#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৩১
#Raiha_Zubair_Ripti
পড়ন্ত বিকেল,,খাওয়া দাওয়া শেষ রজনী দের। রজনী এখন বসে আছে সাদমানের সাথে প্যান্ডেলের ভেতর সাজানো চেয়ারে৷ রুয়াত শাফায়াত বাড়ির ভেতরে নাইমুর সানজিদার কাছে। একটু পরই বের হবে সবাই। রজনীর ওয়াশরুমের চাপ পেলো। সেজন্য বসা থেকে উঠে সাদমানের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আমার একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে। আমি আসছি একটু।
সাদমান মাথা ঝাকিয়ে আচ্ছা বলল। রজনী চলে গেলো বাড়ির ভেতর। দোতলায় ওয়াশরুম। রজনী দোতালায় চলে গেলো। করিডোর পেরিয়েই লাস্টের দিকে গেস্ট রুমে ওয়াশরুম আছে। রজনী করিডর পেরিয়ে রুমের ভেতর ঢুকলো। ওয়াশরুমের দরজা ধরে ধাক্কা দিতেই দেখলো ভেতর থেকে আটকানো। রজনী বুঝলো ভেতরে কেউ আছে। তাই অন্য রুমের ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসে কানে। রজনী পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকায়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসা এক মুখশ্রী দেখার সাথে সাথে রজনীর হৃদপিণ্ড টা কেঁপে উঠে। মনে হলো পৃথিবী থমকে গেছে তার। দু কদম পিছিয়ে গেলো। আজ কয়টা বছর পর এই মুখশ্রী দেখছে রজনী। শ্বাস আটকে গেলো। কণ্ঠনালী কেউ ধরে রেখেছে। সামনে থাকা মানুষটার ও কি একই অবস্থা রজনী কে দেখে? কোলে আছে সেই তখনকার বাচ্চা টা। পড়নে ব্লু কালারের স্যুট। আগের থেকেও সুদর্শন লাগছে। আচ্ছা বাচ্চা টা নওফিল এর কি হয়? মেয়ে? নওফিল তাহলে বুঝি বাচ্চা পেয়ে এখন পরিপূর্ণ তাই না? রজনী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। মুখ চেপে চলে আসলো। রুম থেকে বের হতেই চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি বের হতে লাগলো। আহ্ আবার সেই কষ্ট। রজনী তো এবার মরেই যাবে। কি দরকার ছিলো এতো গুলো মাস পর আবার এই মুখশ্রী কে চোখের সামনে নতুন রূপে দেখার?
নওফিল নিজেও পাথরের মতো জমে আছে। এতোদিন পর প্রাক্তন কে দেখে হৃদয়টায় কেমন একটা অনুভূতি হলো। মেয়েটার সাজ দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা ভালো আছে। আচ্ছা সত্যি রজনী ভালো আছে সুখে আছে তাই না? ও কি বিয়ে করেছে? ও কি নওফিল নামক মানুষ টিকে ভুলে গেছে? নাহ্ ভুলে নি। ভুললে কি চলে যেত এভাবে মুখ চেপে? মেয়েটা কে কম করে তো আর ভাঙে নি নওফিল। নিশ্চয়ই ঘৃণা ও করে নওফিল কে। মেয়ের হাতের স্পর্শে ঘোর কাটলো নওফিল এর। এসেছে দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের বউ ভাতে৷ যদি কোনো ভাবে জানতো এখানে রজনী আসবে। তাহলে কস্মিনকালেও এই মুখ দ্বিতীয় বার দেখাতো না রজনী কে।
নওফিল বেরিয়ে আসলো রুম থেকে। আজ আবার যেতে হবে নাইমুর এর শ্বশুর বাড়ি।
সাদমান আকস্মিক রজনী অস্থির হয়ে দৌড়ে ছুটে আসতে দেখে ভারি চমকালো। রজনীর বাহু ধরে বলল-
-“ কিছু হয়েছে রজনী?
-“ আ..আমি বাসায় যাব সাদমান। প্লিজ আমাকে বাসায় নিয়ে যান। আমি আর থাকতে পারবো না এখানে। আই নিড মেডিসিন। তা না হলে যে কোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলবো নিজের সাথে।
কেঁপে কেঁপে বলল কথাটা রজনী। সাদমান বুঝলো না হুট করে রজনীর এমন কথা বলা দেখে। রজনী কে আস্বস্ত করে বলল-
-“ ব্রো আর রুয়াত ওদের নিয়ে আসুক। তারপর…
-“ কোনো তারপর এরপর নয়। আপনি না পারলে বলুন আমি একাই চলে যাব।
রেগে বলল কথাটা রজনী। সাদমনে বিস্ময়ের চরমে। সাদমান ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো রজনীর শরীর স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। এই ঠান্ডা আবহাওয়া তেও বাজে ভাবে ঘামছে। সাদমান বুঝে নিলো কিছু একটা হয়েছে যার কারনে রজনীর এমন অবস্থা হচ্ছে। পকেট থেকে ফোন বের করে শাফায়াত কে চলে যাওয়ার টেক্সট পাঠিয়ে রজনী কে নিয়ে চলে গেলো।
সাদমান রজনী কে নিয়ে নিজেদের বাসায় আসে। রজনী নিজের রুমে ঢুকে মেডিসিন টা খেয়ে নেয়। পড়নের শাড়ি খুলে কামিজ পড়ে নেয়। ব্যথায় বুক ভারি হয়ে আসছে। বুকে হাত ঘষে সারা রুম পায়চারি করতে লাগলো। সাদমান এতক্ষণ বসার রুমে ছিলো। এখন রজনীর রুমের সামনে আসলো। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। সাদমান টোকা দিলো।
-“ রজনী দরজা টা খুলুন।
রজনী সাদমানের গলার আওয়াজ শুনে দরজা টা খুলে আবার পায়চারি করতে লাগলো। সাদমান টেনে বসালো রজনী কে খাটে। রজনীর এমন অবস্থা জাস্ট নিতে পারছে না সাদমান। গালো আলতো করে হাত রেখে বলল-
-“ হোয়াট হ্যাপেন্ড’স রজনী? কি হয়েছে আপনার? এমন দেখাচ্ছে কেনো? বলুন আমায়?
রজনী জোরে জোরে শ্বাস নিলো।
-“ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে সাদমান।
রজনীর গলার স্বর শুনে সাদমানের ভেতর আত্মা টা কেঁপে উঠলো।
-“ কোথায় ব্যথা হচ্ছে আমায় বলুন?
রজনী বুকে হাত দিয়ে বলে-
-“ আমার এইখান টায় ব্যথা হচ্ছে সাদমান। আমি পারতেছি না এই ব্যথা সহ্য করতে। মনে হচ্ছে আমি ম’রেই যাব। আমাকে মে’রে ফেলুন না সাদমান। সত্যি আমি এই ব্যথা নিতে পারতেছি না। উফ কি অসহ্য ব্যথা।
রজনীর চোখ দিয়ে সমান তালে জল পড়তে লাগলো।
সাদমান জড়িয়ে ধরলো রজনী কে। মাথায় হাত রেখে বলল-
-“ হঠাৎ এতো কষ্ট পাচ্ছেন কেনো রজনী? কি হয়েছে আমাকে বলুন না। আপনার চোখের জল আমাকে বড্ড পিড়া দিচ্ছে।
রজনী এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। সাদমান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল-
-“ জানেন আমি আজ নওফিল কে দেখেছি। ও ছিলো বিয়ে বাড়িতে। ঐ যে আমরা যেই বাবু টাকে কোলে নিলাম না? ঐ বাবু টা ওর কোলে ছিলো। নওফিলের বাবু হয়েছে। ও সুখী আছে। ও চোখের সামনে আসার পর থেকেই আমার বুকে ব্যথা করতেছে সাদমান। আমি কি এই বুকে ব্যথা নিয়ে ম’রে যাব?
সাদমান বুঝে গেলো। ঐ নওফিল ই সেই নওফিল। কি এক ভাগ্য। ঘুরে ফিরে সেই নওফিল কেই কেনো রজনীর সামনে আসতে হবে? রজনী তো সাদমান এর সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চাইছিল আর হুট করে এই লোকের আগমন।
রুয়াত শাফায়াত নাইমুর সানজিদা কে নিয়ে নাইমুর দের বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাফায়াত হাত ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ দাঁড়িয়ে আছিস কেনো নাইমুর? ওঠ গাড়িতে।
নাইমুর এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
-“ আরে আমার এক দূর সম্পর্কের কাজিন যাবে। তারজন্য ই অপেক্ষা করছি।
নাইমুর ফোন দিলো নওফিল কে। ফোন রিসিভ হতেই বলল-
-“ আপনি কোথায় ভাইয়া?
নওফিল তার নিজের গাড়িতে বসে আছে নাইমুর এর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে।
-“ তুমও যাও নাইমুর। লোকেশন টা সেন্ড করো আমি চলে যাব নওরিন কে নিয়ে।
নাইমুর লোকেশন টা সেন্ড করে সানজিদা কে নিয়ে উঠে বসলো গাড়িতে। শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ তোর দূর সম্পর্কের কাজিন আবার কে?
-“ চিনবি না। আমি নিজেও চিনতাম না। মাস কয়েক হলো চিনেছি। আমার বাবার চাচার চাচার ঘরের নাতি সে। আম্মার সাথে পরিচয় হয়েছে মাস খানেক আগে। আমরা কুয়াকাটা গেলাম না? তখন। এই শহরেই নাকি থাকে এখন মেয়েকে নিয়ে।
শাফায়াত গাড়ি চালানো তে মনোযোগ দিলো। বাড়ির কাছে এস গাড়ি থামিয়ে ভেতর ঢুকে সবাই৷ নাইমুর সোফায় বসে বারবার সদর দরজার দিকে তাকায়। রুয়াত নিজের রুমে যায় শাড়ি চেঞ্জ করতে। শাফায়াত বারবার সদর দরজার দিকে তাকাতে দেখে বলে-
-“ তর কাজিন কতদূর ফোন দিয়ে দেখ।
নাইমুর ফোন দেওয়ার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করতে নিলে দেখে সদর দরজা দিয়ে নওফিল তার মেয়ে নিয়ে ঢুকছে। নাইমুর ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ ঐ তো এসে গেছে।
শাফায়াত তাকালো। নওফিল এগিয়ে আসলো। নাইমুর বলল-
-“ এটা হচ্ছে আমার কাজিন নওফিল। আর ভাইয়া এ হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড শাফায়াত।
নওফিল সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে কুশলাদি করলো। নামটা শুনে শাফায়াত এর কিছুটা খটকা লাগলেও তা পাত্তা দিলো না। সোফায় নওফিল কে বসতে বলে নিজেও বসে পড়লো। রুয়াত শাড়ি পাল্টে থ্রিপিস পড়ে বসার ঘরে আসতেই পা জোড়া থেমে যায়। এই অভদ্র লোক তাদের বাসায় কেনো? এই লোক কে তার বোন দেখলে তো হুলস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে। রুয়াত এগিয়ে আসতে নিলে শাফায়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুয়াতের দিকে এগিয়ে আসলো। রুয়াত থেমে গেলো। শাফায়াত এর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ এই লোক এখানে কেনো?
-“ এখানে কেনো মানে? এটা নাইমুর এর কাজিন।
-“ কিহ! এটা তো সেই নওফিল। আপনি বুঝতে পারছেন আপু দেখলে কি হবে? ওরে বের করেন বাসা থেকে।
শাফায়াত রুয়াতের হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। বেরিয়ে যেতে বলবে এটা কোন ধরনের কথা। সবার সামনে সিনক্রিয়েট করার কোনো মানেই হয় না৷ এখন অতিথি বাসার নওফিল। একটা লোককে অসম্মান করবে এভাবে?
বিকেলে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে নীতি। গন্তব্য ইউনিভার্সিটি। সেখানে গিয়ে যথাসম্ভব সব কাজ শেষ করে ঢাকা চলে যাবে। ভার্সিটির গেটের কাছে আসতেই দেখা মিলল নীলয়ের। রোজকার নিয়ম করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একা না। পাশে তিন চারজন ছেলেও আছে। নীতি উপেক্ষা করে চলে আসতে নিলে নীলয় হাত টেনে ধরে। নীতির ভেতর আত্মা কেঁপে উঠে। আশেপাশে সবাই তাকিয়ে আছে। নীতি পেছন ফিরে বলে-
-“ হ… হাত টা ছাড়ুন নীলয়।
নীলয় হাত টা ছাড়লো না৷ আগের তুলনায় চেপে ধরলো জোরে৷ ব্যথায় চোখ বন্ধ করলো নীতি। নীলয় এগিয়ে নীতির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে-
-“ এভয়ড করছিস আমায়? বলেছি না আই লাভ ইউ? কথা কানে যায় নি। শুনলাম ভার্সিটি ছেড়ে চলে যেতে চাইছিস? পারবি যেতে? এই নীলয় তোকে যেতে দিবে ভেবেছিস? তুই নীলয়ের না হলে তোর এমন অবস্থা করবো যে তুই অন্য কারোর ও হতে পারবি না।
নীতি মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু নীলয় তা হতে দিলো না। নীতির পড়নের ওড়নায় হাত দিতেই নীতি আর পারলো না। ডান হাত দিয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো নীলয় এর গালে। নীলয় এর চোখ হিংস্র হয়ে জ্বলে উঠলো। নীতি বুকে ধাক্কা দিয়ে গেট থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে হোস্টেলের চলে গেলো।
নীলয় এর সাঙ্গোপাঙ্গ রা এগিয়ে এসে বলল-
-“ আপনি কিছু বললেন না ভাই? কত বড় সাহস আপনার গালে চড় মে’রেছে।
নীলয় গালো হাত দিয়ে রিকশার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ঘুঘু দেখেছে ঘুঘুর ফাঁদ দেখে নি। ভালো মতো বলেছি শুনলো না। এরপর ওর সাথে যা হবে ও কল্পনাও করতে পারবে না।
নীতি হোস্টেলে ফিরে কান্না করে দিলো। ছেলেটা কতটা অসভ্য হলে নীতির ওড়নাতে অব্দি হাত দেয়। নিজ শহর হলে এতক্ষণে জুতা দিয়ে পি’টিয়ে সোজা করে দিত। কিন্তু নিজ শহর না হওয়ায় তা পারছে না। নীতির রুম মেট হাবিবা নীতি কে কান্না করতে দেখে এগিয়ে আসলো। নীতির পিঠে হাত রেখে জিগ্যেস করলো-
-“ কাঁদছিস কেনো নীতি? কিছু হয়েছে আবার?
নীতি হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল-
-“ ঐ বেয়াদব টা আজ আমার ওড়না ধরেছিল হাবিবা। আমি আর না পেরে থাপ্পড় মে’রে এসেছি।
হাবিবার বুক টা ছ্যাত করে উঠলো। এই ছেলে ভীষণ খারাপ। নীতির জন্য ভয় হচ্ছে। খারাপের সর্ব শেষেও যেতে পারে এই ছেলে। হাবিবা নীতি কে সাবধান করে দিলো। বলল আজ থেকে একা হোস্টেলের বাহিরে না যেতে। ভরসা নেই নীলয় কে নিয়ে।
নীতি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।
#চলবে?
#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৩২
#Raiha_Zubair_Ripti
ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপিনে নীরবতা। মুখোমুখি হয়ে বসে আছে নওফিল শাফায়াত আর সাদমান। রজনী ঘুমিয়েছে বিধায় জানে নি নওফিল এ বাসায় এসেছে। নওফিল এর মুখ অপরাধীর ন্যায় চুপসে আছে। শাফায়াত তা আড় চোখে দেখছে। নাইমুর সানজিদা নিজের রুমে চলে গেছে। শাফায়াত কৌশল খাটিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে রুমে। শাফায়াত লম্বা শ্বাস টানলো। নওফিল নওরিনকে নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে শাফায়াত বলে উঠে –
-“ উঠছেন যে?
নওফিল তাকালো।
-“ আসলে আর্জেন্ট একটা কাজ মনে পড়েছে। আমাকে যেতে হবে।
শাফায়াত হাসলো।
-“ পালাতে চাইছেন?
-“ যা ভাববেন।
-“ বসুন,আপনি অতিথি আমাদের। চলে যাবেন কেনো।
-“ নাহ্ আর থাকা সম্ভব নয়। আমি চাই না আমাকে দেখে পূনরায় কারো হৃদয় মস্তিষ্ক বিষণ্ণতায় মূর্ছা যাক।
-“ তারা আপনাকে দেখেই ফেলেছে মিস্টার নওফিল। বিশেষ করে রজনী।
সাদমান বলে উঠলো কথাটা।
নওফিল গম্ভীর কন্ঠে বলল-
-“ সেটার জন্য ই আফসোস হচ্ছে। যদি দেখা না হতো তাহলেই ভালো হতো। আমি কখনই চাই নি রজনীর সাথে দ্বিতীয় বার আর দেখা হোক।
-“ দেখা হওয়াতে ভালোই হয়েছে। সামনে রজনীর বিয়ে। আপনাকে ইনভাইট করতে আর কষ্ট পোহাতে হবে না। তা আসবেন তো আমার আর রজনীর বিয়ে তে?
নওফিলের বুঝতে বাকি নেই সাদমান লোকটার সাথে রজনীর বিয়ে।
-“ কাটা গায়ে নুনেরছিটে দিচ্ছেন সাদমান?
সাদমান নড়েচড়ে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ আপনার শরীরে ক্ষত ছিলো নাকি নওফিল? আমার তো জানা ছিলো না। আমার জানামতে যারা অন্যকে ক্ষত-বিক্ষত করে তাদের শরীরে তো ক্ষতের রেশ অব্দি থাকে না।
নওফিল চুপ হয়ে গেলো। শাফায়াত বলল-
-“ তা মেয়েটা আপনার?
-“ হ্যাঁ।
-“ আপনার ওয়াইফ কে যে দেখছি না। উনি আসে নি বিয়ে তে?
নওফিল কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। জিহ্বা দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে বলল-
-“ ও একটু ব্যস্ত কাজে,তাই আসতে পারে নি। আজ আসি। নাইমুর কে বলে দিবেন ইমার্জেন্সি হওয়ায় আমি চলে গেছি।
-“ সত্যি সত্যি চলে যাবেন?
-“ হ্যাঁ, ভালো থাকবেন।
নওফিল চলে গেলো মেয়েকে নিয়ে। শাফায়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
রুয়াতের বলা সেই কথাগুলো নিশ্চিত নওফিল শুনেছিল। তাই হয়তো চলে গেলো। বউ তার ভীষণ রেগে আছে শাফায়াত রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে। এখন বউয়ের রাগ ভাঙাতে হবে।
সাদমান পকেট থেকে ফোন টা বের করে তার বাবা মা কে ফোন করলো। সে আর দেরি করবে না রজনী কে বিয়ে করা নিয়ে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই সাদমান গম্ভীর কন্ঠে বলল-
-“ কবে আসবে তোমরা? আমি যে বললাম তাড়াতাড়ি চলে আসতে। আমাকে কি বিয়ে করাবা না তোমরা, তোড়জোড় দেখছি না কেনো তোমাদের?
সাইদুল ইসলাম বললেন-
-“ কালকের ফ্লাইটে আসছি আমি আর তোর মা।
-“ হু তাড়াতাড়ি এসো আর হ্যাঁ সাবধানে। মা কোথায়?
-“ ঘুমাচ্ছে।
-“ আচ্ছা রাখি, তুমিও ঘুমাও গিয়ে।
সাদমান ফোন কেটে দিলো। নিজের রুমের দিকে যাবার সময় রজনীর রুমে উঁকি দিয়ে ঘুমন্ত রজনী কে দেখে চলে গেলো।
নওফিল বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করে। হৃদয় টা একটু না অনেকটাই পুড়ছে। কেনো পুড়ছে রজনী দেখার পর থেকে? রজনী নামক মেয়েকে তো আর ভালোবাসার মতো দুঃসাহস নওফিল করবে না। রজনী সুখে থাকুক। সকল সুখ তার ভাগ্যে এসে ভীড় জমাক। তবুও নওফিল এর সাথে তার আর দেখা না হোক। দেখা হলেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মরন হয়। আর লাইফে করা সবচেয়ে বড় ভুল টা বিষাক্ত তীরের মতো এসে বিঁধে বুকে। নওফিল হ্যাপি তার জীবন টা নিয়ে। বেঁচে থাকার মতো যে তার একটা পরী আছে। নওফিল তাকালো নওরিনের দিকে। মেয়েটা তাকিয়ে আছে বাহিরে।
এই টুকু একটা বাচ্চা কে ছেড়ে কি করে একটা মা চলে যেতে পারে অন্য এক পুরুষের হাত ধরে? নওফিল এর দ্বিতীয় স্ত্রী ফারজানা বছর দুই হলো চলে গিয়েছে অন্য এক পুরুষের সাথে। নওফিল সেদিনই বুঝেছে তার সাথে এটা রিভেঞ্জ অব নেচার ঘটেছে। কারন নওফিল একজন কে কাঁদিয়ে, পুরোপুরি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন ভাবে শুরু করেছিল সব এক ছলনাময়ীর সাথে। ছয় মাসের বাচ্চা টাকে নওফিল একা হাতে মানুষ করছে। বাসায় অবশ্য একটা সার্ভেন্ট আছে যে নওফিল অফিসে থাকাকালীন দেখাশোনা করে। নওফিল মেনে নিয়েছে ভাগ্য। সে বাকি টা এই মেয়েকে নিয়েই পাড় করবে। জীবনে শুধু একটাই চাওয়া ছিলো,যেনো রজনীর সাথে দেখা না হয়। কিন্তু সেটাও হয়ে গেলো। রজনী রুয়াত সবাই জানুক নওফিল ঠকিয়েও সুখে আছে। কেউ না জানুক নওফিল ও ঠকে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ শহর ছেড়ে চলে যাবে। যে শহরে প্রাক্তন থাকে সে শহরের আশেপাশে থাকাটা নিষিদ্ধ প্রত্যেক প্রাক্তনের।
রুয়াত খাটের উপর পা তুলে বসে আছে। চোখ মুখ জুড়ে রাগের আভাস। ক্ষনে ক্ষনে সাপের মতো ফুঁসে উঠছে। শাফায়াত দরজার কাছ থেকে দেখতে দেখতে এগিয়ে আসলো। রুয়াত সেদিক পানে তাকিয়ে বলল-
-“ খবরদার আমার কাছে আসবেন না একদম।
শাফায়াত পা ঘুরিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো৷ রুয়াত ভ্রু কুঁচকালো। আশ্চর্য আসতে না বলছে দেখে তাই আসবে না? রুয়াত আরো ফুঁসে উঠলো।
-“ ঐ বেয়াদব চলে গেছে?
-“ হ্যাঁ।
-“ ভালো করেছে। তা আপনি সোফায় বসছেন কেনো?
-“ তুমি বিছানার ধারে কাছে যেতে না করছো সেজন্য।
-“ আপনি আমার সব কথা শুনেন?
-“ অবশ্যই। আমি তোমার বাধ্য স্বামী।
-“ কচু। পাশে বসে রাগ ভাঙান।
শাফায়াত ভ্রু কুঁচকালো।
-“ তোমার চোখ মুখে তো রাগ নেই। ভাঙাবো কি?
রুয়াত মুখটায় রাগী ভাব এনে বলে-
-“ এই দেখুন আমার চোখ মুখে কত্তো রাগ। নাকের ডগায় এসে আছে। আসুন ভাঙান।
শাফায়াত উঠে চলে আসলো বিছানায়। রুয়াতের পাশে এসে বসে নাকের ডগায় ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিয়ে বলল-
-“ উমম আই থিংক আর রাগ নেই নাকের ডগায়।
-“ চোখ মুখে আছে।
শাফায়াত রুয়াতের ওষ্ঠে হাল্কা ওষ্ঠদ্বয় মিলিয়ে বলে-
-“ আরো আছে?
রুয়াত অন্য দিকে মুখ করে বলল-
-“ না আর নেই। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে এখন।
শাফায়াত রুয়াত কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল-
-“ হোয়াই?
-“ আপনাকে বিয়ে করার পর আমার একটু কাঁদা উচিত। কষ্টরা আসে না কেনো কাছে?
-“ সবাই সুখ খুঁজে আর তুমি কান্না কষ্ট খুঁজতেছ?
-“ হ্যাঁ। শুধু সুখ দুঃখ ছাড়া পানশে।
-“ তোমাকে ছাঁদ থেকে ফেলে দিয়ে দুঃখ কষ্টের স্বাদ পাইয়ে দেই।
-“ তা মন্দ হয় না। হাত পা ভেঙে ঘরে পড়ে থাকবো। আর আপনি ভার্সিটির ক্লাস বাূ দিয়ে আমার সেবা যত্ন করবেন আহ্!
-“ ভালো হবে না তাই না?
-“ উঁহু। আমি যা তাই ই থাকবো চিরকাল।
শাফায়াত কপালে চুমু খেয়ে বলল-
-“ হু সেটাই থেকো। কখনও বদলে যেয়ো না।
রাত ১২ টার দিকে রজনীর ঘুম ভেঙে যায়। প্রচুর ক্ষিদে পেয়েছে। নিজের বাসা না যে ক্ষিদে পেলো আর গিয়ে খেয়ে নিলো। কাউকে ডেকে নেওয়া উচিত। কিন্তু কাকে ডাকবে? রুয়াত? ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে। শারমিন বেগম ও ঘুমে। সাদমান কে ডাকবে? হ্যাঁ ডাকাই যায়।
রজনী সাদমান কে টেক্সট করলো তার ক্ষিদে পেয়েছে। মিনিট দশ পাড় না হতেই সাদমান ভাতের প্লেট নিয়ে হাজির। রজনী জানতো হয় সাদমান জেগে আছে। কিন্তু খাবার নিয়ে যে একেবারে রুমে চলে আসবে সেটা ভাবতে পারে নি।
সাদমান খাবার প্লেট টা বিছানায় রেখে রজনী কে বলল-
-“ ফ্রেশ হয়ে আসুন।
রজনী ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার টা খেতে আরম্ভ করলো। সাদমান বসে বসে রজনীর খাওয়া দেখলো।
-“ আপনি খেয়েছেন?
সাদমান হ্যাঁ জানালো। রজনী ঝটপট করে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হলে সাদমান প্লেট টা নিয়ে বলল-
-“ ঘুম কি আসবে আর?
রজনী বিছানায় শুতে শুতে বলল-
-“চেষ্টা করে দেখি।
-“ হু করুন,গুড নাইট।
-“ আপনাকেও।
সাদমান চলে গেলো।
পরের দিন সকালে রজনী কে রজনীর বাসায় দিয়ে আসে সাদমান। শাফায়াত রুয়াত ভার্সিটিতে এসেছে। রোহান নেহাল ও এসেছে। রোহান নেহাল মাঠেই দাঁড়িয়ে ছিলো। রুয়াত আসা মাত্রই রোহান খেয়াল করেছিল। রুয়াত পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে রোহান জিজ্ঞেস করে বসে-
-“ কেমন আছো রুয়াত?
রুয়াত পেছন ফিরে।
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
-“ এই তো চলছে বেশ।
-“ আলহামদুলিল্লাহ বলতে শিখুন।
-“ হ্যাঁ সরি।
-“ ফর হোয়াই?
-“ কুয়াকাটায় করা বিহেভিয়ার এর জন্য। ফল্ট টা আমারই ছিলো।
-“ হুমম। ভুল টা বুঝতে পেরেছেন তাহলেই হবে। সরি বলতে হবে না। আসি ভালো থাকবেন।
রুয়াত চলে গেলো। নেহাল রোহান কে ধাক্কা দিয়ে বলল-
-“ তলে তলে এহন ও ভালোবাসছ নাকি?
-“ ভালোবাসা? সেটা চিরকাল থেকে যাবে মনে গোপনে অতি সঙ্গোপিত ভাবে।
-“ তাইলে আর বিয়াশাদী কইরা আরেক মাইয়ার জীবন নষ্ট করিছ না।
-“ তর শালি রে এনে দিবে।
-“ সো স্যাড আর বউয়ের কোনো বোন নেই।
রোহান হাই তুলতে তুলতে বলল-
-“ তর তো আছে। তাতেই চলবে।
নেহাল ভেঙচি কেটে বলল-
-“ আমার বোন কে পাওয়ার জন্য রাজপথে নামলেও তোর মতো ছ্যাকা খোর এর সাথে আমার বোন কে দিব না।
-“ একটা ইশারা দিলেই নীতি চলে আসবে। সো বড় বড় ভাষণ বন্ধ কর।
-“ একটু না হয় দিলামই ভাষণ। সভায় তো একা একা তুইই ভাষণ দিস। আমারে তো দিতে দেছ না।
-“ বয়স হয়নি বাচ্চা ছেলে তোমার ভাষণ দেবার। আগে বয়স হোক তারপর ভেবে দেখবো।
#চলবে?