কৃষ্ণডাহুক পর্ব-২৭+২৮

0
318

#কৃষ্ণডাহুক – ২৭
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো মীরা। এবার নিজের বিয়েতে চমক ছিলো অনাথ আশ্রমের সকলে। তাদের দেখে মীরা আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলো। চিরচেনা এই মুখ বছর দুয়েক আগেই ছেড়ে চলে এসেছিলো। এই প্রথম দেখলো তাদের আবার। নজর গেলো অনাথ আশ্রম দেখে রাখা মানুষদের উপর। সবাই আছে, শুধু একজন বাদে! তিনি হলেন আতিফা! যার হাত ধরে মীরার চলা, যার হাতে খাওয়া, যাকে মা-বাবা দুজনই মেনে আসা, তিনিই হলেন আতিফা। মীরার বিয়ের মাসেক পর অসুস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর খবর কানে পৌঁছালেও মানুষটার লাশ দেখতে অনাথ আশ্রমে ছুটে যেতে পারেনি, সংসারের বেড়াজাল!

‘ ইয়ামিন ভাই কই, মীরাপু? ‘

মীরা এই কথায় চমকালো, থমকালো। আদ্রিক পাশেই ছিলো এই কথায় আড়চোখে তাকালো শুধু আদ্রিকই না পরিবারের সবাই-ই পাশে ছিলো। এই কথায় তাদের সবার দৃষ্টিই মীরার দিকে। অনাথ আশ্রমের দেখভাল করা লোকটি তখন মেয়েটিকে ধমকে বলল,’ ইয়ামিন কে? বেশি কথা বলিস তুই! ‘

মীরার গলা ধরে আসতে লাগলো, আদ্রিক নিজের শক্তপক্ত হাত দিয়ে মীরার হাত চেপে ধরলো। মেয়েটি জবাবে বলল,’ আংকেল, ইয়ামিন ভাইয়ের সাথে বিয়ের সময় তো আপনিও আছিলাম তো এখন কেন বলছেন চেনেন না? ‘

লোকটি বিপাকে পড়লো। মেয়েটি এবার মীরার অপর হাত ধরে বলল,’ মীরা আপু, ইয়ামিন ভাই খুব ভালো আসিলো, কত আদর করতো আমাদের। উনি কই? উনি কি ভালো নেই? ‘

মীরা জবাব দিলো না। কয়েকজোড়া স্তম্ভিত চোখ তখন তাকেই ঘুরছিলো। লোকটি মেয়েটিকে টেনে সরিয়ে মীরার কাছে এসে বলল,’ কিছু মনে করিস না মীরামা, ও একটু ওমনই,কার না কার সাথে তোকে গুলিয়ে ফেলেছে। ‘

মিথ্যা বললেন লোকটি। মীরা হেসে বলল,’ আমার বিয়েতে এসেছেন অনেক খুশি হয়েছি, কিন্তু আংকেল ওর মুখ বন্ধ করালেই কি সত্য কখনো আড়াল হবে? উহু! ‘

‘ মীরা, কি বলছো তুমি? আগেও তোমার বিয়ে হয়েছিলো? ‘
পরিবারের সবার বিস্মিত কণ্ঠস্বর!

_

নববধূ মীরা আর আদ্রিক সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মীরার মুখে হাসির নির্লিপ্ত রেশ, আদ্রিক সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই মার্জিয়া আর আদিল সহ পরিবারের সবাই। তাদের পাশেই আদ্রিকা ভীতু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যদিও সে এসবের কিছুই জানতো না কিন্তু তারপরও ভয় লাগছে! ভাইয়ের নতুন সংসারটা না জানি ভেঙ্গে যায়!

আদিল বললেন,’ মীরা তোমার আগে বিয়ে হয়েছিলো?’

‘ জ্বী। ‘

মার্জিয়ার রেগে গেলেন, বললেন,’ তো আমার ছেলেকে ফাঁসালে কেনো মীরা? তোমার জন্য আমার হাসিখুশি পরিবার ভেঙ্গে গেছে। ‘

মীরা জবাব দিলো না, আদিল বললেন,’ ডিভোর্স দিয়েছো? ‘

‘ হ্যাঁ দিয়েছি। ‘

‘ তোমার উদ্দেশ্যই ছিলো বড়লোকের গলায় ঝুলে পড়া তাইনা? চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার! ‘

আদিল ক্ষোভে কাঁপছেন। মীরা মুখ বুজে সহ্য করে নিতে পারলো না,বলল,’ ডিভোর্সি হলেই আমি চরিত্রহীন?আচ্ছা আমি চরিত্রহীন কিন্তু আমি তো আপনাদের ছেলেকে ফাঁসাই নি! উলটো আপনাদের কথা ভেবেই এতোদিন প্রত্যাখ্যান করেছি! ‘

‘ তো বিয়ে করেছো কেনো? ‘ মার্জিয়া বললেন

জবাব না দিয়ে মীরা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। সাহিল বললেন,’ এই ব্যাপার নিয়ে এখন কথা বলার দরকার নেই, তোমরা নিজেদের ঘরে যাও। ‘

‘ না ভাইয়া, আমি এদের আর এক মূহুর্তেও এখানে সহ্য করতে পারছি না! আদ্রিক মীরাকে ডিভোর্স দিবে! মীরা আদ্রিককে ঠকিয়ে বিয়েটা করেছে। ‘

‘ মীরা আমাকে ঠকায়নি, বাবা, আমি সব জানতাম! আমি মেনে নিয়েছি, তোমাদের আপত্তি করার মানে নেই। ‘

ছেলের কথায় আদিল স্তব্ধ! মার্জিয়ার অবস্থাও তা। মার্জিয়া আদ্রিকের কাছে এসে বললেন,’ এই মূহুর্তে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি আদ্রিক! আমি এক মূহুর্তের জন্যও তোকে সহ্য করতে পারবো না এই বাসায়। ‘

আদ্রিক মুচকি হেসে বলল,’ চলে যাবো মা, সেদিনই ফিরবো যেদিন তোমরা নিজে আসতে বলবে। ‘

বলেই নববধূর হাত শক্ত করে চেপে ধরলো আদ্রিক। মীরা আদ্রিকের দিকে তাকালো। সে চাহনিতে আদ্রিক ভালোবাসা, বিশ্বাস ব্যতীত কোনো কিছুর ছাপ দেখতে পেলো না!

#চলবে?

#কৃষ্ণডাহুক – ২৮
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

জনবহুল এয়ারপোর্টে শত লোকের আনাগোনা, কেউ এসেছে সন্তানকে নিতে, কেউ এসেছে স্বামীকে নিতে আবার কেউ এসেছে নিজের জন্মদাতা পিতাকে নিতে! শত মানুষের ভিড়ে একটুখানি এগিয়ে যাওয়ার আশায় দুটি নির্লিপ্ত হৃদয় হাঁটছে। এক বছর বাদের কাহিনি, বিদেশ ছেড়ে পুনরায় দেশের মাটিতে পা রেখেছে দুজনে! দেশ ছাড়বার সময় রেখে গিয়েছিলো হাজারো অতীত, এক টুকরো বিষাদ! নিয়ে গিয়েছিলো শুধুই ভালোবাসা, বিশ্বাস, একটুখানি আত্মসম্মান! ফিরেছেও তাই নিয়ে। মীরা আদ্রিকের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো, ছলছল করে উঠলো তার দৃষ্টি। এক বছরে তার জীবনের উন্নতি হয়েছে কেবল আদ্রিকের জন্যই। মানুষটা না থাকলে উন্নতির চেয়ে অবনতিই হতো! এক বছরে আদ্রিক কি না করেছে তার জন্য? প্রতিটা ক্ষণ পাশে ছিলো, পড়ালেখার দিক থেকে মীরা সবসময়ই নাজুক, তাতেও পাশে পেয়েছে আদ্রিককে। রান্নাবান্নায় বেশ পটু সে কিন্তু আদ্রিক তাকে ছুঁতে দেয়নি, প্রতিদিন হরেক রকমের খাবার খাইয়েছে! মানুষটা তার কথা রেখেছে! ইয়ামিনের জায়গা সে নেয়নি! বরং নিজের জন্য আলাদা জায়গা তৈরি করেছে যে জায়গায় নেই ইয়ামিনের মতো বিষাদের ছায়া! নিজের সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছে মানুষটা, মীরাকে সুখ দিতে যেয়ে! কিন্তু মীরা? সে তো কিছুই করেনি, কখনো ভালোবাসিও বলেনি অথচ মানুষটা প্রতিক্ষণ ভালোবাসি বলে দিচ্ছে নিজের কাজকর্ম দ্বারা! মীরার আফসোস হয় এমন মানুষটা সে কেনো ইয়ামিনের আগে পেলো না? ইয়ামিনের আগে পেলে খুব একটা ক্ষতি হতো না বরঞ্চ প্রাপ্য সম্মানে শ্বশুড়বাড়ি থাকতে পারতো, কপালে এই ‘ডিভোর্সি’ ট্যাগটা নিয়ে বাড়ি ছাড়া লাগতো না!

আবারো একই রকম বাড়িটি দেখেছিলো বছর দেড়েক আগে। সেই আগের ‘হুমায়ূন মঞ্জিল’ বেশ পরিচিত তার। পার্থক্য তখন অজানা, অচিন মানবী ছিলো এখন এই বাড়ির বড় ছেলের বউ! এই মঞ্জিলের বড় বউ! সেটা শুধু নামেই অবশ্য! কেউ তাকে মেনে নেয়নি! মাথা উঁচু করার স্পর্ধাও নেই তার। মীরা তপ্ত শ্বাস ফেললো। গাড়ি থেকে নামলো, এক বছরে তার উন্নতি হয়েছে, হ্যাংলা পাতলা শরীর থেকে হালকা মোটা তাজায় রূপান্তরিত হয়েছে, গায়ের রং উজ্জ্বল হয়েছে এতেই বুঝা যায় কতোটা যত্নে, আরামে কেটেছে তার জীবন এই এক বছরে। কিন্তু তার কি এসব চাই? শুধুই তো চাই একটা পরিবার, মা-বাবা, স্বামীর ভালোবাসা। স্বামীর অসীম ভালোবাসা পেলেও, পরিবার আর মা-বাবার ভালোবাসা না পাওয়ার আফসোস মীরার।

ধ্যান ভাঙলো তখন,যখন আদ্রিক মীরার কাঁধে হাত রাখলো। গম্ভির দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মীরা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দরজার সামনে দাঁড়ালো। বিয়ের সাজে সজ্জিত বাড়ি, হবেই না কেনো? অনন্ত হুমায়ূনের আদরের যে অন্তির বিয়ে আজ! যে কিনা গত চারবছর ধরে বিদেশ ছিলো, কয়েকমাস আগেই হয়তো দেশে ফিরেছে, তার বিয়ে, সেই উপলক্ষ্যেই এই দেশে তাদের আসা! অনন্ত হুমায়ূন খুব কান্নাকাটি করে আনিয়েছেন নয়তো আদ্রিক কখনো আসতোই না। কঠিন মন তার গলে তখনই গিয়েছে যখন অনন্ত হুমায়ূন বলল,’ মার্জিয়া ভাবী, মৃত্যুর পথ যাত্রী আদ্রিক, তার অবস্থা এতোই খারাপ যে কোনো নিদ্রায় সে আমাদের ছেড়ে দিবে, তুই আস! অভিমান, আত্মসম্মান নিয়ে থাকিস না, মা ম রে গেলে পাবি না আর তখন বুকে হাহাকার নিয়ে বাঁচতে হবে, পারবি তো? ‘

তখন আদ্রিক জবাবে বলতে পারেনি,’ এই মা-বাবা আজীবন নিজের সম্মান ভেবে গিয়েছে কিন্তু কখনোই বুঝেনি নিজের সন্তানদের মন, ইচ্ছা! আমি কখনোই অভিমান করে বের হতাম না যদি সেদিন আমার ইচ্ছাকে না হ ত্যা করা হতো, আমার সামনেই আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে চরিত্রহীন উপাধি দেওয়া না হতো। তাকে দেওয়া প্রত্যেকটা আঘাত, তীরের মতো আমার বুকে বিঁধেছে তবুও টু শব্দ করিনি, মা-বাবা তো! এমন কিছু বলতে চাইনি যাতে আঘাত পেয়ে সন্তানের নতুন সংসারে অভি শাপ দেয়! তাই কোনোরকম শব্দ না করেই বেরিয়ে গিয়েছি! না বেরুই কিভাবে? যে বাড়িতে আমার স্ত্রীকে সম্মান দেওয়া হবে না সে বাড়িতে আমাকে সম্মান দেওয়া হবে না কারণ আমার স্ত্রী আমার অর্ধাঙ্গিনী! তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মানে আমাকেই করা। ‘

এই কথাগুলো বলতে যেনো গলা ধরে আসবে আদ্রিকের, মুখ খুলতে পারেনি, স্তব্ধ হাতে কেটে দেয় ফোন। দুদিন ধরে ভাবে, ঠিক করে বাংলাদেশ ফিরবে আবার। ব্যস; কোনোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে রওনা দেয় বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে! যে দেশ ছেড়েছিলো অপমান, আত্মসম্মানে আঘাত লাগার কারণে!

মীরা আর আদ্রিককে দেখে সবার মুখই হাসিতে রূপান্তরিত হলো। সাহিল বাদে, তার মুখ বরাবরই গম্ভির! অনন্ত হুমায়ূন বিয়ের সব কাজকর্ম রেখেই দৌড়ে এলেন, আদ্রিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন,’ আমাদের আদ্রিক ফিরেছে বাড়ি! সবাই দেখে যা! ‘

সবাই এলো দেখা করতে, শেষে সাহিল এলেন,বললেন,’ ভালো আছো তোমরা? ‘

জবাব দিলো মীরা,’ হ্যাঁ, আপনি কেমন আছেন, বাবা? ‘

মীরার মুখে বাবা ডাক শুনে থতমত খেলেন সাহিল, চকিত নয়নে তাকালেন ওর দিকে। মীরার হাস্যজ্বল মুখশ্রী, বুকে প্রশান্তি বয়ে গেলো সাহিলের, তবু মুখে দাম্ভিক ভাব রাখলেন, জবাবে বললেন,’ ভালো আছি, রেস্ট নাও ঘরে যেয়ে। ‘

সম্মতি প্রদান করে আদ্রিক ও মীরা আদ্রিকের ঘরে গেলো। ছিমছাম, পরিপাটি ঘর আদ্রিকের। মার্জিয়াই হয়তো পরিষ্কার করতেন আদ্রিকের ঘর। সন্তান তো! মুখে যতই বলুক বের হয়ে যা মন থেকে কখনোই বের করতে পারেনা।

_

‘ বাবা, এসেছিস তুই? আদ্রিক বাবা আমার। ‘

মার্জিয়ার নিভু নিভু কণ্ঠস্বর! আদ্রিকের অন্তঃকরণ কেঁপে উঠবো। মার্জিয়ার কণ্ঠস্বর আগের মতো মধু নেই, ভেঙ্গে গিয়েছে তবুও মার কণ্ঠস্বর আজীবন মধুরই থাকবে সন্তানের কাছে। আদ্রিক বলল,’ হ্যাঁ আমি। ‘

মার্জিয়া আচমকা ফুঁপিয়ে উঠলেন আদ্রিকের হাতজোড়া আঁকড়ে বলে উঠেন,’ আমি ম রে যাচ্ছি বাবা, আমার অবস্থা খারাপ, খুব বেশিদিন বাঁচবো না, তুই থাকবি তো মার কাছে? ‘

‘ থাকবো। ‘ সোজাসাপ্টা জবাব দিলো আদ্রিক। এক দম নিয়ে বলল,’ বাবা কোথায়? ‘

‘ মানুষটা কোথায় আছে কে জানে! তুই যাওয়ার পর সেও কেমন যেনো হয়ে গেলো, চুপচাপ থাকতো, কথায় কথায় রাগতো, আগের মতো হাসিখুশি নেই। তুই আমাদের একমাত্র ছেলে! তোর খোঁজখবর নেই চিন্তা হবেই! আদ্রিকা আমাদের অনেক খেয়াল রাখতো! মেয়েটা এখন বড্ড সুখে আছে রে! আমাদের পছন্দের পাত্র বিয়ে করলে হয়তো সুখী থাকতো না ও! ঠিকই বলেছিস আমরা কেউ তোদের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেইনি! আমাদের সম্মানটাই আসল! এই দেখ সম্মান বাঁচাতে তোদের হারাতে বসেছিলাম। ‘

বলেই থামলেন মার্জিয়া। একনাগারে এতো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি, মীরা পানি দিলো তাকে। পানি খেয়ে মার্জিয়া বললেন,’ অরিন মেয়েটা ভালো নেই জানিস? অরিনের….’

#চলবে?