কি নামে ডাকবো তোমায় পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
27

#কি_নামে_ডাকবো_তোমায়
#আফরিন_সিকদার
অন্তিম পর্ব

গলির প্রান্তে ভগ্ন টিনশিটের কুটিরের অন্তঃস্থলে সামিউল ও তার দলের আসন। টেবিলের উপর সস্তা মদের কাচপাত্র, অর্ধদগ্ধ সিগারেটের ছাই, তাসের স্তূপ। বিকট অট্টহাস্যে মত্ত সকলে। মৃন্ময়ী উপুড় হয়ে নিথর মেঝেতে শায়িত। নওশাদ তাকে বিসর্জন দিয়ে প্রস্থান করেছে সেখান হতে। সামিউলে ডান হাতে জ্বলন্ত সিগারেট আর বাম হাতে কাচের দ্যুতিময় মদের পাত্র ধারণ করে মৃন্ময়ীর পার্শ্বে অগ্রসর হয়। মৃন্ময়ীর সম্মুখে হাটুগেড়ে অবস্থিত হয়। নাসিকা-মুখ দিয়ে ধূম উগরে ঝাঁঝালো মদের পাত্রে চুমুক দেয়। মৃন্ময়ী শিরোন্নতি করে দৃষ্টি তোলে। মদের তীব্র গন্ধে নাসা-মুখ কুঞ্চিত হয়। সামিউল বিকট হাসি দিয়ে উচ্চারণ করে,

“আইজ নতুন মদের গন্ধ নিলি বুঝি?তোর স্বামী তো এক নাম্বারের নেশাখোর। অথচ ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে আইজই প্রথম মদের গন্ধ নাকে গেলো!”
মৃন্ময়ী শাড়ির আচল তুলে ঘুরিয়ে সুন্দর করে গায়ে পেচিয়ে নিলো।কেমন উশখুশ করছে অস্বস্তি লাগছে তার এখানে।সামিউল মানুষ হিসেবে কতটা জঘন্য সেটা মৃন্ময়ী জানে।গ্রামে পাশে বাড়ির পনেরো বছরের মেয়েটাকে ধর্ষণ করে এখানে গা ঢাকা দিয়েছিলো।অবশ্য এখন বুক ফুলিয়ে গ্রামে যাওয়া আসা করে। দেশের আইন বিভাগের ব্যবস্থা একদমই জঘন্য যে ধর্ষণ করে তাকে নয় যে ধর্ষিত হয় তাকেই মুখ লুকিয়ে চলতে হয় সমাজে। সামিউল নারী দেখলেই উত্ত্যক্ত করে গায়ে হাত দেওয়া চেষ্টা করে।
মৃন্ময়ী বসা থেকে চট করে উঠে দাঁড়ায়।এক পা দুপা করে পিছনের দিকে পা বাড়ায়।
মৃন্ময়ী দরজার কাছাকাছি আসতেই দরজার কপাট আটকে যায় খট করে।মৃন্ময়ী তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়।পিছনে পরপর সারি বেধে দাড়িয়ে আছে সামিউলের দলের লোকেরা।মৃন্ময়ীর সর্ব শরীরে কাঁপুনি। গলির পাশেই দোকান থেকে ভেসে আসছে মানুষের কন্ঠস্বর। সবাই নানা গল্পগুজবে মেতেছে।হাসিঠাট্টায় আড্ডায় মগ্ন।মৃন্ময়ী এদিক ওদিক চেয়ে দৌড়ালো জানালার দিকে।জানালার পাল্লাগুলো হাত দিয়ে ভালো ভাবে খুলে দিয়ে তাকালো ডানে।চায়ে পা রুটি ডুবিয়ে বেশ মজা করে চা খাচ্ছে নওশাদ।মৃন্ময়ী গলা উচিয়ে ডাকে।ভেজা কন্ঠস্বরে থেমে থেমে বলে,
“রক্ত বেঁচে হলেও আপনার টাকা আমি শোধ করে দিবো।দয়া করে এই পিশাচের হাতে আমারে ছেড়ে দিবেন না।”
নওশাদের কান অব্দি পৌছালো না মৃন্ময়ীর ডাক।মৃন্ময়ী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।
সামিউল ততক্ষণে মৃন্ময়ীর কাছাকাছি চলে এসেছে।মৃন্ময়ীর পেট বরাবর ডান হাত রেখে নিজের কাছে টেনে আনে।

সামিউলের ছোয়ায় মৃন্ময়ী সর্ব শরীর ঘৃনায় ঘিনঘিন করে উঠে।মৃন্ময়ীর হৃদকম্পন যেন উন্মত্ত ঢাকের আঘা। প্রতিটি স্পন্দন শিরা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। দেহ জুড়ে এক অচল অবসন্নতা অস্থি-মজ্জা পর্যন্ত শীতল আতঙ্কের কামড়ে অসাড় হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে কোনো প্রজ্ঞা নেই কেবল বিভীষিকার ঘূর্ণি যেন শূন্যতার গহ্বরে টেনে নেওয়া হচ্ছে তাকে। ভেতরে এক অদৃশ্য আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় মৃত্যুই বোধহয় মুক্তি।”

সামিউল হেচকা টানে মৃন্ময়ীকে ফেলে দেয় ধুলোবালি জড়ানো মেঝেতে।মেঝে পাকা থাকলে ও জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট বালি উঠে মাটির বের হয়ে আছে।মৃন্ময়ী কোমড়ে তীব্র ব্যাথা পায়।মৃদু আর্তনাদে কোমরে হাত রাখে।গায়ের ঢিলে ঢালা রঙচটা টিশার্ট খানা খুলে ফেলে সামিউল। প্যান্টের বেল্ট খুলে ছুড়ে মারে দূরে।মৃন্ময়ীর মস্তিষ্ক ফাকা হয়ে আসছে ক্রমশ।কি করবে,কিভাবে নিজের সম্মান রক্ষা করবে। অবলা নারী কি প্রতি নিয়ত এভাবেই হেরে যাবে এই পুরুষ নামক নরপশুরদের কাছে?
জীবনযুদ্ধে হার না মানা মৃন্ময়ী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেয়ে দেখে এদিক ওদিকটা।টেবিলের উপড় রাখা চকচকে ধারালো চাপাতি। সামিউল এসে বসে মৃন্ময়ী সামনে।মৃন্ময়ীর কোমড়ে দুই হাত রেখে নিজের সংস্পর্শে টেনে আনে।শাড়ির আঁচলে হাত রাখতেই মৃন্ময়ী অগ্নিচোখে তাকায় সামিউলের পানে।
সামিউল চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে মৃন্ময়ীর।দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“কারে চোখ পাকাস শালী?চোখ নিচে নামা কইলাম।আইজ তোর ত্যাজ কত সব দেইখা ছাড়ুম।”

মৃন্ময়ী হাত রাখে খোপায়।খোপায় গোজা কাঠের কাটা খানা আলগোছে হাতে খুলে আনে।কাটা শক্ত করে হাতে চেপে ধরে চট করে আঘাত করে সামিউলের চোখ বরাবর।ডান চোখে কাটার অর্ধেকটা ঢুকে যায়।রক্তের তীর ছুটছে এসে পড়ে মৃন্ময়ীর মুখে।সামিউল চোখ চেপে ধরে তীব্র আর্তনাদ করে উঠে।মৃন্ময়ীকে ছেড়ে দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে মেঝেতে।মৃন্ময়ী সামিউলের বাহুডোর থেকে আলগা হতেই এক ছুটে উঠে গিয়ে চাপাতিখানা হাতে তুলে নেয়।সামিউলের দলের সবাই এগিয়ে যায় মৃন্ময়ীর দিকে।মৃন্ময়ী এলোপাতাড়ি আঘাত শুরু করে সবার গায়ে।আহত সবাই ঢলে পড়ে মেঝেতে।মৃন্ময়ী ক্ষান্ত হয়না তবুও।শাড়ির আঁচল কোমড়ে পেচিয়ে এগিয়ে যায় আহতদের দিকে।বুকের উপর পা তুলে তুই হাত দ্বারা চা-পাতি শক্ত করে চেপে ধরে।এক কোপে আহত সবার মস্তক আলাদা করে ফেলে।সামিউল হাউমাউ করে কাঁদছে।তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা যেনো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।একটাু মেয়ে হয়ে এতো গুলো ছেলেকে শেষ করে ফেললো?
সামিউল হাত জোর করে প্রান ভিক্ষা চাইলো মৃন্ময়ীর থেকে।রক্তের ছোপছোপ দাগ মৃন্ময়ীর সর্ব শরীরে। নাকের ডগা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তরল রক্ত।মৃন্ময়ীর চেহারার আদলে আজ নেই কোনো কোমলতা।চোখ দিয়ে ঝরছে যেনো অনল।সামিউল নিজেকে রক্ষা করতে আহত অবস্থায় উঠে দাঁড়ালো। দৌঁড়ালো উল্টোদিকে। দরজা পেরিয়ে গলির দিকে ছুটছে সামিউল। মৃন্ময়ী থামেনা চাপাতি হাতে নিয়েই পিছু নেয় সামিউলের।সামিউল বেশ ক্লান্ত। আঁধা ভাঙা ইদের টুকরোয় হোচট খেয়ে ছিটকে পড়ে দোকানের সামনে।

টং দোকানের পরিস্থিতি মূহুর্তেই পাল্টে যায়।হাসি তামাশায় মত্ত হওয়া প্রতিটা মানুষের মুখে আতংকের ছাপ।নওশাদ চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে ও থেমে যায়।কেপে উঠে বুকের ভিতর।আহত বাঘীনির ন্যায় মৃন্ময়ী এসে দাড়ায় সামিউলের পাশটায়।মৃন্ময়ীর এমন চেহারা দেখে নওশাদ বাকরুদ্ধ। তুতলিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা।গলাগহ্বর আটকে যায়।বাকযন্ত্র যেনো অকৃয এই মূহুর্তে। লোক সমাগমের মধ্যেই মৃন্ময়ী শাড়ির আচল আরো শক্ত করে কোমড়ে পেচিয়ে নেয়।ডান পা তুলে আঘাত করে সামিউলের বুক বরাবর।বুকের পাজরের হাড় মটমট করে উঠে।খন্ডবিখন্ড হয়ে যেনো মাংসপেশিতে ঢুকে যায়।সামিউল মুখগহ্বর ভেদ করে তরল রক্তের তীর ছোটে গগন পানে।মৃন্ময়ী সামিউলের শরীরের উপর ভর দিয়ে বসে।সামিউলের উজ্জ্বল চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেছে।মুখখানা চুপসে আমচুর। বোবা অটিস্টিকের মতো গোঙরায়।হাতে শক্ত করে ধরে রাখা চাপাতি খানা মৃন্ময়ী এবার কিছুটা উচু করে ধরে।
সামিউলের হাত জোরকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে চাপাতির কোপ ঝাড়ে সামিউলের গলায়।মূহুর্তেই মস্তকখানা আলাদা হয়ে যায়।

লোকসমাগমে এমন নিস্বংস হত্যাকান্ড দেখে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের বুক কেঁপে উঠে।নওশাদ ভয়ে ঢোক গিলছে।হাত পা কেমন অবস হয়ে আসছে।এ কোন মৃন্ময়ীকে দেখছে সে?হাজারটা আঘাত করার পরও যে মৃন্ময়ী চোখ তুলে তাকাতো না তার দিকে।গলা উচিয়ে কথা বলতো না এ কি সেই মৃন্ময়ী! নওশাদ সবার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসে মৃন্ময়ীর দিকে।মৃন্ময়ী মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে।অগাছালো শাড়িতে দলা পাকিয়ে আছে তাজা রক্তের দাগ।নওশাদ মৃন্ময়ীর হাত চেপে ধরে বলে,
“এই ছেড়ি এইডা কি করলি?একলা মাইয়া মানুষ হইয়া এতো গুলো পুরুষরে কেমনে হত্যা করলি?”

মৃন্ময়ী জবাব দিলো না কোনো।হাঁপানী রোগীর মতো জোরে জোরে শ্বাস টানছে। নওশাদ এবার রাগ দেখিয়ে ধাক্কা দিলো মৃন্ময়ীকে।রাগী গলায় হুংকার ছেড়ে বলল,
“কথা ক কইলাম শালী।ওদের টপকালি কেনো?”

মৃন্ময়ী নওশাদের ধাক্কায় এক চুল ও নড়েনি।একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় কাত করলো নওশাদের দিকে।মৃন্ময়ীর চাহনী, ভয়ংকর মুখশ্রীতে আত্মা কেঁপে উঠে নওশাদের।পরপর ঢোক গিলে নেয়।মৃন্ময়ী খাবলে ধরে এবার নওশাদের শার্টের কলার। হাটু তুলে আঘাত করে নওশাদের পেটে।সবে দোকান থেকে পেট ভরে ভাজা পোড়া খেয়েছিলো নওশাদ। পেটে এমন আঘাতে সকল খাবার উগড়ে দেয়।নওশাদ ছিটকে পড়ে দোকানের খুঁটির উপর। আধভাঙ্গা বাঁশে খুটি ঢুকে যায় নওশাদের রানে।ব্যাথায় গগনবিদারী আর্তনাদ নওশাদের।মৃন্ময়ী থামেনা পিঠে লাথি দেয় পরপর কয়েকটা।নওশাদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।ধুলো জড়ানো দুহাত তুলে বলে,
” আমি তোর স্বামী মৃন্ময়ী। আমার প্রান ভিক্ষা দে।আল্লাহ কসম আমি ভালো হইয়া যামু । এসব জুয়া, নেশা সব ছাইড়া দিমু।তোরে সুখে রাখবো । তুই যা কবি আমি তাই শুনুম।তোরে লইয়া প্রয়োজনে এই শহর ছাইড়া চলে যামু।”

মৃন্ময়ী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।গগনকাপানো হাসিতে দেহের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় আঘাত হানে।উপস্থিত সবাই কানে হাত দেয়।দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে দেখছে সবাই তামাশা।মৃন্ময়ী হাসি থামিয়ে রুদ্রমূর্তি ধারন করে এবার।হুংকার ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“তোকে ছেড়ে দিলে হেরে যাবো আমি।হেরে যাবে মৃন্ময়ীর মতো শতশত নারী।মৃন্ময়ীরা বারবার হেরে যেতে পারেনা।তোকে খুন করে আমি দেখিয়ে দিবো নারীরা পারে নিজেদের সম্মান নিজেরাই রক্ষা করতে। তোদের মতো নরপশুকে বিন্যাস করতে তারা অস্ত্র চালাতে ও পারে।তোর মতো জানোয়ারের এই মনুষ্য জাতীতে কোনো ঠাই নেই।সমাজের কলঙ্ক তোরা।”

নওশাদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।সাদা লুঙ্গি খানা লালচে হয়ে উঠেছে। কাটায় জায়গা থেকে অনবরত রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।মৃন্ময়ী এদিক চেয়ে দেখে।দোকানের টিনসিটের চালে জড়িয়ে রাখা মোটা রশি।মৃন্ময়ী হাত দিয়ে পেরে নেয় রশীখানা।নওশাদে দুইহাত রশীর সাথে বেঁধে দোকানের কেরোসিনের বোতল তুলে বোতলের মুখ খুলে সবটুকু কেরোসিন ঢেলে দেয় নওশাদের শরীর।মৃন্ময়ীর হাতে দিয়াশলাই। নওশাদ হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। প্রান ভিক্ষা চায় করুন আর্তনাদ করে।নওশাদের এমন করুন আর্তনাদেও মন গলে না মৃন্ময়ীর। দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ছুড়ে মারে নওশাদের শরীরের উপর। মূহুর্তেই দগদগ করে জ্বলে উঠে নওশাদের শরীর।নওশাদের গগন বিদারী আর্তনাদ। মৃন্ময়ী চট করে ঘুরে তাকায় পিছনের দিকে।নওশাদের জ্বলন্ত শরীর সে চোখে দেখতে চায়না।বুকের ভিতরের তীব্র ব্যাথা।মৃন্ময়ী আকাশপানে মাথা তুলে তাকায়।চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েকফোটা নোনা জল।।


উত্তপ্ত সূর্য মাথার উপর পিচঢালা রাস্তায় খালি পায়ে মৃন্ময়ী হেটে আসে থানা চত্বরে। থানায় প্রবেশদ্বারে চেকপোস্ট পুলিশকে অবজ্ঞা করে হনহনিয়ে ভিতরে ঢুকে আসে।

দুপুরের দহনায় থানা চত্বরে সূর্যের তীব্র কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে। কংক্রিটের মেঝে আগুনের মৃদু ছোঁয়ায় স্ফটিকিত হয়ে উঠেছে। অফিস কক্ষে ফাইলপত্রের স্তব্ধ খসখস এবং চেয়ার টেবিলের নীরব হুলস্থুল এক অদৃশ্য ভীতি ও সচেতনতার বাতাবরণ সৃষ্টি করছে। স্টাফরা নিজ নিজ কর্তব্যে নিযুক্ত। পদক্ষেপের হালকা শব্দ যেন দেওয়ালের সোনালি প্রতিধ্বনিতে মিলেমিশে কক্ষটিকে নিঃশব্দ অথচ তীব্র জীবনানুভূতিতে পূর্ণ করে। বারান্দার ফাঁক দিয়ে প্রবাহিত হালকা বাতাস কক্ষে প্রবেশ করে। মৃন্ময়ী রক্তাক্ত শরীরে থানার ভিতরে পা রাখে।কাজে ব্যস্ত প্রতিটা পুলিশের নজর পড়ে মৃন্ময়ীর দিকে।থ হয়ে যায় তারা মূহুর্তেই।
দামী লেদার চেয়ারে বসে জরুরি ফাইলপত্র চেক করছে বিয়াল্লিশ বছর বয়সী এসিপি সাফওয়ান তালুকদার রহিদ ।মৃন্ময়ী দূর্বল শরীর নিয়ে এগিয়ে আসে রহীদের পাশে।দুহাত তুলে মৃদু স্বরে বলে,
“আমাকে গ্রেফতার করুন এসিপি সাহেব।”

নারী কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতে চোখ তুলে তাকায় রহীদ।মৃন্ময়ীর আপাদমস্তক পরখ করেই চমকায়।ব্যস্ত গলায় বলে,
“আপনি!আপনি কে?”
“আসামাীর কোনো আলাদা পরিচয় হয়না।আমি খুনী।নিজের স্বামী এবং আরো চারজনকে নিজ হাতে খুন করেছি। আমায় গ্রেফতার করুন।”

চাকরীর আঠারো বছর বয়সে রহীদ আজ প্রথম এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো।আসামী নিজ থেকে আত্মসমর্পন করছে।
মৃন্ময়ী রক্তাক্ত শরীর দেখে কিছুটা বিশ্বাস করলো রহীদ।বাকি সত্যতা জানার জন্য পুলিশ পাঠায় বস্তিতে।রহিদের সামনের চেয়ারে বসা মৃন্ময়ী পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে।মৃন্ময়ীর মুখে সবটা শোনার পর রহীদ বাকরুদ্ধ। একটা মেয়ে ঠিক কতটা অসহায় হলে নিজের স্বামীকে খুন করতে পারে তার কিঞ্চিৎ ধারনা আছে রহিদের।চোখের চশমাখানা খুলে ডেস্কের উপর রেখে রহীদ রাশভারি গলায় বলে,
“আইন হাতে তুলে নেওয়ার জন্য আপনার ফাসি হতে পারে মৃন্ময়ী। ”
মৃন্ময়ী জবাবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।দূর্বল কন্ঠে থেমে থেমে বলে,
“আমারে কোর্টে তুলবে কবে এসিপি সাহেব?”
“আগামী কাল।”

মৃন্ময়ী এবার শব্দ করে হেসে ফেলে।রহীদ বেশ অবাক হচ্ছে মৃন্ময়ীর এমন ব্যবহারে।পাঁচটা খুনের আসামী অথচ চোখে নেই কোনো ভয়ের ছাপ।

সকাল হতে মৃন্ময়ীকে তোলা হয় আদালতে।
আদালতে থমথমে পরিবেশ।মৃন্ময়ীর পক্ষে কোনো ডিফেন্স উকিল কেস লড়ছে না।প্রসিকিউটর উকিল সকল প্রমান পেশ করলো বিচারকের হাতে।চশমার ফ্রেমটা ঠিক করে নিয়ে সকল প্রমানে চোখ বুলিয়ে নিলো বিচারক।দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালো কাঠগড়ার দিকে।তপ্ত নিশ্বাসে বললো,” আপনার পক্ষে যেহেতু কোনো উকিল নেই।আপনি চাইলে নিজের হয়ে কিছু বলতে পারেন।”

মৃন্ময়ী বিরবির করছে কিছু একটা।প্রসিকিউটর বিরক্ত হয়ে বললো,” মিস মৃন্ময়ী খু/ন করেছেন আপনি।একজন খু/নি হয়ে এতোটা ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করবেন না। যা বলার ফাস্ট বলুন।”

খু/নি শব্দটা মৃন্ময়ীর অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিলো।বুকে উঠলো তীব্র ঝড়।মূহুর্তেই চোখমুখের বদন বদলালো।চিৎকার দিয়ে বললো,”হ্যাঁ! হ্যাঁ! খুন করেছি আমি সবাইকে।

কাঠগড়ার পাশে দাঁড়ানো এসিপি রহিদের করুন চাহনী।সে মৃন্ময়ীর মুখে সবটা শুনেছে।তবে খুনের কারনটা মৃন্ময়ী কোর্টে জানায়নি।আদালত হয়তো কঠিন সিদ্ধান্ত নিবে মৃন্ময়ীর বিরুদ্ধে। তারও হাত পা বাঁধা মৃন্ময়ী তাকে হাজার বার অনুরোধ করেছে আদালতে সবটা না জানাতে।
তার ভাবনার মাঝেই কাঠের হাতুড়িতে আঘাত পড়ে।জজ রাশভারি গলায় বলে উঠে,

“আদালত সকল সাক্ষ্য এবং প্রমাণের উপর ভিত্তি করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো মিস মৃন্ময়ী নিজ স্বামীসহ আরও চারজনকে হত্যা করেছেন।
অতএব আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করিলো।”


#সমাপ্ত