয়াশেষে চা-কফির আড্ডায় আরেকদফায় কিছু ভিডিও নেয় তাশদীদরা।
জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে, মনোযোগ দিয়ে ওদের হুল্লোড় শুনছিলো তাথৈ। শার্লি, আলো নিজেরা কথা বলতে বলতে খেয়াল করলো, তাথৈ সকাল হবার পর একবারো কানে হেডফোন লাগায় নি। ওদের কথা শুনে জবাব না দিক, তাথৈয়ের ঠোটে ফোটা কিঞ্চিৎ হাসিটাই ওদের জন্য যথেষ্ট।
বেলা এগারোটার নাগাদ ট্রেন পৌছায় কক্সবাজার স্টেশনে। একঝাক তরুণতরুণী হৈচৈ বাধিয়ে ট্রেন থেকে নামে। তুল্য আগেআগে নেমে একপাশে দাড়ালো। তাশদীদ শান্তরা নেমে সবাইকে গুনে আগেআগে চললো। ওদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলো বাকিসব। তাথৈকে বেরোতে দেখে তুল্য এগোলো। বললো,

– ট্রলিটা আমাকে দে।

– তোর হেল্পের দরকার নেই আমার।

স্পষ্ট জবাব দিয়ে, চোখে সানগ্লাস এটে পা বাড়ালো তাথৈ। ঠিক সেসময়ই শার্লি পাশ কাটালো তুল্যকে৷ তুল্য পেছন থেকে ডাক লাগালো,

– ওয় শার্লি!

চমকে দাড়িয়ে যায় শার্লি। দুরুদুরু বুক নিয়ে পেছন ফিরলো ও। তুল্য এগিয়ে শক্ত আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,

– তুই স্টেশনে ইশারা করেছিলি কেনো আমাকে?

শার্লি থতমত খেয়ে যায়। তবে চোখ তুলে তাকালো না ও। বহুকষ্টে সাহস করে জবাব দিলো,

– ট্ টিপটা ঠিক জায়গায় পরেছি কিনা। ভাইভার দিন তুই টিপ পরিয়ে দিয়েছিলি, তাই…

– তো? আমি একদিন টিপ পরিয়েছি বলে তুই দৈনিক টিপ পরবি? দৈনিক আমাকে জিজ্ঞেস করবি টিপ ঠিক আছে কিনা?

এবারে চোখ তুলে তাকালো শার্লি। রাগ হলো ওর। তখন তো ঠিকই টিপ ঠিক আছে বোঝালো। এখন এই ছেলে ওকে এটিচিউড দেখাচ্ছে। গলায় জোর সঞ্চার করে বললো,

– ওইদিন ঠিকঠাক পরিয়েছিলি বলে ভেবেছিলাম তোর অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে। তাই আজ পরেছি বলে জিজ্ঞেস করেছিলাম! আর পরবো না টিপ! জিজ্ঞেসও করবো না তোকে!

তেজ দেখিয়ে চলে আসছিলো শার্লি। পেছন থেকে ওর হাত কোমড়ে চেপে ধরে তুল্য। ‘দেখ তুল্য…’ বলে শার্লি মুখ খুলতে যাবে, তুল্য ওকে সুযোগ না দিয়ে বললো,

– লিসেন! তোর এই গেটআপ কেবল লোকজনের নজর কাড়ছে! এই তেজটা এই গেটআপে ঠিক মানাচ্ছে না। সো তেজ দেখাতে চাইলে, আগের মতো টমবয় সেজে, তারপর আসিস আমাকে তেজ দেখাতে! গট ইট?

বলাশেষে তুল্য শার্লির হাত ছেড়ে দিলো। হনহনিয়ে চলে গেলো ওকে পাশ কাটিয়ে। বহুদিন পর চোখ জলে ভরে উঠলো শার্লির। এই ছেলে কি চায়? এমন বাজে ব্যবহার কেনো করলো? এর আগেও তুল্য ওকে ধমকেছে। কিন্তু তখন তো ওর এমন খারাপ লাগেনি। তাহলে আজ কেনো এতোটা খারাপ লাগছে ওর? সবার থেকে পিছনে পরে যাওয়ায় তাথৈ পিছন ফিরে ডাক লাগালো ওকে। শার্লি দ্রুত পলক ফেলে অশ্রু সামাল দিলো। মৃদ্যুবেগে দৌড়ে তাথৈয়ের পাশে পাশে হাটতে লাগলো ও।

হোটেলে এসে এক রুমে পাঁচটা মেয়েকে দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পরলে তাথৈয়ের। রুমের দরজায় দাড়িয়ে ভেতরে আরো দুটো মেয়েকে দেখে কাচুমাচু মুখ করে তাথৈয়ের দিকে তাকালো আলো। যে মেয়ে আরেকজনের নিশ্বাসবায়ুতেও রাগ দেখায়, সে মেয়ে কি করে আরো চারজনের সাথে রুম শেয়ার করবে? স্টেশন থেকে হোটেলে লোকাল অটো করে আসতে হয়েছে ওদের। সেখানে ছয়জনের সিটের অটোতে তাথৈ যে অতি কষ্টে নিজেকে সংবরন করেছিলো, তা স্পষ্ট বুঝেছিলো আলো। রুমের ভেতরে দুটো বিছানার একটাতে মেয়েদুটো এসেই লাগেজের সব জিনিসপত্র নামিয়ে ফেলেছে। তাথৈ দুদন্ড ওদের কর্মকাণ্ড দেখে মুখ খুললো। সোজাসাপ্টা প্রশ্ন ছুড়লো,

– কোন ব্যাচ আপনারা?

– ফাইনাল ইয়ার।

জুনিয়র রুমমেটের আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় আলোর। এখন এই সিনিয়র আপুদের সাথে তাথৈকে কি করে সামাল দেবে ও? তাথৈ বাহাতে কপালের ওপরনিচ বরাবর ডলতে লাগলো। শার্লি এতোক্ষণ চুপ ছিলো। কি ভেবে হাটা লাগালো ও। সোজা এসে রিসেপশনে বসা শান্তকে বললো,

– আমাদের রুমে দুজন সিনিয়র আপু আছেন। ওনাদের কোনোভাবে অন্যরুমে শিফট করানো যায় শান্ত ভাই?

কফি হাতে ফোনে স্ক্রল করছিলো শান্ত। তুল্যর ব্যবহারে জন্য শার্লিকে দেখে রাগ হলো ওর এ মুহুর্তে। বেশ কড়া গলায় জবাব দিলো,

– তোমাদের আবদার পুরনে বসে নেই আমি! বাজেটে যেভাবে প্লান করা গেছে, সেটাই করেছি! থাকার হলে থাকো, আদারওয়াইজ লিভ!

শান্তর উচ্চস্বর শুনে কিছুটা দুর থেকে ওরদিকে তাকালো তাশদীদ। শার্লি নিজেও অবাক হয়েছে ওকে চেচাতে দেখে। চুপচাপ চলে আসছিলো ও। তাশদীদ ওরদিক এসে বললো,

– কি সমস্যা শার্লি?

তাথৈয়ের ব্যাপারে তাশদীদকে জানালো শার্লি। তাশদীদ হতাশ হলো। গায়ের হুডিটা খুলে হাতে মুঠো করে, শার্লিকে পথ দেখিয়ে বললো,

– চলো।

শার্লি এগোলো। ওর পেছনপেছন তাশদীদও আসলো। ওরা রুমের সামনে এসে দেখে তাথৈ সেভাবেই কপাল ডলছে আর পায়চারী করছে। আলো দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ। তাশদীদ এসেই তাথৈয়ের ট্রলিটা ধরে দরজায় নক করলো। বড়বড় চোখে ওরদিক তাকিয়ে রইলো তাথৈ। তাশদীদ দরজা খুলে ট্রলিটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, সোজা এসে হাত ধরলো ওর। তারপর ওকেও রুমে ঢুকিয়ে, হাত ছেড়ে দিলো। খালি বিছানাটা দেখিয়ে বললো,

– এটা চারজনের রুম। বাজেট সংকুলানের জন্য একরুমে পাঁচজনকে সেটেল করে দিতে হয়েছে। দুইবেডে দুজন দুজন করে চারজন, আরেকজন সোফায়। এখন ওরা দুইজন ওই বেড দখল করেছে। তো তুমি চাইলে একা এই বেড দখল করতে পারো, আলো-শার্লি সোফায় ঘুমোবে; নয়তো বেডটা আলো শার্লিকে দিয়ে তুমিই সোফায় ঘুমাতে পারো; আর নয়তো তিনজনে মিলে এক বেডে ঘুমাতে পারো। ইওর উইশ। দুইটায় লান্চ, ফ্রেশ হয়ে দোতলার বুফেতে চলে এসো।

একপলক রুমের বাকি চারজনকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেলো তাশদীদ। ও চলে যেতেই সিনিয়র মেয়েদুটো কিছু একটা বলে শব্দ করে হেসে উঠলো। সেটুক কানে গেলো তাথৈয়ের। ধপ করে সোফায় বসে গেলো ও। দু হাটুতে দুহাতের কনুই ঠেকিয়ে, আঙুলগুলো ভাজেভাজে শক্তমুঠো করে নিলো। চোয়াল শক্ত করে নিচদিক তাকিয়ে রইলো ও। আলো-শার্লি একে অপরের দিকে তাকালো। ওরা বুঝলো, তাথৈ নিজের রাগ সংবরন করার চেষ্টা করছে। কেবল এটুকো বুঝলো না, তাথৈ কেনো নিজের রাগ সংবরন করার চেষ্টা করছে।

সুবিশাল জলরাশির সুউচ্চ ঢেউ একের পর এক আছড়ে পরছে ইনানী সি বিচে। বিচের অনেকটা দুরে দাড়িয়ে, বালুতীরে সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়রদের দৌড়াদৌড়ি করতে দেখছে তাথৈ। দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রামশেষে সবাইমিলে বেড়াতে এসেছে বিচে। তাথৈয়ের ইচ্ছে ছিলো না আসার। কিন্তু ও না এলে আলো শার্লিও আসবে না বলছিলো। তাই বাধ্য হয়ে এসেছে ও। বাকিরা ছোটাছুটি করছে, সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাচ্ছে, শার্লি বালুতে কিছু লিখছে, আবার মুছছে। আলো বালি দিয়ে ঘর তৈরীর চেষ্টা করছে। তাথৈ কিছুটা ডানদিকে তাকালো। তুল্য বিচের চেয়ারগুলোতে আধশোয়া হয়ে ডাবের পানি খাচ্ছে। ভাবখানা এমন, ও মোবাইল চালাচ্ছে। অথচ ওর দৃষ্টি শার্লির দিকে। শার্লি চেন্জ করে আবারো জিন্স টিশার্ট পরেছে এখন। এদিকটায় শীতের প্রকোপ তুলনামুলকভাবে কম। সমুদ্রের বুকে ডুব দেবে বলে বিকেলের সোনালী রোদটা বাতাসের সাথে মিশে বেশ আরামদায়ক পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছে। ডাবের স্ট্র টা বের করে এক পর্যায়ে ছুড়ে মারলো তুল্য। তারপর মুখ লাগিয়ে খেতে লাগলো। ভাইয়ের রাগ দেখে অভ্যস্ত তাথৈ চোখ সরিয়ে নিলো। এরমাঝে কানে আসলো,

– এখানে দাড়িয়ে ঢেউ গুনছো? নাকি কোরাল পাথর গুনছো?

তাথৈ পাশে তাকালো। অফ হোয়াইট রঙের শার্ট আর জিন্স পরিহিত তাশদীদ ওর পাশে দাড়ানো। তাশদীদের শার্টের ওপরের দুইটা বোতাম খোলা, প্যান্টের নিচেরদিকটা ভাজ দিয়ে পায়ের গিটের ওপর অবদি তোলা। পকেটে দু হাত গুজে দাড়িয়ে আছে সে। তাথৈ জবাব দিলো না। জবাব না পেয়ে তাশদীদ দুপা এগোলো। আগ্রহ নিয়ে শুধালো,

– কি সমস্যা তোমার? বাধভাঙা আনন্দের স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে না? সৌন্দর্য উপভোগের পিপাসা জাগে না?

– আনন্দ বলতে আমি কেবল আমার সঙ্গ বুঝি। আর সৌন্দর্য উপভোগের কিছু না, ওটা দেখার বস্তু৷

তাশদীদ হেসে ফেললো ওর কথায়। ওরদিক বাকা চোখে তাকালো তাথৈ। তাশদীদ হাসি কমিয়ে ওর সামনে এসে দাড়ালো। বললো,

– এতো ভুল জেনে টপ করো কি করে?
যাইহোক, লেট মি কারেক্ট ইউ। আনন্দ বলতে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গকে বুঝায়। তুমি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারো, কিন্তু নিজেই নিজের ভালোবাসা হতে পারো না। রইলো বাকি সৌন্দর্য কি? সৌন্দর্যকে দেখার উদ্দেশ্যই হলো উপভোগ।

– যা ঘরে বসে উপভোগ করা যায়, তার জন্য এতোসব অনর্থক।

– যেটাকে তুমি অনর্থক বলছো, তা মোটেও অনর্থক না ম্যাডাম তাথৈ আলফেজ। আই’ল পারসোনালী মেক শিওর, এই ট্রিপে তুমি অভূতপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব কিছুর অভিজ্ঞতা পাও। এন্ড দ্যাটস মাই প্রমিস!

বড়সড় একটা হাসি দিয়ে বলা শেষ করলো তাশদীদ। তাথৈয়ের দিক তাকিয়ে দু পা পেছোলো ও। তারপর মৃদ্যুবেগে দৌড়ে চলে গেলো শান্তদের দিকে। তাথৈ একহাত বুকে গুজে আরেকহাতে গলার চেইনটা খামচাতে লাগলো। সামনে দেখার মতো এতোকিছু মাঝেও, ওর একজনে দৃষ্টি স্থির। গ্রুপফটো, সেলফি, ভিডিওতে হুল্লোড় মাতিয়ে রাখা সে চির-হাসোজ্জ্বল মুখটায়। তাশদীদ ওয়াসীরে।

#চলবে…