#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী
আজকে একসাথে এক টেবিলে শহিদ আহমেদ তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী এবং মায়ের সাথে খেতে বসেছে। খাবার পরিবেশন করছে কান্তা। তার ছোট ছেলে শুভ থাকলে খাবার টেবিল পরিপূর্ণ হত।
” কান্তা মা, তুমিও আমাদের সাথে খেতে বস। যে যার মত তুলে নিয়ে খাবে। একটা দিনেরই তো ব্যাপার। ” শহিদ আহমেদ কান্তাকে বললেন।
” আপনারাই খেয়ে নিন, বাবা। আমি পরে খালার সাথে খাব। খালা একা একা খায়। আমি তার সাথে খেলে , সে খুশি হয়। ”
আরমান খেতে আসায় আকলিমা খানম ও রাজিয়া খানম দুজনেই নারাজ। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে আরমানও বুঝে গেছে। কিন্তু ও কান্তার কথা ভেবে চুপ থাকে।
কান্তা সবার প্লেটে ভাত দিয়ে, একে একে তরকারি দিচ্ছে। সবাই তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। সবশেষে কান্তা সবার পাতে মাছের তরকারি তুলে দেয়। সবাইকে বড় মাছের টুকরা দিয়ে, আরমানের ও শজিদ আহমেদের পাতে মাছের মাথা তুলে দেয়।
কান্তার এহেন কাণ্ডে আকলিমা খানম দাঁত কিড়মিড়িয়ে ওঠে।
রাজিয়া খানম দাঁতে দাঁত চেপে আরমানের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।
” দাদিমা, আপনাকেও মাছের মাথা দিব? কিন্তু আজ যে তরকারিতে দুইটা মাছের মাথা দিয়েছি। একটা আপনার ছেলের জন্য, আরেকটা আপনার নাতির জন্য। কালকে বরং আপনাকে মাছের মাথা দিব। আপনার নাতি সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে। পরিশ্রম অনুযায়ী তার তো খাবার প্রয়োজন, তাইনা? তাই আমি ভেবে রেখেছি এখন থেকে নিয়মিত তাকে ভালোমন্দ খাবার খেতে দিব। ”
” আরমান মাছের মাথা খায়না। তুমি ওকে মাছের মাথা দিলে কেন? ওর বাসায় খাওয়ার সময় কোথায়, যে ওকে ভালোমন্দ খাওয়াবে? দুইদিন হল এই বাসায় এসেছ, এখনই মাথায় চড়ে বসনা। আকলিমা এখনও এই বাড়ির কর্ত্রী। তুমি ওর ওপর টেক্কা দেয়ার চেষ্টা করনা। ” আর চুপ থাকতে পারেনা রাজিয়া খানম। সে ফুঁ’সে ওঠে কান্তার ওপর।
” আপনারা কখনও তাকে মাছের মাথা খেতে দেননি, তাই তিনিও খাননি। আর দুইদিনের কথাই যদি উঠে, তবে এই দুইদিনে আমার অনেক বৈষম্য চোখে পরেছে। তাই আমি চেষ্টা করছি বৈষম্য দূর করার। একে যদি আপনারা মাথায় চড়া মনে করেন, তবে আমার কোন আপত্তি নেই। আম্মাকে আমিও এই বাড়ির কর্ত্রী মনে করি। তাকে জিজ্ঞেস করেই আজকের সব রান্না করেছি। এবং ভবিষ্যতেও করব। এতে কোন হেলদোল করবনা। তবে এর মধ্যেও আমি উনার খেয়াল ঠিকই রাখব। ” কান্তাও ত্যা’ড়াভাবে উত্তর দেয়।
” মাথা তুলে নাও। আমি খাবনা। আজ থেকে রান্না করতে হলে উনাকে জিজ্ঞেস করে নিবে। আমার খাওয়া নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবেনা। এত বড় মাছের মাথা আমার পেটে সইবেনা। আর আমাকে ভবিষ্যতে কখনও এভাবে খেতে ডাকবেনা। ” আরমান মাছের মাথা প্লেট থেকে তুলে এক্সট্রা বাটিতে রাখছে, আর কথাগুলো বলছে।
কান্তা আরমানের হাত আটকে দেয়। তার কাছ থেকে মাথাটা নিয়ে পুনরায় আরমানের প্লেটে রাখে।
” আমি আপনার পাতে যা যা দিয়েছি, তার সবগুলোই আপনাকে খেতে হবে। আমি শুনেছি আপনি প্রতি মাসেই সংসার খরচের টাকা দেন। তাহলে আপনাকে তো আর অন্যের টাকার খাবার খেতে হচ্ছেনা। নিজের টাকার খাবার নিজে খাচ্ছেন। তাই বেশি কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে উঠুন। এই বাড়িতে যার যার জায়গায় সে থাকবে। কারও কর্ত্রীর পোস্ট আমি দখল করতে চাইনা। আমি শুধু চাই বৈষম্য দূর করতে। ” কান্তার গলায় এমন কিছু একটা ছিল, যা শুনে ডাইনিং রুমে উপস্থিত সকলে চুপ হয়ে যায়।
” মা, তুমি এভাবে বলছ কেন? বউমা যা করেছে, একদম ঠিক করেছে। বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হলে ছেলেটা খেতেই পারেনা। আজ যখন ও সবার সাথে খেতে বসেছে, তখন তোমার এসব কথা না বললেই নয়! ” শহিদ আহমেদও ছেলের পক্ষে কথা বললেন।
ছেলের কথার ভেতর রা’গ বুঝতে পেরে রাজিয়া খানম চুপ হয়ে যায়৷
আরমান সবার আগে খেয়ে উঠে যায়। কোন ফর্মালিটির ধার ধারেনা।
সবার খাওয়া শেষে কান্তা আর খালা দু’জনে মিলে খেয়ে নেয়।
এরপর সব পরিষ্কার করে নিজের রুমে আসে।
আরমান বিছানায় বসে কোচিং-য়ের পরীক্ষার পেপারস দেখছে।
কান্তা রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ায়।
” এই যে, মাদার তেরেসা? আজ যা করেছ মেনে নিয়েছি। ভবিষ্যতে এমন কিছু করলে মাথায় যে কয়টা চুল আছে, তার একটাও অবশিষ্ট থাকবেনা। করতে হবেনা আমার এত যত্ন। এত খেয়ালেরও প্রয়োজন নেই। আমি এত খাতিরযত্নে অভ্যস্ত নই। ”
কান্তা কেবলই চুলে চিরুনি চালিয়েছে। আরমানের কথা শুনে ঠক করে ড্রেসিংটেবিলের ওপর চিরুনি রেখে তার দিকে রা’গী চোখে তাকায়।
” আমি এ বাড়িতে আসার আগ পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটা হয়েই গেছে। কিন্তু আমি আসার পর আপনার সাথে কে, কি করছে, এ নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আর আপনি এখন থেকে নিয়মিত বাসায় খাবেন। সেটা হোক একবেলা অথবা দুইবেলা। এ নিয়ে কোন বাহানা আমি মানবনা। কে, কি বলল অথবা করল সেটা আমিই বুঝে নিব। আমাকে উপদেশ দিতে থাকলে মনে হয়, তিনি একজন জ্ঞানের ভান্ডার। কিন্তু নিজের বেলায় রা’গ ছাড়া কিছুই নেই। ”
” তুমি কি আমাকে থ্রে’ড দিচ্ছ! দুইদিনের পুঁচকে মেয়ে, আমাকে চাপার জোর দেখাচ্ছে! এই মেয়ে, শোন আমার সাথে দাদাগিরি করতে আসবেনা। ফল ভালো হবেনা বলে দিলাম। তুমি জাননা রা’গ’লে আমি তোমার কি করতে পারি। ”
” আমিও জানতে চাই, দেখতে চাই, রা’গ’লে আপনি কি করতে পারেন। আমার সাথে বেশি হম্বিতম্বি করে লাভ নেই। রা’গ’লে আপনি আমাকে কি করবেন? বড়জোড় গালে দুই-চারটা ঠা’টি’য়ে দিবেন। এসবে আমি অভ্যস্ত।অ’ত্যা’চা’রে’র সকল স্টেজ আমি পাড় করেছি অনেক আগেই। তাই আপনার হু’ম’কি’তে একটুও বিচলিত হলামনা। যতই আমাকে হু’ম’কি দেন, মা’রে’ন আমার কোন আপত্তি নেই। তবুও এ বাড়িতে আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়ব। আমাকে যতটা পুঁচকে মনে করছেন, আদতেই ততটা পুঁচকেও নই আমি। ” কথাগুলো বলতে যেয়ে কান্তার গলা কেঁপে ওঠে। যা আরমানের কানে ঠিকই পৌঁছে গেছে।
ও অবাক হয়ে কান্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার সাথে কতইনা অবিচার, অ’ত্যা’চা’র হয়েছে!
” কোন অ’ত্যা’চা’রে’র কথা বলছ তুমি? তোমার মত র’ণ’চ’ণ্ডী’কে অ’ত্যা’চা’র করার সাহস দেখিয়েছে! সে কি লর্ড ক্লাইভের বংশধর? লর্ড ক্লাইভের বংশধর ছাড়া তোমাকে টাইট দেয়ার সাহস কারও আছে বলে আমার মনে হয়না। ” আরমান সামনে থাকা এক্সাম পেপারের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে।
” আমার তো আপনাকেই লর্ড ক্লাইভ মনে হয়। লর্ড ক্লাইভের সাথে শুধু একটাই পার্থক্য আছে। তাছাড়া বাকিসব কিছুই মিল আছে। ”
” কি বললে! আমাকে তোমার লর্ড ক্লাইভ মনে হয়! কোন দিক দিয়ে আমাকে লর্ড ক্লাইভ মনে হয়? আর পার্থক্যটাই বা কি? ” তীক্ষ্ণ চোখে আরমান তাকিয়ে আছে।
” পার্থক্য একটা তলোয়ারের। তার কাছে তলোয়ার থাকত কিন্তু আপনার কাছে শুধু দুইটা হাত আছে। আর বাকিসব কিছু এক্কেরে খাপে খাপ, ইউনুসের বাপ। তার মত জা’লি’ম, ত্যা’ড়া, ঠ্যা’টা, নি’ষ্ঠু’র যার সবকিছুই আপনার মধ্যে বিদ্যমান। লর্ড ক্লাইভ যেমন জোর করে মানুষকে দিয়ে নীল চাষ করাতো, আপনি তেমন আমাকে জোর করে অধিকার আদায়ের চেষ্টা দমিয়ে রাখতে চান। আরও কিছু শুনতে চান? ”
” আরও কিছু আছে! আমি যে জা’লি’ম, নি’ষ্ঠু’র তা আজ প্রথম জানলাম৷ তুমি… ” কান্তার ফোন বেজে ওঠায় আরমান থেমে যায়।
কান্তা ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করেছে।
কান্তার কথার ধরনে আরমান বুঝতে পারে ওর গ্রামের কেউ ফোন দিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে কান্তা ফোন রাখে।
এরপর বই নিয়ে এসে বিছানায় বসে।
” তোমাকে না বলেছি চেয়ারে বসে পড়তে। যাও, বারান্দায়, যাও। চেয়ারে গিয়ে বস৷ ”
” ঠিক আছে। ” বলেই কান্তা স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বারান্দায় যায়৷
ও বারান্দায় যাওয়ার পর আরমানের মনে হল, কান্তা রা’গ করে বারান্দায় যায়নি তো?
কথাটা মনে আসা মাত্রই আরমান এক্সাম পেপারগুলো নিয়ে বারান্দায় আসে। বারান্দার মেঝেতেই ধপ করে বসে।
আরমানের আওয়াজ পেয়ে কান্তা ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়।
” আপনি এখানে আসলেন কেন? এই চেয়ারে বসুন। আমি আরেকটা চেয়ার আনছি। ” কান্তা চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলেই আরমান কথা বলে৷
” অনেকগুলো পেপার দেখতে হবে। এখানে হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারব। তুমি ঐখানেই থাক। আমি এখানেই ঠিক আছি। ”
কান্তার কথায় আরমান বুঝল মেয়েটা রা’গ করেনি৷ সে নিজেও এতে স্বস্তি পায়।
ফজরের নামাজের সুমধুর ধ্বনিতে কান্তার ঘুম ভাঙ্গে।
ঝটপট বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। অযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাবার আশায়।
নামাজ শেষে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে।
এরপর বারান্দায় এসে বই নিয়ে বসে।
আরমান গোসল সেরে রুমে এসে দেখল ওর শার্ট-প্যান্টসহ প্রয়োজনীয় সকল কিছু বিছানার ওপর রাখা। নিশ্চয়ই কান্তার কাজ।
আরমান স্মিত হেসে শার্ট হাতে নেয়।
ড্রয়িংরুমে আসতেই কান্তার ডাকে আরমানকে থামতে হয়।
কান্তা টেবিলে খাবার দিয়েছে। শহিদ আহমেদও ছেলের জন্য অপেক্ষায় রত।
বাবা-ছেলে দুজনেই চুপচাপ খাওয়া শেষ করে।
এরপর কান্তা এসে আরমানের হাতে টিফিনবাক্স ধরিয়ে দেয়। আরমান চোখমুখ কুঁচকে সেটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
শহিদ আহমেদ ওদের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকেন। তার ত্যা’ড়া ছেলেটাকে এই মেয়েটা বেশ জব্দ করছে৷
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে রাজিয়া খানম ও আকলিমা খানম সব দেখছে। সেই সাথে কান্তাকে জব্দ করার ফন্দি আঁটছে।
বিঃদ্রঃ গত তিনদিন থেকে আমার আর আমার ছেলের ভিষন জ্বর ও সর্দি-কাশি। সেই সাথে বাসায় মেহমান এসেছে। এমনিতেই রোজায় ব্যস্ত থাকি। তারউপর অসুখ এবং মেহমান আসায় লিখার সময় পাইনি।
সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হয়তোবা নিয়মিত গল্প দিতে পারবনা। তাই আমি আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
চলবে….