কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব-৪০+৪১

0
273

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৪০
জাওয়াদ জামী

আকলিমা খানম ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশেই নত মুখে বসে আছে শহিদ আহমেদ। চেষ্টা করছে তাকে শান্তনা দেয়ার। কিন্তু তার মুখে একটাও শব্দ আসছেনা। কষ্টতো তারও হয়, কিন্তু সেই পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া তার সামনে কোন পথ খোলা ছিলনা।

” আকলিমা, তুমি এভাবে কাঁদলে, আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মনে হয় আমি একজন নিকৃষ্ট বাবা, যে তার সন্তানকে শিক্ষা দিতে পারেনি, সহবৎ শেখাতে পারেনি, সর্বোপরি মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে পারেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বেঁধে থাকার কোন অধিকার নেই। আমি ব্যর্থ, চরমভাবে ব্যর্থ। ”

” আমি কি করব বলতো? সন্তান হাজার খারাপ হলেও কোন মা তাকে ঘৃণা করতে পারেনা। দূরে ঠেলে দিতে পারেনা। হয়তো রাগের কারনে, সন্তানকে শোধরাবার জন্য সাময়িকভাবে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু ভালোবাসা ঠিকই থাকে। দিনশেষে তো বাবা-মা সন্তানের ভালোই চায়। আমার শুভ কেন এসব বুঝলনা? ওর কি একটাবারও আমাদের কথা মনে হয়না? ” ডুকরে কেঁদে উঠে আকলিমা খানম।

” আমাদের ছেলে অনেক আগেই পর হয়ে গেছে, আকলিমা। যে ছেলের কাছে পরিবারের সম্মান, বাবা-মা’ র ভালোবাসার থেকেও বাইরের মানুষের প্রতি বেশি টান থাকে, সেই ছেলের কাছে ভালো কিছু আশা করা বৃথা। ওর এখন আর আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। ও নিজের মত করে নিজের দুনিয়া সাজিয়েছে। সেই দুনিয়ায় আমাদের কোন জায়গা নেই। ভালো হবে বরং আমরা তাকে ভুলে যাই। জানি, ভুলে যাওয়া সহজ নয়। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করতে দোষ কোথায়। ”

” তুমি ওকে সঠিক পথে ফেরানোর চেষ্টা না করে, ওকে ভুলে যেতে বলছ! আমার নাড়ি ছেঁড়া ধনকে আমি কিভাবে ভুলব? আমি যে ওর মুখে প্রথম মা ডাক শুনেছি। আমার নারীত্ব পূর্ণ হয়েছে ওকে জন্ম দিয়ে। সেই ছেলেকে আমি হাজার চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবনা। ”

” আমি ওকে ফেরানোর চেষ্টা করিনি, সেটা তোমাকে কে বলেছে! আমি কয়েকবার শুভর কাছে গিয়েছি। ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ফিরিয়ে আনতে চেয়েছি ওকে। কিন্তু ও প্রতিবারই আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওর অভিযোগ, আমি নাকি ওকে ঠকিয়েছি। আমার প্রপার্টির ন্যায্য হিস্যা ওকে দিইনি। এখনতো ওর আশেপাশে যাওয়ার সুযোগ পাইনা। ওর অসভ্য বন্ধু-বান্ধব আমাকে ওর কাছে পৌঁছানোর আগেই আটকে দেয়। তারা বলে, আমার নাকি ওর বাবার হওয়ার যোগ্যতা নেই। ” মলিন হেসে বললেন শহিদ আহমেদ।

” তুমি শুভর সাথে দেখা করতে গিয়েছো! কেমন আছে আমার ছেলে? ও যা-ই বলুকনা কেন, তুমি কিছু মনে করোনা। তুমি ওকে বলনি, ওর নামে আরও প্রপার্টি তুমি রেখেছ? তাহলে ছেলেটা হয়তো ফিরে আসত। ”

” ওকে যদি প্রপার্টির কথা বলতাম, তবে ও লোভে আমার সাথে আসত। কিন্তু আমিতো তা চাইনা। আমি চাই আমার সন্তান ভালোবেসে আমাদের কাছে ফিরুক। তুমি চিন্তা করোনা, ও ভালো আছে। হয়তো আমাদের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিচ্ছে কেউ। তাই আমাদের কথা ওর মনে নেই। দেখ, একদিন ও ঠিকই ফিরবে। ও ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। আমি চাই ও কোন কিছুর লোভে নয়, আমাদের ভালোবেসে বাসায় ফিরুক। ”

” তুমি ঠিকই বলেছ। শুভর ভালোর জন্য এখন আমাকে শক্ত হতে হবে। আচ্ছা শোন, আরমানকে যেসব প্রপার্টি তুমি দিয়েছ, ও বলে দিয়েছে সেগুলোর কিছুর নিবেনা। ওকে আমি কয়েকবার বলেছি, তবুও সে রাজি হয়নি। তুমি এক কাজ কর, ঐ প্রপার্টির কিছু অংশ তুমি আমাদের ছোট্ট পুতুল সোনার নামে করে দাও। আর বাকিটা পরে যখন আরেকটা পুতুল আসবে ওদের ঘরে, সেটা তার নামে দিও। আর বউমাকে আমাদের গাজীপুরের স মিল দিও। আর যত তারাতারি পার মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা কর। এবার আরমান আসলে ওর সাথে যেয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে এস। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে ম’র’তে পারলেই জীবনের সব চাওয়া পূর্ণ হবে। ”

” তুমি এভাবে বলছ কেন! আমাদের আরও অনেকদিন বাঁচতে হবে। আমাদের নাতি/নাতনির জন্য, আরমানের জন্য, আমার শুভর জন্য, আমার শ্রীজার জন্য। আমরা ছাড়া ওদের যে আর কেউ নেই। এই যে তুমি সবার কথা বললে। সবাইকে প্রপার্টি বুঝিয়ে দিতে বললে। নিজের জন্য তো কিছুই চাইলেনা? ”

” আমার নিজের জন্য কিছুই প্রয়োজন নেই। আমি জানি সবাই আমাকে দূরে ঠেলে দিলেও, আরমান আমার শরীরে ফুলের টোকাও লাগতে দিবেনা। তাই সম্পত্তির বিনিময়ে নিজের ভবিষ্যৎ কিনতে চাইনা আমি। আরমান কোন সম্পত্তি ছাড়াই আমাকে বুকে তুলে রাখবে। মাঝেমাঝে বড্ড আফসোস হয় জানো? বারবার মনে হয়, কেন আমি আরমানের গর্ভধারিনী হলামনা? ওর মত সন্তান জন্ম দিতে যে সে নারী পারেনা। ”

আজ শহিদ আহমেদ তার স্ত্রীকে যতই দেখছেন, ততই অবাক হচ্ছেন। এই মানুষটা একদিন আরমানকে অপমান করলেই যেন সুখী হত। কিন্তু আজ সেইজনই আরমানের মা হতে না পারার জন্য আফসোস করছে!

জাবেদ যেদিন থেকে গ্রামে এসেছে, সেদিন থেকেই শিখা খোশমেজাজে আছে। কান্তার শ্বশুর বাড়ি থেকে ওর জন্য তিনটা শাড়ি পাঠিয়েছে। প্রতিটি শাড়িই দামী, দেখেই বোঝা যায়। আর গাড়িগুলো দেখতেও চমৎকার। শিখা এত সুন্দর শাড়ি আগে কখনও পরেনি। আবার জাবেদকে তারা যেসব পোশাক দিয়েছে সেগুলোও দামী।ওদের দেয়া পোশাক পরলে আরাফকেও বেশ মানাচ্ছে।
বাড়িতে যখন কেউ থাকছেনা, তখনই শিখা শাড়িগুলো পরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে যেয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওর নিজের কাছে নিজেকে যেন অপ্সরার মত লাগছে। নিজেকে ঘুরেফিরে ভালোভাবে দেখলেই যেন শান্তি লাগছে।
আরাফের কাছ থেকে কান্তার শ্বশুর বাড়ির গল্প শুনে আফসোস হচ্ছে, কেন সে ওদের সাথে ঢাকা যায়নি! মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, এর পরেরবার জাবেদ ঢাকা গেলে সে-ও যাবে। নিজের চোখে দেখবে ওদের শানশওকত।

জাবেদ রাতে বাড়ি ফিরে শিখার কাছে খাবার চাইলে, শিখা জানায় রান্না করতে পারেনি। জাবেদ বিরক্ত হয়ে বকাবকি করতে গেলেই শিখা জানায় ওর পেটে আর কোমড়ে ব্যথা করছে, সেই সাথে আছে কিছু ইন্টারনাল প্রবলেম। তাই সে রান্না করেনি৷ শিখার সমস্যার কথা শুনে জাবেদ ওকে আর কিছু বলেনা। নিজেই ভাত রান্না করে আর ডিম ভাজে। এরপর সে শিখা ও আরাফকে ডেকে একসাথে খেয়ে নেয়।

পরপর তিনদিন শিখা বিছানা থেকে উঠতে পারেনা। দিনদিন ওর অসুস্থতা বেড়েই চলেছে। কাজের মেয়েই বাড়ির সব কাজ করে দেয়। জাবেদ ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে বলে, আর কয়েকটা দিন দেখি।
এভাবেই বিশ দিন পার হয়ে গেছে। শিখার অসুস্থতা কমার বদলে বেড়ে যায়। দিনরাত ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায়। জাবেদ তখন স্কুলে ছিল। প্রতিবেশি একজন স্কুলে যেয়ে ওকে জানায় শিখার কথা।

বাসায় এসে জাবেদ শিখাকে নিয়ে শহরে ছোটে। একজন বিশেষজ্ঞ ডক্টরের শরণাপন্ন হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডক্টর জানায়, শিখার দুইটা কিডনিই ড্যামেজ। সেই সাথে দেখা দিয়েছে ডায়াবেটিস। এবং হার্টেও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। অতিদ্রুতই চিকিৎসা করা না হলে শিখার জীবন সংশয় দেখা দিবে।

জাবেদ কান্তাকে ফোনে সবকিছু জানায়। কান্তা সব শুনে শিখাকে ঢাকা নিতে বলে। এরপর জাবেদ আরমানের সাথে কথা বলে। আরমানও তাকে ঢাকা আসতে বলে। দুইদিন পরই জাবেদ শিখাকে নিয়ে ঢাকা যায়।

কান্তা চিটাগং চলে গিয়েছিল। জাবেদের ঢাকা পৌঁছানোর আগেই আরমান কান্তাকে নিয়ে ঢাকা আসে।

জাবেদ ঢাকা এসে কান্তার শ্বশুর বাড়িতে উঠে। পরদিন ওদের ডক্টরের কাছে যাওয়ার কথা।

পরদিন ডক্টরের কাছে গেলে ডক্টর পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানায় যত দ্রুত সম্ভব শিখার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। এরপর ওরা যায় হার্ট স্পেশালিষ্টের কাছে। হার্ট স্পেশালিষ্ট ওর যাবতীয় পেপারস দেখে জানায় , ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে এনে চিকিৎসা শুরু করতে।

এরপর ডক্টরের অধিনে থেকেই শুরু হয় শিখার চিকিৎসা। নিজের অসুস্থতার কথা শুনে শিখা ভেঙে পরেছে। কবে ওর শরীরে এত রোগ বাসা বেঁধেছে তা একটুও বুঝতে পারেনি। তবে মাঝেমধ্যেই পেট ব্যথা, মাথা ঘোরা, বুকের ধরফরানি, ইউরেনাল ইনফেকশন এসব হত। এসব কিছুকে শিখা মোটেও পাত্তা দেয়নি। মনে করেছে এসব অসুখ এমনিতেই সেরে যাবে। কিন্তু না, তা হয়নি।

কান্তার শ্বশুর বাড়ি থেকে হসপিটালে প্রতিবেলায় খাবার পাঠাচ্ছে। কান্তা প্রতিদিন একবার করে এসে শিখাকে দেখে যাচ্ছে। কখনো শহিদ আহমেদ, কখনো শ্রীজা এসে শিখাকে দেখে যাচ্ছে। আকলিমা খানমও একদিন এসেছিল। আরমান যে দুইদিন ঢাকায় ছিল, জাবেদের সাথে সে-ও শিখাকে নিয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করেছে। আরাফকে বাসায় রেখেছে কান্তা।

সাতদিনে জাবেদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। সে টাকা খরচ করতে কার্পন্য করছেনা।
ডক্টর জানিয়েছে, আগামীকাল দুপুরে অপারেশন হবে। দুইজন ডোনার পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে জাবেদের ত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ হবে।

জাবেদের কাছে বর্তমানে এত টাকা নেই। সে এত টাকা সাথে করে আনেনি। এদিকে এখন সে নাটোরেও যেতে পারবেনা। যদিওবা যায়, তবে কাল দুপুরের মধ্যে ফিরতে পারবেনা। চিন্তায় জাবেদের ঘুম হারাম হয়েছে।

শিখা জাবেদের অসহায় মুখ দেখে কি করবে ভেবে পায়না। ও ফোন করে বড় বোনের কাছে। ওর বোন রিসিভ করলে, শিখা তাকে সবকিছু খুলে বলে। শিখা এ-ও জানায় সাতদিনের মধ্যে জাবেদ তাকে সব টাকা ফিরিয়ে দিবে। সব শুনে শিখার বোন জানায়, ওদের কাছে এত টাকা নেই। অথচ শিখা জানে, ওর দুলাভাইয়ের টাকার অভাব নেই। শিখার বোন কথাটা বলেই ফোন কেটে দেয়। এরপর শিখা ফোন করে ওর বাবার কাছে। শিখার বাবা বলে, সে বিকেলে জানাবে। কিন্তু বিকেলে ফোন করলে শিখা ওর বাবার ফোন বন্ধ পায়। পরদিন সকাল পর্যন্ত শিখার বাবার ফোন বন্ধ থাকে।

কান্তা কেবলমাত্র হসপিটালে এসেছে। শিখার কেবিনে ঢুকতেই ওর কানে কিছু কথা যায়।

” শোন, অপারেশন দিন পিছিয়ে দাও। তুমি বাড়ি যেয়ে টাকা নিয়ে এস। তারপর অপারেশন এর ব্যবস্থা কর। বড় আপাকে, আমার আব্বাকে ফোন দিয়েও তো টাকা পেলামনা। ওরা মনে করেছে, আমি ওদের টাকা আত্মসাৎ করব। অথচ আব্বা-আম্মাকে আমি দিনের পর দিন টাকাপয়সা দিয়েছি। এমনতো নয় যে তাদের অর্থের অভাব আছে। আমি মেয়ে হিসেবে আব্বা-আম্মাকে দেখেছি। কিন্তু আমার আব্বা ভয় পেয়ে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। আর ঐ বড় বোনকেও কম দিইনি। তার ছেলে-মেয়েদের সোনার জিনিস দিয়েছি। তাদের সব চাহিদা মিটিয়েছি। তাদের কোন কিছুর প্রয়োজন হলে, আমার কাছে চেয়েছে। আমি সাথে সাথে তাদেরকে সেসব দিয়েছি। আজ সেই বোনও তার রূপ দেখিয়ে দিল। আজ বুঝলাম প্রয়োজন আর প্রিয়জনের পার্থক্য। ” শিখা কাঁদছে। আজ সত্যিই ওর অনুশোচনা হচ্ছে।

কান্তা সবকিছু শুনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর সেখান থেকে সরে এসে আরমানকে ফোন দিয়ে সবটা জানায়। আরমান সাথে সাথে ওর বাবার কাছে ফোন দিয়ে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলে। কারন আরমান এখন অফিসিয়াল কাজে বাইরে আছে। ওর টাকা পাঠাতে বিকেল হয়ে যাবে।

ছেলের ফোন পেয়ে শহিদ আহমেদ তৎক্ষনাৎ হসপিটালে এসে জাবেদের কাছে টাকা দেন। জাবেদ অবাক হয়ে জানতে চাইল, টাকার কথা তিনি কিভাবে জেনেছেন? শহিদ আহমেদ তখন জাবোদকে আরমানের বলা কথাগুলো জানান। সবকিছু শুনে শিখা লজ্জায় কেঁদে ফেলে। আর সত্যিই কান্তার কাছে ওর মাথা নত হয়েছে।

চলবে…

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৪১
জাওয়াদ জামী

অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে শিখা কান্তার সাথে একান্তে কথা বলতে চায়। সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে কান্তার মুখোমুখি হয় শিখা।
কান্তা উসখুস করছে। ও কিছুতেই শিখার পূর্বের আচরণগুলো ভুলতে পারেনা। শিখার হিং’স্র’তা ওর মন ও মস্তিষ্কের প্রতিটি কোনে গেঁথে গিয়েছে।

শিখা কান্তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, কান্তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।

” যদি আর বেঁচে না ফিরি, তবে আমার ছেলেটাকে দেখিস। দেরিতে হলেও আজ বুঝতে পারলাম, কে আমার আপনজন। সারা জীবন যাদের জন্য সংসারকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছি, আজ তারাই আমাকে নিজেদের পিঠ দেখাল। অথচ আজ আমার স্থান তাদের বুকে হওয়ার কথা। তুই আমাকে মাফ করে দিস। তুই মাফ না করলে আমাকে অনন্তকাল ধরে জ্বলতেই হবে। এতদিন তোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছি, অথচ আমার কঠিন সময়ে তুই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিস। অতীতের কথা একটাবারও না তুলেই নিজের মানবিকতা দেখিয়ে দিলি। আমি তোর খারাপ চাইলে কি হবে! ওপরওয়ালা তোর সাথে আছেন। তাই আজ তোর কাছে আমি চিরদিনের জন্য ঋণি হয়ে গেলাম। আচ্ছা শোন, এই কয়দিন ঢাকা আছি অথচ তোর মেয়েকে দেখতে পারলামনা। যদি ফিরে আসি, তবে মেয়েটাকে একবার দেখাস। তোর ভাই দিনে কয়েকবার করে ওর কথা বলে। আরাফও তাই। যাই রে, দোয়া করিস, যেন নিজেকে বদলানোর সুযোগ পাই। ” শিখা চোখের পানি মুছে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। কান্তাকে কোন কথা বলার সুযোগ দেয়না।

কান্তা শিখার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে, ভাগ্য যে কখন, কাকে, কোথায় এনে দাঁড় করায়, তা সৃষ্টকর্তা ছাড়া আর কেউই জানেনা। এই ছোট দুনিয়ায় নিজের কৃতকর্মের ফল, ঘুরেফিরে নিজের উপরই পতিত হয়।

যথাসময়ে শিখার অপারেশন শেষ হয়। ডক্টর জানায়, ওকে তিনদিন অবজারভেশনে রাখবে। এরপর যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাতদিন পর ডক্টর জানায়, শিখার শারিরীক অবস্থা আগের থেকে ভালো। তবে তাকে আর কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হবে। হার্টের চিকিৎসার জন্য। তাছারা ডায়বেটিস থাকায় অপারেশনের ক্ষত শুকাতে সময় লাগবে এবং ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই অপারেশনের পরও বিশ দিন ওকে হসপিটালে ডক্টরের তত্বাবধানে থাকতে হয়।

কান্তা খাবার নিয়ে হসপিটালে এসেছে। আজ ও সাথে করে মেয়েকে নিয়ে এসেছে। ওর মেয়ের বয়স তিনমাসের বেশি হচ্ছে।
শিখা বেডে শুয়ে আছে। ওর পাশে আরাফ বসে আছে। জাবেদ সিস্টারের সাথে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে।
কান্তাকে দেখে আরাফ দৌড়ে আসে। কায়াকে কোলে নিতে হাত বাড়ায়। কান্তা হাসিমুখে আরাফের কোলে দেয় মেয়েকে। খাবারের পাত্র নিয়ে এগিয়ে যায় শিখার কাছে।

” আজ কেমন আছো, ভাবি? ”

” ভালো আছিরে। তুই কেমন আছিস? মেয়েকেও নিয়ে এসেছিস! কই আমার কাছে একটু নিয়ে আয়। আমিও একটু ওকে দেখি। ”

মায়ের কথা কানে যেতেই আরাফ কায়াকে নিয়ে ওর মা’য়ের কাছে আসে। শিখা আলতোভাবে কায়াকে কোলে নেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ ওকে কোলে রাখতে পারেনা। কান্তার কাছে ফিরিয়ে দেয়। কান্তা বেডের পাশে চেয়ারে কায়াকে নিয়ে বসে। শিখা ওর বালিশের নিচ থেকে পার্স বের করে। এরপর ভেতর থেকে একটা সোনার চেইন নিয়ে পরিয়ে দেয় কায়ার গলায়।

” আমি নতুন জিনিস দিয়ে মেয়েটার মুখ দেখতে পারলামনা। এটা আমার চেইন। অপারেশনের আগে খুলে রেখেছিলাম। আপাতত মেয়েকে এটাই দিলাম। এরপর আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি গিয়ে ওর জন্য একসেট সোনার জিনিস গড়িয়ে আনব। ”

” তোমার চেইন দেয়া লাগবে কেন! ভাইয়া ওকে দিয়েছে তো। ওকে যা দেয়ার দিয়েছ। পরে আর কিছুই দিতে হবেনা। ”

” বিয়ের সময় তোকে কিছুই দেয়া হয়নি। তাই তোর মেয়ে ডাবল সোনা পাবে ওর মামার বাড়ি থেকে। তুই আর এই বিষয়ে কোন কথা বলিসনা। ”

কান্তা ওর ভাবিকে যতই দেখছে, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। মানুষের এতটা পরিবর্তনও হয়!

জাবেদ এসে কায়াকে কোলে নেয়। তখন কান্তা উঠে শিখাকে খাওয়ানোর জন্য। শিখাকে খাইয়ে, জাবেদকে খেতে দেয়। এরপর কিছুক্ষণ ওদের সাথে গল্পগুজব করে। এরপর শহিদ আহমেদ হসপিটালে আসলে আরাফকে নিয়ে ওরা বাসায় ফিরে। কান্তা আরাফকে হসপিটালে থাকতে দেয়না। নিজের কাছেই রাখে।

বিশ দিন পর শিখাকে রিলিজ দিলে, শহিদ আহমেদের জোড়াজুড়িতে শিখাকে নিয়ে জাবেদ তাদের বাসায় উঠে। সেখানে দশদিন থাকার পর ওরা বাড়ি ফিরে। এই দশ দিন কান্তা শিখার যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে, সেবাযত্ন করেছে। এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ শিখা ও জাবেদের সাথে আপনজনের মতই আচরণ করেছে। শ্রীজার সাথে শিখার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
বিদায় কালে শিখা হঠাৎই কান্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। এই একমাসের বেশি সময় কান্তা শিখার সাথে কোন খারাপ আচরণ করেনি। কমতি রাখেনি শিখার সেবাযত্নের।

শিখা সেদিনের পর থেকে নিজের বাবা-মা আর বোনের সাথে একবারও কথা বলেনি। তারা মাঝেমধ্যে ফোন দিলে ও জাবেদকে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। জাবেদ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে, শিখা জানিয়েছে, সুসময়ের বন্ধুর ওর কোন প্রয়োজন নেই। জাবেদও আর কোন কথা বাড়ায়নি।

ওরা রওনা দেয়ার সময় কান্তা জাবেদের হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে শিখা রান্না করতে পারবেনা ভেবেই কান্তা খাবার ফ্রোজেন করে রেখেছিল। আগামী সাতদিন শিখাকে কোন রান্না করতে হবেনা। এছাড়া কান্তা আরমানের নির্দেশে শিখাকে ওর ভাই, ভাতিজাকে পোশাক কিনে দেয়। যাওয়ার সময় জাবেদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। যদিও জাবেদ এসবের কিছুই নিতে চায়নি। কিন্তু কান্তার জোড়াজুড়িতে নিতে বাধ্য হয়।
জাবেদ যাওয়ার আগে শহিদ আহমেদকে জানায়, ও বাড়িতে ফিরেই তার টাকা পাঠিয়ে দিবে।
শহিদ আহমেদ তাকে বলেন, তারাহুরো না করতে। টাকাগুলো ধীরেসুস্থে দিলেই হবে।

শিখা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্বামী-সন্তানের সাথে বেরিয়ে যায়। পেছনে ফেলে রেখে যায়, তার অতীতের তিক্ত স্মৃতি। অতীতকে পেছনে ফেলে, সৃষ্টি হওয়া নতুন সম্পর্কের বাঁধনকে মজবুত করতে পা বাড়ায় নিজের গন্তব্যে। এবার পুরাতন শিখাকে ভেঙ্গেচুরে, নতুন শিখাকে গড়ে তোলার সময় এসেছে।

আরমান ঢাকায় এসে ওর বাবাকে নিয়ে খালার বাসায় গিয়ে, শ্রীজার বিয়ের দিন ঠিক করে আসে। সামনের মাসের পনের তারিখ বিয়ের দিন ঠিক করে। সে হিসেবে ওদের হাতে আর পঁচিশ দিন সময় আছে।
আরমান কান্তাকে এই কয়দিন ঢাকাতেই থাকতে বলে। কান্তাও সহাস্যে রাজি হয়।

আরমান অফিসে বসে কাজ করছে। এমন সময় টেবিলে থাকা ওর ফোন বেজে ওঠে। আরমান ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল ঢাকার ধানমন্ডি থানা থেকে ওসি ফোন দিয়েছে। এই সময় ওসির ফোন দেখে আরমানের কপালে ভাঁজ পরে। কয়েক মূহুর্ত চুপচাপ থেকে ফোন রিসিভ করে।

” আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি ধানমন্ডি থানার ওসি বলছিলাম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি চিনতে পেরেছি। বলুন কেন ফোন দিয়েছেন? ”

” স্যার, আপনিতো জানেন, আপনার বাবাকে আঘাত করা সেই ড্রাইভার, দেড়মাস আগে জামিন পেয়েছে। ও জামিনে বের হওয়ার পর থেকে, আমরা ওর দিকে নজর রাখছিলাম। ওর ফোনে আঁড়িপাতার ব্যবস্থা করেছিলাম। এছাড়া সাতদিন পর পর ওর কল লিষ্ট চেইক করি। গতকালই আমরা ওর কল লিষ্ট চেইক করেছি। সেখানে আমরা কিছু অসংগতি পেয়েছি। ”

” কি অসংগতি? ” আরমানের হার্টবিট বেড়ে গেছে।

” গত পাঁচদিন আগে ওর ফোনে একটা ফোন এসেছিল। ও প্রায় ছয় মিনিট সেই নম্বরে কথা বলেছে। এর একদিন পর আবার সেই নম্বর থেকে ওর কাছে ফোন আসে। আর গতকাল ওর এ্যাকাউন্টে হঠাৎ করেই পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়েছে কেউ। আমরা খোঁজ নিয়েছি সেই অজ্ঞাত নম্বরের ব্যাক্তি সম্পর্কে। আর এ-ও জানতে পেরেছি, সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তিটিই ড্রাইভারের এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে। ”

ওসির কথা শুনে আরমান হাতের মুঠো শক্ত করে। সেই সাথে শক্ত হয় ওর চোয়াল।

” আপনারা নিয়মিত ওর খোঁজ রাখুন। আর আমাদের কেউ যেন ওর আশেপাশে না যায়। ওকে বুঝতে দেয়া যাবেনা, আমরা ওকে ফলো করছি। আপনারা আগে সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তির ডিটেইলস জানুন। এরপর যা ব্যবস্থা করার করতে হবে। আমি দুইদিনের ভেতর ঢাকায় আসছি। এই দুই দিন তাকে নির্বিঘ্নে থাকতে দিন। আর কল লিষ্ট আমাকে এখুনি ইমেইল করুন। ”

আরমান ফোন রেখে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। এরইমধ্যে ওসি কল লিষ্ট আরমানকে ইমেইল করেছে। আরমান লিষ্টে চোখ বুলিয়ে, ফোন করে তার সোর্সদের। যাবতীয় নির্দেশনা দেয় তাদের।

বিঃদ্রঃ গল্প লিখার পর রি-চেইক দেয়ার সময় হয়না। তাই বানান একটু এদিক-সেদিক হতে পারে। আপনার সেগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…