#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৪২
জাওয়াদ জামী
শ্রীজার বিয়ের দিন এগিয়ে এসেছে। শহিদ আহমেদের বাড়িতে সাজ সাজ রব। আত্নীয় স্বজনরা আসতে শুরু করবে দুই-চার দিনের মধ্যেই। শ্রীজা আর কান্তা মিলে শপিং করছে। আরমান বোনকে শপিংয়ের জন্য টাকা দিয়েছে।
শহিদ আহমেদ মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কমতি রাখেনি। সকল দূরের, কাছের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করেছেন। কান্তার বাবার বাড়িতেও দাওয়াত করেছেন। জাবেদ তার পরিবার নিয়ে আসতে রাজি হয়েছে। কিন্তু কান্তার ছোট ভাই না আসতে নানান টালবাহানা করছে।
কান্তা মেয়েকে ঘুমিয়ে দিয়ে নিজেও একটু চোখ বন্ধ করেছে। গত কয়েকদিন থেকে ওর ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছেনা। সারাদিন শপিং, বিয়ের আয়োজন নিয় ব্যস্তু থাকতে হচ্ছে। আকলিমা খানম সব দ্বায়িত্ব কান্তার কাছে দিয়ে নিশ্চিত আছেন। তার কোন ক্ষমতাই নেই মেয়ের বিয়েতে কাউকে কোন সাহায্য করার। কান্তাও হাসিমুখে সব কাজ করছে। শহিদ আহমেদ আত্মীয়-স্বজনদের লিষ্ট থেকে শুরু করে সবকিছুতেই, এমনকি খাবার মেন্যু কি কি হবে সব কান্তার পছন্দমত করছেন। যেহেতু আরমান কাছে নেই, সেহেতু তিনি কান্তাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। তন্দ্রাভাব ঘিরে ধরেছে কান্তার দু’চোখে। হঠাৎই পাশে রাখা ফোনের মৃদুমন্দ আওয়াজে চোখ মেলে চায় ও। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায়, মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছে। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে ফোন রিসিভ করে।
” আসসালামু আলাইকুম। আপনি এই অসময়ে ফোন দিয়েছেন! আপনার শরীর ঠিক আছে তো? ”
” বউয়ের কাছে ফোন দিতে সময়ে-অসময় কোন ম্যাটার করে না, আর শরীরও খারাপ হয়না। কিন্তু তুমি বোধহয় ঘুমাচ্ছিলে? বিরক্ত করলাম? ”
” আপনি ফোন দিলে বিরক্তিরা পাখনা মেলে নীল আকাশে ভ্রমনে যায়। তারা বুঝে আপনি আমার সকল সুখের কারন। তাই আপনি সম্পর্কিত কোন কিছুতেই বিরক্তিরাও আবেগে ভাসে। ”
” আমার বউ কি কাউকে খুব মিস করছে? ”
” কেন, আপনি বোঝেননা? ”
” আমি বাপু নিরামিষ মানুষ, যদিও এটা তোমার ভাষায়। তাই ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান করে থাকি। বেশি বুঝতে গেলে বউ মাথায় চড়ে তবলা বাজাবে। আমার বউয়ের আবার মতিগতি সুবিধার নয়। ”
” তবলা বাজালে বউই বাজাবে, অন্য কেউতো বাজাবেনা। বউ মাথায় চড়লেও আপনার আপনারই লাভ। অন্য মেয়ে মাথায় চড়লে, আপনার মাথায় একটা চুলও থাকবেনা। এক্ষেত্রে আমি দয়াবতী। দু-চারটা চুল রাখব। এসব কথা বাদ দিন। এবার বলুন কবে আসছেন? বাসায় কত কাজ অথচ আপনি নেই। বাবাকে সবটা একা সামলাতে হচ্ছে। ”
” আমি দুই-একদিনের মধ্যেই যাব। এইযে দয়াবতী, আমার প্রিন্সেস এখনও ঘুমাচ্ছে? ইশ! কতদিন থেকে মেয়েটাকে আদর করিনি। একবার শ্রীজার বিয়েটা হয়ে যাক। তোমাদের নিজের কাছে আনব এবং আগামী ছয়মাসের মধ্যে কোথাও যেতে দিবনা। ”
” শখ কত! আমি আগামী ছয়মাসের মধ্যে কোথাও যাচ্ছিনা। এই ছয়মাস এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াব। ”
” ঠ্যাং ভে’ঙে হাতে ধরিয়ে দিব। সাহস কত! আমার থেকে ছয়মাস দূরে থাকতে চায়! তোমার এই শখ পূরণ করার মত দয়ালু আমি নই। এই কয়টা দিন একা ছেড়েছি তাতেই পা বড় হয়েছে? তোমার ভাগ্য ভালো, এই মুহূর্তে আমি তোমার পাশে নেই। ”
” পাশে থাকলে কি করতেন? ঠ্যাং ভা’ঙ্গ’তে’ন? সেই সাহস আছে আপনার? নাকি শুধুই ঢপ মারছেন! ”
” আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলছ! ”
” উঁহু, সাহস নিয়ে নয়। ঠ্যাং ভাঙ্গার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। আপনার এই সাহস আমি দেখতে চাই। ”
” কি মেয়েরে বাবা! কলিজায় ভয় বলতে কিছুই নেই! একবার আমাকে আসতে দাও। ভয় তোমাকে গিলিয়ে খাওয়াব। তখন আমার সাথে কথা বলতে হলে তোমাকে দুইবার ভাবতে হবে। ”
” বলি নিজেকে কি হিটলার ভাবেন? আমাকে ভয় গিলিয়ে খাওয়াতে গেলে আমিও উগড়ে দিব। জোর করে হিটলার হতে চাইলেই হয়না। অন্তরেও হিটলার হতে হয়। আপনি ওপরে ওপরে হিটলারের পার্ট নিচ্ছেন, কিন্তু ভেতরে আমেনার বাপই থেকে গেছেন। অল্পেই বুকে হাত দিয়ে আমেনার মা বলা ছাড়া কিছু পারেননা। বুঝলেন আমেনার বাপ? ”
আরমান কান্তার কথা শুনে টাস্কি খায়। এই মেয়ে বলে কি! আমাকে আমেনার বাপ বানিয়ে দিল! পাজি মেয়ে। একে এইবার একটু ভয় না দেখালেই না। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে আরমান।
” শোন, আমি হয়তো শ্রীজার বিয়েতে আসতে পারবনা। যা করার তোমরাই মিলেমিশে কর।আমি টাকা পাঠিয়ে দিব। তোমার আর প্রিন্সেসের জন্য কেনাকাটা কর। আর বিয়ের পর তোমার যেখানে মন চায়, সেখানেই ঘুরবে। আমি এদিকে সামলে নিব। এখানকার থানায় একজন নতুন এস আই জয়েন করেছে। মেয়েটা খুব সুন্দরী আর এট্রাকটিভও। একদিন থানায় গিয়েছিলাম, মেয়েটা যথেষ্ট আপ্যায়ন করেছিল। বাসায় একদিন খাবারও পাঠিয়েছিল। তার হাতের রান্না মন্দ নয়। আচ্ছা শোন, আমার একটা ফোন এসেছে। এখন আমি রাখছি। পরে সময় করে কথা বলব। ” কান্তার প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশা না করে আরমান ফোন কেটে দেয়। মনে মনে হাসে পৈ’শা’চি’ক হাসি। সে ভাবছে, আমাকে জব্দ করা এত সহজ নয়। এবার তুমি আপাতত জব্দ হও।
এদিকে কান্তা আরমানের কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। সে ফোন কেটে দিয়েছে! আর নতুন এস আইয়ের কথা আমাকে বলল কেন! কান্তার মনে উথালপাথাল চিন্তার ঝড় উঠেছে।
সন্ধ্যার পর থেকে কান্তা আরমানকে একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছে। কিন্তু ওকে চিন্তার সাগরে ভাসিয়ে আরমান নিরব থাকে।
কান্তা আরমানের এমন আচরনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর কোন কাজেই মন বসছেনা।
দুই দিন আরমানের সাথে কান্তার কোন প্রকার কথা হয়নি। কান্তা হাজারবার ফোন দিলেও আরমান রিসিভ করেনি। অথচ সে শ্রীজার সাথে ঠিকই কথা বলেছে। শ্রীজা একবার আরমানকে সেঁধেছে কান্তার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু আরমান কাজের অযুহাত দেখিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে।
আরমানের এহেন আচরণ কান্তার মানতে কষ্ট হচ্ছে। যে মানুষটা ওর সাথে একঘন্টা কথা না বলতে পারলে ছটফট করেছে, আজ সেই মানুষটাই ওর সাথে দুই দিন কথা বলেনি! কান্তার ইচ্ছে করছে আজই চিটাগং ফিরে যেতে। ও একবার শহিদ আহমেদকে ইনিয়েবিনিয়ে সে কথা বলেছেও। কিন্তু শহিদ আহমেদ এখন তার ছেলের বউকে কোথাও যেতে দিতে নারাজ। বাধ্য হয়ে কান্তাকে বুকে পাথর চাপতে হয়। তবে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ের পর পরই ও চিটাগং চলে যাবে।
ড্রয়িং রুমে বসে শহিদ আহমেদের সাথে খাবার মেন্যুতে শেষবারের মত চোখ বুলাচ্ছে কান্তা। ওর পাশের সোফায় শ্রীজা কায়াকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আকলিমা খানম বসে বসে তার স্বামীর কথা শুনছে।
কলিং বেলের আওয়াজে ওদের কাজে বিঘ্ন ঘটে। শ্রীজা কায়াকে আকলিমা খানমের কাছে দিয়ে দরজা খুলতে যায়।
দরজা খুলেই ওর চোখ ছানাবড়া! এ কি দেখছে সে!
কয়েক মুহুর্ত থমকে থেকে, দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।
শ্রীজা সরে দাঁড়াতেই আরমান শুভর কলার ধরে হির হির করে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসে।
ছুঁড়ে ফেলে শহিদ আহমেদের পায়ের উপর।
” এই যে, আপনার ছেলেকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। এর জন্যই আপনারা গুমরে ম’র’ছে’ন!
কিন্তু সে আপনাদের মা’র’তে চায়। আমি ওকে এনেছি। এবার যা সিদ্ধান্ত নেয়ার আপনারা নিবেন। ”
এইভাবে দুই ছেলেকে একসাথে দেখে শহিদ আহমেদ ও আকলিমা খানম দুজনেই স্তম্ভিত। শ্রীজাও কম অবাক হয়নি। আর কান্তা, সে তো আরমানের দিক থেকে চোখ সরাচ্ছেনা।
” এসব তুমি কি বলছ, আরমান!কে, কাকে মা’র’তে চায়? ” শহিদ আহমেদ বিস্মিত।
” আপনাকে মা’র’তে চায় আপনার ছেলে। আপনার যে এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, তার জন্য দায়ী শুভ। সে ঐ ড্রাইভারকে টাকা দিয়েছিল আপনাকে মা’র’তে। ”
” তুমি সত্যি বলছ, আরমান? আমাকে সত্যিটা বল। আমি সবটা শুনতে চাই। ” আকলিমা খানম বিশ্বাস করতে পারছেনা।
শহিদ আহমেদ তার ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আছেন। এতদিন পরে এসব কি শুনছেন তিনি!
” এটাই সত্যি। শুভ আপনাকে মা’র’তে ঐ ড্রাইভারকে ঠিক করেছিল। এতদিন আমরা বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে ছিলাম। কিছুদিন আগে ঐ ড্রাইভার জামিনে মুক্তি পেলে, আমরা জানতে পারি এসবের পেছনে শুভ ছিল। ”
” কিভাবে জানতে পেরেছ? ” আকলিমা খানম অবিশ্বাসের গলায় বলে।
” আমরা সেই ড্রাইভারের দিকে নজর রাখছিলাম। আমার বাবাকে একজন হুটহাট করে গাড়ি চাপা দিবে, এটা মানতে পারছিলামনা। আমার নির্দেশেই ড্রাইভারের পেছনে লোক লাগানো হয়। তার ফোন ট্রাক করা হয়। কয়েকদিন আগে হঠাৎই সেই ড্রাইভারের কিছু এ্যাক্টিভিটি লক্ষ্য করা হয় যা একটু সন্দেহ জাগায়। এরপর তার এ্যাকাউন্টে কাকতালীয়ভাবে কেউ পাঁচ লক্ষ টাকা পাঠায়। আমরা সেই নম্বর ট্রেস করে, সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তির খোঁজ পাই। এরপর সেই ব্যক্তিকে আটক করে জানতে পারি, সে শুভর কাছ থেকে ড্রাইভারের নম্বর পেয়েছে। এরপর ড্রাইভারকে আবার আটক করা হয়। তাকে রিমান্ডে নিলে জানতে পারি, শুভ তাকে টাকা দিয়েছিল তার বাবাকে মা’র’তে। সেসব রেকর্ড আমার কাছে আছে। এবার আপনারা সত্য-মিথ্যা ওকে জিজ্ঞেস করুন। ”
” শুভ, আরমান এতক্ষণ যা যা বলছে, সে সম্পর্কে তোমার কিছু বলার আছে? আমি সত্যিটা শুনতে চাচ্ছি। ” কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন শহিদ আহমেদ।
শুভ নিশ্চুপ।
” শুভ, তোর বাবার কথার উত্তর দে। তুই নীচে নেমেছিস মানছি কিন্তু তাই বলে এতটাও নীচে নামিসনি আশা করছি। সন্তান হিসেবে বাবা-মা’র সম্মান নিয়ে খেলেছিস। কিন্তু মানুষকে দিয়ে বাবাকে খু’ন করাতে চাইবি এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যিটা বল, শুভ। ” আকলিমা খানম দ্বিধার দোলাচালে দুলছে।
শুভ তারপরও নিশ্চুপ থাকে।
” তুমি কি এখানে সংয়ের মত দাঁড়িয়ে থাকতে এসেছ? যদি অপরাধ না-ই করে থাক, তবে কিসের এত লুকোচুরি। তাহলে কি আরমানের কথাই সত্যি বলে ধরে নিব? ”
” কিসের এত আরমান আরমান করছ? আরমান এখন সবকিছু। আর আমি ত্যাজ্য? সবকিছু ওকে দিয়ে খাওয়াবে, আর আমি মাত্র ত্রিশ লক্ষ টাকা নিয়ে শান্ত থাকব? এতটা পাগল আমাকে মনে করেছিলে? তোমার মত বাপকে পিষে মা’রা উচিত। বেইমান তুমি। আমার সাথে বেইমানি করে ঐ আরমানকে সব দিয়েছ। আমিও তাই তোমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমাকে ত্যাজ্য করলে তোমার যদি অন্যায় না হয়, তবে সেই তোমাকে মা’র’তে চেয়ে আমি কোন ভুল করিনি।
আর এই যে তোমার আদরের বড় ছেলে। সে আমার কাছে গেছে আমাকে জ্ঞান দিতে। আমি সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসলে, উশৃংখল জীবনযাপন বাদ দিলে, আমাকে নাকি ওর ভাগের সম্পত্তিও দিবে! আমাকে জেলে ঢোকাবেনা। সৎভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিবে। ওর কথা বিশ্বাস করব আমি! যেই আমি রাজি হইনি, সে তখনই আমাকে জোর করে এখানে নিয়ে আসল। একেও নিশ্চয়ই তোমার হয়ে দালালি করতে পাঠিয়েছিলে? ”
” আরমানের বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি, রাখবে? ” আকলিমা খানম ভেজা গলায় বলে।
” বল। ”
” তুমি ওর ভাগের সম্পত্তি ওকে দিয়ে দাও। ওকে জেলে দিওনা। তাহলে সারাজীবন ও আমার দুই সন্তানের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে থাকবে। ওদের ক্ষতির কথাও ভাবতে পারে। ওর বিচার আল্লাহ করবে। ওর জন্য আজ আমি পঙ্গু। আমার ফুপু দুনিয়ায় নেই। তোমাকে মা’র’তে চেয়েছিল। ওর পাপের পাল্লা ভারি হতে হতে যখন মাটিতে ঠেকে যাবে, তখন ওর পতন হবে। তুমি আমাদের ল ইয়ারকে এখনই আসতে বল। আমরা ওকে ত্যাজ্য করার পরও ওকে ওর প্রাপ্য দিয়েছি এভাবে উইলে লেখা থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে ও কখনও আমার দুই ছেলে-মেয়ের কাছে কোন দাবী না করতে পারে। ওর সাইন থাকবে সেই উইলে। তুমি এখনই ল ইয়ারকে ফোন কর। আমার কাছে আজ থেকে ও মৃ’ত।
এতদিন ওর জন্য যতটুকু চোখের পানি ফেলেছি, আজ থেকে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তুমি আমার এই কথাটা রাখ। এরপরও যদি আমরা ওর জন্য কষ্ট পাই, সেটা হবে আমাদের বোকামি। আমি এই ভুলটা আর করতে চাচ্ছিনা। ওকে আজ খালি হাতে ফেরালে, ও ভবিষ্যতে আমার বাকি দুই ছেলে-মেয়ের ওপর হামলা চালাবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে। তুমি ওর জন্য একটুও কষ্ট পেওনা। ও পর হয়েছে তো কি হয়েছে! আল্লাহ আমাকে আরও সন্তান ঠিকই দিয়েছে। ” আশ্চর্যজনক হলেও আকলিমা খানমের গলা একটুও কাঁপেনি কথাগুলো বলতে।
স্ত্রী’র কথামত শহিদ আহমেদ ল ইয়ারকে ফোন করে প্রয়োজনীয় পেপারস আনতে বললেন।
আরমান বারবার ওর বাবা-মা’কে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা কেউই আরমানের কথা শুনেনা।
ল ইয়ারের উপস্থিতিতে উইল লিখে সেখানে শুভর সাইন নিয়ে, ওকে ওর ভাগের বাকি আশি লক্ষ টাকার চেক দিয়ে, বাড়ি থেকে বের করে দেন।
শুভও টাকাগুলো পেয়ে হাসিমুখে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে । ওর মনে তখন একটাই চিন্তা, আর কিছুদিন লিসাকে কাছে পাওয়া যাবে। আরেকটা নতুন মেয়েকে মনে ধরেছে, তাকেও ট্রাই করতে হবে। এরজন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিল। আজ ওর হাতে সত্যিই প্রচুর টাকা এসেছে।
শুভ একটাবারও ভাবলনা, বাবা-মা’ কে কত কষ্ট দিয়ে ও সুখের হাসি হাসছে। এই হাসির শেষ পরিনতি কি হতে পারে।
চলবে…
#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট__৪৩
জাওয়াদ জামী
শুভ চলে যাওয়ার পরও আরমান বাবা-মা’র কাছে বসে, তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু শহিদ আহমেদ ও আকলিমা খানম কিছুতেই বুঝ নেয়না। তাদের একটাই কথা, শুভকে তাদের জীবনে আর কোনও প্রয়োজন নেই। আকলিমা খানমের ভাষ্যমতে, দুষ্টু গরুর থেকে, শূন্য গোয়াল ভালো। শুভকে ফিরিয়ে এনে সে বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করতে চায়না।
কিংবা আরমান চাইছে, শুভকে কাছে রেখে শোধরাবার চেষ্টা করতে।
কিন্তু ওর প্রস্তাবে শহিদ আহমেদ এবং তার স্ত্রী কিছুতেই রাজি হয়না।
এত সময় ধরে বাবা-মা’ র সাথে কথা বলতে গিয়ে আরমান মেয়ের কথা দিব্যি ভুলে বসেছিল। সে একটিবারও মেয়ের দিকে কিংবা কান্তার দিকে তাকায়নি। এই বিষয়টি লক্ষ্য করে কান্তা ভিষণ কষ্ট পায়। এমনটা নয় যে শুভর বিষয় নিয়ে ও চিন্তিত নয়। কান্তার বারেবার মনে হচ্ছে, কথার ফাঁকে একটিবার অন্তত আরমান ওদের দিকে তাকাতে পারত। কষ্টে কান্তার বুক দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। এ কেমন বাবা!
শহিদ আহমেদের সাথে কথার মাঝেই আরমানের কানে মেয়ের কান্নার শব্দ আসে। ও হকচকিয়ে মেয়ের দিয়ে তাকায়। নিজের অজান্তেই অশ্রাব্য গালি বেরিয়ে আসে মুখ থেকে । ও কি করে পারল এতক্ষণ যাবৎ ওর পরীটাকে ভুলে থাকতে! আজ বাবা হিসেবে নিজেকে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে।
শহিদ আহমেদের সাথে কথা শেষ না করেই, আরমান শ্রীজার কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করে। আশ্চর্যজনকভাবে আরমানের কোলে উঠেই কায়া শান্ত হয়ে যায়। আরমান মেয়ের চোখেমুখে চুমু দিয়ে আদর করতে থাকে। বাবার আদর পেয়ে মেয়েও বিড়াল ছানার মত বাবার বুকে সিঁটিয়ে যায়।
শহিদ আহমেদ ছেলেকে রেষ্ট নিতে বলে নিজেও রুমে যান। তার পিছুপিছু হুইল চেয়ারে ভর করে আকলিমা খানমও রুমে যায়।
এতক্ষণে আরমান কান্তার দিকে তাকায়। কিন্তু ওর সাথে কোনও কথা না বলে সোজা রুমের দিকে পা বাড়ায়।
কান্তাও ওর পিছুপিছু মুখ ভার করে রুমে ঢোকে।
আরমান রুমে এসে মেয়েকে প্রানভরে আদর করছে। কিন্তু কান্তার দিকে একটাবারও ফিরে তাকায়না। ও এমনভাব করছে যেন, কান্তাকে দেখতেই পাচ্ছেনা।
কান্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের আল্লাদ দেখছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আরমান মেয়েকে রেখে ওয়াশরুমে ঢোকে। অনেক সময় নিয়ে গোসল করে বেরিয়ে আসে।
শ্রীজা এসে আরমানকে খাওয়ার জন্য ডাকলে, আরমান মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কান্তাকে একবারও বলেনা।
আরমান বেরিয়ে গেলে কান্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
ওর মনে ভয় চেপে বসেছে। আরমানকে হারানোর ভয়।
রাতে মেয়েকে ঘুমিয়ে দিয়ে, কান্তা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে সূদুর পানে। ওর চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। আরমানের এই পরিবর্তন ও কিছুতেই মানতে পারছেনা। যে মানুষটা ওকে সব সময় ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছে, আজ সেই মানুষটার এ কি পরিবর্তন! বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউ আছড়ে পড়ছে কান্তার বুকের তীরে। এবার বুঝি ভাঙ্গনের সুর বেজেছে! কিন্তু ও আরমানকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে! কিভাবে একা পথ চলবে! কথাটা ভাবতেই কান্তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে র’ক্ত ছলকে উঠছে। প্রতিটি র’ক্ত বিন্দু বলছে, তুই তাকে ছাড়া নিঃস্ব। অনাদরের সাগরে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলি, সে তখন তোর অক্সিজেন হয়ে এসেছিল। তোর শ্বাস নেবার পথ সুগম করেছিল। আজ তুই নিজের দোষে সব হারাতে বসেছিস। তবুও কান্তা নিজের মনকে প্রবোধ দেয়, এসব তার নিছকই কল্পনা। কিন্তু মন সেই প্রবোধ মানলে তো!
কান্তা এবার শব্দ করে কেঁদে উঠে।
রুমে ঢুকতেই আরমানের কর্ণকুহরে কারও কান্নার আওয়াজ বারি খায়। ও সাথে রুমের ভেতর এদিকওদিক তাকায়। রুমে কান্তাকে না পেয়ে ওর বুঝতে বাকি থাকেনা ঘটনা কি।
দ্রুত পায়ে চলে আসে বারান্দায়। পেছন থেকে জাপ্টে ধরে তার রমনীকে। থুঁতুনি রাখে তার কাঁধে। এরপর ছোট্ট করে তার কানের লতিতে চুমু দেয়।
হঠাৎ কারও ছোঁয়া পেয়ে শিউরে ওঠে কান্তা। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে কার বাহু বন্ধনে আবদ্ধকরণ সে। এই ছোঁয়া ওর অচেনা নয়। ওর ঠোঁটের কোন একটু প্রসারিত হয়।
” ভয় গিলিয়ে খাওয়াতে পেরেছি? খুব তো বড়বড় বুলি আওড়াচ্ছিলে! এখন কাঁদছ কেন? ভয় যে উগড়ে দিলেনা? আমি অপেক্ষায় আছি যে। ” আরমান গলায় মধু ঢেলে বলল। ওর হাত বিচরণ করেছে কান্তার পেটে।
এবার কান্তা আরমানের মতলব বুঝতে পারছে। মুহূর্তেই ওর মন ভালো হয়ে যায়। মনের আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে সোনালী সূর্য উঁকি দেয়। মনকে সহাস্যে বলে দেয়, সে আমারই আছে। একান্তই আমার । তার মন বাগানে শুধু আমারই বিচরণ। আমিই তার তনু-মনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারীনি।
” আপনি আমাকে ভয় পাওয়াতে শুধুই কষ্ট দিয়েছেন! আমার কত কষ্ট হচ্ছিল সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারনা আছে? এই কয়দিন আমি যেন বেঁচে থেকেও ম’রে গেছিলাম। না পারছিলাম কাউকে বলতে, না পারছিলাম সহ্য করতে। কি যে এক অসহ্য যন্ত্রণায় আমি দিনাতিপাত করেছি, তা আমিই জানি। আপনি আমাকে যেন এক সমুদ্র অ’ন’লে নিক্ষেপ করেছিলেন। এই অনলের আঁচ অনুভব করা যায়, পুড়ে ক্ষ’ত-বি’ক্ষ’ত হয় মন। শরীরে কোন প্রভাব না ফেলেই জ্বা’লি’য়ে অ’ঙ্গা’র করে দেয়। ” এবার কান্তা ডুকরে কেঁদে উঠে।
কান্তার কান্নার আওয়াজে আরমানের বুকের ভিতর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। বুকের ওপর যেন কয়েকশো পাথর চেপেছে।
” সরি বউ। তুমি কেঁদনা। তুমি এভাবে কাঁদলে আমার যে ভিষণ কষ্ট হয়। বুকের পাঁজরে কুল ভাঙ্গা ঢেউ এসে আঘাত করে। আমি ভেঙে গুঁড়িয়া যাই মুহূর্তেই। ” কান্তার চোখের পানি সযত্নে মুছে দেয় আরমান।
” আপনি আমার কাছে প্রমিজ করুন, কখনও আর এমন দুষ্টুমি করবেননা? এসব সহ্য করার করার ক্ষমতা আমার নেই। ” নাক টানতে টানতে বলে কান্তা।
” আমি প্রমিজ করছি, আর কখনোই এসব করবনা। আমার বউটাকে কতদিন ধরে আদর করিনি বলতো? আরও কতকাল বউয়ের আদর থেকে বঞ্চিত থাকব! পাষাণ নারী। জামাইয়ের চাওয়া বোঝেনা। দেখ, কেমন শীতল হাওয়া বইছে। চারপাশে ঘুম জাগানিয়া গানে সুর তুলেছে ঝিঁঝিঁ পোকার দল। তোমার কি ইচ্ছে করছেনা, ঝিঁঝিঁদের দলে সামিল হয়ে, আমাকে জাগিয়ে রাখতে? তোমার উঞ্চ ছোঁয়ায় আমার শরীরে কাঁপন ধরাতে তুমি কি চাওনা। আজকে তোমার মাঝে ডুবতে ভিষণ ইচ্ছে করছে। ” কান্তাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় আরমান।
আরমানের এমন ডাক উপেক্ষা করার সাহস নেই কান্তার। সে-ও তার পুরুষের গলা জড়িয়ে ধরে, মাথা রাখে তার বুকে।
চলবে…