গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0
111

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৪৫ [ অন্তিম পর্ব ]
#Raiha_Zubair_Ripti

রজনীরা এসেছে প্রায় কয়েক মাস হলো আমেরিকায়। সাদমান এসেই রজনী কে নিয়ে বড় বড় হসপিটালের ডক্টর কাছে ছুটাছুটি করছে। এরমধ্যে একদিন সাদমানের মা খবর পায় রজনীর বিয়ে হয়েছিল আগে। সেটা নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড ঘটে যায়। রজনী ভেবেছিল সাদমান সব বলেছে তার ফ্যামিলি কে বিয়ের আগে রজনীর অতীত সম্পর্কে । কিন্তু না। সেদিন রজনী বুঝতে পারলো সাদমান বলে নি তার মা বাবাকে রজনীর বিয়ের ব্যপারে। সাদমানের মা কয়েক দিন কথাই বলে নি রজনীর সাথে। বাচ্চা হবে না এটা মেনে নিতে পেরেছে কিন্তু আগেও বিয়ে হয়েছিল সেটা সে মানতে পারছে না। সাদমান সূক্ষ হাতে বউ, মা কে বুঝিয়ে মিলিয়ে দেয়। বিয়ের আগে সাদমান এটা বললে তার মা রাজিই হতো না। আর সাদমান এই সামান্য বিষয়ের জন্য রজনী কে হারাতে পারবে না।

সাদমান আজও এসেছে রজনী কে নিয়ে হসপিটালে। রজনী বসে আছে বাহিরে। কতদিন হয়ে গেলো দৌড়াদৌড়ি করতেছে তারা। এদিকে রজনীর ও ডেলিভারির ডেট এগিয়ে আসতেছে। এই সময় বোনটার কাছে থাকতে পারলে রজনীর ভালো লাগতো। রজনী রুয়াত কে একটা ফোন কল দিলো। রুয়াত চেয়ারে বসে আঙুর খাচ্ছিলো। বোনের কল পেয়ে আঙুরের বাটি টা নিচে রেখে ফোন টা রিসিভ করে বলল-
-“ হ্যালো আপা..কেমন আছো?
রজনী মুচকি হাসলো। বলল-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোরা?
-“ ভালো আছি। বাসায় না তুমি মনে হচ্ছে।
-“ হু। হসপিটালে আসছি।
-“ ডক্টর কিছু বলছে?
-“ রিপোর্ট আনতে গেছে সাদমান।
-“ ইনশাআল্লাহ ভালো কিছুই হবে।
-“ হু। বাসায় একা নাকি তুই?
-“ না, শাফু, মা আছে। শাফু আমার জন্য ডিমের অমলেট বানাতে গেছে।
রজনী সামনে তাকিয়ে সাদমান কে রিপোর্ট হাতে নিয়ে আসতে দেখে বলল-
-“ আচ্ছা নিজের খেয়াল রাখিস। রাখছি সাদমান আসতেছে।
-“ আচ্ছা, কি হয় না হয় আমাকে জানিয়ো। আল্লাহ হাফেজ।

রুয়াত ফোন কাটতেই শাফায়াত হাজির অমলেট নিয়ে। রুয়াতের পাশের চেয়ার টা টেনে বসে অমলেট টা এগিয়ে দিলো। রুয়াত খেতে আরম্ভ করলো। আজকাল বেশ খাচ্ছে রুয়াত। যখন যা খেতে চাচ্ছে শাফায়াত এনে সব হাজির করে দিচ্ছে। শাফায়াত ফোনে তারিখ দেখে বলল-
-“ নেক্সট মান্থে কিন্তু তোমার ডেলিভারি ডেট রুয়াত। আমাদের পুচকুর আসার মাস। খুব সাবধানে থাকবা।
-“ হু জানি। এই ধরুন প্লেট। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে আপনি লাইট নিভিয়ে চলে আসুন। আমি গেলাম।
রুয়াত বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। শাফায়াত প্লেট টা টি-টেবিলে রেখে লাইট নিভিয়ে রুয়াতের পাশে এসে শুলো। রুয়াত শাফায়াত এর দিকে ফিরে শাফায়াত কে জড়িয়ে ধরলো। শাফায়াত রুয়াতের পেটে হাত রাখতেই দেখলো তার মেয়েটা নাড়াচাড়া করছে ভেতরে। তাদের মেয়ে হবে এটা জেনেছে তারা দেড় মাস হবে। খবর টা জানার পরই শাফায়াত মেয়ে বাবুর সব কিনে রেখেছে। আলমারির এক পাশে তার মেয়ের জামাকাপড়.. ঘর ভর্তি খেলনা, ট্যাডি,দোলনা।

শাফায়াত উঠে বসলো। পেটে কান পেতে বলল-
-“ মাম্মাম নাড়াচাড়া করছো কেনো? আর তো কয়টা দিন তারপর বাবার কাছে চলে আসবা।
রুয়াত শব্দ করে হেঁসে বলল-
-“ আপনার কথা বুঝি ও শুনে উল্টিয়ে ফেললো?
-“ শাট-আপ আমার মেয়ের সাথে আমি কথা বলছি..তুমি মাঝখানে কথা বলতেছো কেনো?
-“ কারন মেয়েটা আমারও। এখন মেয়েকে সময় না দিয়ে আমাকে দিন। জড়িয়ে ধরুন ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো। মনে রাখবেন আমি স্বস্তি তে থাকলে আমার মেয়েও স্বস্তি তে থাকবে।
শাফায়াত মৃদু হেসে রুয়াত কে জড়িয়ে ধরলো।

রজনী বাসায় ফিরেই সাদমান কে জিজ্ঞেস করতেছে রিপোর্টে কি বলেছে ডক্টর। সাদমান প্রতিবারই চুপ হয়ে আছে। রজনীর এবার সন্দেহ হচ্ছে। তাই সাদমানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত চেপে বলল-
-“ আপনি কি আমাকে বলবেন নাকি আমি নিজেই আবার ডক্টরের কাছে যাব কোনটা?
সাদমান রজনীর হাত মুঠোয় নিয়ে হাতে চুমু খেয়ে বলল-
-“ আমরা এর চেয়েও বড় ডক্টরের কাছে যাব রজনী।
-“ মানে? রিপোর্ট এবারও বলছে আমার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব না তাই তো?
-“ না তেমন টা না আসলে..
-“ মিথ্যা কথা আর কত বলবেন সাদমান? আমি মা হতে পারবো না এটাই সত্যি। আমি আপনাকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম। এখন পস্তাচ্ছেন নিশ্চয়ই তাই না?
-“ মোটেও পস্তাচ্ছি না রজনী। আমার বাচ্চার দরকার নেই। আপনি থাকলেই চলবে আমার।
-“ আর আপনার মা? সে কি মেনে নিবে?
-“ আমি মানতে পারলে মা ও মানতে পারবে। আপনি শান্ত হন। আমরা আর ডক্টরের কাছে যাব না। বাকি জীবন আমি এভাবেই কাটাতে পারবো। আই ডোন্ট নিড বেবি।
রজনী দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সাদমান মাথা চেপে বসে পড়লো বেডে।

রোহান এখন সাংসারিক হয়ে গেছে। রাজনীতির পাশাপাশি নিজের একটা বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। নীতি পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের হাতে নিজের সংসার টাকে সামলাচ্ছে। রোহান বেশি রাত করে বাসায় ফিরে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে। কখনও কখনও নীতি কে নিয়ে গভীর রাতে হাঁটতে বের হয়। আবার ছুটির দিনে নীতি কে নিয়ে লেকের পাড়ে যায়। এরমধ্যে একদিন রুয়াত আর শাফায়াত কে দেখেছিল রোহান। রুয়াতের উঁচু পেট দেখে বুঝে যায় এই দম্পতি খুব শীগ্রই বাবা মা হতে চলছে। রোহান মন ভরে দোয়া করে রুয়াত কে। এও বলে পৃথিবীর সকল সুখ এই দম্পতির হোক। সুখে থাকুক আগাম দিনে এরা।

রুয়াত ও হয়তো দেখেছিল রোহান কে। খানিক তো চোখাচোখি হয়েছিল দু’জনের। রোহান আর বেশিক্ষণ না থেকে নীতি কে নিয়ে চলে এসেছিল।

আজ রোহান দুপুর হতেই বাসায় এসেছে। শ্বশুর বাড়ি ইনভাইট করেছে। নীতি পার্পল কালারের একটা শাড়ি পড়ে নেয়। রোহান হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পড়ে। নীতি হাল্কা সাজগোছ করে নীতি কে নিয়ে চলে আসে। নেহাল বিয়ে করেছে দু সপ্তাহ হলো। সুইটি খাবার টেবিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। নীতি পাশের চেয়ার টেনে সুইটি কে বসতে বলে বলল-
-“ তুমিও বসে পড়ে। যার যা লাগবে নিয়ে নিবে হাত দিয়ে।
নেহাল ও সুইটি কে বসে পড়তে বলল। সুইটি বসে পড়লো। সাইফুল ইসলাম খাবার খেতে খেতে বললেন-
-“ বিয়ের পর দেখছি বেশ ভালোই পরিবর্তন হয়েছে তোর রোহান।
রোহান খেতে খেতে জবাব দিলো-
-“ সব আপনার মেয়ের সংস্পর্শে। ক্রেডিট টা তাকেই দিন।
-“ দেখতে হবে না মেয়েটা কার?
-“ বুঝতে হবে বউ টা কার।
-“ সকাল বিকেল আমার কাছে গ্রেটফুল থাক।
রোহান ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ হোয়াই?
-“ আমার মেয়েকে জীবনে পেয়েছিস সেজন্য।
-“ আপনার ও আপনার শ্বশুরের কাছে গ্রেটফুল থাকা উচিত আন্টিকে জীবনে পেয়েছেন বলে। নীতি কে জন্ম দিতে পেরেছেন।
সাইফুল ইসলাম কথা বললো না আর। একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেয় না এই ছেলে। সব কথার পিঠে কথা তাকে বলতেই হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে নেহাল,সুইটি,রোহান,নীতি বাড়ির ছাঁদে এসে বসে পড়ে। ঠান্ডা বাতাস বইছে চারিপাশ। নেহাল পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলল-
-“ আমাদের উচিত একটা ট্যুর দেওয়া। এখন আমরা কাপল সবাই কক্সবাজার যাওয়া উচিৎ। বিচে বউ নিয়ে হাঁটবো । সমুদ্রে গোসল করবো। আহ্ সেই দারুন একটা ফিল।
রোহান অন্য দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আমার সময় নেই। বিজনেস সামলাতে হবে। এসব ট্যুর দিতে গিয়ে বিজনেস টাকে ডুবাতে চাই না। তোর যাওয়ার হলে তুই যা। বেকার মানুষ তুই আমি তো আর বেকার নই।
নেহাল রেগে ফুঁসে উঠলো বলল-
-“ আমি বেকার বলে তুই আমাকে অপমান করছিস রোহান!
-” আমাকেও কম অপমান করিস নি বিয়ের আগে। তার শোধ তুলবো না আমি? নীতি চলে আয় তো ঘরে। ঘুম পেয়েছে। বেকার দের সাথে থাকলে বেকারত্ব ছোয়াছে রোগ আমার শরীরেও লেগে যাবে।
রোহান নীতি কে নিয়ে চলে গেলো। নেহাল পাটির উপর সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। সুইটিও শুয়ে পড়লো। বলল-
-“ রাত টা কি এই ছাঁদে ই কাটাতে চাও নেহাল?
-“ রুমে গিয়ে কি করবো? রুমে গেলেই মুড চলে আসে করার।
-“ অসভ্য বেয়াদব। রুমে যাচ্ছি তারাতাড়ি আসো।

———————-

দেখতে দেখতে রুয়াতের ডেলিভারি পেইন উঠলো। শাফায়াত বাসায়ই ছিলো যার দরুন সাথে সাথেই শাফায়াত রুয়াত কে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। ডক্টর জানালো নরমাল ডেলিভারিতেই বাচ্চা প্রসব করা সম্ভব সেজন্য রুয়াত কে নিয়ে গেলো। শাফায়াত বাহিরে পায়চারি করতে লাগলো। ভেতর থেকে রুয়াতের কান্নার শব্দ আসতেছে। শাফায়াত বারবার আল্লাহ কে শরণ করতেছে। আল্লহর রহমতে আধ ঘন্টা যেতেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজে চারিপাশ মুখরিত হলো। শাফায়াত শুকরিয়া আদায় করলো। এক নার্স বাচ্চাকে পরিষ্কার করে সাদা কাপড়ে মুড়ে শাফায়াতের হাতে দিলো। শাফায়াত নার্স কে জিজ্ঞেস করলো রুয়াতের কথা। নার্স জানালো রুয়াত ভালো আছে। গিয়ে দেখা করতে পারবে।

শাফায়াত মেয়েকে কোলে নিয়ে রুয়াতের কাছে গেলো। রুয়াত তখন চোখ বুঝে ছিলো। শাফায়াত পাশে বসতেই রুয়াত চোখ মেলে তাকালো। শাফায়াত বলল-
-“ খুব কষ্ট হচ্ছে এখনও রুয়াত?
রুয়াত মাথা নেড়ে না জানালো। বলল-
-“ ওর নাম রাখছেন?
শাফায়াত না জানালো।
-“ রাখেন নি কেনো।
-“ তুমি ঠিক করেছো নাম?
-“ হু শুনবেন?
-“ হু বলো।
-“ রুবাইয়াত।
-“ বাহ্ সুন্দর নাম তো।
-“ হু কোলে দিন তো আমার মানিক কে।
শাফায়াত রোয়াতের বুকের উপর দিলো মেয়েকে। রুয়াত মেয়েকে আদর করলো।
কোনো অপূর্ণতা রইলো না আর তাদের। মেয়ে নিয়ে তাদের নতুন পথ চলা শুরু।

বছর তিনেক পর,,,

সব গোধূলি সবার জীবনকে পূর্ণতায় রাঙিয়ে দেয় না। কিছু জীবন অপূর্নতায় থেকে যায়। রজনী জীবন অপূর্ণতায় থেকে গেলেও এক ফালি আলো সাদমান ঠিকই নিয়ে এসেছিল রজনীর জীবনে। তারা বাচ্চা এডপ্ট করেছে। মা ডাক কে না শুনতে চায়? বাচ্চার বয়স পাঁচ মাস। রজনী সাদমানের প্রাণ সেই বাচ্চা। সাদমানের মা ও মেনে নিয়েছে বাচ্চা কে। বাচ্চাটার আসল মা ডেলিভারির সময়ই মা’রা গেছে। বাচ্চাটার বাবার ও আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। মেয়েকে মানুষ করতে পারতো না সেজন্য বাচ্চাটাকে হসপিটালেই ফেলে চলে যায়। হসপিটালের ডক্টর সাদমানের পরিচিত ছিলো। সে ফোন দিয়ে বলে বাচ্চাটার কথা। তারপর সাদমান আর রজনী গিয়ে নিয়ে আসে দুই দিনের সেই শিশু মেয়ে কে।
থাক না কিছু অপূর্ণতার মাঝেও পূর্ণতা। ক্ষতি কি তাতে?

নীতি ও অন্তঃসত্ত্বা। চার মাস হলো। রোহান নীতিকে একটা কাজ ও করতে দেয় না। রোহানের জীবনে এখন প্রাপ্তির সংখা বাড়ছে। নীতির কাছে সবসময় রোহান গ্রেটফুল থাকে। তার জীবনে আসার জন্য। এই তো আজ নীতি রোহানকে বলে দিয়েছে আসার পথে ফুচকা নিয়ে আসতে। রোহান তাই নিয়ে আসলো। বাসায় এনে প্লেটে বেড়ে বউয়ের সামনে দিলো। নীতি খাচ্ছে আর রোহান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে তার বউটাকে। জীবনের আসল আনন্দ তো নীতি কে পাওয়ার পর থেকে প্রতি মূহুর্ত রোহান ফিল করছে। এভাবেই কেটে যাক সব বসন্ত তাদের। থমকে থাকুক নীতির দিকে রোহানের এই চোখ। ভালো থাকুক সবাই যার যার নিজস্ব জীবনে।

#সমাপ্ত