কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব-১৮+১৯

0
437

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১৮]
লাবিবা ওয়াহিদ

———————-
নিথি রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সার্ভেন্ট লাগেজটা রুমে রেখে চলে গেলো। নিথি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে লাগেজের দিকে অগ্রসর হয়। লাগেজ খুলে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নিথি বের হতে হতে মাগরিবের আযানের ধ্বনিতে চারিপাশ মুখোরিত হলো। রুমে আসতেই নিথি চমকে উঠলো। আয়নার মুখোমুখি রায়িন দাঁড়িয়ে মাথায় টুপি পরছে। নিথির বুকে তীব্র ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। অস্বস্তি, জড়তায় গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। এমন অনুভূতির কারণ জানা নেই নিথির। হয়তো রায়িন এবং নিথি এক রুমে সম্পূর্ণ একা অবস্থান করছে, তাই? নিথি কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ঘনঘন পলক ফেললো। সবটাই নিজেকে স্বাভাবিক করার নমুনা। রায়িন আয়নাতে নিথির প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো। পাঞ্জাবিতে আতর ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
–“ওযু থাকলে নামাজ পড়ে নাও। আমি মসজিদ যাচ্ছি!”

রায়িন এক মুহূর্তও দেরী না করে বেরিয়ে গেলো। নিথি যেন গলায় আটকে থাকা দম ফিরে পেলো। এত অস্বস্তি লাগছে কেন তার? কই, আগেও তো একাকী পাশাপাশি হেঁটেছে, এক রুমে বসে রায়িনের কাছে পড়েছে।

নিথি নামাজ সেরে বাহিরে যেতেই উপলব্ধি করলো করিডোরের আলো নেই। নিথির পা জমে গেলো ভয়ে। সন্ধ্যা হয়েছে তাও লাইট কেন জ্বলছে না? অদ্ভুত তো! নিথি ভয়ার্ত দৃষ্টি চারপাশে বুলালো। কারো সাড়াশব্দ নেই। কেমন স্তব্ধ, গা ছমছমে পরিবেশ৷ বাড়িতে কী কেউ নেই? এমন ভুতুড়ে পরিবেশ হয়ে আছে যে? নিথির অধরজোড়া মৃদ্যু কম্পনরত। তার চেয়েও বড়ো কথা হাতে ফোন নেই, ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতে পারবে না। এছাড়া নিথির ফোন-ই তো ভাঙ্গা৷ সেটা আর চলবে কীভাবে? রুমের লাইট জ্বলছে। নিথির সাহস হচ্ছে না, পিছে ফিরে রুমে দৌড় দিতে।

হঠাৎ পায়ের শব্দ পেলো নিথি৷ যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে তার দিকেই আসছে। নিথি চোখ-মুখ খিঁচে এক চিৎকার দিয়ে পাশে থাকা ফুলের টব দ্বারা অবয়বটাকে আঘাত করার চেষ্টা চালালো। নিথি এরকম ভয়ংকর কিছু করার পূর্বেই এক বলিষ্ঠ হাত তার হাত ধরে আটকালো। চোখে তীব্র আলো পরায় নিথি পিটপিট করে এক চোখ খুললো।
–“পাগল নাকি তুমি? শেষমেষ আমায় খু*ন করতে আসছো এখানে?”

নিথি এবার পুরোপুরি চোখ খুললো। রায়িন ততক্ষণে নিথির চোখের সামনে ধরে রাখা ফোনের ফ্ল্যাশ সরিয়ে নিয়েছে৷ ইলেক্ট্রিসিটি হঠাৎ চলে এলো। তীব্র আলোয় চারপাশ ঝলমল করে ওঠলো। নিথি চরম লজ্জিত। দৃষ্টি নুইয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়। ভয় পেয়ে শেষে কি না রায়িনকে আঘাত করতে গেছিলো? কী লজ্জাজনক অবস্থা।
–“খেতে আসো।”

বলেই রায়িন চলে গেলো। রায়িন নিথির চোখের আড়াল হতেই নিথি নিজ মাথায় এক চা’প’ড় মেরে নিজেকে গালমন্দ করলো।

——————————-
রাত ন’টায় অন্তরা রহমান ফিরলেন মেয়ে রায়াকে নিয়ে। নিথি এসেছে শুনে তার তর সইছে না! বাড়ি ফিরেই রায়া নিথিকে জড়িয়ে ধরলো,
–“ওহ, ভাবী!! তুমি এসেছো? কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আনার কথা কী তোমার একদমই মনে পরেনি?”

নিথি উত্তরে শুধু হাসলো, মুখে কিছু বলার মতো উত্তর তার জানা নেই। নিথি ম্লান দৃষ্টিতে রায়িনের দিকে তাকালো। রায়িন তখন বেশ মনোযোগের সাথে রায়ার রিপোর্ট দেখছে। নিথি চোখ নামিয়ে রায়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে,
–“আগে ফ্রেশ হয়ে নাও৷ তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে খুব গল্প করবো!”

রায়ার নিথির প্রস্তাব পছন্দ হলো। খুশি মনে ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে রায়া নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। ততক্ষণে অন্তরা রহমানও ফিরলেন ফ্রেশ হয়ে। নিথির মাথায় হাত বুলিয়ে নিথিকে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। নিথি এতক্ষণে অন্তরা রহমানের অপর হাত খেয়াল না করলেও এখন দেখলো একটা রিং এর বক্স। নিথি চোখ বড়ো বড়ো সেটায় নজর বুলিয়ে দৃষ্টি নুইয়ে ফেললো। অন্তরা রহমান গলা খাঁকারি দিয়ে শুধালেন,
–“রায়িন, আব্বু। এই রিপোর্ট রাখো, একটা কাজ আছে!”

রায়িন মাথা তুলে অন্তরা রহমানের দিকে তাকালো।
–“বলো!”
–“বিয়ে যেভাবেই হোক, দেনমোহর না পরিশোধ করা অবধি তোমরা একই ঘরে থাকতে পারববে না। তাই আমার প্রশ্ন, তুমি নিথির দেনমোহর পরিশোধ করেছো?”
নিথি চমকে গেলো। সে ভেবেছিলো তার শ্বাশুড়ি আগের বারে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করবে, নানান উপদেশ দিবে। কিন্তু সেরকম কিছুই তো হলো না। নিথি তো এতক্ষণ এসব হজম করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তাহলে?
রায়িন নিশ্চুপ হয়ে কী যেন ভাবে। অতঃপর রিপোর্টে দৃষ্টি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
–“আমার কাছে আপাতত ক্যাশ নেই!”
–“তাহলে তুমি ঠিক আগামীকালের মধ্যে ওর দেনমোহর পরিশোধ করবে। পরিশোধ না করা অবধি তোমরা এক ঘরে থাকতে পারবে না!”
–“তাহলে তোমার কাছেই এই মেয়েকে রেখে দাও! আমার কী?”

মিনমিন করে বললো রায়িন। অন্তরা রহমান রায়িনের কিছুটা কাছাকাছি বসায় বেশ ভালো করেই শুনতে পেলেন। অন্তরা রহমান চোখ রাঙালে রায়িন নজর ঘুরিয়ে নেয়। নিথি পিটপিট করে তাকিয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখছে। যেন সে নিরব দর্শকের তালিকায় রয়েছে।

অন্তরা রহমান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রিং এর ছোট বক্সটি রায়িনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“এটা এখন নিথিকে পরিয়ে দিবে। ওর জন্যে আমি গয়না বানাতে দিয়েছি। আশা রাখছি শীঘ্রই পেয়ে যাবো। আমাদেরও তো ওর উপর দায়িত্ব আছে নাকি?”

রায়িন শীতল দৃষ্টিতে নিথিকে দেখে বিনা-বাক্যে বক্সটা হাতে নিয়ে নিলো। খুব আরাম করে রায়িন রিং টা বের করলো। রায়িনের রিং বের করার মুহূর্তে অদ্ভুত ভালো লাগায় নিথির সর্বাঙ্গে থেমে থেমে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো যেন। রায়িন উঠে এসে নিথির বাম হাত নিজের হাতে তুলে অনামিকা আঙুলে সেটা পরিয়ে দিলো।

——————–
গভীর রাত। রায়ার পাশে শুয়ে আছে নিথি। রায়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু নিথি নিদ্রাহীন, তার চোখে ঘুম ধরা দেয়নি এখনো। বেলকনির ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় পলকহীন তাকিয়ে রয় রিং টার দিকে। এখনো রিংটা হাতে চিকচিক করছে। নিথি নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় সেটাতেই। কেন যেন এটার মুগ্ধতা কমছে না। রায়িনের দেয়া প্রথম উপহার। অনুভূতিটা কেমন তা নাহয় অপ্রকাশিত থাক। নিথি এ পর্যন্ত কতবার আলহামদুলিল্লাহ পড়ে ফেলেছে তা অগণিত৷ প্রিয় মানুষটিকে নিজের করে পাওয়া, তার থেকে পাওয়া উপহার সবটাই নিথির কাছে এক অবাস্তব স্বপ্ন লাগছে। কেন এত সুন্দর রায়িন? তার এত সুন্দর তার কঠিনের মাঝে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব? মস্তিষ্ক উত্তর দিতে অক্ষম। বলা যায়, রায়িন মুগ্ধতার আরেক নাম। নিথি মিনমিন স্বরে গাইলো,
–“কোনো এক রূপকথার জগতে,
তুমি তো এসেছো আমার-ই হতে।”

রায়িনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এলো নিথির, জানা নেই। ঘুম ভাঙলো আলোর তীক্ষ্ণ কিরণের ঝলকানিতে। নিথি পিটপিট করে তাকালো। বেশ ঠান্ডা লাগছে তার। কোনো মতে উঠে বসতেই দেখলো তার গা থেকে ব্ল্যাঙ্কেটটা সরে ডান পাশে গিয়ে জড়ো হয়েছে। সবকিছু বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো নিথির। পাশ থেকে রায়ার দিকে তাকালো। রায়া এখনো ঘুম। নিথি চারপাশে নজর বুলিয়ে কোথাও দেয়াল ঘড়ি বা ছোট ঘড়িও পেলো না। ফোনটাও নেই যে সময় দেখবে। হাই তুলতে তুলতে বিছানা হতে পা নামিয়ে বসলো। হাত টানটান করে আড়মোড়া ভাঙলো। ফ্রেশ হওয়া জরুরি। নিথি উঠে দাঁড়াতেই তার মনে পরে লাগেজ তো রায়িনের ঘরে। সেটাতেই নিথির তাওয়াল এবং জামা-কাপড় আছে। কী করা যায়? নিথি কী যাবে রায়িনের ঘরে? হয়তো রায়িন ঘুমাচ্ছে।

নিথির এক তীব্র আকাঙ্খা হৃদয়ে জেঁকে বসলো। ঘুমন্ত রায়িনকে একপলক দেখার আকাঙ্খা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সে রায়িনের রুমে যাবে। রায়িনকে দেখাও হলো আবার ফ্রেশও হতে পারলো। নিথি আর দেরী করলো না। এলোমেলো চুল ঠিক করে মাথায় ওড়না টেনে বেরিয়ে পরলো রায়িনের রুমের উদ্দেশ্যে। রুমের কাছাকাছি আসতেই নিথি তার পা জোড়া ধীর গতিতে এগোতে লাগলো। পা টিপে টিপে ভেঁজানো দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। শব্দ ছাড়াই দরজাটা খুলে শুধু মাথা ঢুকালো এবং উঁকি দিয়ে বিছানায় নজর বুলালো। কিন্তু একি? রায়িন তো বিছানায় নেই! এবার নিথি মাথা সরিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়েও রায়িনকে কোথাও পেলো না। বেলকনিতেও নেই। পরমুহূর্তে নিথির খেয়াল যায় পরিপাটি, সাজানো বিছানার দিকে। আচ্ছা, রায়িন কী কোথাও বেরিয়েছে? হতেও পারে।

নিথির নিমিষেই মুখ ভার হয়ে গেলো। কোথায় ভাবলো ঘুমন্ত রায়িনকে দেখবে কিন্তু সাহেব তো রুমেই নেই। উদাসী মনে লাগেজ থেকে তাওয়াল এবং জামা-কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। ওয়াশরুমের দরজা লক করে পিছে ফিরতেই নিথি ভূত দেখার মতো চমকে গেলো। রায়িন তার থেকে কিছুটা দূরে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। রায়িনের চুলগুলো ভেঁজা, যা কপালে লেপ্টে আছে। নিশ্চয়ই সবে গোসল করেছে। তার চেয়েও ভয়ানক কান্ড হচ্ছে রায়িন উদোম শরীরে শুধু কোমড়ে একটি সাদা তাওয়াল পেঁচানো৷ রায়িনকে এ রূপে দেখে নিথির চোখ কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কোনো দিক না দেখে যেই চিৎকার দিতে যাবে ওমনি রায়িন ছুটে এসে নিথির মুখ চেপে ধরলো!
–“এই চুপ! নিজের সাথে আমারও ইজ্জতহরণ করবে নাকি? কথায় কথায় এত চিল্লাও কেন?”

নিথির এবার দম বেরিয়ে যাবে যাবে অবস্থা। রায়িনের সদ্য গোসল করা দেহের সঙ্গে সে লেপ্টে আছে! এ যে অবাস্তব, ভ্রম! এত বড়ো বিষ্ময়কর ঘটনা নিথি মানতে পারলো না। মানতে পারলো না তার ছোট্ট মস্তিষ্ক। ধীরে ধীরে বুজে এলো নিথির চোখ জোড়া। ঢলে পরলো রায়িনের বুকে। রায়িন বেসামাল ভাবে নিথিকে আঁকড়ে ধরলো। নিথিকে না ধরলে যেন পরেই যেত। এবার যেন রায়িন বিষ্ময় আকাশচুম্বী। নিথির জ্ঞানহীন মুখটার দিকে তাকিয়ে মিনমিন স্বরে আওড়ায়,
–“কী হলো ব্যাপারটা? এভাবে জ্ঞান হারালো কেন? আশ্চর্য! মানসিক রোগী নাকি এই মেয়ে? ওহ গড!”

—————————

~চলবে, ইনশাল্লাহ!
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১৯]
লাবিবা ওয়াহিদ

————————-
নিথির জ্ঞান ফিরতেই সে দ্রুত উঠে বসলো। বক্ষঃস্থলের তীব্র ওঠা-নামা শব্দ উপলব্ধি করছে সে। শক্ত হাতে ওড়নার একাংশ মুঠিবদ্ধ করে ফেললো। নিঃশ্বাসও কেমন ঘন হয়ে আসছে তার। নিথি পিটপিট করে আয়নার দিকে তাকাতেই দেখলো রায়িন টাই বাঁধছে। আয়নার নিথির প্রতিচ্ছবি খেয়াল হতেই রায়িন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“ফাইনালি আপনার জ্ঞান ফিরলো। আমি তো ভাবলাম বড় কিছু ঘটে গেছে৷ আর জ্ঞান হারানোর লজিক পরে এসে শুনবো, এখন অফিস আছে!”

বলেই রায়িন বেরিয়ে গেলো। আর নিথি সেখানেই হ্যাবলার মতো বসে রয়। তার চোখে এখনও রায়িনের ওই রূপটা দৃশ্যমান। সদ্য ঘুম থেকে উঠে ওরকম একটা অবস্থা নিথির মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করেছে৷ লজ্জা, জড়তা, আতঙ্ক সব একসাথে আসায় নিথি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এখন নির্ঘাত এই জ্ঞান হারানো নিয়ে রায়িন মজা লুফবে। নিথি চোখ-মুখ কুচকে মুখ দিয়ে ফোঁস করে শব্দ করলো। যেন নিজের প্রতি ভিষণ বিরক্ত। এর মাঝে অন্তরা রহমান আসলেন। নিথি চমকে গেলো বেশ। অন্তরা রহমান ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে চিন্তিত স্বরে বলে,
–“তুমি নাকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে?”

গেলো! সব গেলো! নিথির গালজোড়া লাল হয়ে উঠলো জড়তায়। কী দরকার ছিলো রায়িনের এসব বলার? নিথি লাজুক হয়ে আমতা আমতা করে বললো,
–“জ্ঞান হারাইনি, হ..হঠাৎ মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠেছিলো আর কী!”
–“ও আচ্ছা। শুনো, ফ্রেশ হয়ে একটা সুন্দর শাড়ি পরিও। তোমার শ্বশুর এবং ফুপি শ্বাশুড়ি নিচে অবস্থান করছে!”
নিথি জড়তার সাথে শুধালো, “জ্বী!”

—————————–
রায়িনকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে আঁচলের অংশ কাঁধ দিয়ে টেনে নিলেন জবেদা রহমান। চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা। বয়সের ছাপ মুখশ্রীতে দৃশ্যমান৷ রায়িনের বাবা আরমান সাহেব ছেলের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টিতে স্পষ্ট ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। রায়িন নামতেই তার ফুপিকে দেখতে পেলো। প্রথমে কী করবে তা উপলব্ধি করতে না পেরে সালাম জানালো। পাপাকে দেখতে পেয়ে ইচ্ছে করলো ফুপির পাশ কেটে চলে যেতে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয় ফুপির অনুতাপসূচক চাহনি দেখে। জবেদা রহমান ভাঙ্গা গলায় সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
–“দু’মিনিট সময় হবে এই অক্ষম মহিলার সাথে কথা বলার!”

রায়িনের যেন তীরের মতো কথাগুলো বললো। জবেদা রহমানের কন্ঠে স্পষ্ট বেদনা প্রকাশ পাচ্ছে। রায়িন নরম হলো। কন্ঠস্বর যথাসম্ভব শীতল করে বলে,
–“এভাবে বলে লজ্জা দিচ্ছো কেন ফুপি? আমি তোমার অপরিচিত কেউ নই!”
–“পূর্বে যা ভুল করেছি তাতে তোর থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্যে কাঁতরাচ্ছি রে বাবা! বারবার মনে হয় তোকে ভুল পথে ঠেলে দিয়েছি!”

রায়িন ঘাড় ডানে বামে কাত করে ব্যায়াম করলো। অতঃপর জবেদা রহমানের দিকে দুই ধাপ এগিয়ে বলে,
–“তুমি কোনো ভুল করোনি আর না আমি ভুল পথে হেঁটেছি। বরং তুমি আমার বাস্তবতা শিখিয়েছো। নয়তো আমি তো জানতামই না, সৌখিনতা ব্যতীত আলাদা একটা জীবন আছে। ভাগ্যিস জেদ ধরেছিলাম, নয়তো এই জীবনের আসল মূল্যটা বুঝতাম না।”

শেষোক্ত বাক্যটি বলে রায়িন চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দু’জনের কথার মাঝে বাম হাত ঢোকায় আরমান সাহেব।
–“কী*সব ন’স্টালজিক নিয়ে কথা বলছো তোমরা? আর আপা, আপনি কবে এসব আধুনিকতা ছাড়লেন? কিসব ভুল শিক্ষা দিয়েছেন যার জন্যে আমার ছেলে থার্ডক্লাস টিউশনি আর এক সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললো?”

জবেদা রহমান হাসলো।
–“তুই আর মানুষ হলি না রে আরমান। সেই যন্ত্র-ই থেকে গেলি। ছোট জিনিসের সুখ যে কতটা অমূল্য, সেটা তোর যান্ত্রিক মন বুঝলো না। আমি খুশি, যে আমার ভাইয়ের ছেলে কোনো যন্ত্রে পরিণত হয়নি৷ ভাগ্যিস সেদিন দু’চারটা কথা শুনিয়েছিলাম। আমার উচিত ছিলো এসব তোকেও শোনানো। তোকে শোনালে অন্তত কোনো যন্ত্রতে পরিণত হতি না!”

আরমান সাহেব যেন ধপ করে জ্বলে ওঠে। তিনি বসা ছেড়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
–“বেশি বলে ফেলছো তুমি আপা! ও ভুল করেছে আর তুমি তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছো? সাধারণ ঘরের মেয়ে কিনা এই সম্রাজ্যের রাণী হবে? তুমি আমাকে এই কঠিন বিষয়টি হজম করতে বলছো?”
–“খবরদার পাপা, মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো অপরাধ করবে না!”
আরমান সাহেব তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
–“এদের মতো মেয়েকে আমার টাকা বিশ বা তার অধিক বার কিনতে পারি। কেন? আমার দেখা মেয়ে কী খারাপ ছিলো? যথেষ্ট মর্ডান এবং উচ্চশিক্ষিত!”
–“আমি ওকে ভালোবাসি তাই বিয়ে করেছি। আর ভালোবাসার কাছে তোমার থার্ডক্লাস রূপ, উচ্চশিক্ষা মূল্যহীন। ভালোবাসার মানে তুমি কী বুঝবে? তুমি তো বুঝো শুধু টাকা আর স্ট্যাটাস!”

রায়িন বাসাতেই আর থাকলো না। রেগে-মেগে নাস্তা না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। ওদিকে নিথি সিঁড়িতে ঠায় দাঁড়িয়ে। চোখে-মুখে একরাশ বিষ্ময়। রায়িনের বলা বক্তব্য গুলো এখনো তার কানে পিয়ানোর মতোন বাজছে। সে কী ভুল শুনলো?

————————-
রায়িনের ফোনে একটার পর একটা কল আসছে। ফোনের স্ক্রিনে “মা” নিকনেমটি ভেসে উঠছে। একসময় রায়িন অতীষ্ঠ হয়ে কল রিসিভ করলো।
–“মা, প্লিজ বাবার টপিকে…”
রায়িন পুরো বাক্য শেষ করার পূর্বেই অপরপাশ থেকে নরম স্বরে কেউ বলে ওঠে,
–“আমি মা নই, নিথি৷”
রায়িন শান্ত হলো।
–“তোমার ফোন কই? এই ফোন দিয়ে কল দিকে যে?”

নিথি ইতস্ততায় জমে গেলো। আঁচলের ছোট পুঁতি খোঁচাতে খোঁচাতে আমতা আমতা করে বললো,
–“আসলে আমার ফোনটা বিয়ের দিন ভেঙ্গে গিয়েছে। তাই…”
–“কল কেন দিয়েছো?”
–“আপনি খাননি?”
–“ইচ্ছে নেই!”
–“আপনার মা যে বললো, আমি নাস্তা সময়মতো না খেলে অসুস্থ হয়ে পরেন?”
–“ওরকম কিছুই না!”
–“আন্টি চিন্তায় আছে, প্লিজ খেয়ে নিন।”
–“তোমায় মাথা ঘামাতে বলেছি?”

রায়িনের রাগাম্বিত কন্ঠে নিথি চুপসে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
–“আমি নাস্তা করিনি!”
–“কেন?”
–“আপনি খাননি, তাই!”

রায়িন যেন হঠাৎ বরফের ন্যায় গলে গেলো। এক অদ্ভুত শীতলতা খেলে গেল তার মস্তিষ্কে। এই বাক্যটিতে অদ্ভুত মায়া, ভালোবাসা, আকাঙ্খা মিশে আছে। এই যুগে কয়টা মেয়ে এতটা স্নিগ্ধ হতে পারে? সেখানে নিথির রায়িনের প্রতি চিন্তা, ভালোবাসা সম্পূর্ণ পবিত্র। রায়িন যদি নিথির দিকে আরেকটু মনোযোগ দিতো, তাহলে নিথিকে বুঝতে পারতো। রায়িনের চট করে মনে পরে গেলো নিথির চিঠিতে বলা “ভালোবাসি” শব্দটি! একই সাথে মনে পরলো রায়িনকে অসুন্দর, নিরামিষ বলা কথাগুলো।
–“হ্যালো? শুনতে পাচ্ছেন?”

রায়িন গলা খাঁকারি দিলো। অতঃপর মৃদ্যু স্বরে বলে,
–“ব্রেকফাস্ট অর্ডার করছি!”

বলেই রায়িন কল কেটে দিলো। নিথির আনন্দ হলো, খুব। একসময় তো এরকম এক সংসারের স্বপ্ন বুনেছে সে! সবটা এত সুন্দর ভাবে তার জীবনকে ধন্য করবে কে জানতো? নিথি মিষ্টি হেসে রায়ার রুমে চলে গেলো রায়াকে ঘুম থেকে ওঠাতে। অতঃপর দু’জন মিলেই ব্রেকফাস্ট করবে!

———————-
–“আপনি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন?”

রায়িন চমকে নিথির দিকে তাকালো। নিথি তখন তার দেয়া দেনমোহর এবং উপহারস্বরূপ নতুন ফোনটায় নজর বুলাচ্ছে। কন্ঠস্বরও যেন শোনালো ভাবলেশহীন! রায়িন হাতার বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
–“সকালের কথা শুনে নিয়েছো বুঝি? ফাইন, ব্যাপার না!”

বলেই রায়িন নিথির দু’পাশে হাত রেখে নিথির দিকে ঝুঁকে পরলো। নিথি চমকালো, ভড়কালো। বিষ্ময়ে সে মাথা পেছনের দিকে সরিয়ে ফেলেছে। রায়িনের অপ্রস্তুত কান্ড নিথির এক্সেপ্টেশনের বাহিরে ছিলো। বড়ো বড়ো চোখের রায়িনের রহস্যময় চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে। মস্তিষ্ক মুহূর্তে-ই শূন্য হয়ে গেলো! যেন, উপস্থিত হতবুদ্ধি লোপ পেলো। রায়িন নিথির বিষ্ময়ে ভরা চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
–“এক অসুন্দর, আনরোমান্টিক ছেলের কাছে ভালোবাসা কীভাবে এক্সেপ্ট করো তুমি?”

রায়িন সরে এলো। নিথি তখনো পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে বসে রইলো। কী করবে, কী করছে কিছুই তার মস্তিষ্কে ধরছে না। শ্বাস যেন গলাতেই আটকে আছে। রায়িন নিথির অবস্থা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে টি-শার্ট, টাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে ফিরে দেখে নিথি রুমে নেই। অন্তরা রহমান ডিনারের জন্যে ডেকে পাঠালে কপালে পরে থাকা চুলগুলো হাতের সাহায্যে পেছনের দিকে নিয়ে রায়িন রুম থেকে বেরিয়ে পরে। রায়ার রুম অতিক্রম করতেই অট্টহাসির শব্দ পেলো। দরজা ছিলো সম্পূর্ণ খোলা, তাই রায়িনের নজর সরাসরি রুমে প্রবেশ করে। রায়া এবং নিথি বালিশ দিয়ে খেলছে। এই অসাধারণ দৃশ্যটি দেখে রায়িনের অভ্যন্তরে প্রশান্তি অনুভব হলো। ফিচেল হেসে রায়াকে উচ্চস্বরে বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়,
–“রায়া, দ্রুত খেতে আয়। তোর সাথে তোর পার্টনার্রকেও নিয়ে আসিস!”

পার্টনার কথাটি শুনে রায়া নিথিকে খোঁচালো!
–“ভাবী, ভাইয়া মেবি বলতে ভুল করেছে! যে তুমি আমার পার্টনার নও, ভাইয়ার!”

মুহূর্তে-ই নিথির মস্তিষ্কে কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা তরঙ্গিত হলো। নিথি এবার লাল হয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো,
–“খেতে ডাকছে। চলো!”

ডাইনিং বিচরণ করছে কঠোর নিরবতা। আরমান সাহেব চেয়েও নিথির উদ্দেশ্যে কিছু বলতে পারছে না। সামনে যে তার বড়ো আপা বসে আছে। সে থাকতে কী করে নিথিকে কথা শুনাবে? জবেদা রহমান তো সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, সে থাকতে নিথিকে যদি কোনোরকম কথা শোনায় তাহলে ছেলের বউয়ের সামনে আরমান সাহেবকে লজ্জিত করতে ভুলবে না। তাইতো আরমান সাহেব মান-সম্মান বাঁচানোর খাতিরে দমে আছেন। নয়তো নিথিকে সে একদমই সহ্য করতেন না। রায়িন তার পাপাকে দেখিয়ে খাবার টেবিলে নিথির খুব খাতির-যত্ন করলো। নিজে থেকে নিথির পাতে এটা ওটা তুলে দিয়েছে। রায়িনের কান্ডে অন্তরা রহমান, রায়া এবং জবেদা রহমান মিটমিটিয়ে হেসেছে। শুধু মুখে হাসি নেই আরমান সাহেবের। আজ হাসি তার সাথে কঠিন বেঈমানী করেছে যে!

নিথি সংকোচে পরে গেলো রায়িনের পাশে শোয়া নিয়ে। রায়িন তো বেশ আরামেই নিজ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ফোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিথির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“শুবে নাকি বেলকনিতে বিছানা পেতে দিবো?”

নিথি চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
–“বেলকনিতে কেন শুবো?”
–“তোমার হাবভাবে তো তেমনই মনে হচ্ছে। ভাব ধরছো এমন যেন আমি পরপুরুষ! আমার পাশে শুলে তোমার গায়ে ফো’স্কা পরবে!”

নিথির এবার যেন মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছা হলো। এভাবে বলে নাকি কেউ? প্রথম প্রথম শুতে বুঝি লজ্জা লাগে না!
–“এখনো সটান মেরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? শুবে নাকি তোমায় টেনে-হিঁচড়ে বিছানায় ফেলবো? যতটা নিরামিষ ভাবো আমি ততোটাও নিরামিষ নই!”

এবার নিথি দাঁড়ানোর সাহস পেলো না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রায়িনের পাশে গিয়ে শুলো। তবে বিছানার একদম কর্ণারে। রায়িন ল্যাম্প অফ করে নিথিকে হেঁচকা টানে মাঝামাঝিতে আনলো।
–“বিছানায় এত জায়গা থাকতে ওই কোণায় গেছো কী করতে? আমি তো জানি-ই তোমার ঘুমের স্টাইল ভালো না। বলা যায় না যে কোনো পরে নাক, কোমড় ফাটাতে পারো!”

নিথি চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
–“আপনি কী করে জানলেন?”
–“এর মানে আমার গেস সত্যি ছিলো?”

নিথি তার অবুঝের প্রশ্নে ভীষণরকম লজ্জিত হলো। আজ কী তার লজ্জা পাওয়ার দিন? এই গম্ভীর মানুষটা কেন তাকে পদে পদে লজ্জায় ফেলছে? বিয়ের আগের সব আজেবাজে ঘটনার প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি? কে জানে!

রায়িন নিথির থেকে দূরত্ব রেখেই শুয়েছে। এতেও নিথির অস্বস্তির শেষ নেই। নিথির ঘনঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করার অস্ফুট শব্দ নিস্তব্ধ রুমটায় শ্রবণ হচ্ছে। নিথি হলফ করে বলতে পারবে, আজ আর তার চোখে ঘুম ধরা দিবে না। অনেকসময় পর রায়িন কপালে হাত রেখে চোখ বুজে বলে ওঠে,
–“পাপা আমাকে আরেক জায়গায় বিয়ে দেয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছিলো, ইভেন তোমাকে নিয়েও পাপা অকারণে অসন্তুষ্ট। সে একদমই অবগত নয় বিয়ের ঘটনার ব্যাপারে। ওসব পাপার কানে গেলে কঠিন ঝড় উঠবে। ডিভোর্সের জন্যেই জোরাজোরি করবে যা আমার অপছন্দ। তাই সবটা মাটি চাপা দিতেই আমি সেই ভালোবাসার মিথ্যেটা বলেছি। যদিও এটা বড় অন্যায় তবে আমি ছিলাম উপায়হীন। এছাড়া পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতোন অন্য কোনো পথ খুঁজে পাইনি। আমার সময়ের প্রয়োজন। আর যাই হোক না কেন, আমার বিবাহিতা স্ত্রীর পবিত্র ভালোবাসার মর্যাদা আমি দিবো, সবসময়। তুমি এখন আমার হেফাজতে আছো, তোমার ভালো-মন্দ দেখা আমার দায়িত্ব!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।