কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব-১৮+১৯

0
263

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী

দেখতে দেখতে কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। সেদিনের পর থেকে শহিদ আহমেদ তার ছেলের সামনে যাওয়া বন্ধ করেছেন। ছেলের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি তার নেই।

কান্তা কয়দিন থেকে নিজের মত রান্না করছে। কারো সাথে তেমন একটা কথা বলছেনা। সবাইকে এড়িয়ে চলছে। ও অনেক চেষ্টা করেছে স্বাভাবিক হওয়ার, কিন্তু পারছেনা। এমনকি শহিদ আহমেদের সাথেও খুব একটা কথা বলছেনা।
এদিকে রশিদ বেগ বেশ বুঝতে পারছে এই সংসারে ভাঙ্গনের সুর বেজেছে। বহু বছর যাবৎ এই বাড়িতে থাকায়, সে এই সংসারেরই একজন হয়ে গেছে । আরমান, কান্তা কিংবা শহিদ আহমেদের নিরবতা তাকে ভিষণভাবে পো’ড়া’চ্ছে।
আরমানকে সেই ছোটবেলা থেকেই রশিদ বেগ দেখে আসছে। শান্ত, নম্র এই ছেলেটার ওপর আলাদা টান আছে তার। আরমানও তাকে বেশ মানে। অথচ সেই আরমান গত কয়েকদিন থেকে তার সাথে কথা বলছেনা, তাকে এড়িয়ে চলছে। এ নিয়ে সে ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পাচ্ছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় এই বিষয়ে আরমানের সাথে কথা বলতে হবে।

আরমান কয়েকদিন থেকে হন্যে হয়ে বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেহেতু তার অনুপস্থিতিতে কান্তা বাসায় একা থাকবে, সেহেতু তার প্রয়োজন নিরাপদ একটা বাসা।
আজও ভার্সিটি শেষে বের হয় বাসা খুঁজতে।
বাসাটা মোটামুটি অভিজাত এলাকায়। সিকিউরিটি সিস্টেমও বেশ ভালো। সবদিক দিয়েই বাসাটা ওর পছন্দ হয়।
বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে এগ্রিমেন্টে সাইন করে। আগামী পরশুই ওরা নতুন বাসায় শিফট করবে।
এরপর চলে যায় কোচিং-এ।

আজ দু’জনে একসাথে বাসায় ফিরে। আরমান আজ আগেই বেরিয়ে এসেছে। আগামী কয়েকদিন ওকে ব্যস্ত থাকতে হবে।

পরদিন সকালে ভার্সিটিতে যেয়ে তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাসায় আসে। কান্তাকে সাথে নিয়ে গোছগাছ শুরু করে। শ্রীজা ছাড়া কেউই জানেনা ওদের বাড়ি ছাড়ার কথা। বিকেলের মধ্যেই গোছগাছ শেষ করে আরমান বাইরে যায়। মালামাল বহন করার জন্য ট্রাক ভাড়া করতে হবে।

রাতে আরমান বাসায় আসলে রশিদ বেগ তাকে কথা বলার জন্য ডাক দেয়। তার কাছে গেলে, সে আরমানকে নিয়ে বাগানে যায়।

” বাবা আরমান, তুমি আমার কাছে আগে যেমন ছোট্টটি ছিলে, এখনও ঠিক তেমনটিই আছ। আমার কোন পরিবার না থাকায় তোমাদের এখানেই বছরের পর বছর ধরে থেকে গেলাম। সেই সুবাদে এই বাড়ির সবার সম্পর্কেই আমার একটুআধটু ধারনা আছে। তুমি এখানে কতটা সাফার করেছ বা এখন অব্দি করছ তা আমি ভালো করেই জানি। এ নিয়ে তোমার বাবার সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। কিন্তু সে চিরটাকাল অন্ধই থেকে গেল। তাকে বোঝাতে আর পারলামনা। কিন্তু তাই বলে তোমার ভেঙে পরলে চলবেনা। এ বাড়িতে তোমাকে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি এটাও জানি প্রতি পদক্ষেপেই তোমাকে বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে। তাই বলে তোমাকে পিছিয়ে গেলে চলবেনা। আমার ফুপু আর বোন মিলে তোমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করবে, এটাও আমি জানি। তারা আজও নিজেদের শোধরাতে পারলনা। তবে মনে রেখ, যেকোন পরিস্থিতিতেই আমি তোমার পাশে থাকব। তুমি তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন করে লড়াই শুরু কর। ”

” যেখানে অধিকার জোড় করে ছিনিয়ে নেয়া হয়, সেখানে মাথা খুঁটে ম’র’লেও অধিকার পাওয়া যায়না। আর তাছাড়া অধিকারের লড়াইয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। আপনি আমার জন্য এতটা ভেবেছেন এজন্য ধন্যবাদ। চাচা, এসব নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগছেনা। আমি ভিষণ ক্লান্ত। ” আরমান আর সেখানে দাঁড়ায়না। সোজা রুমে চলে আসে।

বাসায় আসার পথে আরমান তিনজনের জন্য খাবার এনেছে। আজ এই বাসায় ওদের শেষ রাত। হয়তো আর কখনোই এখানে ওর আসা হবেনা। তাই ও শ্রীজাকে সাথে নিয়ে এই বাসায় শেষ খাবার খাবে।
রুমে এসে শ্রীজাকে ফোন করে তার রুমে ডাকে আরমান।
ভাইয়ের ফোন পেয়েই সাথে সাথে তার রুমে আসে শ্রীজা।
রুমটায় এসেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। তাদের প্যাকিং শেষ!

আরমান, কান্তা দু’জন কেউই আজ রাতে ডাইনিং রুমে খেতে আসেনি, এই বিষয়টা আকলিমা খানম এবং রাজিয়া খানম ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে, কিন্তু এতে তাদের কিছুই যায় আসেনা। তারা খাবার সময় শ্রীজাকে ডাক দিলে শ্রীজা জানায় ওর ক্ষুধা নেই।
এরপর বাসার সবাই মিলে খেয়ে নেয়।

আরমান ফ্রেশ হয়ে আসলে ওরা তিনজন মিলে খাবার খায়। এরপর অনেকক্ষণ যাবৎ আড্ডা দেয়। রাত বাড়লে শ্রীজা নিজ রুমে ফিরে যায়।

প্রতিদিনের ন্যায় ঘুম থেকে ওঠার খানিক পরেই কান্তা রান্নাঘরে যায়না। আরমান ওকে গতরাতেই নিষেধ করেছিল রান্নাঘরে যেতে।
টুকিটাকি যেসব গোছগাছ বাকি ছিল সেগুলো সেড়ে নেয় দুজন মিলে।

শহিদ আহমেদ বেশ কিছুক্ষণ যাবং ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। নাস্তা করে তিনি বেরিয়ে যাবেন।

কান্তা আজ রান্নাঘরে না আসায় খালা নিজ থেকেই নাস্তা তৈরি করে। এরপর শহিদ আহমেদ সামনে সেগুলো পরিবেশন করে।

” খাদিজা, বউমাকে দেখছিনা যে? সে কি আজ রান্নাঘরে আসেনি? ”

” নতুন বউয়ে আইজ ঘর থাইকা বাইর হয়নাই, ভাই। হের মনে কয় আইজ ঘুম ভাঙ্গেনাই। আপনে এহন এইগুলাই খান। রাইতে নতুন বউয়ের হাতের রান্দন খাইয়েন। ”

খাদিজার কথা শুনে শহিদ আহমেদ চুপচাপ খেয়ে নেন। খাওয়া শেষ করেই তিনি অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে কয়েকবার তিনি আরমানের রুমের দরজার দিকে তাকিয়েছেন। আজকে তার মন কেমন কেমন করছে। ছেলেটাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। গত কয়েকদিন তিনি আরমানের মুখোমুখি হননি। ছেলেটাকে একটিবারের জন্যও তিনি দেখতে পাননি। আজকে তার মন বড্ড উচাটন করছে। বারবার তার মনে হচ্ছে, তিনি কিছু একটা হারাতে চলেছেন।
বেশ কয়েকবার আরমানের রুমের দরজার দিকে তাকানোর পরও যখন ছেলের দেখা পেলেননা, তখন তিনি বাধ্য হয়েই অফিসে রওনা দিলেন৷

সকাল দশটায় ট্রাক চলে আসে। আরমান আগেই কয়েকজন লোককে বলে রেখেছিল, মালামাল গাড়িতে উঠানোর জন্য। তারাও এসে গেছে।

হঠাৎই বাসায় এত লোকজন দেখে আকলিমা খানম বিরক্ত হয়।
আরমান তখন তিনজন ছেলেকে নিয়ে রুমে যাচ্ছিল।

” তুমি কি আমার বাসাটাকে ধর্মশালা পেয়েছ? যাকে তাকে এসে বাসায় ঢোকাচ্ছ! তুমি কি আমার কাছ থেকে হুকুম নিয়ে বাসায় মানুষ ঢুকিয়েছ? আমার বাসায় কে আসবে না আসবে সেটা বুঝব আমি। তোমাকে এসব বিষয়ে কোন অধিকার দেয়া হয়নি। নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা কর। সীমা ছাড়ালে পরিনতি ভালো হবেনা। ” আকলিমা খানমের চোখেমুখে ক্রো’ধ উপচে পড়ছে।

” আমি সীমার মধ্যেই আছি, থাকি এবং থাকার চেষ্টা করি। আপনার আমাকে নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। এখনই যদি এতসব চিন্তা করে শরীরে রোগ বাঁধান তবে বাকিটা জীবন কি করে চলবেন! সামনের দিনগুলোতে আপনার চিন্তার শেষ থাকবেনা। ” আরমান এতটুকু বলেই ছেলেদের নিয়ে রুমে আসে।

ছেলেগুলো অবাক হয়ে যায় আকলিমা খানমের কথা শুনে।

রাজিয়া খানম সোফায় বসে চা পান করছিল।
সেসময় আরমানের রুম থেকে কয়েকজনকে আলমিরা বের করতে দেখে অবাক হয়। ঘটনা কি ঘটছে তা জানার জন্য উসখুস করতে থাকে।
এরপর লোকগুলোকে একে একে খাট, ড্রেসিং টেবিল, রিডিং টেবিল, বুকশেলফসহ আরমানের রুমের সকল ফার্নিচার বের করতে দেখে সে মোটামুটি শিওর হয়ে যায়, আরমান বাসা ছাড়ছে। সে ইশারায় আকলিমা খানমকে কাছে ডাকে।

একে একে সবকিছু ট্রাকে উঠানো হলে কান্তা ও আরমান রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কান্তা একটৃ আগেই বেরিয়েছে।
আরমান দরজার কাছে এসে শেষ বারের মত ফিরে তাকায় তার এত বছরের একাকিত্বের সাক্ষী রুমটার দিকে। এক পা দু পা করে রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। এরপর ধীর পায়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে রুমের প্রতিটি দেয়াল।
আজ থেকে এ বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক ঘুচবে। মায়ের ছোঁয়া আর পাওয়া হয়ে উঠবেনা। এতদিন এত অনাদরের পরও এই বাড়িটার প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোন, প্রতিটি ইটের মাঝে ও মা মা গন্ধ পেত। আজ থেকে আর সেই গন্ধ ওর নাকে আসবেনা। বাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে ওর মায়ের সকল স্মৃতি, যা এই বাড়ির বাতাসে মিশে আছে তার সবকিছুই ছেড়ে যাচ্ছে।
একফোঁটা পানি টুপ করে ঝরে পরে চোখের কোন বেয়ে।
নিজেকে সামলে নিয়ে সকল স্মৃতি পেছনে ফেলে নিজ গন্তব্যে পা বাড়ায় আরমান।

তখনও ড্রয়িংরুমে আকলিমা খানম বিরক্ত রাজিয়া খানম ঠাঁয় বসা।
শ্রীজা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
খালা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আরমান এসে দাঁড়ায় তার সামনে।

” খালা, আজ থেকে এ বাড়ির সাথে আমার সকল সম্পর্ক ঘুচল। কিন্তু তোমার সাথে আমার সম্পর্ক চিরকালের। তাই আমি যেদিন তোমাকে আমার কাছে ডাকব, সেদিনই সবকিছু ফেলে আমার কাছে তোমাকে যেতে হবে। তুমি তৈরি থেক। আর তোমার ভাইকে বলে দিও, তার সকল মাথা ব্যথার কারন, বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে। কোনদিনও আমি এ বাড়ির ত্রী সীমানা মাড়াবোনা। তিনি যেন তার স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ভালো থাকেন। ভালো থেক আমার আরেক মা। ”
আরমানের কথা শুনে খালা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সে আজ কথা বলার ভাষা হারিয়েছে।

” শ্রীজু, আমরা আসছি। ভালো থাকিস। ” শ্রীজা নিশ্চুপ।

” আপনারাও ভালো থাকবেন। জানি কখনও আমার জন্য দোয়া করবেননা। কিন্তু তাই বলে কখনও অ’ভি’শা’প দিয়েননা। ”
আরমান সোজা বেরিয়ে যায়।

এরপর কান্তা একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়।

চলবে….

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী

” আমার যতটুকু দ্বায়িত্ব আমি পালন করেছি। এবার তোমার পালা। ফটাফট সব গুছিয়ে ফেল। এরপর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লিষ্ট কর। রান্নাঘরের কোন কিছু যেন বাদ না যায়।” আরমান নতুন ফ্ল্যাটে এসে সব ফার্নিচার জায়গামত রাখার পর বলে।
ততক্ষণে সাহায্যকারী লোকেরা বিদায় নিয়েছে।

কান্তা আরমানের কথার উত্তর না দিয়ে গোছগাছ শুরু করে।

” দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাও। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ” আরমান ওয়ালেট প্যান্টের পকেটে রেখে বলল।

” এখন কোথায় যাচ্ছেন! এই নতুন জায়গায় আমার একা থাকতে ভয় করবে। ”

” এখন দুপুর বারোটা দশ। সকাল থেকে কারও খাওয়া হয়নি এটা মাথায় আছে? নাকি না খেয়ে স্বামীর অর্থ সাশ্রয়ের চিন্তা করছ? বালিকা এটাই যদি ভেবে থাক, তবে তোমার ধারনা ভুল। না খেয়ে যতটুকু সাশ্রয় করবে, অসুখে পরে তার থেকে বেশি খরচ হবে, বুঝলে? আর এখন থেকে একা থাকার অভ্যেস করে নাও। তোমাকে পাহারা দেয়ার জন্য সব সময় আমাকে পাবেনা। ”
কান্তার ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়ে আরমান বেরিয়ে যায়।

বিকেলের মধ্যেই গোছগাছ শেষ করে দু’জন মিলে। এরপর সন্ধ্যায় কান্তাকে নিয়ে বাইরে আসে। উদ্দেশ্য ফ্রিজ আর রান্নাঘরের টুকটাক জিনিসপত্র কেনা।
কান্তার পছন্দমত ফ্রিজ, ডিনার সেট, হাঁড়ি পাতিল কিনে আরমান। দুইজনের সংসারের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই কিনেছে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আরমান বাজারে যায়। রাতেই কান্তা লিষ্ট করে রেখেছিল। আরমান আগামী সাতদিনের কাঁচা বাজার করে।

নতুন বাসা সাজাতে সাজাতে সাতদিন কেটে গেছে। দুই রুমের বাসাটা আজ ফার্নিচারে পরিপূর্ণ। ওরা যেদিন এখানে আসে সেদিন এতকিছু ছিলনা। এই সাতদিনে আরমান কান্তাকে সাথে নিয়ে একে একে সব কিনেছে।

” আর দশদিন পর থেকে তোমার পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, সেটা মনে আছে? তোমার পরীক্ষার কেন্দ্র কোথায়? কোথায় থেকে পরীক্ষা দিবে, সেটা ভেবেছ? ”

” পরীক্ষা কেন্দ্র নাটোরেই। কিন্তু কোথায় থাকব সেটা এখনও জানিনা। আচ্ছা এখান থেকে যেয়ে পরীক্ষা দিলে হবেনা? ”

” মাথায় স্ক্রু আছে না রাস্তায় ফেলে এসেছ? তুমি ঢাকা থেকে নাটোর যাবে পরীক্ষা দিতে! গাড়িতে বসেই কি পরীক্ষা দেয়ার প্ল্যান করছ? নাটোর তোমার পরিচিত কেউ আছে, যেখানে থেকে পরীক্ষা দিতে পারবে? যদি না থাকে তবে একমাসের জন্য একটা বাসা ঠিক করতে হবে। ”

” আমার ফুপুর বাসা নাটোর। এছাড়া নানার বাড়িও সেখানে। আবার কয়েকটা কাজিন সেখানেই থাকে। ”

” তুমি এক কাজ কর, তোমার যাকে ভালো মনে হয় তার কাছে ফোন করে একটা বাসা দেখতে বল। আমি তো তাদের চিনিনা। তোমাকে কে সাহায্য করতে পারবে, তা তুমিই ভালো যান। ”

” যাকে বলব সে-ই সাহায্য করবে। অন্য কাউকে বলার আগে আমি বরং ফুপুকে জানাই। দেখি সে কি বলে। ”

” তাহলে তাকেই ফোন কর। এই-যে নাও আমার ফোন। এটা দিয়েই কথা বল। ”

কান্তা আরমানের কাছ থেকে ফোন নিয়ে ওর ফুপুকে ফোন করে। তিনি সবটা শুনে কান্তার উপর রা’গ করেন। তিনি কোনভাবেই চাননা তার ভাইঝি অন্য কোথাও থেকে পরীক্ষা দিক। তিনি আরমানের সাথে কথা বলতে চান।
আরমান ফোন নিলে তিনি আরমানকে জানান, কান্তাকে তিনি তার বাসাতেই রাখবেন। তিনি অনেকক্ষণ কথা বলেন আরমানের সাথে। আরমান যখন জানল, ফুপুর বাসায় তারা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া কেউ থাকেনা, তখন সে কান্তাকে সেখানে থাকতে দিতে রাজি হয়। সে ফুপুকে জানায় , পরীক্ষার দুইদিন আগেই কান্তাকে নাটোর পাঠাবে। কিন্তু ফুপু চান আরমান নিজেই কান্তাকে নিয়ে আসুক। ওদের বিয়েতে দাওয়াত পায়নি, তাই এখন পর্যন্ত আরমানকে তিনি দেখেননি। তাই তিনি আরমানকে দাওয়াত করলেন। ফুপাও আরমানের সাথে কথা বললেন। ওকে দাওয়াত করলেন। তারা তাদের মেয়ে জামাইকে আপ্যায়নের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়না।
তাদের দাওয়াত আরমান অগ্রাহ্য করতে পারেনা।

সকালে আরমান ভার্সিটিতে বেরিয়ে গেলে কান্তা কোমড় বেঁধে রান্নার জোগাড় করে। ও পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আরমানের জন্য রান্না করে রেখে যাবে। সে অনুযায়ী ও রুটি, কয়েকরকম ভাজি, মাংসের তরকারি, মাছের ভুনা, বিরিয়ানি রান্না করে। এগুলো ঠান্ডা করে ফ্রিজে রাখবে। আরমান শুধু প্রয়োজনমত বের করে গরম করবে।

কান্তার এহেন কর্মকান্ডে আরমানের মাথায় হাত।
এই মেয়ে করেছেটা কি!

” তুমি পা’গ’ল হয়ে গেছ! এতসব খাবার আমি খেয়ে শেষ করতে পারব? শুধু শুধু কষ্ট করে এত খাবার রান্না করেছ। ”

” আপনি তো এগুলো একদিনে খাবেননা। হাতে একমাস সময় পাবেন এগুলো শেষ করতে। শুনুন আমি রুটিগুলো হালকা সেঁকে রেখেছি। আপনি খাওয়ার পনের মিনিট আগে বের রাখবেন, এরপর সেগুলো নরমাল হলে ভেজে নিবেন। আর আলু ভাজি ওভেনে গরম করে নিবেন। তরকারিগুলো আলাদা আলাদা বাটিতে রেখেছি। একটা করে বাটি বের করে ওভেনে গরম করবেন। এই যে এখানে বিরিয়ানি রেখেছি। যখন খাবেন, তখন একটু কষ্ট করে গরম করে নিবেন। ”

” তুমি নিজে পা’গ’ল, সেই সাথে আমাকেও পা’গ’ল করেই ছাড়বে। ” আরমান কপট রা’গে’র সাথে বলে।

নির্দিষ্ট দিনে আরমান কান্তাকে নিয়ে বেরিয়ে পরে নাটোরের উদ্দেশ্যে।
দীর্ঘ ছয় ঘন্টা জার্নির পর ওরা নাটোর পৌঁছায়। আরমান ঢাকা থেকেই কয়েকরকম মিষ্টি ও ফলমূল কিনেছে।
বাস থেকে নেমে ওরা অটোরিকশায় উঠে।

কান্তার ফুপু রোকসানা আক্তার কান্তাকে দেখে ভিষণ খুশি হন৷ তিনি কান্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।

নতুন বাসায়, নতুন মানুষদের সামনে আরমান অপ্রস্তুত বোধ করছে। ও চুপটি করে সোফায় বসে রোকসানা আক্তারের কান্না দেখছে। তবে ওকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন কান্তার ফুপা ওবায়দুর রহমান।

” রোকসানা, ওরা অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে। এবার ওদেরকে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ দাও। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। ওরা এতক্ষণ যাবৎ না খেয়ে আছে। ”

” দেখেছ, আমি কান্তাকে পেয়ে সব ভুলে বসে আছি। কান্তা তুই জামাইকে নিয়ে রুমে যা। তোর সেই দখিণ দুয়ারি রুমে তোরা থাকবি। ”

কান্তা আরমানকে নিয়ে রুমে যায়।

খাবার টেবিলে এসে আরমানের চোখ কপালে উঠে। টেবিল ভর্তি নানানরকম খাবার!
ওরা সবাই একসাথে খেতে বসে। রোকসানা আক্তার ওদের সাথে খেতে না চাইলেও আরমানের অনুরোধে খেতে বসেন।

আরমান বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাবার খায়। ফুপুর হাতের রান্নার তুলনা নেই।

পরদিন দুপুরে আরমান ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। ফুপা-ফুপু চাইছিলেন আর একটা দিন আরমান তাদের সাথে থাকুক। কিন্তু ওর ভার্সিটিতে জরুরি কাজ থাকাঢ ওকে পরদিনই বের হতে হয়।

শহিদ আহমেদের শরীর কয়দিন থেকে ভালো যাচ্ছেনা। তিনি আরমানের চিন্তায় সব সময়ই অস্থির থাকেন। আরমান কোথায় থাকে আজ পর্যন্ত তিনি জানতে পারেননি।
একদিন তিনি সাহস করে আরমানের ভার্সিটিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আরমানের কলিগরা কেউই ওর বাসা বদলের খবর জানেনা। আর সেদিন আরমান ভার্সিটির কাজে বাহিরে গিয়েছিল। তাই শহিদ আহমেদের সাথে তার দেখা হয়নি।
এরপর আরেকদিন শহিদ আহমেদ ছেলের সাথে দেখা করতে ভার্সিটিতে গেলে আরমানের সাথে দেখা হয়। আরমান সেদিন স্পষ্ট করে তাকে জানিয়ে দেয়, ভার্সিটিতে আর কখনও না আসতে। এবং সে ওর বাসার ঠিকানাও দেয়না।
শহিদ আহমেদ ব্যর্থ চিত্তে ফিরে আসেন।

শ্রীজা ওর বাবাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে এসেছে। কয়েকদিন থেকেই তার প্রেশার বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে নিদ্রাহীনতা।
ডক্টর তাকে চেক-আপ করে মেডিসিন দেন। এবং টেনশন করতে নিষেধ করেন।

কান্তার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। প্রথম তিনটা পরীক্ষা ওর খুব ভালো হয়েছে। আরমান নিয়মিত ওর খোঁজ রাখছে। যাওয়ার সময় কান্তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে।
আরমানকে ছাড়া একা থাকতে কান্তার মোটেও ভালো লাগছেনা। মানুষটা ঠিকমত খাচ্ছে কি না সেই চিন্তায় ওর নিজেরও ঠিকমত খাওয়া হচ্ছেনা।

চতুর্থ পরীক্ষা দিয়ে কান্তা বাসায় এসেছে। আজও ওর পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে।
বাসায় এসে গোসল সেরে কেবলই খেতে বসেছে।
তখনই বেজে ওঠে কলিং বেল।
ফুপু দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে গেছে।
আরমান এসেছে!

চলবে..