খেরোখাতার ছেঁড়াপাতা পর্ব-৩+৪

0
118

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা — ৩

কে কে ওইহানে? কতা কয় না ক্যান?
সচকিত হয় তমিজ সর্দার..

ভুট্টা খেতের ঝোপের পাশে কিছু একটার নাড়াচাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে টর্চ লাইটের আলো ফেলতেই দেখা যায় বকুল গলায় দড়িবাঁধা একটা কলস বুকে চেপে ধরে থরথর করে কাঁপছে, আর বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে, দুচোখে তার অশ্রুর বন্যা।

দুহাত তুলে বকুল করজোড়ে মিনতি করে উঠে
— চাচা আমারে ছাইড়া দেন? আপনার পায়ে পড়ি, আল্লার দোহাই লাগে।
মেয়েটার এই অবস্থা দেখে তমিজের মন নরম হয়ে কেঁদে উঠে, মুখ ফুটে বলে উঠে
— মা’রে তুই ভয় পাইস না, আমি তোর কোন ক্ষতি করুম না, জীবনে অনেক পাপ করছি? কিন্ত তোর ক্ষতি করতে আমার মন সায় দেয় না। আমার নিজেরও যে তোর লাহান একটা ঢাঙর মাইয়া আছে রে মা। তুই এক কাজ কর মা এহান থেকে পলাইয়া যা, গ্রামে থাকলে তোরে আমি বাঁচাইতে পারুম না এই রাক্ষসের হাত থেইকা।
— চাচা আমি তো এখন গাঙে ঝাপ দিয়া মরতে আইছিলাম।
— নারে মা এমন কাম করিস না, মরলে তো সব শেষ, বাঁইচা থাকলে একদিন প্রতিশোধ নিতে পারবি?
— কিন্ত আমি কই যামু চাচা? আমার তো যাওয়ার জায়গা নাই?
— আমি তোরে একটা ঠিকানা দিতাছি এইডা লইয়া তুই ঢাকা ধানমন্ডি চইলা যা। ওইখানে আমার এক দুরসম্পর্কের বইন থাকে হ্যারে আমি বইলা দিমু, তুই অনেক ভালো থাকবি। (বলেই পকেট থেকে বাজারের ফর্দ লেখার কাগজ কলম বের করে ঠিকানা লিখে দেয়, সাথে কয়েক হাজার টাকা)
— কিন্তু চাচা আমিতো জীবনেও কুনুদিন ঢাকা যাই নাই, আমিতো পথঘাট কিছুই চিনি না।
— তুই স্টেশনে যাইয়া কাউরে জিগাইয়া ঢাকার ট্রেনে উইঠা যা, ট্রেন যেইখানে একেবারে থাইমা যাইবো ওইটাই কমলাপুর তুই ওইখানেই নামিস। তারপর পথের মাইনষেরে জিগাইয়া জিগাইয়া যাইস আর মা মনে রাখবি নিয়তি তোরে পথে নামাইছে, সে ই তোরে গন্তব্যে পৌঁছাইবো। আইজ থেইক্কা তোর নতুন জীবনের পরীক্ষা শুরু।
— চাচা!
— এই ল ঠিকানা।
(পকেটে হাতড়ে দেখে মাসের বেতনের টাকাটা আছে।)
ল আর কিছু টাকা রাস্তাঘাটে বিপদে তোর কাজে লাগবো। আয় তোরে আমি নদী পার করে দেই? সোজা স্টেশন চইলা যা ওইখান থেইকা সোজা ঢাকার ট্রেনে উঠে যাইস।

নদী পার করে দিয়েই তমিজ সর্দার বকুলকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন মাথায় হাত বুলিয়ে দেন আর বলেন,
— শোন সবুজ বাঁইচা নাই আমরা খবর নিছি ওরা চোরাই পথে বিদেশ যাইতে সময় জঙ্গলেই মারা পড়ছে, মোল্লাসাব সব জাইন্না শুইন্নাই ওরে বিদেশ পাঠাইছে।
আর…. সবুজের বাপ কোনদিন ফিররা আইবো না ওরে পশ্চিমের ওই বাগানবাড়ীর সাথের জঙ্গলের বড় গাছের নিচে আধামরা অবস্থায় নিজের হাতে পুইতা রাখছিলাম….হুজুরের নির্দেশে, আর ওই প্রণব দাশের বউ আরতি হেরে হুজুরে বেইচ্চা দিছে নারী পাচারকারীর হাতে।
যা যা মা দেরি হইয়া যাইতেছে, বেলা উইঠা গেলে আর যাইতে পারবি না, বিপদ বাড়বো।

যাবার আগে বকুল পা ছুঁয়ে সালাম করে , কেঁদে উঠে তমিজ….. আল্লাহ তোর সহায় হোক মা, তোর মঙ্গল করুক।

অজানার পথে পা বাড়ায় বকুল, দ্রুত পায়ে হাঁটে আর ভাবে এইছিলো কপালে তিনকুলে আর কেউ রইলো না আমার, মা বাবা, স্বামী আপন বলতে আর কেউ নেই, কোথায় যাবো কী করবো? জীবনটা কেনো কচুরিপানার মতো হলো? কেনো স্রোতের টানে ভাসতে হচ্ছে আমাকে? কেনো সুখেরকাঁটা হয়ে বারবার কষ্ট আমায় জড়ায়? কেনো সুখ হাতছানি দেয় কিন্ত ধরতে গেলে মরীচিকা হয়ে যায়? কি আমার অপরাধ?

টিকেট জোগাড় করে ঢাকাগামী ট্রেনে উঠে বসে বকুল, আচ্ছা গ্রামে কেউ টের পায়নি তো?
নাহ! আমাকে খোঁজার মতো কে আছে ওই পিশাচ ছাড়া।
তবে বলা যায় না আমার খোঁজে এসে যদি না পায়? তমিজ চাচা বিপদে পড়বে নাতো?
না না চাচা সব সামলে নিতে পারবে। ম্লান হাসে বকুল, হায়রে কপাল…. কোথায় চলেছি অজানার পথে, আর ভাবছি কে বিপদে পড়বে আরো কতো কী?
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে আর সারারাতের নির্ঘুতায় ঘুমিয়ে পড়ে ।
হঠাৎ ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙে,অচেনা ঢাকা শহরের প্লাটফর্মে নামে বকুল।

.

ধানমন্ডি আট এর রাস্তার মোড়ে কুপার্স থেকে অর্ডার করা কেক নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে আফজাল সাহেবকে এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে অফিস থেকে বেরুতে, আর দেরি হলে খবর আছে , সবচেয়ে আদুরে ছোট্ট মেয়েটির আজ জন্মদিন।
কেক নিয়ে গাড়ীতে উঠতে যাবেন হঠাৎ দেখেন একদল বখাটে একটা মেয়েকে ঘিরে আছে আর মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে দেয়ালের সাথে সিঁটিয়ে আছে……
*
স্পষ্টত ইভটিজিং হচ্ছে অসহায় মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হচ্ছে, মেয়েটার চোখ মুখ আচরণ বলে দিচ্ছে বড়ই বিপদগ্রস্ত সে, আর শহরে নতুন নাকি কে জানে? বুকের কাছে একহাতে পুরো আঁচল আঁকড়ে ধরা অন্য হাতে ছোট একটা কাগজের টুকরো।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন বেশ বিরক্ত করছে বখাটে গুলো, মেয়েটাকে যে কোন সময় এট্যাক করবে একটা কিছু দ্রুত করতে হবে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে এক মিনিট কিছু ভাবলেন। এরপর গাড়ীর দরজা খুঁলে
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন, ছেলেগুলোকে পাশ কাটিয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে হঠাৎ বলে বসলেন
— আরে আছমা, তুই এখানে? আর আমরা সারাদিন ধরে তোকে খুঁজে মরছি? তাড়াতাড়ি বাড়ি চল সবাই চিন্তায় আছে।
বলেই হাত ধরে টেনে এনে গাড়িতে বসালেন। (বকুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাকরুদ্ধ পিছনে হেটে চলেছে)গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে আবার বললেন
— ভয় পেয়ো না মেয়ে তোমাকে রাস্তায় মোড়ে নামিয়ে দেবো, অথবা কোথায় যাবে বলো? আমি পৌঁছে দিবো। বখাটেরা বিরক্ত করছে দেখে এই মিথ্যেটুকু বললাম।
এবার বলো এই সন্ধ্যা বেলায় এখানে কী করছিলে?
বলো তোমার বাসা কোথায়? যাবে কোথায়?

এতক্ষণ চুপচাপ থেকে এবার অস্ফুটভাবে বকুল বললো
—আমার বাসা নেই। জানিনা কোথায় যাবো! আমি এই শহরের কিছু চিনিনা।

কিছুক্ষণ ভাবলেন, ফোনে কার সাথে যেনো কথা বললেন আফজাল আহমেদ। তারপর বললেন, ঠিক আছে তবে আজ আমার বাড়িতে চলো? কাল চিন্তা ভাবনা করে দেখবো কী করা যায়?

ভাবনার অতলে ডুবে গেলো বকুল….কোথায় চলেছি জানিনা, ভাগ্য আমার ঠেলে কোথায় নিয়ে চলেছে জানিনা, কোথায় গিয়ে ঠেকবো তাও জানিনা । কারো কারো জীবন হয়তো দুঃখ দিয়েই গড়া থাকে, সুখের ঠিকানা তারা খুব একটা পায় না। এই যে এখন যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি জানিনা, আমার জন্য যাওয়াটা ভালোও হতে পারে অথবা চরম খারাপও হতে পারে।

ঝলমলে একটা বিরাট এপার্টমেন্ট এর সামনে গিয়ে গাড়ি থামলো, দারোয়ান দৌড়ে এসে গেট খুঁলে দিতেই গাড়ী ভেতরে গিয়ে থামলো। আফজল সাহেবের সাথে নেমে পিছুপিছু হেটে যেতে লাগলো বকুল, লিফটে করে ৬তলাতে গিয়ে ওরা নামলো। নেমেই দরজায় কলিংবেল বাজালেন আফজাল সাহেব। দরজা খুঁলে সুন্দর মুখশ্রীর একজন ভদ্রমহিলা হেসে দাঁড়ালেন,ইশারায় কিছু বললেন দুজনে।ভদ্রমহিলা সরে ভেতরে গেলেন সাথে আফজাল সাহেবও, ভেতরে হৈহুল্লোড় চলছে, কিশোর কিশোরীরা আনন্দ করছে। বকুল ইতস্ততভাবে দাঁড়িয়ে রইলো,

ভদ্রমহিলা আবার ফিরে আসলেন এসে বললেন — কই রে ভেতরে আয়?
বকুল ভেতরে গেলো, ভদ্রমহিলার পিছুপিছু।
একটা ছোট্টখাট্টো রুমে নিয়ে বকুলকে বসিয়ে রেখে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এক সেট সেলোয়ার কামিজ দিয়ে বাথরুম দেখিয়ে দিলেন, কিভাবে গিজার ব্যবহার করতে হবে দেখিয়ে দিয়ে বললেন — তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়? পরে তোর নামধাম, পরিচয় সব জেনে নেবো।

গোসল শেষে বকুল বের হয়ে দেখে ছোট টেবিলের উপর ভাত, করল্লা ভাজি, গরুর মাংস , ডাল ঢাকনা দিয়ে রাখা, খাবার দেখে বকুলের কান্না চলে এলো। প্লেট হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে, পেটের ক্ষুধায় বকুল খাবার নিয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগলো,চোখের পানি আর খাবারে একাকার হলো। অর্ধেক খাবার খাওয়ার পর খেয়াল হলো দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে….

*
প্রতিদিন এসে মেয়েটা সকালের নাস্তা বানায়,এঁটো বাসনকোসন ধোয়, আজ সারাদিন চলে গেছে একবারের জন্যও উঁকি দেয়নি দেখে মিয়া গিন্নী লোক পাঠালেন খোঁজ নিতে।

মিয়া সাব দাওয়ায় ইজি চেয়ারে শুয়ে আয়েশ করে হুক্কা টানছেন, আর গতরাতের সুখস্মৃতি নিয়ে ভাবছেন…. অনেকদিনের খায়েশ মিটছে, লাজ একবার ভাইঙা দিলে আর লাজ থাকে না। অবশেষে কবজায় নিতে পারলাম সবুজ্জার বউডারে। আহা কি টসটসে, কি নরম গতর এক্কেরে কইতরের লাহান, ইসসরে….

বকুলের খোঁজে যাওয়া লোক ফিরে এসে জানালো.. দরজা খোলা বকুলে ঘরে নাই। মিয়া গিন্নী খেদোক্তি করে বললেন — এইডা আবার কেমুন কতা, দিনে দুপুরে যাইবো কই? আশেপাশে খুইজ্জা দেখছস?
— হ বেগম সাব খুজ্জি কিন্তু কুনুহানে পাই নাই।
— পাড়াপড়শিরা জানে কিছু।
—– না জানে না, তয় কইলো মাইঝ রাতে কানতে শুনছে, কি না কি ভুত পেতনি ডরে কেউ বাইর অয় নাই।

দুজনের অনবরত কথা তোড়ে মিয়া সাবের চিন্তার ব্যাঘাত হওয়াতে বিরক্ত হয়ে স্ত্রী রাহেলাকে বললেন — ওই বকবকানি থামা? কি হইছে তোগো?
—- বকুলরে তো খুইজ্জা পাইতাছি না।
মিয়া সাব আধা বসা থেকে উঠে সোজা হয়ে বসলেন।
— কি? কি কস এসব?
— হ মিয়া সাব।

চলবে

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা — ৪

বকুল উধাও!
পুরোপুরি গ্রাম থেকে গায়েব!

তন্নতন্ন করে সারাগ্রামে খোঁজা হচ্ছে তাকে, প্রতিটি ঘরে ঘরে তল্লাশি করা হয়েছে। নদীর ঘাটে লোক পাঠিয়ে গ্রাম সীমানার পুরো পাড়ে খোঁজ করে, একঘাটে গিয়ে গলায় দড়িবাঁধা কলস পাওয়া গেছে। আশেপাশের গ্রামগুলোতে চুপেচাপে খোঁজ নেয়া হচ্ছে, কারণ বেশি জানাজানি হলে বিপদ বাড়ার আশংকা আছে।
মিয়া সাবের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে, মুঠি করে ধরে দাঁড়ি হাতড়াচ্ছেন আর মনেমনে বলছেন – এইডা কি অইলো? পাখি হাত থেইক্কা ফসকাইয়া গেলো গা, ভাবছিলাম হাতের মুঠাত যহন আনছিলাম তরাইয়া তরাইয়া মজা নিমু, কিন্তু পাখি যে ফুড়ুৎ হইবো এইডা তো ভাবি নাই। ডর দেখাইছিলাম, যাওয়ার জায়গা নাই,মনে হইছিলো ডরাইবো , হাতের কাছাকাছি থাকবো, যহন ইচ্ছা দুইহাতে খাঁচায় বন্দি করমু। সব আশায় ছাই পড়লো!

কি চিন্তা করেন মিয়া সাব?
তমিজের কথায় মিয়া সাবের চিন্তায় ছেদ পড়ে।
— পাখি পলাইলো তুই কই আছিলি তমিজ্জা?
— ক্যান মিয়া সাব? ঘরে ঘুমাইয়া আছিলাম , আর কই থাহুম?
— তোরে ঘুমাইয়া থাহনের লাইগগা বেতন দেই? একটু পাহারা দিতে পারলি না?
—- হুজুর, আমি কি জানতাম মাইয়া পলাইবো? আপনে যেভাবে শাসাইয়া আইছেন, আমার তো মনে অয় নাই ঘরের বাইরে পাও রাখবো।
—যেভাবে লোক লাগাইছি আশেপাশে কারো বাড়িত থাকলে এতক্ষণে জানতে পারতাম, মনে অয় গাঙের ওইপাড় চইল্লা গেছে।
— হইতে পারে হুজুর, তয় মাইয়ার জব্বর সাহস আছে।
— সাহস এমনে অয় নাই? নিশ্চয়ই কেউ সাহায্য করছে, একলা একলা এতবড় গাঙ পাড়ি দিতে পারবো না! আমার মনে অয় কেউ ওরে নদী পার কইরা দিয়া আইছে?
— কেমনে বুঝলেন হুজুর?
—- আরে ব্যাডা গাধা, মাইয়া একলা পার হইলে তো নৌকা ওইপাড়েই থাকতো, এইপাড়ে নৌকা কি হাইট্টা হাইট্টা আইছে? নৌকার কি পাও আছে?
—- হইতে পারে হুজুর। তয় মাইয়া যদি সাতার জানে তাইলে কিন্তু সম্ভব হুজুর।
—- হ তর মাথা আর মুন্ডু, কেডা এই নিমকহারামডা? ধরতে পারলে কাইট্টা টুকরাটুকরা করতাম।

রাগে ফোসফাস করতে থাকেন তবারুক মিয়া, চোখ দুটো ভাটার আঙ্গরার মতো জ্বলতেছে।
কথা শেষ করে তমিজ ঘরের বাইরে পা বাড়ায়
— ওই যাইস না খাড়া তমিজ্জা..?
— জ্বি হুজুর
—- কামডা তুই করছ নাই তো আবার?

থতমত খেয়ে যাও তমিজ সর্দার, পিঠ বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। একটু ইতস্তত করে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দেয়,
—- কি যে কন হুজুর? আপনার সবকিছুর সাক্ষী আমি, আইজ পর্যন্ত কাকপক্ষীও কিছু জানে নাই? আর আপনে আমারে অবিশ্বাস করলেন? মনডাত বড় দুক্ষু পাইলাম।
—- হইছে হইছে থাম..? বাজাইয়া দেখলাম তরে? তয় যেই করছে কামডা তারে ধরতে পারলে গতরের চামড়া দিয়া ডুগডুগি বানামু, মাটির নিচে পুইত্তা ফেলমু।
— জ্বি হুজুর
বলে ঢোক গিলতে গিলতে উঠানে নেমে আসে তমিজ সর্দার।

.
আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো পরীদের মতো পোশাক পড়া ১২/১৩বছরের একটি মেয়ে। কাছে এসে বকুলকে দেখতে লাগলো।
— তুমি আমার কে হও?
বকুল আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলো, কি বলবে সে, আসলেই তো! সে তাদের কে হয়? কাল এইবেলা সে কোথায় ছিলো আজ এইবেলা সে কোথায়? কাল একই সময়ে তার জীবনে অমানিশা ঘনিয়ে এসেছিলো, আজ একই সময়ে অজানা অচেনা এক সুরম্য প্রাসাদের এই রাজকুমারীর প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানো।

ও তোমার আপু হয়,ঝুমা এখন যাও তোমার বন্ধুরা তোমাকে খুজছে?

প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ঘরের গৃহকর্ত্রী হাসনা পারভীন রুমে ঢুকলেন।

–আর ভাত লাগবে তোমার? পেটভরে খাও সংকোচ করো না।
— জ্বি না।

ঝুমা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো
মা ওকে আমার পার্টিতে নিয়ে এসো, ও কেক খাবে।
— আচ্ছা নিয়ে আসছি তুমি যাও।

বকুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিছু মনে করো না, আমার মেয়েটা মেহমান ভীষণ পছন্দ করে
বকুলের খাওয়া শেষ হলে, ওকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলেন হাসনা পারভীন।
বকুল রুমের এককোনায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে টেবিলে বিশাল কেক সাজানো, এতবড় কেক সে তার জন্মেও দেখেনি। ছোটবেলা পাশের বাড়ির ব্যাটারি চালিত টিভিতে বাংলা সিনেমায় দেখেছে বেলুন দিয়ে সাজানো জন্মদিনের ঘর, টেবিলজুড়ে বিশাল বড় কেক, অনেক রকম খাবার রাখা টেবিলে। সবকিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে, এমনকিছু স্বচক্ষে দেখবে সে কোনদিন ভাবেনি।

ঝুমা নামের মেয়েটি প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে কি সুন্দর সুখী জীবন, সবই ভাগ্যের খেলা সবই নিয়তি। কেক কাটা হলে সবার হাতে পিরিচে করে কেক তুলে দিলেন হাসনা পারভীন। বকুলকেও দেয়া হলো কেক মুখে দিয়ে তার কাছে অমৃত মনে হলো, ঠিকমতো পেটপুরে ভাত পায়নি যে মেয়ে তার কাছে এতো অমৃত হবেই?

পার্টি শেষ হবার পর সব কাজ গুছিয়ে আফজাল আহমেদ ও হাসনা পারভীন ড্রয়িংরুমে বসলেন বকুলকে নিয়ে। হাসনা পারভীন বকুলকে জেরা করলেন
— কি নাম তোমার?
— বকুল
— বয়স কত?
— ১৭ বছর
— এবার বলো ঢাকা কার কাছে এসেছো?
—- আমি উনাকে চিনিনা, এক কাকা ঠিকানা দিলেন, কিন্তু সারাদিন ঘুরেও খুঁজে পাইনি।
— কেনো এসেছ ঢাকা।

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো বকুল,
—- আরে আরে কি হলো? এভাবে কাঁদছ কেনো? কান্না থামাও আমাদেরকে সব খুলে বলো? আমরা না হয় তোমার সাহায্য করতে পারবো না।

বকুল তার জীবনের সম্পূর্ণ চিত্রপট তুলে ধরলো, বকুলের সব কথা শুনে আফজাল সাহেব মর্মাহত হলেন, হাসনার চোখ ভিজে গেলো।
— সত্যিই তোমার উপর অনেক অবিচার হয়েছে? যাক এসে ভালোই করেছ? আরো নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচলে? কাল ঠিকানাটা খুঁজে ওই বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো?
— আপনারা অনেক ভালো মানুষ, আজকের দিনটার কথা সারাজীবনও ভুলবো না।

আফজাল সাহেব স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন
— যাদের বাসায় যাবে, তাদেরকে তুমি চেনো?
—- না, উনাদের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি।
— তবে কোন ভরসায় ওখানে যাবে? আবার যদি বিপদ হয়?
—- জন্ম থেকে দুঃখ যার সঙ্গী, বিপদ যার পায়ে পায়ে তার আর নতুন করে বিপদের ভয় কি?
— দাঁড়াও… দাঁড়াও , ঠিকানা খুঁজে বের করে আগে দেখি, তারপর ভাবনা চিন্তা করা যাবে, যাও গিয়ে ঘুমাও? কাল যা হবার হবে?

.
অল্প শিক্ষিত তমিজ সর্দার ঠিকানায় যা লিখেছে তার অর্ধেকই বুঝা যাচ্ছে না, শুধু বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে লেখা ফোন নম্বরটা সম্বল । সেটার উপর ভরসা করে অবশেষে ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেলো, নাম আফিয়া খাতুন।
বিকেল নাগাদ আফিয়া খাতুন আফজাল আহমেদের বাসায় আসলো।

বিধবা আফিয়া খাতুন দুই ছেলেকে নিয়ে সাত মসজিদ পেরিয়ে একটু ভেতরের দিকের গলিতে দুইকামরার একটা বাসায় দিনযাপন করেন। বকুল তার বাসায় আসবে সেটা তার জানা ছিলো, কিন্তু বাসা পর্যন্ত না পৌঁছানোতে একটু চিন্তিত ও ছিলেন, পরে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন এই ভেবে যে, পরের মেয়ের জন্য দুঃখ করে লাভ নেই। কে কার জন্য আজকাল মরে? আফসাল আহমেদের লোক যখন তার দরজায় হাজির হলো, তখন তার কাছ থেকে জানতে পারলেন বকুল এখানে। অগ্যতা বকুলকে নিতে আসলেন, ভাই গ্রাম থেকে অনুরোধ করেছেন ফেলাও তো যায় না।

গৃহকর্ত্রী হাসনা বেগম বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করে তথ্য প্রমাণ নিয়ে, ঠিকানা রেখে তার হাতে বকুলকে সোপর্দ করলেন। আর বকুলকে বারবার বলে দিলেন যেকোনো প্রয়োজনে সাহায্য করবেন। বকুল আফিয়া খাতুনের সাথে হাত ধরে কচুরিপানার মতো সময় স্রোতের টানে ভেসে চললো নতুন ঠিকানায়।

.
মিয়া সাবের লোক যখন লোকমান শেখের বাড়িত পা রাখলো, তখন তিনি দুপুরের খাবার খেয়ে বারান্দায় পাতা চৌকিতে সবে গা এলিয়েছেন।
দূর গায়ের লোক দেখে উদোম গা ঢাকতে আলনায় রাখা ফতুয়াটা টেনে গায়ে জড়ালেন। আগন্তুককে প্রশ্ন করলেন
— আপনি কে ভাইসাব? আপনেরে তো চিনলাম না?
— আমার নাম মতিন মিয়া আপনি আমারে চিনবেন না। ফারিজপুরের মিয়া সাব আমারে পাঠাইছে।
— ক্যান পাঠাইছে? আমার কাছে কি কাজ?
—- কাজ একটা আছে?
— খুইল্লা কন ভাইসাব?
— আপনার মাইয়ার নাম তো বকুল?
থতমত খেয়ে গেলো লোকমান শেখ
—- হ আছিলো, ক্যান, হ্যায় কি করছে?
—- কিছু করে নাই, আমাগো গেরামের আসাদ মুন্সীর পোলা সবুজের লগে বিয়া হইছে?
— হ, তয় এহন কি হইছে, ওইডা কন?
—- না মানে সবুজ্জা মালয়েশিয়া যাবার আগে, আমরার মিয়া সাবের হাতে বকুলরে দেইখখা রাখার দায়িত্ব দিয়া গেছিলো। মিয়া সাব ফেরেশতার লাহান মানুষ, দেখবাল বালাই করতাছিলো। কিন্তু…
— কিন্তু কি?
— আইজ দুদিন যাবত, বকুলরে খুইজ্জা পাওন যাইতাছে না।
—- কি? কি কন এসব?
— স্বর্ণ গয়না ভাঙলে যায় স্বর্ণকারের ঘরে, মাইয়া মানুষ ভাঙলে যায় বাপের ঘরে… তাই মনে করলাম আপনের বাড়িত যদি আইয়া থাহে।

..
আমার বাড়িত আইবো ক্যান? হ্যা আমি কি লঙ্গরখানা খুইল্লা রাখছি, খারাপ চরিত্রের মাইয়া, যারা বংশের মুখে চুনকালি মাখে তাগো লাইগা আমার দরজা চিরকাল বন্ধ থাকবো।
কর্কশ ভাষা এসব বলতে বলতে মাঝবয়েসী এক নারী বারান্দায় আসলেন। একপলক চেয়ে থেকে মতিন মিয়া বললো,
— তাইনে কি আপনার বিবি?
— জ্বি আমার বিবি। বকুলের ছোড মা।
— একটা কতা কই ভাবী সাব? আপনে.. কতাডা ভুল কইলেন? বকুল একটা লক্ষ্মীমন্ত মাইয়া আইজ তিন বছরে গ্রামের মানুষ অর গলার আওয়াজ কুনুদিন শোনে নাই। এমুন মাইয়া হাজারে একটা অয়।
আমি যাই ভাইসাব, মিয়াসাব বড় চিন্তায় আছে, কই যে গেলো মাইয়াডা?আপনে মাইয়ার বাপ,আপনের কাছে আইতে পারে? যদি এই বাড়িত আইয়া উডে মাইয়াডা আমগোরে একটু জানায়েন।

লোকটা চলে যেতেই লোকমান শেখ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন, বড় আদরের সন্তান ছিলো এই বকুল, কত্ত আদরে ওর মা ওরে মানুষ করছে, আর আইজ মাইয়াডার কোন হদিস পাওয়া যাইতেছে না। মা মরা মাইয়াডারে কুনুদিন নিজের কাছে বসাইয়া খাওয়াই নাই, কুনুদিন জিগান নাই — মা তোর কিছু লাগবোনি? লোকের মুখে শুনতাম ছোড মা ওর উপর অত্যাচার করে মারধোর করে, ঠিকমতো খাইতে দেয় না। চুপ কইরা সব হজম করছি সংসারে অশান্তির ভয়ে। প্রতিদিন ঘরের সব কাজকর্ম কইরা দিয়ে খাইয়া না খাইয়া মাইয়াডা আমার ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ছে। হঠাৎ কইরা দোকানের কর্মচারীর লগে পলাইয়া গিয়া মানসম্মান ধুলায় মিশাইয়া দিলো? এই রাগে কুনুদিন মাইয়ার খোঁজখবর নেই নাই, বউ নিতে দেয় নাই। জনমের তরে ত্যাগ কইরা দিছিলাম, কিন্তু আইজ মাইয়াডা নিরুদ্দেশ শুইন্না কইলজা ক্যান মোচরায়, চক্ষে ক্যান বানের পানি নামে, ?

.
মারুফের আজকাল বাইরে মন টেকে না, খালি ঘুরেফিরে ঘরে থাকতে মন চায়। ছোটভাই মামুন গার্মেন্টসে চাকুরী করে সংসার চালায়, মারুফ আর মা মিলে গলির মাথায় ছোট স্টল নিয়া পান বিড়ি সিগারেট বিক্রি করে। মারুফ দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডাবাজি করেই দিন কাটায়, পাড়ায় পাড়ায় গলির মাথায় বখাটেপনা করে, নেশা ভাঙ করে বেড়ায়। বিয়ে একটা করেছিলো কিন্তু ‘ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোসাই যারা তাদের সংসার টেকে না বেশিদিন। তাই বাউন্ডেলে স্বামীকে ছেড়ে পালিয়েছে বউ। বাসায় বকুল আসার পর তার মন ঘরে পড়ে থাকে, এমন সুন্দর নজরকাড়া মেয়ে ঘরে রেখে বাইরে মন টেকে কি করে?

বকুল নিজ দায়িত্বে আফিয়া খালার বাসার সব কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে রান্নাবাড়া সব কাজ নিজ হাতে করে, আফিয়া খালাও কিছুটা স্বস্তি পায়। সব কাজ সেরে খালা কাজে যাওয়ার সাথে সাথে রুমের দরজা বন্ধ করে নিজেকে বন্দি করে ফেলে।
মারুফের সারাক্ষণ ছোকছোকানী তার ভালো লাগে না, চক্ষের চাহনি কথা বলার ভঙ্গি তার মনে আতঙ্ক ছড়ায়। জীবনে এত পোড় খেয়েছে যে মানুষের চোখের ভাষা চিনতে আর কষ্ট হয় না।
সময়ে অসময়ে সারাদিন মারুফ দরজা নক করতে থাকে
— বকুল দরজাটা একটু খোলো? বাইরে আসে দুজনে একটু সুখদুঃখের গল্প করি?

বকুল ভেতর থেকে কোন উত্তর দেয় না, ভয়ে সিটিয়ে থাকে। ভয়ে কাঁপে আর ভাবে কোথাও কি নিরাপদ জায়গা নেই ? কোথায় যাবে সে, কি করবে? সুখের সন্ধানে নিশ্চিত দুটো খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার পথ আর কতটা দূরে? আর কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে?
সন্ধ্যার দিকে যখন খালা আসে ঘরে, কথাবার্তার শব্দ পাওয়া যায় তখনি কেবল দরজা খোলে বকুল।

রাগে ফোসফাস করে মারুফ, জিনিসপত্র আছড়ায় অজানা আক্রোশে। খালা শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সব বুঝেও ভাষা যোগায় না তার মুখে।
তবুও ছেলেকে শাসায় আফিয়া খালা,
— আমার বুড়া হাড্ডির তো জোড় বাড়ে না? কামে আইস নাই ক্যান?সারাদিন বাসাত কি করস তুই?
— কাম করতে ভাল্লাগেনা আমার? ঘরে বউ আনো?
—- কামাই তো করস না, বউরে খাওয়াবি কি? আর তোরে মাইয়া দিবো কেডায়?
— মাইয়া দূরে খোঁজো ক্যা? ঘরেই তো আছে?
বিস্ফোরিত চোখে চায় আফিয়া খাতুন,
— খবরদার এহন কইছিস, আর মুখেও আনবি না?
— ক্যান? আমি কুনদিক দিয়া খারাপ?
— তুই কুনুদিক দিয়াই ভালা না? কাইল থেইক্কা কামে যাবি তোরে বসাইয়া খাওয়াইতে পারমু না।
— ঘরে যারে আনছো তারে তো বসাইয়া খাওয়াইতাছো?
— হেই চিন্তা তোরে করতে হইবো না।
বকুল সব শোনে কিন্তু নিরুপায়, তার যে যাবার জায়গা নেই।

এভাবেই চলতে থাকে বকুলের জীবন, মারুফ তক্কেতক্কে থাকে, কাজে গেলেও সময় অসময়ে বাড়ি চলে আসে। আফিয়া খালার কলজের পানি শুকিয়ে আসে ছেলে কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে, সেই ভয়ে তটস্থ থাকেন।

একদিন অসতর্কতায় দরজা খোলা থাকে, প্রাকৃতিক ডাকে বের হতেই দেখে যম হয়ে মারুফ বসা।
দৌড়ে রুমে ঢোকার আগেই হ্যাচকা টানে বকুলের শরীরটাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে, বকুলের মুখ চেপে ধরে মারুফ।
বকুল হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে, মুখ বন্ধ তাই গোঙাতে থাকে….

চলবে

#শামীমা_সুমি